প্রেম পায়রা ২ পর্ব ৯

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___০৯

১২.
ভোরবেলা এলার্মের শব্দে সম্পদের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মুখ কুঁচকে উঠে পড়লো সে। অফিস শুরু হয়েছে তিনদিন হলো। সেজন্য তাড়াতাড়ি উঠতে হচ্ছে। টাওয়াল হাতে নিয়ে সে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ব্রাশে টুথপেষ্ট নিয়ে সে আয়নার দিকে তাকালো। ঘুম ঘুম চোখে আয়নায় দৃশ্যমান প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। চোখের মণি কিঞ্চিৎ লাল। চেহারায় কেমন কালশিটে একটা ভাব! সে চোখ সরিয়ে নিল। কাল অনেক রাত অবধি তার ঘুম হয়নি। মাথার মধ্যে তিথির ব্যাপারটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিথি তাকে ভয় পায়, তাকে আর দশটা পুরুষের মতো ভাবে যেটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। সে তো চায়, পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধতম পুরুষ হিসেবে তিথি তাকে চিনুক। চট করে হাত থেমে গেল তার। আয়নার দিকে পুনরায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নিজের ভাবনা দেখে চমকিত হলো। হঠাৎ করে তিথির ভাবনা নিয়ে সে উঠেপড়ে লেগেছে কেন? তিথি তাকে খারাপ ভাবুক, বাজে ছেলে মনে করুক তাতে তার কি?

তার কিছুই না! বলে নিজের মনকে প্রবোধ দিল সম্পদ। দ্রুত হাত চালিয়ে দাঁত পরিষ্কার করলো। হাত মুখ ধুয়ে একেবারে বের হলো। রুমের দরজা খুলে বাইরে বের হতে বুকের ভেতর ধাক্কা খেল। তিথি কাউচে শুয়ে আছে। সে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ চেয়ে রইলো না। দৃষ্টি সংযত করে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। হিটারে পানি গরম করতে দিয়ে অপেক্ষায় রইলো। রান্নাঘর থেকে এক পলক তিথির দিকে তাকালো। তিথি এই ফ্ল্যাটটা নিজের মতো ব্যবহার করছে। এতে অবশ্য স্বস্তি! পানি গরম হয়ে গেছে। দুটো মগে অল্প অল্প করে পানি ঢেলে নিল। এক চামচ কফি, দেড় চামচ কফিমেট আর হাফ চামচ চিনি দিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে নাড়লো। নিজের মগটা হাতে নিতে থমকে গেল। আরেকটা কি করবে? তিথির জন্য কফি বানানোর কি খুব দরকার ছিল?

নিজের মগে চুমুক দিল সে। সব ঠিকঠাক। কি মনে করে তিথির মগেও চুমুক দিল। তার এঁটো জিনিস খাবে। এটা তার জন্য ছোট্ট একটা শাস্তি। কাল রাতে অহেতুক তার মন খারাপ করিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। দুটো মগ হাতে নিয়ে সে বের হলো। একটা টেবিলের উপর রেখে তিথির কাছে এলো। মগে চুমুক দিয়ে সে তিথির দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ আটকে গেল তিথির ডান হাতের উপর। ডান হাতের তালুতে কুচকুচে তিল। যেটা আজ প্রথম সে আবিষ্কার করলো। সাদা মসৃণ তালুর উপর তিলটা মন কাড়া। একটুপর খেয়াল করলো শুধু তালুতে নয়। একই হাতের শাহাদাত আঙুলের ডগায় আরো একটা তিল। সম্পদ কফি খাওয়া ভুলে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

ঘুমের মধ্যে তিথি নড়ে উঠলো। সম্পদও কিছুটা নড়ে উঠলো। সরে আসার জন্য তৎপর হতেই তিথি গড়িয়ে কাউচ থেকে পড়ে যেতে নিল। সম্পদ অতিদ্রুত হাত বাড়াল ধরার জন্য। কিন্তু তার আগেই তিথি ধাড়াম করে ফ্লোরে পড়ে গেল। চিৎকার দিয়ে উঠলো সে। চোখ খুলে সম্পদকে কাছে দেখে ভড়কে গেল। সম্পদ সরে এসে ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ঘুমানোর স্টাইল দেখে যে কেউ ফিদা হয়ে যাবে।’

তিথি শুনতে পেল না। দ্রুত ফ্লোর থেকে উঠে বসলো। মাথার খুলে যাওয়া চুলগুলো হাত খোঁপা করলো। ঘুমের মধ্যে ফ্লোরে পড়ে গেছে বিষয়টা আবিষ্কার করতে পেরে লজ্জিত সে। মাথা নিচু রেখে বলল,

‘আপনার অফিস আছে না?’

‘হুঁ!’

‘আমি নাস্তা রেডি করছি।’

সম্পদ ভেঙে ভেঙে বলল,

‘দরকার নেই। আ-মি করে নিবো। করে নি-বো। তুমি রেস্ট নাও।’

বলে সে রুমে ঢুকে গেল। তিথি ঝটপট ফ্লোর থেকে উঠে পড়লো। টেবিলের উপর মগ দেখে কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল। ধোঁয়া উঠা গরম কফি দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। তাকে সম্পদের খেয়াল রাখার জন্য এখানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সমীকরণ পুরো উল্টে গেছে। সম্পদ নিজেই সর্বদা তার খেয়াল রাখে। বেশিরভাগ দিন রাতের খাবার রান্না করতে দেয় না। অফিস থেকে ফেরার সময় কিনে নিয়ে আসে। আবার ভোরবেলা সে ঘুম থেকে উঠার আগেই সম্পদ উঠে যায়। তিথি মনে মনে কড়া সিদ্ধান্ত নিল। কাল থেকে সম্পদের আগে উঠে যাবে। কফির মগ হাতে নিয়ে সে সম্পদের রুমের দিকে এগোল। লুকিয়ে একটু পরখ করবে সম্পদ কি করছে!

দরজা খোলা। তিথি নিজেকে আড়ালে রেখে সামান্য উঁকি দিল। দেখলো সম্পদ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তার পাশে বেড টেবিলের উপর কফির মগ রাখা। কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে কিছু একটা লেখালেখি করছে। থেকে থেকে কফির মগে দু এক চুমুক দিচ্ছে। তিথি সরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই সম্পদ জিগ্যেস করলো,

‘কিছু বলবে নাকি?’

তিথির বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলোম এতটা চমকে গেল যে মগ থেকে কফি ছলকে কয়েক ফোঁটা হাতে পড়লো। হাতের কফিটা দ্রুত নিচে নামিয়ে রাখলো। বাম হাতে কফি মুছতে মুছতে বলল,

‘না, না! কিছু বলবো না।’

সম্পদ এতক্ষণে চোখ তুলে তিথির দিকে তাকালো। চমকে বলে উঠলো,

‘হাতে কি হয়েছে?’

‘কিছু না! কয়েক ফোঁটা কফি ছিঁটে পড়েছে।’

তিথির কথা শেষ হতে না হতে সম্পদ একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। হুড়মুড় করে এগিয়ে এসে তিথির হাত চেপে ধরলো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘কোথায় পড়েছে?’

তিথি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লো। সামান্য দু একফোঁটা কফিই তো পড়েছে। জ্বলন্ত উনুনে সে তো আর পড়ে যায়নি। হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,

‘কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিছু হয়নি আমার।’

‘ভালো!’

বলে সম্পদ হাতটা অনেকটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তিথি পড়ে যেতে নিতেও পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। সম্পদের চোখ মুখ কুঁচকানো। তিথি এক পলক দেখেই বুঝতে পারলো রেগে আছে। কিন্তু এটা বোধগম্য হলো না রেগে যাওয়ার মতো কিছু বলেছে কি না! সে কিছু বলার চেষ্টা করতে সম্পদ বলল,

‘আমি এখন অফিসের কাজ করবো।’

তিথি আর কিছু বলল না। সম্পদ হনহন করে রুমে ঢুকে গেল। তিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রতিবার সম্পদের অবর্তমানে ভাবে যে ছেলেটার সাথে একটু ভালো ভাবে কথা বলবে। একসাথে থাকতে গেলে দুজনের মাঝে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দরকার। কিন্তু দু একটা কথা বলতে না বলতে কি যেন হয়ে যায়। না হয় সম্পদ মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়, না হয় সে মুখ বাঁকিয়ে চলে আসে। এভাবে কতদিন চলবে?

ফ্লোর থেকে কফির মগটা হাতে তুলে নিল সে। সম্পদের দিকে এক নজর তাকিয়ে রুমে চলে এলো।

১৩.

শুক্রবারের বিকেল! টিভির সামনে বসে একের পর এক চ্যানেল পাল্টাচ্ছে তিথি। অথচ দেখার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। হয়তো দেখার সতো অনেককিছু আছে। তার মন বসছে না। ছোটবেলা গ্রামে সবার ঘরে ঘরে টিভি ছিল না। কিন্তু তখন দেখার জন্য মন ছটফট করতো। এখন ভুলেও টিভির দিকে তাকাতে মন চায় না। সম্পদের এখানেও টিভি ছিল না। অনেক কিছুই ছিল না। সে আসার পর আস্তে আস্তে টিভি কিনেছে। প্রয়োজনীয় ফার্ণিচার কিনেছে। তার নিজের রুমটা গুছিয়ে দিয়েছে। এসব কিছুর জন্য সে মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার আর মানুষটার মধ্যবর্তী দূরত্ব দিন কে দিন বেড়ে চলেছে।

টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে। সম্পদের রুমের সামনে এসে দেখলো বড় তালা ঝুলছে। কিছুদিন হলো সম্পদ অফিস যাওয়ার সময় নিজের রুমে তালা ঝুলিয়ে যায়। আজ উইকেন্ড ডে। সেই সকালবেলা বাইরে বের হয়েছে। বন্ধুদের সাথে হয়তো ঘুরতে গেছে। আজও তালা ঝুলিয়ে গেছে। তিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে এলো। নিজের রুমে ঢুকে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানালা দিয়ে দৃষ্টি বিস্তৃত করলো সামনের শহরে। বিকেলের মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে শহরে। এই শহর তার এখনো দেখা হয়নি। আজ দিয়ে একুশ দিন হতে চলল সে ঘরবন্দী। বাইরে বের হওয়া হয় না, কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। শুধুমাত্র নিজের রুম, ড্রয়িং রুম আর রান্নাঘরে যাতায়াত তার। হাঁপিয়ে উঠেছে সে।

গত সপ্তাহে সম্পদ তাকে দু বার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বলেছিল। কিন্তু তার সে প্রস্তাবে কেমন গা ছাড়া একটা ভাব ছিল। যেন মন থেকে বলেনি। ব্যাপারটা ধরতে পেরে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। সেজন্য আর যায়নি। এখন অপেক্ষায় আছে গ্রামে ফেরার।

ফোনের রিংটোনের শব্দে ধ্যান ফিরে তিথির। ড্রেসিং টেবিলের উপর ফোন বাজছে। কিছুটা বিচলিত হলো সে। মাত্রই মায়ের সাথে কথা হয়েছে। এখন আবার কে ফোন দিতে পারে? এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে চমকে গেল। সম্পদ ফোন দিয়েছে। এটা তার জন্য বড়ই আচানক ঘটনা। সম্পদ তার সাথে ফোনে কথা বলতে চায় না। ফোনালাপ বিষয়টা এড়িয়ে চলতে চায়। একবার কারণ জিগ্যেস করায় কড়া গলায় বলেছিল, তোমার কন্ঠ বিদঘুটে। শুনলে কানের সাথে সাথে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

সেদিন তিথি কষ্ট পেলেও প্রতিবাদ করেনি। আজ সম্পদ নিজে থেকে ফোন করেছে ভেবে চমকিত হলো। রিসিভ করে কানে ধরে চুপ করে রইলো। ওপাশ থেকে সম্পদের বিষণ্ণ সুন্দর কন্ঠ ভেসে এলো। ডাক দিল,

‘তিথি?’

‘হুঁ!’

তিথি উত্তর দিতে সম্পদ ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল,

‘একটু নিচে আসো তো। গেটের কাছে আসো!’

‘কেন? আপনি উপরে আসুন।’

‘আরে আমি আসতে পারছি না। সেজন্য তোমায় বলছি। একটু তাড়াতাড়ি এসো তো।’

তিথি বাঁধ সাধার আগেই সম্পদ ফোন কেটে দিল। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেল তার। মানুষজনের সঙ্গ এখন একদম ভালো লাগে না। বিষের মতো লাগে সব। কেউ চোখ তুলে তাকালে ঘৃণা লাগে। সেজন্য সবার দৃষ্টি থেকে আড়ালে রয়েছে। হাতের ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলো সে। মাথায় লম্বা করে ওড়না পেঁচিয়ে তবে বাইরে বের হলো। সিঁড়িতে কাউকে চোখে পড়লো না। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করলো সে। কারো সাথে যেন দেখা না হয়!

গ্রাউন্ড ফ্লোরে বয়স্ক এক দারোয়ানকে চোখে পড়লো। টুল পেতে বসে আছে। তাকে দেখে বলল,

‘কোন ফ্লোরে থাকো?’

তিথি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,

‘তিনতলায়।’

আর কিছু বলল না। দ্রুত গেটের দিকে এগিয়ে গেল। লোহার গেট দিয়ে চোখে পড়লো সিএনজি। চমকে বাইরে বের হলো। তাকে দেখে সম্পদ ভাঙা গলায় বলল,

‘কাছে আসো তো!’

কাছে এগিয়ে গিয়ে সম্পদকে দেখে তিথির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। সম্পূর্ণ শরীরে দৃষ্টি ঘুরপাক খেতে থাকলো। সম্পদের নাজেহাল অবস্থা। কপালে ব্যান্ডেজ, থুতনিতে কাঁটা দাগ, কনুইয়ে চামড়া ছিঁড়ে গেছে, ছেঁড়া শার্ট, এলোমেলো চুল। বাম পায়ে হাঁটুর নিচ থেকে সম্পূর্ণ পা মোটা ব্যান্ডেজ করা। সে আরো কাছে এগিয়ে গেল। বিস্ফারিত কন্ঠে বলল,

‘কি হয়েছে আপনার? এক্সিডেন্ট করেছেন কিভাবে?’

(চলবে)

কয়েক ঘন্টা পর ‘অনুভবের প্রহর’ পোস্ট করবো। অর্ধেক লেখা শেষ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here