পদ্মপাতা পর্ব ২০

#লেখিকা-আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২০
#পদ্মপাতা

৫৮.
আজ চাঁদের এসএসসি পরীক্ষার প্রথমদিন। তবে সে একাই পরীক্ষার হলে এসেছে। আবির ফোন করে টুকটাক কথা বলেছিল। বড়মামা তো পঞ্চাশ টাকা হাতে দিয়েই দায়সারা। দায়িত্ব পালন শেষ উনার। চাঁদের সাথে কেউ আসেনি। সে একাই এসেছে। নানুমা আসতে চেয়েছিলো। তবে চাঁদ মানা করে দিয়েছে। বাবা-মা বেঁচে থাকলেও কি এমন হতো?
পরীক্ষার হলের সামনে এসে যখন দেখলো বাবা-মা নিয়ে এসেছে ছেলে-মেয়েদের । তখন বড্ড কষ্ট লাগলো চাঁদের। তবে তার নিয়তি তো নির্মম। সে তো এতিম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হলে ঢুকলো চাঁদ।

পরীক্ষা মোটামোটি ভালোই হলো চাঁদের। আজ বাংলা পরীক্ষা ছিলো। এমসিকিউ মিলিয়ে দেখলো সাতাশটা সঠিক। সৃজনশীলও সে পূর্ণাঙ্গ দিয়ে এসেছে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।

সময়টা বিকাল। গোসল সেরে টিবিলে বসে পড়ছে চাঁদ। তখন ফোন বেজে উঠলো। আবির ফোন করেছে। চাঁদ সালাম দিলো। আবির সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-আজ বাংলা পরীক্ষা ছিলোনা?
-জ্বি।
-কেমন হয়েছে? সব দিতে পেরেছিস?
-সব তো দিয়েছি। বাকীটা দেখা যাক।
-শোন মন দিয়ে পরীক্ষা গুলো দে। মন খারাপ করে থাকিস না।
-হুমম। খেয়েছেন আপনি?
-খেয়েছি। তুই খেয়েছিস?
-হ্যাঁ। কবে আসবেন আবার?

চাঁদের কন্ঠ ভেজা। চোখে অশ্রু।

-খুব ব্যস্ত আছি পাখি। জান কান্না করেনা। কিছুদিন পরই আসবো।
-আমার যে কিছু ভালোলাগে না।
-এভাবে বললে কিন্তু এখনই চলে আসবো।
-আসেন। খুশি হবো।
-সত্যি?
-না, থাক।

কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দেয় চাঁদ। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে। মনের মাঝে উঁকি দেয় কিছুদিন আগের সুন্দর একটা স্মৃতি।
________________

আবিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আবির আর চাঁদ। বারান্দা থেকে ধুরী দিঘী দেখা যায়। সময়টা হেমন্তকাল। ধুরী দিঘী জুরে নিজেদের দাপট দেখাচ্ছে শতখানেক পদ্মফুল ও তাদের পাতার দল। সবুজের মাঝে গোলাপি, হলুদ, সাদা পদ্মফুলগুলোকে রাণী মনে হচ্ছে। দিঘীতে পানির দেখা নাই। খালি রয়েছে সারি সারি পদ্মপাতার দল। চাঁদ গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। আবির কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে এবার চাঁদের দিকে তাকালো।
– কি দেখিস চাঁদ?
– পদ্মফুল দেখি। কত সুন্দর!
– তুই আমার পদ্মপাতারে চাঁদ।

চাঁদের কপালটা কুঁচকে গেলো। পদ্মফুল বললে মানতো। তাই বলে পদ্মপাতা।

– আমি কি অসুন্দর?
– কেন?
– পদ্মপাতা বললেন যে।
– তুই তাহলে বুঝিসনি।
– বুঝিয়ে বললেই তো হয়।
– তুই আগে বল পদ্মফুল তোর নজর কেড়েছে না পদ্মপাতা?
– এটা আবার কেমন কথা আবির ভা

আবির এবার চোখ রাঙালো চাঁদকে। চাঁদ একটা ভ্যাবলা হাসি দিয়ে বললো,
-না মানে ভাই ডেকে অভ্যাস তো তাই।
-বুঝলাম। আমার প্রশ্নের উত্তর দে।
-আমার নজর কেড়েছে পদ্মফুল। কারণ পদ্মফুল বেশি সুন্দর।
-আমি যে চাইনা আমার সম্পদে কেউ নজর দিক।
-কি বলছেন। একটু বুঝিয়ে বলুন না।
-পদ্মফুল সুন্দর। সবাই তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হাত বাড়ায় তার দিকে। তবে আমি যে চাইনা আমার প্রেয়সীকে কেউ নজর দিক। আমার প্রেয়সী সকলের মাঝে অনন্য। তাকে কেবল আমি চিনবো। এই যে এতো এতো সবুজ পাতা দেখছিস। এগুলোর মাঝে একটা বিশেষ পাতা আছে। যেই বিশেষ পাতা কেবল আমিই চিনবো আর কেউ না। এতো এতো পাতার মাঝে চোখ বুজেও তাকে আমি খুঁজে পাবো আমার মনের চোখ দিয়ে। যা আর অন্য কেউ পাবেনা। আমি চাইনা আমার প্রেয়সী নিজের সৌন্দর্য সবাইকে দেখিয়ে বেড়াক৷ আমি শুধু তাকে দেখবো। সে পদ্মফুল না সে আমার পদ্মপাতা। যাকে কেবল আমি পাবো। হাজার হাজার পাতার ভিড়ে কেবল আমি পাবো তাকে। শুধু আমি চিনবো আর আমি দেখবো। এটা যদি আমার হিংসা হয় তাহলে তাই।
-আপনি একটা পাগল।
-শুধু তোর।

৫৯.
কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলো চাঁদ। কল্পনাগুলো এতো মধুর হয় কেনো?

পরীক্ষার সময় কেটে গেলো অতিদ্রুত। ব্যস্ততার মাঝে চাঁদও নিজের দুঃখ ভুলে মনোযোগী হয় পরীক্ষায়। পরীক্ষা শেষ সাথে প্রাকটিকালও। চাঁদ যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচল। মাথা থেকে বোঝা নামলো তার।

আমবাগানের মোটা আম গাছটার নিচে শিকড়ে বসে আছে চাঁদ। বিকালের ঝিরিঝিরি বাতাস ভালোই লাগছে তার। অমনি লম্বা বিনুনিতে টান পেলো চাঁদ। নিশ্চয়ই পচু দিয়েছে। যা দুষ্টু ছেলেটা।
-পচুরে ছাড় বলছি।

তবুও ছাড়লোনা। চাঁদ এবার ঘাড় ঘুরিয়ে বলতে গেলো,
-থাপড়ে দাঁত

তবে আবিরকে দেখে থেমে গেলো সে।
-বাহ্ বাহ্। আমার হরিণী দেখি বাঘিনী।
-আবির ভাই আমার চুল ছাঁড়েন।

আবির আরো জোরে টেনে বললো,
-কি বললি।
-ভুল হইছে। মাফ করেন। চুল ছাঁড়েন না।
-আবার যদি ভাই শুনিরে চাঁদ তোর গাল আমার হাত। মানুষ শব্দ শুনবে ঠাস ঠাস।

চাঁদ এবার বিড়বিড় করে বললো,
-এই যে আবার আগের রূপে ফিরে এসেছে। এই খাটাশ লোক ভালো হবার নয়।
-কি বললি।
-কিছুনা।
-এই বিকেলে তুই এখানে কি করিস। এই তুই সত্যি চাঁদ তো। নাকি চাঁদ রুপী পেত্নী।
-পেত্নীই তো এখন আপনার ঘাড় মটকাবো। তার আগে বলেন আপনি যে আসবেন আমাকে বললেন না কেন। আপনি লোকটা খারাপ।
-অনেক খারাপ। পা দেখি তোর। সিউর হই তুই পেত্নী কিনা।
-যান আপনার সাথে কথা নাই।
আবির এবার চাঁদের সামনে হাঁটুমোড়ে বসে বললো,
-পা দেন মহারাণী।
-কি করবেন?
-বেশি কথা বলিস তুই।
আবির নিজেই চাঁদের ডান পাটা নিজের হাঁটুর উপর উঠালো। অতঃপর পকেট থেকে একজোড়া স্বর্ণের চিকন পায়েল বের করলো সে। চাঁদের পায়ে অতি যত্নে পরিয়ে দিতে লাগলো আর বলে গেলো
-দেখতো পছন্দ হয়েছে কিনা। ভাবিস না বাবার টাকা দিয়ে কিনি নাই। নিজে টাকা জমিয়ে কিনেছি। পরশুদিন তো চলে যাবো। কবে আসবো জানিনা। তাই একেবারে বন্দোবস্ত করে গেলাম। ভালো হইছে না।

আবিরের পায়েল পড়ানো শেষ। চাঁদের আগের নুপুরগুলো অভ্যাসমতো নিজের পকেটে নিয়ে নিলো। চাঁদ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। লোকটা এতো পাগলাটে কেনো। চাঁদের দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে তা সুখের না দুঃখের চাঁদ জানেনা।

৬০.
পরেরদিন আবির,চাঁদ,রুমা, দিমা মিলে ঘুরলো অনেকটা সময়। আবিরও নিজের জন্মস্থান চাঁদপুরটাকে ভালো করে দেখে নিলো। এসময়টা আর হবে কিনা জানা নাই।

বিকালে সোফায় বসে গল্প করছে বাড়ির সবাই। আবির,আনোয়ারা,করিম,মতিন,মোহনা,তিলোত্তমা, চাঁদ,রুমা,দিমা। রহিমা আর পচুও বসে আছে। রহিমা এ বাড়িতেই থাকেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুর বাড়ি, বাবার বাড়ি কোথাও যখন স্থান হলোনা তখন আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা রহিমার স্থান হলো চৌধুরী বাড়ি। আর সেই থেকে সে এখানেই আছে।

আড্ডার পাশাপাশি চললো মুড়ি মাখানো। মোহনা তো কেঁদে দিয়েছেন দুইবার। একটামাত্র ছেলে তাও পাড়ি জমাবে বিদেশ। মতিন বরাবরের মতোই চুপ।কাজলের এখনো বেল হয়নি। করিম দৌড়াদৌড়ি করছেন। কেসটা মূলত স্ত্রী হত্যার।

সবাই ঘরে চলে গেলো। আগামীকাল দুপুরেই আবির ঢাকা চলে যাবে। দুইদিন পর তার ফ্লাইট। চাঁদ সারাদিন হাসি খুশি থাকলেও। সময় যতো ঘনিয়ে আসছে ততো মন খারাপ বাড়ছে তার৷ কেনো হলো এতো ভালোবাসা? এই ভালোবাসা যে খালি পুড়ায়।
চারদিকে মেঘ গর্জন করছে। এই অসময়ে মেঘ কেনো? চাঁদের মনের মাঝে একবার উঁকি দিলেও আবার সেই বিষাদ ছেয়ে গেলো। প্রিয় মানুষ দূরে যাওয়ার বিষাদ। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে হয়তো। ঘুম নেই চাঁদের চোখে। এমন সময় দরজায় টোকা পরলো। চাঁদ দরজা খুলে দেখলো আবির।
আবির ভিতরে ঢুকে বললো,
-সারাদিন তো ভালোই ছিলি। আবার মুখে অম্যাবস্যা কেন?
-জানিনা।
-মন খারাপ করিস না চাঁদ। আমার জানপাখি না তুই। তোকে এভাবে দেখে যে আমি থাকতে পারিনা।

চাঁদ চুপ। কোনো কথাই তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।
-কথা বলবি না চাঁদ। আমি কিন্তু কাল চলে যাবো।

চাঁদ তখনো চুপ। আবির এবার রাগ করে উঠে চলে গেলো নিজের ঘরে। তার দোষটা কোথায়?
চাঁদ কতোক্ষণ থম মেরে নিজের খাটে বসে রইল। এখন তার নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত চাঁদ।

আবিরের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। বারান্দা থেকে বেরিয়ে ঘরের দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলো চাঁদ। আবির তাকে দেখে টেবিলের পাশটায় জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।
-কথা বলবেন না।
আবির ওপাশ ফিরে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। চাঁদ কিছু ভেবে না পেয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আবিরকে।
-এবারো কথা বলবেন না।

চাঁদ এবার আবিরের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ালো। শিউরে উঠলো আবির। চাঁদ লজ্জায় সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আবির পিছনে ফিরে চাঁদের কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিলো। অতঃপর তার অধর ছোঁয়ালো চাঁদের শুষ্ক অধরে। চাঁদ চোখ বুজে অনুভব করলো তা।
-চাঁদ তুই ঘরে যা।
-না।
-কিছু একটা হয়ে যাবে।
-হতে দিন।

প্রিয়তমার ডাকে আর সাড়া না দিয়ে পারলোনা আবির। কোলে তুলে নিলো তাকে। হোক না একটু ভুল। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। হাওয়া বইছে মৃদু। কবুতরের টিনের ঘরের চালটায় বৃষ্টি পড়ে শব্দ হচ্ছে টপ টপ টপ।

(চলবে)…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here