নিশীথচিত্র পর্ব ১৬+১৭

‘নিশীথচিত্র'(১৬)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

_____________

তাজিম নামক মানুষটাকে রিনির অকারণেই খুব ভালো লাগে। তাজিমের মিশুক ভাবটা রিনির খুব ভালো লাগে।রিনিকে হাসাতে তার এক মিনিট সময়ের প্রয়োজন পরে না।তাজিম সম্পর্কে রিমির দেবর।রিমির থেকে বয়সে কিছুটা বড় হবে তাজিম।রিমির বিয়ের পর পর রিনি এই মানুষ টাকে মোটেই সহ্য করতে পারতো না তার কাছে কেমন গায়ে পরা মনে হতো। তার ঐ বয়সের ছোট্ট মন এটা একদমই সহ্য করতো না।সরাসরি রিয়াক্ট করে বসতো রিনি।বোনের সাথে তার শশুড় বাড়ি যাবার পরই মূলত ভাব হয়েছে তাদের।তিন চার বছর আগের কথা রিনি তাজিমের সাথে মিশতে চাইতো না বলেই তাজিম ধরে বেধে ঘুরতে নিয়ে যায়। রিনির তখন সে কি কান্না।যে মানুষটাকে তার সহ্যই হয় না তার সাথে ঘোরা? রিনি তখন বয়সে আরও ছোট তিরিক্ষি মেজাজ।হিতাহিতজ্ঞান কম।কষে থাপ্পড়ও দিয়েছিলো একটা ।তবুও তাজিম এক গাল হেসে রিনির পছন্দের সব কিছু কিনে দিলো।পুরো এলাকা ঘুড়ালো।সেদিন থেকেই দুজনের দিব্যি ভাব। এরপর থেকে তাজিমকে পেলে রিনির আর কিছুই লাগতো না।রিনি মনে করতো তার বেস্ট ফ্রেন্ড তাজিম।

— তাজিম ভাইয়া তুমি???

তাজিম রিনির পাশে বসতে বসতে জবাব দিলো
–হুম রিনিরিনি।তোমাকে অনেকদিন না বরং অনেক বছর পরে দেখলাম রিনিরিনি।খুব মিস করেছি আমি তোমাকে।

— এ বাবা তোমার অত্তগুলো জিএফ এর মধ্যে আবার আমায় মিস করার সুযোগও পাও তুমি?

— তোমায় মিস করতে সুযোগ লাগে না রিনিরিনি।

–ও বাবা তাই নাকি তাহলে তো আমি খুবই স্পেশাল।

— তা তো অবশ্যই।সন্দেহ আছে?

— হান্ড্রেডে হান্ড্রেড সন্দেহ আছে তাজিম ভাই।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

— তবে তাজিম ভাই আমি কিন্তু ছোট নেই। আমাকে আর রিনিরিনি ডাকবা না বলে দিলাম।

–রিনিরিনি বলতে আমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুঝি।আর তুমি একটা পিচ্চি বাচ্চা তাই তোমাকে আমি রিনিরিনিই ডাকবো।

রিনি হার মানলো।

— যাও এক্সাম দিয়ে এসেছো ফ্রেশ হয়ে আসো।গল্প করবো অনেক কেমন?

— উহু না।

রিনির নাকচে তাজিম চকিতে রিনির দিকে তাকালো।

— কেন রিনিরিনি?

— আরে আমার এক্সাম না? পড়তে হবে তো,,,,

— আল্লাহ রিনিরিনি তুমি পড়াশোনা, এক্সাম নিয়ে এতো সিরিয়াস হলে কবে?

রিনি ব্যাগ কাধে নিয়ে উঠতে উঠতে বললো
— হতে তো হবেই।আমার দিহান ভাই নয়তো আমায় খুব বকবে।

— তোমার দিহান ভাই?

— হুম

রিনি একটা ভারী হাসি দিয়ে স্থান ত্যাগ করলো।পিছনে তাকালে দেখতে পারতো রিনির ভাবমূর্তিতে তাজিম কতটা অবাক হয়েছে।তার কাছে এ এক নতুন রিনি।

— ভাবি রিনিরিনির দিহান ভাই মানে?

— কি জানি পাগলটা কখন কি বলে ঠিক আছে নাকি?মনে হয় ও যার কথা বলছে তার কাছে ও প্রাইভেট পড়ে।

____________

দুপুরে খাবার সময় দিহান আসলো।রিমি তার ঘরেই খাচ্ছে।অসুস্থতায় বিছানা ছাড়ার ইচ্ছা হয় নি তার।তাই রেহানা রিমির ঘরেই খাবার দিয়ে এসেছে।রিনি এক রাশ হাসি মুখ নিয়ে বললো

— তাজিম ভাইয়া এই হলো দিহান ভাই।আমি তার কাছে পড়ি।

তাজিম দিহানের দিকে তাকিয়ে সালাম বিনিময় করে হাত মেলালো।অতঃপর রিনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো

— তোমার স্যার তোমার বাসায় যে?

রেহেনা হাসি মুখে বললো

— তাজিম ও ভাড়া থাকছে আমাদের বাইরের ঘরটাতে।আমাদের সাথেই খাওয়া দাওয়া করে। ছেলে মানুষ আরও একা রান্না কিভাবে কি করবে তাই আর কি।

তাজিম আর কথা বাড়ায় নি।খাওয়ার ফাঁকে সে রিনির কাছ থেকে দিহানের বিষয়ে সর্ট ডিটেইলস নিয়ে নিয়েছে। রিনি আরও আগ্রহ নিয়ে দুই এক লাইন বেশিও বলেছে।।যার মাধ্যমে তাজিম জানতে পারে দিহান তার এক ব্যাস জুনিয়র। দিহানের ভাবগতি সাভাবিক হলেও রিনির আচারণ তাজিমকে ভাবাতে বাধ্য করছে বার বার । ভাববে নাই বা কেন?তার শত জিএফ এর মাঝেও এই একটা মুখ সে ভুলতেই পারে না।হাজার বার বোন ভাবার চেষ্টা করেও সে রিনিকে বোন ভাবতেই পারে নি কখনও। আলাদা একটা টান কাজ করে তার মধ্যে রিনির প্রতি আর তার বেশির ভাগই মুগ্ধতা ।এর পেছনে গভীর মিনিং টা সে গভীরেই রাখতে চায় অবশ্য এখন পর্যন্ত রাশভারি কিছু ভাবে নি এই নিয়ে।

______________

বিকেলবেলা রিনি ব্যালকুনির রেলিং এর উপর হাত রেখে কিছুক্ষণ ব্যালকুনির শেষ প্রান্তে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে আবার শেষ প্রান্তে যাচ্ছে আবার ফরে আসছে।তার চক্ষুজোড়া দিহানের বন্ধ দরজা আর হালকা খোলা জানালার দিকে ঘোরাঘুরি করছে। দরজায় তালা ঝুলানো নেই মানে দিহান ঘরেই আছে কিন্তু কোন অযুহাতে দিহানের কাছে যাবে একটু কথা বলবে এই নিয়েই সন্ধিহান সে।তখনই দরজায় রিমি দাড়ালো

— কিরে রিনি কি দেখছিস?

— দেখছি দিহান ভাইর দরজা খোলা কিনা।

আনমনেই জবাব দিলো রিনি।

— তা দিয়ে তুই কি করবি?

রিনি চকিতে তাকায় তার পেট পাতলা বোনের কাছে সে অন্তত কিছু বলবে না আর না বুঝতে দেবে।অনেক শিক্ষা আছে তার এসব বিষয়ে।

— না মানে আপু আমার পড়া দাগানোর ছিলো।

— ওহ আচ্ছা।

— হু

— দিহানটা কে রে?আমাদের দাদা বাড়ির পাশে নাকি? মা বললো। কিন্তু আমার মনেই পরছে না।কতদিন যাই না মনে থাকারও কথা না।

— ছবি দেখাই?

— ছবিও আছে?

রিনি মাথা নিচু করে ঠান্ডা আওয়াজে জবাব দিলো “হুম”
–তার থেকে বরং ডাক দে। ঘরেই তো আছে নাকি?

— তা আছে বোধহয়

— ডাক দে

রিনি দিহান ভাই বলে জোরে ডাক দিতেই দিহান জানালা ঠেলে উঁকি দিলো। রিনি আঙুল দিয়ে রিমিকে দেখিয়ে দিলো। হয়তো কোনো প্রয়োজন তাই মনে করেই বেড়িয়ে দরজার সামনে দাড়ালো দিহান। সে রিমিকে দেখেও চিনেছে। ছোট বেলা অনেক খেলছে একসাথে তারা।

— দিহান ভাই আমার বড় আপু৷

রিমি ফিসফিসিয়ে রিনির কাছে বললো ” আল্লাহ এইটা দিহান। ও তো আমার বয়সী একসাথে কতো খেলছি জানিস?” রিনি অবাক হয়ে রিমির দিকে তাকালো।

দিহান বললো
— রিনি তোমার বড় আপুকে আমি চিনি।সে কি আমাকে চিনছে?

রিমিই জবাব দিলো

— কেন চিনবো না দিহান? তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস।কতো খেলছি তোর সাথে।

— আমি বড় হয়ে গেছি আর তুই কি হয়েছিস? কয়দিন বাদে মা হয়ে যাবি শুনলাম।

রিমি হালকা লজ্জা পেলো।অতঃপর রিনিকে ঝাকিয়ে বললো “এই তোর মনে আছে দিহান তোকে কোলে নিয়ে প্রায়ই হাটতো।আমি কোলে নিতে পারতাম না বেশিক্ষণ আর তুই নিজেও হাটতে চাইতি না তখন দিহান তোকে কোলে নিয়ে হাটতো।ওর কাছে তোকে নাকি পরীর মতো লাগতো”রিমি একশ্বাসে রিনির দিকে তাকিয়ে বললো।

রিমির কথাগুলো দিহানের কান অব্দি গেছে।রিমি বললো

— তোর মনে আছে দিহান। বাড়ি গেলেই রিনিকে কোলে নিয়ে ঘুরতি তুই?

দিহান নিজেই ভুলে গিয়েছিলো এই স্মৃতি। তবে তার আফসোস হচ্ছে রিমির কেন মনে থাকতে হলো আর কেনই বা পাগলিটাকে বলতে হলো? এই নিয়ে আবার কি করে কে জানে।আর এদিকে রিনি খুশিতে গদগদ করছে। বলতে গেলে তার এক ডানা এখন আকাশে।উজ্জ বিধায় দেখা যাচ্ছে না।

— এই দিহান উপরে আয় গল্প করি।

— না থাক পরে একসময় আসবো।

— হুহ আচ্ছা।কিন্তু তুই তো পুরাই চেঞ্জ দিহান। ছোট্ট বেলা কিউট ছিলি কিন্তু কালা ছিলি এখন এতো চেঞ্জ কেমনে?

— ধুর তখন বাচ্চা ছিলাম। রোদ বৃষ্টি মাটিতে গড়াগড়ি করেই দিন কাটতো। তুই তখনকার সময় নিয়ে কথা বললে হবে নাকি?তবে তুই বদলাতে পারলি না।

— আমাকে একটুও পরিবর্তন লাগে না?

দিহান রিমির কথা চলতে লাগলো।আর রিনি নীরব দর্শক হয়ে কথা গিলছে।তার বেশ ভালো লাগছে। সে এক মনে দিহানের দিকে তাকিয়ে আছে।দিহান রিমির সাথে কথা বলার ফাঁকে রিনির দিকে তাকাচ্ছে। যখনই তাকাচ্ছে রিনি ফোন করার ইশারা করছে। আসলে সে দিহানকে অনেক মেসেজ দিচ্ছে কিন্তু দিহান কিছুতেই রেসপন্স করছে না। অবশ্য মেসেজ দেখছে কিন্তু প্রতি উত্তরে কিছু পাচ্ছে না রিনি।
‘নিশীথচিত্র'(১৭)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

____________

পরীক্ষা শেষ হতেই বৃষ্টিতে আটকে পরে রিনি।বজ্রপাতে বার বার চোখ নাক মুখে খিচে বন্ধ করে ফেলছে সে। আল্লাহ আল্লাহ করছে যেন মাথায় বাজ না পরে।ছোটবেলা থেকে রিনি বাজ পরার ভয়ে বেশ শঙ্কিত থাকে সবসময়।বজ্রপাতের শব্দ শুনলেই তার মনে হয় এই বুঝি মাথায় পরলো ৷ আর অপেক্ষা করা যায় না এই বৃষ্টি আর থামবে না এই ভেবে রিকশা ডেকেই উঠে পরে রিকশায়।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না বৃষ্টির তোরজোরে গেট থেকে দরজা পর্যন্ত ছাতা ছাড়া যেতে যেতেই পুরোটা ভিজে গেছে সে। ভিজে চুপসে গেছে একেবারে।নিজের রুমে দাড়াতেই পিছন থেকে তাজিম ডাক দিলো।

— রিনিরিনি ভিজেছোই তো চলো না বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলি।

রিনি বেশ উৎসাহের সাথেই সম্মতি জানিয়ে দেয়।বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলায় তার একদমই না নেই। বরং অনেক দিন ধরে এসব খেলা হয় না তাই উৎসাহের সাথেই খেলবে সে।

— আমি স্কুল ড্রেসটা পাল্টেই আসছি।তুমি যাও ফুটবলটা নিয়ে বাইরে নামো

রিনি তাজিমের খেলার মাঝেই মাথায় ছাতা চেপে দিহান গেট দিয়ে ঢোকে।তাজিম আর রিনির খেলা দেখে কিছুক্ষণ থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য।আর তার থেকেও বেশি অবাক হয় রিনির পোশাকে।ট্রাউজার আর জার্সি???খেলোয়াড়দের মতোই খেলতে নেমেছে।গায়ে ওড়না নেই। যদিও বাজে ইঙ্গিত দেয়ার মতো খারাপ দেখাচ্ছে না তবুও তার এতো বাড়ন সত্ত্বেও এভাবে!!!!
মাথায় রক্ত চড়ে বসলো দিহানের।চিন্তার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসে তাজিমের ডাকে

— দিহান খেলবে? চলে এসো।

বৃষ্টির মাঝেই কোমড়ে এক হাত ঠেকিয়ে অন্য হাত দিয়ে ইশারায় দিহানকে ডাকলো তাজিম।দেখাদেখি রিনিও ডাকলো।দিহান কটমট চোখে রিনির দিকে তাকায় যা বৃষ্টির জন্য রিনির কাছে অস্পষ্ট ছিলো।রিনি দৌড়ে দিহানের হাত ধরেই টানতে শুরু করলো।তখনই দিহানের চোখ মুখের কঠোরতা রিনির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।ভয়ে হাত টা ছেড়ে দেয় সে।দিহান তাজিমের দিকে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে জানাত সে খেলতে পারবে না । চকিতে স্থান ত্যাগ করে দিহান।

রিনিকেও আর খেলতে রাজী করাতে পারে নি তাজিম।

— রিনিরিনি তুমি খেলবেই না?

— নাহ তাজিম ভাইয়া পরীক্ষা আছে।আমি বরং যাই জ্বরে পরলে ঝামেলা হয়ে যাবে।

তাজিম বড্ড অবাক হয় এই রিনিকে দেখে।যে রিনি এই সুযোগটাই লুফে নিতো আজ সে সুযোগটা সেচ্ছায় ছেড়ে দিলো??আর আগে ঠান্ডা পানি ঘন্টার পর ঘন্টা খেতো যাতে জ্বর বাধিয়ে এক্সাম দিতে না হয় বা দিলেও খারাপ রেজাল্টের জন্য বকা না শুনে।তাজিমও তখন কিছু বলতো না।এই বাচ্চার বাচ্চামি তার অতি প্রিয় ছিলো তখন।এমন কি হয়ে গেলো যে এতো পরিবর্তন? কিছুতেই ভেবে পায় না তাজিম।

_____________

আজ পরীক্ষা ছিলো না রিনির।বিকেল বেলা ঘরের বাইরের দোলনাটায় তাজিম আর রিনি বসে বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে বসেছে।বেশির ভাগ গল্পই তার গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে।রিনি হাসতে বার বার তাজিমের কাধে হেলে পরছে আবার উঠছে আবার হেলে পরছে।রিনি হাসতে হাসতে বললো

— তাজিম ভাইয়া তুমি যেদিন ধরা খাবা সেদিন তুমি সব মেয়েগুলার মাইর একসাথে খেয়ে পটল তুলবা আমি সিওর।তোমায় আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।

রিনি মুখে প্রসস্থ হাসি টেনে শব্দবিহীন হাতি তালি দেয়ার মতো করছে বার বার।তাছাড়াও সে মাটিতে পা দমাচ্ছে বারংবার।

তাজিম হাসছে রিনির হাসি দেখে।
— খারাপ বলো নি।

— ধরা খাইতে কেমন লাগে তোমার?

— কেমন আর লাগবে!!যার কাছে ধরা খাই সে চলে যায় । আমি ফিরাতেও যাই না কাউকে। অনেকে আবার একা একাই ফিরে আসে। এসে বলে”বাবু তুমি ভালো হয়ে যাও আমি মাফ করে দিবো”। আমিও ভূগোল বুঝাইয়া দেই “যে আর হবে না সোনপাখি আমি ভুল ছিলাম মাফ করে দাও”।তাজিম থেমে হাসলো কিছুক্ষণ। আবার বললো
আর যে ফিরে আসে না সে ক্যান্সেল,ডিলিট, রিমুভ।এমন না যে আমার কাছে অলটারনেটিভ ওয়ে নেই।অন্য জিএফ গুলোও তো সেইম কেয়ার করে, ভালোবাসে, আদর করে।তাই একজন গেলে আমার ফিলই হয় না।

তাজিমের কাছে যে এসব হাতের মোয়া এমন একটা ভাব নিয়েই বললো কথাগুলো।

রিনি তাজিমের কাধে হাত দিয়ে সশব্দে থাপ্পড় মেরে বললো।
— কি পচা তুমি তাজিম ভাইয়া।মেয়েগুলোকে কষ্ট দাও। আমার কিন্তু তোমায় পচা মানুষ মনে হচ্ছে।অন্যের কষ্টে তোমার মোটেই কষ্ট নেই।

— আরেহ আমি অতোও পঁচা না।যে যেমন তার সাথে তেমন করি।যদি কেউ সত্যি সিরিয়াস হয় কিন্তু তার ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো না তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাদ দিয়ে দি। অনেককে ইগনোর করে কষ্টও দি।অদ্ভুত মজা লাগে আমার।এখন অপেক্ষায় আছি কে আছে যার ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো আর আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে।সেই হবে আমার হোনেওয়ালি বহু।

তাজিম আবারও হাসছে।

রিনি শব্দে করে অনেকক্ষণ শব্দ করে টেনে ভেংচি কাটলো।
— এহহহহহ

তারপর বললো

— নিজের নমুনা এই আর মেয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড খোঁজে হারপিক দেয়া ঝকঝকে পরিষ্কার। ঠেস মেরে বললো রিনি।
নাকি ভিম একশ লেবুর শক্তি দিয়ে পরিষ্কার করা মেয়ে চাও? কোনটা?

— রিনিরিনি জানি আমি ভুল তবুও খুজি এমন মেয়েই।কে না খোঁজে বলো সব থেকে খারাপ ছেলেটাও একটা ভালো স্বচ্ছ মেয়েই খোঁজে।

— তাহলে কেন অন্যের দিক টা ভাবছো না? একটা মেয়েও একটা স্বচ্ছ ছেলেই খোঁজে। তোমাকে যে ভালোবাসবে সেও নিশ্চয়ই ভিম দিয়ে ঘষামাজা, চকচকা, ফকফকা পরিষ্কার চরিত্রের ছেলে চাইবে তাই না? তো তুমি তার জন্য অপেক্ষা না করে চরিত্রে দাগে ভরছো কেন? আর সে যদি আসেও কতটা কষ্ট পাবে তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড ভেবে? ভেবেছো?

— চরিত্র যাওয়ার মতো পঁচা কাজ করি নাকি?

— করলেও বলবা আমাকে? মানুষের চরিত্র তখনই যায় যখন সে ধরা পরে অন্যের কাছে বা জানাজানি হয়ে যায় তার কৃতকাজ সবার মাঝে।কিন্তু যত দিন নিজের রূপ নিজের কাছেই আটকে থাকে ততদিন নিজেকে চরিত্রবানই মনে করি আমরা। নিজের সত্তা বলে তুই খারাপ তবুও আমরা ধামাচাপা দি।কারণ একটাই” কেউ তো জানে না তাই আমি ভালো”।

রিনি বিজ্ঞ মানুষের মতো হাসলো।তাজিম খানিকটা অবাক হলো।বিস্ময়ের চোখে রিনির দিকে তাকিয়ে রইলো।রিনি আবার বললো

–বিনা অপরাধে অন্যের মনে কষ্ট দেয়ার পাপ টা করো না কেমন?মজা মাস্তি যা ইচ্ছা করো তবে এইটুক খেয়াল রেখে।

তাজিম হেসে রিনির গালে হাত রাখে।রিনি গালে হাত দেয়ার দিকে তাকিয়ে আবার তাজিমের দিকে তাকায়।
— অনেক বড় হয়ে গেছো রিনিরিনি।

তখনই ফুসকাওয়ালার শব্দ পাওয়া গেলো।নিঃসন্দেহে বাসার সামনের গলিটা থেকেই যাচ্ছে।রিনির চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।

— তাজিম ভাইয়া রাখো তোমার বড়। ফুসকা খাওয়াও।

তাজিম হাসি মুখে আচ্ছা বলে উঠে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে হাটা দিবে তখনই রিনি আর তাজিম একসাথেই দেখে দিহান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আর চোখ তাজিম রিনির দিকেই বোঝা যাচ্ছে।দিহান তড়িঘড়ি করে চোখ সরাতে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ দেয়।আকাশটা তখন গাড়ো ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে।যেন আকাশে কেউ ছাই ফেলেছে।দিহানের মনে হলো তার আকাশেও এক মুঠো না অনেকগুলো মুঠো ছাই ফেলে দিয়েছে কেউ।চোখ নিচে নামিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।তাজিম পিছু ডেকে বললো

— কোথায় থেকে আসলে?

— কোচিং থেকে।

দিহান আবার হাটা ধরে।তাজিম বলে
— দিহান দাড়াও ফুসকা খেয়ে যাও।আমি আনছি।

তাজিম গেট দিয়ে বেড়িয়ে গেলো ফুসকাওয়ালাকে ডাকতে ডাকতে।দিহান নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।সে মনে মনে বললো “বালের ফুসকা খাবেনে”কিছুটা ঠেস মেরে বললো।সে আবার বললো”খাবোনা বালের ফুসকা”
তারপর হাটতে হাটতে হালকা আওয়াজে বিরবির করা শুরু করলো “বাল বাল বাল”

রিনি দিহানের পিছু নিয়েছে। দুইবার ডাকও দিলো দিহান শুনেও যেনো শুনেনি।তৃতীয় ডাকে চোয়াল শক্ত করে বললো”আমার পিছনে যেন তোমায় আসতে না দেখি”

দিহানের গলায় কিছু একটা ছিলো তাই রিনি আগানোর সাহস পায় নি আর।তবে এমন শক্ত কথার কারণও খুজে পাচ্ছে না।তৎক্ষণাৎ সে ব্যাপারটাকে হালকা করে নিলো। সে ভাবলো দিহান অন্যের সামনে তার পাগলামোটা সহ্য করবে না তাই ই বুঝি এভাবে বললো।

তাজিম রিনিকে ডাকলো ঘর থেকে বড় গামলা আর কাপ প্রিজ জাতীয় কিছু আনতে।রিনিও দৌড়ে আনতে চলে গেলো। রিমির জন্য কিছু ফুসকা ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা দোলনায় বসে খাওয়া আরম্ভ করলো ।মাঝে মাঝে তাজিম রিনিকে খাওয়িয়ে দিচ্ছে।তাজিম রিনিকে বলেছিলো দিহানকে ডাকতে রিনি হতাশ কন্ঠে জানালো” তাজিম ভাইয়া থাক আমার মনে হয় দিহান ভাইয়ের মেজাজ খারাপ।চোখ মুখ কেমন লাগলো।”

কিছুক্ষণ বাদে দিহান দরজার সামনে বেড়োতেই রিনি কিছু না ভেবেই হাতের ফুসকাটা নিয়ে এগিয়ে গেলো দিহানকে খাওয়াবে বলে।দিহানের মুখের সামনে ফুচকা এগিয়ে দিতেই দিহানের চোখ মুখে রাগের ছাপটা আরও বেড়ে গেলো।কটমট মেজাজে বললো

— তোমার মতো আমার যখন তখন এতো ফুসকা খাওয়ার সাধ জাগে না রিনি ।এতো বিলাশিতাও আমার নেই।আমার খেটে খেতে হয় বুঝলে?তোমার বিলাশিতা আছে লেখাপড়া বাদ দিয়ে হাহা হিহি করতে করতে তুমি সময়গুলো নষ্ট করতেই পারো ব্যাপার নাহ কিন্তু আমি পারি না।আর না আমার রাশলিলা দেখার সময় আছে।

দিহানের ঝাজালো আওয়াজে রিনি হতভম্ব হয়ে গেলো।শেষ কথাটা পূর্বের থেকেও ঝাজালো আওয়াজে শুনালো। দূরত্ব বেশি না হওয়ায় তাজিমের কানেও কথাগুলো স্পষ্ট গেলো।সেও দাড়িয়ে গেলো। হাত কাপতে কাপতে রিনির হাত থেকে ফুসকাটাই পরে গেল।

দিহান প্রচন্ড রাগে কোমড়ে হাত দিয়ে এদিক ওদিক দুইবার তাকালো।তার রাগে দিশেহারা অবস্থা।

— যাও যে কয়টা এক্সাম বাকি আছে সবকয়টা মেইম বুক আমাকে দিয়ে যাবে,, তোমার এই হাবিজাবি খাওয়া হয়ে গেলেই নিয়ে আসবে।

রিনি জায়গা থেকে নড়লো না।দিহান ধমকের সুরে বললো

— কি হলো যাচ্ছো না কেন?

রিনি কেপে ওঠে অশ্রু সিক্ত চোখে দিহানের দিকে তাকায়।দিহানের তাতে কোনো হেলদোল নেই।রিনি ঘরের দিকে হাটা শুরু করলো। দিহান পিছু ডেকে বললো

— রেড পেন ছাড়া অন্য কোনো কালার পেন থাকলে নিয়ে এসো।।

রিনি আর পিছনে তাকায় না সে হাটছেই।তার মন একটা কথাই বলছে “দিহান ভাই পারলো অন্য একজনের সামনে আমাকে এভাবে ধমকাতে??”” রিনির যেনো কান্নার বেগটা আরও বেড়ে গেলো।

দিহান এখনও একভাবে রিনির যাওয়ার পথে তাকিয়ে । তাজিম দিহানের কাছে এগিয়ে এলো।বললো

— পড়াতে হলে মাথা ঠান্ডা করে পড়াতে হয়।

দিহান হালকা হেসে বললো

— আমি পড়াচ্ছিলাম না ভাই।

— তাহলে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে জমে থাকা ক্রোধ স্টুডেন্টের উপর প্রয়োগ করা উচিত না অবশ্যই?শিক্ষকতায় অন্তত মানায় না।শুনেছি দারুন স্টুডেন্ট তুমি।আমি আবার অতো ভালো স্টুডেন্ট না।তবুও বড় হিসেবে দাবি খাটিয়েই বললাম।রিনিরিনির কান্না দেখতে আমার ভালো লাগে না।

দিহান কোনো জবাব দিলো না সামান্য ঠোঁট প্রসস্থ করলো যাতে করে তার মুখে হাসি ফুটে উঠার ন্যায় আকৃতি ধারণ করলো। মনে মনে বললো” আমি আমার অতি ব্যক্তিগত মানুষকে ব্যক্তিগত রাগ দেখাতেই পারি”

দিহান বললো
— নামাজে যাবেন ভাই?আযান দেবে বলে…

— হ্যা হ্যা অবশ্যই।ওগুলো রেখে আসি।
ফুসকার প্লেটগুলো দেখিয়ে।

— সিওর।

___________

রিনিকে আর রাতে পড়ার টেবিল থেকে উঠানো যায় নি।দিহানকে বইগুলাও দিয়ে এসে যে সে নিজের রুমে ঢুকেছে রাতে আর খেতেও আসে নি।তাজিম বুঝতে পারে না প্রাইভেট টিচারের কথায় এতো রাগ অভিমানের কি আছে? তবে তাজিমের রিনিকে দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে রিনি রেগে নেই সে বিশাল অভিমানের ঝুড়ি নিজের চারপাশে মেলে দিয়ে তার মাঝখানেতে গুম মেরে বসে আছে ।অনেক সাধাসাধি করেও সে রিনিকে খাবার টেবিলে আনতে পারে নি।

দিহান রাতে খেতে আসার সময় রিনির বইগুলোও নিয়ে এসেছে।সে জানে রিনি অভিমানের জন্যই খেতে আসে নি নইলে তার আগেই উপস্থিত হয়ে যেত রিনি।বইগুলো দিয়ে রেহানার কাছে রিনি কই জানতে চাইলো।রেহানা বেশ ভরাট গলায় কিছুটা গর্ব নিয়ে বললো

— রিনি তো পড়তে পড়তে খাওয়াই ভুলে গেছে বাবা।আমি ওর খাবার ওর রুমে দিয়ে আসবো।তোমরা খেয়ে নাও।

— আচ্ছা। আন্টি আমি কাল সকালে গ্রামে যাবো।বেশ কয়দিন থাকবোও।রিনির এক্সাম শেষ হলে ফিরে আসবো।ভার্সিটির গ্যাঞ্জামের কারণে ভার্সিটি বন্ধ আর আমার সব স্টুডেন্টদেরও এক্সাম টিউশনি নেই।তাই ভাবলাম শুধু শুধু থেকে কি করবো!আর গ্রামে তো যাওয়াই হলো নাহ।

— হ্যা হ্যা তা তো। এটাই সুযোগ। বাবা মায়ের সাথে দেখা করে এসো।

রিমি তাজিম দিহান গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করলো।দিহান দাদির কাছে গিয়েও বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে যাওয়ার কথা জানিয়ে ঘরে চলে গেলো।

__________

পরের দিন সন্ধ্যায় রিনি তার মাকে জিজ্ঞেস করলো দিহানের কথা

— মা দিহান ভাই সকালেও খেতে আসে নি দুপুরেও আসে নি,ঘর ও তালা দেয়া কোথায় গেছে কিছু জানো তুমি?

— কেন তোকে বলে নি যে ও গ্রামের বাড়ি যাবে?আমাকে তো কাল রাতে খাওয়ার সময় বলে গেলো।

রিনির কপাল কুঞ্চিত হয়ে এলো। চোখ মুখ যেনো কথা বিশ্বাসই করতে চাইলো না।পরক্ষণেই মনে হলো প্রত্যেকটা মানুষ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।তবুও কন্ঠ সাভাবিক করতে পারলো না।রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো

— কাল রাতে আমাকে খাবার দিতে এলে তখন বললে না কেন তুমি?

–এতে বলার কি আছে?

রিনি নিজেকে শান্ত করে জবাব দিলো

— না মানে কিছু বই দাগিয়ে নেওয়ার ছিলো

তাজিম বললো

— কাল না দিহান তোমার দাগিয়ে দিয়ে গেলো?

রিনির মেজাজ এমনিই বিগড়ানো আরও বিগড়ে গেলো

— তো কি হয়ে তাজিম ভাইয়া আমার কি আর কোনো প্রবলেম থাকতে পারে না নাকি?আমি কি সব জান্তা?

রিনির রুক্ষ গলায় তাজিম আহত হলো।ছোট জিনিস নিয়ে গলা উচানোর কি আছে আদোও বুঝতে পারলো না তাজিম।
রিনি সবার মধ্যে দিয়ে উঠে চলে গেলো হনহন করতে করতে।সবাই আবার হাসি মজায় মেতে উঠলো শুধুমাত্র তাজিম বাদে।তার রিনির ব্যবহারটা একদম ভালো লাগে নি একদম না।

তাজিম ভাইয়া দিহান ভাই.. এই ভাইয়া আর ভাই ডাকার মাঝে বেশ তফাত খুজে পায় সে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here