নীল দিগন্তে পর্ব ২

#নীল_দিগন্তে
পর্ব-০২
লেখা- নীলাদ্রি নীরা

-“আরে আপনাদের মতো মানুষদের কাজই হচ্ছে তামাশা দেখা। আপনারা হলেন দর্শক। ওইযে রেসলিং দেখেন না? দুইপক্ষ মারামারি করে আর দর্শক তালি দেয়। আপনারা সেই দর্শক। এই আপনাদের লজ্জা বলতে কিছু নেই? বলুন না লজ্জা নেই? একটা মেয়েকে হ্যারেস করা হলো, মেয়েটা নিজেই প্রতিবাদ করলো। আর আপনারা তাকিয়ে তাকিয়ে মজা দেখছেন? দেখবেনই তো। কারণ আপনারাও অন্য মেয়েদের হ্যারাস করেন। সেজন্যই এখন এভাবে দাড়িয়ে আছেন। কেনোরে ভাই? একটা মেয়ে বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করলে বা তার পক্ষে কথা বললে কি আপনি নারীবাদী হয়ে যাবেন? আর পক্ষে কেন বলছি ন্যায়ের কথাই ধরুন না! কেন আপনারা এরকম? কেন? আর এই ছেলে এই? ভিডিও করছিস কেন? ফেবুতে,ইউটিউবে ভাইরাল করবি? ফেসবুকিয় প্রতিবাদ করবি? হাজার হাজার লাইক, শেয়ার কামাবি? থাপ্পড় মেরে দাত ফেলে দিবো বেয়াদব।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললো পুষ্প। মানুষ গুলো এত নিষ্ঠুর কেন? কেন এরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় না।
কিছুক্ষণ আগে একটা লোক বাসে ওর গায়ে হাত দিয়েছে। পুষ্প তাকাতেই লোকটা কিছু না বুঝার ভান করলো। পুষ্প সিটে বসা ছিলো আর লোকটা পাশে দাড়িয়ে। ও প্রথমে ভেবেছে ভীড়ের মধ্যে হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে লোকটার হাত লেগে গিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে লোকটার সাহস বেড়ে গিয়ে সরাসরি পুষ্পের পিঠে,ঘাড়ে, বুকের একটু উপরে হাত বুলাতে শুরু করে দিয়েছে। কতবড় খারাপ লোক! লোকটাকে আরো মারতে ইচ্ছে করছে ওর।
এতক্ষন পুষ্পর বলা কথাগুলো শুনছিলো সৌরভ৷ মেয়েটাকে ও আগে কোথায় যেন দেখেছে? মনে করতে পারছে না সৌরভ। হালকা,পাতলা গড়নের ছিপছিপে একটা মেয়ে। অথচ কথার ছিড়ি দেখো! ওর ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটাকে ঠাস করে গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। এই মেয়ে ভেবেছে টা কি? যা মুখে আসছে বলে চলেছে। তুই তুকারিও শুরু করেছে! সব পুরুষ কি এক? সবাই কি শুধু মেয়েদের হ্যারাসই করে? অসভ্য মেয়ে!
-” এই যে আপু! আপনি কি কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিয়েছেন? আমি তো এখানেই ছিলাম। যা দেখলাম, আপনি এই লোকটাকে কিল থাপ্পড় দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে উড়াধুড়া মারতে শুরু করলেন। এর মাঝে আমাদের কি করার আছে? আপনি যেখানে নিজেই রুখে দাড়িয়েছেন সেখানে তো আমাদের আর দরকার পড়ছে না। তাইনা?”
আরেকজন বললো,
-” হ্যা ভাই ঠিক বলছেন। এই মেয়েটা তো নিজেই ছেলেদের মতো মারছে। আর এ যুগে মেয়েমানুষ কি কম যায়? কত পুরুষ লাঞ্চিত হচ্ছে সেটা নিয়ে কোনো কথা হবে না এদিকে দেখেন মেয়েদের ফু লাগলেও পুরো পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়বে।”
অন্য আরেকজন বললো,
-” আরে আপু আপনার ভাষা সংযত করেন। তুই তুকারি শুরু করেছেন কেন? ছেলেটা আপনার ছোট ভাইয়ের মতো। সে তো খারাপ উদ্দেশ্যে ভিডিও করে নি। তাতে অন্য মেয়েরাও নিজে রুখে দাড়ানোর সাপোর্ট পেতো বুঝেছেন? আর আপনার এই সিক মেন্টালিটি চেঞ্জ করেন। সব পুরুষ নারীদের হ্যারাস করার জন্য রাস্তাঘাটে চলে না।”
পুষ্প ভ্রু কুচকে বললো,
-“সত্যি? আচ্ছা মানলাম আমার মেন্টালিটি সিক। ব্যাপারটা জানেন তো! আমি বাসে যখন হ্যারাস হই তখন আমি এই লোকের গায়ে হাত তুলি নি, যাস্ট তাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম। তখন তো কেউ এগিয়ে আসে নি। এরপরে তো বাধ্য হয়ে আমাকেই ব্যাপারটা মিটাতে হয় তাই না! আর আমি উনাকে মেরেছি বলে আপনারা এগিয়ে আসলেন না! আপনারা কি জানেন একটা মেয়ের হাতে একটা ছেলে মার খাওয়া কতটা লজ্জাজনক? জানেন না হয়তো। এজন্যই বলছিলাম! আমার নিজেরই খারাপ লাগছে, কিন্তু কিছু করার নেই। যে আমাকে যেভাবে ট্রীট করবে আমি সেরকমই তাকে ফীডব্যাক দিবো! অন্যায় করলে শাস্তি দিবোই। আর কে যেনো বললেন, পুরুষরাও লাঞ্চিত হয়। হ্যা হয়, আমি জানি সেটা, ইভেন দেখেছিও। কিন্তু শতকরা কতভাগ পুরুষ নির্যাতিত হয়, আর কত ভাগ নারী নির্যাতিত হয় সেটা আগে খুজ নিন। অন্যায় হলে রুখে দাড়াতেই হবে, সেখানে ভিকটিম নারী হোক বা পুরুষ আর ক্রিমিনাল নারী বা পুরুষ যাইহোক। যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়ই।”
-” আপু পুরুষ নির্যাতিত হয় সেটা নিয়ে কোনো মাতামাতি হয় না। মেয়েদের ক্ষেত্রেই বেশি হয়”
-” আপনার কি মনে হয় না, পুরুষদের থেকে মেয়েদের সেইফটিটা বেশি প্রয়োজন? কজন মেয়ে পারে প্রতিবাদ করতে? কয়জনের আছে সে সাহস? বেশিরভাগ এরই নেই।”
-“আপু সাহস নিজে থেকেই তৈরি করতে হয়।”

পুষ্পের বিরক্তির শেষ নেই। এত কথা প্যাঁচানো শুরু করেছে এরা! সৌরভ এতক্ষণ ধরে চুপচাপ সব পর্যবেক্ষণ করছিলো। এতক্ষন মেয়েটার প্রতি বিরক্ত হলেও এখন এই মানুষগুলোর প্রতিও রাগ লাগছে। এগিয়ে গিয়ে সৌরভ বললো,
-” এক্সকিউজ মি! এখানে এতো তর্কাতর্কির কোনো মানে আছে? মেয়েদের সুরক্ষিত রাখা যেমন তাদের দায়িত্ব, তেমনি আমাদেরও উচিত তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত রাখা। সুযোগের সৎ ব্যবহার না করা। সর্বোপরি এদেশে নারীরা সংরক্ষিত না। আপনারা আমাকে হয়তো নারীবাদী বলতে পারেন বাট আমি এক চুলও ভুল বলছি না। জার্নালিজম নিয়ে থাকি, সারাদিন রিপোর্ট করি সেই হিসেবে আমাদের এই বিষয়ে অনেক আইডিয়া আছে। ইভেন এ সমাজে পুরুষ নির্যাতন হয় তা নিয়েও অনেক ধারণা আমাদের আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এভাবে তর্কবিতর্ক করে কোনো সমাধান হবে? হবে না। সো প্লিজ ভাইয়েরা আপনারা যে যার কাজে যান। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই। আর এই যে মিস আপনি এই ক্রিমিনালের বিষয়ে কোন স্টেপ নিতে চান?”
পুষ্প বাসের ওই লোকটার দিকে তাকালো। নাক ফেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। কপালের কাছেও কেটে গিয়েছে। পুষ্প ওই লোকটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে থাকা মানুষটার দিকে ফিরে বললো,
-” না থাক। যেই মার দিয়েছি তাতে আশা করি শিক্ষা হয়ে যাবে।”
-” গুড! আপনি কি আজকের ঘটনাটা নিউজে পাবলিশ করতে চান?”
পুষ্প অবাক হয়ে লোকটার গলায় ঝুলানো আইডি কার্ডে এক নজর চোখ বুলালো। নাম সৌরভ সিদ্দিকী। পেশায় জার্নালিস্ট। বাপরে! এ আবার কোত্থেকে হাজির হয়েছে!! পুষ্প বললো,
-” আপনি এখানে কোথা থেকে আসলেন বলুন তো? আই মীন আমি এক্সাক্টলি কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা মিডিয়ায়ও চলে গিয়েছে! ওহ মাই গড!”
-“আমি আসলে এদিকেই যাচ্ছিলাম। ঝামেলা দেখে এগিয়ে এসে দেখি এই অবস্থা। এই আর কি! আর এরকম হাজার হাজার খবর নিউজে প্রতিদিন পাবলিশ হচ্ছে। এজন্যই বলছিলাম।”
– “ওহহো। আপনি কি সাংবাদিক নাকি সাংঘাতিক! আপনার কি কোন আইডিয়া আছে এর জন্য আমাকে আরও কত হ্যারাস হতে হবে? মানুষ আমাকে দেখলেই বলবে, আরে এই মেয়েটাকে তো বাসে এক লোক গায়ে হাত দিয়েছে। আবার অনেক সেটাকে র‍্যাপ কেসও বানিয়ে দিবে। ওগুলো নিশ্চয়ই আমি টলারেট করতে পারবো না, ইভেন থামাতেও পারবো না!”
-” হ্যা তা ঠিকই। কিন্তু আপনি তো তাতে ভয় পাওয়ার মত মেয়ে না। মানে এতক্ষণে এটা আমার কাছে অন্তত ক্লিয়ার।”
-“একটা মেয়ের কাছে তার সবচেয়ে বড় সম্বল হলো তার সম্মান, সম্ভ্রম। হোপ বুঝতে পেরেছেন।”
সৌরভ স্মিত হাসলো। মেয়েটা সত্যিই খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার।
-“ওয়েল। তাহলে আর কি করা। উনাকে ছেড়ে দিন আর আপনি ও আপনার গন্তব্যে চলে যান।”
-” হুম যাবো তো বটেই।”
পুষ্প ফিরে গিয়ে ওই লোকটাকে টেনে তুলে শার্ট ঝেড়ে দিতে দিতে বললো, “এই যে ভাই, মেয়েদের গায়ে হাত দেয়ার শখ মিটেছে? এরপর থেকে নজরটা ঠিক করবেন। বলা যায় না, আপনার অতি আপনজনেরাও হয়তো এরচেয়ে বড় হয়রানির স্বীকার হচ্ছে। প্লিজ কোনো মেয়েকে নিজের আনন্দের বস্তু বানাবেন না। আপনি নিজেও কোনো মেয়েরই সন্তান। আপনার মাও মেয়ে, আপনার বোনও মেয়ে, আপনারও মেয়ে হবে ইনশাআল্লাহ। তাদের আপনি যেই নজরে দেখেন অন্য মেয়েদের ও সেই নজরে দেখবেন। এই যে দেখুন না এতক্ষন রাগে আমি আপনাকে মারলাম, এখন কিন্তু ভাই বলে সম্বোধন করছি। বিশ্বাস করুন, আমার নিজের ভাই যদি অন্য মেয়ের সাথে এমন করতো আমি তাকে এভাবেই মারতাম। প্লিজ মেয়েদের সম্মান দিন। তাতে তাদের কাছেও পুরুষদের সম্মান বাড়বে। তারা পুরুষদের দেখে তখন আতঙ্কিত হবে না বরং তাদের শ্রদ্ধা আরো বাড়বে। পৃথিবীতে সবাই খারাপ ও না আবার ভালো ও না। সবাইকে আমরা চেঞ্জ করতে পারবো না। তবে নিজে অন্তত সৎ থাকার প্রতিজ্ঞা করি।”
পুষ্প ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে লোকটার নাকে চেপে ধরলো। তারপর বললো,
-“ভাই শুনেন নিজেই হাসপাতালে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করে নিন। আমার জরুরি কাজ আছে গেলাম। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে হেদায়েত করুন।”
সৌরভ পুরো হতবাক হয়ে গেলো। বিরবির করে বললো, মেয়ে মানুষকে আসলেই বুঝা দায়! কোন কবি না লেখক যেন এটা বলেছিলেন? হুমায়ুন আহমেদ নাকি রবীন্দ্রনাথ নাকি অন্য কেউ?
এই মেয়ে তো রাত্রির চেয়েও হাজার গুন এগিয়ে…
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here