প্রিয়ংবদা পর্ব ১৪+১৫

#প্রিয়ংবদা
#চতুর্দশ ও পঞ্চদশ পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

রোববার বিকেল। শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ চালাচ্ছে বর্ষাবিদায়ের তুমুল তোড়জোড়! বৃষ্টিমাখা আকাশ ধীরে ধীরে বিদায় জানাচ্ছে বৃষ্টিস্রষ্টা মেঘেদের!দীগন্তের যেদিকেই চোখ পড়ে সেদিকেই কেবল নীল,নীল আর নীল!
এই সুবিশাল নীলচে জগতটার এককোণেতেই নীল ব্যাথার সমীকরণ গুনে যাচ্ছে কেউ কেউ। তাদের একেকজনের সমীকরণে একেকরকম ব্যাথা। কারো মনে প্রিয়কারো ভুল বোঝার যন্ত্রণা, তো কারো মনে প্রিয় কারো বলা মিথ্যে স্বরুপ প্রতারণা, কেউ নিজের সবটা দিয়ে কামনা করছে প্রিয়তমাকে ফিরিয়ে আনার, তো কেউ নিজের শর্তেই আবদ্ধ প্রিয়র কাছে ফিরে যাবার!
চারটে জীবনের এমন অদ্ভুত সমীকরণেই যেন কেটে গেল সেই তপ্ত, মেঘহীন, তিক্ত বিকেলটা।
কাদম্বিনী দেবী ফিরে গেলেন বৃদ্ধাশ্রমে!আশুতোষবাবু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েই ফিরলেন মেঘকুঞ্জে!হৃদিতা বিগত সময়ের মতো এড়িয়ে চললো আদৃতকে, আর আদৃত সেই দমবন্ধ করা অবহেলাটুকু কুড়িয়ে নিল খুব যত্নে,জমা করলো নিজের ঝুলিতে,হিমেব রাখলো ভালোবাসার বদলে পাওয়া নিষ্ঠুরতার!
.
আমাদের জীবনটা নেহাতই গৎবাঁধা। এই নির্দিষ্ট নিরিখে বাধা জীবনটা ঠিকই বয়ে চলে নিজ নিজ গতিতেই,থামেনা খনিকের জন্যও।আপন গন্তব্যে যেতে তার কোন বাঁধা নেই, নেই কোন জলদি। সে স্থির, সাবলীল, সময়ের স্রোতে গা ভাসানো এক অক্লান্ত শ্রমিক!
এই জীবনের অধিকারীরাও কিন্তু এমনই। সময়ের সাথে এরা সব পরিস্থিতিতেই মানিয়ে নেয় নিজেকে, বুকের মাঝে হাজার টনেক যন্ত্রণা, আকাশসম উঁচু কষ্টের বোঝা বয়েও এরা ঠিক সামলে যায় সময়ের তাগিদেই। মনমরা হয়েই করে যায় নিজের সব করণীয়!ভাঙা মনের আড়ালের ঠুনকো হাসিটাই তখন মনে হয় বাস্তব, সত্যি! তবে হঠাৎ কখনো যখন আবার সেই মরা মনের কারণটা হুটকরেই এসে হাজির হয় সামনে, তখনই বুকের মধ্যে জমে থাকা ছাই চাপা কষ্টটা বেরিয়ে পড়ে। বুকের ভেতরে বেড়ে ওঠা দগদগে ঘা টাকেই খুঁচিয়ে দেয় নিজ মহিমায়!

আদৃত আর হৃদিতার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটলো।
তখন, সবেমাত্র শ্রাবণ গিয়ে ভাদ্র পা রেখেছে ধরায়। নীলাভ আকাশের বুকে সুতো কাটা ঘুড়ির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে থোকা থোকা মেঘ। তুলতুলে সেই মেঘের আড়ালেই ক্ষণে ক্ষণে লুকিয়ে পড়ছে কুসুমবৎ রবি। মেঘের আড়ালেই ম্লান হচ্ছে তার দ্যুতি,প্রখর তেজ!আবার পলক পড়তেই বেরিয়ে পড়ছে আড়াল থেকে!তীব্র তাপোদাহে পুড়িয়ে ঝলসে দিচ্ছে নরলোক!
কলেজ থেকে ফেরার পথে আজও সেই বাদামমামার থেকে বাদাম নিচ্ছিল হৃদিতা। হঠাৎ পাশ কেটে শো করে একটা গাড়ি ছুটে গিয়ে থামে কলেজ গেটের সামনে!হৃদিতা চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“গাড়িতে চড়েন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন, নাকি পাবলিক রোডটা কিনেছেন?রাস্তায় দেখেশুনে গাড়ি চালাতে পারেন না?দামী দামী গাড়ি থাকার মানেই কি পাবলিক রোডে পাবলিকেরই ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবার অধিকার পেয়ে যাওয়া?”

হৃদিতার কথা শেষ হওয়ামাত্র গাড়ির দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে আদৃত! হৃদিতা থমকে যায়। থমকায় আদৃতও। তবে প্রকাশ করেনা কেউই, কে জানে কেন! হয়তো চাপা অভিমানে!
আদৃত হৃদিতার দিকে এগিয়ে আসতে নিতেই হৃদিতার চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মনে ঘুরঘুর করে শখানেক অজানা অসম্ভব ভয়!
তবে সেসবে পাত্তা না দিয়ে মিথ্যে সাহসের ভান করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই,উদ্দেশ্য, আদৃত ঠিক কি করে তা দেখা!
হৃদিতা যখন আদৃতের ঠিক সামনে তখন তাকে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই আদৃত তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তারই পেছনে!দেখতে পায়, তারই বয়সী এক মেয়ের সাথে কথা বলতে।
জীবনে প্রথমবারের মতো হৃদিতা অনুভব করে তার আদৃতনামক এই মানুষটাকে নিয়ে হিংসে হচ্ছে! তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যে আদৃত অন্য একটা মেয়ের সাথে অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে এটা তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না,বিন্দুমাত্র না।
তবে তার সহ্য হবার কথা, সহ্য করা উচিৎ, তবে মস্তিষ্ক এই উচিত কর্মটিই করতে চাইছে না।
হৃদিতা নিজের ওপরেই বিরক্ত হলো। একটু ভেবে মনে করলো, লোকটার সাথে দেখা হলো পুরো সতের দিন পরে!এই সতেরদিনে কমপক্ষে হাজার বার হলেও আদৃতের আনসেভড নাম্বারটায় ডায়াল করতে নিয়েও করেনি সে! পাছে আদৃত কিছু মনে করে, তার দেয়া অবহেলার আগুনে তাকেই পোড়ায়,এই ভয়ে! তবে লাভ কি হলো!সেই তো আদৃতের অবহেলার তীরে বিদ্ধ হলো হৃদিতার কোমল হিয়া, চোখের পলকেই সে ক্ষতে অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হলো,তবে সে ক্ষত সারাবার উপায় পাওয়া গেলনা।
হৃদিতা ম্লান হাসলো! মনে হলো, তার একদিনেই এত কষ্ট হয়!ছেলেটাকে তো প্রথম থেকেই অবহেলা করে যাচ্ছে সে! সে কি বোঝেনি ঐ বৃষ্টিভেজা মিষ্টি মুহূর্তে আদৃতের বলা প্রতিটা কথার অর্থ, প্রতিটা শব্দের পেছনে লুপ্ত অনুভুতি, আদৃতের প্রতিটা উচ্চারণের সময় তার চাহুনীর গভীরতা! নিশ্চই বুঝেছিল! তবে সে তাকে গ্রাহ্য করেনি!
এখন যখন তার সেই অগ্রাহ্যতা তারই কাছে ফিরে আসছে তখন তাকে কষ্ট পেলে হবে কেন?
হৃদিতা সয়ে নিল। দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেল আদৃত ও সেই অপরিচিত মেয়েটির অশ্রাব্য কথোপকথন! তবে শোনা না গেলেও ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা হাসি দেখেই হৃদিতার মনমরা ভাবটা হু হু করে বেড়ে গেল!
হৃদিতা আর দাঁড়ালো না, হনহনে পায়ে সেখান থেকে চলে গেল, আদৃতের পাশ কাটিয়ে। আদৃত দেখেও দেখলো না!
হৃদিতা হয়তো একটিবারের জন্য আদৃতের কন্ঠে “হৃদ” দু অক্ষরের এই হৃদয়হরা সম্বোধনটা শুনতে চাইছিল!তবে তার ইচ্ছে পূরণই হলোনা!আদৃত ডাকলো, একটিবার তাকালো না অবধি। হৃদিতার ভাঙা মনটা যেন কোন নিঠুর পাষাণ হাত আরো দুমরে দুচড়ে দিল। সেই ভঙে টুকরো হওয়া মনটাকেই বহু কষ্টে বয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলো হৃদিতা। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুললেন টাপুর দেবী। মেয়ের চোখমুখের অমন শুকনো দশা দেখে কপালে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“হৃদ!মা!কি হয়েছে, চোখমুখের এমন অবস্থা কেন?শরীর খারাপ মা?”
হৃদিতা ক্লান্ত হেসে মাথা নাড়লো। তারপর আর কিচ্ছু না বলেই ধীর পায়ে চলে গেল নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। দুহাতে মুখ ঢেকে কোন এক অজানা অচেনা নীলচে ব্যাথায় ফুঁপিয়ে উঠলো। চোখের ধারায় কোমল কপোল ভিজে নেয়ে একাকার হয়ে গেল। সেই জলটুকুই হয়তো হৃদিতার মনের গোপণ প্রণয় আভাসের সাক্ষী হয়ে রইলো যাকে কেউ দেখলো না, জানলো না। শুধু আড়ালে এক কিশোরীর মনের সুপ্ত প্রেমটুকু জেগে ওঠার প্রগাঢ় এক প্রত্যক্ষদর্শী রুপে নিজের ছাপ ফেলে উবে গেল বাষ্প হয়ে! মিলিয়ে গেল সিক্ত প্রণয়ের গভীর চিহ্নটুকু!
.
জোৎস্না রাত্রি! কাজল কালো আকাশের বুকে সমহিমায় বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সপ্তমীর একফালি বাঁধা চাঁদ।
সেই চাঁদকে ঘিরেই যেন ঐ গোটা আকাশের কোটি কোটি তারার সকল আকর্ষণ! আদৃত চোখ নামায় কালো আকাশের থেকে!এই কৃষ্ণগগন যে তাকে তার কৃষ্ণমানবীটির কথা আরো বেশি করে মনে করায়! কি লাভ মনে করে। সে যে তার জন্য একবিন্দু অনুভুতিও রাখেনা নিজের মনে, একতরফা অনুভুতি, তাকে কি প্রেম বলা চলে?জানেনা সে! তপ্তশ্বাস ফেলে বাগানের দিকে তাকায়। সেখানের সাদা বাতিটাকে ঘিরে ছোট ছোট পোকার উড্ডয়ন এই দোতলা ঘরের বারান্দা থেকেও দেখা যায়। পাশেই একখানা শিউলি গাছ। ফুলও ফুটেছে অনেক! দুর থেকেই ভাদ্র বাতাসে ভেসে আসছে তাদের ঘ্রাণ।
আদৃতের চোখে আবারও ভেসে ওঠে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরিধেয় সেই নিষ্ঠুরতম নারীর কথা! সে চোখ বুজে নেয়! তবে লাভ কি?চোখের সামনে নিরন্তর যাতায়াত চলে হৃদিতার হাসি, হৃদিতার দুষ্টোমি, তার লজ্জা,তার রাগ সব,সবটা। আদৃতের দস আটকে আসতে চায়। ভালোবাসার এত তীক্ষ্ণ অনুভুতি গ্রাস করে নেয় সকল অভিমান। সব ভুলে নিজ মনেই বলে ওঠে,
“আপনি আমাকে কেন একটিবার জিজ্ঞেস করলেন না হৃদ!কেন?কেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে জোড় গলায় চাইলেন না আপনাকে মিথ্যে বলার উত্তর!চাইলে আমি আর লুকোতাম না। সব বলেদিতাম। বিশ্বাস করুন। আমার একটা ভুলের জন্য এত অসহ্য যন্ত্রণা, বুক জ্বালানো অবহেলা আমাকে না দিলেও পারতেন হৃদ।
কেন ভালোবাসলেন না হৃদ?কেন?ভালোবাসা কি খুব কঠিন ছিল?নাকি আমার যোগ্যতা ছিল না! এত এত প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলেন?এত ঘৃণা করতে পারলেন হৃদ?
আপনি আমার কল্পনার চাইতেও বেশি নির্দয় হৃদ।
তবে সবচেয়ে নির্দয় সত্যি কি জানেন, আমি এই নির্দয় আপনিটাকেই ভালোবাসি, ভীষণ বেশি ভালোবাসি!খুব!”

আদৃতের কন্ঠ কেঁপে উঠল। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে টলমলে চোখে পিছু ফিরতেই মিথ্যে হাসির মুখোশ পড়ে বলে উঠল,
“ছুটকি! তুই?কখন এলি?ডাকবিনা?বুঝতেই পারিনি!কিছু বলবি?”

অন্বেষা কাতর নয়নে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন অযথা হাসির অভিনয় করছিস দাভাই?তোকে চিনি আমি! বুঝি কোনটা তোর সত্যি হাসি আর কোনটা মিথ্যে। ”

আদৃত কথা বলেনা। চোখ নামিয়ে চুপ করে থাকে! অন্বেষা আবার প্রশ্ন করে,
“এতই যদি ভালোবাসিস তবে আজ দেখা হবার পরও কথা কেন বললি না?বল?এত ইগো তোর?”

আদৃত কাতর দৃষ্টি মেলে তাকায়। মলিন স্বরে উত্তর দেয়,
“এটা আমার ইগো নয়, ছুটকি!আমি ওকে ভালোবাসি! ও চাইলে হাজার বার ওর সামনে মাথা নোয়াতে পারি, হাজার বার ফেরার অনুরোধ করতে পারি। তবে সেটা শুধু তখনই যখন ও চায়!কিন্তু ও তো চায়ই না আমাকে।যে আমাকে চায়না তার জীবনে জোড় করে প্রবেশের ইচ্ছে আমার নেই।
আর কথা!ওর সাথে কথা বললে, ওর চোখের দিকে তাকালে আবার দুর্বল হয়ে পড়বো। না জানি তখন কি করে বসবো! তাই! এতে কোথাও ইগো নেই অনু!কোথাও না!”

অন্বেষা তপ্তশ্বাস ফেলে। তিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“তোকে কে বললো, ও তোকে চায়না?ও বলেছে?”
আদৃত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে প্রত্ত্যুত্তর করে,
“না,ও বলেনি!তবে বুঝে গেছি! প্রথম দিন থেকেই ওর অবহেলা, পালিয়ে বেড়ানো, এসবই বুঝিয়ে দিয়েছে!”

অন্বেষা দুহাত কোমরে রেখে রাগী নয়নে তাকালো। তদাপেক্ষা রাগী স্বরে বলে উঠল,
“তোর মাথা আর আমার মুন্ডু বুঝেছিস!স্টুপিড!
মেয়েরা কার থেকে পালায় জানিস, কার সাথে লুকোচুরি করে বেড়ায় নিজের অনুভূতি নিয়ে?যাদের তারা বিশেষ অনুভব করে!আর সে বিশেষ অনুভূতি যাতে বিশেষ ব্যক্তির সামনে হুটহাট ধরা না পড়ে যায় সেই ভয়েই তাদের এমন পালাই পালাই!
আমি আজ ওর চোখে স্পষ্ট তোকে নিয়ে জেলাসি দেখেছি!টানা এক ঘন্টা বাজের চোখে দেখে গেছে আমাকে!আমার খুবই লজ্জা করছিল। ও তো আর জানেনা আমরা ভাইবোন, ঠিক উল্টো পাল্টা কিছু ভেবেছে।
আর তুই যখন ওর সাথে কথা না বলেই যচলে এলি পাশ দিয়ে, তখন ওর টলমলে চোখে উপচে পড়া কষ্ট দেখেছি আমি দাভাই!যেকষ্টে তুই পুড়ছিস,ঠিক সেই কষ্ট!
দেখ আমি তো একটা মেয়ে, তাই ফিমেইল ফিলিংস তোর চেয়ে একটু হলেও বেশি বুঝবো। আর আ’ম শিওর, আমি যা বুঝেছি তা একদম ঠিক!”

আদৃত অবাক দৃষ্টিতে অন্বেষাকে একপলক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“সত্যি বলছিস?শি ফিলস সামথিং ফর মি?”

অন্বেষা একগাল হেসে বলে,
“ইয়াহ্ ব্রো! ”

আদৃত হাসে!অনেকদিন পরে মন খুলে হাসে!অন্বেষা সে হাসিতে খুশি হয়। তারপরে আবারও ভীষণই গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“কিন্তু একটাই সমস্যা!”

আদৃতের হাসিতে উজ্জ্বল মুখখানি ফ্যাকাশে হয়ে যায় হঠাৎই!মলিন বদনে জিজ্ঞেস করে,
“কি সমস্যা? ”

অন্বেষা বহুকষ্টে হাসি চেপে রেখে বলে,
“এই যে আমি তোকে এত গ্রেট একটা ইনফরমেশন দিলাম,এর জন্য তোর কি উচিত না আমাকে কিছু দেয়া। এই ধর, আমি যদি এটা এখন না বলতাম, তো, দুজনেই সারাজীবন দেবদাস-দেবদাসী হয়ে থাকতি!সো ইউশ্যুড গিভ মি আ রিওয়ার্ড! ”

আদৃত হেসে ফেলে অন্বেষার মাথায় একটা গাট্টা মেরে শুধালো,
“ফাজিল!কি চাই বল!”

অন্বেষা আবারো বিস্তর একখানি হাসি আঁকে ঠোঁটের কোণে! পিটপিটে চোখে জবাব দেয়,
“একটা গান শোনা দাভাই!ফটাফট!আর গানটা অবশ্যই তোমার হৃদ মাঝারে যত্নে রাখা “হৃদকে ডেডিকেট করে!
গা গা,চটপট গেয়ে ফেল!”

আদৃত আবারো প্রসন্ন হাসে! ব্যালকনির এককোণে হেলান দিয়ে রাখা গিটারটা তুলে নেয় হাতে। দুহাতের আঙুলে তাতে সুর তুলেই গেয়ে ওঠে,

“দিন পাল্টায় রং বদলায়
অস্থির মন,
হাতের মুঠোয় ফেরারি সময়
শুধু শিহরণ,
ছায়া পথ ধরে হাতছানি কার
সেই পিছুটান,
তার কথা মনে পড়ে
তার কথা মনে পড়ে!

দিন পাল্টায় রং বদলায়
অস্থির মন,
হাতের মুঠোয় ফেরারি সময়
শুধু শিহরণ,
ছায়া পথ ধরে হাতছানি কার
সেই পিছুটান,
কার কথা মনে পড়ে
কার কথা মনে পড়ে।

রাত জাগা পাখি যায় ডেকে যায়
দীর্ঘ শ্বাস,
জোনাকিরা জ্বলে গাছের পাতায়
আলোর আভাস ।
পাশে পড়ে থাকা কবিতার খাতা
নীলচে আকাশ
কলমের রং গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে
স্তব্ধ বাতাস,
I Love You,I Love You!

ঝড় বয়ে গেছে পড়ে আছে শুধু
ছেঁড়া মাস্তুল,
ফিকে হয়ে যাওয়া কুয়াশার পিছে
উঁকি দেয় ভুল,
ঝড় বয়ে গেছে পড়ে আছে শুধু
ছেঁড়া মাস্তুল,
ফিকে হয়ে যাওয়া কুয়াশার পিছে
উঁকি দেয় ভুল,
I Love You,Iove You!”

অন্বেষা এতক্ষণ পুরোটা শুনে যাচ্ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো!প্রতিটা লাইন, প্রতিটা শব্দই যেন চিৎকার করে জানান দিচ্ছিলো হৃদিতার প্রতি তার দাভাইয়ের প্রবল ভালোবাসার অস্তিত্ব!
আদৃত থামতেই অন্বেষা মুগ্ধতা ভরা আঁখিদুটি তাক করলো তার দিকে, নিদারুণ নিমগ্ন স্বরে শুধালো,
“খুব ভালোবাসিস তাই না?এত ভালো কিকরে বাসলি রে?এতটা ভালোবাসার সৃষ্টি হলো কি করে?”

আদৃত মুটকি হাসলো। গিটারটা নামিয়ে রাখলো পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে! তারপর অসীম মুগ্ধতায় মোড়ানো নরম স্বরে প্রত্ত্যুত্তর করলো,
“সাধারণ চোখে দেখলে ওকে ভালো লাগার মতো হয়তো বা কিছু নেই,কিছু ছিলনা।
তবে ওকে খুব সাধারণভাবে দেখার সুযোগটাই আমি পাইনি।
আমাদের দেখাই হয়েছিল এক অসাধারণ পরিস্থিতিতে। সেইদিন, ওনার ভীতু চোখজোড়ার লেপ্টানো কাজল, ওনার মিষ্টি মিষ্টি দুষ্টুমি, ওনার সব অবাধ্যতা, সবটা তাদের সবটুকু দিয়ে মুগ্ধ করেছিল আমাাে, আকর্ষিত করেছিল নিজের প্রতি!
আমারমনে সবচেয়ে বেশি দাগকাটে, মাত্র কিদিনের পরিচয়েই ঠাম্মির সাথে গড়ে ওঠা ওর বন্ডিংটা।
একটা মানুষের হৃদয় কতটা সরল হলে সে এমন অবাধে আপন করে নিতে পারে যে কাউকে?
সত্যি বলতে প্রথম ভালো লাগা সেটাই!
তবে বিষয়টাকে আমি নিছকই একটা মুগ্ধতা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম কেটে যাবে, তবে তা আর হলো কই!
অঘটন ঘটলো তার পরেরদিন, যখন ওনার বাড়িতেই ওনাকে আরো বিমুগ্ধ রুপে দেখলাম। সেই ভেজা চুলের ডগা থেকে গড়ানো বিন্দু বিন্দু জল, ভেজা কোড়রে লেপ্টানো জামা, কালো টিপ পড়া কৃষ্ণ ললাট সবটাই যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে গেল আমায়! আমি প্রথমবারের মতো নির্লজ্জ চোখে কোন নারীর দেহের প্রতিটা বাঁকে বাঁকে চোখ বুলিয়ে গেলাম,আর ফলস্বরুপ মুগ্ধতার পরিমাণ বাড়লো, বৈ কমলো না!
লবণ চা খেয়েও সেই মুগ্ধতা বহরে বৃদ্ধি পেল!ভাবতে পারিস?
তারপরে আর কিছুতেই কমার নাম নিলনা, ওনার হাসি হাসি মুখ, চায়ে নুন মেশাবার পরে যে অপরাধী চোখে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, সে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি, আমার মুখে “হৃদ” শুনে লজ্জায় ওনার মুখ লুকোনো, সবটা বারবার ঘুরেফিরে এসে কেড়ে নিল রাতের ঘুম!আর সেই নির্ঘুম শান্তিহীন রাতের পরেই উনি বরাবরের মতো গেঁথে বসেলেন মনে। আমি সরাতে চেয়েও পারলাম না।
যেদিকে তাকাতে লাগলাম, শুধু আর শুধু ওনার মুখটাই ভেসে উঠলো ক্রমাগত!
অতঃপর আমি বুঝে গেলাম, আমি প্রেমে পড়ে গেছি,গভীর প্রেমে, প্রেমে পড়েছি বলেই তার সব কিছুতেই মুগ্ধতা এসে ছুঁয়ে যেত আমায়!ভালোবেসেছি বলেই নিজের সবটাতে তার অস্তিত্ব অনুভব করতাম অবিরত!”

অন্বেষা সবকথাই বিভোর হয়ে শুনলো। তারপরে আলতো হেসে বলে উঠল,
“পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনাই তবে রিপিট হলো,বল?দাদুর মতো তুইও নিজের কৃষ্ণকায়াকে আলটিমেটলি পেয়েই গেলি!”

আদৃত হালকা হেসে উত্তর দিল,
“উঁহু,দাদুর আর আমার কাহিনিটা একটু ভিন্ন। দাদু প্রেমে পড়েছিল বিয়ের পরেরদিন!মানে বিয়ের পর।তাই দাদুর প্রেমের রাস্তায় কোন বাঁধা ছিলনা।নিজেরই বউ ছিল ঠাম্মি!
কিন্তু আমি প্রেমে পড়েছি বিয়ের আগে। এবারে যার প্রেমে পড়লাম সে যে কি চায়, কেন চায় তা কিছুই বুঝিনা আমি। এমতাবস্থায় অন্যের মেয়েকে নিজের বউ করতে আমাকে প্রচুর খাটতে হবে বুঝলি!
ম,ট কথা দাদুর প্রেমটা রেডিমেট ছিল। আর আমারটাকে দরজি দিয়ে বানাতে হবে!”

অন্বেষা ফিক করে হেসে দিল!হাসলো আদৃতও!দারপরে কিছু মনে পড়েছে,এমন ভাবে বললো,
“আর আমার সে কৃষ্ণকায়া হবে না। তার থাকবে আমার দেয়া নিজস্ব সম্বোধন, একদম নতুন, একদম অনন্য!
কৃষ্ণকায়া যেমন কেবল আর কেবলই দাদুর। তেমনই আমার সেও শুধু আর শুধুই আমার হবে!”

অন্বেষা মাথা নাড়লো!তারপর ছোট একটা হাই তুলে বললো,
“অনেক রাত হলো দাভাই। যা ঘুমা!কাল তো সকালে কাজ আছে তোর!”

আদৃত ভারু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাজ?কি কাজ?”
অন্বেষা আলসে ভঙ্গিতে জবাব দিল,
“হৃদের সাথে দেখা করতে যাবি!ওকে সব বুঝিয়ে বলবি!”

আদৃত হতাশ স্বরে বলে ওঠে,
“ও যা মেয়ে? শুনবে?আমি কিছু বলতে গেলে, না আমাকেই এটা সেটা বলে মেইন টপিক থেকে সরিয়ে দিয়ে যায়! খালি যত রাজ্যের উদ্ভট সব প্রশ্ন!”

অন্বেষা ঘাড় বাঁকিয়ে জবাব দেয়,
“উদ্ভট বলেই সে সরল দাভাই!মনে প্যাচ কষা মানুষেরা কখনো সরল,বোকা বোকা প্রশ্ন করতে পারেনা। তাদের সাজানো প্রশ্নের পসরা হয় জটিল থেকে জটিলতর।
তাই আমার মতে উদ্ভট-অদ্ভুত কাজকর্ম গুলো নিখাঁদ সারল্যের লক্ষণ! ”

আদৃত মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। তারপরে বলে ওঠে,
“ওকে! ডান। চেষ্টা করব সবটা বোঝানোর। তবে কতটা কি বুঝবে, গড নোওস!”

অন্বেষা আস্বস্ত স্বরে বলে,
“ডোন্ট ওয়ারি,ঠিক বুঝবে!এবার চল আমি এলাম। গুড নাইট!”

আদৃত আবারো পিছু ডাকলো, অন্বেষা থামতেই বিমর্ষ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ছুটকি?এবারেও কি আবার ফিরে যাবি হোস্টেলে?এবার থেকে যা না। আর যাস না প্লিজ!”

অন্বেষা ফিকে হেসে জবাব দিল,
“এভাবে বলে আমাকে দুর্বল কেন করিস বলতো?তুই নিজেও জানিস, যে বাড়িতে আমার ঠাম্মি থাকে না, সে বাড়িতে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।
তিন-চার মাস পরে আসি, দু-তিনদিন থাকি,তাও শুধু তোর আর দাদুর জন্য!এর বেশি কিছু সম্ভব নারে।
যদি কখনো ঠাম্মির শর্ত মেনে ওনাকে এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়!তবে সেদিনই ফিরবো বাড়িতে, একেবারেই!তার আগে না।
ঘুমিয়ে পড়।শুভ রাত্রী দাভাই!”

আদৃত কথা বাড়ায় না। কিছু খুঁজেও পায়না বলার মতো! শুধু রাগ হয় সেই পরিস্থিতির ওপরে, যার জন্য আজ গোটা পরিবারটা এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পরস্পরের থেকে!

#চলবে

[ষোড়শ পর্ব আলাদা করে পোস্ট করতে হয়েছে!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here