প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ২+৩

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_2
#Writer_TanhaTonu

(লেখার স্টাইল কিছুটা চ্যাঞ্জ করলাম।আশা করি বুঝতে কারও কোনো সমস্যা হবে না)

আরশি রুমে এসে জিম মেরে কতক্ষণ বসে থাকলো।কিছুই ভালো লাগছে না ওর।নূপুর আপুরাও চলে গিয়েছে।তাদের জায়গায় নতুন মানুষ আসছে..কে জানে হয়ত তাদের সাথে আর নূপুর আপুদের মতো সম্পর্ক হবে না।আর না হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর আরশি নূপুরকে ফোন দিলো..
—”হ্যালো নূপুর আপু?”
নূপুর মুচকি হেসে ফোনের ওপাশ থেকে জবাব দিলো,,,
—”ভালো আছো আরশি?কি করো?”
—”একদম ভালো নেই আপু।তোমাদেরকে ছাড়া ভালো না।আমি কত একা হয়ে গেলাম বলো তো”
নূপুরেরও হালকা মন খারাপ হলো,,,
—”হুম.. আমারও ভালো লাগছে না।নতুন জায়গা।সব কিছু নতুন।অদ্ভুত লাগছে সব”
—”হুউউম”

আরশি অনেক্ষণ নূপুরের সাথে ফোনে কথা বলে।এগারোটার দিকে ডায়নিং রুমে যায়।গিয়ে দেখে রূম্পা(কাজের মেয়ে) টেবিলে খাবার সার্ভ করছে।তাও আবার ইয়া বড় ট্রে তে ভাত,একটা বৌলে মুরগি ভুনা আরেকটা ছোট্ট বৌলে সালাদ।আরশি কিছুটা অবাক হলো।ডায়নিং টেবিলে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করল…

—”কিরে রুম্পু..বাসার সবাই তো এতক্ষণে খেয়ে ফেলেছে।এগুলো কার জন্য বাড়ছিস?আর আম্মু কোথায়?”
রূম্পা বৌলগুলোর উপর ঢাকনা রাখতে রাখতে জবাব দিলো…
“আফনার আম্মাই তো কইল এগুলা বাড়তে।ওই যারা বাড়ি কিনছে হেগো লইগাই বাড়তে কইল।হেগো আজকে এই বাসায় খাওয়াইবো বলে”

আরশি কিছুটা ভ্রু কুচকালো।বুঝল ওর আম্মু এতোক্ষণে সিউর তাদের পরাণের পরাণ হয়ে গিয়েছে।আরশির আম্মু এমনই।কিভাবে অতিথি আপ্যায়ন করবে,কিভাবে মানুষের সাথে মিশে থাকবে সেগুলোই তার চিন্তা!
আরশি আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ দুই পিস স্যান্ডউইচ খেয়ে উঠে গেলো।তারা এসে পড়লে তো আবার খেতেও পারবে না।খাওয়া শেষ করে ড্রয়িং স্পেসে গিয়ে সোফায় বসে মোবাইল চালাতে থাকে…

—”আপা আসেন তো..এই মুন আসো।এখন থেকে আমরা তোমরা তো একসাথেই থাকব।এতো জড়তা থাকলে হয়?”
আরশি ওর আম্মুর কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়।দেখে ওর আম্মুর সাথে একজন মধ্যবয়সী মহিলা আর একটা যুবতী মেয়ে।মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে নূপুরের সমানই অর্থাৎ হয় ইন্টারে পড়বে।আরশির আম্মু আর ওরা দুজন ভিতরে আসে।আরশি সোফা থেকে উঠে সালাম দেয়…
—”আসসালামু আলাইকুম আন্টি..ভালো আছেন?”
মহিলাটি মুচকি হেসে আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়..
—”ওয়ালাইকুমুস সালাম মা।আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।ইশ কি কিউট একটা মেয়ে তোমার রাবিয়া!”

আরশি কিছুটা ব্লাশিং হলেও অবাক হলো এটা শুনে যে মহিলাটি ওর আম্মুকে তুমি করে বলছে।কিন্তু এখন তো আর জিজ্ঞাসা করতে পারবে না কিছু।আরশির আম্মু মুনের সাথে আরশির পরিচয় করিয়ে দিলো…
—”আরশি এটা হলো তোমার মুন আপু।মানে তোমার এই আয়িশা আন্টির মেয়ে।মুন ও-ই আরশি”

মুন আরশির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ওকে জড়িয়ে ধরল।আরশি কিছুটা অবাক হলেও ওর ভালো লাগল এটা ভেবে যে এরাও হয়ত নূপুরদের মতোই ভালো মানুষ।মুন আরশিকে ছেড়ে থুতনীটা হালকা টেনে বলল…
—”তুমি অনেক কিউট গো আরশি”
আরশি মৃদু হেসে বলল….
—”সত্যি তুমিও অনেক সুন্দর।আমার তো তোমার দিকে তাকিয়েই থাকতে মন চাচ্ছে”

মুন হালকা হাসল।আরশির আম্মু বলল..
—”হয়েছে অনেক গল্প করা যাবে।একসাথেই আছিস।এখন মুন আসো তো খেয়ে নিবে।সকালে তো হালকা পাতলা ব্রেড খেয়েছো আর কিছুই খাওনি।আপা আসেন”

সবাই একসাথে খেতে বসল।আরশি শুধু বসে আছে যেহেতু ও খাবে না।সবাই খাচ্ছে আর গল্প করছে।আরশির আম্মু বলল…
“আপা ভাই আর আপনার ছেলে কোথায়?ওরা খাবে না?”
আয়িশা আজওয়াদ মৃদু হেসে জবাব দিলো…
“আর বলো না।বাপ ছেলে মিলেই তো সব ফার্নিচার রুমে সেট করাচ্ছে।ওদের কি আর খাওয়ার টাইম আছে।কত ঝামেলা!”
—”তাই বলে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে?ওদেরকেও ফোন দিয়ে আসতে বলেন”

আয়িশা আজওয়াদ খেতে খেতেই বললেন…
—”লাভ হবে না।বাইরে থেকে খেয়ে নিবেনে”
মুনের খাওয়া হয়ে গেলে ও আরশির সাথে ওর রুমে গেলো।দুজন একসাথে অনেক্ষণ গল্প করল।মুন বলল…

—”আরশি তুমি কোন স্কুলে পড়ো?”
আরশি স্কুলের নাম বলতেই মুনের ঠোঁট জুড়ে হাসির রেখা ফুটল…
—”তাই নাকি? আমার বড় ভাইয়াও তো ওই স্কুলের টিচার”
আরশি কিছুটা ভরকে গেলো..
—”কি বলো?আমি তো এমন কাউকে দেখলাম না।সবই তো আমার চেনা টিচার।তোমার ভাইয়া মনে হয় তাহলে কলেজ শাখার”
—”কি জানি?সেটা তো বলেনি”

আরশি হাসল।বেচারি ভাবতেই পারল না সিদ্রাতই হয়ত মুনের ভাই।সিদ্রাতও তো নিউ টিচার..!

অনেক্ষণ গল্প-গুজব করে মুন আর ওর আম্মু চলে গেলো।বিকালের মধ্যেই ওদের ঘর গুছানোও হয়ে গিয়েছে।রাতে আরশি ফারহাকে ফোন দিয়ে স্কুলের পড়াগুলো জেনে নিলো।কথার এক পর্যায়ে আরশি বলল…

—”ফারু দোস্ত..মেরে জানু..আজ তোর জিজু কি কালার শার্ট পড়েছিলো রে?আজও কি অনেক সুন্দর করে সেজেছিলো।ইশ আমি আজ দেখতে পারলাম না”
ফারহা হাসল…
—”আরে পাগল শান্ত হো।ক্রাশকে একবারে জামাই বানায় ফেলছোস..হাহা!হোয়াটেভার,,আজ তোমার ক্রাশ স্কুলে আসেনি।তার ক্লাশও হয়নি”

আরশির চোখ-মুখ চকচকে হয়ে উঠল…
—”ওহ মাই গড!হোয়াট এ কানেকশন!দেখেছিস আজ আমিও আসিনি আমার সে-ও আসেনি”
আরশি কথাটা বলে ব্লাশিং হলো।ফারহা কিটকিটিয়ে হেসে উঠল…
—”তোরে তো চিনেই না।আর তুই দিবা স্বপ্ন দেখছিস..আল্লাহ!!..হাহা”
আরশি ভেঙচি কেটে ফোন কেটে দিলো।পরের দিন স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সার জন্য গেইট ছেড়ে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।আরশিদের প্রাইভেট কার আছে।কিন্তু আরশির ভালো লাগে না কারে করে যেতে।আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই লাইফ লিড করতে পছন্দ করে ও…

আরশি যখন রিক্সার জন্য দাঁড়িয়েছিলো তখনই ওদের বাড়ির ভিতর থেকে একটা ব্ল্যাক কালার প্রাইভেট কার বেরিয়ে গেলো।আরশি তেমন পাত্তা দিলো না।রিক্সা পেতেই স্কুলে চলে আসল…

স্কুলে…
—”দোস্ত..আজ যদি উনি না আসে?”
ফারহা ভ্রু কুচকালো..
—”এই উনিটা আবার কে?”
আরশি ভেঙচি কেটে বলল..
—”তুমি তো কচি খুকি।একবারে যুক্ত বর্ণ ভেঙে তোমায় বর্ণনা করা লাগবে..হুহ!উনি টা হলো স্যার..মানে সিদ্রাত স্যার”
ফারহা হেসে টেনে বলল…
—”ওওহ উনিইই..তোমার উনিইই তো চলে এসেছে আরও দশ মিনিট আগে”

আরশি লাজুক হাসল।তারপর আবার বলল…
—”আচ্ছা উনাদের বাসা কোথায় রে?কোথায় থাকে উনি?চল না আমরা উনার কাছে প্রাইভেট পড়ি”
—”সেটা করা যায়।কিন্তু আমরা বললেই কি উনি পড়াবে?তারপর আবার কোথায় থাকে সেটাও তো জানিনা।দূরে হলে তো আব্বু পড়তে দিবে না”
আরশির মনটা খারাপ হলো।মন খারাপ করেই বলল…
—”দেখা যাক কি করা যায়।বাট আমি তো উনার কাছে পড়বই।সেটা যত দূরই হোক উনার বাড়ি..আহ আমার সিদ্রাত..ওরে সিদ্রাতরে কি পাগল করলিরেএএ..আমি যে কিছুই দেখিনা তোরে ছাড়ারেএএ”

ফারহার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।ও আরশিকে ইশারা করল চুপ করতে।আরশি পাত্তাই দিলো না..
—”আরে দেখ আমি কি গান গাই আমার জানেমানকে নিয়ে..ওরে ও সিদ্রাত,,,”
আরশি এটুকু বলেই মুখে হাত দিয়ে ফেলল।কারণ পাশ দিয়েই সিদ্রাত লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো..
—”ইয়া আল্লাহ।আসতাগফিরুল্লাহ..ওই ফারু শোনে ফেলছে রে?হায় আল্লাহ মান-সম্মান শেষ”
ফারহা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।দাঁতে দাঁত চেপে বলল..
—”পুরোটাই শুনছে মে বি।তোর পিছনেই একসাইডে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো।আর তোর যেই গলা বাঁশ।এতো জোরে কেউ এগুলো বলে?”
আরশি কাঁদো কাঁদো ফেইস করে তাকালো…

একটু পর বেল বেজে যেতেই সিদ্রাতের ক্লাস শুরু হলো।আরশি সিদ্রাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখটা নামিয়ে ফেলল আর মুচকি হাসল…

—”সো স্টুডেন্টস..ম্যাথ সব করেছিলে?”
স্টুডেন্টসরা হ্যা সূচক জবাব দেয়…
—”ওকে দ্যান আমি তোমাদের কয়েকজনকে বোর্ডে ডাকব।তোমরা সলুইশন করবে যেই ম্যাথগুলো দিবো”

সিদ্রাতের কথায় কেউ কেউ সাহসের সাথে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো আবার কেউ কেউ ভয় পেলো।সিদ্রাত প্রথমেই ডাকল নিরা নামের একটা মেয়েকে।আরশিদের সাথে ওদের সেরকম শত্রুতা।শত্রুতা বলতে পড়াশুনা নিয়ে।নিরার রোল তিন।সো প্রতিযোগিতাটা অনেক বেশিই। নিরাদের টিম অলওয়েজ চান্সেই থাকে কিভাবে আরশিকে অপদস্ত করা যায়…
সিদ্রাত ডাকতেই নিরা মুচকি হেসে বোর্ডে গিয়ে ম্যাথ করতে লাগল…
এদিকে আরশি ফিসফিসিয়ে বনিকে বলল…
—”বনি আমাকে ডাকলে আমি কি করব?আমি যেতে পারব না।আমার যে উনার সামনে গেলেই হার্ট মিস হবে।আমার এখনো হার্ট প্রচুর বিট করছে।হাত দিয়ে দেখ”

—”আরে রিলাক্স কিছু হবে না।আর তুই হলি ম্যাথের কুইন।পারবি ইনশা আল্লাহ”
—”নারে..তুই বুঝতে পারছিস না।সত্যি আমি উনার সামনে গিয়ে করতে পারব না।উনাকে দেখলেই আমার হার্ট লাফায়।সামনে গেলে মরেই যাবো”

বনি আর ফারহা স্পষ্ট আরশির মুখে চিন্তার ছাপ দেখতে পেলো।এক পর্যায়ে সত্যিই আরশির ডাক এলো…
—”এই যে সেকেন্ড বেঞ্চ ফার্স্ট গার্ল?”
আরশি চমকে গেলো।কাঁপা কাঁপা পায়ে দাঁড়ালো।ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল..
—”স্যার আমি?”
—”ইয়াহ কাম?”

আরশি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো।সিদ্রাত একটা ম্যাথ লিখে দিলো আর বলল সলভ করতে।আরশি অনেকটা সাহস নিয়েই মার্কারটা নিলো।যেই এগিয়ে যেতে যাবে সিদ্রাত ফিসফিসিয়ে মৃদু হেসে বলল…
—”গান গাওয়ার সময় একটু আশেপাশে তাকিয়ে গেও”
ব্যাস!আরশির পা স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছে।ও লজ্জায় তাকাতেও পারছে না।হাতগুলো থরথর করে কাঁপছে…
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_3
#Writee_TanhaTonu

সিদ্রাতের কথাটা শুনার পর আরশি জায়গায়ই স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছে।এতোটা লজ্জা কখনো পায়নি ও।আর এমন একটা মানুষের কাছ থেকে পেলো যে লজ্জায় একদম শেষ হয়ে যাচ্ছে…
—”কি হলো যাও বোর্ডে..নাকি পারোনা?”
সিদ্রাত একদম স্বাভাবিকভাবে বলল যেনো কিছুই হয়নি।আরশি সিদ্রাতের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে ধীর পায়ে হোয়াইট বোর্ডের সামনে গেলো।কিন্তু অস্থিরতায় কোনোকিছুই মাথায় আসছে না।ভয়ে যেনো সব গুলিয়ে গিয়েছে।ব্যাপারটা হয়েছে এমন যে মাথায় ঠিকি এসেছে কিন্তু একটুর জন্য মনে আসছে না।আরশির ইচ্ছা করছে কেঁদে দিতে।ও করুণ চোখে তাকালো সিদ্রাতের দিকে…

—”পারোনা রাইট?আমি বলেছিলাম পড়াশুনায় আমি কোনো হেয়ালিপনা দেখতে চাইনা..যাও জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো”
—”স্য,,স্যার,,আমি,,”
—”টাইম ওয়েস্ট হচ্ছে। নেক্সট পাশের জন আসো।এন্ড তুমি জায়গায় যাও”

আরশি অপর সাইডে নিরার দিকে আড়চোখে তাকালো।ও আর ওর টিম মিটিমিটি হাসছে।খুবই খারাপ লাগছে আরশির কাছে।মাথাটা নিচু করে নিজের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে রইল।বেশ কয়েকজন আস্তে আস্তে মিটিমিটি হাসছে।আরশির খুবই অপমানিত ফিল হচ্ছে।লজ্জা আর অপমানবোধে আরশির চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল…

আরশি সিদ্রাতের দিকে একবারও আর তাকালো না।যদিও জানে সিদ্রাতের তো এখানে দোষ নেই তবুও অকারণ অভিমান হচ্ছে।সিদ্রাতের ক্লাস শেষ হওয়ার পর সেকেন্ড ক্লাস হলো ইংলিশ।কিন্তু টিচার জরুরী কাজে অন্য ক্লাশে গিয়েছে।ওদেরকে পড়া দিয়ে গিয়েছে।আরশি বেঞ্চে বসে কাঁদছে নীরবে।ফারহা আর বনি এতো বুঝিয়েও লাভ হচ্ছে না।

—”আরশি বেবি কাঁদিস না জানু।স্যার তো আর এখনো তোর সম্পর্কে জানে না।তুই সব জড়তা কাটিয়ে ভালোভাবে পড়।রেগুলারলি পড়া দে।দেখবি তুই স্যারের প্রিয় স্টুডেন্টস হয়ে গিয়েছিস”

—”হুম আরশি ফারহা ঠিকই বলছে । প্লিজ কাঁদিস না”

আরশি কাঁদতে কাঁদতে বলল…
—”শুধু উনার সামনে যে,,,অপমানিত,,হ,,হয়েছি তা,তো না।নিরারা দেখ কত হাসি,,ত,,তামাশা করছে”

আরশি এটুকু বলে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল।ফারহা আর বনি রাগী চোখে ওদিকে তাকালো। নিরারা নিজেদের মধ্যে হাসা-হাসিতে ব্যস্ত।ফারহা আর বনি আরশির মাথায় হাত বুলালো।তখনই নিরা আর ওর চেলা ছোয়া আসল…

—”কিরে আরশি তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট এই ম্যাথটা পারলি না?হাও ইজ ইট পসিবল?আমার তো মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি”
নিরা উপহাস করে কথাটা বলল।আরশি রাগী চোখে তাকালো।নিরারা পাত্তা দিলো না।ছোয়া আরও একটু ঢোলে তালি দেয়ার মতো করে হেসে বলল…

—”আরে নিরা তুইও না।এটা এতোটাও সহজ ছিলো না।কঠিনই ছিলো ম্যাথটা।আর সবাই কি কঠিন ম্যাথ সলভ করতে পারে”

বনি এবার রেগে গিয়ে বলল…
“hey চুন্নি এতো ডায়লোগ কোথা থেকে আসে তোর?আর তুই কাকে কি বলছিস জানিস?ম্যাথমেটিকসে ও যতটা দক্ষ ততটা দক্ষ সেকেন্ড কেউ এই স্কুলে নেই।চোরের মায়ের বড় গলা”

—”বনিইই বেশি বলছিস না?এতো কথা কিভাবে বলিস।ঝগড়াটে মেয়ে কোথাকার”
ছোয়ার কথার জবাবে বনি রেগে আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরশি থামিয়ে দিলো ওকে।ঝাঁঝালো গলায় বলল…

—”বনি কুকুর হয়ে গিয়েছিস তুই?জানিস না আমার পছন্দ না কুকুরের সাথে তাল মিলিয়ে ঘেউ ঘেউ করা।মুখ অফ কর.. ফাউল।আর কেউ কিছু বললেই তার জবাব দিতে যাস কেন?নোংরা জিনিসে হাত দিবি না একদম”

নিরা বা ছোয়া কেউই আর কিছু বলতে পারল না আরশির কথার জবাবে। অপমান করতে এসে নিজেরাই অপমানিত হয়ে রেগে গটগট করে চলে গেলো।আরশি চোখটা মুছে মৃদু হাসল।সাথে ফারহা আর বনিও…

আরশি এমনই।ও কিছুটা নরম মনের হলেও নিরাদেরকে একদম সহ্য করতে পারেনা।যত বড় বিপদেই থাকুক না কেন নিরারা উল্টা-পাল্টা কিছু বললে বাজখাঁই জবাব দিবেই।আর এমনভাবে জবাব দেয় যে ওদেরকে আর কিছু বলার স্কোপই দেয়না…

সেকেন্ড ক্লাস শেষ হওয়ার বেল বাজার পাঁচ মিনিট আগে আরশি বলল…
—”ফারহা, বনি..আমি বাসায় চলে যাবো। কিছুই ভালো লাগছে না।আজ আমার দিনটাই খারাপ”

—”আন্টি যদি বলে কি হয়েছে এসে পড়লি যে?
—”কিছু হবে না।ভালো লাগছে না কিছু।এমনিই ফার্স্ট ক্লাসে এতো কিছু হলো।তারপর এই নিরা আর ছোয়াকে আমার সহ্য হচ্ছে না”

ফারহা বলল…
—”আচ্ছা তাহলে এপ্লিকেশন লিখে ফেল।সাবজেক্ট কি লিখবি এপলিকেশনে?”
—”আর কি লিখব!লিখব অসুস্থ..নাহলে ছুটি দিবে না”

আরশি এপলিকেশন লিখতে লিখতে বেল বেজে গেলো।থার্ড পিরিয়িডের টিচার আসার আগেই এপ্লিকেশন লিখে দৌড়ে টিচারসরুমের সামনে গেলো।এতোক্ষণে আরশির মনে পড়ল ওদের ক্লাস টিচার সিদ্রাত!
—”উফফ এখন কি হবে?এমনিই আমার সম্পর্কে তার ব্যাড ধারণা।এখন আাবার উনার সামনেই যাবো?”

আরশি যখন এসব ভাবছিলো তখনই সিদ্রাত টিচার্স রুম থেকে বের হয়ে নেক্সট ক্লাসে যাওয়ার জন্য রওনা দিলো।আরশি সিদ্রাতকে দেখতেই ওর সামনে গেলো…
—”স্যার?”
সিদ্রাত আরশির ডাকে ভ্রু কুচকে তাকালো…
—”হুম বলো..কোনো প্রবলেম?”
আরশি জোরে একটা শ্বাস ফেলে চোখ নামিয়ে বলেই ফেলল…
—”আমার ছুটি লাগবে”
আরশি এপলিকেশনটা সিদ্রাতের হাতে দিলো।সিদ্রাত আরশির দিকে একপলক তাকিয়ে এপ্লিকেশনটা পড়তে লাগল।আরশির চোখ আর নাক লাল হয়ে আছে।চোখগুলো হালকা ফুলাও।সিদ্রাত এপ্লিকেশন পড়ে সাইন করে দিলো আর লিখে দিলো এপ্লিকেশন গ্রান্টেড।তারপর বলল…
—”তোমার গার্জিয়ানের ফোন নাম্বার দাও”

আরশি কিছুটা ভরকে গেলো…
—”জ্বী?”
—”ফোন নাম্বার।স্কুলের তো এটাই নিয়ম স্কুল থেকে কাউকে ছুটি দিলে বাসায় ফোন দিয়ে জানিয়ে দিতে হয়”

আরশির এবার মনে পড়ল।সিদ্রাতের কাছে আসলেই ওর যে বেহাল অবস্থা হয়..ও ভুলেই গিয়েছিলো রুলসের কথা।এই রুলসটা করা হয়েছে আসলে সেইফটির জন্য।আরশির মাথায় ব্যাপারটা ভালো করে ঢুকতেই ও খুশিতে মনে মনে নেচে উঠল…
—ওওএমজিইই!আম্মুর ফোন নাম্বার দিলে তো উনি উনার নাম্বার দিয়েই ফোন দিবে।তার মানে আমি উনার নাম্বার পেয়ে যাবো..হায় মে তো মারজাউঙ্গি..এত খুশি লাগে কেন আমার!উফফ মনটাই ভালো হয়ে গেলো।নাচতে মন চাচ্ছে”

—”কি হলো ফোন নাম্বার দাও”
আরশি হুশে এসে ফোন নাম্বার দিতেই সিদ্রাত ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো যে আরশিকে স্কুল থেকে ছুটি দেয়া হয়েছে।আরশি সিদ্রাতের দিকে একবার তাকালো।তারপর সাথে সাথে চোখ নামিয়ে চলে যেতে লাগল।দুই তিন পা এগুতেই সিদ্রাতের ডাকে থমকে গেলো।উফফ আবারও বুকের ভিতর তবলা বাজছে মেয়েটার।সিদ্রাত হালকা আওয়াজে ডাকল…

—”শোনো”
সিদ্রাতের ডাকে আরশির গাল দুটো খুশিতে লাল হয়ে উঠল।ও আস্তে করে পিছনে ফিরে তাকালো।সিদ্রাত বলল….
—”একা যেতে পারবে? ”
আরশি যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে সিদ্রাত তাকে এটা বলল।ক্রাশের ছোট ছোট কথাগুলোই যে অনেক বড়।আরশির গালে হালকা হাসি ফুটে উঠল।মুচকি হেসে বলল…
—”সমস্যা হবে না স্যার।আমি যেতে পারব”

সিদ্রাত আর কিছু বলতে পারল না।আরশি মুচকি হেসে বাসায় চলে আসল।বাসায় এসে দরজা লাগিয়ে বক্স চালু করে উড়াধুরা ডান্স শুরু করেছে।খুশিতে কি যে করবে তাই ভেবে পাচ্ছে না।কেউ দেখলে ভাববে পাগল হয়ে গিয়েছে মেয়েটা…
—”উফফ কি লাক আমার।ভাবলাম দরজা লাগিয়ে রুমে বসে কান্না করব আর সকালের শোক দিবস পালন করব।এখন তো পুরোই উলটা..
উফফ সিদ্রুউ বেপিইই ইউ আর সো কিউউট।ইশ আমি প্রেমে পড়ে গিয়েছি”

আরশি লজ্জা পেয়ে ব্লাশিং হয়ে মুখ ঢেকে ফেলল দুই হাত দিয়ে।ডান্স করছে,, না না…একে ডান্স বলা চলে না,,লাফালাফিটা ভালো মানায়।আরশি বেডে উঠে গান বাজিয়ে লাফাচ্ছে আর এসব বলছে…

বিকালে আরশি রুমে বসে পড়ছিলো।ম্যাথ করছিলো।ক্রাশের সাবজেক্ট বলে কথা..সবার আগে তো এটাই পড়তে হবে!
আরশির আম্মুর ডাকে ওর পড়ায় ব্যাঘাত ঘটে।বইটা অফ করে লিভিং রুমে যেতেই দেখে ওর আম্মু গ্লাসে লাচ্ছি ঢালছে…

—”আম্মু ডেকেছিলে?”
আরশির আম্মু আরশির দিকে একবার তাকিয়ে আবারও লাচ্ছি ঢালায় মনোযোগ দিয়েই আরশিকে বলল…
—”এই লাচ্ছিগুলো আয়িশা আপাদের বাসায় দিয়ে আয়।আমিই যেতাম।মুন নাকি তোর সাথে গল্প করবে।মেয়েটা অনেক ভালো”

আরশিও হালকা হাসল।পরক্ষণেই গ্লাসের সাইজ দেখে আরশির মাথায় বাজ পড়ল…

—”আম্মুউউউ তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো?এই বড় গ্লাস বের করেছো কেন?এগুলো সাধারণ গ্লাসের তুলনায় দ্বিগুন লম্বা..ডেকোরেটিং গ্লাস এগুলো”
—”বলদই থাকবি তুই।ওরা চারজন মানুষ বলে কি গুণে গুণে চার গ্লাস দেয়া যায়?আবার আট গ্লাস দিলেও কেমন যেনো লাগেনা?কি না কি ভাবে?এজন্যই তো এই গ্লাসে দিয়েছি।এক জনে সাধারণ গ্লাসের মাপে দুই গ্লাস করে খেতে পারবে”

আরশি ওর আম্মুর কান্ড দেখে মাথায় হাত দিলো।আরশির আম্মু ট্রে টা আরশির সামনে এনে বলল…
—”ধর আর যা…”
—”হুম দাও”

আরশি ট্রে টা নিয়ে মুনদের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো।কলিং বেল বাজাবে কিভাবে তা নিয়ে পড়ল সমস্যায়।আশেপাশে কেউ আছে কিনা সাহায্য করার মতো দেখল।কিন্তু কাউকেই পেলো না।আবারও রুমে ফিরে যেতে নিবে তখনই দেখল রূম্পা এসেছে..
—”এই রুম্পু বেবি একটু মুন আপুদের রুমে কলিং বেলটা বাজিয়ে দে না”

রূম্পা হেসে কলিং বেল বাজালো।ওর ভালোই লাগে আরশির মুখে অদ্ভুত(ওর ভাষ্যমতে) ল্যাঙ্গুয়েজ শুনতে।কলিং বেল বাজিয়ে রূম্পা আরশিদের রুমে চলে গেলো।আর আরশি অপেক্ষা করতে লাগল ডোর খুলার।বড় বড় চারটা গ্লাসের কারণে আরশির মুখ দেখা যাচ্ছে না।আর আরশিও ভালো করে সামনে কি আছে দেখতে পাচ্ছে।ডোর খুলতেই আরশি বুঝল কেউ ডোর খুলেছে।ঠোঁট উল্টিয়ে বলল…

—”মুন আপুগো তাড়াতাড়ি ধরো এই পাহাড় সমান গ্লাসগুলো।আমার মতো বাবু মেয়েটা এগুলোর চাপায় পড়ে মরে যাবে তো”

সামনে থাকা ব্যক্তিটি ভ্রু কুচকে ট্রে টা আরশির হাত থেকে নিতেই আরশির মুখটা দৃশ্যমান হলো।সে আরশির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।বলতে গেলে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।আরশি হাত দুটো ঝেড়ে সামনে তাকাতেই ওর চোখগুলো রসগোল্লা।মনে হচ্ছে অক্ষি কোটর থেকে এখনি লাফ দিয়ে বের হয়ে আসবে…
—”স,,স্যার আপনি?আপ,,নিই এখানে?”

সিদ্রাত কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভিতর থেকে সিদ্রাতের আম্মু বলতে বলতে আসল…
—”কিরে কে এসেছে?কে কলিং বেল,,,”
আরশিকে দেখে আর কথা শেষ করল না সিদ্রাতের আম্মু।মৃদু হেসে বলল…
—”আরে আরশি..রুমে আয়।তোর কথাই তো ভাবছিলাম”

আরশি এখনো ঘোরের মাঝে।সেভাবেই ও বলল…
—”আন্টি সিদ্রাত স্যার এখানে কেন?উনি কি হয় তোমার?”

সিদ্রাতের আম্মু বুঝল না আরশির কথা।সিদ্রাতই বলল..
—”আম্মু আসলে ও আমার স্টুডেন্ট।মানে ওদের ম্যাথক্লাস আমার”

আরশি এবার যেনো বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো।একটু জোরেই বলে উঠল…
—”আন্টিইই আপনিই স্যারের আম্মুউউউ????”
সিদ্রাতের আম্মু হাসল।আরশি মুখে হাত দিয়ে ফেলল।সিদ্রাত মৃদু হেসে ট্রে টা নিয়ে ভিতরে চলে যায়…

—”উফফ আরশি ভিতরে আয় তো।বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি?”.

আরশি সিদ্রাতদের বাসার ভিতরে যায়।বাসার ভিতরটা ফার্নিচার দিয়ে খুব সুন্দর করে ডেকোরেট করা।লিভিং রুমের মাঝখানে তিন সেট সোফা আর মাঝখানে সেন্টার টেবিল। দুই সেটে দুটো করে।আর আরেক সেটে তিনটা।এক কোণায় একটা মাঝারি সাইজের ওয়াল ক্যাবিনেট।পুরোটা বিভিন্ন লাক্সারিজ শো পিস দিয়ে ভরা।দেয়ালে বিভিন্ন ধরণের পেইন্টিং।আরেকপাশে একটা টিভি ক্যাবিনেটে বিয়াল্লিশ ইঞ্চির একটা স্মার্ট টিভি।
সবকিছু সাজানো-গোছানো…

মুনের ডাকে আরশি তাকায়…
—”কি গো কি খবর তোমার?আজ তো তোমায় দেখলামই না”
আরশি সিদ্রাতের দিকে আড়চোখে তাকালো।সিদ্রাত একটা বড় গ্লাস থেকে লাচ্ছি দুটো সাধারণ মাপের গ্লাসে ঢালছে।আরশি চোখটা ফিরিয়ে মুনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল…
—”আসলে আজ স্কুল থেকে আসার পর আর বের হয়নি তো তাই।তুমিও তো গেলে না আপু!”

মুন হাসল।সিদ্রাতের আম্মুর ফোন আসায় উনি অন্য রুমে গেলেন।মুন কিছু একটা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হেসে বলল…
—”আমার ভাইয়াটাকে পছন্দ হয়েছে নাকি?”

আরশি থতমত খেয়ে গেলো।লজ্জায় গাল আর কান গরম হয়ে গেলো।মুন আরশির লাজুক মুুখ দেখে কিটকিটিয়ে হেসে উঠল..
সিদ্রাত একটা বড় গ্লাস মুনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল….
—”কিরে গাধার মতো হাসছিস কেন?”
আরশির আরও ভীষণ লজ্জা লাগছে।এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়বে ও ভাবে নি
সিদ্রাত আবারও ডায়নিং টেবিলের সামনে গিয়ে দুটো গ্লাসে ঢালা লাচ্ছিগুলো দুইহাতে করে এনে একটা আরশির দিকে এগিয়ে দিলো…
—”তুমিও খাও আমাদের সাথে”
আরশি চমকে গিয়ে বলল…
—”না না..এটা তো আপনার জন্য।আপনিই খান।আমাদের রুমে আরও আছো”
সিদ্রাত মুচকি হাসল…
—”আমরা মেহমানকে না খাইয়ে রাখি না।খাও তো।আর আমি দুইগ্লাসের সমান খেতে পারব না।এজন্যই অর্ধেক তোমায় দিলাম..”

আরশি লাজুক হাসি দিয়ে গ্লাসটা নিলো।সিদ্রাত আরশিদের বিপরীত পাশের সোফাটায় বসল।মুন অর্ধেক খেয়ে বলল…
—”আরশিইই আন্টির রান্না অনেক টেস্টি।গতকাল লাঞ্চ আর ব্রেকফাস্ট করলাম।আর আজ লাচ্ছি..উফফ খুব ইয়াম্মিইই..ভাইয়ার লাক খুলে গেলো।সেরকম জামাই আদ,,,,”

মুনের এটুকু কথা শুনেই আরশির কাশি উঠে গেলো।আর মুন জিহবায় কামড় দিলো।সিদ্রাত দৌড়ে গিয়ে পানি এনে আরশির মুখের সামনে ধরল।আরশি পানিটা খেয়ে লাচ্ছি সেন্টার টেবিলে রেখেই লজ্জায় দৌড়ে চলে গেলো….

চলবে…
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here