প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ৫৭+৫৮

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_57
#Writer_TanhaTonu

সিদ্রাত আরশির নিচের ঠোঁটে ছোট্ট করে কিস করে হেসে চলে গেলো।আরশি ছোট্ট সোফাটায় বসে পড়ল।ওর মাথা ঘুরাচ্ছে।
—”কি বলে গেলো এসব উনি?তাহলে কি আজ সত্যিই…!! “উফ নাহ..”

লজ্জায় আরশি একদম নুইয়ে গেলো।ওর শরীরের লোমগুলো পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গিয়েছে।কি হবে একটু পর ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে…
______________________________________

আরশি শাড়িটা চেইঞ্জ করে একটা পাতলা অফ হোয়াইট কুর্তি আর আর ব্লুয়িশ প্লাজো পড়ে লাইট অফ করে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ল।বারবার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে টাইম দেখার জন্য।সময়ের গতি যত বাড়ছে আরশির হার্ট বিটও তত বাড়ছে।কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না মেয়েটা।এমন হুট করে সিদ্রাত এমন একটা প্রস্তাত দিবে ভাবতেই পারেনি আরশি।শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গিয়েছে একটু পর কি হবে তা ভাবতেই…

বারোটা চারে সিদ্রাত সত্যিই রুমে আসল।দরজা লক করে দেখল আরশি মাথা পর্যন্ত কম্ফোর্টার টেনে শুয়ে আছে।সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির পাশে গিয়ে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।আরশির পেটের ভিতর যেনো মোচর দিয়ে উঠল সিদ্রাতের স্পর্শে।অথচ এমনভাবে কতই জড়িয়ে ধরেছে।কখনো এমন হয়নি।সিদ্রাত কম্ফোর্টারের ভিতর ঢুকে আরশির গালে গাল স্লাইড করতে করতে নেশাধরা কন্ঠে বলল…
—”আমি জানি তুমি ঘুমাও নি”

আরশি ফট করে চোখ করে খুলে বিস্ফোরিত নয়নে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।সিদ্রাত বাঁকা হেসে আরশির ঠোঁটে নিজের বুড়ো আঙুলটা স্লাইড করতে করতে বলল…
—”ধরা পড়েই গেলে এট লাস্ট?”

আরশি এবার জিহবায় কামড় দিলো।আমতা আমতা করে বলল…
—”না মানে,,,”
আরশি চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল…
—”আমি ঘুমাবো প্লিজ।এমন করিয়েন না”

সিদ্রাত আরশির বুকে মাথা রেখে বাঁকা হেসে বলল…
—”কি করেছি?”

আরশি করুণ চোখে তাকালো সিদ্রাতের দিকে।ওর বুক ধুকপুক ধুকপুক করে ছন্দ তুলছে।সিদ্রাত মৃদু হেসে বলল….
—”আমার বুকের ভিতরও তোমার মতোই ছন্দ বয়ে যাচ্ছে…দুটো ছন্দকে একসাথে মিলিয়ে দেয়া দরকার..কি বলো?”

সিদ্রাত কথাটা বলে মাথাটা উঁচু করে আরশির চোখে চোখ রাখল।আরশির বুকের ভিতর যেনো ঢেউ বয়ে যাচ্ছে সিদ্রাতের এমন চাহনীতে।ঘোলাটে মাতাল করা এ চাহনী কি ফিরিয়ে দেয়া যায়?আরশি করুণ স্বরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল…
—”দেখুন,,আমি ঘুমাবো।আর,, আমার সাথে,,আপনি জোর করতে,,পা,রেন না।আমি মামলা,,করব আপনার নামে,,,”

আরশির কথা শুনে সিদ্রাত হু হা করে হেসে উঠল।অতঃপর নিজের শরীরের ভর আরশির শরীরে ছেড়ে দিলো।আরশির মুখ কুচকে গেলো।সিদ্রাত আরশি দু’গালে আলতো করে হাত রেখে বলল…
—”আমিও মামলা করব তোমার নামে নিজের স্বামীকে রেখে অন্য রুমে ঘুমানোর অভিযোগে…”

আরশি পারে না কেঁদেই দেয় সিদ্রাতের এমন ব্যবহারে।সিদ্রাত এবার কিছুটা সিরিয়াস হয়েই বলল…
—”কিছুদিন আগেও তো তুমি আমার কাছে আসতে চাইতে।আর আজ আমি নিজে তোমার কাছে এসেছি জানপাখি।তারপরও তুমি আমায় দূরে ঠেলে দিচ্ছো!তুমি কি সত্যিই চাও না আমি তোমার কাছে আসি?তোমাকে স্পর্শ করি?তোমার মন যা বলে তাই বলো।আমি জোর করব না তোমায় কোনোকিছুর জন্য”

আরশি মুখ ঘুরিয়ে নিলে অন্যদিকে।সিদ্রাতের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। বুকটায় যেনো চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।সিদ্রাত মলিন কন্ঠে বলল…
—”আমি সামান্য মুখ ফিরিয়ে নেয়া বা কিছু কথায় তোমার থেকে দূরে যেতে চাইনা আরশি।একসাথে তোমার সাথে জীবনটা কাটাতে চাই।আমি জানি তুমি অভিমান করে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো।প্লিজ সোনাপাখি..এতো অভিমান করো না”

আরশির চোখ ভরে এসেছে জলে।তবুও ঠোঁট কামড়ে ধরা গলায় বলল…
—”প্লিজ চলে যান। আমার ভালো লাগছে না।সিহরাত যতদিন এ বাড়িতে থাকবে ততদিন আপনি আমায় স্পর্শ করার অনুমতি পাবেন না,,,আমি আপনাকে অধিকার ফলানোর অনুমতি দিবো না সিহরাত এ বাসায় থাকলে…”

সিদ্রাত অবাক নয়নে আরশির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ধরা গলায় বলল…
—”একটা এতিম মেয়েকে একটা পরিচয় দিয়ে আমি কোনো ভুল করিনি.. এটা আমি হাজারবার বলতে পারব।ওর বাবা-মা কি করেছে তা আমার দেখার বিষয় না।ও একটা নিষ্পাপ বাচ্চা।অথচ তুমি বলছ আমি সামার্থ্য থাকার পরও তাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতাম!তোমার কাছ থেকে এতোটা মূর্খের মতো বিহেইভ আমি আশা করিনি।ছুটে এসেছিলাম তোমার কাছে।তোমাকে আপন করে নিতে।নিজের কাছে নিয়ে যেতে।কিন্তু তুমি তো তোমার কথায় অটল..ওকে..থাকো তুমি তোমার কথা নিয়ে।যাচ্ছি আমি…”

সিদ্রাত আরশির উপর থেকে উঠে বসল।বেড থেকে নেমে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেলো।আরশির চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।ও নির্বাক দৃষ্টিতে সিদ্রাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।সিদ্রাত দরজার পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেলো।মাথাটা পেছনে ঘুরিয়ে আবারও বলল….

—”যেদিন কবুল বলে তোমাকে পবিত্র সম্পর্কে বেঁধেছিলাম সেদিন রাতে কিছু কথা বলেছিলাম তোমায়।তুমিও কথা দিয়েছিলে রাখবে আমার কথা।কিন্তু তুমি রাখতে পারোনি সে কথা…
মনে আছে কি বলেছিলাম সেদিন?বলেছিলাম আমাদের মাঝে মান-অভিমান হলেও কখনো আমার বেড রেখে অন্য বেডে যেও না।এটা শয়তানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।বিছানা ত্যাগ থেকেই শয়তান একসময় ডিভোর্স পর্যন্ত নিয়ে যায়…”

সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তারপর হনহনবকরে চলে গেলো।আরশি হু হু করে কেঁদে উঠল।কানের মধ্যে বারবার বাজতে লাগল..”ডিভোর্স” নামক শব্দটা।অজানা একটা ভয় এসে ঘিরে ধরল মেয়েটাকে।মনে হচ্ছে চারপয়াশ থেকে কেউ বলছে তোদের ডিভোর্স হবেই হবে..আরশির যেনো দম আটকে আসছে।বালিশ বুকে জড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে লাগল ও…এতোটা অস্থির এর আগে কখনো লাগেনি…

সিদ্রাতও নিজের রুমে এসে বারান্দায় চলে গেলো।গ্রিল ধরে দূর আকাশের দিকে তাকালো।কেন যেনো আকাশ পানেও তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।চোখটা বন্ধ করে ফেলল সিদ্রাত।আর সাথে সাথে দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু কণার সাথে লেপ্টে থাকা কিছু কষ্ট।

সিদ্রাত গ্রিল ছেড়ে থাইয়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়প।কোনো কিছু ভাবতেও কেন যেনো কষ্ট হচ্ছে।শূন্য দৃষ্টিতে ও আকাশের দিকে তাকালো পুনরায়।সবকিছু এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে কখনো ভাবেইনি বোধয়…

সিদ্রাতের কানে আজানের ধ্বনি ভেসে আসল।ও চোখটা ভালো করে মুছে রুমের ভিতর গেলো।দেখল সিহরাত হাত-পা জামার ভিতরে ঢুকিয়ে ঘুমিয়ে আছে।একদম কিউটের ডিব্বা লাগছে।সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিহরাতের পাশে গিয়ে ফ্লোরে হাঁট গেড়ে বসল।তারপর সিহরাতর কপালে চুমু দিয়ে বলল…
—”সবার কপালে বাবা-মায়ের ভালোবাসা থাকে না রে মামনী।তুমিও হয়ত তাদের দলের একজন।পারলে তোমার এই পাপাটাকে মাফ করে দিও সোনামনি..”

সিদ্রাতের চোখ বেয়ে আবারও পানি গড়িয়ে পড়ল।ও ওয়াশরুমে চলে গেলো।ওযু করে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো…
————–

চোখে-মুখে সূর্যের আলো পড়তেই আরশির ঘুমটা ভেঙে গেলো।চোখ ডলতে ডলতে বেডে পা মুড়িয়ে বসল।মাথাটা যেনো একটু একটু ভারী লাগছে। পরক্ষণেই আরশির মনে পড়ল রাতে তো আর ঘুম হয়নি।একদম ফজরের নামাজের পরে ঘুমিয়েছিলো মেয়েটা।আরশি মোবাইলে চেক করল টাইম এখন নয়টার উপর।পরপর দুটো হামি দিয়ে আরশি বেড থেকে উঠে পড়ল।ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে গেলো।দেখল স্যান্ডউইচ বানানো।আরশি ভ্রু কুচকালো আর বিড়বিড় করে বলল…

—”শুধু স্যান্ডউইচ কেন?বাচ্চাকেও কি উনি এসব খাইয়েছে নাকি?”
আরশির মুখে বিরক্তি দেখা গেলো।ও কিচেন থেকে বেরুতে গেলেই এক জোরা ছোট ছোট হাত এসে ওর পা জড়িয়ে ধরল।আরশি চমকে তাকাতেই দেখল সিহরাত ওকে জড়িয়ে ধরেছে।বাচ্চাটা আরশির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো।আরশির মনটা যেনো জুড়িয়ে গেলো বাচ্চাটার হাসি দেখে।সিহরাত আধো আধো বুলিতে বলল..
—”আ,,ম্মু…তুতা,,তুতা,,”

আরশির ভিতর কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভূতি ছেয়ে গেলো সিহরাতের “আম্মু” ডাক শুনে।যেনো মনে হচ্ছে সিহরাত ওরই নিজের গর্ভের সন্তান।কত সুন্দর করে বাচ্চাটা কথা বলে!কিন্তু আরশি সিহরাতের “তুতা” কথার অর্থ বুঝতে পারল না।হাঁটু গেড়ে বসে বলল…
—”আবার বলো তো..”তুতা”আবার কী?”

সিহরাত টলমলে চোখে আরশির দিকে তাকালো।আরশির খুব মায়া হলো সিহরাতের এমন মুখ দেখে।সিহরাতের চোখের পাপড়ি ভিজে গেলো।মেয়েটা আরশির বুকে মাথা রেখে আরশির শরীরের সাথে লেপ্টে ধারালো আর বলতে লাগল…

—”তু,,তা,,খাপো,,খাপো,,উউউউউ,,,”

সিহরাত কেঁদেই দিলো।আরশির বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে কিছু একটা আন্দাজ করে বলল…
—”আম্মু তোমার কি ক্ষুধা পেয়েছে?খাবে তুমি?”

সিহরাত ঠোঁট ফুলিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।আরশির খুব কষ্ট লাগল বাচ্চা মেয়েটার এমন অসহায় মুখ দেখে।বাচ্চাটার চোখের পানিগুলো দুহাত দিয়ে মুছে দিয়ে আরশি সিহরাতকে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো।তারপর বলল…
—”চলো আমি তোমাকে খাইয়ে দেই”

সিহরাত আরশির কথা কতটুকু বুঝতে পারল কে জানে!মেয়েটা খিলখিলিয়ে হেসে আরশির গালে মুখ খোলে স্লাইড করতে লাগল।আরশি মুচকি হাসল।তারপর সিহরাতকে উপরে রুমে এনে বেডে বসিয়ে রেখে দুধ গরম করতে গেলো।দুধ গরম হলে তা একটা বাটিতে ঢেলে আবারও রুমে ফিরে এলো।তারপর একটু একটু করে সিহরাতকে চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগল।সিহরাতও কোনো দুষ্টুমি ছাড়া লক্ষী মেয়ের মতো খেতে থাকল।হয়ত একটু বেশিই ক্ষুধা পেয়েছিলো।আরশি খাওয়াতে খাওয়াতে বলল…
—”তোমার পাপা কোথায় মা?”

সিহরাত ফ্যালফ্যাল চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে থাকল।হয়ত তেমন একটা বুঝেনি মেয়েটা।আরশি মুচকি হাসল।হুট করে সিহরাত দৌড়ে গিয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে ফটোফ্রেমটা নিয়ে আরশির কাছে এসে আগের মতো বসল।তারপর সিদ্রাতের পিকে চুমু দিতে দিতে বলল…
—”পা,,,আ,,পিত,,আপ,,ইত..”

আরশি হাসল সিহরাতের আধো বুলি শুনে।মুচকি হেসে বলল…
—”তোমার পাপা একটা ছাগল..এজন্যই তো তোমায় না খাইয়েই চলে গিয়েছে”

সিহরাত ঠোঁট ফুলিয়ে টলমল চোখে আরশির দিকে তাকালো।আরশি সরু চোখে তাকিয়ে বলল…
—”কথাতো কিছুই বুঝে না অথচ দেখো পাপার নামে যেই একটু পঁচা কথা বললাম ওমনি কেঁদে দিচ্ছে..হুহ পাপার প্রিন্সেস!”
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_58
#Writer_TanhaTonu

সিহরাত ঠোঁট ফুলিয়ে টলমল চোখে আরশির দিকে তাকালো।আরশি সরু চোখে তাকিয়ে বলল…
—”কথাতো কিছুই বুঝে না অথচ দেখো পাপার নামে যেই একটু পঁচা কথা বললাম ওমনি কেঁদে দিচ্ছে..হুহ পাপার প্রিন্সেস!”
____________________________________
আরশি সিহরাতের ঠোঁট ফুলানো দেখে মুচকি হেসে গাল টেনে দিলো।সিহরাত তবুও মুখ ফুলিয়ে রাখল।আরশি চোখ ছোট ছোট করে সিহরাতের দিকে তাকালো।তারপর দুষ্টু হেসে দুধের বাটিটা সাইড টেবিলে রেখে সিহরাতকে সুরসুরি দিতে লাগল।বাচ্চাটা সাথে সাথে খিলখিল করে হাসতে লাগল।আরশিও হেসে হেসে সুরসুরি দিয়ে চলেছে আর সিহরাতও হাসতে হাসতে প্রায় ক্লান্ত।আরশি সিহরাতের অবস্থা বুঝতে পেরে সুরিসুরি দেয়া থামিয়ে সিহরাতকে কোলে নিয়ে চুমু এঁকে দিলো গালে।সিহরাত খুশি হয়ে আরশির মুখেও অনেকগুলো চুমু এঁকে দিলো।আরশি তাকিয়ে থাকল বাচ্চা মেয়েটার মায়ামাখা মুখশ্রীর দিকে।মুখটা একদম ধবধবে সাদা..চুলগুলোও বেশ বড় বড় হয়েছে।দুই ঠোঁটের উপর নিচে ছোট্ট দুটো তিল আছে একদম আরশির মতোই..পুরো মুখটাই যেনো মায়ায় ভরা।কেউ বলবে না এটা নীরার মেয়ে।বরং গায়ের রঙ আর মুখের তিলের কারণে সবাই হান্ড্রেট পার্সেন্ট সিউর হয়েই বলবে এটা আরশির মেয়ে..

সিহরাত আরশির মুখে গলায় হাত ছুড়াছুড়ি করতে লাগল।আবার চুলগুলো টানতে লাগল।আরশি সিহরাতে হাত-পা ছুড়াছুড়ির কারণে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো আর মনে মনে নিজেকে বকা দিলো এজন্য যে কেন সিহরাতকে নিজের মেয়ের আসন দিচ্ছে!

সিহরাত আরশির গাল ধরে অস্পষ্ট আওয়াজ করতে লাগল।আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিহরাতের দিকে তাকালো।কোমল কন্ঠে বলল….

—”কি হয়েছে তোমার?”

সিহরাত ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও আগের ন্যায় শুরু করল।কয়েকবার আরশির গালে আলতো করে হাতও বুলালো।আবার আরশির গাল টেনে দিলো বড়দের মতো।আরশি মিষ্টি হেসে বলল…

—”আমায় অনেক ভালো লাগে বুঝি?আমি কি হই তোমার?”

সিহরাত কোনো জবাব দিলো না।কি জবাবই বা দিবে বাচ্চা মেয়ে..কথাই তো বুঝে না সব।বাচ্চাটা মুখে কোনো জবাব দিলো না।কিন্তু আহ্লাদিভাবে আরশির গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিলো।আরশি মুচকি হাসল।ইদানিং কেন যেনো বাচ্চাটাকে একটু বেশিই ভালো লাগে।অদ্ভুদ এক মায়া জড়ানো এই বাচ্চাটার মুখে…
আরশি সিহরাতকে কোলে রেখেই বেডের কার্নিশে হেলান দিয়ে শুলো।কেন যেনো বাচ্চাটাকে কাছ ছাড়া করতে মন চাচ্ছে না।আরশি বিড়বিড় করে বলল….

—”তুই কি কোনো মায়াবিনী নাকি সিহরাত?আমার তো তাই মনে হচ্ছে।একমাত্র মায়াবিনীরাই চোখ আর মুখের মায়াজালে মানুষকে কাবু করে ফেলে।তুইও সেই চেষ্টাই করছিস….”

আরশি নিজের বলা কথাগুলোয় নিজেই হাসল।বেশ ক্ষানিকটা সময় সিহরাতকে কোলে নিয়ে বেডে আধো শুয়া হয়ে থাকল।অনেকটা সময় পর বাচ্চাটাকে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিজে চলে গেলো গেস্ট রুমে।তারপর কাউকে ফোন করল।ফোন ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই আরশি বলল….
—”হ্যালো নুসু বেবি কেমন আছিস?”

নুসাইফা ওপাশ থেকে বলল…
—”আমি আর ভালো?জানিস নিহানের সাথে আমার আবারও ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে।ভালো লাগে না…এএএএ”

আরশি বিরক্ত হয়ে বলল…

—”শাটাপ…তোর ব্রেকাপের গুল্লি মারি আমি।দিনে কয়শবার যে তোদের ব্রেকাপ হয় আল্লাহ পাক জানে!এখন কাজের কথা শোন”

নুসাইফা মুখ ফুলিয়ে বলল…
—”হুম বল”
—”শপিংমলে যাবো কিছু কেনাকাটা করতে।তুই তাড়াতাড়ি রেডি হো”
—”এহ?সর আমি যাবো না।আগামীকাল ক্লাসে এনাটমির কত হার্ড পড়া আছে ভুলে গেলি?আমি এখন পড়ব”

আরশি দাঁতে দাঁত চেপে বলল…

—”তুই যাবি না তো?ওকে আমি নিহান ভাইয়াকে ফোন করে বলি তোকে অন্য একটা ছেলের সাথে ফুচকা খেতে দেখেছি”

আরশি কথাটা বলে ফোন কেটে দিতে নিলো।তৎক্ষনাৎ নুসাইফা বলে উঠল…

—”এই না না..আমি যাবো তো..আমি যাবো না তো কে যাাবে বেবি বল?আমি তো জাস্ট ফান করেছি”

আরশি নুসাইফার কথা শুনে মনে মনে হাসল।কিন্তু বাইরে দিয়ে গম্ভীরভাবে বলল…
—”ওকে রেডি হো তাহলে”

আরশি ফোন কেটে দিলো।নুসাইফাও ভেঙচি কেটে ফোন রেখে দিলো।তারপর রেডি হতে হতে আরশির গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল….

—————

—”ভাইয়া ওই ব্ল্যাক ড্রেসটা দেখান..হোয়াইট স্টোন বসানো যে..”

শপার আরশির বলা ড্রেসটা বের করে দিলো।আরশি সেটা প্যাক করে নিলো।নুসাইফা বলল….

—”কিরে এতগুলো ড্রেস কি শুধু সিহুর জন্য নিলি?তুই না ওকে দেখতে পারিস না!”

—”আহ নুসু বকবক করিস না তো।আমাকে কি তোর ভিখারি মনে হয় যে আমার বাসায় ছোট্ট একটা বাচ্চা এতোদিন ধরে থাকছে অথচ আমি ওকে কিছু কিনে দিবো না?”

নুসাইফা ঠোঁট চেপে হাসল আর বলল…

—”কি জানি তুই কেন আবার জামা কিনে দিচ্ছিস ওই বেয়াদ্দপ সিহরাতকে”

আরশি চোখ রাঙিয়ে নুসাইফার দিকে তাকালো আর বলল…

—”শাট আপ..একটা বাচ্চা মেয়ের সম্পর্কে এমন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করিস কিভাবে তুই?”

নুসাইফা ভেঙচি কেটে বলল…
—”প্রথম দিন তুইই আমায় বলেছিলি এটা”

আরশির মুখটা ছোট হয়ে গেলো।ও কাচুমাচু করে বলল…
সিদ্রাত
—”সে যাই হোক..আমার সামনে সিহুকে নিয়ে বাজে কথা বলবি না”

নুসাইফা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো আর আরশির আড়ালে মুচকি হাসল….

—————-

বাসায় এসে আরশি সিহরাতকে গেস্ট রুমে নিয়ে এলো।আজ প্রায় সারাদিনই সিদ্রাত বাসায় নেই।তাই আরশির জন্য আরও সহজ হলো সিহরাতকে নিজের কাছে রাখতে। তারপর একে একে সব জামা-কাপড় খুলে সিহরাতকে দেখাতে লাগল।সিহরাততো এতো নতুন নতুন জামা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা।একটার পর একটা জামা নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।দুটো জামার গলা একসাথে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।আরশি সিহরাতের কান্ড দেখে ফিক করে হেসে উঠল।সিহরাতও ফিক করে হেসে দিলো।তারপর ভদ্র মেয়ের মতো আরশির সামনে এসে দাঁড়ালো।আরশি মুচকি হেসে শরীর থেকে দুটো জামাই খুলে দিলো।তারপর যেটা পড়ে ছিলো সেটাও খুলে কিনে আনা হালকা পিংক কালার একটা টপস আর অফ হোয়াইট কালার থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়িয়ে দিলো।সিহরাত দৌড়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলে নিজেকে দেখে আবারও দৌড়ে আরশির কাছে আসল বেডের উপর।তারপর আরশির গালে চুমু দিয়ে দিলো।আরশি হেসে দিলো।তারপর বলল….

—”চলো তোমাকে সাজিয়ে দেই…”

আরশি সিহরাতের চুলগুলো সুন্দর করে সেট করে দিলো।তারপর চিকন করে আইলাইনার আর লিপ্সটিক দিয়ে দিলো।সিহরাত আরশির কাজলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল।আরশি মুচকি হেসে বলল….

—”আরেকটু বড় হও তুমি..তারপর এটাও লাগিয়ে দিবো হুম?”

সিহরাত কোনো জবাব দিলো না।হয়ত আরশির কথা কানেই নেইনি।আরশি সিহরাতকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে দাঁড় করালো আর বলল….

—”একদম পরীর মতো লাগছে আমাদের সিহুকে…”

সিহরাত আয়নায় নিজেকে দেখে হাসতে লাগল।তারপর আয়নার উপর দিয়ে নিজের প্রতিফলিত ছায়াকে ধরতে চাইলো। কিন্তু পারল না।মুখটা এগিয়ে নিয়ে আয়নার ভিতরের সিহুকে চুমু দিলো।এতে যেনো সেই আয়নার ভিতরের সিহুও সিহরাতকে চুমু দিলো..এটা দেখে সিহরাত অস্পষ্ট আওয়াজ করে হাসতে লাগল।আরশিও হেসে দিলো বাচ্চাটার কান্ড দেখে।তারপর কোলে নিয়ে নিলো সিহরাতকে।সিহরাত আরশির গলা জড়িয়ে ধরে বলল…

—”আম,,মু,,,ম্মমু,,”

আরশি মুচকি হেসে বলল…
—”হুম আম্মু বলো…”

সিহরাত আরশির মুখে গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল….
—”তুন্দল…আ,,ম্মু,,তুন,,দল…”

আরশি মৃদু হাসল।তারপর বলল…
—”আমার সিহু আম্মুটাও সুন্দর…”

সিহরাত আরশি কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিলো আর ছোট্ট একটা হামি দিলো।আরশি সিহরাতকে উপরে রুমে নিয়ে গিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো।তারপর বের হয়ে আসার সময় সিদ্রাতের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচের দিকে তাকালো।সিদ্রাত এক পলক আরশির দিকে তাকালো।তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলো।আরশি সিদ্রাতের দিকে তাকাতেই ওর চোখটা ছলছল করে উঠল।মানুষটার চুলগুলো কেমন যেনো উশকোখুশকো।চেহারাটাও ফ্যাকাশে….

সিদ্রাত আরশিকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে চলে গেলো।আরশিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো…..

—————

পরের দিন যথারীতি আরশি মেডিকেলে চলে গেলো।ক্যাম্পাসে গিয়ে পৌঁছতেই নুসাইফা হুড়মুড় করে আসল আরশির কাছে।আরশি ভ্রু কুচকে বলল….

—”হোয়াট’স ইউর প্রবলেম?”

নুসাইফা হাপাতে হাপাতে বলল….

—”আরে জানিস না কি হয়েছে!মেডিকেলে একজন নতুন টিচার এড হয়েছে”

—”সো?এতে এতো হৈহুল্লোর করার কি আছে?”

নুসাইফা দাঁত কেলিয়ে বলল…

—”অবশ্যই আছে।কারণ সে এসেই বলছে যে আরশি কি এখনো আসেনি?কখন আসবে?”

আরশির চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেলো।ও গোল গোল চোখে নুসাইফার দিকে তাকিয়ে বলল…

—”তুই সিউর আমাকে খুঁজেছে?না মানে..আমাকে আবার কেন কে খুঁজবে?”

—”আলবাত সিউর আমি।কারণ আমাদের ক্লাসে এসে জিজ্ঞাস করেছে।কিন্তু আমি পেছনের দিকে বসে ছিলাম আর তাছাড়া ইচ্ছা করেই কিছু বলিনি..কে না কে?কেন খুঁজল কে জানে?”

আরশি বেশ ক্ষানিকটা চিন্তিত হলো।নুসাইফা বলল….

—”আচ্ছা বাদ দে..এখন ক্লাসে চল”
—”হুম….”
—————–

তখন এনাটমি ক্লাস চলছিলো।অথচ আরশির তাতে কোনো মনোযোগই নেই।ও পড়ে আছে নুসাইফার সেই কথায়।কোন ডক্টর ওকে খুঁজছিলো কে জানে?আর খুঁজলে আবারও আসল না কেন খুঁজতে?

নুসাইফা আরশিকে গুতো দিলো।আরশি ভ্রু কুচকে নুসাইফার দিকে তাকালো।নুসাইফা দাঁতে দাঁত চেপে বলল…

—ক্লাসে মন দে..”

আরশি লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ক্লাসে মনোযোগ দিলো…

বাসায় যখন ফিরল তখন আরশি একদম ক্লান্ত।রুমে গিয়ে ব্যাগটা বেডে রেখে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল।এখন এক গ্লাস লবণ-লেবুর শরবত বা স্যালাইন হলে বড্ড ভালো হতো।আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো।স্যালাইন বা শরবত যেটাই হোক..নিজেরটা তো নিজকেও বানাতে হবে।আরশি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গেলো।লবণ দিয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।একটু ফ্রেশ লাগছে যেনো….

আরশির হঠাৎ সিহরাতের কথা মনে পড়ল।মেয়েটাকে ইদানিং যেনো একটু বেশিই ভালো লাগে।খুবই মিষ্টি আর মায়াবী চেহারার গড়ন।মায়ায় না পড়ে উপায় আছে!

আরশি গুটিগুটি পায়ে সিদ্রাতের রুমে গেলো।কিন্তু রুম পুরো ফাঁকা।আরশির কপাল কিছুটা কুঞ্চিত হলো।আরশি চিন্তিত হয়ে ভাবল…..

—”উনি না হয় এই সময়ে অফিসে থাকে।কিন্তু সিহরাত কোথায় গেলো?উফফ বাচ্চাটা ঠিকাছে তো?”

আরশির ভিতর অজানা একটা ভয় ঢুকে গেলো।ও পুরো রুম খুঁজতে লাগল সিহরাতকে।না পেয়ে বারান্দায় খুঁজল তাও পেলো না।রুমে ফিরে আসতেই ড্রেসিং টেবিলের উপরে একটা চিরকুট দেখতে পেলো আরশি।কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুটটা নিয়ে খুলে পড়তে লাগল….

“প্রিয়তমা,
তোমার মনে হয়ত এই কয়দিনে আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।বাট সত্যিটা আমি জানি..আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি
তুমি ভালোবাসার আগে থেকেই আমি তোমায় ভালোবাসি।যাই হোক…আমার ভালোবাসা নিয়ে যে কারণে তোমার মনে প্রশ্ন উঠেছে সে কারণটাকেই সরিয়ে আনলাম।সিহুকে আমি ওর আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।তোমার সংসার,তোমার স্বামী..সব তোমারই ছিলো আর আছেও।একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য তোমাকে কষ্ট পেতে হবেনা।সিহু আগেও একা থাকতে পেরেছে।ভবিষ্যতেও পারবে।তাছাড়া ওকে বুঝতেও হবে অনাথদের জন্য না এই সমাজ।
আমি সন্ধ্যার পর ফিরে আসব।তুমি চিন্তা করো না…

তোমার প্রিয়তম”

আরশি স্তব্দ হয়ে গেলো চিঠিটা পড়ে।চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা জল গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার।বারবার চোখের সামনে সিহরাতের সেই হাসি, দুষ্টমি, আহ্লাদিপনা, খিলখিল করে হেসে উঠা–এসবই ভেসে উঠছে।আরশি ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।দুহাতে মুখ চেপে বিনা শব্দে কাঁদতে লাগল…

চলবে…

গতকালই গল্প দিতাম।কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তিতে যে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি।সরি এভ্রিওয়ান।”এলোমেলো অনুভূতিরা” ইনশা আল্লাহ রাতে দিবো
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here