প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ৫৩+৫৪

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_53
#Writer_TanhaTonu

সিদ্রাত বলল…
—”ও আমার সন্তান আরশি।কখনো এই কথাটা বলবে না যে ও কার সন্তান?আমি ওর বাবা..
তবে তোমার কাছে আমি কিছুই লুকাবো না।সব ক্লিয়ার করব। নীরার রক্ত ওর শরীরে..নীরা আর হাবিবের রক্ত ওর শরীরে।কিন্তু সেসব আমি মানি না।জন্ম থেকে ও আমার সন্তান হয়েই বড় হচ্ছে…”

আরশি সিদ্রাতের কথায় চিল্লিয়ে বলে উঠল…

—”কিইইহহ??নীরা??”
___________________________________

আরশির চিৎকারে সিদ্রাতের তেমন কোনো ভাবাবেগে হলো না।আরশি আবারও বলল…

—”নীরার সন্তান আপনার কাছে কেন আর কীভাবে?আপনি ওর সন্তানকে নিজের সন্তানের পরিচয়ই দিচ্ছেন কেন?”

—”তোমার মনে আছে তুমি নীরার উপর চিৎকার চেচামেচি করলে আমি তোমার উপর রিয়েক্ট করতাম?চড়-থাপ্পর দিতাম?”

আরশি কষ্টমিশ্রিত কন্ঠে বলল…
—”হুম..আর লাস্ট বার তো সেজন্যই তিন বছর আপনার থেকে দূরে থাকতে হলো।এতো কিছু ঘটে গেলো আমাদের লাইফে”

সিদ্রাত ঘন একটা শ্বাস ফেলল…
—”হুম..কিন্তু এর পেছনে রিজন ছিলো।নীরা মেন্টালি সিক ছিলো যেটা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলো।ও “অ্যাডেল সিন্ড্রোম” নামক সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলো”

আরশি ভ্রু কুচকে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।তারপর বলল…
—”এটা কিভাবে সম্ভব?এটা তো প্রেম ঘটিত মানসিক সমস্যা।কিন্তু ও আবার কার প্রেমে এমন পাগল হলো?”

সিদ্রাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তারপর বলতে শুরু করল…

—” ‘অ্যাডেল সিন্ড্রোম’ এমন একটি রোগ যেটায় আক্রান্ত রোগী একজনকে ভালোবাসার পর যদি ব্রেকাপ হয়ে যায় তবুও তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।আর এক সময় স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়…

এটা তো জানো যে ফ্রেঞ্চ লেখক ভিক্টোর হুগো’র কন্যা অ্যাডেল হুগো’র নামানুসারে এই রোগের নাম “অ্যাডেল সিন্ড্রোম।” অ্যাডেল সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিল । সিজোফ্রেনিয়ার কারণে তার নতুন ধরণের এক আসক্তি দেখা দেয় । সে একজন ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসারের প্রেমে এতটাই আসক্ত হয়ে পরে যে মিলিটারি অফিসারটি তাকে প্রত্যাখ্যান করলে সে পাগলপ্রায় হয়ে যায় । এই রোগের পরিণতি হিসেবে সেই মিলিটারি অফিসারটি অন্য একজনকে বিয়ে করলে শেষ পর্যন্ত অ্যাডেলের ঠাঁই হয় পাগলাগারদে….

প্রেম নিয়ে এই ভয়াবহ আসক্তি যে এক ধরণের অসুস্থতা তা অনেকেই মানতে চায় না । কিন্তু সাইক্রিয়াটিস্টরা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখেছেন যে, এ আসক্তি তামাক, অ্যালকোহল বা ক্রেপটোম্যানিয়া আসক্তির মতই ভয়াবহ যা রোগীর শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে । এ ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি বিষন্নতায় ভুগতে থাকে, তারা নিজেই নিজেকে নানাভাবে কষ্ট দিতে থাকে, অবাস্তব আশায় বুক বাঁধে, নিজেই নিজেকে বিভিন্নভাবে ধোঁকা দিতে থাকে, কারো কোন উপদেশ মানতে চায়না, বেপরোয়া আচরণ করতে থাকে, কারো সাথে মিশতে চায়না এবং ভালবাসার মানুষটি ছাড়া পৃথিবীর যাবতীয় ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে যেটা নীরার সাথেও হয়েছিলো।হাবিব নামক এক গুন্ডাকে ও ভালোবেসে ফেলে যেটা কেউ জানত না।হাবিব ওকে রিজেক্ট করে।তারপর থেকেই ওর এই রোগের সিম্পটমগুলো শুরু হয়।তবে তার আসক্তিটা হাবিবের উপর তৈরি হয়না।আনফর্চুনেটলি সে সেকেন্ড টাইম প্রেমে পড়ে এন্ড আসক্তি তৈরি হয় তার সেকেন্ড লাভের প্রতি।আর তার সেকেন্ড লাভটা অন্য কেউ ছিলো না..আমিই ছিলাম”

আরশির চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেলো।ওর মনে হচ্ছে ও ভুল কিছু শুনছে।অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল…

—”পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি?ও আপনার প্রেমে কখন পড়ল?আর পড়লেও আমরা কেউই টের পেলাম না?”

—”হুম পাওনি।কারণ ও আমি এই স্কুলে জয়েন করার আগেই আমার প্রেমে পড়েছিলো এন্ড ও প্রকাশ্যে কিছুই করত না।ও ডিরেক্টলি আমায় প্রপোজ করে।কিন্তু আমিও ওকে রিজেক্ট করি।আর আমি তখন জানতাম না ও এই রোগে আক্রান্ত।কিন্তু ওকে রিজেক্ট করার পর থেকেই ওর পাগলামিগুলো শুরু হয়।আর একটা ব্যাপার অলওয়েজ খেয়াল করতাম ও তোমাকে এট্যাক করতে চাইত বিভিন্নভাবে।তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই ও কিছু ছেলেকে দিয়ে তোমায় রেপ করাতে চেয়েছিলো?”

আরশি দ্রুত হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায়।সিদ্রাত আবারও বলে…

—”শুধু সেটাই না।ও তোমাকে খুন করার চেষ্টাও করেছে বিভিন্ন সময়।বাট আমার কারণে সাকসেস হয়নি।ওর আক্রমণাত্মক আচরণটা তখন বেড়ে যেতো যখন তুমি ওর উপর চিৎকার করতে বা আমার প্রতি পজিসিভ হতে ওর সামনে।বাট এর বিপরীত ঘটনাটা যদি ঘটত তাহলে ও একদম শান্ত হয়ে যেতো।বিপরীত ঘটনাটা আবার কী সেটাই তো ভাবছ?তোমার প্রতি আমার রিয়েক্ট,তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করা..এগুলোই ওকে শান্ত রাখত যা তোমায় সেইভ রাখত ওর থেকে”

সিদ্রাতের কথা শুনে আরশি ধপ করে পাশে থাকা সোফায় বসে পড়ল।এতো কিছু ওর সামনে ঘটে গিয়েছে অথচ ও কিছুই জানে না।আরশির মাথা যেনো চক্কর দিচ্ছে।সিদ্রাত সিহরাতকে বেডে বসিয়ে দিয়ে নিজে আরশির পাশে বসে ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।আরশি ফ্যালফ্যাল চাহনীতে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।সিদ্রাত কোমল কন্ঠে বলল…

—”এবার বুঝেছো তো আমি কেন তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম ওর সামনে?”

আরশি লম্বা একটা শ্বাস নিলো।তারপর বলল..
—”কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন ও এ রোগে আক্রান্ত?”
—”ওর আচরণে আমার সন্দেহ হতো।তাছাড়া আমি মেন্টাল ডিজর্ডারের উপর কিছু স্টাডি করেছিলাম।তাই কিছুটা সন্দেহ থেকেই আমি আমার চেনা একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে ওর ব্যাপারটা ক্লিয়ার করি।পরে উনি নীরার টেস্ট নিয়ে নিশ্চিত করেন যে আমার সন্দেহই সত্যি”

—”কিন্তু এসবের সাথে এই বাচ্চার কি সম্পর্ক?উফফ আমার মাথা পাগল হয়ে যাবে”

আরশি দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে…

—”এরপর আর নীরাকে নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাইনি।ওর ব্যাপারটা আমি ওর বাবা-মাকে ক্লিয়ার করি।পরে উনারাই ওর ট্রিটমেন্ট কন্টিনিউ করে।এসবকিছু তুমি থাকা কালীন ঘটা ঘটনা।তারপর দুই বছর কেটে যায়।আমিও মেন্টাল প্রবলেম থেকে বেরিয়ে আসি।আব্বুর অফিসে জয়েন করি।একদিন আমার মোবাইলে ফোন আসে এক হসপিটাল থেকে।বলা হয় আমার পরিচিত একজন নাকি প্রেগনেন্ট।আমার সাহায্য চাচ্ছে।তার ডেলিভারি হবে।আমি ছুটে হসপিটাল যাই।সেখানে গিয়ে নীরাকে দেখে অবাক হয়ে যাই।ও আমার হাত ধরে কেঁদে দেয় আর বলে হাবিব নাকি ফিরে এসেছিলো।ওকে বেডে নিয়ে গিয়েছিলো।ভালোবাসায় পাগল হয়ে নীরাও কোনো দ্বিধা ছাড়াই ফিজিক্যালি হাবিবের সাথে এট্যাচড হয়।তারপর নাকি হাবিবের অংশ ওর গর্ভে আসলে হাবিব পালিয়ে যায়।বাসা থেকেও ওকে বের করে দেয়া হয়।আমাকে শুধু অনুরোধ করে ওর কিছু হয়ে গেলে যেনো ওর বাচ্চাটাকে আমি দেখি।সেদিন নীরা সত্যিই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলো। রয়ে গিয়েছিলো নিষ্পাপ বাচ্চাটা।আমি নিজের সন্তান হিসেবেই ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম।প্রতিজ্ঞা করেছিলাম নিজের কাছে ও আমার সন্তান হয়েই থাকবে আজীবন”

সিদ্রাত একদমে কথা শেষ করে আরশির দিকে তাকায়।আরশির চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।সিদ্রাত অশ্রুকণা মুছে দিতে চাইলে আরশি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সিদ্রাতকে আর চিল্লিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে…

—”আমি মেনে নিতে পারব না এই বাচ্চা।কিছুতেই না।ওর শরীরে নীরার রক্ত।দুই বেইমানের রক্ত ওর শরীরে।নীরার বাচ্চা নীরার মতোই হবে।আমি কিছুতেই ওকে নিজের সন্তানের জায়গায় বসাবো না…”

সিদ্রাত বিষ্ময় নিয়ে আরশির দিকে তাকিয়ে থাকে।ও যেনো ভাবতেই পারছে না তার প্রেয়সী এতোটা স্বার্থপর হতে পারবে!
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_54
#Writer_TanhaTonu

সিদ্রাত একদমে কথা শেষ করে আরশির দিকে তাকায়।আরশির চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।সিদ্রাত অশ্রুকণা মুছে দিতে চাইলে আরশি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সিদ্রাতকে আর চিল্লিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে…

—”আমি মেনে নিতে পারব না এই বাচ্চা।কিছুতেই না।ওর শরীরে নীরার রক্ত।দুই বেইমানের রক্ত ওর শরীরে।নীরার বাচ্চা নীরার মতোই হবে।আমি কিছুতেই ওকে নিজের সন্তানের জায়গায় বসাবো না…”

সিদ্রাত বিষ্ময় নিয়ে আরশির দিকে তাকিয়ে থাকে।ও যেনো ভাবতেই পারছে না তার প্রেয়সী এতোটা স্বার্থপর হতে পারবে!
_____________________________________

সিদ্রাত আরশির গাল দুটো দু’হাতে আলতো করে ধরে।আরশি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সিদ্রাতের দিকে।সিদ্রাত বলল….

—”আরশি তুমি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে দেখো..ওর কি এই বিশাল পৃথিবীতে কেউ আছে?কেউ নেই। নীরা যা-ই করে থাকুক না কেন তার জন্য এই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে তো আমরা শাস্তি দিতে পারিনা”

আরশি মুখ ঘুরিয়ে নিলো।সিদ্রাত হাত দুটো সরিয়ে নিলো আরশির গাল থেকে।আরশি বলল….

—”নীরার করা অন্যায়গুলো আমি ভুলতে পারব না।ও আমাকে রেপ পর্যন্ত করাতে চেয়েছিলো।সেদিন আরেকটু হলে আমার রেপটা হয়েই যেতো।তখন কিন্তু সমাজের মানুষ এই নীতি কথাগুলো বলত না।বরং তারা আমায় বাধ্য করতো আত্মহত্যা করতে।আমার বাবা-মা হয়ত সমাজে মুখ দেখাতে পারত না।তখন তারাও কোনো ভুল পথ বেছে নিতো।সে দায় কি আপনার নীরা নিতো সেদিন?নাকি তার ভাড়া করা সেই রেপিস্ট নিতো?কেউ নিতো না,,কেউ না।আমার কথা কিন্তু সমাজ ভাবত না।বরং অন্যায় না করেও লাঞ্চনা,অপমান,ধিক্কার মাথায় নিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে হতো।তাহলে আজ আমি কেন নীরার কথা ভাবব?কেন ভাবব ওর রক্তের কথা?’রক্তের টান’ কথাটার মানে বুঝেন?নীরার সব অপরাধ না হয় একটা অসুখের আড়ালে চাপা পড়ে গেলো।কিন্তু ওর বাবা-মা?তাদের অপরাধ?আরও আটবছর আগের ঘটনা।নীরার আব্বু আর আমার আম্মুর খালাতো বোন একই স্কুলে জব করত।নীরার আব্বু আমার সেই আন্টিকে বাজে অফার করেছিলো।আন্টি রাজি হয়নি।তাই ফেইক ভিডিও বানিয়ে ভাইরাল করে দিয়েছে।সেদিনও কিন্তু কেউ আমার আন্টির কথা শুনেনি।বরং তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো আত্মহত্যার পথে।ব্রিজ থেকে লাফিয়ে সব অপমানের বিসর্জন দিয়েছিলো আমার আন্টি।নীরার আব্বু যেমন খারাপ ছিলো তেমন রক্তের ধারায় নীরাও একই হয়েছে..জঘন্য পরিবার এরা।তাহলে সেই পরিবারের আরেক রক্ত যে ভালো মানুষ হবে তার কি প্রমাণ?আমি এসবে নেই।আমার আন্টির কেইস প্রমাণের অভাবে চাপা পড়ে গিয়েছে।আমারটাও হয়ত এমনই হতো।আমি এই নোংরা রক্তের কাউকে আমার বাসায় জায়গা দিবো না…”

আরশি কথাগুলো বলে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।ডান হাতের তালু দিয়ে চোখটা মুছে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।সিদ্রাত অবাক চাহনীতে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে।আরশির আন্টির ঘটনা যে আজ তার সামনে প্রথমবার উদঘাটন হলো।সিদ্রাত লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল….

—”আরশি তোমার আন্টির সাথে যা ঘটেছে তা খুবই বাজে ছিলো।আর এজন্য নীরার আব্বু শাস্তি ডিজার্ব করে।আমি সেই শাস্তির ব্যবস্থা করব।কিন্তু প্লিজ ওদের শাস্তি এই ফেরেশতার ন্যায় নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে দিও না।ওকে আমি কার কাছে রাখব বলে?তুমি জানো না এই পৃথিবীটা কতটা নিষ্ঠুর?একটা এতিম মেয়ের জন্য জীবনের প্রতিটি পথ কন্টকময়।আল্লাহর কাছে আমাদেরকে জবাবদিহিতা করতে হবে আরশি..এতো বড় অন্যায় করা যাবে না।আর রক্তের ধারার দোহাই দিয়ে আমরা এতোটা স্বার্থপর হতে পারিনা পাখিটা।আমাদের জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ)ও তো এক পুরোহিতের ঘরে জন্মেছিলো,,,উমর(রা) ও তো একজন নন মুসলিম ছিলেন যে কিনা মহানবী(সা)কে মারতে তলোয়ার তুলে নিয়েছিলেন হাতে,,আছিয়া(আ)ও তো ফিরাউনের ওয়াইফ হয়েও তিনি শ্রেষ্ঠ চারজন নারীর মধ্যে একজন…সবকিছুকে রক্ত বা সম্পর্ক দিয়ে পরিমাপ করলে হয়না আরশি।নীরা ওর বাবার শিক্ষায় বড় হয়েছে তাই ওর নৈতিকতা ছিলো না।কিন্তু সিহরাতকে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে আগলে রাখব।নৈতিকতা কাকে বলে ও-ই মানুষকে শিখাবে।প্লিজ তুমি মুখ ফিরিয়ে নিও না”

সিদ্রাতের আকুতিভরা কথা আরশির মন গলাতে পারল না।ও শক্ত কন্ঠে বলল….
—”আমি এসব কিছু শুনতে চাইনা।যা বলার আমি বলে দিয়েছি।ওই নীরার রক্তের ঠাই আমার আঙিনায় হবে না”

সিদ্রাতও এবার বেশ রেগে গেলো।চিল্লিয়ে বলে উঠল….
—”রক্ত!রক্ত!রক্ত!…ফেড আপ আমি তোমার এই রক্তের বাহানা শুনতে শুনতে।এতো রক্ত রক্ত যে করছ তোমার গুষ্ঠির রক্ত ভালো বুঝি?তোমার ফুপিদের সব রেকর্ডই আমি শুনেছি।তোমার বড় ফুপি তো তোমার আম্মুর নামেই মানুষের কাছে মিথ্যা মিথ্যা অপবাদ রটায় তাইনা?আর রইল তোমার ছোট ফুপি!সে তো আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে।নিজেরই আপন মেঝো বোনের হাজবেন্ডের সাথে ফস্টিনস্টি করে,, প্রতিদিন নতুন নতুন বিএফদের সাথে ফ্লাটে যায়।বিয়ে তো হয়না তাইনা?এরকমই তো শুনেছি।তাহলে সেই রক্তের মেয়ে হয়ে তুমি যে সতীসাধ্বী তার প্রমাণ কি বলো আমায়?”

আরশি থমকে গেলো সিদ্রাতের কথাগুলো শুনে।চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরে পড়ছে মেয়েটার।সিদ্রাত যে শেষ পর্যন্ত ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলবে তা যেনো ভাবাটাও ওর জন্য পাপ ছিলো।আরশি জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল….

—”আপনি,,,আমার চরিত্র,,,নিয়ে এভাবে বলতে পারলেন?”

সিদ্রাত মুখ ঘুরিয়ে নিলো।শক্ত গলায় বলল….
—”আমি কারও চরিত্র নিয়ে কিছুই বলিনি।তোমার কথাই আমি তোমার কাছে ব্যাখ্যা করেছি জাস্ট।রক্তের ধারাই যদি সব হতো তাহলে সিহরাত যদি খারাপ হয় তাহলে তুমিও কোনো ফেরেশতা না।কিন্তু বাস্তবেতো তেমন কিছুই না আমি জানি।আমি জাস্ট তোমাকে বোঝাতে চাচ্ছি যে,,,,,”

আরশি হাত উঁচু করে সিদ্রাতকে থামিয়ে দিলো।রেগে কাঁদতে কাঁদতে বলল…

—”আর কিছু বোঝাতে হবে না আমায়।আজ আপনি আমায় চারটা চড় মারলেও হয়ত এতোটা কষ্ট লাগত না যতটা না আপনি আমার চরিত্র নিয়ে বলে দিয়েছেন।আমি যেহেতু খারাপ আমার সাথে আপনার আর আপনার নীরার সন্তানের মতো ফেরেশতাদের থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।পরে শরীরে পঁচন লেগে যাবে..বলা তো যায়না!আমি খারাপ….আমিই চলে যাবো।থাকেন আপনি আপনার সিহরাত,নীরা,হাবিব..সবাইকে নিয়ে”

আরশি কথাগুলো বলে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলো।সিদ্রাত মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়প।বিড়বিড় করে বলল…
—”মেয়ে মানুষের দোষই এটা!যা বোঝাতে চাই তা মরে গেলেও বুঝবে না।উল্টা-পাল্টা বুঝে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে এই নারী জাতি…”

আরশি অলরেডি নিজের জামা-কাপড় সব গুছিয়ে ফেলেছে।রাগী চোখে বেডের দিকে তাকালো।সিহরাত বেডে বসে ফ্যালফ্যাল চোখে আরশিকেই দেখে যাচ্ছে।আরশির রাগ আরও বেড়ে গেলো।ও এগিয়ে গিয়ে সিহরাতের হাত চেপে ধরে বলল….

—”বেয়াদ্দপ মেয়ে এভাবে তাকাস কেন?তোর মা আমার জীবনটাকে অর্ধেক নরক বানিয়েছে আর তুই পুরো বানালি।অসভ্য মেয়ে কোথাকার”

হাতে ব্যথা অনুভব করায় সিহরাত চিকন কন্ঠে কেঁদে উঠল।সিদ্রাত রেগে আরশির দিকে এগিয়ে যেতে নিবে তার আগেই আরশি সিহাতের হাত ঝাড়া মেরে ছেড়ে দিলো।বাচ্চা মেয়েটা ঠোঁট উল্টিয়ে ছোট ছোট তুলতুলে নরম হাত দুটো বুকের মাঝে চেপে ধরল।সিদ্রাতের কষ্ট লাগল বাচ্চাটার জন্য।সেই সাথে আরশির উপর রাগটাও বেড়ে গেলো….

—”কোথায় যাবে তুমি এখন?”
—”যেখানেই যাই আপনার সাথে আর এক ঘরে থাকব না আমি”

কথাটা বলেই আরশি লাগেজটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল।সিদ্রাত রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল….

—”বেশি বাড় বেড়ো না বলে দিচ্ছি।সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে ঘিয়ের পুরো কৌটাটাই উলটে দিতে জানে এই সিদ্রাত”

আরশি পাত্তা দিলো না সিদ্রাতের কথায়।রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।সিদ্রাত সিহরাতের দিকে একবার তাকালো।তারপর রুম থেকে বের হয়ে যেই আরশিকে আটকাতে যাবে দেখল আরশি সিড়ি বেয়ে নেমে নিচে গেস্টরুমে ঢুকছে।সিদ্রাতের ভ্রু জোরা অটোমেটিক কুচকে গেলো।ও জোরে জিজ্ঞাস করল….
—”কি ব্যাপার তুমি না চলে যাও?”

আরশি রুম থেকে বের হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল….
—”চলে এসেছিই তো।বলেছিই তো আপনার সাথে থাকব না।এজন্যই তো আপনার রুম ছেড়ে এসে পড়েছি।কেন আপনি কি ভেবেছেন আমি বাসা ছেড়ে চলে যাবো?এতো সহজ না।আমার সংসার আমি ছাড়ব কেন?যেনো আপনি ওই নীরার বাচ্চাকে নিয়ে আমোদে-প্রমোদে কাটাতে পারেন?উহু…তা হচ্ছে না..হুহ”

আরশি কথাটা বলেই ভিতরে ঢুকেই শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো।সিদ্রাত মুচকি হাসল আর নিজে নিজে বলল…

—”আর যাই হোক আমার বউটা জাতে মাতাল তালে ঠিক ”

সিদ্রাত নিজের রুমে গেলো।গিয়ে দেখল সিহরাত বেডে আগের মতোই বসে আছে দুহাত বুকে জড়িয়ে। শুধু চোখের পাপড়িগুলো ভেজা।সিদ্রাতের বেশ কষ্ট লাগল শান্তশিষ্ট বাচ্চাটার জন্য।এই মেয়ে আর যাই হোক নীরার মতো যে হবে না তাতে সিদ্রাত হান্ড্রেট পার্সেন্ট সিউর।সিদ্রাত সিহরাতের পাশে বসে সিহরাতের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিলো।আর সিহরাতও ঝাঁপ মেরে সিদ্রাতের কোলে উঠে গালে অসংখ্য চুমু দিয়ে দিলো।সিদ্রাত হেসে দিলো বাচ্চাটার কাজ দেখে।পরম যত্নে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল সিহরাতকে সিদ্রাত….

————

আরশি বেডের সাথে হেলান দিয়ে কাঁদছে আর রেগে বিড়বিড় করছে….
—”তোর জন্য আজ এসব হয়েছে নীরা।শুধু তোর জন্য..তোর জন্য আজ আমি বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে রুড বিহেইভ করেছি।ছিহ কতটা জঘন্য হয়ে গিয়েছি আমি!মাফ করব না আমি তোকে..মরেও শান্তি দিলি না আমায়।”

আরশি দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগল…

—”নাহ যা হবার হবে।কিন্তু তোর বাচ্চাকে আমি মানতে পারব না।কিছুতেই পারব না আমার সিদ্রাতকে হারাতে,,ভবিষ্যতে আমার বাচ্চাদের জীবন নরক বানাতে…”

চলবে…

আমি জানি আরশির উপর এখন সবাই মোটামুটি বেশ রেগে আছেন বা থাকবেন।তাতে আমার আপত্তি নেই।রাগ করাটাও জায়েজ…
বাট আমি একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করতে চাই।সেটা
হলো—আমরা মানুষ।ভুল,অন্যায়,অপরাধ মানুষের জন্যই প্রযোয্য।তবে উত্তম সে যে নিজের অন্যায় বা অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়।যাইহোক…আমি চাইলে গল্পটা অন্যরকমভাবে লিখতে পারতাম।অনেকটা এভাবে যে সিদ্রাত সিহরাতকে বাসায় নিয়ে আসল আর আরশিও খুশি মনে মেনে নিলো।কিন্তু আমি এভাবে লিখি নি।কারণ আরশিও মানুষ।ও গল্পের হিরোইন বলে কি সবসময় সবক্ষেত্রেই ওকে ভালো হতে হবে?তাহলে তো সে ফেরেশতা হলেই পারত।গল্প হোক বা সিনেমা…সবসময় হিরো-হিরোইনকে মহান বানিয়ে দিলে আমি মনে করি এতে গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট হয়।বাস্তবতা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়।অনেকটা রোবোটিক হয়ে যায়।মানুষ মানেই ভালো-খারাপ মিলিয়ে।ভুল না করলে তো সে মানুষই না।কিন্তু হাদিসেই আছে—”প্রত্যেক আদম সন্তান ত্রুটিশীল ও অপরাধী;তবে অপরাধীদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাওবাকারী”—(তিরমিজি)
এখন দেখা যাক আরশি নিজের ভুলের মধ্যেই বহাল থাকে নাকি অনুতপ্ত হয়!
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here