প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ৪+৫

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_4
#Writer_TanhaTonu

আরশি আর সিদ্রাতের সামনেও যায়নি।মুনকে ইচ্ছা করছে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে কিন্তু সেটাও সম্ভব না।কি বড় একটা লজ্জা পেতে যাচ্ছিলো মেয়েটা!সিদ্রাত বুঝলে কত কিছু ভাবতো..এসব ভেবে আরশি আরও লজ্জা পাচ্ছে।নিজের রুম থেকেও আর বের হয়নি।যদি দেখা যায় সিদ্রাত মুনের কথা বুঝে গেলো আর আরশির নামে বিচার নিয়ে এলো!!এই ভয়ে…

পরের দিন স্কুলে যাওয়ার জন্য আরশি রুম থেকে বেরুতেই সিদ্রাতও বেরুলো।আরশি লজ্জায় মাথা নিচু করে সালাম দিলো…
—”আসসালামু আলাইকুম স্যার”
—”ওয়ালাইকুমুস সালাম..স্কুলে যাচ্ছো?”
—”হুম”
আরশি এটা বলে অধীর আগ্রহ নিয়ে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।ভেবেছিলো সিদ্রাতও বলবে চলো আমার সাথে।আমরা তো একই স্কুলে যাচ্ছি।কিন্তা সিদ্রাত আরশির চিন্তায় জল ঢেলে ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসিয়ে ঝুলিয়ে চলে গেলো।আরশি মনে মনে একশটা বকা দিতে লাগল…

—”আল্লাহ এটা কী এলিয়েন নাকি?ভদ্রতার ক্ষাতিরেও তো বলতে পারত..হুহ!নিরামিষ একটা..ছিহ শেষ পর্যন্ত আমি নিরামিষের প্রেমে পড়লাম!”

শেষের লাইনটা আরশি মনে মনে না ভেবে বাস্তবেই আওয়াজ করে বলে ফেলল।আর এতেই দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মুন হেসে উঠল।আরশি এবার খেয়াল করল মুন দাঁড়িয়ে আছে ওদের দরজার সামনে।মুন হেসে বলল…
—”আরশি নিরামিষ কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ভালো”
আরশি মুখ বাঁকালো।মুন আবারও হেসে দিলো।আরশি ঠোঁট উল্টিয়ে বলল…
—”মুন আপু তুমি অনেক পাজি।গতকাল স্যারের সামনে এসব কি বলছিলে বলো তো?স্যার আমায় নিয়ে উল্টা-পাল্টা ভাবত”
মুন শব্দ করে হেসে উঠল।হেসেই বলল…
—”আরে রিলাক্স বাচ্চাটা..তোমায় দেখে আমি সিউর যে তুমি আমার হ্যান্ডসাম ভাইয়াটার উপর ফিদা।কোনোভাবে যদি আমার ভাইটার চোখেও তুমি কোনোদিন পড়ো তাহলে তোমাদের প্রেম হবে।তো সে হিসেবে একদিন তোমাদের বিয়ে হবে।তারপর আমার ভাই তোমার আম্মুর রান্না করা ইয়াম্মি খাবার খাবে..এজন্যই তো বললাম”

আরশি লজ্জা পেয়ে গেলো মুনের কথায়।লাজুক হেসে দৌড়ে চলে গেলে সিড়ি বেয়ে।মুন হেসে উঠল আরশির কাজ দেখে।

মুনের সাথে সাথে গল্প করতে করতে যে লেইট হয়ে গিয়েছে সেদিকে আরশির খেয়ালই ছিলো না।স্কুলের গেইটে প্রবেশ করেছে আর সাথে সাথে বেল বেজে গিয়েছে।আরশি মাথায় হাত দিয়ে দৌড় দিলো।স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়লে প্রচুর পানিশমেন্ট পেতে হবে।
আরশি দৌড়ে দরজার সামনে আসতেই সিদ্রাতের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেলো…
—”আরে দৌড়াচ্ছ কেন?আস্তে..”
আরশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।আবার এটা ভেবে রাগ হলো যে ধাক্কাটা লাগল না কেন?
—”সিনেমায় কত সুন্দর হিরো আর হিরোইন ধাক্কা খায়।তারপর দুজন কি সুন্দর প্রেমী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে একে-অপরের দিকে।আহ কি রোমান্টিক সিন।আর আমার যত ফুটা কপাল”
আরশি ভাবনা থেকে বের হয়ে সিদ্রাতকে সরি বলে পার্মিশন নিয়ে ক্লাশে প্রবেশ করল।তারপর সিদ্রাতও ভিতরে ঢুকল….

ক্লাসে ফাকে ফাকে আরশি সিদ্রাতের দিকে তাকাচ্ছে।কয়েকবার চোখাচোখি হওয়ায় আরশি বেশ লজ্জা পায়।লজ্জায় আর তাকায় না।সিদ্রাত “দূরত্ব ও উচ্চতা”অধ্যায়টা বুঝাচ্ছে আজ।কিছুটা বুঝানোর পর আগের দিনের পড়াগুলো ধরতে লাগল।ত্রিকোণমিতির বিভিন্ন সূত্র পড়া ধরল।আরশিকে আজ সহজ প্রশ্ন ধরেছে।আরশি তো পড়া দিতে পেরে সেই খুশি!সিদ্রাত পাশের বেঞ্চের পড়া ধরছে এখন।ফারহা আর বনির দিকে তাকিয়ে দেখল ওরা হালকা হাসছে।সিদ্রাতের দিকে তাকাতেই দেখল ওর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠেছে…

সিদ্রাত নিরাকে এবার প্রশ্ন ধরল।নিরার প্রশ্নটা তুলনামূলক বেশ কঠিন।বেচারি বলতে পারল না উত্তর…
—” ক্লাশ টাইম শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবে।ক্লিয়ার?”
নিরা মাথা নিচু করে মাথা নাড়ালো।ছোয়াকেও কঠিন কুয়েশ্চন ধরায় ও-ও পারল না।আরশি তো ওদের দিকে তাকিয়ে ভেঙচি দিয়ে হাসল…
ফারহা বলল…
—”একদম ঠিক হয়েছে”
—”কিন্তু এটা সত্যি যে স্যার ওদেরকে একটু কঠিন প্রশ্নই ধরেছে।”
বনির কথায় আরশি রেগে তাকালো।রাগী কন্ঠে বলল…..
—”তোর বুঝি মায়া হচ্ছে ওদের জন্য”
বনি ঢোক গিলল..
—”দোস্ত রাগ করিস কেন?এমনিই বললাম”
আরশি আর ফারহা হেসে দিলো…

ছুটির টাইমে আরশি প্ল্যান করে ফারহা,বনি আর ওদের ক্লাসের দুটো ছেলে তাশফি আর রাফিকে সিদ্রাতের কাছে পাঠালো।উদ্দেশ্য একটাই..যেভাবেই হোক সিদ্রাতকে কনভেন্স করা প্রাইভেটের জন্য।আরশি ইচ্ছে করে যায়নি।সিদ্রাতের সামনে গিয়ে ও লজ্জায় ভুলেও প্রাইভেটের কথা বলতে পারবে না

আরশি ওদের চারজনের আশার অপেক্ষা করছে।আর মনে মনে দোয়া করছে যেনো সিদ্রাত রাজি হয় প্রাইভেট পড়াতে।পারলে এখনি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ত।একটু পরই ওদেরকে আসতে দেখে আরশি নড়েচড়ে উঠল।আরেকটু কাছে আসতেই ওদের শুকনো মুখটা দেখে আরশির মনটা মোচর দিয়ে উঠল…
—”রাজি হয়নি তাইনা?”
সবাই না-সূচক মাথা নাড়ায়।আরশির এবার সত্যিই কান্না আসছে।ইচ্ছে করছে কাঁদতে।ও জিহবা দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে ভাঙা গলায় বলল…
—”আচ্ছা বাদ দে।চল বাসায় ফিরে যাই”

ওরা আরশির মনের অবস্থা বুঝতে পারল।কিন্তু ওদেরই বা আর কি করার আছে…
বাসায় এসে আরশি মন খারাপ করে বারান্দায় বসে রইল।হঠাৎ পাশের বারান্দায় যেনো চোখ পড়তেই ওখানেই যেনো আটকে গেলো ওর চোখজোরা।আরশিদের বিল্ডিংটা এল সিস্টেম।আরশির রুমের বারান্দার বাম সাইডেই সিদ্রাতদের বারান্দা।সিদ্রাত বারান্দার রেলিং ধরে ধোঁয়া উড়ানো কফি খাচ্ছে।চুলগুলো হালকা ভেজা।বুঝা যাচ্ছে মাত্রই হয়ত গোসল করেছে।খুবই স্নিগ্ধ লাগছে আরশির কাছে সিদ্রাতকে।সিদ্রাতের ডাকে আরশির ধ্যান ভাঙল।ক্ষানিকটা লজ্জা পেলো ও।সিদ্রাত বলল…
—”ফারহা আর বনি নামে যে দুটো মেয়ে ওরা তোমার ফ্রেন্ড না?”
সিদ্রাতের কথায় আরশি ভয় পেয়ে গেলো।তাহলে কি সিদ্রাত জেনে গিয়েছে আরশি-ই ওদেরকে পাঠিয়েছে!আরশি শুকনো ঢোক গিলে হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়।সিদ্রাত মৃদু হেসে বলে…
—”ওরা আজ প্রাইভেট পড়ার জন্য আমার কাছে এসেছিলো।আমি কাউকেই প্রাউভেট পড়াইনা।ওদের না করে দিয়েছিলাম।পরে ভেবে দেখলাম হয়ত ম্যাথমেটিক্সে তাদের প্রবেম বেশিই তাই পড়তে চাচ্ছে”

আরশি এতোক্ষণ উৎসুক হয়ে তাকিয়েছিলো।নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে উৎসুক কন্ঠেই জিজ্ঞাসা করে ফেলল…
—”তো আপনি কি পড়াবেন তাদেরকে?”
সিদ্রাত সরু চোখে তাকালো।আরশি জিহবায় কামড় দিলো।সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল…
—”হুম আগামীকাল থেকে এসো।সাড়ে তিনটায় আসবে।আর ওদেরকেও বলে দিও..”

সিদ্রাতের কথা শুনে আরশি ভীষণ লজ্জা পেলো।দৌড়ে রুমে চলে এলো।এসে বালিশটা বুকে জড়িয়ে লাজুক লাজুক হেসে চলেছে।লজ্জায় গালগুলো একদম টমেটো হয়ে গিয়েছে…
—”ধ্যাত কি লজ্জা!স্যার বুঝল কিভাবে আমিও পড়ব?এখন কি ভাববে?আর আমিও এতো মুখ পাতলা কেন কে জানে!এতোতা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাস করার কি দরকার ছিলো!ভাল্লাগে না..”

রাতে আরশি প্রাভেটের কথা ওর আম্মুকে বলল।আরশির আম্মু বলল…
—”হুম এটাতো ভালোই হবে।আমি তো জানতামই না সিদ্রাত তোদের স্কুলে জয়েন করেছে।ছেলেটা অনেক ভালো আর হেল্পফুল”

মায়ের মুখে সিদ্রাতের প্রশংসা শুনে আরশির গাল দুটো প্রসারিত হলো খুশিতে।আরশির আম্মু আবারও বলল…
—”ভালোই হবে দূরে গিয়ে আর পড়তে হবে না।কিন্তু কে কে পড়বি?একা কিন্তু আমি পড়তে দিবো না।যত ভালোই হোক মানুষের শিরায় শিরায় শয়তান চলাচল করে।এখন যুগই খারাপ।নেট চালু করলেই ধর্ষণের খবর
আরশির খারাপ লাগল আম্মু এভাবে বলায়।কিন্তু মায়েদের মন..কি আর করার!আরশি ওর আম্মুকে আশ্বস্ত করে বলল…
—”আরে আম্মু আমি একা কেন পড়ব?আর আমি তো উনার কাছে পড়ার কথা ভাবিওনি।বনি,ফারহা ওরা বলল তাই ভাবলাম আমিও পড়ি”
—”হুম তাহলে ঠিকাছে।তো তোদের সাথে তাশফিদেরকেও নিয়ে নে।ছেলেটা তো ভালো স্টুডেন্ট”
—”হুম নিয়েছি নিয়েছি।বাদ দাও এবার..আব্বু কোথায়?”
—”একটু আগেই তো খেয়ে রুমে গেলো”

আরশিও ডিনার করে চলে গেলো।ওর তো খুশি ধরছে না আজ।কাল থেকে প্রাইভেট পড়তে পারবে সিদ্রাতের কাছে…
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_5
#Writer_TanhaTonu

প্রতিদিনের মতো আজও আরশি রিক্সার জন্য গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আজ যেনো সকাল সকালই সূর্য একদম মাথা বরাবর।সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে রিক্সার জন্য।অথচ একটা রিক্সাও চোখে পড়ল না।ঘামে চিকচিক করছে কপাল।আরশির আব্বুও অফিসে চলে গিয়েছে।নাহলে কার দিয়েই যেতে পারত…
—”আজ কি কপাল নিয়ে বের হয়েছিলাম আল্লাহই জানে।আজও লেইট হবে নাকি?কপাল রে!”

আরশি বিড়বিড় করছিলো তখনই রাস্তার অপর পাশে একটা রিক্সা দেখল।কিন্তু আফসোস হলো আরেকটু দূর থেকে একটা ছেলে দৌড়ে আসছে রিক্সায় উঠার জন্য।আরশিও দিলো দৌড়।আরশি রিক্সায় উঠতে যাবে তার আগেই ছেলেটা আরশিকে ধাক্কা দিয়ে রিক্সায় উঠে চলে গেলো।আর এদিকে ধাক্কা খেয়ে আরশি রাস্তায় পড়ে যেয়ে পায়ের গ্রিবার একটু উপরে ক্ষানিকটা অংশ কেটে গেলো।হাতেও হালকা ব্যথা পেলো।আরশির চোখ দিয়ে ব্যথায় কান্না চলে এসেছে।ছেলেটাকে মনে মনে হাজারটা বকা দিয়ে কোনো রকম উঠে দাঁড়ালো।চোখ দিয়ে তবুও পানি পড়ছে।রিক্সার জন্য আর দাঁড়ালো না আরশি।কাঁদতে কাঁদতে হাঁটা দিলো।হেঁটে যেতে প্রায় বিশ মিনিট লাগে।হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে।প্রচুর জ্বলছে কাটা জায়গায়…

যেতে যেতে ক্লাসের টাইম অর্ধেক পেরিয়ে গেলো।পা ভালো থাকলে হয়ত আরেকটু জোরে হাঁটতে পারত।কিন্তু এখন তো আরও আস্তে হাঁটতে হচ্ছে…

ক্লাসের সামনে গিয়ে আরশি দেখল সিদ্রাত ক্লাস করাচ্ছে।ক্লাসটা কেমন যেনো থমথমে।সিদ্রাতকেও কিছুটা গম্ভীর লাগছে।আরশি ভালো করেই জানে আজ প্রচুর পানিশমেন্ট পেতে হবে।কাঁপা কাঁপা কন্ঠেই বলল….
—”মে আই কাম,,,”
আরশিকে পুরো কথা বলতে দিলো না সিদ্রাত।থমথমে কন্ঠে বলল…
—”ক্লাস টাইম কখন?এখন?”
আরশি মাথা নিচু করে ফেলল।সিদ্রাত হালকা রাগী কন্ঠে বলল…
—”অর্ধেক টাইম যেহেতু পাড় করেই ফেলেছো বাকি টাইমও ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো”

সিদ্রাত এটা বলে ক্লাস করাতে মনোযোগ দিলো।মাথা নিচু করে রাখা অবস্থাতেই আরশির চোখ দিয়ে আবারও পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।ফারহা আর বনি করুণ চোখে আরশির দিকে তাকালো।আরশি নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে।ক্লাশ টাইম শেষ হলে সিদ্রাত ক্লাশ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে আরশিকে বলল…
—”যাও নিজের সিটে যাও”

আরশি খুড়িয়ে খুড়িয়ে সিটে গিয়ে বসল।বনি বলল…
—”কিরে তোর পায়ে কি হয়েছে?আর এতো লেইট করলি কেন?”

আরশি কাঁদতে কাঁদতে বনি আর ফারহাকে সব বলল।দুজনই রেগে ফায়ার..
—”ওই বদমাশ ছেলের এতো সাহস!তুই কিছু বললি না কেন ওই বেয়াদ্দপটাকে?আর স্যার যখন তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল তুই বললি না কেন এজন্য লেইট হয়েছে”
আরশি অভিমান নিয়ে বলল,,,
—”দরকার নেই।উনি কি আমায় একবারও জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন লেইট করলাম?একবারও আমার এক্সপ্লেইন করতে দিয়েছিলো।বলব না কিছু”

আরশি আর ফারহা মাথায় হাত দিলো।ফারহা বলল,,,
—”এই বলদ মেয়ে..স্যার কি জানে এতোকিছু?থাক বাদ দে..অনেক কষ্ট হয়েছে তাইনা দাঁড়িয়ে থাকতে!”

আরশি কাঁদো কাঁদো ফেইসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
টিফিন টাইমে ক্লাশের সামনে আরশি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিটক্যাট খাচ্ছিলো।ফারহা আর বনি গিয়েছে ক্যান্টিনে।আরশিকে অনেক জোর করেছিলো।ও যায়নি।খেতে নাকি মন চাচ্ছে না।হঠাৎ ক্লাস এইটের একটা মেয়ে এসে আরশিকে ডাকল…

—”আরশি আপুউউ”
আরশি ঘুরে তাকালো আর বলল…
—”আরে সুমনা..কিছু বলবে?”
—”গ্রাউন্ড ফ্লোরে বাগানের সাইডে তোমাকে স্যার ডাকছে।এখনি যেতে বলেছে”
—”স্যার!কিন্তু কোন স্যার.?”
সুমনা পুরো কথাটাও শুনল না।দৌড়ে চলে গেলো..
—”আরে এই মেয়ে..কোন স্যার?কিছুই বলল না।ধূর..গিয়ে দেখি”

আরশি খুড়িয়ে খুড়িয়ে গ্রাইন্ড ফ্লোরের শেষ সাইডে বাগানের দিকে গেলো।দেখল সিদ্রাত পায়চারি করছে।আরশি অনেকটাই অবাক হলো এটা ভেবে যে সিদ্রাত কেন ওকে ডাকল!
—”উফফ আমিও না!হয়ত প্রাইভেটের কথা বলবে”

আরশি সিদ্রাতের সামনে গিয়ে বলল…
—”স্যার ডেকেছেন আমায়?”
সিদ্রাত আরশির দিকে তাকালো।কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল।জিজ্ঞাসা করল…
—”কার সাথে মারামারি করে পা ভেঙেছো?”
আরশি অবাক হয়ে বলল…
—”মারামারি!!!আস্তাগফিরুল্লাহ!মারামারি আর আমি..দুজন দুজনের বিপরীত।আমাকে তো ওই বদমাশ ছেলেটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে পায়ের এই অবস্থা করেছে”

সিদ্রাত কিছুটা অবাক হলো।কিন্তু তা প্রকাশ করল না।শুধু বলল…
—”এই নাও তুলো আর স্যাভলন। পরিষ্কার করে নিও”
আরশি চমকে উঠল।সিদ্রাত ওকে নিয়ে ভাবছে!কিভাবে সম্ভব?আরশির চোখ-মুখে বিষ্ময় ভর করল।সিদ্রাত পরক্ষণেই আরশির ভাবনায় জল ঢেলে দিলো।সে বলল….
—”দায়িত্ব বলতে কিছু একটা তো আছে।তুমি তো পড়াশুনার ক্ষেত্রেও দায়িত্বহীন।মোরওভার একই বাসায় থাকি।প্রতিবেশীর খোঁজ রাখাও কর্তব্য ..”
আরশি মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো।মাথা নাড়িয়ে তুলো আর স্যাভলন নিয়ে চলে গেলো।সিদ্রাত মৃদু হেসে অফিসরুমে চলে গেলো…

_________
দুপুর আড়াইটা বাজে এখন।আরও একঘন্টা পর সিদ্রাতের কাছে পড়তে যাবে।আরশি প্রচুর অস্থির হয়ে আছে।আজ টাইমেরাও যেনো প্রতিজ্ঞা করেছে যেনো একচুলও এগুবে না।আরশি হালকা সাজুগাজুও করল।প্রেমে পড়লে যা হয় আর কী!সবই তখন রঙিন রঙিন লাগে।চুল ভেজা বলে আর বাঁধল না।শরীরে উড়নাটা জড়িয়ে চোখে একদম হালকা করে কাজল আর ঠোঁটে লাইট পিংক কালারের লিপবাম দিলো।ব্যাস এটুকুই তার সাজ।আরও বেশি সাজলে আবার অতিরিক্ত হয়ে যায়!

তিনটা পনেরো বাজে তখন।আরশি খাতা আর বই নিয়ে দৌড় দিলো সিদ্রাতদের রুমের সামনে।আর যে অপেক্ষা করা সম্ভব না।আরশি কলিং বেল বাজাতে গিয়েও বাজাতে পারছে না।বুক ধুরু ধুরু করছে।আরশি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শ্বাস নিলো।কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেল বাজিয়েই দিলো অবশেষে।সিদ্রাতের আম্মু এসে দরজা খুলল…
—”আরে আরশি যে!আয় আয়..এতো লেইট করলি কেন?আরও আগে আসবি কাল থেকে”
আরশি ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে মুচকি হেসে বলল…
—”স্যার তো সাড়ে তিনটায় পড়াবে বলেছে।আমি তো আরও পনেরো মিনিট আগেই আসলাম”
—”দেখ গিয়ে আরও দুইজন চলে এসেছে।যা.. তোর স্যার রুমেই আছে”

আরশি মৃদু হেসে সিদ্রাতের রুমের দিকে গেল।রুমের দরজায় পা রাখতেই ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো।রাগে চোখগুলো লাল হয়ে গিয়েছে।নিরা আর ছোয়াও এসেছে।কি সুন্দর তিনজন গল্প করছে।আরশির ইচ্ছা করছে নিরা আর ছোয়াকে মাথায় তুলে আছাড় দিতে….

সিদ্রাত খেয়াল করল আরশি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।মুচকি হেসে বলল…
—”আরশি দাঁড়িয়ে যে?ভিতরে আসো”

আরশি মুখ গোমরা করে টেবিলের শেষ কোণায় গিয়ে বসল।ভেবেছিলো সিদ্রাতের সাথে কোনো একটাতে বসবে।কত আশা করে এসেছিলো।কিন্তু তার আগেই নিরা আর ছোয়া দুই পাশের প্রথম দুইটা চেয়ার দখল করে আছে।সিদ্রাত আরশির দিকে তাকিয়ে বুঝল ওর মন খারাপ।তাই জিজ্ঞাসা করল…
—”কি ব্যাপার কোনো প্রবলেম হয়েছে?মন খারাপ নাকি?”

আরশি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না।কিছুটা দাঁতে দাঁত চেপে বলল…
—”চোখের সামনে শকুন দেখলে মন তো খারাপ হবেই”

সিদ্রাত আরশির কথা বুঝল না।নিরা আর ছোয়া ভিতরে ভিতরে রাগছে আর ফাটছে।বাকিরাও কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসল।সিদ্রাত অনুশীলনী ১১ ধরল।কারণ ৯ আর ১০ ক্লাসেই করাচ্ছে।আরশির কাছে এই অনুশীলনীটা জমের মতো লাগে।কিছুতেই মাথায় ঢুকে না।সিদ্রাত কয়েকটা অঙ্ক বুঝানোর পর জিজ্ঞাস করল সবাই বুঝেছে কিনা।সবাই বলল বুঝেছে।তাই আরশি না করতে পারল না।না করলেই নিরা আর ছোয়া সুযোগ পাবে কথা শুনানোর।ম্যাথ করানোর বেশিরভাগটা সময় আরশি সিদ্রাতের দিকে আড়চোখে তাকিয়েছে।চোখই যেনো সরানো যায়না।পাঁচটা পর্যন্ত সবাইকে পড়িয়ে সিদ্রাত ছুটি দিয়ে দিলো।আরশি চলে যেতে নিবে কিন্তু সিদ্রাতের ডাকে থমকে গেলো।পেট মোচড় দিয়ে উঠেছে মেয়েটার..
—”আরশিই..ওরা যাক।তুমি বসো ”
আরশি আবারও বসে পড়ল।ফারহা আর বনি মিটিমিটি হাসতে হাসতে চলে গেলো।আরশি ভীষণ লজ্জা পায় এতে।সবাই চলে গেলে সিদ্রাত নিজের চেয়ারটা ছেড়ে আরশির পাশের চেয়ারে এসে বসে…
—”বের করে চ্যাপ্টারটা।আমি জানি তুমি ভালো করে বুঝোনি”
আরশি অবাক চোখে তাকালো।সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল..
—”লিসেন..কে কি বলল না বলল তাতে কান দিলে লাইফে এগিয়ে যাওয়া যায়না।তুমি নিজের এক্সাম্পলটাই দেখো।তুমি ম্যাথটা না বুঝেই চলে যাচ্ছিলে।এতে যারা তোমার সমালোচনা করে তাদের কি আদৌ কোনো ক্ষতি হতো নাকি এক্সামে তোমারই ক্ষতি হতো..হুম?কোনটা বলো..”

আরশি মুগ্ধ নয়নে সিদ্রাতের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।মানুষটার আরও একটা গুণের দেখা পেলো ও আজ।এই লোকটা শুধু ম্যাথই ভালো বুঝায় না।মোটিভেটও ভালো করে।আরশির কানে সিদ্রাতের সুরেলা কন্ঠের বাণীগুলো বারবার প্রতিফলিত হচ্ছে।আরশি মৃদু হেসে চ্যাপ্টারটা বের করল।সিদ্রাত এবার খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো।আরশির মাথায় অনায়াসেই ঢুকে গেলো রুলসগুলো।আরশি তো বলেই ফেলল…
—”স্যার আপনি এতো সুন্দর করে কিভাবে বুঝান?উফফ জাস্ট অসাধারণ।আমার তো এখন মনে হচ্ছে আপনার সংস্পর্শে আসতে হবে ম্যাথের কুইন হতে হলে..”

আরশি এটুকু বলেই জিহবায় কামড় দিলো।সিদ্রাত সরু চোখে তাকালো।পরে দুষ্টুমি করেই বলল…
—”তাই বুঝি?একদম সংস্পর্শেই আসতে হবে!”
আরশি লজ্জা পেয়ে গেলো।লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল..
—”না মানে আমি ওইগুলো মিন করিনি।আমি তো,,,”
এটা বলে আবারও জিহবায় কামড় দিলো।কি যে বলছ ও নিজেও বুঝতে পারছে না।সিদ্রাত আরেকটু দুষ্টুমি করে বলল…
—”ওইগুলো!ওইগুলো কোনগুলো”

আরশি করুণ চোখে তাকালো সিদ্রাতের দিকে।সিদ্রাত হালকা হেসে বলল…
—”আচ্ছা আচ্ছা রিলাক্স।জাস্ট ফান করলাম।”

আরশি নিচের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসল।সিদ্রাত বলল…
—”ওকে এবার বাসায় যাও।ম্যাথ তো বুঝেছোই তাইনা?”
—”হ্যা”
—”হুম গুড।ওকে বাসায় যাও।নামাজ পড়ো।আমিও মসজিদে যাবো।আজান দিবে মাগরিবের”

আরশি সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেলো।সিদ্রাতও মৃদু হাসল
আজানের পাঁচ মিনিট আগেই মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো।গেইটের সামনে আসতেই হঠাৎ আরশির রুমের বারান্দায় চোখ যেতেই দেখল আরশি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।সিদ্রাতকে দেখার সাথে সাথে আরশি লজ্জা পেয়ে ভিতরে চলে গেলো।সিদ্রাত মুচকি হেসে মসজিদে চলে গেলো…

চলবে..
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here