নিশীথচিত্র পর্ব ৪২+৪৩

‘নিশীথচিত্র’ (৪২)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

____________

সকালের মিষ্টি রোদের উজ্জ্বল কিরণ কার্পন্য ছাড়াই রিনির মুখে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।চোখে রোদ পরতেই রিনি চোখ কচলে পিট পিট করে চোখ মেললো।চকিতে মনে হলো কাল রাতের সব কিছু বুঝি স্বপ্ন ছিলো।এটা মাথাত আসতেই বুকটা খালি হয়ে গেলো যেনো তরাক করে।আশপাশে তাকিয়ে বুঝতে একটা পুরুষালি শরীরের বুকে শোয়া সে।মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পায় সাধনার মুখ খানা, শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে তাকে আগলে।পাশে থাকা মোবাইলটা অন করে সময়টা দেখে নেয় সে।সাতটা সাত বাজে।রাতে বেশি সময় জাগতে পারে নি দিহানের জন্য।সারা শরীরে এতো মারের দাগ দেখে তার নাকি আদর পাচ্ছে না।মূলত সে আবার নিজেকে দায়ী করছে রিনির অবস্থার জন্য।এসবের কারণেই তার মনের অবস্থা পাংসুটে হয়ে গেছিলো।মারের জায়গা গুলোতে ক্রিম লাগিয়ে কঠিন করে পায়তারা শুরু করেছিলো ঘুমানোর জন্য।তবুও রিনির জোরাজোরিতে খানিকক্ষণ ভালোবাসাময় সময় কাটালেও বেশি সময় পেরে ওঠে নি দিহানের সাথে।দিহান রিনির হাত পা আটকে জোর করে বুকে নিয়েই ঘুমিয়ে পারালো।আজানের সময় উঠে তৈরি হয়ে নামাজটা পরে আবার ঘুম।ঘুম ভাংলো মাত্র।রিনি মাথা তুলে দিহানের চোখের উপর চুমু খায়।বুকে মাথা দিয়ে নিশপিশ করতে থাকে।

–“এমন করে না বউ, ঘুমাচ্ছি তো।রাতে ঘুম হয় নি ঠিক মতো আমার।”ঘুম জড়ানো দিহানের গলা।রিনি আবার মাথা তুলে তাকায়।চোখ না খুলেই কথা গুলো বলছে দিহান।রিনি মৃদু হাসে।কি আদুরে ডাক “বউ”।

রিনি উঠতে উঠতে অভিযোগ নিয়ে বলে
–“চোখে যখন ঘুম ছিলোই না আমাকে কেন ঘুম পারালেন?”
দিহান আর উত্তর দেয় না।জানালার পর্দাগুলো আটকে কামিজ নিয়ে বাথরুমে চলে যায় সে।বের হয়ে দেখে দিহান বিছানায় বসে শার্ট পড়ছে।রিনি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো।বললো
–“উঠে গেলেন যে ঘুমাবেন না?”

–“আসলে ঘুমানো সাজে না এখানে।কেমন কেমন লাগছে।একটু অভিনয় তো করতে হবে।সুখী দম্পত্তির মতো চলাফেরা করলে তো চলবে না।”

–“তা ঠিক।”

–“যাও নিচে যাও।”

দিহান ওয়াশরুমে ঢুকে।রিনি দরজা খুলতেই দেখে রেহানা দাঁড়িয়ে। রিনি হকচকিয়ে যায় অপ্রস্তুত ঘটনায়।

–“কেবল এলাম।”

মাকে দেখে তার মুখটা ভোতা হয়ে আসে।রেহানা রিনিকে পরখ করে দেখে।নাহ চুল শুকনোই আছে।

–“চুল শুকনো কেন তোর?”

রিনির মেজাজ তুঙ্গে ওঠে।কি সব প্রশ্ন।

–“কেন ভেজা থাকার কথা ছিলো?”

–“কেন দিহান তোকে ছোয় নি?ছুলে গোসল করে আয় যা।করতে হয় গোসল।”

রিনির মেজাজ খারাপ হয়ে যায় গটগট করে হেটে চলে যায় দীপ্তির রুমে।রেহানা চিন্তিত হয়। ভাবমূর্তি ভালো না এই মেয়ে কিনা পালিয়ে যায়।

দীপ্তির খিলখিল চাপা হাসির শব্দ রুম জুড়ে।পেট চেপে হাসতে বলে
–“ভাগ্যিস হেয়ার ড্রায়ার ছিলো।”

রিনি চোখ পাকিয়ে তাকায়।এই মেয়েকে কিছু বলাই উচিত না।কত্তো সিরিয়াস বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে।আজিব।

____________

বিকালে ছাদে চলে যায় দীপ্তি, রিনি, দিহান।রিনি অবশ্য দিহানকে টেনে নিয়ে এসেছে ছাদে।তার নাকি দীপ্তির সামনে যেতে লজ্জা লাগছে।রিনি ভেবে পায় না এতো লজ্জা, অপরাধবোধ নিয়ে মানুষটা ঘুমায় কেমনে?অবশ্য ঘুমাতেও বা পারছে কই!

সন্ধ্যা থেকেই দিহান রিনি দীপ্তিকে পড়াতে বসেছে।খাটে হেলান দিয়ে দিহানও মনোযোগী বইয়ের দিকে।বই পড়ার সময় তার ধ্যান জ্ঞান বাইরে যায় না।রিনি দীপ্তি ফুসুরফাসুর করেই যাচ্ছে নন্সটপ।

–“আমি কিন্তু লাঠি তুলবো দুটোর গায়ে।মলম লাগানোর জন্য জায়গা বাকি থাকবে না।”

দিহানের ধমকে দুজনই শান্ত বাচ্চার মতো চুপসে যায়।চোখ স্থির করে বইয়ের দিকে।এই সময়টায় যে দিহান কঠিন সিরিয়াস থাকে তা দুজনেরই অবগত।

আজ ভার্সিটিতে সাগর,মিলন,তিন্নি ট্রিটের জন্য চেপে ধরেছিলো।দিহান অবশ্য ওদের বলেছে বিয়ে গ্রামের বাড়ি থাকতে হয়েছে ঘরোয়া ভাবে।লজ্জায় জানায় নি।এ নিয়েও বন্ধুমহলে অনেক কথা শুনেছে।সবাই বলছে দিহান সুপার ফাস্ট।আর এদিকে দিহান সব মিলিয়ে মিথ্যা বলতে বলতে ক্লান্ত।ফোনের রিং বেজে ওঠে।রিসিভ করে ব্যালকুনিতে চলে যায় দিহান।

হাফসার কথা শুনে বলে,
–“আম্মা তারা বলছে আসতে মানলাম।কিন্তু আমি চাই আমি বাসা ভাড়া নেয়ার পরে তোমরা আসো।ঢাকায় এসে এই বাড়িতেই থাকো, খাও আমি তা চাই না।একবেলা এলে হবে সেটাই যথেষ্ট ।”

ফিরোজ পাশ থেকে বলে
–“ওনারা যে বললো।”

–“বললেই আসতে হবে আব্বা?নিজেরা বোঝো না যে বিষয়টা কেমন দেখায়?বাসা দেখেছি আমি।মাসের শেষ এখন ৫/৬ দিনের মধ্যে উঠতে পারবো।ফোন দিলে বুঝিয়ে বলো।আমিও বলবোনে।”

কথা বলে রুমে ফিরে আসে।খাবারের জন্য ডেকে যায় রেহানা।মেয়ের মতিগতি পরখন করে সে সেকেন্ডে সেকেন্ডে।

রাতে খাবার পরে রিনি টেনে হিচরে দীপ্তিকে আবার নিয়ে এসে আড্ডা জমায়।
–“তোমাদের বিয়ে তে তোমাদের থেকে বেশি অবাক হয়েছে তনয় ভাইয়া। মোটে বিশ্বাস করতেই চাইছে না সে।”এরপর দীপ্তি রিনির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে”আমাকে খালি বলছে বিয়ের কথা।পাগল থামাই কিভাবে বলো তো?”

দিহান বলে
–“কানে কানে কি বললি দীপ্তু?তোর ও কি বিয়ে করার ইচ্ছা জাগতেছে নাকি তনয়ের?”

দীপ্তি লজ্জা পায়।ভেংচি কেটে বলে
–“আমার বিয়ের কোনো শখ নেই।”

–“তাহলে তনয়ের?”

–” তা তার কাছে জিজ্ঞেস করো।”

দিহান রাশভারী হয়। বলে
–“আমি অন্যায় করেছি বলে আমার মতো করিস না আবার।তোকে শাসন করারও মুখ থাকবে না আমার। আর না থাকবে বাবা মায়ের মুখ।বলবে আমি শিখিয়েছি।স্বাধীনতা দিয়েছি তোকে। সৎ ব্যবহার করিস সেটার।”

দিহানের নিজেকে কতোটা তাচ্ছিল্য করে কথা বলছে তা তার কন্ঠেই প্রকাশ পাচ্ছে।দীপ্তি রিনি একেবারে নিভে যায় যেন।দিহান এক মনে বইয়ের দিকে তাকানো। বেশ কিছুক্ষণ পরে দীপ্তি উঠে চলে যায়। রিনি দরজা আটকে দিহানের পাশে বসে।জগ থেকে পানি ঢেলে এক গ্লাস দিহানের মুখের সামনে ধরে।দিহান চোখ তুলে তাকায়।ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করে
–“কি?”

–“খান।”

দিহান হেসে গ্লাসটা নেয়। গ্লাসটা নিজেই টেবিলে রাখতে গেলে দিহানের হাত দিয়ে রিনি গ্লাসটা নিয়ে নিজে রাখে।দিহান হেসে বলে
–“পতি সেবা হচ্ছে মনে হচ্ছে।”

রিনি মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে যায়।

___________

আলমিরা খুলে সেটার সামনে ঘুচুর ঘুচুর শুরু করেছে ত্রিশ মিনিট হলো।দিহান মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকিয়েও আবার পড়ায় মনযোগী হয়।হাতে কিছু একটা নিয়ে গট গট করে চলে যায় বাথরুমের দিকে । দিহান সব কান্ড কারখানাই পরখ করছে। পড়ায় মনযোগী হয় সে।

দশ মিনিট পেরোয়,বিশ মিনিট পেরোয়,ত্রিশ মিনিট পেরোয়।রিনির বের হবার নাম নেই।দিহানের কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ছাপ পরে।বেশ কয়বার ডাকে রিনিকে। নাহ বের হচ্ছে নাহ!দিহান উঠে বাথরুমের সামনে দাড়ায়।কড়া আওয়াজে বলে

–“বের হও বলছি রিনি রাত বিরেতে কি শুরু করছো এতোক্ষণ ধরে?”

কড়া আওয়াজে আর কয়বার ডাকার পরে ভেতর থেকে দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়।দিহানের চোখে তাক লেগে যায়।মুহুর্তের জন্য মনে হয় সে অবচেতন।চোখ ঝলসে যাচ্ছে।রিনি চোখ ফ্লোরের দিকে রেখেছে।পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খোটার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।মুখে লজ্জা মিশ্রিত হাসি চেপে রেখেসে সে।দিহানের চোখ বুজে আবার চোখ মেলে। নাহ একই,ভুল দেখছে না সে।ঠোঁটে গাড়ো লিপ্সটিপ, চোখে গাড়ো কাজল,চুল পিঠময় খোলা,স্লিভলেস শর্ট ওয়েস্টার্ন।

দিহান তোতলানো স্বরে বলে
–“এই পোশাক পেয়েছো কই?”

রিনি ঝিমানো স্বরে বলে
–“আমি কিনেছিলাম, আম্মুর এক বোন বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিলো বেশ কয়বার।অনেক আছে।তবে সব এখন লাগে না।বেছে বুছে দেখলাম এটা লাগবে।”

দিহান দ্রুত পায়ে টেবিলের কাছে চলে যায়।পানি ঢেলে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি সাভার করে দেয়।রিনি এসে দিহানের গলায় দুই হাত আটকে দিয়ে ঝুলে পরে।

দিহান চোখ পাকিয়ে বলে
–“কি বাদরের মতো ঝুলছো কেন?”

–“আজ কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি ঘুমাবো না।আপনি বললেও না জোর করলেও না।”

__________

বিয়ের চারদিন কেটে গেছে।রেহানা ইতস্ততবিক্ষিপ্ত চেহারায় ফোন দেয় রিমিকে। রিমিকেও জানানো হয় নি বিয়ের কথা ।ওর শশুর বাড়ির মানুষ জেনে যাবে এই জন্যই চেপে রাখছিলো।কিন্তু আজ ফোন দিতেই হবে।ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হয়।রিমিকে সব বলতেই সে বিস্ময়ে চূড়ান্ত।

–“মা যা বলছো এখন তা কিভাবে সম্ভব?আর এটা জীবনের জন্যও তো রিস্ক। ”

–“তুই থাম। যা বোঝার আমি বুঝবো।”

চলবে
‘নিশীথচিত্র'(৪৩)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

[তেতাল্লিশ পর্বের আগের অংশের সাথে নতুন অংশ যুক্ত করে ৪৩ পর্ব লিখেই পোস্ট করা হলো।কেউ বিব্রত হবেন না।যেটুকু পড়েছেন তার পর থেকে আরম্ভ করলেই হবে]
____________

ভালোবাসায় দুটো মানুষের পাগলামি খুনসুটি সর্গীয় হয়।আর ভালোবাসার যুগল দুটো স্বামী স্ত্রী ক্ষেতাপ পেলে তো বাকিই রাখে না কিছু।ক্ষুদ্র নিশ্বাসটায়ও তখন ভালোবাসা মাখামাখি। গলায় মুখ ডুবিয়ে শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে শান্তির ঘুম কয়জন দিতে পারে? রিনি দিহান পারছে খুব পারছে।খাবার পরে রুমে এসেই ঝটাপট দরজা বন্ধ করে দিহানের কোলের মধ্যে ঝাপিয়ে পরে।কোলে বসে গলা জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে শান্ত হয়ে থাকে রিনি।মাঝে মাঝে খুব শান্ত আর মাঝে মাঝেই বেশামাল পাগলামিতে মাতিয়ে দেয় দিহানকে। বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেই দিহান পড়াশুনা করে।তার একটুও বিরক্ত লাগে না।মনে হয় জীবনটা পরিপূর্ণ,অপূর্ণতা নেই। আর এই পরিপূর্ণতার হাতটা আগে পেলে আরও ভালো কিছু পারতো।ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।খুব ভয়ও হয় তার।রিনির মা বাবা অনাগত সন্তানটা নিয়ে কি বলে কে জানে।মাত্র চার পাঁচ দিনের বিয়ে! সত্যি ঘটনা খুলে বলা রিস্কি। যা সে চায় না।রিনিকে পেয়েও হারানোর ভয় শতবার কাপিয়ে তোলে তার অন্তর্দেশকে।দিহান আরও একটু শক্ত করি জড়িয়ে ধরে রিনিকে।ঘাড়ে চুমু খেয়ে ডান দিকের টেবিলে রাখা বইয়ের দিকে মনোযোগী হয়।রিনি কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে তরাক করে তাকায়।সূক্ষ্ম চোখ জোড়া দিয়ে পরিদর্শন করতে থাকে দিহানকে।

–“এই যে এই ছেলে পড়াশুনা রেখে আদর করা হচ্ছে কেন?একদম মনোযোগী নয় তুমি পড়ায়।চেন আমাকে? মেরে তক্তা বানিয়ে দেবো।সেই তক্তা দিয়ে আমার খাট বানিয়ে শান্তিতে ঘুমাবো।চেনো আমাকে চেন?”

রিনির ধমকপূর্ণ কথায় দিহান শরীর কাপিয়ে হেসে ওঠে। রিনির কোমড় দুই হাতে আরও শক্ত করে চেপে ধরে।হাসি থামিয়ে বলে

–“রাত তো অনেক হলো তাহলে এখন খাটই বানিয়ে দাও।”

রিনি ঠোঁট উল্টে বলে।
–“ইস পরে বলবেন তোমার জন্য আমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।আমি এই নাম একদম চাই না পড়েন পড়েন।”

–“না আর থাক।ইচ্ছে করছে না।”

রিমি দুষ্ট চোখে বললো
–“আমার দিব্য অনুভূতি বলছে এখন আপনার আদর চাই।তাই না?”

বলেই রিনি খিলখিল করে হেসে ওঠে।বউয়ের হাসি দেখে দিহানও না হেসে পারে না।

___________

বিশাল খাটটায় পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে পা দুটো অনবরত নাড়াচ্ছে শাহানারা বেগম।পান চিবুয়ে পানের চিপ ফেলছে খানিক পর পর।হাতের মোটা বালাটা ঘুরাচ্ছে আপনমনে।গভীর পরিকল্পনায় মগ্ন সে। পাশেই তার স্বামী মোটা চশমা দিয়ে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে। খোলা দরজা থেকে বড় ছেলে মারুফের বউ রিমিকে দেখে ডাকলো সে।রিমি বাচ্চার জন্য দুধ গরম করতে এসেছিলো। শাশুড়ীর ডাক শুনে পা থামিয়ে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

–“ডাকছিলেন মা?কিছু লাগবে?চা করবো?”

–“না তা কিছু না।এদিকে আসো। রিনির সম্পর্কে কি শুনলাম?”

রিমির মুখ পাংসুটে হয়ে গেলো।স্বামীর কাছে মনের কথা বলেও সে কখনও শান্তি পায় নি।সেই কথা তার মায়ের কাছে পাড়বেই।কাল রেহানার সাথে কথা বলার সময় সে কথা মারুফও শুনে ফেলছিলো। রিমি পই পই করেই বললো এগুলো যাতে শাহানারা বেগমকে না বলে। কিন্তু সেই বললোই।রিমি ফোস করে নিশ্বাস ছাড়লো।

–“কি কথা কও না ক্যান?”

–“আসলে মা আমিই কাল শুনলাম।”

–“কও তো নায় সেডাই মেইন কথা।যাই হোক বাচ্চা মাইয়া শাসনে রাখতে পারো নায় বয়সের দোষে ভুল করছে মানলাম।তাই বইলা ফকিরের বাচ্চার কাছে মাইয়া দিবা?”

–“মা আম্মু ব্যবস্থা নিচ্ছে সে বিষয়। ”

শাহানারা আওয়াজ শক্ত করে বললো
–“জানি জানি সব শুনছি।”মুহুর্তেই তার গলা নরম হলো। বললো”আমগো তাজিম ছিলো না?নিতাম আমরা ঐ অবস্থায়ই।পরে জারজ সন্তানটার করতাম ব্যবস্থা।আজকাল এগুলা ব্যাপার কোনো?দাও দেখি তোমার মা রে ফোন লাগাইয়া দাও। কথা বলবো আমি।”

এরপর আবার বিরবির করে বললো”ফকিরের বাচ্চার লগে মাইয়া দিছে।পরিচয় কেমনে দেবে তা ভাবে না।”
আবার তাড়া দিয়ে বললো”দাও ফোন লাগাও।”

___________

গম্ভীরতা ঝেকে বসেছে চোখে মুখে।কিছু ভালো ঠেকছে না দিহানের।বোধ শক্তি বলসে রিনির মায়ের আচারণ স্বাভাবিক না। যে মানুষ টাকা পয়সা ধন দৌলতের মাধ্যমে আশপাশের মানুষও বিচার করে,তার চারপাশের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষকে তখন তুচ্ছ জ্ঞান করে চলে।একসাথে ওঠা বসাতেই লজ্জাবোধ করে, মধ্যবিত্তদের নিম্নবিত্তদের সাথে সেখানে সম্পর্ক পাতানো দূরের বিষয় ।পরিচয় দিতেই তাদের ইচ্ছা হয় না।রিনির মা ও সে ধাচের মানুষ ।দিহানকে যে পরিচয় দিতে পারছে না তা সে বুঝতে পারছে।প্রথম প্রথম দিহান তার চোখে দেখেছে সে দিহানকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু এখন পুরোপুরি অন্য কথা বলছে ওনার চোখ।পরশু রিনিকে নিয়ে চলে গেলেই শান্তি।তবুও মনের মধ্যে উতলতা থামছেই না।কিংকর্তব্যবিমুঢ় লাগছে ।মধ্যবিত্ত হওয়া কি অভিশাপ? এই কথায় দিহান কখনোই বিশ্বাসী ছিলো না।কিন্তু তবুও রিনির প্রভাব জীবনে পরার পর মাঝেই মাঝেই মধ্যবিত্তের অসহায়ত্ব গা চারা দিয়ে ওঠে।তখন নিজেই আবার প্রবোধ গোণে নাহ প্রত্যেকটা অবস্থানেরই নিজস্ব সম্মান আছে।

রিনি ঘুম থেকে জেগে দিহানকে বিছানায় না পেয়ে চোখ কচলে জানালার বাইরে তাকায়।পর্দা হালকা উড়তেই দেখতে পায় রেলিংয়ে দুই হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিহান।ওড়না গায়ে চাপিয়ে পা টিপে টিপে দিহানের পেছনে দাড়ায়।দিহানের দুইহাতের ফাঁকা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কাধে আর চিবুক রাখা হয় না।ওতো লম্বা হলে তো! রিনির মাথাই দিহানের কাধ বরাবর।পিঠে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিলো।বললো

–“এতো ভাবুক কেন আমার বরটা? বউ রেখে এতো কি ভাবে? টিনা মিনার কথা?”

দিহান আনমনেই বললো
–“মধ্যবিত্তের আবার টিনা মিনা।দুই একজনের রিনি জোটে এটাই সাত কপাল।”

রিনি অবাক হয়।
–“দিহান ভাই কি বলছেন এসব?”

–“কিছু না।তোমার মায়ের ব্যবহার, চোখ, মুখ অস্বাভাবিক লাগে না তোমার কাছে?”

রেহানার চোখে মুখে আন্তরিকতা প্রকাশ পায় না তা রিনিও খেয়াল করেছে। খারাপ লাগলেও কিছু বলতে পারে না তার মাকে।
দিহান তেমনই দাঁড়িয়ে আছে।রিনি আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

–“তোমার মা বাবা যদি আমাদের আলাদা করে দিতে চায়?”

রিনির আত্মা কেপে ওঠে।প্রবোধ দিয়ে বলে

–“আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে দিহান ভাই।সম্ভব না”

–“সব সম্ভব। তোমার আমার বিয়ের কথা পাড়াপ্রতিবেশিও জানে না।যদি বলে তার মেয়ের সর্বনাশ করে পালিয়ে বিয়ে করেছি? বা ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করেছি?এছাড়াও তোমার বয়স আঠারোও হয় নি।”

রিনি দিহানকে নিজের দিকে ঘুরায়। বুকে মাথা দিয়ে বলে
–” কিচ্ছু হবে না।আমাদের একটা পুচকি আসছে না?ওকে দেখেই সব ভুলে যাবে দেখেন।”

দিহান বিরবির করে বলবো
–“ওকে নিয়েই তো ভয়।”

_______________

দিহান ঘরের টুকটাক সব কিছুই এই দুইদিন ভাড়া বাসায় নিয়ে গেছে।আজ রিনির সব কিছু গোছানো শুরু করেছে। গোছানো হলেই বের হবে আজই।গ্রাম থেকে হাফসা ফিরোজ এসেছে দুদিন আগেই।তারা ঘরের আসবাব গুছিয়ে রাখছে।এছাড়াও নতুন আসবাব কিনতে হবে দিহান ধার কার্য করে কিছু টাকা মেনেজ করেছিলো।বাকিটা ফিরোজ জোগার করেছে কিছু জমি বিক্রি করে।দিহান ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলো তাতে কিন্তু ফিরোজ ধমকে ছেলেকে চুপ রেখেছে।বড় বাড়ির মেয়ে আসলে এসব লাগে।মেয়ের না লাগলেও মেয়ের পরিবারের চোখ ভরানোর জন্য অবশ্যই লাগে তা তারা বোঝে ।

দীপ্তি, রিনি গোছাচ্ছে।দিহান বিছানায় হেলান দিয়ে বউকে দেখছে।পেটে বাম হাত রেখে ডান হাতে দীপ্তির কাছে ওয়ারড্রব থেকে জামা কাপড় এনে এনে দিচ্ছে। দীপ্তি ভাজ করে ব্যাগ ভরছে।ফিরোজা রংয়ের গোল একটা জামা পরা রিনি।ডান কাধে ওড়না রেখে শরীরময় টেনে দিয়েছে।একটা হাত পেটে।দিহানের বেশ লাগছে দেখতে।মিটিমিটি হাসছেও মাঝে মধ্যে।তা দেখে রিনি সূক্ষ্ম ভেংচি কাটছে।
দিহান উঠে দাড়ায় একপর্যায়ে ।

–“তুমি বসো রিনি আমি এনে দিচ্ছি।বার হাটছো কষ্ট হচ্ছে তোমার।”

–“নাহ আপনি পারবেন না।আমার কি কি নিতে হবে আপনি বুঝবেন?”

আচ্ছা ওখানটায় দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দাও।আমি করে দিচ্ছি।দিহান এগিয়ে এলো।এমন সময় রেহানা প্রবেশ করলো হন্তদন্ত হয়ে।বেশ কড়া এবং স্পষ্ট গলায় বললো

–“রিনি কোথাও যাবে না। তোমরা চলে যেতে পারো।”

উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষ হতভম্ব হয়ে তাকালো । বিষ্ময় কাটিয়ে রিনিই প্রথমে বললো
–“এসব কি বলছো মা।যাবো না কেন?এতো দিন ধরে শুনে আসছো যাবার কথা আজ হঠাৎ কিসব বলা শুরু করছো?”

রেহানার গলার স্বর মোটা হলো।রিনির হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বললো

–“তোকে তোর পছন্দের ছেলের সাথেই বিয়ে দেবো। ”

রিনি আকাশ থেকে পরছে যেনো। কোন ছেলে আবার তার পছন্দের?

–“যে তোর বাচ্চার আসল বাবা তার সাথেই তোর বিয়ে দেবো।এই ছোট লোকের সাথে যেতে হবে না।”

অপমানে দিহানের কান ভন ভন করে উঠলো।দীপ্তি যেনো চুপসে গেছে।রিনি কিছু বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে।কি বলছে এসব তার মা?দিহান বেশ বুঝতে পেরেছে রিনির মা সবটা জেনে গেছে।চোখ বন্ধ করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অপমানটা হজম করলো।শান্ত এবং শক্ত কণ্ঠে বললো
–“আন্টি আপনার ভুল হচ্ছে। রিনির সন্তানটা আমারই।তাই ওকে আর ওর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে না।ওর পছন্দের ছেলের সাথেই ওর বিয়ে হয়েছে।”

–” আমি জেনে গেছি সবটা ধরে ফেলেছো তাই না?তাই খুব তাড়াতাড়ি স্বীকার করে ফেললে হ্যা? মুনির ঠিকই বলে তোমার বুদ্ধি আছে নইলে আমরা ধরতেই পারলাম না সেদিন!”

–“আন্টি আমি যা করেছি ভুল তবুও রিনিকে সম্মান দিতে যেটুকু দরকার সেটুকু করেছি।তখন মুখ বুঝে থেকে ওর সাথে যা তা হয়ে যেতো সেটা মেনে পালিয়ে বেড়ানোটা আমার বিবেকে বেধেছে।আমি পারি নি।আমি যতটা সম্ভব সম্মান দেয়ার চেষ্টা করেছি।আর আপনারা তখন মেনে নিতেন না তাই আমি স্বীকার করি নি।কিন্তু পরে আমি ঠিকই বলতাম।”

–“উহু তা না। তুমি আমাদের সম্পত্তির লোভটা সামলাতে পারো নি।রিনিকে ফুসলিয়ে প্রেম করেছো, নষ্টামি করে আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছো।আর এখন বিয়ে করে বলছো সম্মান দিয়েছো?আমাদের টাকা পয়সা না থাকলে তো ঠিক ঠিক ওকে ছেড়ে দিতে।”

দিহান হাত আরও শক্ত মুষ্টিবদ্ধ করলো।রাগে মাথার রগ টনটন করে উঠছে।রিনির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে।

–“মা তুমি ভুল ভাবছো।আমাদের কোনো প্রেম ছিলো না। আর না সে ফুসলিয়েছে। আমিই তার পেছনে লেগে ছিলাম। আর সে আমার সর্বনাশও করেনি।আমার দোষটা বেশি ছিলো।”

রেহানা মেয়ের গালে কষে থাপ্পড় বসালো।
–“একটাও কথা বলবি না তুই।তোর নতুন করে বিয়ে হবে তৈরি কর নিজেকে এসব ছোট লোকের কথা ভুলে।”

প্রত্যেকের বিষ্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।রিনিকে মারায় দিহানের মেজাজ আরও চড়ে গেছে।হাত টেনে রিনিকে এক হাতে আগলে ধরলো।শক্ত আওয়াজে বললো

–“আন্টি রিনির সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।আমার সন্তানও সে বহন করছে। ওকে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছেন কিভাবে?

–“আমি সব ভাবতে পারি।কিসের সন্তান? কিসের বিয়ে?আর কে জানে তোমাদের বিয়ে হয়েছে?নারী নির্যাতন মামলা দেবো বুঝলে?বউ টউ মুখে তোলার আর সাহস করো না।”

রেহানা হাতের কাগজটা সামনে ধরলো।কয়েক ভাজে কাগজগুলোকে টুকরো টুকরো করে ছিড়লো।সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মাত্র।

–“নাও তোমাদের বিয়ের স্বাক্ষরের কাগজটাও শেষ। এখনই ঘর থেকে বের হয়ে যাও এক্ষনি। আর ছোট লোকদের তো মনও ছোট।যাওয়ার সময় দেনমোহরের টাকাগুলো নিয়ে যেও।”

দিহানের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো।
–“বার বার ছোট লোক বলবেন না আন্টি।ছোট লোকের মতো কিছু আজ অব্দি করি নি।ইন ফ্যাক্ট আপনার কথাবার্তাকে আমি ছোট লোকি ব্যবহার বলতে বাধ্য হচ্ছি।মাফ করবেন।যথেষ্ট সম্মান করি সম্মানটা রাখতে দেন।আর এসব আংকেল জানে?”

রেহানা দ্বিগুণ রাগ নিয়ে বললো
–“।চোরের মায়ের বড় গলা না।নিজে ছোট লোকের বাচ্চা আর আমাকে বলছো আমার ছোট লোকি ব্যবহার? রিনির বাবা তাই ই তোমাদের মতো ছোট লোকদের সাথে কথা বলতে চায় নি।আমাকে পাঠালো।”

দিহানের শেষ আশাটাও শেষ। রিনির বাবাও তাহলে এক জোট।আতংকে রিনি দিহানকে খিচে জড়িয়ে ধরে আছে।আতংক ভরা চোখ দুটো দিয়ে একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে একবার মাথা তুলে দিহানের দিকে তাকাচ্ছে।দীপ্তি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। অপমানে চোখ দিয়ে পানি ঝরছে শুধু।দীপ্তি চোখের পানি টুকু মুছে বললো

–“আন্টি বাবা মা তুলে কথা বলবেন না একদম।”

–“তুই চুপ কর।তুইও কি তোর ভাইয়ের মতো নাকি তার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে?আমার তো মনে হয় তুই পতিতা মেয়েদের মতো শরীর বিলিয়ে টাকা ইনকাম করিস বড়লোক ছেলেদের ফাসিয়ে।”

দীপ্তি জায়গায় থমকে গেলো।শিরদাঁড়া বেয়ে কেমন বিশ্রি অনুভূতি।

–” ছেলেদের শরীর দেখিয়ে টাকা ইনকাম করিস না?দুই ভাই বোনই এক।নষ্টা।বড় লোকদের ধরেই এরা টাকার জন্য।শরীরটাই তোদের ইনকাম না?”

দীপ্তি দুই কান চেপে ধরলো।দিহান রিনিকে ছেড়ে বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।রিনি চোখে একসাগর পানি নিয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।এতো জঘন্য তার মা?

দিহান বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–“আমাকে মাফ করে দিস দীপ্তু।”

রেহানার দিকে লাল রঙা চোখ নিয়ে তাকালো দিহান।রেহানার চোখে মুখে তাচ্ছিল্য ভরা কপটতা।

–” সম্মান করতে চাই বলে মুখ বুজেই চলে যাচ্ছি।”

দিহান আর এক মিনিটও দাড়ায় না।দীপ্তির হাত ধরে হন হন করতে করতে চলে যায়।পেছন থেকে রেহানা বলে

–“টাকাটা নিয়ে যাও। ছোট লোকদের টাকা খাওয়ার জন্য আমরা বসে নেই।”

দিহান রক্ত চোখে একবার পেছনে তাকালো।পরক্ষণেই দীপ্তি হাত টেনে সদর দরজা থেকে বেড়িয়ে গেলো।রিনি ধপ করে বিছানায় বসে পরলো।চিৎকার করে কাদতে শুরু করলো।

–“এসব কান্নাকাটি বাদ দাও।রিমিরা কাল আসছে পরিবারসহ।তাজিমের সাথে ধুমধাম করে বিয়ে হবে তোমার।”

–“তাজিম ভাইয়া!”

রিনি বিপন্ন চেহারায় রেহানার দিকে তাকালো।পরক্ষনেই দিহান ভাই বলে জোরে চিৎকার করতে লাগলো।এতো অপমান সহ্য করে দিহান ফিরে আসবে তো।আল্লাহ!চিৎকার করতে করতে একসময় স্থির হয়ে গেলো রিনি।শান্ত একদম।চোখে মুখে ভাষা নেই। নির্বিকার মানুষ সে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here