নীল দিগন্তে পর্ব ১০

#নীল_দিগন্তে
পর্ব-১০
লেখা- নীলাদ্রি নীরা

মাঝরাতে রাজীবের ঘুম ভাঙ্গলো গোঙানির শব্দে। শব্দটা যে ওর খুব নিকটে সেটা ওর বুঝতে খুব একটা সময় লাগলো না। ফোনের টর্চ জ্বেলে পুষ্পর দিকে নজর দিলো রাজীব। থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। পুষ্পর কপালে হাত দিতেই শিউরে উঠল রাজীব। এত জ্বর এসেছে মেয়েটার! বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে জেনেও কেন ভিজতে গেলো? রাজীব ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার বের করে পুষ্পর মুখে পুরে দিলো। এই অবস্থায় কি করা উচিত ওর? মাকে ডাকবে? জলপট্টিটা সে নিজেই দিতে পারবে। তবুও কি করবে বুঝতে পারছে না রাজীব। দুই মিনিট পর থার্মোমিটারটা এনে দেখলো টেম্পারেচার ১০৩.৫। রাজীব এবার সত্যি ঘাবড়ে গেলো। মাকে ডাকা দরকার। পুষ্পকে কি একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দেয়া যায়? কিন্তু তিনদিনের আগে জ্বরে নো মেডিসিন। রাজীব আর দেরী না করে রুমাল ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে লাগল। পুষ্প বিরবির করছে। রাজীব বুঝতে পারছে না। রাজীব পুষ্পর মুখের কাছে কান নিলো। ওর কথাগুলো অস্পষ্ট। অনেকক্ষণ জলপট্টি দেয়ার পর রাজীব পুষ্পর মুখ, গলা, হাত মুছে দিতে নিলো। পুষ্প আঁকড়ে ধরলো রাজীবের হাত। অস্পষ্টস্বরে বলতে লাগলো,
-” আলিফের সাথে সত্যি আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কারো সাথেই নেই। সত্যি বলছি। আমার কারো সাথেই কোনো বাজে সম্পর্ক নেই। আমি ছেলেদের সাথে মিশতে পারিনা। কোনো ছেলে আমাকে প্রপোজ করলেও আমি এক্সেপ্ট করিনি। সত্যি। জানো তো, আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন একটা ছেলে দুষ্টুমি করে আমার বইয়ে লাভ লেটার রেখে দিয়েছিল। সেটা আমি না দেখলেও মা দেখে ফেললো। তারপর আমাকে কি মারটাই না দিল। তুমিও আমাকে মেরেছিলে সেদিন। আমার দোষ কি ছিলো বলো? আমি কি করেছিলাম? আমাকে সবাই ভুল বুঝে, আমাকে দোষ দেয়। তুমিও দাও। ওইদিন রেস্টুরেন্টে আমি যার সাথে বসে কথা বলছিলাম সে আমার কেউ না। কিছুই না। অথচ এরজন্য তুমি আমাকে কতগুলো কথা শুনিয়েছ। তুমি খুব খারাপ লোক। খুব বাজে। খুব”
রাজীব বলল,
-” আমি তো খারাপই। ওই ভালো লোকটা কে শুনি? ”
-” কোন লোকটা?”
-” ওই যে যার সাথে রেস্টুরেন্টে আইসক্রিম খেয়েছিলি?”
-” তুমি চিনবে না। ”
-” কেন চিনব না? না বললে চিনব কিভাবে? ”
-” জানি না”
পুষ্প ভ্যাঙচালো। পুষ্পর চোখ বন্ধ। রাজীব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে পুষ্পর দিকে। জ্বরের ঘোরে হুশ না থাকলেও তেজ দেখানো মিস হবে না উনার। রাজীব কনুইয়ে ভর করে পুষ্পর দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। ওর দৃষ্টি কেবলই পুষ্পর দিকে। পুষ্প আবারও বলতে লাগলো,
-” জানো তো। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। কেউ না। সবাই শুধু করুনা করে।”
-” কে বলেছে? আমি তো ভালোবাসি ”
-” হুহ মিথ্যা কথা। সবাই ই এই কথা বলে”
-” আর কে বলেছে? ”
-” কেউ বলে নি। কিন্তু বুঝা যায়। এই যে চাচা,চাচী,ফুফু আমাকে এতো ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। এটা কি ভালোবাসা? কখনোই না। এটা শুধুই করুণা। বাবা নেই বলে অসহায়ত্ব যাতে না বুঝি সেজন্য এত স্নেহ করেন উনারা। এটা কখনোই ভালোবাসা না। সবাই নিজেদের জায়গা থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করছে মাত্র। কারণ দাদু বলে গিয়েছিলেন আমি যেন বাবার অভাব না বোধ করি। এই দায়িত্ব কাধে নিয়ে চাচা চাচী তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। এটা কি ভালোবেসে করেছেন বলো? আবার আমার মা, সে তো আমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না। ছোটবেলায় মা বলতো আমি মায়ের পেটে আসায় নাকি বাবা মায়ের থেকে দূরে চলে গিয়েছিল৷ এটাতে আমার দোষ? কেন আমার দোষ বলো? আমি কি জন্মের আগেই চেয়েছি আমার বাবা আমার মাকে ছাড়ুক। যে যাবার সে চলে যাবেই সেটা মা বুঝে না। মা খুব খারাপ আচরণ করেছে আমার সাথে সারাজীবন। আমাকে কখনো স্নেহ করেনি, ভালোবাসে বুকে আগলে রাখে নি। সত্যি বলতে মা কি জিনিস তা আমি বুঝেই উঠতে পারিনি। তবে মাঝরাতে ঠিকই মা আমার কাছে এসে আমাকে আদর করে যেত, কপালে চুমু খেতো, চুলগুলো ঠিক করে দিত। কিন্তু এসব ভালোবাসা মায়ের ওসব আজেবাজে কথার কাছে নিঃস্ব হয়ে যেতো। মা প্রতিদিন নিয়ম করে আমাকে কথা শোনায়। আমার কি অপরাধ বলো? আমি কি মায়ের স্নেহ, মায়ের সাথে হাসিমুখে গল্প করা, বাবার স্নেহ ভালোবাসা ডিজার্ব করি না? বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়া কেন আমার জীবনে নেই? বিন্দুমাত্র সুখ ও কি আমার প্রাপ্য নয়? আমি কেন এত দূর্ভাগা? কেন আমার বাবা নেই? কেন? আমি ছোটবেলায় দেখতাম সব বাচ্চাদের স্কুলে ওদের বাবা নিয়ে যায় আবার মা গিয়ে নিয়ে আসে। এটা সেটা কিনে দেয়। তাদের কত উল্লাস কত আনন্দ! আর আমার! আমার তো বাবা ছিলো না। মাও যেতো না। আমাকে নিয়ে যেতে তুমি, নয়তো দাদু। আমার খুব কষ্ট হতো জানো!, লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করতাম কেন আমার বাবা নামক আশীর্বাদটা নেই? প্রাইমারী লেভেল পর্যন্ত প্রায়ই আমার ক্লাসমেট সহ অনেকেই বলতো, পুষ্প তোর বাবা নেই হাহাহা। ওরা হাসতো। ওরা বাচ্চা বুঝতো না তাই হাসতো। অনেকের গার্ডিয়ান মায়েরাও আমাকে সুযোগ বুঝে উপহাস করতো। আমি যখন টেনে পড়তাম স্কুলের শাম্মী ম্যাম আমাকে একদিন টিচার্স কমন রুমে ডাকলেন। আমি যাওয়ার পর উনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা নেই? আমি বললাম, না। উনি বললেন, কে বলেছে নেই? তোমার বাবা তো জীবিত আছেনই। তোমাদের ছেড়ে নাকি চলে গিয়েছেন। আমি চুপ করে রইলাম। ম্যাম আবার বললেন, তোমার বাবা কেন গিয়েছেন বলো তো? তোমার মায়ের কোনো প্রবলেম টবলেম আছে নাকি? তোমার মায়ের কি অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল? এজন্য তোমার বাবা চলে গেছেন? এই বলে উনারা মুখ টিপে হাসতে লাগলেন। পুরু রুমে টীচাররা ভর্তি। সবাই এ ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছেন। পৃথিবীটাকে যে কতটা নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল সেদিন। কারো দূর্বলতায় আঘাত করার আগে একটাবার ও মানুষ গুলো ভাবে না। বরং তারা খুব আনন্দ পায়। আমার মায়ের কোনো দোষ ছিল এতে? আমার মাকে কেন কথা শুনতে হয় বলো? ”
রাজীব চুপ। পুষ্পর বন্ধ চোখ টপকে অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ছে। পুষ্পকে কান্না করতে খুব কমই দেখেছে সে। ভিতরে ভিতরে একটা মেয়ে এভাবে কষ্ট পেয়ে পেয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে কেউ বুঝতেই পারছে না। ও সবাইকে বুঝিয়ে বেড়াচ্ছে ও খুব ভালো আছে। অথচ! একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজীব। মানুষগুলো এমন কেন? সুযোগ পেলেই কথা শুনিয়ে দিতে মিস করেনা কেন! কারো সম্পর্কে কিছু বলার আগে নিজের লিমিটনেসটা কেন চেক করে না? তাদের কোনো রাইট আছে এতে?
পুষ্প চোখ মেলে তাকালো। ওর চোখ দুটো ভয়ানক লাল। পুষ্প বলল,
-” পানি খাবো”
রাজীব পুষ্পর মাথা উচু করে পানি গ্লাসটা ওর মুখের সামনে এগিয়ে দিলো। পুষ্প উঠতে নিলে রাজীব ওকে আধশোয়া হয়ে বসালো। এক চুমুক খেয়েই গ্লাসটা সরিয়ে দিলো সে। বড্ড তেতো পানিটা! জঘন্য!
-“আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ডসরা আমাকে বলে আমি নাকি অহংকারী। রূপের অহংকারে আমি কারো সাথে মিশতে পারিনা। কাউকে মানুষই মনে করি না আমি। আমাকে ওরা ডাকে দ্যা প্রাউড গার্ল। অথচ মানুষের কথার আগুনে প্রতিনিয়ত মৃত্যু হয় আমার। সেটা কি কেউ দেখে? দেখে শুধু আমি চুপচাপ, মজামাস্তি করিনা, ফাজলামি করিনা, হাসাহাসি করিনা। এটাকে ওদের ভাষায় বলে আত্মঅহংকার। অথচ অহংকার করার মতো কিছুই আমার নেই। আমাকেই কেন এসব শুনতে হবে বলো?”
পুষ্প হু হু করে কান্না শুরু করলো। রাজীব পুষ্পকে বুকে জড়িয়ে নিল। পুষ্পর চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে রাজীবের বুক। আর পুষ্পর তপ্ত শরীরের ছোয়া থেকেও বেশি জ্বলছে রাজীব নিজে। জ্বলন্ত আগুনের আঁচ থেকে তিলে তিলে কথার আগুনে পোড়া মনের আঁচটা বেশি তীব্র। সেটা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। এমনকি সবাই সেটা অনুভবও করতে পারে না। এই পোড়ার কোন ধোঁয়া নেই, নেই কোন দৃশ্যমান ক্ষত!
পুষ্প হেচকি তুলতে তুলতে বলল,
-” আমাকে তুমি অযথাই সন্দেহ করেছো। সত্যি বলছি আমার জীবনে অন্য কোনো ছেলে আসে নি।”
রাজীব চুপ। সে জানে পুষ্প মিথ্যে বলে না। কিন্তু ব্যাপারটা কি শুধুশুধুই সন্দেহ? কে মিথ্যে বলছে? পুষ্প নাকি রুমা? বউ নাকি এক্স গার্লফ্রেন্ড?
.
পুষ্পর ঘুম ভাঙ্গলো পরদিন বিকালে। জ্বরটা পুরোপুরি কমে নি। রাত্রি ওর পাশে বসেছিল। পুষ্প জেগেছে দেখতে পেয়ে রাত্রি বলল,
-” এখন কেমন লাগছে? ”
পুষ্প বলল,
-“ভালো।”
-” মাথা যন্ত্রণা করছে? ”
পুষ্প না সূচক মাথা নাড়ালো। রাত্রি বলল,
-” কিছু খাবি?”
পুষ্প আবারও মাথা নাড়ালো। রাত্রি বলল,
-” খাবি না কেন? খেতে হবে। দাড়া বড় মামীকে বলে আসি স্যুপ বানিয়ে দিতে।”
রাত্রি দরজার কাছে গিয়েই ফিরে এলো। পুষ্পর পাশে বসে বলল,
-” ওহহো পুষ্প! ভাইয়া অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছে কখন আমি বের হবো আর সে রুমে ঢুকেই ধপাস করে দরজা বন্ধ করবে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে না তাকে সুযোগ করে দিতে। এজন্যই আমি সারাদিন তোর কাছে বসেছিলাম। ভাবছি রাতেও আমি তোর সাথেই শোব। বেচারা মনেমনে খুব বিরক্ত হচ্ছে আমার উপর। আই ইঞ্জয় ইট। আমি চাচ্ছিনা আমি এখন মামীর কাছে যাই আর ভাইয়া সেই সুযোগটা নিক। আমি বরং বাসার ল্যান্ড লাইনে ফোন করে বলি। শারমিন রিসিভ করলেই মহারানীদের মত করে বলব, এই বাদী এক্ষুণি স্যুপ বানিয়ে পুষ্পর রুমে হাজির হ! কুইক!”
রাত্রি হাসছে। পুষ্প বুঝতে পারছে না রাজীব কেন এত এই রুমে আসতে চায়। কালকে তো কত কথাই শুনালো। এখন কেন এখানে আসার জন্য উতলা হয়ে আছে। হুহ..
.
রাত্রি বলেছিলো সে পুষ্পর সাথে রাতে থাকবে। কিন্তু সে কারো সাথে বেড কেন রুমই শেয়ার করতে পারে না। তার উপর পুষ্প কিছুক্ষণ বাদে বাদে বিলাপ বকছে। তাই সে পুষ্পর সাথে শোয় নি। রাজীব রাতে রুমে এসে দেখলো পুষ্প ঘুমে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ওর। কেন এই সময়টাতেই পুষ্প অসুস্থ হতে হলো? ট্রেনিং এর আগে দুইটা দিন কি পুষ্পর সাথে কাটানো যেত না? কালকে রাতের ট্রেনেই তো রাজশাহী চলে যাবে ও। ছয়মাসের আগে কি সে পুষ্পর সাথে একটু সময় কাটাতে পারবে নাকি! আজ রাতের মধ্যে কি পুষ্পর জ্বরটা ছাড়বে? আচ্ছা পুষ্পর কি গতরাতের কথা মনে আছে? পুষ্প তাকে কি কি বলেছিলো সেটা
কি পুষ্পর মনে আছে? হয়তো বা নেই। হুশ না থাকা অবস্থায় মানুষ কি বলে না বলে সেটা তার মেমরিতে জায়গা করে নিতে পারে না। বুকচিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রাজীবের। বড় কপালপোড়া সে! হতভাগা!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here