প্রেম_পায়রা পর্ব ১৩+১৪

#প্রেম_পায়রা 🕊️🕊️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#ত্রয়োদশ_পর্ব

– “মিস অরিন, আপনি!!”
অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো স্নিগ্ধ। অরিনকে এখানে সে মোটেও আশা করে নি সে! সাজেক থেকে ডিরেক্ট আবার এখানে দেখা হবে ব্যাপারটা মোটেও বোধগম্য হয় নি তার। ব্যাপারটা কি আসলেই কাকতালীয় নাকি অন্যকিছু!
অরিন চোখে থাকা চশমাটা ঠিক করে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠলো,
– ” আরে মিস্টার স্নিগ্ধ না? হোয়াট এ কোয়িনসিডেন্স!
যাক ভালোই হলো!
এখানে এসেছিলাম টুকটাক একটা জব করতে! ইন্টারভিউ দিতে এসে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।
এনি ওয়ে এইযে আমার ফাইলপত্র গুলো!”

হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধর দিকে পেপার গুলো এগিয়ে দিল অরিন। স্নিগ্ধ একবার আড়চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে ফাইল গুলো চেক করে। ইন্টারভিউ শেষ হতেই স্নিগ্ধ অরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– ” অল গুড মিস অরিন!
আপনি গিয়ে ওয়েটিং রুমে ওয়েট করুন। আমি একটু পর রেজাল্ট জানিয়ে দিবো!
হ্যাভ এ গুড লাক!!”

অরিন ও হালকা হেসে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো। এদিকে স্নিগ্ধর কপালে চিন্তার ভাঁজ। হুটহাট পরিস্থিতি এমন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায় কেন তার!!

মিনিট বিশেক পর ওয়েটিং রুমে বসে থাকা সকল ইন্টারভিউ পরীক্ষার্থীদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে জাকির সাহেব বলে উঠলেন,

– ” এখানে অরিন সারাহ্ কে?”
অরিন নামটা শুনে মাথা তুলে তাকালো অরিন।

– ” ইয়েস! আ’ম অরিন সারাহ্!”

– ” কংগ্রেচুলেশন, মিস অরিন!
ইউ আর সিলেক্টেড। আগামীকাল থেকে আপনি অফিস জয়েন করতে পারবেন!”
জাকির সাহেবের কথা শুনে অরিনের‌ ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল!

দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। মিশরাত রোজ নিয়মমাফিক ভার্সিটিতে যায়। ইফতেখার চৌধুরীর শরীরের কন্ডিশন আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো হয়েছে। এতে অবশ্য মিশরাতেরও অবদান রয়েছে। স্নিগ্ধ ও রোজ অফিসে যায়। তবে স্নিগ্ধ আর মিশরাতের সম্পর্কে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যাওয়ার বিষয়টা ভুলে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে। এখন আর হুটহাট ঝগড়া লেগে যায় না।

ঘড়িতে কাটায় রাত নয়টা বাজে। জ্যোৎস্নার আলো এসে ব্যালকনির জানালা ভেদ করে রুমের মেঝেতে এসে পড়েছে। জানালার গ্রিলের উপর এক হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধ। দৃষ্টি তার বাহিরের দিকে।

“ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে,,
তোমার দেখা আমার সঙ্গে!
মুখোমুখি আমরা দুজন
মাঝখানে অনেক বারণ..!

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে,,
তোমার দেখা আমার সঙ্গে..!
মুখোমুখি আমরা দুজন,
মাঝখানে অনেক বারণ…!
ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
তোমার দেখা আমার সঙ্গে…!

বাইরে তখন হাওয়া ঝড়ো
তুমি হয়তো অন্য কারোও….!
বাইরে তখন হাওয়া ঝড়ো
তুমি হয়তো অন্য কারোও…!

আরো একবার বলবো সেদিন (২)
আজ জানে কি জিদ না কারো,,,,”

– ” বাহ্! থামলেন কেন?
আপনার গানের গলা তো বেশ সুন্দর!
কই আগে তো কখনো শোনান নি!”
পিলে চমকে উঠে স্নিগ্ধ। মিশরাত ধোঁয়া ওঠা গরম দু কাপ কফি মগ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে প্রবেশ করে। স্নিগ্ধর দিকে এক কাপ এগিয়ে দিতেই সেও হাসিমুখে সেটা নিয়ে নিল। মিশরাত পুনরায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,

– ” কি হলো বললেন না তো!
আপনি তো বেশ গান গাইতে পারেন। এর আগে তো কখনো দেখিনি!”
কফির মগে চুমুক বসিয়ে পাশ ফিরে তাকাল স্নিগ্ধ। মুখে এক টুকরো হাসির রেশ লেগে রয়েছে। মগটা পাশে টেবিলের উপর রেখে বলে উঠলো,

” তুমি আমার সাথে ঠিক কতদিন থাকো?
বেশি হলে এক দু মাস! কতটা জানো আমার ব্যাপারে?
আমার বিষয়ে অনেক কিছুই তোমার অজানা! ”
স্নিগ্ধর কথা শুনে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মিশরাত‌। স্নিগ্ধর বলা কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মিশরাতকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্নিগ্ধ হালকা সামনে ঝুঁকে গেল মিশরাতের‌।

– ” এই ছোট্ট মাথায় এতো প্রেশার দিও না!
পরে সমস্যা হয়ে যেতে পারে!”
স্নিগ্ধর ফিসফিস করে বলা কথাগুলো শুনে মিশরাতের পুরো শরীর বেয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। এটা কেমন ধরনের অনুভূতি!!

আলমারির দরজা খুলে কাপড় গুলো গোছাতে লাগলো মিশরাত‌। স্নিগ্ধ অনেকক্ষণ আগেই অফিসের জন্য বেরিয়ে গিয়েছে। আজকে ভার্সিটি না যাওয়ায় বেশ বোরিং লাগছে তার‌। নিজের কাপড়গুলো আর স্নিগ্ধের কাপড় পাশাপাশি রাখায় মিশরাতের ভাঁজ করা কাপড় রাখতে গিয়ে স্নিগ্ধের একটা শার্ট নিচে পড়ে যায়।
– ” একটা কাজ করতে গেলে আরো দুটো বিগড়ে যায়! কি যে করি!!”
বিড়বিড় করতে করতে শার্ট টা পূর্বের জায়গায় রাখতে যাবে তখনই হাতে কিছু একটা বাজে মিশরাতের‌। ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। হাতরে হাতরে সেটা বের করতেই খেয়াল করে একটা পেন্ডেন্ট! যদিও অনেক দিন আগের! তবুও কৌতুহলবশত সেটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শুরু করে সে। লকেটের সিস্টেম দেখে আরেকটু অবাক হয় সে! পেন্ডেন্টের মাঝে কারো ছবি দেয়া! পেন্ডেনটা খুলতেই বিস্ময়ে তার চোখ দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে গেল! একপাশে স্নিগ্ধর ছবি আর অন্যপাশে একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটাকে মোটেও তার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছে না। লাভ শেপের পেনডেন্ট‌ এর মাঝে স্নিগ্ধর আর অন্য একটা মেয়ের ছবি দেখে অনেকটাই অবাক হয়ে যায় মিশরাত‌।
এই ছবির মেয়েটি কে?

কিছু একটা চিন্তা করে আরো চমকে উঠে সে? ছবির এই মেয়েটা আর স্নিগ্ধর বলা শুভ্রতা একই মেয়ে নয় তো?

অফিসের মিটিং শেষ করে কেবিন থেকে বের হতেই মুখোমুখি হলো স্নিগ্ধ আর অরিন‌। স্নিগ্ধ যথেষ্ট মেইনটেইন বজায় রেখে চলে এ মেয়েটার কাছ থেকে! কেননা অরিনের‌ চালচলন আর কথাবার্তা অনেকটাই রহস্যে ঘেরা!
– ” স্যার এইযে আপনার নেক্সট মিটিংয়ের শিডিউল!”
স্নিগ্ধ ও হালকা হেসে সেগুলো হাতে নিল।
– ” থ্যাংকস মিস অরিন! আগামীকাল মিটিং এ দেখা হচ্ছে তাহলে!
হ্যাভ এ গুড ডে!”
বলেই অরিনকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলো স্নিগ্ধ। অরিন পেছন ফিরে একবার স্নিগ্ধর যাওয়ার পানে তাকালো!
– ” অবশ্যই মিস্টার আশফিন‌ চৌধুরী স্নিগ্ধ! দেখা তো আমাদের হতেই হবে!
সেটা আপনি চাইলেও হবে আর না চাইলেও হবে! বিকজ ইটস্ মিস্ট্রিয়াস‌!”
বলেই আলতো হাসলো অরিন‌। যে হাসিতে লুকানো রয়েছে অনেকখানি রহস্যের ছোঁয়া!

রাতে ডিনার শেষে রুমে আসতেই খেয়াল করে মিশরাত অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইস্ত্রি করছে কাপড়। যার কারণে গরম ইস্ত্রির ছোঁয়া হাতে লাগতেই লাফিয়ে উঠে মিশরাত‌। বাম হাতের তালুতে লাগায় সেখানে অনেকটা অংশ জ্বালা করছে!
– ” আরে দেখেশুনে একটু কাজ করবে তো! দেখো এখন কতখানি পুড়ে গিয়েছে।!”
বলেই স্নিগ্ধ একপ্রকার দৌড়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে ‌মিশরাতের হাতে সযত্নে মলম লাগানো শুরু করে।
আর এদিকে মিশরাতের মাঝে যেন কোনো প্রতিক্রিয়া ই নেই। সে একদৃষ্টে স্নিগ্ধর তাকিয়ে রয়েছে। ব্যান্ডেজ করা শেষে মিশরাতের ওমন চাহনি দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে স্নিগ্ধ।
– ” কি হয়েছে? এমনভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
স্নিগ্ধর কথায় হুঁশ ফিরে আসে মিশরাতের‌। তারপর ছোট্ট একটা দম নিয়ে বলে উঠল,

– ” শুভ্রতা কে স্নিগ্ধ?”
চোখ তুলে তাকায় স্নিগ্ধ। চোখে মুখে বিরক্তির আভা স্পষ্ট।

– ” মিশরাত আমি তোমাকে একবার বারণ করেছি যে এই নামটা আমার সামনে উচ্চারণ করবে না!
তবুও তুমি ফের শুভ্রতার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছো!!
আর আমি তো বলেছিই যদি কোনোদিন সঠিক সময় আসে তাহলে সেদিন তোমাকে সবটা বলবো! ”
চাপা স্বরে বলে উঠল স্নিগ্ধ। এদিকে মিশরাত মোটেও এমন প্রত্যুত্তর আশা করেনি স্নিগ্ধর কাছ থেকে। তবে সেও ছাড়বার পাত্রী নয়।

সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে পেন্ডেনটা স্নিগ্ধর সামনে ধরতেই স্নিগ্ধ চরম অবাক হলো।
– ” এটা কি তাহলে? এই মেয়েটা কে? আর শুভ্রতাই বা কে?
আমি জানতে চাই স্নিগ্ধ!”

এবার আর রাগ সামলে উঠতে পারলো না স্নিগ্ধ। হুট করে তার ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে তাকে জেরা করাটা মোটেও পছন্দ হয় নি তার!
– ” শুভ্রতা, শুভ্রতা, শুভ্রতা!!!
কে এই শুভ্রতা সেটাই জানতে চাও তো তুমি? তাহলে শোনো আমি শুভ্রতা কে ভালোবাসি!!
আই লাভ হার!!”

অনেকটা চিল্লিয়ে বলে উঠলো স্নিগ্ধ। আর মিশরাত এখনো থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।তার মানে তাদের মধ্যকার ডিলটা শুধু মাত্র এই মেয়ের জন্য! স্নিগ্ধ কি অন্য কাউকে ভালোবাসে? আর যদি ভালো বেসেই থাকে তাহলে তাকে বিয়ে করার কি প্রয়োজন ছিলো??…………
#প্রেম_পায়রা 🕊️🕊️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#চতুর্দশ_পর্ব

“আমি শুভ্রতা কে ভালোবাসি!”
কথাটা বারংবার মিশরাতের মাথায় ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। এটা শোনার পর আর কোনো কিছু ব্যাখ্যা করে বলে দিতে হয় নি তাকে। সবকিছুর হিসেব ই তার মিলে যাচ্ছে।
রুমটায় পিনপতন নীরবতা। কারো মুখেই কোনো শব্দ নেই। মিনিট পাঁচেক পর নীরবতা ভেঙে মিশরাত নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে উঠলো,

– ” তাহলে অযথা এই ডিলটার‌ কি প্রয়োজন ছিলো?
আপনি তো চাইলেই শুভ্রতাকে বিয়ে করে নিতে পারতেন!”

পিছনে ফিরে তাকাল স্নিগ্ধ। চোখে মুখে কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার ব্যর্থতা!
এতক্ষণ ধরে মিশরাতের সাথে রুড ব্যবহার করলেও এখন আর সেটা হয়ে উঠছে না। পুরোনো অতীত আবারো তার সামনে ফিরে এসেছে যেটা থেকে সে এতদিন পালিয়ে পালিয়ে থাকছিলো। কিন্তু কথায় আছে না, সত্য বেশি দিন লুকিয়ে থাকতে পারে না। ঠিক তেমনটাই তার ক্ষেত্রে ঘটেছে। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রয়ারের দিকে এগিয়ে গেল স্নিগ্ধ। ড্রয়ার থেকে কালো রঙের ডায়েরিটা হাতে নিয়ে মিশরাতের মুখোমুখি বসলো সে। ডায়েরিটা মিশরাতের দিকে এগিয়ে দিতেই মাথা তুলে তাকালো মিশরাত‌। স্নিগ্ধর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে স্নিগ্ধ চোখের ইশারায় ডায়েরিটা খুলতে বলল।
– ” এতেই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া রয়েছে। আশা করি এটা পড়লেই সবটা তোমার বোঝা হয়ে যাবে!”
মিশরাতের হাতে ডায়েরিটা ধরিয়ে দিয়ে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো স্নিগ্ধ।

এদিকে মিশরাত একপলক স্নিগ্ধর যাওয়ার পানে চেয়ে ডায়েরির প্রথম পাতা উল্টানো শুরু করলো।

০৬ই ডিসেম্বর, ২০১৮.

লন্ডন শহর‌। বিশাল এক সাম্রাজ্যের এক বিশাল শহর লন্ডন। লন্ডনকে ঘিরে রয়েছে হাজারো ঐতিহাসিক সব ঘটনা।
মূলত দু বছরের একটা কোর্স কমপ্লিট করার জন্যই লন্ডনে আসা। তবে দু বছর একা একা একটা অচেনা শহরে কাটানো মোটেও ছোট ব্যাপার নয়। লন্ডন ভার্সিটি থেকে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজে পিএইচডি কমপ্লিট করতে দু বছর সেখানেই পরিবার ছেড়ে কাটাতে হয় আমাকে। তবে এ দু বছরেই যে আমার জীবনটা সম্পূর্ণ রূপে পাল্টে যাবে তা কখনো কল্পনাও করিনি।
সিটি অফ লন্ডনের বিখ্যাত কয়েকটা জায়গার মধ্যে লন্ডন আই হলো অন্যতম। টেমস নদীর অন্যপাশে অবস্থিত গোলাকার রাইড ই লন্ডন আই নামে পরিচিত। যেখান থেকে পুরো লন্ডন কে ঘুরে দেখা সম্ভব।
আর ঠিক এই দিনটাই আমার জীবনের সবচেয়ে মেমোরিয়াল দিন ছিল।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭.
লন্ডন আই তে এসেছিলাম ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে ঘোরাঘুরি করার জন্য। ভার্সিটির পিএইচডি ফার্স্ট ইয়ার সবে মাত্র শুরু হয়েছে। টেমস নদী পেরিয়ে লন্ডন আইতে পৌঁছাতে ছোট ছোট বৃত্তাকার ক্যাপসুলের মতো সিটে বসে ৩৬০° কোণে লন্ডন শহর ঘুরে দেখা যায়। আর এখানেই সর্বপ্রথম দেখা হয়েছিল আমার তার সাথে।
কালো শাড়ি পরনে এক বাঙালী নারী। চোখ গুলো টানা টানা, ঘন পাপড়ি যুক্ত চোখে রয়েছে অসংখ্য মায়া। আর সেটার মায়াতেই পড়ে গিয়েছিলাম আমি।
লাভ এট ফার্স্ট সাইট বাক্যটায় ছোট কাল থেকেই বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল আমার। কেননা ছোট বেলায় স্কুল কলেজে থাকতে মেয়ে পটাতে গিয়ে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তাই তখন থেকেই এসব প্রেম ট্রেম বাদ দিয়ে দেই ”

পড়ার মাঝেও ফিক করে হেসে উঠলো মিশরাত‌। কিছুক্ষণ হাসি থামিয়ে আবারও মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলো সে।

” এই মায়াটাই আমার জীবনটাকে কিভাবে বদলে দিল কখন টেরই পেলাম না। ভীড়ের মাঝ থেকে এগিয়ে গিয়ে ক্যাপসুলে প্রবেশ করি আমরা। সেখানে ঐ মেয়েটাও থাকে। সরি মেয়েটা বলছি কেন? সে তো আমার মায়াবতী! আমার শুভ্রতা!!
রাইড চলা শুরু করলে গ্লাসের বাইরে থেকে লন্ডনের পুরো শহর এক এক করে দৃশ্যমান হতে থাকে। কিন্তু আমার দৃষ্টি তখনও আমার মায়াবতীর দিকে বিদ্ধ‌। হঠাৎ পকেটে থাকা ফোনটা বের করে আনমনে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম তার‌। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো ওখানেই। তবে এতে কিছুটা উপকার ও হয়েছে। লাস্টের ছবি তোলার সময়ে মেয়েটা পেছন ঘুরে তাকায়। আমাকে এমনভাবে ধরা খেতে হবে তা মোটেও কল্পনা করি নি। মেয়েটা তেড়ে আস আমার দিকে।
– ” হেই! হোয়াট ইজ ইওর প্রবলেম!
হোয়াই আর ইউ ক্লিক মাই পিকচার উইদাউট টেক মাই পারমিশন‌।”

থতমত খেয়ে গেলাম আমি। আমার ফ্রেন্ড রাও পাশে ইতিমধ্যে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। তাই আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
– ” একচুয়ালি! আই ওয়াজ টেক পিকচার এরাউন্ড দ্যা সিনারি! আই ডিড নট নোটিস্ড ইউ।”

মেয়েটি যে আমার কথায় বিশ্বাস করেনি সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটা রুক্ষ স্বরে বলে উঠে,
– ” আমি জানি আপনাদের মতো ছেলেদেরকে। রিডিকিউলাস!!”
বলেই গটগট করে সামনে হাঁটা শুরু করে দেয় মেয়েটি। আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। এটাই আমার তার সাথে প্রথম দেখা।
এরপর কয়েকদিন অনেক খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু খুঁজে পাইনি। মিনিমাম তিন চার দিন পর হঠাৎ আবারো তার সাথে কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে যায় আমার।
লন্ডনের আইকন যে স্থির ব্রীজ যা মোটামুটি কম বেশি সব ছবিতেই দেখানো হয়। লন্ডন ব্রীজের উপর ফ্রেন্ড সার্কেলের দু একজন গিয়েছিলাম ফটোগ্রাফী করতে। স্টুডেন্ট থাকতে ফটোগ্রাফীর প্রতি অদ্ভুত একটা নেশা ছিল। সুন্দর সুন্দর দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দি করতে ভীষণ ভালো লাগতো।
তো সেদিন ও নিয়মমাফিক ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম সেদিন। হঠাৎ লন্ডন ব্রীজের একপ্রান্তে ক্যামেরাতে ছবি বন্দি করতে গিয়ে ছবি বন্দি হয়ে গেল আমার মায়াবতীর। সাদা শাড়ির মাঝে কালোর কারুকাজ। লম্বা চুলগুলো একপাশে এনে বিনুনি করা। যেন একদম শুভ্র অপ্সরী‌। পাশ থেকে আনানের ডাকে ধ্যান ফিরে আসে আমার। ও হ্যাঁ আমিতো বলতেই ভুলে গিয়েছি। আনান আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
– ” কিরে এভাবে হ্যাবলার মতো ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছিস। ছবি তোলা বাদ দিয়ে!”

– ” কই‌ কিছু না তো! এখান থেকে সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। চল সামনের দিকটায় যাই।”

এটুকু বলে সামনের দিকে দৃষ্টি যেতেই ভ্রু কুঁচকে যায় তার। সেকি মেয়েটা কোথায় চলে গেল? এখানেই তো ছিল। সেদিন তার দেখা পেয়েও একরাশ হতাশা নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলাম!”

হাই দিয়ে উঠে মিশরাত‌। ঘড়িতে কাটা জানান দিচ্ছে রাত বারোটা বেজে গিয়েছে। হালকা ঘুম ঘুম ভাব এসে জড়ো হচ্ছে তার চোখে। কিন্তু এখন তো ঘুমোলে চলবে না। তাকে জানতে তো শুভ্রতা আসলে কে!
তাই অলসতা কাটিয়ে আবারো পরবর্তী থেকে পড়া শুরু করলো সে!

” এর মাঝ থেকে কেটে গিয়েছে আরো একমাস। ভার্সিটিতে অলরেডি এক্সাম ও শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে এ একমাসে মেয়েটাকে কম খুঁজি নি। কিন্তু মেয়েটা যে হাওয়ার মতো অদৃশ্য হলো যে আর তাকে খুঁজে পেলাম না।
কিন্তু নিয়তি নামে একটা জিনিস আছে না? যেটাকে আমরা চাইলেও কন্ট্রোল করতে পারি না। ঠিক তেমনি আবারো নিয়তি আমাদের এক সাথে মুখোমুখি করলো।
ঘুরেফিরে আবারো আমাদের দেখা হলো একই ভার্সিটিতে। এতে যে কি পরিমান খুশি হয়েছিলাম সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। এরপর থেকে মায়াবতীর সাথে রোজ রোজ দেখা হতো। টুকটাক কথাও হতো তার সাথে। এর মাঝে জেনে গেলাম আমার মায়াবতীর একটা মিষ্টি নামও রয়েছে। শুভ্রতা! লাইব্রেরীতে প্রায় সময় দেখা হলে একসাথে বসে কফি খাওয়া বা টুকটাক আড্ডা জমানো হতো‌।
মাস পাঁচেক পর একদিন একগাদা সাহস নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবার সামনেই হাঁটু গেড়ে বসে তাকে জানিয়েছিলাম আমার মনের সব কথা।
মনে মনে অবশ্য একরাশ ভয় হচ্ছিল যে আবারো ছোটবেলার মতো রিজেক্টেড হতে না হয়।
কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে শুভ্রতা ও আমার ভালোবাসাকে একসেপ্ট করেছিল।
এখান থেকেই সূচনা ঘটেছিল আমার আর শুভ্রতার নতুন প্রেমের। তবে কথায় আছে না যেখানে তুমি সবচেয়ে বেশি সুখ খুঁজে পাবে সেখানে দুঃখ রাও এসে জড়ো হবে।
তেমনি আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল‌। ফাটল ধরেছিল আমাদের ভালোবাসায়‌। শুনেছি যাকে মন থেকে ভালোবাসা হয় তারা নাকি কখনো ছেড়ে চলে যায় না।
তাহলে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল কিভাবে?
একবছর রিলেশন ভালো থাকলেও এরপর শুভ্রতার বিহেভিয়ারে ব্যাপক একটা পরিবর্তন চলে আসে। হুটহাট মেজাজ বিগড়ে যাওয়া, কথায় কথায় ব্রেকআপ করার হুমকি দেয়া আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবাতে শুরু করে। তাই এর মূল কারণ জানার চেষ্টা করি। কিন্তু সেই সত্যি জানতে গিয়ে আমার পায়ের তলা দিয়ে জমিন সরে গিয়েছিল‌।
নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে নিজের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দেখতে পেয়ে মাথা কাজ করছিলো না আমার। ভরা রেস্টুরেন্টের মাঝে গিয়ে শুভ্রতাকে একটা ঠাঁটিয়ে চড় মেরে বসি!
– ” স্নিগ্ধ বিশ্বাস করো, আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি।
আর আনানের‌ সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। প্লিজ আমাকে ছেড়ে চলে যেও না!”

শুভ্রতার বারণ করা সত্ত্বেও বেরিয়ে আসি রেস্টুরেন্ট থেকে। শুনেছি ছেলেরা খুব সহজে কান্না করেনা। তবে সেদিন আমার চোখে জল জমেছিল। পেছনে যে শুভ্রতা আমাকে ডাকছে তা আমার কানে পৌঁছালেও পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। কেনই বা করবো!
কিন্তু হঠাৎ কারো গগন কাঁপানো চিৎকার কানে পৌঁছাতেই রুহ কেঁপে উঠলো আমার। পেছনে ফিরে তাকাতেই মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসলো,
– ” শু‌,শুভ্, শুভ্রতা!!”

মিশরাতেরও গলা শুকিয়ে আসলো। এর পর থেকে ডায়েরির পাতা গুলো ছেঁড়া। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলেও আর কিছু লিখা নেই। কিন্তু এর পর কি হয়েছিল? আর শুভ্রতাই বা কোথায়!

– “তোমার জন্য কষ্ট হয় মিশরাত‌। বাট কি করবো বলো? আমার আর স্নিগ্ধের মাঝে তুমি থার্ড পার্সন। তাই তোমাকে তো সরতেই হবে! স্নিগ্ধ কে আমি তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিবো।

আর স্নিগ্ধ তোমার কাছ থেকেও আমার অনেক হিসেব নিকেশ বাকি! তোমাকে তো এত সহজেই ছেড়ে দিতে পারিনা!”
বলেই বাঁকা হেসে উঠলো অরিন!……………

#চলবে 🍂
( দুঃখিত অনেকটা দেরি হয়েছে। সারাদিন বিদ্যুৎ না থাকায় গল্প পোষ্ট করতে পারিনি।
কেমন হয়েছে জানাবেন!
ভালোবাসা অবিরাম 🖤🖤)
#চলবে 🍂
( আসসালামুয়ালাইকুম। সবাই কেমন আছেন? শুভ্রতার রহস্য আগামী পর্বে আপনারা পেয়ে যাবেন। তাই সবাই ধৈর্য ধরুন।
কেমন হয়েছে জানাবেন।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤🖤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here