নির্মল প্রেমানুভব পর্ব -০২ ও শেষ

#নির্মল_প্রেমানুভব
#অন্তিম_পর্ব
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা

একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো বাসা ভর্তি মানুষজন।জুলেখা খালার পুরো পরিবার সহ বেশ কয়েকজন মুরুব্বি এসেছেন।জুলেখা খালা সাফার মায়ের দার সম্পর্কের চাচাতো বোন।কিন্তু সমবয়সী হওয়ায় বান্ধবীর মতো সম্পর্ক ওনাদের।যা এতোদিনেও অটুট রয়েছে।এই মিল বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতেই সাফা ও রাদিনের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।আর তা যে আজকেই হবে তা জানা ছিলো না সাফার।ড্রয়িং রুমে রফিক খালু ও সাফার বাবা বসে আছে।সাফার নানু সহ সব মুরুব্বি উপস্থিত।কিন্তু রাদিনের দেখা নেই।উৎসুক চোখদুটো যেন রাদিনকেই খুঁজে চলেছে।হটাৎ মাহমুদার কন্ঠ কানে এল,

“তুই উঠে গিয়েছিস সাফা?যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে।আয়েজন ঘরোয়া হলেও সাজতে ঠিকই হবে।”

গোল গোল করে চেয়ে থাকে সাফা।এ সব কি হচ্ছে তার সাথে।মুখে কোন রা করে না।সাফাকে জাগ্রত হতে দেখে স্মিত হাসলো জুলেখা।আদুরে কন্ঠে বলল,

“কেমন আছো মা?”

এই মুহুর্তে সবচেয়ে বিরক্ত লাগছে জুলেখাকে।তার জন্যই এই বিয়ের আয়োজন।ইচ্ছা করছে কোন উত্তর না দিয়ে খট করে দরজা লাগিয়ে দিতে।তবুও সৌজন্যস্বরুপ হাসি বিনিময় করে সে।কন্ঠ গলিয়ো বলে,

“আলহামদুলিল্লাহ আন্টি।আপনি কেমন আছেন?আর এলেন কখন?ডাকবেন না!”

“আমরা আসার সাথে সাথেই ওরা ডাকতে চেয়েছিল তোমাকে।কিন্তু রাতে নাকি ঘুম হয়নি তোমার।মাইগ্রেনের পেইন বেড়েছিল।এজন্য ডাকিনি।”

“আর একটু ঘুমিয়ে নিলে পারতি সাফা।কে জানে আজ রাতেও ঘুম হবে কি না!”

সদর দরজা পেরিয়ে এদিকে উপস্থিত হল তিশা। বদমাইশি কন্ঠে বলল উপরোক্ত কথা।সাফার চাচাতো বোন সে।বিয়ের জন্য এ বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে।অন্য সময় হলে এহেন দুষ্টুমির দু চারটা ঘা বসিয়ে দিত তিশা পিঠে।কিন্তু আকষ্মিক ঘটনায় নির্বাক সে।কিন্তু লজ্জিত হল জুলেখা।লালাভ হল তার বৃদ্ধা গন্ড।নেত্রপল্লব নামিয়ে বলল,

“এখনকার পোলাপান এতো দুষ্ট। মুরুব্বিও মানো না বাপু।”

জিভ কাটলো তিশা।উত্তেজনাবশত জুলেখাকে যেন নজরেই পরেনি তার।মাথা নুইয়ে সালাম করল সে।সালামের জবাব দিয়ে সাফাকে রেডি করতে বলে প্রসৃথান করল জুলেখা।

সাফা তখনও মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে।মস্তিষ্ক শূন্য তার।সাফার এহেন দশা দেখে তার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল তিশা।সন্দিহান কন্ঠে বলল,

“কি হয়েছে সাফা?এমন পাথরের মতো হয়ে গেছিস কেন?কোন উৎফুল্লতা নেই।অথচ আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি খুশি তোর হওয়ার কথা ছিলো!নাকি আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়েছিস!”

সাফা তখনও নিরব।তপ্ত শ্বাস ফেলল সে।কন্ঠ নালী দিয়ে বের করল উৎকন্ঠা,

“আমার জীবন শেষ হতে চলল বইন।এ বিয়েটা আটকানোর কোন উপায় নেই?”

তিশা গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলচোখে তার নিগুঢ় বিষ্ময়।অধর গলিয়ে বের করল নিজের মনোভাব,

“কিন্তু তুই তো রাদিন ভাইকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করিস।তাকে বিয়ে করলে সমস্যা কি?”

“করি না করতাম বল।বয়স অল্প ছিলো তখন।ওনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম।কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সাথে বুঝেছি ওটা অল্প বয়সের মোহ ছাড়া কিছু নয়।ওনার ব্যক্তিত্বের সাথে তাল মেলানো সম্ভব নয় আমার।দুইজন দুই মেরুর প্রানী।তাছাড়া উনি তো কাঠখোট্টা টাইপের আচরণ করে আমার সাথে।সব মিলিয়ে এখন অপছন্দের তালিকার শীর্ষে সে।আর যাকে অপছন্দ করি তাকে বিয়ে করে কি সুখী হব বল?”

“আর ইউ শিওর?তুই ওনাকে আর পছন্দ করিস না?”

“আমাকে বাঁচা বইন।এই বিয়েটা আটকা প্লিজ।”

করুন স্বরে অনুরোধ করল সাফা।চিন্তায় পড়ে গেল তিশা।কিছু সময় ভেবে বলল,

“এ বিয়ে আটকানোর একটা উপায়ই আছে।”

“কি?”

“রাদিন ভাইকে বিষয়টা জানানো।”

ছিটকে গেল সাফা।

“তোর কি মাথা খারাপ?ওনাকে অপছন্দের ব্যপারটা ওনাকে জানাবো!যে হিটলার মানুষ উনি।”

নিজের বোকা বুদ্ধির জন্য নিজেই লজ্জিত হল তিশা।হাঁফ ছেড়ে বলল,

“তাহলে বিয়ে করা ছাড়া আর উপায় নেই বইন।সব রেডি।শাড়ী গহনা দিয়ে গিয়েছে।”

“কি ব্যপার এখনও তৈরি হওনি তুমি?”

শরিফুল ইসলামের থমথমে গলায় মিইয়ে গেল ওরা।মাথা নিচু করে ফেলল দু’জনে।বাবাকে ভীষণ ভয় পায় সাফা।আবারও থমথমে গলায় পরিবেশ ভারী করে তুলল শরিফুল।

“আধা ঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিবে।কাজী সাহেব বেশি সময় দেরি করবে না।”

ভয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল দু’জন।অতপর পরিবেশের দায়ে পড়ে তৈরি হয়ে নিল সাফা।সব কিছু তার হাতের নাগালের বাহিরে।

_______
বাসর ঘরে বসে চিন্তার পাহাড় জমিয়ে চলেছে সাফা।মাকড়সার জালের মতো একে একে বৃদ্ধি পাচ্ছে চিন্তা।রাদিনের এতোদিনের ব্যবহারে স্পষ্ট সাফাকেও তার চেয়ে কোন অংশে কম অপছন্দ করে না রাদিন।এক কালে সাফার মনে ভালোলাগা জন্মালেও রাদিনের মাঝে তার রেশও ছিলো না।সাফার ষোড়শী জীবনের প্রথম ভালোলাগা ছিলো রাদিন।সাফা তখন দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল।পদার্থ ও রসায়ন একেবারেই তার মাথায় ঢুকত না।অন্যদিকে রাদিন ছিলো এস এস সি পরীক্ষায় বোর্ড স্ট্যান্ড করা স্টুডেন্ট।বি সি এস এ সিলেক্টেড হওয়ার পর বাড়িতে অবসর কাটাচ্ছিলো তখন।সাফার দূর্বল বিষয়গুলো একটু দেখিয়ে দিতে অনুরোধ করে শরিফুল ইসলাম।এলাকায়ই বাড়ি হওয়ায় ও খালুর অনুরোধ ফেলতে না পারায় রাজি হয়ে যায় রাদিন।কথা কম বললেও পড়ানোর কৌশলটা তার দারুন।যে বিষয়টা সাফার অল্প বয়সী মনে ভালোলাগার জোয়ার বইয়ে দেয়।একটা মানুষ এতো ব্রিলিয়ান্ট হয় কি করে এই ভাবনাই তখন ঘিরে রাখতো সাফাকে।রাদিনের স্ব্যক্তিত্র,কথা বলার ধরন,সৌন্দর্য সব কিছু আকৃষ্ট করত সাফাকে।ঠিক তখনই প্রথম প্রেমানুভব জেগেছিল তার হৃদয়ে।একদিন বইয়ের ভাজে রাদিনকে নিয়ে নিজের অনুভুতি নিয়ে চিঠি লিখে রেখেছিলো সাফা।পড়ানোর সময় হুট করে চিঠিটা চোখে পড়ে যায় রাদিনের।রাদিন গম্ভীর কেও জেনেও ভাবাবেগশূন্য ছিলো সাফা।তার ধারনা ছিলো চিঠির ভাষা রাদিন পড়তে পাড়বে না।কারন সাঙ্কেতিক ভাষায় চিঠিটা লিখেছিলে সে।হুমায়ুন আহমেদ এর হিমু সিরিজের কোন এক পর্বে পড়েছিলো কৌশলটা।তার ধারনা সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে আধমন ওজনের একটা ধমক দিলো রাদিন।অভিমান জমলো ক্ষুদ্র হৃদয়ে।চিঠির প্রত্যেকটা শব্দ সে পড়ে ফেলেছে।আর তখন থেকেই সাফাকে তার চোখের বিষের মতো আচরণ দিত রাদিন।সেদিনই পড়ানো বাদ দিয়ে দেয় সে।তারপর থেকে রাদিনের ঘরে গেলেও বাকা কথা শুনতে হতো সাফাকে।সময়ের বহমানতায় অভিমান কেটে রাগে রুপান্তর হয়েছে।কারো এতো খারাপ ব্যবহার পেলে রাগ জমাটাই স্বাভাবিক।এক সময় রাদিনের সান্নিধ্য পেতে কারনে অকারনে ছুটে চলা সাফা এখন জুলেখা খালার বাড়িতে পাও রাখে না।যখন নিজেকে সম্পূর্ণ রুপে গুটিয়ে নিল তখনই তার সাথে নিজের জীবন জুরে গেল?

রাদিন তো সাফাকে সহ্য করতে পারে না।তবে সে কেন সাফাকে বিয়ে করছে।শুধুমাত্র মায়ের ইচ্ছার এতো প্রাধান্য তার নিকট!সত্যি ছেলেটা এ জেনারেশনের আর পাঁচ দশ জনের মতো নয়।

হটাৎ দরজা খোলার শব্দে শুষ্ক চোখ তুলে তাকায় সাফা।রাদিনের গোছালো পদচারণা তার দিকেই ধাবিত।রাদিনের চোখ মুখ শকৃত হয়ে আছে।শুকনো ঢোক গিলল সাফা।লোকটা বা জানি তার জীবনকে এখন কোন নরকে পরিনত করতে এগিয়ে আসছে।এ বিয়ের সব দায় কি তার ঘাড়েই চাপাবে!

প্রশ্নটা জাগতেই মনে মনে উত্তর সাজিয়ে ফেলে সাফা।প্রতিবাদের পশরা সাজিয়ে রাখল যেন চট করে উত্তর দিয়ে এতোদিনের রাগ পুষিয়ে নিতে পারে।কিন্তু তার ধারণাকে আবারও ভুল প্রমান করে দিল রাদিন।সাফার দিকে এগিয়ে দিল দুটি স্মার্টফোন।ধাতস্থ গলায় আওয়াজ তুলল,

“এটা সম্পূর্ণ তোমার।আর এটার উপরেও কিন্তু পুরো অধিকার আছে।দেখো পছন্দ হয় কি না।”

রাদিনের কোমল আচরণে নিমিষেই রাগ গলে ঠান্ডা হয়ে গেল।একটা নতুন ফোন ও পাশে রাদিনের ব্যবহৃত ফোন।বিষ্মিত সাফা স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল সেগুলোর দিকে।সাফার বিষ্ময় দেখে কিছুটা ইতস্তত করে রাদিন বলল,

“বাসর রাতে বউকে কিছু গিফট দিতে হয়।সেজন্য দিলাম এটা।আর আমার ফোনের দিকে সবসময় ছোক ছোক ভাব ছিলো তোমার।সেটার অধিকারও দিয়ে দিলাম।”

রাদিনের মুখে বউ ডাক শুনে অন্যরকম অনুভুতি বইয়ে গেল সাফার শিরদাঁড়া বেয়ে।আরও শিহরণ বইয়ে দিল রাদিনের ফোনের গ্যালারি জুরে নিজের পিকচার দেখে।লোকটা তাকে আগে থেকেই পছন্দ করে?তবে এমন রুষ্ট আচরণ দিত কেন?সাফার মন হয়ত পড়তে সক্ষম হয় রাদিন।স্মিত হেসে বলে,

“এই পিকচারগুলো যেন কারো নজরে না পড়ে এজন্যই তাকে ফোন দেওয়া হয়নি।আর অনুভুতিটা তো নির্মল ছিলো।সেটা জানিয়ে কারো মাথায় প্রেমের ভুতও চাপাতে চাইনি।এমনি পড়তে চায় না, তখন আরও পড়ত না কেও।”

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সাফা।আজকে একের পর এক বিষ্ময় ঘিরে ধরছে তাকে।যেখানে নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে সন্দিহান ছিলো সেখানে রাদিনের এমন ব্যবহার তার হৃদয়ের শুকনো প্রেমের ক্ষত তাজা করে।লোকটাকে বেশ অদ্ভুত লাগছে তার।সাফাকে আরও খানিকটা অবাক করতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ডায়মন্ডের নোজ পিন বের করে নিজ হাতে সাফার নাকে পড়িয়ে দিয়ে বলে,

“আসক্তের পাতায় বিষাক্ত আমি।যে বিষের পুরোটা জুরে ছিলো তোমার প্রেমানুভব।আজকের রজনীতে সে বিষে ডুবিয়ে দিবে আমায়?”

রাদিনের শীতল স্পর্শ নাক ছোয়াতেই কেঁপে ওঠে সাফা।সাথে তার কথাগুলোতেও।স্মিত হাসে রাদিন।সাফার নুখে লেপ্টে থাকা ছোট চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয় সে।সে সাথে উড়ে যায় সাফার সকল রাগ অভিমান।অষ্টাদশী হৃদয়ে আবারও জাগ্রত হয় নির্মল প্রেমানুভব।

সমাপ্ত

(গল্পটা নিয়ে গুটি কয়েক পাঠক মহলের মন্তব্য হৃদয় পুড়িয়ে দিয়েছে।যাত্রাপথের শুরুতেই তাই সমাপ্তি টানলাম।কে জানে,আমার লেখালেখির সমাপ্তিও হয়তো এখানেই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here