পূর্ণতা নাকি শূন্যতা পর্ব -১১

#পূর্ণতা_নাকি_শূন্যতা
#রেজওয়ানা_রমা
#পর্ব_১১

সন্ধ্যায় নোভাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। সাথে লামু, মিতু, তৌহিদ, তৌফিক সবাই আছে। আর ওদিকে বড় মা, বড় বাবা, আম্মু,আব্বু, ফুপি, মামিমা সহ বাড়ির সবাই কাজে ব্যস্ত। বিয়ে বাড়ি বলে কথা কাজ কি কম। রান্নার মসলাগুলো বাটা, শুকনো মসলা গুড়া করা, খাবারের মেনু তৈরী করা, আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করা সহ আরো কত কাজ। তবে আমাদের বাড়ি টা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। পুরো বাড়ি টা আলো আর আলো। এমন কি বাগানেও লাইটিং করেছে। একদম অন্য রকম লাগছে। বিয়ে বিয়ে একটা আমেজ এসেছে যেন। আমার বিয়ে এভাবে এতো টা বড় করে হবে ভাবতে পারি নি। সব কিছুই সুন্দর ভাবে হচ্ছে। কিন্তু এতো সুখ আমার সইবে তো? আড্ডায় সবাই ব্যস্ত থাকলেও আমার মন সিদ্ধাত ভাইয়া কে মিস করছে। এতো হইচই এর মাঝেও সিদ্ধাত ভাইয়ার শূন্যতা অনুভব করছি। সবার মাঝখান থেকে উঠে এলাম নিজের ঘরে। বেলকানি তে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আর সিদ্ধাত ভাইয়ার কথা ভাবছি। তখনই তৌহিদের প্রবেশে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসি।

– ঈশা আপুই
-হুম বলো মাই ডিয়ার লিটিল বয়ফ্রেন্ড
– আপুই তুমি চলে যাবা তাই তোমার মন খারাপ?
– কই না তো। মন খারাপ হবে কেন
-তাহলে তুমি এখানে একা একা কি করছো?
– কিছু না। এই তো এমনি ছিলাম আর কি
– ঈশা আপুই তুমি কি বিয়ের পর আমাদের ভুলে যাবা না তো?
– ধুর পাগল ভুলবো কেন?
– তুমি কি আমাদের সবাই কে মিস করবা?
– হুম করবো তো। তুই,আম্মু, আব্বু, ফুপি, মামিমা, লামু, মিতু, তৌফিক তোদের সবাই কে খুব মিস করবো রে
– আমিও তোমাকে খুব মিস করবো ঈশা আপুই। আমরা এখন যেমন আছি এমন আর হবে না তাই না ঈশা আপুই। তুমি বিয়ের পর এবাড়ি তে আর তেমন আসবেও না। আমাদের কে আগের মত সময় ও দেবে না তাই না?
– কে বলেছে পাগল ছেলে। আমি সব সময় আসবো। আর আগের মত তোদের সময়ও দেবো।

তৌহিদ এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি একটু বেশিই অবাক হয়েছি। কারণ ও কাদছে। তৌহিদ আর তৌফিক দু’ভাই সারাক্ষণ আমার পিছে লাগে। সব সময় চাইছে আমার বিয়ে হয়ে যাক। আমার বিয়ে নিয়ে ওরা অনেক বেশি খুশি ছিল। কিন্তু হঠাৎ কি হলো? ও কাদছে কেন। কিছু বুঝতে না পেরে ওকে স্বান্তনা দিলাম

– কি হয়েছে কাদছিস কেন? আরে বোকা আমি কি সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি নাকি। আমি তো আবারও আসবো। আর বড় মা, বড় বাবা কি আমাদের পরিবারের বাইরে নাকি। আমি তো আমাদের পরিবারের মধ্যেই থাকবো। আমার কথা শোন উঠ কান্না বন্ধ কর। এই তুই না ছেলে মানুষ। তো ছেলেরা কি এমন ভ্যা ভ্যা করে কাদে?
– কিহ! আমি ভ্যা ভ্যা করে কাদছি? ( আমাকে ছেড়ে চোখ মুছতে মুছতে)
– তা নয় তো কি? রাম ছাগলের মত ভ্যা ভ্যা করে কাদছিস
– ঈশা আপুই ভালো হবে না কিন্তু
– ভ্যা ভ্যা
– ঈশা আপুই
– আজকের ব্রেকিং নিউজ তৌহিদ ভ্যা ভ্যা করে কাদে ( জোরে চিল্লিয়ে বললাম)
– ঈশার বাচ্চা। আজকে তোমার খবর আছে

বলেই তৌহিদ আমাকে তাড়া করলো। আমিও ছুটে বাইরে এলাম। তৌহিদ আমার পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। আর আমাকে ধরতে পার কি কি করবে সেগুলোই বলছে। আপনারাই শুনে নিন ওর মুখে

– আজকে খালি ধরতে পারি তোমায় দেখো কেমনে ছাদে নিয়ে কাকতাড়ুয়া বানাই, খালি একবার ধরি দেখো রহিম চাচার পুকুরের পচা পানিতে কেমনে গোসল করাই, তোমার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দেবো।

ওর এমন সব কথায় আমি সহ সবাই হাসছে। অবশেষে আমাকে ধরতে না পেরে বলে,

-ওই যে রাস্তার পাশে ঝান্ডুর দোকানের বাসি বিস্কুট দিয়ে নাস্তা দেবো কাল তোমায়।

এর এই কথায় আমি ফিক করে হেসে দিলাম। পাগল ছেলে। যাক তাও ভালো অবশেষে মন টা তো ভালো করতে পেরেছি। আর তৌহিদ ক্লাস ফাইভে। ভাই বোন দের মধ্যে ও সবার ছোট। লামু আর মিতু একটা ইন্টার ফাস্ট ইয়ার আর একজন সেকেন্ড ইয়ার। আমরা সবাই ই প্রায় সমবয়সী এই জন্য কাজিনদের আড্ডা টা জমে খুব। বিয়ে উপলক্ষ্যে সবাই এক হয়েছি নয়তো এতো মজা খুবই কম হয়। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম।সিদ্ধাত ভাইয়ার কথা এবার খুব মনে পড়ছে। আজকে একাই ঘুমাতে হবে। সিদ্ধাত ভাইয়ার কথা ভেবে লাভ নেই।

☆☆ দিন পেরিয়ে রাত এলো। বাড়িতে প্রচুর কাজ। সারাদিন বাড়ির কাজের চাপে ঈশার সাথে কথা বলার সময় টুকু পাই নি। কে জানি রেগে ফুলে বসে আসে কিনা। এতো রাতে ঈশা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ফোনেও পাবো না। তাই বাধ্য হয়ে ওর একটা ছবি বের করে দেখছি। আমার মায়াবিনী টা আসলেই অনেক সুন্দর। চোখ গুলো টানা টানা। কাজল দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। একদম হরিণী চোখ। মুখে একটা মায়া রয়েছে। এই মায়ায় যে পড়েছে সে আর কখনো উঠতে পারে নি। আসলে যদি বলি ও সুন্দর বলে ওকে ভালোবাসি তাহলে ভুল বলা হবে। ভালোবাসি শুধু সেই ছোট থেকে। তখন ও একদম ছোট্ট। তখন এই সৌন্দর্য ছিলো না। তবুও ওর প্রতি একটা মায়া আমার ছিলই। আর এখন বড় হয়েছে এখানো সেই মায়া টা রয়ে গিয়েছে। আর এখন বেশ সুন্দর ও হয়েছে। ঈশা শুধু সুন্দরী নয়, বেশ গুনোবতীও বটে। অনেক কিছু পারে ও। বাচ্চা বাচ্চা স্বভাব হলে কি হবে গুন আছে। ওর গানের কণ্ঠ অনেক বেশি সুন্দর। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সব খানেই ওর গানের জন্য নাম আছে। আর দুই দিন পর ঈশা আমার। আমার অপেক্ষার শেষ হবে। ঈশা কে নিজের করে পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। নিজের ভালোবাসার মানুষ কে বিয়ে করতে পারা টা অনেক বেশি আনন্দের। কাল সন্ধ্যায় মেহেন্দি আর সংগীত অনুষ্ঠান করতে বলবো। পরশু গায়ে হলুদ, তার পর বিয়ে। এতো এতো নিয়ম মেনে এতো অনুষ্ঠান করার দরকার নেই। ঈশা কে ছাড়া থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ভাবছি কালকের মধ্যেই পুরো বাড়ি সাজিয়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজন আরো বেশি লোক কাজ করবে তাও কালকের মধ্যেই সব শেষ করতে হবে। আজকে প্যান্ডেলের লোকও এসেছিল। ঈশাদের মত আমাদের ও বাইরে প্যান্ডেল করা হয়েছে। তবে প্যান্ডেলের কিছু কাজ এখনো বাকি। কাল থেকে ভালো ভাবে কাজ শুরু হবে। আজ রাতে আর আমার ঘুম হলো না। ভোর চার টা বাজে। একটু পরে আজান দেবে। তার পর প্যান্ডের লোক আসবে, বাড়িতে কাজের ধুম পড়ে যাবে। চারিদিকে হইচই হবে। উফফ আর জাস্ট দু’টো দিন পর ঈশা চিরকালের জন্য আমার হবে। আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। আমি প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেবো। আমার পৃথিবী রঙিন হয়ে উঠবে ঈশার ভালোবাসায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এ দীর্ঘশ্বাসের সাথে যেন অনেক টা ক্লান্তিভার অপেক্ষার প্রহর চলে গেলো। আজান দিলো। পুরো রাত টা ঈশা কে ভেবেই কাটিয়ে দিলাম। শুধু একটা রাত নয় কয়েক হাজার দিন রাত কাটিয়ে দেওয়া যাবে শুধু ওকে ভেবে। যত ভাবি তত ভালো লাগে। না আসে কোনো বিরক্তি , না আসে কোনো ক্লান্তি, ঈশা কে ভেবে সময় কাটাতে গেলেও সময় দ্রুত চলে যায় ওকে নিয়ে আমার ভাবনা শেষ হয় না। কি যে আছে ওর মধ্যে। ভোর হয়ে এলো। দেখতে দেখতে সূর্য ও উঠে পড়লো। আমি পুরো রাত টা নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম। প্রতিদিনের মত পুশআপ দিয়ে গোসল সেরে নিচে এলাম। আমার নিচে আসতে দেরি কিন্তু বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড়ে দেরি নেই।

আমার চাচ্চু, বড় ফুপা, ছোট ফুপা, বড় মামা, ছোট মামা, সবাই বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। কি কি কিনতে হবে, কি কেনা হয়েছে, বাড়ি কিভাবে সাজাবে, এখনো কাদের কে নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া বাকি এসবই আলোচনা করছে। আর অন্য দিকে আম্মু, বড় ফুপি, ছোট ফুপি, মামনি, বেলী আপু, কনা আপু ওনাদের ছেলে মেয়ে সবাই এক সাথে কাজ করছে। কেউ কিচেনে খাবার তৈরী তে ব্যস্ত, তো কেউ বিয়ের মসলা পাতি নিয়ে। বাড়ির সার্ভেন্ট গুলো ও দৌড়ের ওপর। বেলি আপু আমার বড় ফুপির মেয়ে। আর কনা আপু ছোট ফুপি মেয়ে। বেলি আপু, কনা আপু দুইজনি আমার বয়সে অনেক বড়। দুইজনই বিবাহিত। বেলি আপুর ছেলে আয়ান, আর কনা আপুর মেয়ে আলিশা। আমরা কাজিনরা এই তিন জনই। যাই হোক, এখন সিফাতকে বাড়ির দিক দেখা শোনা করতে দিয়ে আমাকে ঈশার কাছে যেতে হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে কিছু কাজ সেরে যেতে হবে। আগে গেলাম আব্বুর কাছে ।

সিদ্ধাত: আব্বু
আব্বু: আরে সিদ্ধাত এসো এসো।
আমি: আব্বু একটা কথা ছিল
আব্বু: হ্যাঁ বলো না
সিদ্ধাত: বিয়ে তো তোমরা আগামি শুক্রবার ঠিক করেছো। তাই না
আব্বু: হ্যাঁ বাবা। কেন কোনো সমস্যা?
আমি: বিয়ে টা এগিয়ে আনলে হয় না?
বড় ফুপা: কি হয়েছে? শুক্রবার বার বিয়ে হলে কি আপত্তি আছে?
আমি: হ্যাঁ ফুপা। আমি চাই আজকেই মেহেন্দি আর সংগীত হয়ে যাক। কাল গায়ে হলুদ পরশু বিয়ে
ছোট মামা: এতো তাড়া কেন? আস্তে ধীরেই সব হচ্ছে হোক
আব্বু: হ্যাঁ সেটাই তো। বাড়িতে এখনো কত কাজ। কিছুই গুছিয়ে উঠা হয় নি।
আমি: আমি যা বলেছি সেটাই হবে। এটাই আমার শেষ কথা। আর কিছু শুনতে চাই না ( বলেই উঠে এলাম)
আব্বু: বললেই হয়ে যায়? এই ছেলে টা এমন হয়েছে কি বলবো। এতো তাড়াহুড়ো করে কি শুভ কাজ হয়। কি যে করি না
ছোট মামা: দুলাভাই আপনি চিন্তা করবেন না। সব হয়ে যাবে। আমি যাই দেখি প্যান্ডেলের লোকজনের সাথে কথা বলে আসি কত দূর কি হলো।
বড় মামা: আমিও যাই তাহলে বাজার থেকে জিনিস গুলো নিয়ে আসি
আব্বু: হ্যাঁ যাও যাও।
বড় ফুপা: তাহলে আমরা নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দেই বাকিদের কে।
আব্বু: হ্যাঁ দিন।

সবাই আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে গেল এবার। সিফাত কে লাত্তি দিয়ে ঘুম থেকে তুললাম। ঘুমের মধ্যে লাথি খেয়ে তারাতারি উঠে বসে,

– কি কি কি হয়েছে? মারছিস কেন?
– নেশা করে ঘুমাচ্ছিস নাকি? কয়টা বাজে?
– কয়টা বাজে?
– সকাল ১০ টা
– ঘুমিয়েছি তো একটু আগে
– সারারাত কি করেছিস?
– কথা বলেছি
– সারা রাত?
– হুম ( ঘুমে টলতে টলতে )
– আর এখন ঘুমাচ্ছিস? ( রেগে)
– এখন তো ভোর
– হ্যাঁ ভোর। তোর কাছে। এখন এই ভোরে যদি তুই না উঠিস তো
– তো কি
– তোর বউ নিয়ে ভেগে যাবো। ( ফোন টা নিয়ে)
– আরে ফোন টা দে
– না। উঠে ফ্রেস হয়ে আয়। তোর অনেক কাজ আছে।
– ধ্যাত বা*ল
– যাবি?
– যাইতেছি

সিফাত বাধ্য হয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল। বের হলে ওকে নিয়ে বাড়ির সব কাজ বুঝিয়ে দিলাম।

– ঠিক আছে এদিক টা এখন তুই দেখ। আমি আমার দিক টা দেখে আসি
– ফোন টা দিয়ে যা
– সারা রাত প্রেম করেছিস। আর সারাদিন কাজ করবি।
– করবো বাট ফোন টা দে
-ফোন দিয়ে গেলে এদিকের কাজ কিছুই হবে না তাই নিয়ে গেলাম। বাইইইই
– ধ্যাত শালা ভাল্লাগে না ভাবলাম একটু গুড মরনিং জানাবো। ধুরু কিছুই হলো না।

আমি গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ঈশার কাছে। বাড়িতে ঢুকে দেখি বাড়ির মানুষ সবাই ব্যস্ত। আমাদের বাড়ির মত। সবাই ছোটাছুটি করছে। সিড়িতে নোভার সাথে দেখা,

নোভা: আরে ভাইয়া আপনি? একটা দিন বউ কে না দেখে কি থাকা যায় না?
আমি: একটা দিন তো অনেক। একটা মুহূর্ত ও থাকা যায় না। এখন বলো কোথায় তিনি?
নোভা: ইসস কি ভালোবাসা গো। আপনার তিনি তার রুমেই আছে।
আমি: ওকে

আমি সোজা ঈশার রুমে চলে এলাম। কিন্তু রুমে এসে দেখি রুমের কোথাও ঈশা নেই…….
.
.
.
.
.
.
.
.
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here