#ফাল্গুনের_ঢেউ
পর্ব – ৬ #এক_বষর্ণময়_মূহূর্তে
লেখিকা – Zaira Insaan
তর্জনী দিয়ে কপাল ঘেষলো সে তারপর বিরক্ত হয়ে বলল,,
“আসো আমার সাথে।”
বলে মিহি কে নিয়ে গাড়িতে বসলো স্নিগ্ধ। মিহি ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকায় আছে। সময় নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছলো তারা। গাড়ির থেকে বের হওয়ার নির্দেশ প্রদান করলো স্নিগ্ধ। মিহি দরজা খুলতে যাবে এমন সময় মেঘ জোরে গর্জন করে উঠলো। আলোর বেশ ঝলকানি পরলো রাস্তার বা পাশে। ঠুস করে বেশ জোরে শব্দ ফুটলো কোথাও। হয়ত কোন রাস্তার তার ছিঁড়ে গেছে। মিহি জোরে চিৎকার মেরে দরজা বন্ধ করে দিল। স্নিগ্ধ অতটাও ভয় পায়নি যতটা ভয় মিহির চিৎকার শুনে পেয়েছে। চোখে মুখ দুহাত দিয়ে ঢেকে ঝুঁকে রইলো মিহি। স্নিগ্ধ দেখলো সে কাঁপছে। ভয়ের কাঁপুনি ধরছে তাকে। শান্ত হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। মেঘ আর গর্জে উঠলো না মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে শান্ত ভাবে। স্নিগ্ধ নরম স্বরে বলল,,
“এবার নামতে পারবা।”
চোখে তুলে একনজর দেখে নিল তাকে। পরে একটা শুকনো ঢোক গিলে আস্তে করে দরজা খুলল। আকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে দৌড় মেরে স্নিগ্ধের পিছু ধরলো। ছোট এক উঠান পেরিয়ে ঘরে ঢুকলো তারা। মিহি ভালোভাবে খেয়াল করলো সবকিছু। পুরোনো আমলের ঘরের মত। ঝোঁপঝাড় উঠান। ঘরে সাদামাটা রং করা। মিহি কৌতুহলী জিজ্ঞেস করলো,,
“ঘরটা এমন কেন? এখানে কে থাকে?”
স্নিগ্ধ লাইট জ্বলছে কিনা দেখলো। না কোন লাইট জ্বলছে না! বুঝলো ঠাডা পড়ার কারণে সবখান থেকে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বিরক্ত সূচক শব্দ বের করলো সে। মিহি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এই ঘর। টিনের চালের উপর ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মিহি তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বলল,,
“স্যার বলেন না, এখানে কে থাকে?”
তার এমন কৌতুহল দেখে বলল,,
“আমার মা ও বোন।”
মিহি অবাক হলো প্রচুর বলল,,
“এখানে? কেমনে!?”
স্নিগ্ধ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,,
“আমার বাবা মা’র জন্য শখের বশে এমন ঘর বানিয়েছে। বেশ সাদামাটা প্রকৃতি আমার মা। এতো করে বলছিলাম এখানে না থাকার জন্য তাও শুনে না।”
এতটুকু বলে মুখমণ্ডল কেমন যেন হয়ে গেল স্নিগ্ধের। মিহি শান্ত চোখে তাকালো তারপর ওহ্ বলে সুর টানলো। ভালোভাবে লক্ষ্য করল ঘরটি বেশ পুরোনো হয়ত ১৫/২০ এর মত হচ্ছে বা তার চেয়েও বেশি। কিন্তু ঘরটি রং ছাড়াও ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে না।
পুরো ঘরে ৪টি রুম রান্নাঘর সহ। মিহি বলল,,
“ওরা কোথায় এখন?”
“আমার ঘরে।”
“আচ্ছা।”
বাহির থেকে বৃষ্টি হাওয়ায় ঘরে ঢুকছে। বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে গেল পুরো ঘর। স্নিগ্ধ সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলে দরজা লাগিয়ে দিল। একেবারে সবকিছু অস্পষ্ট অন্ধকার হয়ে গেল। একফুটো আলোর ছিটেফোঁটা নেই। স্নিগ্ধ সাবধানে আস্তে ধীরে গিয়ে রান্নাঘর থেকে হারিকেন বাতি জ্বালিয়ে আনলো। মিহি চমকে ভ্রু উঁচু করলো। হারিকেন এনে উপরে ঝুঁলে দিল। সেখান থেকে সোনালী রঙের মৃদু আলো আসছে। মিহি হারিকেনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফিরতে গিয়ে স্নিগ্ধের চোখ পড়লো তার অধর যুগলে। কাঁপছে সেই ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে গেল কিঞ্চিৎ পরিমাণ। স্নিগ্ধ দ্রু দৃষ্টি সরিয়ে নেয় তারপর একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বলল,,
“ওই রুমে কাপড় রাখা আছে ওখানে গিয়ে চেঞ্জ করে আসো।”
পিলে চমকালো মিহি। কেমন যেন ইতস্তত বোধ করতে লাগল ও। কিন্তু পরিবর্তন করতে হবে এই ভেজা পোশাক নাহয় ঠান্ডা লেগে যাবে। বাধ্য মেয়ের মত গুটিসুটি মেরে গেল ওই রুমে। রুমে এসে আলমারি খুলল মিহি সেখানে অনেক কাপড় ফোল্ড করে রাখা। একটি বেগুনী ও সাদা রঙ মিক্স করা থ্রি-পিস নিল।
রুম থেকে বেরিয়ে এসে সামনে তাকালো স্নিগ্ধও নিজের পোশাক চেঞ্জ করে নিয়েছে। আড়চোখে তাকালো স্নিগ্ধ তারপর সামনে এক চেয়ার টেনে তাকে বসতে ইঙ্গিত করলো। মিহি বসলো তার মুখোমুখি হয়ে। সোনালী ও লাল রঙ মিশ্রিত এক ধরনের আলো সৃষ্টি হলো যা মিহির মুখে পড়ছে। হারিকেন স্নিগ্ধের ঠিক পেছনে বেশ দূরেই ঝুঁলে আছে। স্নিগ্ধ গম্ভীর মুখে বলল,,
“তুমি পুরো কথা তোমার বাবাকে না বলে ঘর থেকে কেন বেরিয়েছো?”
“আমার কোন কথা শুনতে চাচ্ছেন না তিনি।”
“তুমি বলছো?”
কিছুটা ঝুঁকে প্রশ্ন করল স্নিগ্ধ। মিহি কিছুটা পিছিয়ে যেতেই আবারো আগের মত বসলো সে। মিহি এখনো কাঁপছে হাতের আঙুল গুলোও কাঁপছে খেয়াল করলো স্নিগ্ধ। হাত বাড়িয়ে ললাট স্পর্শ করলো চমকে মিহি বসা অবস্থায় চেয়ার পিছনে ঠেলে দূরে সরে গেল। চোখ গোল গোল হয়ে গেল। থতমত খেয়ে গেল স্নিগ্ধ বলল,,
“তোমার জ্বর আসছে।”
একনজর তাকিয়ে চোখ সরালো সে। স্নিগ্ধ উঠে দাঁড়ায় অতঃপর গিয়ে রুম থেকে এক ছোট চাদরখানা নিয়ে আসলো। মিহির গায়ে তা জড়িয়ে দিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,,
“আপাতত এটায় গায়ে জড়িয়ে রাখো। আমি কিছু করতে পারি কিনা দেখি।”
স্নিগ্ধ আবারো যেতে নিলে মিহি দ্রুত বলে,,
“লাগবে না আমার স্যার, আপনি প্লিজ বসুন।”
কপাল কুঁচকে তাকালো ও। মিহি আবারো বলল,,
“প্লিজ বসুন স্যার।”
স্নিগ্ধ তার কথা তোয়াক্কা না করে রান্নাঘরে যেতে নিলে এবার মিহি তার হাতের মাঝখানের আঙুল টা ধরে নিল বলল,,
“স্যার আপনি আমার জন্য অনেক করছেন যার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, এবার প্লিজ বসুন আর কোন কিছু করা লাগবে না।”
আঙুল ছাড়িয়ে নিল তারপর কঠিন গলায় বলল,,
“বেশি কথা বলবা না, বসো চুপচাপ এক কিঞ্চিৎ পরিমাণও যেন নড়তে না দেখি।”
ধমক দিয়ে সোজা চলে গেল সে। চুপসে গেল মিহি।
কিছুক্ষণ বাদে ফিরে আসলো স্নিগ্ধ হাতে এক গ্লাস ভর্তি সবুজ রঙের কিছু। তার দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,,
“কোন কথা না বলে খেয়ে নাও।”
মিহি নিল এক চুমুক দিতেই মুখ এক ধরনের হয়ে গেল। আড়চোখে তাকালো স্নিগ্ধের দিকে সে কড়া নজরে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ভয়ে এক নিঃশ্বাসে মধ্যেই খেয়ে নিল। গ্লাসটা ওর হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রাখলো স্নিগ্ধ। বসে বলল,,
“আমার জ্বর আসলে মা এটা বানিয়ে খাওয়াতো যেন জ্বর তাড়াতাড়ি সেড়ে যায়।”
ঠোঁট ভিজিয়ে পেছন থেকে ভালোভাবে গায়ের সাথে লেপ্টে নিল চাদর। নিরবতা কেটে স্নিগ্ধ বলল,,
“ঘরে গিয়ে সবার সাথে ভালোভাবে ক্লিয়ার করে নাও। স্পেশালী তোমার বাবার সাথে নাহলে পরে পরিস্থিতি বেশ বাজেভাবে বিগড়ে যেতে পারে মিহি।”
“আমার কোন কথাই শুনতে নারাজ বাবা।”
“শুনতে না চাইলেও জোর করে শোনাবা। মান সম্মান ডুবিয়েছে, মান সম্মান ডুবিয়েছে বলে বলে তোমাকে দূরে ঠেলে দিলে তো হবে না।”
উপুর চোখে একবার তাকালো নির্বাক হয়ে। সে আরো বলল,,
“তনুর ভাই এসব জানে?”
“এটার চিন্তা না করলেও চলে কেননা তনুর ভাই এখানে থাকে না সিলেটে থাকে।”
“এসব পুরো ঝয় ঝামেলায় তোমার দোষ।”
অবাক হলো মিহি। তাকে অবাক হতে দেখে বলল,,
“হুম, বিয়ের আসরে সময় না পালিয়ে সেখানে সুন্দর করে মিটমাট করতে পারতে।”
মিহি হয়রানি সুরে বলল,,
“বর দেখেই আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম স্যার।”
ফিক করে শব্দ তুলে হেঁসে দিল স্নিগ্ধ। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মিহি দুতিনবার পলক ফেলল সে। স্নিগ্ধ হাসি থামালো, মিহি কিছুটা রুঢ় হয়ে বলল,,
“হাসছেন কেন?”
স্নিগ্ধ পুরোপুরি হাসি থামালো। বলে,,
“মেয়েরা প্রমিকের টানে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসে আর তুমি বর দেখে পালিয়ে আসছো।”
কথাটি টিটকারি মেরে বলল স্নিগ্ধ। যা শুনে একেবারে চুপসে গেল মিহি। স্নিগ্ধ পুরোপুরি হাসি থামালো। বলল,,
“ওসব বাদ দাও, তুমি কালকেই বাড়ি গিয়ে তোমার বাবার সাথে কথা বলে সব ঠিক করবা, ওকে?”
থমথমে মুখ করে ফেলল মিহি। বিড়বিড় করলো কিছু। স্নিগ্ধ তা দেখে বলল,,
“কি?”
কিছু না বলে মাথা দুলালো মিহি। বেশ ঘাবড়ে আছে সে। না জানে কি হয় কাল তার সাথে!স্নিগ্ধ উঠে দাঁড়ায় তারপর রান্নাঘর চলে যায়। মিহি হাতের তালু ঘষছে। বড্ড শীত করছে তার। স্নিগ্ধ এসে তার সামনে চায়ের কাপ তুলে ধরলো। মিহি চমকে তাকায়। স্নিগ্ধ বসতে বসতে স্বাভাবিক গলায় বলল,,
“শীতল পরিবেশে চা খাওয়ার মজাই আলাদা।”
মুচকি হেসে বলে এগিয়ে দিল সেই কাপ। মিহি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তা হাতে নিল। দুই হাতের মুঠোয় জুড়ালো। কাপে চোখ পড়তেই অবাকের সীমা ছাড়িয়ে গেল। স্নিগ্ধ তাকে দুধ চা না দিয়ে রং চা দিল। মিহি ফট করে তাকালো ওর দিকে। স্নিগ্ধ মিটমিট করে হেঁসে মজা নিয়ে চা খাচ্ছে তাও তার দিকে তাকিয়ে। মিহি ঘাড় উঁচু করে ওর কাপের দিকে নজর দিল। ওর কাপে দুধ চা আর নিজের কাপে রং চা! ফ্যাকাশে হয়ে মুখ। বলল,,
“স্যার এটা তো ঠিক না।”
“অসুখ যেহেতু বাড়িয়েছো সেহেতু তোমাকে সুস্থ করার দায়িত্ব আমার।”
হেঁসে বলল স্নিগ্ধ। অবাক হলো মিহি কথাটি কেমন যেন তার ভালো লেগেছে। কিন্তু বিরক্ত নিয়ে কাপে একের পর এক চুমুক দিতে লাগল ও। বিভিন্ন কথাই মশগুল হয়ে পড়লো ওরা। রাত যেন থেমে থেমে চলছে দীর্ঘ সময় নিয়ে। দুজনের মুখে তৃপ্তির হাসি। দুজনের কথাপকথন এমন যেন বহু বছরের কথা একে একে শেষ করছে।
কথার শেষ সীমায় মিহির ঘুম ধরে বসলো। চোখ দুটো ভারী হয়ে আসলো। মাথা এক পাশ হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সে। স্নিগ্ধ খেয়াল করলো সে এগিয়ে এসে আস্তে করে ওর হাত থেকে কাপ টা নিয়ে নিল। টেবিলে রেখে তার চাদরখানা টেনে দিল। তারপর নিজ স্থানে বসে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল স্নিগ্ধ।
(চলবে…)
[ রিচেক দেওয়া হয়নি ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ]
ছবিরিয়াল- ইন্সট্রাগ্ৰাম