নীল দিগন্তে পর্ব ১১

#নীল_দিগন্তে
পর্ব-১১
লেখা- নীলাদ্রি নীরা

রাজীব একরাশ মন খারাপ নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। যাওয়ার আগে অন্তত ভেবেছিল পুষ্পর সাথে একটু আধটু কথা বলবে। কিন্তু পুষ্প ঘুমের মধ্যেই আছে। এত ঘুম কোথা থেকে এলো ওর? সারাজীবন কি না ঘুমিয়েই কাটিয়েছে যে এখন ঘুমিয়ে অভাব পূরণ করছে? যত্তসব..
এর মাঝে সকালে রাজশাহীতে পৌঁছে মায়ের সাথে কথা বলার পর পুষ্পকে ফোন করেছিল রাজীব। ফোন ধরেছে রাত্রি। পুষ্পর ফোন রাত্রি কেন ধরছে? রাজীব কি বলবে না বলবে বুঝতে না পেরে রেখে দিল। দুপুরের দিকে যখন দিলো তখনও সেইম ঘটনা। রাজীব রাত্রিকে বারবার রিকুয়েস্ট করে বলল, পুষ্পর খবর জানাতে। মেয়েটা কি সুস্থ হলো? নাকি এখনও ঘুমাচ্ছেই। কিন্তু রাত্রি কিচ্ছুই বলছে না। রাজীব ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলেছিল, মায়ের কাছ থেকেই জানবে সে।
রাত্রি ফোন রেখে খুব হাসছিল। দুইজনকে মাইনকা চিপায় ফেলবে সে। মিস করা কাকে বলে এবার পুষ্প ও বুঝবে। বুঝবে কিভাবে বিরহের গান গাইতে হয়।
.
পুষ্পকে দেখে আরেকবার হতাশ হলেন সোহেলী খাতুন। মেয়েটা এতটা ক্লান্ত। জ্বরে চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুষ্পর কাছ থেকে সরে আসলেন তিনি। বড় ছেলে ছয় মাসের ট্রেনিং এ যাচ্ছে অন কোর্সে কোনো যোগাযোগই করা যাবে না, বড় ছেলের বউ ও অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, ছোট ছেলেটা বিয়ে করে লাপাত্তা। সবকিছু মিলিয়ে এক ধরনের পীড়ার মধ্যেই আছেন সোহেলী। সংসার টংসার আর উনার ভালো লাগছে না। এদিকে মশিউর রহমান রাহাতের জন্য থানায় মিসিং জিডি করেছেন। সারাদিন খিটখিট করে বলছেন, “বলদটাকে একবার পেলে মেরে পাছার চামড়া তুলে ছাড়বো। বাপ মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলা শেখাবো আমি। বেয়াড়া হয়েছে।”
.
পুষ্পর ঘুম কাটলো রাজীব রাজশাহী যাওয়ার পরেরদিন সন্ধায়। তাও পুরোপুরি কাটে নি। চারদিনের জ্বরে একদম কাবু হয়ে গেল সে। পুষ্প বিছানা ছেড়ে উঠেই সিদ্ধান্ত নিলো খুব ঝাল কিছু একটা বানিয়ে খাবে তারপর কড়া এক কাপ চা খাবে। ঘুমের জন্যে তাকাতেও পারছে না সে। শারমিন পুষ্পকে রান্নাঘরে দেখে চিৎকার করে বলল,
-” ও আফা গো। আপনে এতদিন পর ঘুম থাইক্কা উঠলেন। কত কি যে হইয়া গেসে গো আফা।”
পুষ্প হাই তুলতে তুলতে বলল,
-” কি হয়েছে? ”
শারমিন ফিসফিস করে বলল,
-” খালু ছুডু ভাইজানের উপরে কেইস কইরা দিছে। কেমইন্না বাপ দেখছেন? এইডারেই কয় উকিল জাত। হেরা বাপ ভাইরেও ফাসাইতে ছাড় দেয় না। আর বড় ভাইজান তো….”
পুষ্প ধমকে বলল,
-” ফাউ কথা বলো না তো শারমিন আপা। কি শুনো তুমি আর কি বুঝ আল্লাহ মালুম।”
-” সত্য কথার ভাত নাই, দুয়ারে দিয়া ও পথ নাই। দুনিয়াত আর ভালা মানুষ নাই গো আল্লাহ। সত্য কথা কেউ বিশ্বাস করে না।”
পুষ্প রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো। শারমিন যতক্ষণ থাকবে আজাইরা বকবক করতে করতে মাথা খারাপ করে দিবে। ক্ষুধায় পেট চোঁচোঁ করছে পুষ্পর। পুষ্প সিদ্ধান্ত নিলো, শারমিন আপাকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিয়েই দরজাটা বন্ধ করে দিবে সে।
.
পুষ্প ঘড়ি দেখলো। রাত সাড়ে দশটা বাজলো রাজীব এখনও ফেরে নি। পুষ্প ভাবলো রাত্রির সাথে কিছুক্ষণ গল্পটল্প করবে। কিন্তু রাত্রি রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। পুষ্প ডাকে নি আর। চলে গেল সোহেলী খাতুনের রুমে। উঁকি দিতেই দেখলো চাচী টিভিতে নিউজ দেখছেন। পুষ্প খাটের এক পাশে বসলো। সোহেলী খাতুন বললেন,
-” মাথা ধরা কমেছে? ”
পুষ্প বলল,
-” হ্যা। চাচা বাসায় নেই?”
-” চেম্বারে গেল। থানার অফিসার এসেছে।”
-” ওহ”
-” তোর চাচা থানায় মিসিং ডায়েরি করেছিল। অফিসারটা আশ্বাস দিতে দিতে মুখ তেতো করে ফেলছে। দুই চারটা কথা যদি আমি শুনিয়ে দিতে পারতাম মনটা শান্তি হতো। রাহাতের খোঁজ খবর নেই পুরো দেড় মাস হতে চলল। ছেলেটার জন্য ভালো লাগে না কিছুই।”
-” ফুফুদের বাসা থেকে কোথায় গিয়েছে সেটা ফুফুদের বলে যায় নি?”
-” না।”
পুষ্প কিছু বলল না। সোহেলী খাতুন বললেন,
-” আচার খাবি? তোর জন্য সাতকড়া, আর জলপাইয়ের আচার আনিয়েছি রাজীবের সুলতানা খালার বাড়ি থেকে। সুলতানা আচার বানানোতে উস্তাদ। এইদিকে রাত্রি সব আচার শেষ করে দিচ্ছে। চার বৈয়মের একটা অলরেডি একদিনেই সাবাড় করে ফেলেছে। কেমন রাক্ষস মেয়ে! বিকেলে আচারের বৈয়ম নিয়েই গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন গেল। কিচ্ছু ঠিক নেই মেয়ের।”
পুষ্প ভ্রু কুচকে বলল,
-” আমার জন্যে আনিয়েছ কেন?”
সোহেলী খাতুনের ইচ্ছে হল পুষ্পর মুখে পিঠে ঢুকিয়ে বসিয়ে রাখতে। বেকুব মেয়ে বসে বসে পিঠে খা। বুদ্ধিসুদ্ধি তো নেই কি আর করবি? সোহেলী বললেন,
-” এমনি। দরকার তো হতেই পারে। আর জ্বর সেরে উঠেছিস সবে রুচি মরে গেছে নিশ্চয়ই। সেজন্যই আনালাম।”
-” ও”
পুষ্প নিউজ চ্যানেলে সময় দেখলো। প্রায় এগারোটা। এখনও আসছে না কেন? আশ্চর্য! বাহিরে এত কি আছে হুহ! পুষ্পকে হাসফাস করতে দেখে সোহেলী বললেন,
-” কিছু বলবা আম্মা?”
পুষ্প বলল,
-” ভাইয়া কি কোথাও গিয়েছে চাচী? ”
সোহেলী খাতুন ভ্রু কুচকে বললেন,
-” ভাইয়াটা আবার কে?”
পুষ্প পুরো ভড়কে গেল। কি বলবে! রাজীবকে তো সে ভাইয়াই ডাকে। আমতা আমতা করে বলল,
-” তোমার বড় ছেলে ”
-” সে তোর ভাই হবে কেন?”
পুষ্প চুপ। কি বলবে ও? রাজীবকে তো সে ভাইয়াই ডাকে। এটা শুনে আবার চাচী না কথা শুনিয়ে দেয়।
-” এই তোরা কি ঢং করছিস রে। যত্তসব! এটা কোন ধরনের ফাজলামি। থাপড়ে সব কয়টা দাত ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীতে কোন বউ বরকে ভাইয়া ডাকে হ্যা? আশ্চর্য তো! আর গাধাটা কি এখনও তোকে তুই তুই করে কথা বলে? ”
পুষ্প হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। সোহেলী খাতুনের মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছে। দু’টোকেই ধরে একসাথে শাস্তি দেয়া উচিত ছিল উনার।
-” গাধার বাচ্চা গাধা। বউকে তুই তুই করে। আর বউ ভাইয়া ভাইয়া করে। যত্তসব বদমাইশের দল। আর তুই কেমন বউ হ্যা? ছেলেটার কোনো খোঁজ খবর নিস না? মানলাম অসুস্থ ছিলি। এখন তো নিজেই ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারতিস ছেলেটা পৌছালো কি না? পারতিস না?”
পুষ্প বলল,
-” আমার ফোনটা তো পাচ্ছি না।”
-” ফোন কি হাওয়া হয়ে গিয়েছে? কোথাও পড়েছে আরকি। খুজে দেখেছিস কি?”
-” খুজেছি তো। ধমকাচ্ছো কেন চাচী। তোমরা না বললে আমি কি করে জানব সে কোথায়? আমার ফোন যেহেতু পাচ্ছি না সেহেতু আমি কিভাবে খুজ নিব?”
সোহেলী খাতুন বললেন,
-” ওরে মাথামোটা মেয়ে। নে অন্তত আমার ফোনটাই নে। সে রাজশাহীতে চলে গিয়েছে। কাল সকাল থেকে তার ট্রেনিং শুরু। শেষবারের মতো কথা বলে নে। যা ”
পুষ্প বসেই রইল। সোহেলী খাতুন বললেন,
-” ঢং করিস না পুষ্প যা এখান থেকে ”
পুষ্প ভ্যাংচিয়ে সোহেলী খাতুনের ফোন নিয়ে বেরিয়ে আসলো। সুযোগ বুঝে চাচী ও এভাবে কথা শুনিয়ে দিলো? হুহ…
পুষ্প নিজের রুমে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো সে রাজীবকে ফোন দিবে না। কেন দিবে? এই ছেলে পুষ্পর চরিত্র নিয়ে কথা তুলেছে। সে কিভাবে ওইদিন ওসব বলতে পারলো? আশ্চর্য একটা মানুষ। পুষ্পর ওইসব ভাবনার মধ্যেই রাজীব ফোন করলো। পুষ্প ফোন হাতে নিয়ে ভাবছে ধরবে কি ধরবে না। কি আর কথাই বলবে? ওই তো বলবে তুই ছেলে ফ্রেন্ডসদের ডলাডলি করিস, রেস্টুরেন্টে যাস। কি নোংরা মানসিকতা!রাজীব নিশ্চয়ই জানেনা যে তার মায়ের ফোন পুষ্পর হাতে? পুষ্প ফোন রিসিভ করলো তবে কিছুই বলল না। ওপাশ থেকে রাজীব বলল,
-” হ্যালো মা”
পুষ্প চুপ। কোনো রেসপন্স না পেয়ে রাজীব হ্যালো হ্যালো করতেই আছে। পুষ্প কল কেটে দিল। মনের মধ্যে এত ধুকপুক ধুকপুক করছে কেন? উফফ…
রাজীব ভাবলো, আশ্চর্য মা কথা বলল না কেন? নেটওয়ার্ক প্রবলেম নাকি? নাকি রাত্রি মায়ের ফোনটাও হাবিশ করে ফেলেছে। আবার ট্রাই করল রাজীব। পুষ্পর ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেল। কলটা কোনো মতে রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরল সে। রাজীব পুরো বিরক্ত।
-” মা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো…”
-” আমি মা না।”
রাজীব কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। রাত্রি না এটা। ভয়ংকর ফুল।
রাজীব বলল,
-” ওহ ম্যাডাম আপনি তাহলে। তা এটা কোন ধরনের ফাজলামি ছিল?”
-” কোনটা?”
-” এই যে ফোন রিসিভ করে কথা না বলা।”
পুষ্প চুপ। কি বলবে সে? এত অস্থির লাগে কেন? রাজীব নিঃশব্দে হাসলো।
-” শরীর কেমন এখন? জ্বর কমেছে? ”
-” হু”
-” ডিনার করেছিস? আর মেডিসিন?”
-“হু”
-” পুষ্প!”
-” হু”
রাজীব পুরোপুরি বিরক্ত। একটা মেয়ে এত ফিলিংলেস হয় কিভাবে? এত ইগনোর করে কিভাবে এই মেয়ে? একবারও কি ওর জানতে ইচ্ছে হয় না আমি কেমন আছি, কি করছি? ওর লাইফে কেউ না থাকলে কেন এত অবহেলা? সত্যিই মানুষ যার কাছ থেকে অবহেলা পায় তাকেই চায়। মনেপ্রাণে চায়। রাজীব মুখে বলল,
-” আমার ট্রেনিং কাল থেকে শুরু। তোর সাথে ছয়মাসের জন্য আজকেই শেষ কনটাক্ট।”
-” ও”
পুষ্পর ভীষণ কান্না পেলো। কেন এত খারাপ লাগছে? ও জানে না কেন। অভিমান ও হচ্ছে। কেন হচ্ছে? এত অস্থিরতা, এত অভিমান, এত খারাপ লাগার কারণ পুষ্প জানে না। রাজীব বলল,
-” পুষ্প আই হ্যাভ এ রিকুয়েস্ট ”
-” কি”
-” একটু হাসবি? প্লিজ?”
পুষ্প কান্না করে ফেললো। নিঃশব্দে কান্না। রাজীব যাতে শুনতে না পায় এক হাত দিয়ে মুখ চেপে রেখেছে সে। এই মানুষটার জন্যে এত খারাপ লাগার নাম কি ভালোবাসা? এই যে ছয়মাস কথা হবে না জেনে এতটা কষ্ট পাওয়ার নাম কি ভালোবাসা?
-” কাঁদছিস কেন পুষ্প?”
পুষ্প হতভম্ব। ও কাঁদছে সেটা রাজীব বুঝলো কি করে? পুষ্প স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-” কই? কাঁদছি না তো।”
রাজীব মুচকি হাসলো। মানুষ যখন কান্না করে তখন তার ভয়েসটা এত কাঁপাকাঁপা হয় কেন?
.

রাত্রি প্রেগন্যান্সি কিটটা হাতে নিয়ে বসে আছে। লাল দাগ দুটি স্পষ্ট। শিট! এবার কি হবে? তাও ব্যাপার ছিলো না যদি ভিসাটা পেয়ে যেতো। ভিসাই তো পায় নি এখনো। এরমধ্যেই মা জেনে ফেললে সর্বনাশ। অবিবাহিত একটা মেয়ে প্রেগন্যান্ট। এটা শুনলে মামার ফেমিলিতেও এর ছায়া পড়তে পারে। বাবাকে নিয়ে প্রতিদিন নিউজে ছাপা হচ্ছে। এবার মিডিয়ার কানে গেলে রাত্রিকেও রেহাই দিবে না ওরা। হয়তো নিউজ ছেপে বসবে, দুর্নীতিবাজ বাবার কুমারী মেয়ে প্রেগন্যান্ট! রাত্রি দুহাতে মুখে চেপে ধরলো। মা যদি এসব শুনে স্ট্রোক করে? রাত্রির চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। সে কি করবে এবার? এত ভয় কেন হচ্ছে ওর? এর আগেও তো অনেক ঝামেলাই নিপুনভাবে হ্যান্ডেল করেছে সে। এটা কি তাহলে সত্যিই ভয়াবহ কিছু? ও কি সত্যিই কোনো ভুল করে ফেলেছে?
ফোনের স্ক্রিনে সৌরভের নাম্বার ভেসে উঠলো। রাত্রি ফোনটা ছুড়ে মারলো ফ্লোরে। কিটটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেললো। সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে রাত্রির। মাথাটা এত ঘুরছে কেন? কেন এত নিস্তেজ লাগছে শরীরটা?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here