নীল দিগন্তে পর্ব ১২

#নীল_দিগন্তে
পর্ব- ১২
লেখা- নীলাদ্রি নীরা

রাজীব বলেছিলো তার ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে পার্সোনাল কোনো ফোন বা ল্যাপটপ ইউজ করার পারমিশন নেই। অথচ ট্রেনিং শুরু হওয়ার দিনই রাত একটায় পুষ্পকে ফোন করলো সে। পুষ্প নামটা বারবার চেক করলো। ওর মনে হচ্ছে কলটা ওর কল্পনা মাত্র। রাজীব অন কোর্সে থাকাকালীন সময়ে ফোন করার প্রশ্নই আসে না। হতেও পারে অন্যকেউ ফোন করছে আর পুষ্প ভাবছে রাজীব। পুষ্প রিসিভ করলো না। কলটা কেটে গেলো। পরক্ষনেই আবার কল এলো। পুষ্প আবার রিসিভ করলো না। যদি রিসিভ করে দেখে অন্য কেউ? এতবড় ধোকাটা সে খেতে চায় না! কিন্তু টেনশন আর অস্থিরতায় থাকতে না পেরে কলটা রিসিভ করেই ফেললো পুষ্প। মনে মনে চাইলো রাজীবই যেন হয়। আর আমতা আমতা করে বলল,
-“হ্যালো”
রাজীব বলল,
-” শুকরিয়া। মহারানীর কল ধরার মর্জি হলো!”
পুষ্পর প্রাণ ফিরে এলো। দ্যাট মীনস রাজীবই। উফফ… এতো অস্থির হলে চলে! রাজীবের প্রতিও রাগ হলো পুষ্প। একবার রিসিভ না হতেই ডিরেক্ট খোঁচা! হুহ
-” তুমিই তো বলেছিলে অন কোর্সে পার্সোনাল ফোন এলাও না!”
রাজীব নিজের মাথায় নিজেই ঠুকা দিলো। এরপর কি বলবে গুছিয়ে নিলো সে। তারপর বলল,
-“হুম বলেছিলামই তো”
-” তাহলে এখন ফোন করেছো কিভাবে? ”
-” হুম তবে এতটাও হার্ড না। বউদের জন্য একটু ফেসিলিটি আছে। আফটার অল সব পুরুষরাই বউ পাগলা। নাহলে শেষে দেখা যাবে ট্রেনিং ঠিকঠাক করতে পারছে না। তাতে আরও প্রশাসনের লস। সেজন্যই বউদের সাথে কন্টাক্ট করার জন্য একটু স্পেশাল ফেসিলিটি রেখেছে।”
পুষ্প আলতো করে হাসলো। তারপর বলল,
-” আর যাদের বউ নেই?”
-” গার্লফ্রেন্ড নিশ্চয়ই আছে। না থাকলেও সমস্যা কি যাস্ট ফ্রেন্ড দিয়ে কাজ হয়ে যাবে। ”
-” ভালোই তাহলে ”
-” হুম দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো আরকি। ”
-” মানে কিভাবে! ”
-” কিছু না। সংঘটনে যাচ্ছিস? কয়েকদিন তো যাসনি।”
-” না যাইনি।”
-” কেনো?”
-” চাচী যেতে দেয়নি। মাত্র অসুস্থ থেকে উঠলাম তাই।”
-” গুড। ঘুমোস নি কেন? কি করছিলি?”
পুষ্পর ইচ্ছে হচ্ছে বলতে তোমাকে মিস করছিলাম। কিন্তু বলল না। মুখে বলল,
-” এইতো ঘুমাবো বলে বেডে আসছিলাম”
-” ওহ”
-” তুমি ঘুমাচ্ছ না কেন?”
-” বউ ছাড়া ঘুম আসে না”
পুষ্প লজ্জা পেলো। একটা ছেলে এত অসভ্য হয় কিভাবে? রাজীব বলল,
-” একটা গল্প শুনবি পুষ্প? রাজা রানীর গল্প।”
পুষ্প যেন লাফিয়ে উঠলো। দ্রুত বলল,
-” হ্যা শুনবো!”
রাজীব একটু জিরিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো,
-” একদেশে ছিলো এক অভাগা রাজা, আর এক কঠোর রাণী। রাণীটা শুধু রাজার সাথেই কঠোর ছিল। রাজাকে ভালোবাসতো না, রাজার কাছে আসতো না, আদর করত না। এমনকি রাজা আদর করতে চাইলে কান্না শুরু করে দিত। শুধু দূরে দূরে থাকতো। তবে রাণী অনেক দয়ালু ছিলো। রাজ্যের সব মেয়েদের নিয়ে সে কাজ করতো। সারাক্ষণ সে তাদের নিয়েই থাকতো। আর অভাগা রাজা দুঃখে কষ্টে দিন কাটাতো। মনের দুঃখে সে ছয়মাসের জন্য রাজকার্যে বনবাসে চলে গেলো। রাণীহীনা রাজা মোটেও ভালো ছিলো না। কিন্তু দুষ্ট রাণীটা সবসময় পেত্নী সেজে তাকে তাড়া করে বেড়াতো। তবু রাজার এটাকে খুবই ভালো লাগতো। কারণ রাজা তার রাণীকে খুব ভালোবাসে তো।”
রাজীব থামলো। আর তখনই পুষ্প বলল,
-” রাজাও কম দুষ্ট ছিলো না। রাণীকে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছিল সে। অনেক কথা শুনিয়েছে। সেই কষ্টে রাণী ধুকে ধুকে মরেছে। সেটা কি রাজা ভেবেছে? ভেবেছে তো শুধুই নিজের দিকটাই!”
এতটুকু বলেই পুষ্প খুব শান্তি পেলো। গল্পর নাম করে তাকে খোঁচা দেয়া একদম চলবে না। হুহ রাজীব শান্তস্বরে বলল,
-” আমার গল্প শেষ হয় নি পুষ্প!”
পুষ্প জিভ কাটলো। পুরোটা না শুনে লাগামছাড়ার মতো এটা কি বলে ফেলল! ইশ!
পুষ্প সরি বলল। রাজীব আবার বলতে লাগলো,
-” রাজা রাণীর মধ্যে সব ঠিক না থাকলেও রাজা রাণী দুজন দুজনকেই ভীষণ ভালোবাসতো। আর রাণী লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু কাঁদত। কিন্তু সেটা রাজা ঠিকই বুঝতে পারতো। রাজা খুব করে চাইতো রাণী যেন সব সময় হাসিখুশি থাকে, রাণীর জীবনের সব দুঃখ কষ্ট ঘুচে যাক। রাজাকে নিয়ে রাণী খুব সুখী হোক। রাণীর জীবনে সুখের বন্যা নেমে আসুক। যাইহোক, তাদের এই ভালোবাসার মধ্যে আসলো তৃতীয় পক্ষ। রাজ্যের একদল কুটনীতিবিদ গুপ্তচর রাজা রাণীর এই সম্পর্কটা মানতে পারছিলো না। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে রাজাকে ইনিয়ে বিনিয়ে রাণী চরিত্র সম্পর্কে মিথ্যে বদনাম করল। রাজার পূর্ব শত্রু হলেও গুপ্তচররা আবার রাণীর বিশ্বস্ত লোক ছিল। রাণীর সম্পর্কে এমন কিছু শুনে রাজা ঠিক থাকতে পারলো না। শুরু হয়ে গেলো রাজা রাণীর মধ্যে ঝামেলা। রাণীটা খুব বোকা আর বদমেজাজি ছিলো। তবে বিয়ের পর রাণী মেজাজ দেখানো কমিয়ে দিয়েছিল। তাই সে চুপ করে রইল। রাজার তাতে আরও অভিমান হলো। রাণী এত বোকা কেন? কেন সে এর প্রতিবাদ করে নি? এত ছাড় দিবে কেন রাণী? রাণী কেন নিজেকে গুপ্তচরদের থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে না? ভবিষ্যৎ এ যে এর থেকে ভয়াবহ কিছু গুপ্তচরেরা ঘটাতে পারে সেটা কেন বোকা রাণী বুঝে না? কেন সাবধান হয় না?”

রাজীব থামলো। তার বলা শেষ। পুষ্প চুপ। দুজনেই চুপ। পুষ্প কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এত কেন কষ্ট হচ্ছে? ইচ্ছে হচ্ছে সব লজ্জা, অভিমান, দ্বিধা ছুড়ে ফেলে এক্ষুণি ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে রাজীবের বুকে। এই মানুষটা এত কেন বুঝে তাকে? পুষ্প তো তাকে বুঝতে পারে না। পুষ্পর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রেখেছে সে। নিরবতা ভেঙে রাজীব বলল,
-” পুষ্প”
-” হুম”
-” ইটস অলমোস্ট টু এ এম। ঘুমিয়ে পড়।”
পুষ্প এবার কান্না শুরু করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” অ্যাম সরি। ”
রাজীব রাগ দেখিয়ে বলল,
-” একদম কাঁদবি না। স্টপ দিস। নাহলে কিন্তু আমি ট্রেনিং ছেড়ে চলে আসব মাইন্ড ইট।”
পুষ্প কাঁদছেই। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গিয়েছে। রাজীব রাগটা কন্ট্রোল করে বলল,
-” পুষ্প প্লিজ। আমার সত্যি ভালো লাগছে না। ”
পুষ্প কান্না থামালো ক্ষনিকের জন্য। চোখমুখ মুছে বলল,
-” ঘুমাও”
তারপর আবার নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। চোখের জল গুলো যেন বাঁধ মানতে চাচ্ছে না। রাজীব নিশ্চুপ। ফোন রাখলো না কেউই। দুজনেই কানের কাছে নিয়ে বসে আছে। পুষ্প শুনছে রাজীবের নিঃশ্বাস। রাজীব শুনছে পুষ্পের নীরব কান্নার আর্তনাদ।
.

পুষ্পকে দেখে নওশিন চিৎকার করে বলল,
-” ইয়াল্লাহ পুশ! নিজের এই কি অবস্থা করেছিস তুই? এমনিতেই স্টিক ছিলি এখন তো মনে হচ্ছে স্টিচ। ”
পুষ্প বলল,
-” তোর মতো ড্রাম হওয়ার শখ নেই আমার। জিরো ফিগারই বেস্ট।”
নওশীন ভ্যাংচি কেটে বলল,
-” হুহ। আসছে আমার জিরো ফিগার। বর বলেছিল বুঝি? হুউহুহু। ইতিহাসে এই প্রথম দেখলাম কোনো মেয়ে বরের শোকে কাতর হয়ে জ্বর টর ও বাধিয়ে ফেলে।”
পুষ্প কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,
-” মানে কি নশ?”
নওশিন পুষ্পকে বিকৃত করে বলল,
– “মানে কি নশ.. হুহ,, বুঝ না? ফিডার খাও? কি ভেবেছ চুপিচুপি বিয়ে করবে, তারপর আবার প্রেম করবে, তারপর ছ্যাঁকা খাবে, তারপর বিরহের গান গাইবে আর আমাদের জানাবে না? আরে ছাগলী তুই যে তোর বর ট্রেনিং এ চলে গেছে তার সাথে কথা হবে না এই টেনশনে আধমরা হয়ে গিয়েছিস তা আমরা সবাই জানি রে। ভাগ শালি। তোর সাথে কথা নেই বেঈমান ”
-” আশ্চর্য এসব তোকে কে বলেছে? ”
-” কেন? তাকে মারবি নাকি আবার?”
-” মিথ্যে যেহেতু বলেছে মারবোই তো!”
-” বোন কি বোনের সম্পর্কে মিথ্যে বলে? ন্যাকামি ছাড় পুষ্প। আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি। খারাপ ও লেগেছে তুই আমাকে ও জানাস নি। এতটা পর ভাবিস বুঝতেই পারিনি।”
-” উম্ম রাত্রি বলেছে। আরে ইয়ার এসবের কিচ্ছু না। রাত্রিটা যে কি বলে! আমার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে। তুই তো জানিস বৃষ্টির পানি আমার স্যুট করে না। আর বিয়ের কথা জানাবার স্কোপই পাই নি। বিলিভ মি নশ। আমি তোকে কি বলতাম? একটা সম্পর্ক যার কোনো ঠিক ঠিকানা কিছুই ছিল না।”
-” ছিল না? এখন আছে?”
পুষ্প মুচকি হাসলো। তা দেখে নওশিন বলল,
-” ওয়াও গ্রেট! তোর যে যে চেঞ্জ হয়েছে সেগুলো বলব পুশ?”
পুষ্প হেসে বলল,
-” ধুরর”
-” আরে শোন শোন। অনেকগুলো চেঞ্জ হয়েছে তোর। যেমন এক. তুই আগে যেকোনো কিছুতে ফট করে রেগে যেতিস। এই যে আমি তোকে বেঈমান বললাম। এটা আগে হলে তুই কঠিন স্বরে বলতিস, হ্যা আমি বেঈমানই। কিন্তু এখন কোনো রিয়্যাকশন নেই। আবার এই যে এখন কি সুন্দর করে বারবার হাসছিস। এটা তো তোর নিউ স্টাইল। আগে ও হাসতিস তবে সেই হাসিটা হত মলিন হাসি। কিন্তু এটা কিসের হাসি রে?”
পুষ্প মুখটা গোমড়া করে বলল,
-” আর হাসব না যা। ওরা কই?”
নওশিন মুখটা কালো করে বলল,
-” তুই বিয়ে করেছিস শুনে আলিফ সংঘটন ছেড়েছে। লিখিত নোটিশ দিয়ে গেছে। আলিফের লেজ ধরে রুমাও পালিয়েছে। শয়তানের দল। আলিফটা সংঘটনে এসেইছিলো তোর কাছাকাছি থাকার জন্য। এখন ভেগেছে। ছ্যাছড়া কোথাকার।”
পুষ্প চুপ। এক তরফা কি ভালোবাসা হয়? সব সম্পর্কের পিছনেই কেন স্বার্থটা নিহিত থাকে? মানবসেবা করতে ইচ্ছা পোষনের ভিতরেও কেন এরা স্বার্থটাকে টানে। ছিহ…..
.
রাত্রি যা ভেবেছিল তাই হয়েছে। ওদের ভিসা হয় নি। উল্টো রাত্রিকে পুলিশ এলার্ট করে দিয়েছে যে ওরা কেউ দেশের বাহিরে যেতে পারবে না। ওরা যেই ফেমিলিতে আছে তারাও না। শুধুমাত্র সদ্য বিসিএস ক্যাডার হওয়া তানজিম আহসান অফিসিয়াল কোনো কাজে দেশের বাহিরে যেতে পারবে। রাত্রি যাস্ট অবাক। পুলিশ ওদের চোখেচোখে রেখেছে! ইনফ্যাক্ট পুরো মামার ফ্যামিলিকেও! ওহ মাই গড..

ব্যাপারটা আবার ঠিকই নিউজে ছাপা হলো,
যার হেডলাইনঃ “দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়লেন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ভূমি কর্মকর্তার স্ত্রী কন্যা”
বিস্তারিতঃ আত্মগোপনে থাকা দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত ভুমি কর্মকর্তা নাসির হোসেনের স্ত্রী, কন্যা দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। ইউএস বাংলা এম্বেসী থেকে পুলিশকে ইনফর্ম করা হলে পুলিশ তাদের পাসপোর্ট থানায় জব্দ করে রেখেছে। কেউ কেউ বলছেন নাসির হোসেনের খবর উনার স্ত্রী কন্যা জানেন। এজন্যই তারা পালাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে উনারা কিছুতেই স্বীকার করছেন না। স্থানীয় সুত্রে জানা যায়…… ”

সৌরভ সিগারেটের আগুনেই পেপারটা পুড়ালো। তার আগে রিপোর্টার এর নামটা দেখলো । নিউজটা কে লিখেছে? পাবলিকের এটেনশন পাওয়ার জন্য অধিকাংশই বানিয়ে লিখেছে। সৌরভ বসা থেকে উঠে দাড়ালো। রাত্রিকে একটা চরম শিক্ষা দিতে হবে। সে ছুটে গেলো ব্যারিস্টার মশিউর রহমান এর বাসার উদ্দেশ্যে। কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিল রাত্রি। দরজার বাহিরে দাড়ানো সৌরভকে দেখেই ধপাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। শিওর হওয়ার জন্য ম্যাজিক আইয়ে চোখ বুলালো। ইটস সৌরভ! ওহ মাই গড! বিপদের আঁচ পেয়ে রাত্রি দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। সৌরভ যাস্ট হতভম্ব! রাত্রিকে শিক্ষা তো সে দিবেই। খুব সাহস বেড়েছে মেয়ের। আবারও কলিংবেল চাপলো সে। শারমিন দরজা খুলে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
-“কে? কাকে চাই?”

সৌরভ ভাবছে কি বলবে। সে কে? কাকে চায়?

চলবে……..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here