প্রণয়ের সূচনা পর্ব -১৬

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৬
____________________________
হসপিটালের করিডরে সবার অবস্থান। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিঃসৃত হচ্ছে। ইরাদের জ্ঞান ফিরেছে। তখন নিহাদ ফোন করে এটাই জানিয়েছে।তারপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটেছে সবাই হসপিটালের উদ্দেশ্যে।আফরিন বাসায় রিশা আর হৃদুকে নিয়ে।মিসেস আফরোজা অধীর অপেক্ষায় বসে আছেন করিডরে সারি করে রাখা চেয়ারে।তার পাশে আরহাম সাহেব, মিসেস দিশা। আর সূচনা দাড়িয়ে আছে তার মায়ে’র পাশে।প্রণয় আর নিহাদ ফার্মেসি তে গিয়েছে ঔষধ পত্র আনতে ঘন্টাখানেক পরেই কেবিনে দেয়া হবে ইরাদকে।
.
.
কেবিনে দেয়া হয়েছে ইরাদকে।মিসেস আফরোজা ইরাদের হাত ধরে বসে আছেন আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছেন।ইরাদকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে তাই কিছু বলতেও পারছেনা।মিসেস দিশা ইরাদের বেডের আরেক পাশে বসে আছেন টুল টেনে। সূচনা ভেতরে যায়নি।সে মুখোমুখি হতে চায় না এখন।একটু পর মিসেস দিশা কেবিন থেকে বের হলেন। ব্যস্ত গলায় সূচনাকে বললেন-

–‘তাড়াতাড়ি বাসায় চল সূচি, রান্না করতে হবে। আপা,নিহাদ রাতে হসপিটালে থাকবেন বলছেন,খাবার পাঠাতে হবে তাদের জন্য।

–‘মামী কিছু করতে হবে না।কিনে খেয়ে নিব, আর রাতের বেলা অত কিছু খাওয়া লাগবেনা।আপনি ব্যস্ত হবেন না।

–‘নাহ আমি রান্না করে পাঠাচ্ছি। প্রণয় তো যাবে এখন নিয়ে আসবে।

বারবার বলার পরে মিসেস দিশা রাজি হলেন।এখন বাসায় যেয়ে রান্না করা তারপর নিয়ে আসা টা অনেক সময়ের ব্যাপার।প্রণয়ের সাথে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে গেলেন আরহাম সাহেব, সূচনা আর মিসেস দিশা।পেছনের সিটে মিসেস দিশা আর সূচনা।ড্রাইভিং সিটে প্রণয় আর তার পাশে আরহাম সাহেব। সময়টা এখন রাত সাড়ে আটটা প্রায়। শুক্রবার আজকে, আর বরাবরের মতোই শুক্রবারে ঢাকা শহরে জ্যামটা একটু বেশিই হয়। লম্বা জ্যাম ঠেলে বাসায় পোঁছাতে পোঁছাতে সাড়ে নয়টা বেজে গেল।কলিং বেল বাজাতেই আফরিন দরজা খুললো সাথে সাথে। হৃদু ছিল তার কোলে।প্রণয়কে দেখেই লাফ দিয়ে চলে গেল তার কোলে।কিন্তু প্রণয় আটকে দিল। কোমল স্বরে বললো-

–‘আমি হসপিটাল থেকে এসেছি পাখি,আমার হাতে জা/র্মস আছে। এখন তোমাকে কোলে নিলে সেগুলো তোমার কাছে চলে যাবে। আগে জার্মস ক্লিন করি তারপর কোলে নিব।

হৃদু মাথা নাড়িয়ে আধো আধো বুলিতে বললো-

–‘ঠিক আতে যাও।

মিসেস দিশা আর আরহাম সাহেব রুমে চলে গেলেন।প্রণয় ও চলে গেল।সূচনা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়লো সোফায়।আফরিন তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো-

–‘ফ্রেশ হবে না?

–‘হ্যা হব।

–‘তোমার ভাইয়া ফোন দিয়েছিল,বললো ইরাদের কথা।আমার মাথায় একটা জিনিস ঢুকছে না এত রাতে ও একা বাইরে গেল কেন?যদি বন্ধুদের সাথে যেত তাহলে একটা কথা ছিল।কিন্তু একা গিয়েছে। ও তো এমন করে না কখনো।

সূচনা চোরা চোখে তাকালো আফরিনের দিকে।তার মুখ পানেই তাকিয়ে আছে আফরিন।মুখশ্রীতে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ।সূচনা থমথমে গলায় বললো –

–‘আমিও তাই ভাবছি ভাবি।কখনো তো শুনিনি যে ভাইয়ার রাত বিরাতে বাইরে থাকার বদঅভ্যেস আছে।তাহলে কেন যে কালকে গেল।

–‘ তা তো ইরাদ ই বলতে পারবে।তবে এখন ও যে সুস্থ আছে এটাই আলহামদুলিল্লাহ।যাক গে তুমি ফ্রেশ হতে যাও।

–‘হ্যা
.
.
ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে মিসেস আফিয়া কে ফোন করলো সূচনা।সেই দুপুরে কথা হয়েছিলো।উনিই কল করে করে খবর নিয়েছেন।সারাদিনে তো ঠিক করে কথা বলার সুযোগ হয়নি।একবার রিং হতেই রিসিভ করলেন মিসেস আফিয়া,যেন ফোন হাতে নিয়েই ছিলেন সূচনার কলের অপেক্ষায়। সূচনা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘ আসসালামু আলাইকুম মামী।

–‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম,তোকেই ফোন দিতাম এখন।তোর ফুপাতো ভাইটা এখন কেমন আছে?বাসার সবাই ঠিক আছে?

–‘জ্বি সবাই ঠিক আছে আর ভাইয়াও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে এখন।

মিসেস আফিয়া যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।বললেন-

–‘যাক আলহামদুলিল্লাহ।

–‘ইরা,তিথি ওরা কোথায়?

–‘তিথি তো পড়ছে,ইরা এতক্ষণ আমার কাছেই ছিল এখন তিথির রুমে।দিনার শরীরটা একটু খারাপ তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

–‘কী হয়েছে আপুর?

–‘তেমন কিছু না,হালকা জ্বর আর মাথা ব্যথা।

–‘আচ্ছা।

–‘হ্যা।

–‘মামা বাসায় এসছেন?

–‘হ্যা। প্রণয়কে ছাড়া ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ঘর দোর।তুইও ছিলি আর কালকে তো মিহুও ছিল।

হালকা হাসলো সূচনা।বললো-

–‘কালকে চলে আসব।

–‘আমি আসতে বলিছি তোকে?

–‘না বলেননি তো।

–‘তাহলে?

–‘না মানে,

–‘বেশি বুঝিস।এখন এখানে থাকার চেয়ে তোর ওখানে থাকাটা বেশি জরুরি।এখন তোর পরিবারের মানুষদের তোকে দরকার।যখন সব ঠিক হবে তখন আমিই বলব প্রণয়কে তোকে নিয়ে আসতে।প্রণয়ের কাছ থেকে তো জানবই আমি।বুঝেছিস?

সূচনা নিচু স্বরে বললো-

–‘জ্বি।

–‘হুম,,শোন অনিয়ম করবি না একদম,কোনো সমস্যা হলে বা কিছু লাগলে আমাকে বলবি কল দিয়ে। ঠিক আছে?

–“জ্বি,, আপনিও কোনো অনিয়ম করবেননা। আনি ফোন দিব।

–‘আচ্ছা এখন তাহলে রাখি।

–‘জ্বি,, আসসালামু আলাইকুম।

–‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম।

ফোন রেখে লম্বা করে শ্বাস নিল সূচনা।সে ভেবে পেল না মানুষগুলো তাকে চেনেই না ক’দিন ধরে,অথচ তাদের ব্যবহার এমন যে মনে হয় কত আগের চেনা পরিচিত সে।কত তাড়াতাড়ি আপন করে নিয়েছে তাকে।ভাবতেই প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো, এমন পরিবার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার আজকাল।
.
.
–‘আপনি এখন আবার যাবেন?

প্রণয়কে তৈরী হতে দেখে প্রশ্ন করলো সূচনা।প্রণয় শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে জবাব দিল-

–‘হ্যা নিহাদ ভাই আর ফুপি তো একা।

–‘রাতে ওখানে থাকবেন কীভাবে তিনজন?

–‘ সমস্যা নেই এক রাতের ব্যাপার।

–‘অসুস্থ হয়ে যাবেন।

–‘সমস্যা নেই এখন বউ আছে।

–‘বউ অকর্মার ঢেকি।কিছু করতে পারেনা।

–‘তাতেও সমস্যা নেই,সব শিখিয়ে দিব ধীরে ধীরে।কিপ পেশেন্স।

সূচনা আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কী শিখিয়ে দিবেন?

ভ্রু কুটি করল প্রণয়।জিজ্ঞেস করলো-

–‘আসলেই জানতে চাও?

সূচনা মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললো-

–‘হুম।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে প্রণয় এক ঝটকায় দাঁড়ালো সূচনার সম্মুখে।একেবারে মুখোমুখি দু’জন। সূচনা ভড়কে গিয়ে পিছিয়ে গেল দু কদম।প্রণয়ের ঘোর লাগা দৃষ্টি সূচনার মুখে,ঠোঁটে।লজ্জা আর ভয়ে মিইয়ে গেল সূচনা।না চাইতেও চোখে মুখে লাজুকতা ধরা দিল।বু/কের ভেতর অস্বাভাবিক রকমের ধুকপুকানির সুর উঠল তার।হাত, পা যেন জমে গেছে সেখানেই।সূচনার মুখের উপর ঝুঁকে প্রণয়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার কম্পনরত ঠোঁট জোড়ায়।বা’কা হাসলো প্রণয়।আরেকটু ঝুঁকতে ই ভয় পেয়ে গেল সূচনা।সূচনার মুখে জোরে ফু দিতেই আখি জোড়া বন্ধ করে নিল সে। মিনিট দুয়েক বাদেও যখন কোনো কিছুর টের পাওয়া গেল না তখন চোখ খুললো সূচনা।দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে প্রণয়।মুখে সেই বা’কা হাসি। তাকে তাকাতে দেখে প্রণয় দুষ্টুমির স্বরে বললো-

–‘ কী ভাবছিলে?কী করব আমি?

সূচনা আমতাআমতা করে বললো-

–‘আব,,ব,,ক,,কি ভাববো আবার।আপনিই তো

–‘আমি ই তো?

–‘ আপনি কী করছিলেন?

–আমি তো ডেমো দেখাচ্ছিলাম যে কী শিখাব।

সূচনা মাথা নিচু করে নিল। প্রণয় হাসলো নিঃশব্দে। তারপর বললো-

–‘আমি গেলাম,,সাবধানে থেক।

নত মস্তক উপরে করে মৃদু স্বরে বললো-

–‘আপনিও সাবধানে যাবেন।

মুচকি হেসে প্রণয় রুম থেকে বেরোলো, সূচনা পেছনে পেছনে গেল তার।
.
.
পড়ার টেবিলে বসে কলম নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তিথি, তার বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করছে ইরা।একটা অঙ্ক কোনোভাবেই মেলাতে পারছেনা তিথি তাই খাতা আর বই নিয়ে ইরার সামনে বিছানায় বসে পড়লো। ইরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালনা।তিথি ইরার বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিতে কেঁপে উঠলো ইরা।তিথি ভড়কে গেল।ইরা চকিতে তিথির দিকে তাকিয়ে কম্পনরত কণ্ঠে বললো –

–‘ক,,কী, হ,হয়েছে তিথি?

তিথি অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

–‘তুমি এমন কেঁপে উঠলে কেন ইরাপু?

–‘আব,,ব,,ক,,কিছুনা তো

–‘কী হয়েছে বলো তো,কয়দিন ধরে দেখছি তুমি কেমন যেন হয়ে গেছ।পরীক্ষার পর কত প্ল্যান করেছিলে এই করবে সেই করবে কিন্তু এখন ঘরে ঘাপটি মে/রে বসে আছ।কী হয়েছে বলো?আমি না হয় ছোট তাহলে দিনাপু কে বলো।

হালকা হাসলো ইরা।বললো-

–‘কিছু হয়নি এমনি।তুই বল কি হয়েছে?

–‘এই ম্যাথটা বুঝিয়ে দাও একটু।

–‘ঠিক আছে দেখা।

তিথিকে ম্যাথটা বুঝিয়ে দিয়ে ইরা এক সেকেন্ড ও দেরি করলো না সেখানে।দ্রুতপায়ে রুমে আসলো নিজের।রুমে আসতেই কর্কশ আওয়াজ তুলে বেজে উঠল ফোন।আবারো কেঁ/পে উঠলো ইরা।ভয়ে হাত পা কাঁপছে তার,গলা শুকিয়ে আসছে।কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করলো ফোন।
——————————————————-
কেবিনের বাইরে চেয়ারে বসে আছে নিহাদ আর প্রণয়।টুকটাক কথা হচ্ছে তাদের। নিহাদের মুখশ্রীতে চিন্তার ছাপ নেই।ঠান্ডা মাথায়ই সামলাতে চেষ্টা করছে সব। বাবা নেই মা,দুই ভাই -বোনের দায়িত্ব তার ওপর। আবার নিজের স্ত্রী -সন্তান ও আছে তারওপর হুট করে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা।অথচ সে ঘাবড়াচ্ছে না একটুও।

–‘তুমি একটু বসো আমি কেবিনের ভেতর থেকে আসছি।

–‘ঠিক আছে যান।

নিহাদ যেতেই প্রণয় ফোন বের করে সূচনা কে কল করলো। একবার রিং হতেই ফোন তুললো সূচনা।রিসিভ হতেই প্রণয় হাসিমাখা কণ্ঠে বললো –

–‘বাহ ফোন বুঝি হাতে নিয়েই রেখেছিলে।

–‘হ্য,,হ্যা আসলে,,

–‘আমার কলের অপেক্ষা করছিলে?

সূচনা নিশ্চুপ। সে প্রণয়কে কল দেয়ার জন্য ফোন হাতে নিয়েছিল।আর তখনই ফোন দিয়েছে প্রণয়।

–‘খেয়েছো?

–‘জ্বি।

–‘ঘুমাওনি কেন?

–‘এমনি

-‘আপনি কোথায় এখন?

–‘কেবিনের বাইরে,,করিডোরের কোণায়।

–‘ঘুম হবেনা আজকে আপনার।

–‘হ্যা বোধহয়। সমস্যা নেই কালকে ঘুমিয়ে নিব।

কিছু বললো না সূচনা।প্রণয় ও চুপ।এই মুহূর্ত টাও অদ্ভুত রকমের সুন্দর।ফোনের দুপাশে নিশ্চুপ দুইজন মানব মানবি, রা নেই তাদের মুখে শুধু শোনা যাচ্ছে তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here