প্রেমের খেয়া পর্ব ৩

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৩

সকালের সূর্য টা নিজের তপ্ত তাপে উত্তপ্ত করছে পুরো ধরণী।কাঠফাটা রোদে ঘাম ঝরার ও উপায় নেই।ঘাম গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই উধাও হয়ে যাচ্ছে।মাটিতে পা রাখা অসম্ভব। যেন জলন্ত কয়লা।

ক্লান্তি মাখা দুপুরে কলেজের সমস্ত কাজ শেষ করে আমীর মির্জা আর মায়া ফিরে এলো।মায়ার কলেজের এডমিশন কমপ্লিট।শেহনাজ ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। আমীর আর মায়া কে প্রবেশ করতে দেখে গ্রিল খুলে দিলেন। আমীর মায়ার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। প্রচন্ড গরমে মায়ার হাল বেহাল হয়েছে। শেহনাজ জলদি পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়,
“-এই নে ঠান্ডা পানি।ভালো লাগবে।
“-দেখেছো ছোট আব্বু আমরা শুধু শুধুই গরম কে দোষারোপ করছিলাম।এই গরমের কারণে আজ ছোট মা আমাদের ঠান্ডা পানি নিজেই এনে দিলো ভাবা যায়।বলেই হাসলো মায়া।
“-একদম।কোনো ফায়দা হোক না হোক ঠান্ডা পানির ফায়দা কিন্তু হয়েছে। বলেই হাই ফাইভ দিলো আমীর আর মায়া।
শেহনাজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
“-বাপ মেয়ের রসিকতা শেষ হলে ফ্রেশ হতে যান। আমি খাবার দিচ্ছি। বলেই শেহনাজ রান্নাঘরে চলে গেলো।আমীর আর মায়া ঠোঁট চেপে হাসলো।

খাবার টেবিলে বসে আছে সামরান।সেলিনা মালিক পাশেই আছে। সামরানের সাথে তেমন কথা বলছে না।সামরান কথা বলতে চাইলেই এড়িয়ে যাচ্ছে।এতে সামরানের রাগ আর কষ্ট দুটোই বাড়ছে।
সামাদ মালিক চেয়ার টেনে সামরান এর সামনা সামনি বসলেন।তারপর সেলিনা মালিক কে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন।সেলিনা মালিক মাথা নেড়ে হলা খাকারি দিলো।
সামরান সেলিনা মালিকের দিকে তাকালো,
“-কি হলো মা? পানি দেবো?খাবে?ঠিক আছো?এক নিঃশ্বাসে বলে সামরান।
“-আমি ঠিক আছি।কিছু হয়নি।হালকা হেসে বলে সেলিনা মালিক
“-ওহহ!!বলেই মাথা নোয়ালো সামরান।
“-সামরানননন!!!সেলিনা মালিকের শান্ত কন্ঠ শুনে সামরান তাকালো,
“-কিছু বলবে মা?কিছু লাগবে?দেবো?
“-কিছু লাগবে না!!একটি কার্ড সামরানের সামনে এগিয়ে দিলো।এটা সিটি কলেজ এর কার্ড তোমাকে যেতে হবে।কাল ওদের নবীন বরণ উৎসব।স্পেশাল গেস্ট হিসেবে তোমাকে চুজ করেছে তো কাল ওখানে যাবে।
“-সামরান কার্ড সাথে সাথে হাতে তুলে নিলো।যাবো।আমি কালই যাবো।
সামরান কারো ইনভাইটেশন এ যায় না।তাই সামাদ মালিক সেলিনা মালিক কে দিয়ে বলিয়েছেন।কারণ সেলিনা মালিকের কথা সামরান ফেলবে না। আর এবারও তাই হলো।সামরান রাজি হয়ে গেলো।সামাদ মালিক সস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

কথা শেষ করেই সেলিনা মালিক উঠে চলে আসে। সামরান পিছু পিছু সেলিনা মালিকের রুমে আসে।
সেলিনা মালিক দরজা বন্ধ করার আগেই ভেতরে প্রবেশ করে সামরান।সেলিনা মালিক কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে বসেন।সামরান হাটু ভাজ করে সেলিনা মালিকের সামনে বসে পরে,
“-ও মা!কেন রাগ করে আছো?আমার ভালো লাগছে না।
“-সেলিনা মালিক চুপ…..
“-তুমি যা বলবে আমি করবো মা।তারপরও এমন করে মুখ ফিরিয়ে নিও না মা।আমি পারবোনা।মরে যাবো মা।
“-সেলিনা মালিক সামরানের দিকে তাকালেন..যেদিন দেখবো আমার সন্তান কোনো ভুল পথে হাটছে না, সেদিন মন খুলে কথা বলবো তার আগে না।এবার যাও আমার কাজ আছে।বলেই অন্যদিকে ফিরলেন সেলিনা মালিক।

সামরান চুপচাপ ফিরে আসলো।হিয়ার উপর রাগ হচ্ছে সামরানের।এই মেয়ের জন্যই আজ ওর মা ওর সাথে কথা বলছেনা। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে এই মেয়ে।হিয়ার কথা ভাবতেই সামরানের রাগ আরো দ্বিগুণ হলো।

“-তা কেমন লাগলো।আর নবীন বরণ কখন।প্লেটে খাবার দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে শেহনাজ।
“-কাল।প্লেট টেনে নিজের সামনে নিয়ে বলে মায়া
“-ওহহ!! ভালো মত পড়াশোনা করবি।একদম দুষ্টুমি করবি না।
“-আচ্ছা।বলেই হালকা হাসলো মায়া।
কিছুক্ষন পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো পরিবেশ।নীরবতা ভেঙে মায়া বলে উঠে,
“-ছোট মা!!কাল আপুর জন্মদিন।
“-শেহনাজ আর আমীর থমকে গেলো।দুজনই মায়ার দিকে তাকালো। মায়া দুজনের সামনে বসায় দুজনকে দেখে মায়া একটু চুপসে গেলো।অপরাধীর মত অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মায়া।
আমীর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
“-আমাদের একটাই মেয়ে সেটা মায়া মির্জা।আর কেউ না।
“-কিন্তু…..
“-চুপচাপ খাওয়া শেষ করো মায়া।শেহনাজের কড়া ভাষা শুনে মায়া চুপচাপ খেয়ে চলে আসে।

নিজের রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মায়া
“-কেন করলে আপু এমন।সামান্য টাকার জন্য কেন মা বাবাকে ছেড়ে দিলে?আচ্ছা টাকাই কি সব?টাকা তো মা বাবার ভালোবাসা দিতে পারেনা।তাহলে কেন এমন করলে?তুমি কোথায় আপু? ওদের কথা কি একবারও মনে পড়ে না তোমার।তুমি চাইলে তো ওদের কাছে এসে মাফ চাইতেই পারো।ওরা তো তোমায় ফেলে দেবে না আপু?কেন এমন করলে? ফিরে এসো আপু।প্লিজ ফিরে এসো?আমি সব ঠিক করে দেবো।ছোট আব্বু, ছোট মা কে আমি রাজি করাবো তুমি শুধু ফিরে আসো।

In London ***

কুয়াশাচ্ছন্ন রাত।দোতালার একটি এপার্টমেন্ট। পুরো এপার্টমেন্ট জুড়ে ৫টি রুম।দোতালার একটি রুম থেকে চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। একটি মেয়ে ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে কাদঁছে।সামনেই একটি ছেলে বসে আছে।হাতে কেক।পুরো রুম সাজানো।অথচ মেয়েটি এলোমেলো হয়ে আছে।ছেলেটি হাতের কেক টেবিলে রেখ্ব মাটিতে বসে পড়লো।
“-সিমি বেইবি কেন কাদঁছো?তুমি কেন কাদঁছো। আমাকে কেন ভয় পাচ্ছো তুমি।আচ্ছা আমি আর এমন করবো না।আর তোমাকে হার্ট করবো না।কক্ষনো না বেইবি।তুমি চলে যাওয়ার কথা বললে আমার মাথা ঠিক থাকেনা তাইতো আমি রাগ করি।চলো আর কাদঁবে না।অনেক হয়েছে। দেখো আমি তোমার জন্য কত সুন্দর এরেঞ্জমেন্টস করেছি।সব তোমার জন্য।এসো এসো কেক কাটবে।তোমার তো জন্ম দিন। জন্মদিনের দিন কেউ কাদেঁ?

সিমি কান্নামিশ্রিত মিনমিনে কন্ঠে বলে উঠে,
“-আমার ভালো লাগছে না।আমি কেক কাটবো না।আপনি প্লিজ যান এখান থেকে আমি একা থাকতে চাই।
“-বেইবি এমন বলেনা আমার কিন্তু মাথা আবার গরম হয়ে যাবে কেমন?তুমি তো আমার রাগ সম্পর্কে জানো।শেহেরজাদ মালিক এসব একদম পছন্দ করে না।তুমি কেন একা থাকবে আমি আছিতো।চলো চলো ফ্রেশ হবে।কাম অন।বলেই সিমি কে দাড় করালো শেহেরজাদ।সিমি পায়ের ব্যাথায় নড়তে পারছে না।একটু আগে শেহেরজাদ রড গরম করে পায়ের তালুতে ছ্যাকা দিয়েছে। শেহেরজাদ এর অনুমতি ছাড়া সিমি ফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলেছিলো।যার ফলে শেহেরজাদ রেগে যায়।আর শেহেরজাদের রাগ মানেই ভয়ংকর শাস্তি।

সামনে পা বাড়াতে গিয়ে সিমি পড়ে যেতে নিলেই শেহেরজাদ ধরে নিলো।সিমি ব্যাথায় ঢুকরে কেঁদে ওঠে।
“-ওহ হোও!!সরি বেইবি আমি তো জানতামই না।এসো এসো আমি হেল্প করছি।বলেই সিমি কে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো শেহেরজাদ।সিমিকে হাত মুখ ধুইয়ে দিয়ে রুমে ফিরে আসে।বিছানায় বসিয়ে ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে সিমির পায়ের কাছে বসে পড়ে শেহেরজাদ।
সিমির পায়ে অনেক যত্ন সহকারে ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়।
তারপর কেক সামনে রাখে।হাসি মুখে সিমির হাত ধরে কেক কাটে।কেক কাটা শেষ হলে একটু সিমি কে খাইয়ে দেয়।আর তারপর সিমির গালে কেক লেপ্টে যায়।লেপ্টে যাওয়া অংশ শেহেরজাদ হাত দিয়ে মুছে নেয় তারপর নিজেই খেয়ে নেয়।কেক রেখে সিমি কে ওষুদ খাইয়ে শুইয়ে দেয়।নিজেও শুয়ে পড়ে সিমির পাশে।সিমিকে বুকের সাথে চেপে ধরে।সিমি নড়তে চাইলে গম্ভীর কন্ঠে সাবধান বাণী দিল,
“-ডোন্ট মুভ বেইবি।আমার অনেক ঘুম আসছে।ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে জানোই তো কি হবে?সো প্লিজ!!
শেহেরজাদ এর কথা শুনে সিমি চুপচাপ শুয়ে থাকে।আর নীরবে কাদঁতে থাকে।কাদঁতে কাদঁতে এক সময় সিমি গভীর ঘুমের তলিয়ে গেলো।

আজকের দিনেও গরম পড়ছে।আগের দিন থেকে আজকের দিনের গরম যেন আরো বেশি। সামরান স্টেজ এ বসে আছে।একটু আগে এসেছে।গেইট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতেই সবাই অভ্যর্থনা জানালো।স্টেজে ওঠার আগে কলেকের প্রিন্সিপাল বিশাল ফুলের বুকি দিলো।সামরান হালকা হেসে ফুলের বুকি নিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়লো।

গরমে অস্থিরতা বাড়ছে সামরানের।কিছুতেই অস্বস্থি কমছেনা সামরানের।একটা কালো শার্ট পড়েছিলো।তার উপর ব্ল্যাক ব্লেজার।ব্লেজার এর বোতাম অনেক আগেই খুলে দিয়েছে সামরান।শার্টের দুটো বোতাম খুলে শার্ট পেছনের দিকে টেনে দিলো।অসহ্য গরমেও তাকে মাইকের সামনে দাড়িয়ে স্টুডেন্টদের ওয়েলকাম করতে হলো।সাথে মোটিভেশনাল স্পিচ তো আছেই।বক্তৃতা শেষে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে নিজের আসনে এসে বসে সামরান।

উৎসব প্রায় শেষ। স্টেজ ছেড়ে সামরান গাড়ির দিকে পা বাড়ালো।হঠাৎ একটি মিষ্টি কন্ঠ স্বর শুনে থমকে দাড়ালো সামরান।সাথে কথা গুলো শুনে আরো অবাক হলো।
মায়া নিজের ফ্রেন্ডদের সাথে আলোচনা করছিলো।এক পর্যায়ে পছন্দের দিকে প্রসঙ্গ গেলে মায়া মিষ্টি হেসে বলে,
“-শ্যামবর্ণ!!
“-কিহহহ?অবাক হয়ে বলে সবাই।
“-সবার এমন অবস্থা দেখে হাসলো মায়া।হ্যা শ্যামবর্ণ।শ্যামবর্ণের মানুষেরা অনেক ভালো হয়।আর অনেক মায়াবী।শ্যামবর্ণের পুরুষদের চোখ কথা বলে।তাদের হাসিতে মিশে থাকে এক রাশ মুগ্ধতা। যা যেকোন মেয়্বকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। সবাই টা জানিনা।বাট আমি অন্যরকম।আমার শ্যামবর্ণের পুরুষ অনেক ভালো লাগে।
আমার কাছে শ্যামবর্ণ ধারণকারী পুরুষই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর মানুষ। তাদের সব কিছু আমার ভালো লাগে।এই যে এখানেই দেখ।আমাদের সামরান স্যার কে।উনি ও তো শ্যামবর্ণ। কিন্তু কত ভালো।কি সুন্দর সবাইকে মোটিভেশন দিলো।এক কথায় শ্যামবর্ণ মানেই আকাশ সমান ভালোবাসা যায় এমন এক মায়াবী পুরুষ।বলেই থামলো মায়া।
“-তা ম্যাডাম আছে নাকি কেউ?শ্যামবর্ণের?রসিকতার সুরে বলে একজন।
“-না না নেই।এসব এখন ভাবছিনা।আপাতত পড়াতেই মনস্থির করেছি।বাকিটা পরে ভাববো।বলেই হাসলো মায়া।

কথা গুলো শুনে সামরানের নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো।আনমনে একবার তাকালো কিন্তু মায়াকে দেখতে পেলো না।পরে লম্বা পা ফেলে গাড়িতে গিয়ে বসলো সামরান।মুখে এখনো হাসির ছাপ স্পষ্ট বিদ্যমান।
গাড়ির লুকিং গ্লাসে ড্রাইভার সামরান কে হাসতে দেখে নিজেও হাসলো।এই প্রথম সামরান কে একা একা এত মিষ্টি ভাবে হাসতে দেখেছে। হাসলে সামরানের মুখে আলাদা মায়াবী ঝলক দেখা যায়।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here