নীল দিগন্তে পর্ব ১৪

#নীল_দিগন্তে
পর্ব- ১৪
লেখা- নীলাদ্রি নীরা

পুষ্পর দিনগুলো যাচ্ছে দূর্দান্ত। সারারাত জেগে বরের সাথে ফোনে কথা বলা, সংঘটনের দিনদিন উন্নতি দুই মিলিয়ে দিব্যি দিন কাটাচ্ছে ও। টীনেজে প্রেম ভালোবাসা আসে নি ঠিক কিন্তু বিয়ের মাধ্যমে ঠিকই প্রেম এসেছে। সে কি ভেবেছিল এমন কেউ আসবে ওর জীবনে? প্রতিটা সেকেন্ড মানুষটাকে নিয়েই ভাববে পুষ্প? তবে মাঝেমধ্যে পুষ্পর খুব রাগ হয় রাজীবের প্রতি। পুষ্পর না হয় সারাদিন কাজ নেই তাই রাত জেগে কথা বলতে পারলো কিন্তু রাজীব তো ফ্রী না। এত পাগলামি করলে চলে? এইতো গতকাল ও ওদের মধ্যে মোটামুটি একটা ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। পুষ্প খুব কৌশল করে ঝগড়া মিটিয়েছে। ওদের কনভার্সেশনটা ছিলো এরকম
পুষ্প-” কয়টা বাজে দেখেছো কি?”
রাজীব-” সাড়ে তিনটে। তো?”
-” তো কি! ঘুমাবা না?”
-” না”
-” তোমার কি ট্রেনিং নেই নাকি? মনে হচ্ছে কাজ কাম নেই তাই শুধু কথা বলতে হবে।”
-” প্রতিদিন এক কথা কিভাবে বলতে পারিস পুষ্প? ট্রাই সামথিং নিউ”
-” আজব তো। আমি তোমার ভালোর জন্যই তো বলি। এত কম ঘুমালে তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে।”
-” তাতে কি হয়েছে? তুই সেবা করে সুস্থ করবি। স্বামীর সেবা করা প্রত্যেক স্ত্রীর কর্তব্য, ফরজ।”
-” আমি ফাজলামি করছি না।”
-” ও আচ্ছা। তাহলে কি আমি ফোন দিলে তুই বিরক্ত হোস? এজন্যই যত এক্সকিউজ তোর। আচ্ছা যা আর ফোন দিব না।”
-” কি আশ্চর্য আমি কখন বললাম আমি বিরক্ত হই?”
রাজীব ফোন রেখে দিলো। পুষ্পর রাগে ইচ্ছে করছিল রাজীবকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে। পুষ্প বারবার ট্রাই করছিলো। রাজীব রিসিভ করছে না। শেষমেশ পুষ্প টেক্সট করলো, বাসায় আসবা না? বাসায় আসলেই এর শোধ তুলবো দেখো। একদম মেরে ফেলবো। রাজীব সাথে সাথেই টেক্সট করলো, প্লিজ কিল মি। আমি তোর হাতে মরতে চাই। পুষ্প রিপ্লাই দিল না। রাজীব অপেক্ষা করে থেকে নিজেই কল করলো। রিসিভ করেই পুষ্প শুনতে পেলো লো ভলিউমে গান বাজছে।
Every night in my dreams,
I see you, I feel you
That is how I know you
Go on……
পুষ্প চুপ। রাজীব বলল,
-” আজকেই মারবি? এখন চলে আসি?”
পুষ্প বলল,
-” হ্যা আসো”
-” আসলে কয়টা কিস করবি?”
-” ছিহ”
-” এহহ আসছে আমার ছি বলতে। জামাইকে কিস করতে ছি এর কি আছে রে? এটা আমার অধিকার”
পুষ্প লজ্জা পাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করল না। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
-“সিরিয়াসলি আসবা কবে? ”
রাজীব দুষ্টামি করে বলল,
-” আমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হচ্ছে?”
পুষ্প চুপ। মনে মনে বলল, হ্যা ভীষণ রকম কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসো। রাজীব বলল,
-” তুই যদি এখনই একটা কিস করিস তাহলে খুব শীঘ্রই চলে আসব?”
-” কাকে কিস করবো? ফোনকে? ফোনকে কিস করার কি আছে আজব তো!”
রাজীব রাগ দেখিয়ে বলল,
-” আনরোমান্টিক কোথাকার”
পুষ্প হাসছে। আর ওদিকে রাজীব খুব খিটখিট করছে। বউরা এত আনরোমান্টিক হবে কেন? কি হয় একটু আদুরে আদুরে কথা বললে? পুষ্পটা কি কখনো বুঝবে না? গাধী কোথাকার একটা। এভাবেই চলছিলো পুষ্প আর রাজীবের দিনগুলো।
.
সৌরভদের বনানীর বাসা থেকে বেরিয়ে হাটতে হাটতে মেইন রোডে আসলো রাত্রি। মিরপুরের বাস ধরবে সে। সৌরভদের বাসা থেকে রাত্রিদের নিজের বাসা খুব একটা দূরে না। অথচ রাত্রি বিগত পাঁচবছরেও জানতো না সে কথা। ড্রাইভারকে গাড়ি সমেত বিদেয় করে দিয়েছে। সত্যিই এখন ওর মনে হচ্ছে ও খুব তুচ্ছ একটা মানুষ। মামার গাড়ি ব্যবহার করার অধিকার ওর কোথা থেকে হলো? মামাদের ওখানে থাকতে পারছে এটাই তো অনেক। জীবনে এর আগে কখনো অপদস্থ, অপমানিত হয়েছে রাত্রি? উত্তরটা ক্লিয়ারলি, না। যাস্ট না। আচ্ছা প্রথমবার এতটা অপমানিত হলে কি খুব খারাপ লাগে? সুইসাইড করতে ইচ্ছে হয়? পুষ্পর ও কি কখনো সুইসাইড করতে ইচ্ছে হয়েছে? পুষ্প তো ছোট বেলা থেকে দিব্যি ভালো থাকার অভিনয় করে গিয়েছে। কম অপমানিত তো পুষ্প হয় নি। সেগুলো এত নিখুঁতভাবে মানিয়ে নিয়েছে কি করে ও? পুষ্পকে তো রাত্রি কখনো কাঁদতে দেখেনি। তাহলে রাত্রি কেন পারবে না? ওর কেন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে? রাত্রির কেন নিজেকে এত তুচ্ছ মনে হচ্ছে? হোয়াই? রাত্রি আর পুষ্পর মধ্যে তফাত টা কি? পুষ্প সারাজীবন যেটা সাফার করেছে সেটা রাত্রিকে এখন করতে হচ্ছে। পুষ্পর ও কি এতটা কষ্ট হয়েছে? পুষ্পর তো তাও সাপোর্ট পাওয়ার মতো লোক ছিল। আর এখন আছে রাজীব ভাইয়া। রাত্রির কি কেউ আছে? কেউ না। রাত্রি দুহাতে নিজের মাথাটা চেপে ধরলো। কিছুতেই পারছে না এসব চিন্তা মাথা থেকে সরাতে। আর রাত্রি এসব অপমান হওয়ার কথাই বা ভাবছে কেন? এটা তো অপমান ছিলো না। ওর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হয়েছে ওর অবস্থানটা, ওর যোগ্যতাটা। এতে অপমানের কি আছে? ওর উচিত সৌরভের বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। মনে মনে সৌরভের বাবাকে হাজারটা ধন্যবাদ জানালো রাত্রি। এই মানুষটাই তাকে বাস্তবটা বুঝিয়ে দিলো। হয়তো পরবর্তীতে এটা রাত্রিকে খুব সাহায্য করবে।
বাস থেকে নেমে রাত্রি রিকশা ধরলো। সৌরভ বারবার ফোন দিচ্ছে। রাত্রি সেটা দেখছে তবু ধরছে না। সৌরভ ভয়েস মেসেজ পাঠালো। রাত্রি সেটা ওপেন করলো। ২৩ সেকেন্ডের ভয়েস মেসেজটা ছিলো এরকম, “রাত্রি তুমি কোথায়? এতগুলো কল দিচ্ছি রিসিভ করছ না কেন? আর ইউ ওকে? তুমি কি চলে এসেছ? প্লিজ রাত্রি ভয়েসটা শোনামাত্র কল দিবে টেনশন হচ্ছে খুব। বাবা মা কি বলল জানাবে। প্লিজ” রাত্রি চোখের পানি মুছে কল করল সৌরভকে। সৌরভ সাথসাথে রিসিভ করলো।
-” রাত্রি! রাত্রি তুমি কোথায়?”
-” রিক্সায় ”
-” চলে এসেছ? ফোন রিসিভ করছিলে না কেন? ভয়েস পাঠাতেই তো সেটা সাথে সাথে শুনেছ।”
-” ইচ্ছে করেই রিসিভ করিনি।”
-” কেন?”
-” ইচ্ছে হচ্ছিল তাই”
-” বি সিরিয়াস রাত্রি। কি হয়েছে। ইজ এনিথিং রঙ? প্লিজ আমাকে সব বলো। বাবা মা কি বলল সব বলো প্লিজ।”
-” নতুন করে বলার কিছু নেই সৌরভ। আমি তোমাকে আগেই যা যা বলেছিলাম সেটাই হয়েছে। তবে তোমার বাবা মায়ের কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। উনারা আজকে আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। চোখ থাকতেও অন্ধ ছিলাম এতদিন আমি।”
-” ফর গড সেক তুমি কি আমাকে সবটা বলবে? এত টেনশন সহ্য হয় না রাত্রি আর তুমিও কোনো ইনট্রোভার্ট মেয়ে না যে এত ঘুরানো প্যাঁচানো শুরু করেছো।”
-” রাত্রি ইনট্রোভার্ট না হলেও রাত্রি একটা মানুষ সৌরভ। সি হেজ অলসো সাম উইক পয়েন্টস। জীবনে কারো কটুবাক্য শুনেনি সে। তাহলে সে কিভাবে এখন ব্যাপারটা সহজে হজম করবে? ”
-” প্লিজ রাত্রি বলো আমাকে ”
সৌরভকে বলার কোনো মানে আছে? নেই। তবে সৌরভকে সবটা জানতে হবে। ওর জেনে রাখাটা দরকার। রাত্রি বলল,
-” নিজে তো খুব বড় মুখ করে আমাকে পাঠিয়েছিলে যে তুমি তাদের সাথে কথা বলেছো। আমাকে তোমার বাবা মায়ের পছন্দ হবেই হবে। অথচ তুমি তোমার বাবা মাকে যাস্ট আমার নামটাই বলেছ। তাতে আমি অবাক হইনি। আমি আমার পুরো ডিটেইলস তোমার বাবা মাকে বলেছি। আমার নিজের লাইফ, বাবার ঘটনাগুলো, ইনফ্যাক্ট মামার বাসার কথাও। একদিন তো উনারা জানতেনই তারচেয়ে বরং আগেই বলে নেয়া ভালো। তোমার বাবা মা আমার কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুনেছেন। তারপর তোমার বাবা বললেন, তোমার বাবার জায়গায় যদি আমি হতাম, তখন কি তোমার বাবা এসব শুনেও সৌরভকে তার একমাত্র মেয়ের জামাই করতে রাজী হতেন? আমি বললাম, না। সৌরভের প্রফেশন বাবার আগেই পছন্দ ছিল না। তখন তোমার বাবা বললেন, আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ আমি কেন প্রশ্ন করেছি। আমি মাথা নাড়লাম। এতটা বোকা আমি না যে বুঝব না। তোমার বাবা বললেন, সৌরভকে আমি ওর নিজের মতো করে চলতে দিয়েছি। ও ইউনিভার্সিটি লাইফে হলে থাকতো। ওর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তাই ও এখনও ব্যাচেলর বাসায় থাকে। সপ্তাহে একদিন এই বাসায় থাকে। আমি না করি নি। কারণ এতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে না। ও নিজের ইচ্ছেমত জব করছে। দ্যাটস নট মাই প্রবলেম। তুমি জানো, আমাদের পুরো বংশে এরকম কোনো হিস্ট্রি নেই। তাহলে তুমিই বলো আমার ছেলে কি এসব ডিজার্ব করে? তার জন্য ভালো ভালো ফেমিলির মেয়েরা পরে আছে। যাদের ফেমিলি রেকর্ডস অত্যন্ত সুনামধন্য। বাদ দাও ওসব। ধরো, সব জেনেও হয়তো আমি তোমাকে পুত্রবধু করে আনলাম আমার ছেলের খুশির জন্য। বাবা হিসেবে আমিও সন্তানের খুশিটাই দেখতে চাই। কিন্তু তাতে আমার আত্মীয়স্বজন যাদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক তারা আমাদেরকে অবশ্যই ত্যাগ করতে চাইবে। ইউ নো, রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করা কতটা পাপ? জানো হয়তো। তারপর তোমাকেও নানান রকম কথা শুনতে হবে আর আমরা তো শুনবই। পৃথিবীতে কেউই সুযোগ পেলে সেটা মিস করতে চাইবে না। নিজের বাবা সম্পর্কে কটু কথা মেনে নিতে পারবে? ধরে নিলাম, তুমি হয়তো মেনে নিবে সেটা। আর আমরাও তা মেনে নিলাম। কারন পাছে লোকে কিছু বলে। ওয়েল। ইন ফিউচার, তোমাদের বেবিদেরকে যখন অন্যরা বলবে যে তাদের নানাভাই একজন স্মাগলার। তখন তাদের মনের অবস্থাটা কেমন হবে আর তোমাদের নিজেদের কেমন লাগবে সেটা ভেবেছ? শোনো মা, তুমি সময় নাও। একটু ভাবো। ভেবে দেখো যে তুমি কি আসলেই সৌরভকে বিয়ে করতে চাচ্ছো কিনা। এতসব কিছু জেনেশুনেও টলারেট করতে পারবে কিনা। লাঞ্চ করে যাবে কেমন? এতটুকুই তোমার বাবার কথা।”
সৌরভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
-” তুমি তাহলে আমাদের বিয়ের কথা বলো নি? তুমি প্রেগন্যান্ট সেটাও বলো নি।”
-” না।”
-“কেন?”
-” আমি চাচ্ছি না তুমি তোমার বাবা মায়ের চোখে খারাপ হও”
-” আমার কথা তোমাকে কে ভাবতে বলেছে?”
-” বলে লাভ কি হতো। উনারা হয়তো আমাকে মেনে নিতেন। কিন্তু সৌরভ আমি জীবনেও এসব টলারেট করব না। প্রতিটি মেয়ের কাছে তার বাবা তার জীবনের সবচেয়ে দামী গিফট। বাবারা খারাপ হয় না। পৃথিবী উল্টে গেলেও না। তাও বাবা যেমনই হোক, কোনো মেয়েই তার বাবা সম্পর্কে কিছু সহ্য করবে না। আমি তো না ই। সৌরভ তোমার মা আমাকে একটা মেয়ের ছবি দেখিয়েছেন, অসম্ভব রূপবতী মেয়ে। সবদিক দিয়েই সি ইজ পারফেক্ট ফর ইউর ফেমিলি এন্ড ইউর ক্লান! যার তুলনায় আমি সত্যি নগন্য। অনেক দিন ধরেই নাকি আলাপ চলছিল। তাও তোমার কথা ভেবে তোমার বাবা মা আমার সাথে কথা বলেছেন। সৌরভ মাথায় রেখো বোকা ছাড়া ডায়মণ্ড রেখে কেউ কখনো স্বর্নে হাত দেয় না। রাখছি ভালো থেকো।”
রাত্রি ফোন রেখে চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করলো। রিকশাওয়ালা বারবার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে। রাত্রি সেটা খেয়াল করেই তা অগ্রাহ্য করছে। কে কি ভাবলো না ভাবলো সেটা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। কারো কথা সেও ভাববে না। সৌরভের কথাও না। কি লাভ ভেবে? কেন কষ্ট পাবে ভেবে ভেবে? সে কিভাবে পারবে সৌরভকে ছাড়া থাকতে? সৌরভকে ছাড়া থাকতে হবে এ কথাটা মনে হলেই রাত্রির দম বন্ধ হয়ে আসে। ও তো আগেও জানতো সৌরভকে ও পাবে না। তখন তো এত কষ্ট হয় নি। এখন কেন হচ্ছে? হারানোর কষ্ট এত ভয়ানক কেনো….
” মামা কোন গলিতে যামু? ডাইনে না বামে?”
রাত্রি চেয়ে দেখলো ও বাসার সামনে এসে গেছে। রিক্সাওয়ালাকে বলল,
-” এখানেই রাখেন”
রাত্রি চোখ মুছে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া মেটালো। লিফটে ওঠে নিজের দিকে তাকালো রাত্রি।তাকে এতটা বিদ্ধস্ত লাগছে কেন? মাথাও ঝিম ধরে আছে। লিফট থেকে নেমে রাত্রি বাসার কলিংবেল চাপলো। রাত্রি সবকিছু ঝাপসা দেখছে। শরীরটাও যেন দুলছে। আবছা আবছা দেখতে পেলো কেউ একজন দরজা খুলে দিয়েছে। সেটা রাত্রির মা নাকি ছোট মামী সেটা রাত্রি বুঝতে পারছে না। মানুষটাকে ধরার জন্য আলতো করে হাতটা বাড়ালো রাত্রি। কিন্তু তার আগেই রাত্রি মাথা ঘুরে পড়ে গেল ফ্লোরে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here