নীলাঞ্জনা পর্ব -১৩

#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_১৩
#লেখনীতে_শুভ্রতা(প্রাণ)

আয়রা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে পিয়াল। পাশে দাঁড়িয়ে নয়ন আর নিহা। আনোয়ারা বেগমও আছেন সাথে। নওশাদ শেখ বোধহয় বাড়িতে নেই। এদের সকলের দিকে অবাক চেয়ে আছে নভ-নীল।

কিছুক্ষণ আগে গ্রামে এসে নওশাদ শেখের নাম বলে বলে এ বাড়িতে এসে পৌঁছে পিয়াল। বাড়িতে ঢুকে দেখে তার মায়ের বয়সি দুই মহিলা উঠোনে বসে গল্প করছেন। বারান্দায় কিছু একটা নিয়ে মারামারি করছে দুইটা ছেলে মেয়ে। একটু জড়তা নিয়েই তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় পিয়াল। বাড়ির লোকগুলো একটু অবাক হয়েই তাকায় তার দিকে।

আনোয়ারা বলেন
“কাকে চাও বাবা?”

পিয়াল একটু ইতস্তত করে বলে
“এটা কি নওশাদ শেখের বাড়ি?”

নিহা ফট করে বলে ওঠে
“আব্বা তো বাড়িতে নাই।”

পিয়াল আবারও বলে
“ওনার স্ত্রী আছেন?”

এগিয়ে আসেন আয়রা বেগম।
“হুম আমিই তার স্ত্রী। কি হয়েছে?”

পিয়ালের চোখে এসে ভিড় করে অজস্র অশ্রু কণা। ইনি ওর জন্মদাত্রি? নিজের মা? অস্ফুট স্বরে মা বলে ওঠে পিয়াল। এতক্ষণে আয়রা বেগমের খেয়াল হয় ছেলেটা দেখতে হুবহু তার ছেলে নয়নের মতো। বুকটা ধক করে ওঠে তার। আবারও পিয়াল আমার মা বলে উঠলে চমকান আয়রা বেগম। তাহলে কি তিনি যা ভাবছেন তাই সত্যি?

আনোয়ারা এগিয়ে এসে বলেন
“মা মানে? কে তুমি বাবা?”

কোনো ভনিতা ছাড়াই ধরা গলায় বলে পিয়াল
“আমি নওশাদ শেখের বড় ছেলে পিয়াল।”

আনোয়ারা, নয়ন, নিহা সবাই অবাক হয়ে তাকায়। বলে কি ছেলেটা? তারা তো জানে নওশাদ শেখের দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে নীল তো অন্য বাড়িতে। আর নয়ন, নিহা এখানে। তাহলে এ কে?

“মা তুমি আমাকে চিনতে পারছো না?”

কাঁদতে কাঁদতে বলা পিয়ালের কথায় আয়রা বেগম নিজেও ডুকরে ওঠেন। ওই নার্স তো বলেছিলো নয়ন এর জন্মের দিন যে সে আয়রা বেগমের বড় ছেলেকে এক বড়োলোক মহিলার হাতে তুলে দিয়ে নীলাঞ্জনাকে রেখেছিলেন। তাই তো নীলের প্রতি ক্ষোভ ছিলো আয়রার। তাহলে কি এই তার হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলে?

“তুমি কি সে যাকে ওই নার্স বদলে দিয়েছিলো নীল এর সাথে?”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে পিয়াল। আয়রা বেগম ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। বাকিরা চেয়ে রয় অবাক হয়ে। আবেগ সামলে অতঃপর সবাইকে সবটা খুলে বলেন আয়রা বেগম। আনোয়ারা তো বাকরুদ্ধ প্রায়। নয়ন, নিহাও অবাক। তখনই উপস্থিত হয় নীল আর নভ। তারপর জানতে পারে সব। ধীরে ধীরে সবাই ধাতস্ত করে নিজেকে।

পিয়াল আর নীল এই পরিবারে আপাতত নতুন হলেও নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে সবার সাথে। সবাই ভীষণ খুশি তাঁদের দুজনকে পেয়ে। বিশেষ করে নয়ন আর নিহা নীলকে পেয়ে প্রচন্ড খুশি। ছোট থেকে তারা নভ ভাইয়ার মুখে অনেক শুনেছে নীলময়ীর গল্প। বাকিরাও বলেছে তবে নভ বেশিই বলেছে একটু। সেই নীল আজ তাঁদের সামনে। দুইজন মেতে আছে পিয়াল আর নীলকে নিয়ে। নীলও বেশ হাসিখুশি ভাবেই আছে তাঁদের সাথে। পিয়াল প্রথম দিকে ইতস্তত করলেও পরে মানিয়ে নিয়েছে। এ যে তারই পরিবার। অপরদিকে নভ শুধু বসে বসে দেখে যাচ্ছে বাকিরা কি করে। আয়রা বেগম আর আনোয়ারা বেগম ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন ছেলে মেয়েদের জন্য রান্নাবান্না করতে। নয়ন, নিহা, পিয়াল, নীল গল্পে ব্যাস্ত। এমন মনে হচ্ছে নভ যেন এবাড়ির কেউই না।

“আপা আপা তুমি নাকি ছোটবেলায় নভ ভাইয়াকে নবু বলতে?”

কথাটা নয়ন হাসতে হাসতে বললেও বেজায় ক্ষেপে যায় নীল। বাকিরাও এ কথা শুনে বেশ জোরেই হেসে ওঠে। তা যেন নীলের রাগের জন্য আগুনে ঘি! রাগী চোখে তাকায় নভর দিকে। ছোটবেলায় কি করেছে না করেছে সেগুলো ছোটদের সামনে বলে তার মানসম্মানের ফালুদা বানাতে হবে কেন? নাহয় ছিলো নীল একটু তোতলা। তাই বলে এভাবে সবাই পঁচাবে? নীলের তাকানো দেখে নভ হাবলার মতো হাসে। যাব্বাবা! এভাবে তাকাচ্ছে কেনো? সে আবার কি করলো? সে জাস্ট গল্পই বলেছে! নীল তো শুধু সুযোগ খুঁজছে কখন নভকে একা পাবে। নীলাঞ্জনার মানসম্মান নিয়ে ফালুদা বানানো? দেখাবে তোমাকে মজা!

পিয়াল কোনো মতে হাসি কন্ট্রোল করে বলে ওঠে
“সত্যি নাকি রে নীল? তুই নভ ভাইকে নবু বলতি? লাইক সিরিয়াসলি? ভাইয়ের নামটা একেবারে খেয়ে দিলি বইন।”

পিয়ালের কথায় যেন নভর দল একটু ভারী হয়।
“তাই বলো ভাই পিয়াল। তোমার বোন আমার এত সুন্দর নামটা খেয়ে দিয়ে এখন কীভাবে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছে দেখো। এবার যেন চোখ দিয়েই আমাকে খেয়ে ফেলবে।”

নভর কথা শুনে নিহা অবাক হয়ে বলে
“মানুষ কীভাবে খায় ভাইয়া? তাও আবার চোখ দিয়ে!”

কপাল চাপড়ে নভ বলে
“এই হয়েছে আরেক পাকনা। নীলও ছোট থাকতে এভাবে আমার কথা ধরতো। বলি তোদের দুবোনের কি আমার কথা ধরা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই?”

নিহা গাল ফুলায়। কি এমন বললো সে যার জন্য এভাবে বলতে হবে। মানুষ কি খাওয়া যায় নাকি? জানতেই তো প্রশ্ন করলো। তাতেও দোষ। কিছু বলবেই না আর। এদিকে নীল দাঁতে দাঁত পিষে কিছু বিড়বিড় করতে করতে উঠে চলে গেলো। তা দেখে বাকিরা আরেক দফা হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। আনোয়ারা বেগম নভ আর পিয়ালকে ধমক দিয়ে বললেন

“দিলি তো দুই বাঁদর মিলে আমার মেয়েটাকে রাগিয়ে? পিয়াল নাহয় ছোট নভ কিন্তু তুই তো বড়। কখনো ভালো হবি না তাই না?”

নভ অবাক হয় নিজের মায়ের কথায়। পিয়াল ছোট? ১৮-১৯ বছর বয়সি ছেলেকে কোন দিক দিয়ে ছোট লাগে? ভ্রু কুঁচকে পিয়ালের দিকে তাকায় নভ। কোনো ভাবে যদি তার চোখেও পিয়ালকে ছোট মনে হয়। কিন্তু কই সে তো এমন কিছু দেখছে না! নভর এভাবে তাকানো দেখে চোখ মারে পিয়াল। তা দেখে চোখ রাঙায় নভ। এরমধ্যে আয়রা বেগম বলেন

“তোমার মেয়েরই বা এত রাগ কোত্থেকে আসে আপা? আমার ছেলে কি এমন বলেছে! তোমার মামনি তো আমার নভকে নবুই বলতো।”

সকলে আবার মেতে উঠলো যার যার কাজে। পিয়াল তো নয়ন আর নিহার সাথে এমন ভাবে মিশে গেছে যেন ছোট থেকেই এদের সাথে বড় হয়েছে সে। কোনো জড়তা নেই, আছে কেবল নিজের ভাইবোনকে কাছে পাওয়ার এক টুকরো সুখ। সবাই আছে, কেবল নীলই নেই। তা খেয়াল হতেই উঠে চলে গেলো নভও।

রাগ করে সকলের মধ্যে থেকে উঠে ছাদে এসে দাঁড়ালেও পরোক্ষণে হেসে ওঠে নীল। এরকম ছোট ছোট আনন্দ দিয়ে জীবনের প্রতিটা দিন রাঙানো গেলে মন্দ হয় না। আবার খারাপ লাগে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অতীতের ঘটনা গুলো ভাবলে। নীলের ভাবনার মাঝে অনুভূত হয় তার পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ঘুরে দেখে নভ। তাকে দেখে দমে যাওয়া অভিমান গুলো আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তার হবু স্বামী তাকে সবার সামনে তোতলা বললো। এর জন্য মোটেও ছেড়ে দেবে না নীল নভকে। কথাই বলবে না, হুহ। মুখ ঘুরিয়ে নেয় নীল।

নীলকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে দেখে নভ বলে
“কিরে বিচ্ছু ভ্যাবলার মতো মুখ বাঁকাস কেনো?”

তেতে ওঠে নীল। সে ভ্যাবলা? এত বড় কথা!
“এই এই মুখ সামলে কথা বলুন। ভ্যাবলা কি হ্যাঁ? আমাকে কোন দিক দিয়ে ভ্যাবলা মনে হয় আপনার?”

নীলের অগোচরে হাসে নভ। এখনো ছোটবেলার মতোই আছে তার নীলময়ী।
“ভ্যাবলা না তো কি? আয়নায় দেখেছিস কখনো নিজের সবজিচুন্নির মতো মুখ?”

ভ্যাবাচ্যাকা খায় নীল। সবজিচুন্নি আবার কি? শাকচুন্নি হয় বলে শুনেছে সে কিন্তু এটা কি বললো নভ? তাহলে কি নীল যথেষ্ট সুন্দর নয় যার জন্য নভ তাকে এভাবে বললো! ছলছল করে ওঠে নীলের চোখ।

অভিমানী সুরে বলে
“তাহলে আমাকে বিয়ে করছেন কেনো?”

আরেকটু রাগাতে নভ বলে
“সে তো রওনক স্যারের কথা ফেলতে পারিনি তাই। নইলে এই নভ সওদাগর তোর মতো সবজিচুন্নি বিয়ে করে?”

“ঠিক আছে। আমি বাবাইকে বলে দিচ্ছি কল করে। আমাকে বিয়ে করতে হবে না আপনার।”

কথাটা বলেই নিজের ফোনে বাবাই এর নাম্বার বের করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে নীল। যার ওকে পছন্দ নয় জোর করে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কোনো মানে হয় না। বাবাইকে নাহয় সে নিজে বুঝিয়ে বলবে। তার জন্য একটা ছেলের লাইফে অশান্তি আনবে কেনো সে? নীলকে সিরিয়াস দেখে নভ বুঝতে পারে একটু বেশিই মজা করে ফেলেছে সে। এতটা উচিত হয়নি। নীলময়ী যে তার বড্ড অভিমানী। ঠিক যেমন ছোট বেলায় ঠোঁট ফুলাতো এখনও তেমনি করে রেখেছে ঠোঁট দুটো। নিশ্চয়ই তাকে পাগল করার ধান্দা এই মেয়ের। আর কিছু না ভেবে নীলকে নিজের কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে নভ।

অফিসের কোনো একটা কাজের জন্য ইমিডিয়েটলি অভ্রকে দেশের বাইরে যেতে হবে। কত দিন লাগবে তা বলা যাচ্ছে না। খুব সম্ভবত বোনদের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবে না সে। একথা শোনার পর রওনক সাহেব, রেহমান সাহেব উভয়ই বারণ করেছে তাকে যেতে। কিন্তু সে জানিয়েছে এটা তার ক্যারিয়ারের প্রশ্ন। কোনো কম্প্রোমাইস এখানে মানায় না। সেই থেকে অভ্রর সাথে তার বাবাই এবং বাবা কেউই কথা বলছে না। একমাত্র ছোট ভাই বিয়েতে থাকবে না শুনে রেহানাও কম ঝামেলা করেনি। বোনের থেকে কি চাকরি বড় হয়ে গেলো? এত কিছুর পরেও অভ্রকে টলানো যায়নি। সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। আয়শা বেগম বুঝতে পারছেন না কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবেন। অভ্র গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে। রাতে ফ্লাইট হলেও বিকেলের মধ্যেই সে অফিসে চলে যাবে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তারপর রওনা হবে। আয়শা বেগম সন্ধ্যা অবধি থেকে নীলকে বলে যেতে বললেও শোনে না অভ্র। তার যে সে সাহস নেই! এদিকে বাকিরা ভাবছে বাড়ি ফিরে নিজের অভ্রদাকে না দেখে না জানি নীল কি তুলকালাম করে।

হঠাৎ করে নভ জড়িয়ে ধরায় হকচকিয়ে যায় নীল। পাপাই, বাবাই আর অভ্রদা ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সান্নিধ্যে এখনো পর্যন্ত যাওয়া হয়নি তার। পিয়ালকে ভাইয়ের মতো দেখলেও তারও বেশি নিকটে যায়নি সে। এই মুহূর্তে হঠাৎ নভ জড়িয়ে ধরাতে যেন বরফের ন্যায় জমে গেছে সে। নভকে যে ছাড়তে বলবে তাও পারছে না। থেকে থেকে যেন কেঁপে উঠছে সারা শরীর। এদিকে নভ অত্যাধিক মজা পাচ্ছে নীলের এমন ভীতু রূপ দেখে। হবু স্বামী জড়িয়ে ধরেছে তাতেই এমন করে কাঁপছে মেয়েটা যেন অচেনা কেউ। প্রশস্ত হয় নভর অধর যুগল।

অস্ফুট স্বরে নীল বলে ওঠে
“ছাড়ুন আমাকে। আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরার অধিকার কে দিলো আপনাকে?”

নীলের কথায় হেসে ওঠে নভ।
“তুই পুরোটাই তো আমার। তাহলে জড়িয়ে ধরবো নাকি খেয়ে ফেলবো সে অধিকার অন্য কেউ দিতে যাবে কেনো?”

নীল খানিকটা লজ্জাই পায়। খেয়ে ফেলবে মানে কি? এভাবে কেউ বলে? ভারী বজ্জাত লোক তো। নীলকে লজ্জা পেতে দেখে নভ আবারও বলে ওঠে
“কিরে নীলময়ী আর কিছু জানতে চাস নাকি?”

চলবে…?

[আস্সালামুআলাইকুম। কেমন আছেন সবাই?আগে কিছুটা লেখা থাকায় বাকিটা কষ্ট করে লিখে দিলাম আজ তবে কাল কি করবো জানিনা। ভাগ্য প্রসন্ন হলে তো সুস্থ হলাম আর না হলে দেখা যাক কি হয়। ধন্যবাদ🖤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here