প্রেয়সী পর্ব – ২১+২২

#প্রেয়সী ♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ২১

৪১.

—-” নিধি মা? কিরে.. এ বেলায় হঠাৎ ঘুমচ্ছিস? শরীর খারাপ মা? উঠ তো একটু? আমায় কফি দে! না কফি না! আজ বরং আমায় পাস্তা করে খাওয়া। বাপ বেটিতে বেশ আয়েস করে খাবো আজ। কিরে উঠলি?”

বাবার অগোছালো কথা গুলো ধীরেধীরে মিলিয়ে যেতেই ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে উঠে পড়লাম। মাথার মধ্যে টনটন করে ব্যা/থা করে উঠলো। দু’হাতে শক্ত করে মাথাটা চেপে ধরতেই আবারও বাবার কন্ঠ পেলাম যেন। ঝটপট চোখ খুলে তাকাতেই সব কিছু ফাঁকা বলে অনুভব হলো। সেই সাথে নি/স্ত/ব্ধ পরিবেশ। রাত হয়ে গিয়েছে অনেক্ষন। প্রহর ক’টা কাটলো ঠিক বুঝতে পারছিনা। এ-ঘরে কি কেউ এসেছিলো? বিছানা ছেড়ে নামতেই কিছুতে খোঁচা খেয়ে কাতর কন্ঠে গোঙ্গিয়ে উঠলাম। রাফিদ ভাইয়ার এসাইনমেন্টের বড় ফাইলটা। তার সুউচ্চ মাথাতে হাতের চাপ পড়তেই সেও পাল্টা আ/ঘাত করলো আমার হাতের কব্জিতে। কপাল কুঁচকে সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত ডলতে ডলতেই হঠাৎ আমার ভেতরটা ধক করে উঠলো।

‘এসাইনমেন্ট গুলো যে সব বাকি’ মনে হতেই মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। আমি যে সব গুলো ইনকমপ্লিট রেখেই… আচ্ছা ক’টা বাজে? কাল ভেবেছিলাম ভার্সিটি যাবো! এই ম/র/ন দশার জন্য তো মনে হচ্ছে আগামী এক মাসেও ভার্সিটিতে পা রাখা সম্ভব হবেনা! দৌড়ে উঠে গেলাম ওয়াসরুমে। কোনো রকমের চোখে মুখে পানি ছিটিয়েই বের হয়ে আসলাম। মানবতার খাতিরে হলেও এগুলো আমায় কমপ্লিট করতে হবে! এতোদিন তাদের এসাইনমেন্ট গুলো আঁটকে রেখেও যদি কমপ্লিট না করে দেই তবে উনারা আমায় কথা শোনাতে বা আদারস্ পানিশমেন্ট দিতে দু-বারও ভাববেনা! রাহিয়ান ভাইয়া হয়তো তার কাজিন হওয়ার সুবাদে ছেড়েও দিতে পারে কিন্তু বাকিরা? মনে মনে নিজেকে বকা দিয়েই রাহিয়ান ভাইয়ার এসাইনমেন্ট টা নিয়ে বসলাম। দরকার হলে না হয় রিম্মি আপুর থেকে হেল্প চেয়ে নিবো। প্রশ্নপত্র টা কই জানি ছি….! অ্যা…. এগুলো কি?

পুরো এসাইনমেন্ট কমপ্লিট!! হাউ ইজ দিস পসিবল! মাম্মিইইইই….. ফাইলটা ফেলে দিয়ে সিঁটিয়ে গেলাম দেয়ালের সাথে। এ-কি ভূ/তু/ড়ে কান্ড! এগুলো তো সব ইনকমপ্লিট ছিলো পাপ্পাজি! তবে কমপ্লিট হলো কি করে? আআআআআ……. (গলা ফাটিয়ে দিলাম এক চিৎকার) আমার মাথা ঘুরছে। এখনি আমি জ্ঞান হারাবো। হেইয়ো… আমি জ্ঞান হারাবো ম/রে যাবো বাঁচাতে পারবে না কেউ!

আমার চিৎকারের উৎস খুঁজেই সবাই এক এক করে হাজির হলো আমার রুমে। বউমনি আর রিম্মি আপু আমাকে ভ;য়ের দরুন কাঁপা-কাঁপি করতে দেখে দৌড়ে এসে ধরলো। ‘কি হয়েছে, কি হয়েছে’ জিজ্ঞেস করতে করতে নিজেরাও হ/য়রান হচ্ছে আমাকেও হ/য়রান করছে। নীচে এসাইনমেন্টের ফাইলগুলো পড়ে থাকতে দেখে ফাহিম ভাইয়া এসে সব গুলো তুলে বেডের উপর রেখে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল,

—-” পিচ্চি? কি রে কি হয়েছে? চেঁচালি কেন? ভ/য় পেয়েছিস? আর এগুলো কি? কার এসাইনমেন্ট?”

লিয়া জল ভর্তি গ্লাস এনে আমার সামনে ধরে ভী/ত কন্ঠে বলল,

—-” আপু পানিটা খেয়ে নিন। খেয়ে নিন।”

বউমনি লিয়ার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরতেই আমি চোখ বুঁজে ঢকঢক করে সব পানি গিলে খেলাম। আহ্ শান্তি। বড় করে বার কয়েক দম ফেলে সবার দিকে চোখ বুলালাম। সবার মুখই কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু কথা হলো আমি কি জবাব দিবো?

রিম্মি আপু আমার হাত ধরে বেডের উপর বসিয়ে দিলো। বউমনি লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল ফ্যানের পাওয়ারটা আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিতে। লিয়া মাথা নেড়ে ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে আবারও এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। ফাহিম ভাইয়া এসাইনমেন্টের ফাইল গুলো গোছাতে গোছাতে বলল,

—-” এগুলো তো ভাইয়াদের এসাইনমেন্ট মনে হচ্ছে। পিচ্চি? এগুলো তোর রুমে… মানে তোর কাছে কি করে?”

আমি জবাব দিলাম না। এদের কারোর আগ্রহই আমার গায়ে লাগছে না। আমি তো ভাবছি অন্য কথা। এই ইনকমপ্লিট ফাইল গুলো কমপ্লিট কি করে হলো আর এই টুকু সময়ের ব্যবধানেই বা কি করে সম্ভব?

—-” বউমনি? কি হয়েছে! কে চিৎকার করলো? কার কি হয়েছে?”

হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন রাহিয়ান। আমি চোখ তুলে তাকাতে তাকাতে উনি আমার সামনে এসে হাজির হলেন। বউমনি সবার মুখ চেয়ে উনার দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

—-” নিধি!… ও বোধহয় কিছু দেখে ভ/য় পেয়েছে! দেখছো না এখনো কেমন ঘাবড়ে আছে মেয়েটা?”

—-” নিধি? আর ইউ ওকে?”

আমি ঢোক গিললাম। ওকে আর কি? কিছুই ওকে নয়!

—-” ভ/য় পেয়েছো? কি দেখেছো?”

আমি ফুস করে নিঃশ্বাস ফেললাম। ডানে বামে মাথা নেড়ে বললাম,

—-” কিছু না। আমি ঠিকাছি ভাইয়া।”

আমার কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো ফাহিম ভাইয়া। আমাকে খোঁচা মা/রা/র উদ্দেশ্য বলল,

—-” হ্যাঁ রে পিচ্চি? তোর কি আমাদের কাউকে নজরেই পড়ছে না? না মানে এতক্ষণ ধরে যে আমরা বারবার জিজ্ঞেস করেই চলেছি তোর কি হয়েছে, কি হয়েছে? তুই কোনো জবাবই দিলিনা! অথচ ভাইয়া এসে জিজ্ঞেস করতেই তুই সুন্দর করে বলে দিলি? মানে, হলো কিছু এটা? আমাদের কোনো পাত্তাই দিলিনা তুই!”

বউমনি হেসে ফেললো ফাহিম ভাইয়ার কথায়। রিম্মি আপু হাসতে নিয়েও হাসলো না রাহিয়ান ভাইয়ার উপস্থিতির ভ/য়ে। আমি লজ্জায় পড়লাম। ভারী অদ্ভুত কান্ড করে বসলাম। সত্যিই তো এতোক্ষণ ধরে এতগুলো মানুষের প্রশ্নের কোনো জবাবই দিলাম না!

রাহিয়ান ভাইয়া গম্ভীর মুখে বললেন,

—-” চুপ কর তুই। নিধি?”

রাহিয়ান ভাইয়ার গম্ভীর স্বরে ঢোক গিললেন ফাহিম ভাইয়া। রাহিয়ান ভাইয়া আবারও বলে উঠলেন,

—-” কি হয়েছে ঠিকঠাক বলো? এনি প্রবলেম?”

আমি করুন চাহনি দিয়ে না সূচক মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ না! নো প্রবলেম। আর হলেও তাকে জানানো পসিবল না। আর কথা বাড়ালেন না রাহিয়ান ভাইয়া। চুপচাপ বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। উনার ভয়ে টটস্থ সবাই হঠাৎই হু হা করে হেসে উঠলো। ফাহিম ভাইয়া আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

—-” তুই হঠাৎ গঞ্জিকা সেবন করছিস কবে থেকে রে?”

আমি তো নির্বাক! মানে? গঞ্জিকা? আর আমি? কি করে কি? আমি মাথায় হাত ডলতে ডলতেই বোকা গলায় প্রশ্ন করলাম,

—-” মানে কি ভাইয়া? এসব তুমি কি বলছো?”

রিম্মি আপু মুখ বাঁকিয়ে বলল,

—-” ঐ কু/ত্তা কি বলছিস এসব? ও কেন গাঁজা খেতে যাবে?তুই খাস, আর সেটা ওকে বলছিস?”

ফাহিম ভাইয়া রিম্মি আপুকে পাল্টা বকে বলে উঠলো,

—-” গাঞ্জা না খেলে এমন কবুতরের মতো নাক ডেকে ঘুমায় কি করে?”

ফিক করে হেসে উঠলো লিয়া। ফাহিম ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” কবুতর কি নাক ডেকে ঘুমায় ফাহিক ভাইয়া?”

ফাহিম ভাইয়া ভ্রু কুঁচকালো। তার কথায় কোনো যুক্ত নেই বুঝতেই জোরপূর্বক হাসলো। কথা ঘুরানোর তালে বলল,

—-” ঐ তো একই হলো! আসল কথা হলো গাঞ্জা খেলে মানুষ দিন দুনিয়া ভুলে হারিয়ে যায়। বিশেষ করে একবার ঘুমোতে পারলে তাকে তুলে নিয়ে পুকুরে ফেললেও তার ঘুম ভা/ঙে না। ওর বেলায়ও এমন হয়েছে!”

আমি ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,

—-” আমি তো টেনশনে ঘুমিয়ে গেছি ভাইয়া।”

আমার কথায় চারজনেই বেশ মনোযোগী হলো আমার প্রতি। ভাবুক গলায় লিয়া বাদে বাকি তিনজনই বলে উঠলো,

—-” কিসের টেনশন?”

আমি এসাইনমেন্ট গুলোর দিকে ইশারা করে বললাম,

—-” এগুলো রাহিয়ান ভাইয়া আমাকে দিয়েছিলেন। কমপ্লিট করতে।”

ফাহিম ভাইয়া বুকে হাত চেপে গোল গোল চোখ করে বলল,

—-” ওদের এসাইনমেন্ট নোট হঠাৎ তোকে কেন দিলো? হুয়াই?”

—-” পা/নি/শ/মে/ন্ট!”

‘পা/নি/শ/মে/ন্ট’ আবারও একই সাথে বলে উঠলো তিনজনে। আমি তিনজনেরই মুখ চেয়ে বললাম,

—-” হু পা/নি/শ/মে/ন্ট!”

ফাহিম ভাইয়া ধপ করে উঠে বসল আমার পাশে। বেশ আগ্রহ করেই গোলাকার চোখ নিয়ে বলল,

—-” ইন্টারেস্টিং ইয়ার। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভাইয়া এজ আ সিনিয়র তোকেই কেন এতবড় পা/নি/শ/মে/ন্ট দিতে গেল? কাহিনি কি?”

আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে আবারও বললাম,

—-” সেটা আমারও প্রশ্ন। ভার্সিটি উঠেই কেন এই সিনিয়রদের র‍্যাগিংএর খাতায় সেরা ইডিয়ট হিসেবে আমার নামটাই উঠলো আর আমার সাথেই বা এতোকিছু কেন হলো?”

রিম্মি আপু আমার পাশ ঘেঁসে বসলো। ফাহিম ভাইয়ার ন্যায় সেও একই ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,

—-” এই নিধু বলনা? বলনা কি হয়েছিলো?”

আমি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। সবার মুখ চেয়ে রাহিয়ান ভাইয়া আর তার ফ্রেন্ডদের সাথে আমার হাড্ডাহাড্ডির কাহিনী শোনাতে লাগলাম। ফাহিম ভাইয়া ভিসি আর চিতা বাঘ স্যারের কাহিনী শুনতেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। রিম্মি আপুও হাসতে হাসতে আমার উপরই ঢলে পড়লো। বউমনি আর লিয়ারও একই দশা। তাদের এতো হাসি দেখে আমিও হেসে উঠলাম। সত্যিই সে এক ইতিহাস হয়েছিলো মাত্র কয়টা দিনে।

—-” আচ্ছা এখন বল হঠাৎ চেঁচালি কেন এখন??
ভূ/ত-প্রে/ত দেখলি নাকি?”

ফাহিম ভাইয়া পেট চেপে ধরে বলে উঠলো কথাটা। আমি মাথা নেড়ে বললাম,

—-” না গো ভাইয়া। এই এসাইনমেন্ট গুলো ইনকমপ্লিট রেখে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু উঠে দেখি এগুলো সব কমপ্লিট হয়ে আছে! ভাবতেই তো আমার গায়ে কাটা দেয়। এগুলো কমপ্লিট কে করলো? তাও মাত্র বিকেল থেকে রাতের মধ্যে?”

ফাহিম ভাইয়া চিন্তিত ভঙ্গিমা টেনে বলল,

—-” ভাইয়া করেনি তো?”

রিম্মি আপু অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” ভাইয়া কি করে করবে? ও তো সন্ধ্যার পরপরই বেরিয়ে গেলো ফ্রেন্ড’দের আড্ডায়। আর এলো কখন? রাত এগারোটায়। তবে ওর দ্বারা কি করে সম্ভব?”

বউমনি বলল,

—-” হ্যাঁ গো নিধি। রিম্মি কিন্তু ঠিকই বলেছে।”

ফাহিম ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ভ/য় দেখানোর চেষ্টা করে বলল,

—-” তবে কি জ্বী/ন বাবাজিই খেল দেখালো নিধু?”

আমি আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে উঠলাম। রিম্মি আপু আমায় ধরে ফাহিম ভাইয়ার বিরূদ্ধে বলল,

—-” সর বেয়াদব ফাজলামো করিস না। ও কিন্তু এমনেই ভ/য় পেয়ে আছে।”

ফাহিম ভাইয়া চোখ দুটো সরু করে নিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,

—-” আমি তো তোকে ভ/য়/ই দেখাতে চাই বাচ্চে। ভ/য় পা… তুই ভ/য় পা!”

আমি ভ/য়ে গুটিয়ে গিয়ে চেপে ধরলাম রিম্মি আপুকে। বউমনি আমাদের কান্ড দেখে বকা দিলো ফাহিম ভাইয়াকে। ফাহিম ভাইয়া ফিক করে হেসে উঠতেই লিয়া বলল,

—-” বউমনি, রাত তো দেড়টা বাজে। নিধি আপু তো এখনো খায়নি। আমি কি আপুর খাবার দিবো টেবিলে?”

খাবারের কথা শুনতেই যেন ক্ষিধেয় মোচড় দিলো পেট। আমি বউমনির দিকে অসহায় মুখে তাকালাম। বউমনি লিয়াকে যেতে বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” সেই বিকেলে রুমে এসে ঘুমিয়েছো। আর একাবারও উঠলেনা। আর কিছু খেলেও না। রাত এখন দেড়টা। অনেক হয়েছে গল্প আর এসাইনমেন্ট। এসো চলো? খেতে চলো।”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই হোহো করে হেসে উঠলো ফাহিম ভাইয়া। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” আমি কি আর সাধে বলেছি তুই গ?ঞ্জি/কা সেবন শুরু করেছিস? মানুষ গা/ঞ্জা খেলেই এমন ম/রা/র মতো ঘুমায় বনু!”

আমি ঠোঁট উল্টে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,

—-” আমার নামে মিথ্যে অপবাদ জাতি মেনে নিবেনা ভাইয়া।”

ভাইয়া হেসে ফেললো। সাথে বউমনি আর রিম্মি আপুও হাসতে লাগলো।

৪২.

টানা ৬দিন বাদে আজ আবারও ভার্সিটির প্রাঙ্গণে নিধির পায়ের ধুলো পড়লো। উফফ! এতোদিন পার হওয়ার পর ফিলিং লাইক “ভার্সিটি টা আমার জন্যই হয়তো অকেজো পড়েছিলো।” আমিও আসলাম আর ভার্সিটিও তার সতেজতা ফিরে পেলো।

ভার্সিটির সামনে বড় বটগাছটাকে কেন্দ্র করেই তার ছায়াতলে বসে আছে অসংখ্য স্টুডেন্ট। তাদের মাঝেই সিনিয়রদের গ্রুপ টা দেখা যাচ্ছে। রাতে হুলস্থুল কান্ডটা হলেও এক দিক থেকে বলা যায় আখেরে লাভ আমারই হয়েছে। এসাইনমেন্ট গুলো কমপ্লিট তো হলো। কথাটা ভেবেই ফাহিম ভাইয়ার মতে লাইক গা/ঞ্জাখোরদের মতো করে একখানা হাসি দিতে ইচ্ছে করলো। হাঁটতে হাঁটতে তাদের দিকেই এগোচ্ছি। মনে মনে একগাদা ঠাঁসা সুখ থাকলেও সমস্যা হলো ওয়েদার। আজ ওয়েদারটা খুব বেশি ঝলসানো। রোদের প্রখরতায় চারপাশের সবুজ ঘাস গুলোও যেন হলুদ হয়ে উঠেছে। বেশিদূর তাকাতে নিলেই চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো দশা হয়ে যায়। তাই কপালে হাত ঠেকিয়েই এমন অমানবিক রোদের থেকে নিজেকে সেফ করছি।

—-” হেই নিধি! হোয়াটসআপ?”

একটু দূর থেকেই আরফান ভাইয়ের উচ্ছ্বাসিত কন্ঠটা পাওয়া গেলো। চোখ তুলে তাকিয়ে জোরপূর্বক একখানা হাসি টেনে মাথা নাড়তে নাড়তে অবশেষে হাজির হলাম তাদের সামনে। আমাকে দেখতেই চোখের মাঝে সূর্য এঁটে তাকালেন অরিন আপু। বুঝি ছোটখাটো একখানা মুখ ভেংচিও কেটেছেন। আমার দশআনা দামের পাত্তা তাকে আর ছোঁড়া হলো না। আমি নিজের মতো করে ব্যাগ থেকে এসাইনমেন্ট গুলো বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিলাম। আরফান ভাই হাসি মুখে সেগুলো হাতে তুলে নিয়ে যার যার হাতে দিয়ে দিলেন। রাহিয়ান ভাইয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে ফোন চেপে চলেছেন! মুডের উনিশ বিশ চলছে নাকি? বাসা থেকে তো ভালো মানুষই বের হয়েছিলেন!

—-” ভাই এটা কি আমার এসাইনমেন্ট? নিধি তুমি আমারটাও নিজ হাতে নিয়ে এলে?”

রূপ ভাইয়ার অসহায় কন্ঠে খানিক ভাবুক হয়ে তাকালাম আমি। যেহেতু এসাইনমেন্ট গুলো করার দায়িত্ব আমারই ছিলো তবে তো তা সহীহ্ সালামিতে নিয়ে আসার দায়িত্বও আমার। পাশ থেকে খোঁচা মে/রে উঠলেন দিপু ভাই।

—-” কেন রে তোর এসাইনমেন্ট কি অন্যকারোর নিয়ে আসার কথা ছিলো নাকি?”

জিয়ান ভাই নাকি সুরে বললেন,

—-” আরে বুঝোছ না বেটা? মনে সুখ চলছে।”

হেসে ফেললেন অনন্যা আপু আর আরফান ভাই। আমি তাদের মশকরার “ম” টাও ঠিক ধরতে পারছিনা। আমার পাশে দাঁড়িয়ে রাই এর দিকে প্রশ্নসূচক মুখ করে তাকাতেই ঠোঁট উল্টালো রাই। অর্থাৎ তাদের ঠাট্টা মশকরা ওর মগজেও ঢুকছেনা ঠিক। আমি জোরপূর্বক হেসে রূপ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,

—-” কেন ভাইয়া? এসাইনমেন্টে কি কোনো প্রবলেম…”

আমাকে থামিয়ে দিয়েই মাঝপথে বলে উঠলেন আরফান ভাই,

—-” আরে না না কোনো প্রবলেম নেই নিধি। ও বেটা এমনেই ফাজলামো করছে।”

আমি সবার মুখ চেয়ে তাকালাম। আসলেই কি এমনি ফাজলামো করলো নাকি ডালমে কুছ কালা ধলা হ্যায়?

—-” নিধি? তোমাদের ক্লাস আই থিংক অনেক্ষন স্টার্ট হয়ে গিয়েছে। জলদি যাও এন্ড ক্লাস জয়েন করো।”

দৃষ্টি সম্পূর্ণ ফোনে রেখেই গম্ভীর স্বরে কথাটা বলে উঠলেন রাহিয়ান ভাইয়া। কেন জানিনা তার গম্ভীর গলা আমার ভেতরটায় ঝড় তুলে দিলো। উনার এই গম্ভীর চেহারার পেছনে এক্স্যাক্ট কারনটা কি সেটা যতক্ষণ জানতে না পারছি ততক্ষণে তো শান্তি পাচ্ছি না!

রাই আমার হাত টেনে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,

—-” হাওয়া তো বেশ গরম মনে হচ্ছে নিধু। চল চল ক্লাসে যাই!”

—-” কিন্তু….”

আমার কথার মাঝেই আহত গলায় বলে উঠলেন রূপ ভাইয়া,

—-” রাই? তুমি চলে যাচ্ছো?”

তার প্রশ্নের ধরনে হাসির বেগ যে আমারও চাপল না তা ঠিক নয়। আমি মুখ টিপে হেসে উঠতেই হু হা করে হেসে উঠলেন সবাই। শুধু গুমোট বাঁধা মুখ করে বসে রইলেন মহাশয়! হয়েছে টা কি কে জানে?

দিপু ভাই ধরাম করে এক কিল বসিয়ে দিলো রূপ ভাইয়ার পিঠে। স্বজোরে কিল খেয়ে পিঠ চ্যাপ্টা করে মুখ কুঁচকে ফেললেন রূপ ভাইয়া। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে
মা/রা/ত্ম/ক টাইপ এক গালি আওড়াচ্ছেন দিপু ভাইয়ের জন্য। আমি আর হাসি চেপে রাখতে না পেরেই ভূমি কাঁপিয়ে হেসে ফেললাম। আমার সেই হাসিতে যোগ হলো বাকি সবাই। হাসতে হাসতে হঠাৎ রাহিয়ান ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তেই খাঁড়ার উপর হাসি থেমে গেলো আমার।

ভ/য়ং/ক/র এক হেঁচকি তুলে রাই-এর হাত ধরে উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম। সত্যিইতো হাওয়া বেশ গরম মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে কিছু পথ এগোতেই রূপ ভাইয়ার ভাঙা গলার গান ভেসে আসল কিঞ্চিৎ।

—-” যেও না সাথিইই… ও সাথি রেএএএ….”

বুঝলাম, রূপ ভাইয়া আমার পাশের এই সুন্দরীর প্রেমে পড়েছে।

#চলবে____________________#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ২২

৪৩.

—-” নাচের প্রোগ্রাম?”

আমার জোরেশোরে করা প্রশ্নটিতে স্যার সহ ক্লাসের বেশির ভাগ স্টুডেন্টেরই দৃষ্টি এসে ঠেকলো আমার ভোলা ভালা চেহারার উপর। আমি থতমত খেয়ে “উপস সরি” বলেই মুখ চেপে ধরলাম। স্যার পড়া থামিয়ে দিলেন। কতক্ষণ তিক্ত চোখে আমাকে দেখে আবারও নড়েচড়ে পড়াতে শুরু করলেন। রাই নিজের মাথা চেপে ধরলো বেঞ্চের উপর। এমন অস্বস্তিকর ঘটনার জন্য মূলত এই বেয়াদবই দায়ী। হঠাৎ নাচের প্রোগ্রাম হতে যাবে কেন ভার্সিটিতে? আমি বাম হাতটা তুলে চটাস করে বারি লাগিয়ে দিলাম রাইয়ের মাথায়। রাই মাথা উঠাতে গিয়েও উঠাতে পারলো না। কেননা না চাইতেও ওর মাথাটা খানিক ঝুঁকে গেলো সামনের দিকে। অবশেষে ভ্রু জুগল কুঁচকে নিয়েই রা/গী চোখে তাকালো আমার দিকে। আমার মুখের ভঙ্গিমা বিরক্ততায় সিক্ত। কেন? বুঝতে পারছিনা। এই অর্ধেক কথা বলা মানুষ গুলো আমার ভীষণ বিরক্তের। আর তারই মাঝে রাই একজন অন্যতম প্রানী।

—-” পুরো কথা বলবি নাকি আরেকটা গাট্টা খাবি?”

রাই ঠোঁট ফুলিয়ে তাকালো। মাথায় হাত ডলে করুন গলায় বলল,

—-” স্যার বার বার তাকাচ্ছিলেন! দেখতে পাচ্ছিস না তুই?”

আমি আঁড়চোখে স্যারের দিকে তাকালাম। আসলেই এমন কিছু ছিলো নাকি?

—-” আর কিছু বলতে নিলেই সোজা ঘাড় ধরে ক্লাসের বাইরে ছুঁড়ে মা/র/তেন!”

—-” অহ এ-কাহিনী তবে! যাক-গে, এখন বল কিসের নাচের প্রোগ্রাম? ভার্সিটিতেও এসব হয় নাকি? জানা ছিলো না তো?”

—-” নাচের প্রোগ্রাম বলতে নবীন বরন অনুষ্ঠান!”

—-” কিইইই…”( উত্তেজনার বসে আবারও চেঁচিয়ে ওঠা আমার নিষ্পাপ গলা)

—-” হেই ইডিয়ট!! বোথ অফ ইউ… স্ট্যান্ডআপ?”

স্যারের বাজখাঁই গলায় আমার অন্তর-আত্মা অব্দি কেঁপে উঠলো। চমকে উঠে রাইয়ের হাত খামচে ধরতেই রাই, “ও-মা গো” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আমার কি দোষ? আমি তো স্রেফ নবীন বরন হওয়ার খুশিতেই চেঁচিয়ে উঠেছি। উনার বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে উনার একমাত্র ছেলের হাতে মদের বোতল দেখে তো চেঁচাইনি! রাই কাঁপতে কাঁপতে আমাকে নিয়েই দাঁড়িয়ে গেলো। আমার দিকে একবার তাকিয়েই মেয়ের কেঁদে দেওয়ার উপক্রম হলো। আমি দাঁত কেলিয়ে একখানা হাসি দিয়ে স্যারের দিকে তাকালাম। চোখে মুখে এঁটে দিলাম সেরা অসহায়ের খেতাব।

—-” সরি স্যার!”

ছোট্ট বলা কথাটাতে স্যারের রাগে আরও ঘী-মসলা পরলো। গলার রগ ফুলিয়ে আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি,

—-” তোমরা দুজনে এক্ষনি বের হয়ে যাবে ক্লাসরুম থেকে। গেট আউট.. গেট আউউউট!”

আমি আবারও আঁতকে উঠলাম। সকাল বেলা এই লোক ঠিকই কচু ভর্তা দিয়ে গোল্লা গোল্লা ভাত খেয়ে এসেছে। অকারনেই ভীষণ চটছে। সামান্য কথাই তো বলেছি মশাই তাতে এতো চটে যাওয়ার কি হলো? হুহ্। আমি পাশ থেকে রাইকে খোঁচা মে/রে বের হয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করলাম। স্কুল কলেজের টিচাররা হলে কতক্ষণ ঘ্যানোর ঘ্যানোর ঘ্যান করে আবারও ঠিক বসিয়ে দিতেন কিন্তু এরা কিছুতেই তা করবেননা। তাই কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বের হয়ে যাইয়াই উচিৎ কার্য।

ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছি। চারিপাশ একদম বেকায়দায় ফাঁকা। কেননা সব রুমেই ক্লাস চলছে। এই মুহুর্তে এ-পথ ধরে একা না যাওয়াটাই বেটার। যদিও আমার সাথে রাই আছে। মেয়েটা গুম
মে/রে আছে। কথা বলছেনা! স্যারের ধমক খেয়ে কোমায় চলে যায়নি তো আবার?

—-” কি-রে?? বাঁইচা আছিস না কোমায় ট্রান্সফার হয়েছিস?”

চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো রাই। নাহ্ সত্যি রে/গে আছে!

—-” স্যারের ধমক খেয়ে এখনও শকে আছিস?”

—-” তুই ওমন করে চেঁচালি কেন বলতো?”

—-” কেমন করে?”

—-” কেমন করে কি! ওমন করে! স্যার কি ভাবলো আমাদের বলতো? আর ক্লাসের প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট আমাদের কীভাবে দেখছিলো! দেখেছিস তুই?”

—-” রিলাক্স ইয়ার। স্যারের ক্লাসে আমার নিজেকে স্রেফ মগা মগা বলে ফিল হচ্ছিলো! প্রচুর বোরড হচ্ছিলাম তাই তো তোকে কাজে লাগিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসলাম!”

—-” হোয়াট! তাই বলে এভাবে?”

—-” এভাবে আর কি? ভাল্লাগছিলো না ব্যস বেরিয়ে এসেছি এই তো! এসে গেছি… চল আজ জমিয়ে উপন্যাসের বই পড়বো। দেখবো কে ক’টা শেষ করতে পারে!”

—-” আমার এখন মুড নেই!”

—-” চড়িয়ে তোমার মুড করে দিবো বেদ্দপ! আয় বলছি।”

রাইয়ের অনিচ্ছা স্বত্বেও ওকে মোটকথা টেনেটুনে নিয়ে এলাম ভেতরে। ভেতরে আসতে আমি মোটামুটি ধরনের চমকালাম। বাইরে থেকে ভেতরকার অবস্থা ভূতুড়ে পরিবেশের মতো সুনসান লাগলেও ভেতরে তো পুরো উল্টো কাহিনী। লাইব্রেরীর এপাশ থেকে ওপাশ অব্দি ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে একদম গিজগিজ করছে। এই সময় এতো স্টুডেন্ট থাকে? জানা ছিলো না তো!

বড় বুক সেল্ফটার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা দাঁতভাঙা উপন্যাস পড়বো কি-না ভাবছি! মাঝেমধ্যে এমন দাঁতভাঙা উপন্যাস পড়তেও বেশ মজাই আছে।

রাই হাতের ভাজে শরৎচন্দ্রের একটা উপন্যাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—-” তুই কোনটা পড়ছিস?”

আমি বইয়ের মাঝে হাত চালাতে চালাতে বললাম,

—-” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইন্টারেস্টিং টাইপ কোনো বইয়ের নাম জানিস তুই?”

রাই উগ্র কন্ঠে বলল,

—-” এতো এতো কবি, লেখক রেখে উনার ওমন শক্ত লেখার প্রতি তোর এতো আগ্রহ জন্মালো কেন?”

আমি বিরস মুখে তাকালাম বটে। তবে জবাব দিলাম না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একখানা জব্বর ধাঁচের বই পেতেই একটা ফাঁকা জায়গায় এসে বসলাম। বইয়ের পাতা চটপট উল্টানোর মাঝে রাইও এসে বসল। ব্যস, এখন দিন দুনিয়ার সব খেয়াল রেখে কেবল বইয়েই মগ্ন হয়ে পড়বো। রেডি 1,2,থি…… মনোযোগে বিগ্ন ঘটিয়েই পার্সের মধ্যে ফোনটা করুন সুরে চাপা আর্তনাদ করতে লাগলো। রাই আঁড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

—-” কি হলো?”

আমি তিক্ত সুরে জবাব দিলাম,

—-” ফোনটার ক্ষিধে পেয়েছে! তাই কাঁদছে!”

রাই মুখ টিপে হেসে বলল,

—-” দেখ তোর বরের কল হয়তো?”

—-” হ্যাঁ, আমার জন্মগত বর!”

রাই আবারও হাসলো। শব্দ বিহীন হাসি! ফোনটা বের করতে করতে কল কেটে যাওয়ার লাস্ট স্টেজ এসে গেছে। তাই তাড়াহুড়োর উপর নাম্বারে চোখ রাখা হলো না। এটা লাইব্রেরী! এখানে একজনের গলার আওয়াজ অন্যজনের কানে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই গলার স্বর চেপেই বলে উঠলাম,

—-” হ্যালো, কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসলো জবাব,

—-” এক আজনাবি, হাছিনা ছে~~
ইউ মুলাকাত হো-গায়ি।
ফির কেয়া হুয়া, ইয়ে না পুছো~~
কুছ এছি বাত, হো গায়ি।

আমি থতমত খেয়ে গেলাম গানের লাইন শুনে। অপরিচিতর গলা!

—-” আপনি!”(ফিসফিসিয়ে)

—-” হ্যাঁ আমি।”

উনি আমার থেকেও আরো ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন। আমি দাঁত চিবিয়ে বললাম,

—-” আপনি কেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছেন?”

উনিও আমার সহিত বলে উঠলেন,

—-” তুমি কেন এভাবে কথা বলছো?”

—-” আমি বলছি কারন আমার ইচ্ছে!”

—-” ওহ, তবে ধরে নাও এটা আমারও ইচ্ছে!”

আমি গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,

—-” কেন কল করেছেন?”

—-” ঐ যে আমার ইচ্ছে।”

আমি শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,

—-” তাই বুঝি? তাহলে আমিও কলটা কেটে দিয়ে আপনাকে ব্লক করে দিচ্ছি!”

উনি কেশে উঠে বললেন,

—-” আরে আরে তা কেন?”

—-” ঐ-যে আমার ইচ্ছে!”

—-” নো নো নো এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয় নীলু! তুমি এমন অমানবিক কাজ কিছুতেই করতে পারো না।”

—-” ওয়েট আ মিনিট! হু ইজ নীলু?”

হেসে উঠলো লোকটা। চাপা হাসি দিয়ে বলল,

—-” আই মিন নীলাদ্রিতা!”

—-” হোয়াট!”(চেঁচিয়ে)

রাই আমার হাত চেপে ধরলো। করুন চাহনি দিয়ে বলল,

—-” কি করছিস? চেঁচাচ্ছিস কেন? এখন কি এখান থেকেও বের হয়ে যেতে চাস??”

আমি চুপসে গেলাম রাইয়ের কথায়। কারন এখান থেকে তো আমরা বের হতে চাই না! সব দোষ এই অভদ্র লোকের। আমি গলার স্বর আবারও চেপে বললাম,

—-” হাউ ডেয়ার ইউ? আপনি আমাকে নীলু বলেন কোন সাহসে?”

—-” কেন? নীলাদ্রিতা কে শর্ট করে নীলু বলা টা কি অন্যায়?”

—-” অন্যায় মানে? এতো রীতিমতো ঘোর অন্যায়। মহাপাপ!”

—-” বাট নীলাদ্রিতা, আমার যে তোমার এতবড় নাম নিতে নিঃশ্বাস ভরে আসে!”

আমি রাগে ফুঁসে উঠে বললাম,

—-” নিঃশ্বাস ভরে আসলে নিঃশ্বাস আঁটকে ম/রে যান! তবুও আমার নাম শর্ট করে ডাকবেন না! বুঝেছেন?”

—-” বাট নীলু…”

আমি আরও ক্ষে/পে গেলাম! দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফাস গলায় বললাম,

—-” আপনাকে কিন্তু আমি জাতাঁকলে পি/ষে মে/রে ফেলবো বলে দিলাম! ডোন্ট কল মি নীলু!”

উনি মাতাল সুরে হেসে উঠলেন। কোমল কন্ঠে বললেন,

—-” এই নীলু… সরি সরি! নীলাদ্রিতা, তুমি জানো এই মুহুর্তে আমার কিরকম ফিল হচ্ছে?”

—-” আমার জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই! বেশি ফিল হলে বুড়িগঙ্গার পানি খেয়ে ম/রে যান আপনি!”

—-” বাট নীলু আমার যে বলতে ইচ্ছে করছে!”

—-” আবার নীলু!”

—-” তুমি যতক্ষণ আমার কথা না শুনবে ততক্ষণ আমি নীলুই বলবো হু!”

—-” ভারি ডিজগাস্টিং লোক তো আপনি!”

—-” এভাবে বলছো!”

—-” আচ্ছা বলুন আপনার বুড়িগঙ্গার পঁচা পানি খাওয়ার ফিলিংস!”

—-” হোয়াট?”

—-” বলবেন কি বলবেন না?আমি তবে কল কেটে… ”

—-” এই না না বলছি!”

—-” হু,ফাস্ট…”

—-” এতো তাড়া দিচ্ছো কেন বলোতো?”

—-” ভাগ্যিস ফোনটা আমার খুব সাধের। তাই এখনো ছুড়ে মা/র/ছি/না! অন্যথা…”

—-” নীলু, আর ইউ এংরি উইথ মি?”

—-” বেটা তরে তো আমি…”

—-” নিধি তোমরা এখানে? ক্লাস শেষ?”

কয়েক কদম দূর থেকেই ভেসে আসলো আরফান ভাইয়ের কন্ঠ। আমি ফেনটা কান থেকে নামাতে ভাইয়া ধীরগতিতে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। আমি কলের দিকে আর না তাকিয়েই লাইনটা কেটে দিলাম।

রাই হাসি মুখে জবাব দিলো,

—-” জ্বী ভাইয়া। ক্লাসে একটু বোরিং লাগছিলো তাই…”

—-” তা বেশ ভালোই করেছো? উপন্যাস পড়ছো?”

আমি মাথা দুললাম। মুখে হাসির রেখা টেনে বললাম,

—-” হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!”

আরফান ভাই অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

—-” আরে ইয়ার! সব বই রেখে অবশেষে উনি?”

রাই হাসতে হাসতে বলল,

—-” ইউনিক লোক ইউনিকই চুজ করে ভাইয়া!”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম রাইয়ের দিকে। দাঁত চিবিয়ে বললাম,

—-” অপমান করছিস?”

আরফান ভাই ফিক করে হেসে দিলেন। সাথে রাইও যোগ দিলো। হাসতে হাসতেই বলতে লাগলেন আরফান ভাই,

—-” না না নিধি! রাই কিন্তু ভুল কিছু বলেনি। তোমার মাঝে সত্যি সবটাই ইউনিক। আর তুমি সত্যিই মা/রা/ত্ম/ক লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট।”

অপমান করছে না সুনাম করছে ব্যাপারটা ক্যাচ করতে সত্যিই ঘাম ছুটছে আমার। আমি জোরপূর্বক দাঁত কেলালাম। মাথা চুলকে বললাম,

—-” হঠাৎ আপনার এমন কথা কেন মনে হলো ভাইয়া?”

আরফান ভাই আবারও অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

—-” আরে কি বলছো তুমি? যেখানে এজ আ সিনিয়র স্টুডেন্ট যারা নিজেরাই নিজেদের এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন করতে হিমশিম খেয়ে যায় সেখানে তুমি কতটা ইজিলি সবটা করে ফেললে। যদিও কয়েকদিন সময় লেগেছে তবে সময়টা কিন্তু তোমার অন্য কাজে ব্যয় হয়েছে নট ফর এসাইনমেন্ট। এম আই রাইট?”

আমার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। কি থেকে যে কি হলো আমি নিজেই তো ঠিক করে বুঝতে পারিনি!

—-” হেহে হ্যাঁ হ্যাঁ!”

রাই আমার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—-” আসলেই?”

আরফান ভাই বললেন,

—-” আম ইমপ্রেসড নিধি!”

—-” থ্যাংক্যু ভাইয়া।”

—-” ফর এসাইনমেন্ট আমি তোমাকে ছোট্ট একটা ট্রিট দিতে চাই নিধি! তুমি কি আসবে আমার সাথে?”

আমি উনার কথায় হোঁচট খেলাম। এবার মনে হচ্ছে একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।

—-” আর তাছাড়া তোমার কিন্তু কথা ছিলো আমাকে রেঁধে খাওয়ানোর? মনে আছে তো?”

আরফান ভাই আবারও বলে উঠলেন। আমি রাইয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই রাই বলে উঠলো,

—-” আপনি তো ভারি সেলফিশ মানুষ ভাইয়া। আমার সামনে থেকে আমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রিট দিচ্ছেন, অথচ আমায় একবারও বলছেন না?”

আরফান ভাই ছোট্ট করে হাসলেন। লজ্জিত কন্ঠে বললেন,

—-” ভেরি সরি রাই। চলো তোমার ফ্রেন্ডের সাথে আজ তোমাকেও ট্রিট দিবো।”

এই হলো বেস্ট ফ্রেন্ড। যেখানে উদ্ধার করতে গিয়ে বাঁশ-ই বেশি দিতে প্রস্তুত। কোথায় ভাবলাম মগারাম এই যাওয়া থেকে আমায় কোনো মতে আঁটকে দিবে তা-না উল্টো আরও ফাঁসিয়ে দিলো। এই কান্ড যদি রাহিয়ান ভাইয়া কোনো মতেও জানতে পারে তো জানিনা ঠিক কি কি হবে! সেদিন গার্ডেনে উনার সাথে কথা বলার সময় মনে নেই কিভাবে টানতে টানতে আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন? আর তারপর!! উফফ! আর ভাবা যাচ্ছে না! কি করে আঁটকাই এই বিপদ?

—-” বলছিলাম কি ভাইয়া…”

—-” তুই আর কোনো কথা বলিস না! চলতো চল?”

কথার মাঝখানে বা-হাত ঢুকিয়ে দিয়েই কথা থামিয়ে দিলো রাই। আরফান ভাইও আমোদিত গলায় বলে উঠলো,

—” ‘Popular Foods’ এ যাবে? বেশ নাম করা এবং খুব ভালো সার্ভিস দেয় ওরা!”

রাই আমোদে লাফিয়ে উঠে বলল,

—-” হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন!”

৪৪.

রেস্টুরেন্টের থাই ঠেলে ভেতরে পা রাখার আগেই শূন্যে ভেসে উঠলাম আমি। ভয়ে থরথরিয়ে কেঁপে উঠতেই আবারও পায়ের নীচে যেন জমিন খুঁজে পেলাম! ভ/য়/টা আরও কিছুটা জাঁতা দিয়ে ধরলো। ভ/য়ে/র দরুন বন্ধ করা চোখ দুটো পিটপিট করে খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলাম। না, আমার সামনে তো কোনো ভূত নয়! তবে ভূতের চেয়েও কম নয়! স্বয়ং রাহিয়ান রাফিদ। ঠিকই মাঠে গোল দেওয়ার পূর্বে হাজির হয়ে গেলেন। কি টাইমিং ইয়ার! এই পা রাখতে যাচ্ছিলাম আর উনি এই এসে হাজিরও হয়ে গেলেন। পেছন থেকে আরফান ভাইয়ার কিছুটা ভ/য়মিশ্রিত আওয়াজ পাওয়া গেলো,

—-” দোস্ত? তুই না বাসায় ফিরে গেলি?”

রাহিয়ান ভাইয়ার কোনো জবাব নেই। উনি লাল চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আর আমার অসহায় হাতটা তার হাতের ভাজে বন্ধি! চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

রাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে রাহিয়ান ভাইয়ার উদ্দেশ্য আমতাআমতা করে বলল,

—-” রাফিদ ভাইয়া, আপনিও আমাদের সাথে জয়েন করুন না? আমাদের খুব ভালো লাগবে! আরফান ভাই বলুন না আপনি?”

আরফান ভাই গলা খাঁকারি দিলেন। বার কয়েক ঢোকও গিললেন। অতঃপর আমতাআমতা করে বললেন,

—-” হ্যাঁ রে রাফিদ। তুইও জয়েন কর আমাদের সাথে।”

—-” আমি বা নিধি কেউই তোদের সাথে জয়েন করছিনা আবির।”

গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন রাহিয়ান ভাইয়া। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে উঠলো৷ মস্তিষ্ক শীতল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই।

—-” বাড়িতে কেউ নেই। আমাদের সবাইকে রিম্মির শশুর-শাশুড়ী ইনভাইট করেছেন তাদের বাড়িতে। তাই সবাই আগে মেঝ-মনির বাড়িতে গিয়েছে। ওখান থেকেই রেডি হয়ে সেখানে সবাই একসাথে যাবো। আমাদেরও তাই মেঝ-মনির বাড়িতে যেতে বলেছে মা। কারন বাকিরা আমাদের জন্য ওখানেই ওয়েট করবে। বেশি লেট যেন না হয় তাও বলে দিয়েছে। তাই নিধি আর আমি সেখানেই যাচ্ছি। তোরা ইনজয় কর। পারলে রূপ আর বাকি সবাইকেও ডেকে নিস।”

একটুকু বলেই আমার হাত ধরে হাঁটা ধরলেন রাহিয়ান ভাইয়া। আমার মনের মধ্যে কাল বৈশাখী ঝড় উঠেছে। না জানি সামনে কি শনি নাচছে আমার ফুটা কপালে।

#চলবে_______________

[ লাইক, কমেন্ট দিনদিন কমেই যাচ্ছে ভাই🥺 বুঝলাম না কিছুই! ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here