পদ্মপাতা পর্ব ১

#পদ্মপাতা
#লেখিকা-আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১
#রিপোস্ট

১.

প্রাণোচ্ছল এক কিশোরী আম গাছে উঠে বসে আছে।তার হাঁটু সমান চুলগুলোকে সে বেণী নামক এক বাঁধনে আটকে রেখেছে। তাদের হয়তো দম বন্ধ লাগছে। তাই ছাড়া পাওয়ার জন্য এলোমেলোভাবে বের হওয়ার চেষ্টা করছে তারা।সেদিকে মেয়েটির বিশেষ খেয়াল নেই।সে একটা ডালে বসে কাচঁমিঠা আম খাচ্ছে। আর তালু দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করছে।যা অনেকটা ট্টা ট্টা ট্টা এর মতো শুনাচ্ছে।পাশাপাশি কাঁচা আমে কামুড় দিয়ে সে মুখের একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করছে।নিচে তার বন্ধু তমাল,জুবায়ের আর প্রণয় দাঁড়িয়ে। প্রণয়ের নামটা সুন্দর হলেও বেচারাকে এই নামে কেউ ডাকেনা।হ্যাংলা, পাতলা রোগা ধরনের এই ছেলেটাকে সবাই পাটকাঠি নামে চিনে।এই বিশেষ নামটা অবশ্য গাছে যে মেয়েটা বসে আছে তারই দেওয়া। দুইদিন প্রণয় খুব রাগ করেছিল মেয়েটার সাথে তবে আবার ভাব হয়ে গিয়েছে।

-চাঁদ। জলদি কর। আমগুলো তাড়াতাড়ি দে।বৃষ্টি আসবে মনে হয়।

জুবায়ের এই কথা বলে নিচ থেকে কাপড়ের ব্যাগটা মেলে ধরলো।আর চাঁদও আম খাওয়া ফেলে আম পাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।বড় মামি বলেছেন তাড়াতাড়ি আম নিয়ে যেতে।এইটা চাঁদের মামার বাগান।চাঁদপুর শহরে প্রাচীর ঘেরা দুইতলা বাড়িটি চাঁদের নানুবাসা।আহা সে দেখার মতো বাড়ি।অনেকটা পুরানোদিনের জমিদার বাড়ির মতো।বাড়ির সামনে বিশাল রাস্তা। একপাশে গোয়ালঘর আর গোয়ালঘর পেরিয়ে আমবাগান।আর অপরপাশে ঘাটবাধাঁনো একটা পুকুর। পুকুর বলা চলেনা।এটাপুরানো এক দিঘী। যা একনামে ধুরী দিঘী নামে পরিচিত। এরপিছনেও মজার একটা ঘটনা আছে।চাঁদের মামাদের পদবি হলো চৌধুরী। এই দিঘীটা এককালে চৌধুরী দিঘী নামেই পরিচিত ছিল।কিন্তু এক পাগল চৌধুরী দিঘী বলতে পারতোনা। সে বলতো ধুরী দিঘী। সেই থেকে এই নামটাই গ্রামে ছড়িয়ে গেল।ধুরী দিঘির একটা বৈশিষ্ট্য আছে এখানে পদ্মফুল জন্মে।পদ্মফুল আর তার পাতারা যেন রাজত্ব করে দিঘীটাতে।
২.
চাঁদ অনেক তাড়াহুড়ো করছে।বড়মামি বলেছেন ডাল রান্না করবেন।ডালে আম দেওয়া লাগবে।বড়মামা খেতে ভালোবাসেন কিনা।চাঁদ আম খেতে খেতে দেরি করে ফেললো।নির্ঘাত বড়মামি বকা দিবেন।

হঠাৎ জুবায়ের হাতের থলেটা ফেলেদিলো।চাঁদ তা দেখে বললো,

-এই জুবু ব্যাগ ফেলছোত কেন?আরে এই জুবু।

জুবায়ের বললো,
-তুই থাকরে চাঁদ আমরা যাই।এই তমাল,পাটকাঠি চল।

বলে ব্যাগ রেখে একদৌড় দিলো তারা।তাদের যমযে এইদিকে এগিয়ে আসছে।চাঁদের সাথে দেখলে একটা মারও মাটিতে পড়বেনা।আগেরবার চাঁদের হাত ধরায় কি পিটানোটাই না পিটিয়ে ছিল।না, বাবা থাক। বাবা আপন প্রাণ বাঁচা।
তাদের এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়ে নিচে নেমে আসলো চাঁদ। গাছের উপর ডাল, পাতার আড়ালে নিচের কিছুই স্পষ্ট দেখা যায়না।নিচে নামতে দেরি হলো আর তার গালে একটা চড় পড়তে দেরি হলোনা।

চাঁদ সামনে তাকিয়ে দেখলো আবির দাঁড়িয়ে।রক্তচক্ষু করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।মৃদুল চৌধুরী আবির।চৌধুরী বাড়ির বড়ছেলে।আর চাঁদের কাছে ভয়ের অপর নাম আবির।চাঁদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আজ তো সোমবার। আর আবির তো আসে শুক্রবারে। নয়তো চাঁদ ভুলেও গাছে উঠতোনা।

-কতবার না করেছি আমি গাছে উঠতে?বল কতোবার?
-আবির ভাই।
-একদম চুপ। আরেকটা কথা বললে থাপড়ে গাল লাল করে দিবো বেয়াদব। এতোবড় মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে এখনো ছেলেদের সাথে এতো ঢলাঢলি কেন?

চাঁদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। চোখে তার সমুদ্র নেমেছে। আবির ভাই এভাবে তাকে বলতে পারলো!

-আরেকবার যদি ছেলেদের সাথে দেখি পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো।এই একদম আমার সামনে কাঁদাবিনা।চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে নে।
৩.
রাগে গজগজ করতে করতে আবির বাড়ির দিকে রওনা দিলো।আর চাঁদও আমের ব্যাগ নিয়ে ছুটলো তার পিছুপিছু। আর মনেমনে বলছে,

“অ্যাহ্।আমাকে শিখাতে আসছে।নিজের ব্যবহার আগে ঠিক করেন।কে বলবে এই লোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। সবার সাথে ভালো ব্যবহারই করে। খালি আমার বেলা করোলা।আমাকে বেয়াদব বলা।ব্যাটা তুই বেয়াদব।তোর চৌদ্দগোষ্ঠী। না না সেখানে তো বড়মামাও পরে।যা ব্যাটা তুই খালি বেয়াদব।হুহ।”

কিন্তু মুখে এই কথাবলার সাধ্যনেই চাঁদের। মোহনা বেগম ছেলেকে আমভর্তা খেতে দিয়ে গেলেন।আবিরের ঘরটা একেবারে দুইতালার একপ্রান্তে।ধুরী দিঘী দেখা যায় বারান্দা থেকে।আর টেবিলে বসলে জানালা দিয়ে উঠোন দেখা যায়।বাইরে তুমুল বর্ষণ শুরু হয়েছে ।আবির আমভর্তা খেতে খেতে দেখলো উঠোনে এক হরিণী লাফিয়ে লাফিয়ে বর্ষণ উপভোগ করছে।তার নাই কোনো দুঃখ নাই কোনো হতাশা। আবির বিরবির করে বললো,

“তুই কবে বড় হবিরে চাঁদ”।

এই বাড়িটিতে চাঁদের বড়মামা মতিন চৌধুরী আর উনার স্ত্রী মোহনা এবং তাদের দুইসন্তান বড় ছেলে আবির আর ছোট মেয়ে প্রমা থাকে।আবির অবশ্য ঢাকা থেকে পড়াশোনা করে কিন্তু মাসের মধ্যে দুই তিনবার সে বাড়িতে আসে।জমি ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর বাগান ভরা ফল। এগুলো বিক্রির পাইকারি ব্যবসা করেন মতিন।এছাড়াও বাজারে তার পনেরোটি দোকান রয়েছে। যা তিনি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। এই বাড়িতে আরো থাকেন চাঁদের ছোটমামা করিম চৌধুরী আর তার স্ত্রী তিলোত্তমা। তাদের কোনো সন্তান নেই।।ছিল কিন্তু ছোটবেলায় মারা গিয়েছে।করিমও ভাইয়ের সাথে ব্যবসা দেখেন । চাঁদের নানুমা থাকেন।তিলোত্তমার ভাই কাজলও এই বাড়িতেই ঘাটি গেড়েছে।চাঁদের দুইজন খালাতো বোন দিমা আর রুমা এই বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করে।বাকি সবাই কাজের লোক বললেও রহিমাকে চাঁদ খালা বলেই মানে।চাঁদের প্রিয় আরো দুইজন সদস্য আছে দুলি আর মুলি।গাভীর বাচ্চা। এতো সুন্দর দুইটা!রহিমা খালার ছোট একটা ছেলে আছে পচু।এইতো তের জনের বিশাল পরিবার তাদের। তবে চাঁদের মতে পনেরো জন। দুলি আর মুলি আছে না!

আবির বিভোর হয়ে চাঁদকে দেখছে।চাঁদ হাতদুটো ছড়িয়ে চোখটা বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে আছে।বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যখন তার মুখে পরে তখনই সে হেসে উঠছে।আহা তার কি উল্লাস!আবির ভাবে তার ভিত হরিণী এতো সুন্দর কেন!চাঁদের মতই তার রূপ। এইজন্যই তো সে ভয়েভয়ে থাকে।কেউ যদি ছিনিয়ে নেয়। তাহলে আবির মরে যাবে।একদম মরে যাবে।হঠাৎ আবির খেয়াল করলো কাজল কেমন লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে চাঁদকে।এই লোকটাকে তার একদম পছন্দ না।কিন্তু ছোট চাচির জন্য কিছু বলাও যায় না।মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার।এই এক সমস্যা তার।যে যাই করুক সব দোষ সে ফালাবে চাঁদের ঘাড়ে।আর শাস্তিও দিবে চাঁদকে।আবির হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,

-চাঁদ।

চাঁদ হকচকিয়ে জানালার দিকে তাকালো।আবার কি করলো সে।কাজলও স্থান ত্যাগ করলো।

-দুই মিনিটের মধ্যে আমার রুমে আসবি।ফাস্ট। আমি নিচে আসলে তোকে কেটে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দিবো।

প্রমা, দিমা, রুমা তারাও বৃষ্টিতে ভিজছিলো।আবিরের কথায় প্রমা জিজ্ঞেসা করলো,

-চাঁদ আবার কি করলো ভাই।ও তো আমাদের সাথেই ছিল।
-তুই মাঝে কথা বলিসনা প্রমা।যাকে বলেছি সে যেন দ্রুত আসে।টাইম স্টার্ট নাও।

চাঁদ ভিজা শরীরে আবিরের ঘরে এসে পৌঁছালো।দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে গিয়েছে সে!

-হাত পাত।
-কেন আবির ভাই?
-কথা নাই।হাত পাত।

হাত পাতার সাথে সাথে দুইটা স্কেলের বাড়ি পড়লো।

-আর কোনোদিন যেন বৃষ্টিতে ভিজতে না দেখি।এই একদম ডং করে কাদঁবিনা।সন্ধ্যায় বই খাতা নিয়ে চলে আসবি। যা এখন।

চাঁদের সাদা হাত দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।চাঁদ আর মাথা নিচু করে রাখলোনা।

-আপনি অনেক পচাঁ আবির ভাই বলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

আবির একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে।আর বিরবির করে বললো,

“তোমার ভালোর জন্য যে আমাকে খারাপ হতেই হয় প্রিয়।”

(চলবে কি?)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here