ফিলোফোবিয়া পর্ব -০৩

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)

৩.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

জানুয়ারির প্রথম থেকেই শীতের প্রকো*প চলছে প্রচণ্ড। বছরের প্রথমদিন ক্লাস শুরু হলেও, পুরো পাঁচদিন পর স্কুলে উপস্থিত হলো প্রিয়। রোজ তার স্কুলে না যাওয়ার নতুন নতুন বাহানায়, খালা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল প্রায়। তার কোন বাহানায় কাজ হয়নি আজ। খালা ধরে বেঁ*ধে স্কুলে এনেছে একপ্রকার। স্কুল মাঠের দিকে তাকাতে চোখ জুড়িয়ে গেল প্রিয়’র। কি বিশাল মাঠ! মাঠের চারপাশে বড় মোটা মোটা গাছ। চারকোনায় চারটি ধবধবে দোতলা ভবন। সোনালী রোদের উপচে আসা আলোতে উজ্জ্বল রঙটা চকচক করছে আরো। একরাশ মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল মন। ঢাকায় এমন বড় সুন্দর মাঠ সচরাচর দেখা যায়না। সেখানকার মাঠগুলো শুরু হতেই শেষ! স্কুল দেখে পছন্দ হয়েছে প্রি’র। চারিপাশে সকল অচেনা মানুষ। আশপাশে ছোটবড় কত ছেলে মেয়ে। কিন্তু কাউকে চিনেনা সে।
খালার পাশে যেয়ে দাঁড়াল। এই স্কুলের কলেজ শাখায় খালা শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত। সেই সুবাদে প্রায় সকলেই পরিচিত। খালা প্রধান শিক্ষকের অফিস থেকে বেরিয়ে একজন দপ্তরি ডেকে বলল,
‘ নিউ এডমিশন। নবম শ্রেণির ক্লাসটা দেখিয়ে দেও।’
লোকটা বোকাসোকা মুখ করে মাথা নাড়াল। খালা প্রিয়’র উদ্দেশ্যে বলল,
‘ ছুটির পর অপেক্ষা করতে হবেনা। টিউশন আছে আমার। রিকশা ধরে বাড়ি চলে যাবি সোজা।’
বাধ্য মেয়েদের মত মাথা ঝাকালো প্রিয়।
‘চিনবি তো?’
‘ হ্যাঁ চিনবো।’

দপ্তরির পিছন পিছন ক্লাসে গেল প্রিয়। ক্লাসে পা রাখতেই অদ্ভুত ভী*তিতে বিষিয়ে এলো মন। ছোট ছোট পা ফেলে ভিতরে ডুকল। কাচুমাচু হয়ে এক খালি বেঞ্চে বসল। আড়চোখে চারিপাশে তাকালো। কিছু মেয়ে তাকে দেখে ফিসফিস করছে। কখনো আবার কি*টকিটে হাসছে। ভীষণ অ*স্বস্তি লাগছে প্রিয়’র। ক্লাসে এসেছে দশ মিনিট হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা হুড়মুড় করে ঢুকছে। তার বেঞ্চ ডিঙ্গিয়ে পিছনে যাচ্ছে তবুও তার পাশে বসছে না কেউ। পেছন থেকে এক মেয়ের ব্যঙ্গ আওয়াজ কানে এলো হ্ঠাৎ,
‘ দেখ, দেখ ক্লাসে শহুরে ম্যাডাম এসেছে। কাপড়ের ছিড়িটা একবার দেখ! সিনেমার নায়িকা সেজেছে।’
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো প্রিয়’র। নিজের দিক একবার ভালো করে চাইল। তাকে দেখতে খুব বেশি উদ্ভট লাগছে কি? লাগার তো কথা নয়। কি এমন পড়েছে সে? শর্ট কুর্তি আর সিম্পল ব্লাক জিন্স। সাথে লম্বা স্কার্ফও আছে। ঢাকায় সবসময় এভাবেই তো বের হতো।
আশেপাশে মেয়েদের দিকে চাইল একবার। পুরাতন ছাত্রীরা স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে এসেছে আর নতুনেরা সেলোয়ার কামিজ পড়ে মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা মোড়ানো। পেছন থেকে আবার একজন বলল,
‘ আস্তে বল, শুনেছি ম্যাডামের আত্মীয়। ঢাকা থেকে এসেছে।’
‘ কোন ম্যাডাম?’
‘ কলেজের আয়শা ম্যাডাম আছে না? উনার। জানলে হেড স্যারের কাছে না*লিশ করবে।’
‘ ওইতো ক্ষমতার জোর। পোশাকেই বুঝা যায় চরিত্রের কি হাল।’
রা*গে তে*তে উঠল প্রিয়। পিছন ফিরে কিছু বলবে তার আগেই কারো প্রতি*বাদী আওয়াজ কানে এলো,
‘ বেশি বাড় বাড়িস না নিলু। তোর চরিত্র যেমন খুব ভালো? তুই যে বারো*ভাতারি গ্রামের সবাই জানি। ইটের সারির পেছন রিপুইন্নার লগে কি খেল চলে তোমার সেই কথা আমাদের সবার জানা।’
‘ তুই কি দুধে ধোঁয়া তুলসীপাতা! চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে তোর প্রেম চলছে তা কি সবার অজানা?’
‘ প্রেম করি তোর মত চিপায় চাপায় যাইয়া ন*ষ্টামি করি না?’
প্রিয় হা করে মেয়েদের কথা শুনছে। তাদের ভাষার কি ছিড়ি। এই বয়সেই প্রেম? এতো ফাস্ট! মায়ের থেকে শুনেছিল এখানকার মেয়েরা ভীষণ সভ্য শান্ত। ঘোমটার আড়াল থেকে চুল বের হয় না কারো। এখানকার মেয়েদের সাথে তুলনা করে তাদের তিনবোনকে কত কথাই শুনাতো। এদের এইসব ভাষা যদি মা আজ শুনতো! নি*র্ঘাত জ্ঞান হারাতো।
সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার আওয়াজে ঘোর কা*টল প্রিয়’র।
‘ চাপো, আমি বসবো।’
প্রিয় সরে বসলো। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বেঞ্চে বসতে বসতে মেয়েটা বলল,
‘ এদের ছাড় দিলে আরো সাহস পাবে। নরম পেয়ে আরো যাতবে। শুনোনি শক্তের ভক্ত নরমের য*ম?’
‘ এসবের দরকার ছিল না কোন। আমার জন্য তুমি শুধু শুধু ওদের সাথে ঝা*মেলা বাঁধালে।’
‘ ওরা আমার সাথে ঝা*মেলায় জড়াবে না। কিছু বললে র*ক্ষা আছে? আমি চেয়ারম্যানবাড়ির ভবিষ্যৎ পুত্রবধূ।’
শেষ কথাটা বুক ফুলিয়ে বলল। প্রিয় অবাক হয়ে বলল,
‘ তোমার বিয়ে ঠিক?’
‘ না দুবছর যাবত প্রেম করছি, বিয়েটাও হয়ে যাবে।’
আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল মেয়েটা। প্রিয় নিখুঁত দৃষ্টিতে মেয়েটাকে পরখ করল, শ্যামলা বর্ণের গোল কাঠামোর মায়াবী মুখ। রোগা পাতলা আহামরি সুন্দরী না হলেও বেশ মিষ্টি।
মেয়েটা জিজ্ঞেস করল,
‘ নাম কি তোমার?’
‘ অশীতা জাফর প্রিয়’
‘ বাহ। ভারী সুন্দর নাম তো!’
‘ তোমার নাম?’
‘ তাসবিয়া তানহা। তুমি ঢাকা থেকে এসেছো?’
‘ হ্যাঁ।’
ঢাকার কথা শুনে তানহা খুশিতে গদগদ করে উঠল। চোখেমুখে চমক। একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করল। ক্লাসের ফাঁকে দুইজ্নের অনেক কথা হলো। অল্প সময়েই তানহার সাথে প্রিয়’র বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।

ক্লাস শেষে রিকশায় উঠল প্রিয়। ভরদুপুর। রাস্তাঘাট খুব একটা ব্যস্ত না এখন। কোমল রোদের সাথে শীতের অনুষ্ণ পরশ। ভীষণ ভালো লাগছে তার। গলির মাথায় ঢুকতে হ্ঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কায় রিকশা থামল। লোহার সাথে প্রিয়’র হাঁটু গিয়ে লাগলো। পায়ে কিছু একটা বিঁধ*ল। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল, বিরক্তির কন্ঠে বলল,
‘ আস্তে মামা। কিভাবে রিকশা চালাচ্ছেন!’
‘ সামনে পোলাপান আইয়া পড়ছে আম্মা।’
আশেপাশে তাকালো প্রিয়। কেউ নেই। ঝুঁকে তাকাতেই চাকার নিচে বল দেখতে পেল। নিচে নেমে বলটা হাতে নিতেই বাচ্চাদের হৈচৈ শুনা গেল। বিল্ডিংয়ের পিছন থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসছে। দল বেঁধে প্রিয়’র সামনে দাঁড়ালো। সেই দলের নেতা শাদ নামের সেইদিনের সেই দু*ষ্ট ছেলেটা। প্রিয়’র প্রচুর রা*গ হলো। চেঁচিয়ে বলল,
‘ রাস্তা কি খেলার জায়গা? এখনি তো অঘটন ঘটতো। যদি আমার কিছু হয়ে যেত?’
ছেলেটার চেহারায় বিন্দু মাত্র অপ*রাধবোধ নেই। বেশ স্বাভাবিক খাপছাড়া কন্ঠে বলল,
‘ আমাদের দেরি হচ্ছে বল দেন।’
এতবড় অপরাধ করে কই সরি বলবে। তা না বে*য়াদবি করছে। শাদের কথায় প্রিয়’র আরো বেশি রাগ হলো। রেগে গিয়ে বলল,
‘ তুমি আসলেই একটা বে*য়াদব ছেলে। ভুল করেছ। সরি না বলে হুকুম দিচ্ছ? এই বল আমি দিবোনা। দেখি কি করে নেও!’
‘ ভালোয় ভালোয় বলটা দিয়ে দেন আপু। নয়তো আন্টির কাছে নালিশ করবো।’
ছেলেটার কথায় হতভম্ব প্রিয়। একে দো*ষ করেছে তার উপর তাকেই ভ*য় দেখাচ্ছে? কেমন ঘাড় ব্যাকা ছেলে!
‘ তুমি আস্ত এক ফাজিল ছেলে!’
‘ আর আপনি কি? মাথা ফাটাতে চান খু*নি মেয়ে।’
‘ তোমার সাহস তো দেখছি কম না? এখনি কিন্তু
‘ কি করবেন আপনি? আপনি আমাকে…..
কথা শেষ করতে পারলো না শাদ। তার আগেই পেছন থেকে কেউ গম্ভীর আওয়াজে ধম*কালো। পেছন ফিরে শতাব্দকে দেখে প্রিয়’র চোখমুখ আরো কুঁচকে গেল। গম্ভীর মুখ করে হুডিতে হাত। ওদের দিকই এগিয়ে আসছে শতাব্দ। কাছাকাছি এসে শাদকে বলল,
‘ উনাকে সরি বল’
‘ কিন্তু ভাই..’
‘ সরি বলতে বলেছি’
ধম*কে উঠল শতাব্দ। মাথা নুয়ে নিলো শাদ। মিনমিনিয়ে বলল,
‘ সরি’
‘ দরকার নেই সরি’র’
প্রিয় ঝাঁঝালো গলায় বলল। মাটিতে বল ছুড়ে ফেলে। ভাড়া মিটিয়ে শতাব্দকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিক হাঁটা দিলো। খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটছে। হাঁটুর সাথে তখন পায়ের গোড়ালিতেও ব্যথা পেয়েছিল। সুচাল তারকাটায় লেগে উপরের চামড়া চি*ড়ে গেছে। চুয়ে চুয়ে র*ক্ত ঝরছে। কিছু দূর যেতেই পেছন থেকে প্রিয়’কে ডাকলো। প্রিয় থামলো। শতাব্দ পাশে এসে বলল,
‘ পা থেকে র*ক্ত ঝরছে। সামনে ফার্মেসি আছে, চলো।’
‘ দরকার নেই, বাসায় গিয়ে এন্টিসেপটিক লাগালেই র*ক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।’
নিচের দিক তাকিয়ে ঝটপট উত্তর দিলো প্রিয়।
‘ ক্ষ*ত দেখে মনে হচ্ছে পুরাতন কিছুতে লেগেছে ইনফেকশন ছড়াবে।’
‘ কিছু হবে না।’
শতাব্দ কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো। ধমকে বলল,
‘ বলছি না ইনফেকশন হবে? আমার কথা মানতে তোমার সম*স্যাটা কোথায়?’
কথার পিঠে কোন উত্তর দিলোনা প্রিয়। বাধ্য মেয়ের মত শতাব্দের পেছন পেছন গেল। দুপুর টাইম। ফার্মেসী খোলা। কিন্তু লোক নেই। ফার্মেসীর সামনে একটা বাচ্চা ছেলে চেয়ার পেতে বসে। শতাব্দ জিজ্ঞেস করতেই বলল,
‘ আব্বা বাড়ি গেছে ভাত খাইতে।’
প্রিয় যেন সুযোগ পেলো। অচি*রে বলল,
‘ লাগবেনা। আমার দেরি হচ্ছে। বাসায় চলে যাই।’
বলেই উত্তরের আশা না করে। ঝটপট পা বাড়ালো। শতাব্দ গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ থামো!’
প্রিয় যন্ত্রের মত থেমে গেল। গম্ভীর চড়া আওয়াজে শতাব্দ বলল,
‘যেতে বলেছি?”
‘ উনি আসতে দেরি হবে। আমি নাহয় এখন চলে যাই পরে এ..
‘ চুপচাপ বেঞ্চে গিয়ে বসো। পরে ব্যথা আরো বাড়বে। আমি করে দিচ্ছি।’
‘ আপনি?’
উত্তর দিলো না শতাব্দ। ভেতরে চলে গেল। প্রিয় কাচুমাচু মুখ করে কাঠের বেঞ্চটায় বসলো। মিনিট কয়েক পর শতাব্দ হাতে স্যাভলন ব্যান্ডেজ আর কি কি নিয়ে যেন ফিরে এলো। প্রিয়’র সামনে চেয়ার পেতে বসলো। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়। তুলোয় স্যাভলন লাগিয়ে কাটা জায়গা পরিষ্কার করছে শতাব্দ। প্রিয় ব্যথায় আঁ*তকে উঠল। ভীষণ জ্বলছে। কি ভেবে জানো একবার উপর দিক চাইল শতাব্দ, তারপর ক্ষ*ত স্থানে ফু দিতে দিতে বলল,
‘ এখন একটু জ্বলবে। দাঁত খিচে বসো।’
প্রিয় কিছু বলল না। পায়ে শীতল নিশ্বাস পড়তেই কেমন কুঁ*কড়ে উঠলো হ্ঠাৎ। ছোট ঢোক গিয়ে চোখমুখ শক্ত করে বসলো। ব্যা*ন্ডেজ করতে করতে শতাব্দ জিজ্ঞেস করল,
‘ তখন শাদ সরি বলছিল না বলে ঝ*গড়া করছিলে। যখন বলল, দরকার নাই বলে চলে এলে।’
প্রিয় মুখ কালো করে বলল,
‘ কারণ ও আপনার ভ*য়ে আমাকে সরি বলেছে। আমার জন্য নয়। কারো দানে দেওয়া সরির আমার দরকার নাই।’
প্রিয়’র উত্তরে গাল বাকিয়ে হাসল শতাব্দ। এই প্রথম লোকটাকে হাসতে দেখলো প্রিয়। কি দারুণ হাসি! কিছু একটা ভেবে সাথে সাথেই কপাল কুঁচকে নিলো। ব্যান্ডেজ করা হতেই উঠে দাঁড়ালো প্রিয়। অনুভূতিশূন্য যন্ত্রের মত করে বলল,
‘ ধন্যবাদ।’
বলেই তাড়াতাড়ি করে হাঁটা দিলো। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রিয়’র চলে যাওয়ার দিক নিমিষ চেয়ে রইল শতাব্দ। রাস্তার পাশে বড় বটগাছের ছায়া পড়ছে প্রিয়’র গায়ে। খুরিয়ে খুরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ব্যথায় কুঁ*কড়ে উঠছে, থামছে না তবুও। এতটুকু মেয়ের আত্মনির্ভর হওয়ার অদম্য জেদ।
সামান্য হাসলো শতাব্দ, ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ সুন্দর! অদ্ভুদ সুন্দর।’

চলবে……….

সবাই সবার মতামত জানাবেন। পেজের রিচ ডাউন পোস্ট পৌঁছালে অবশ্যই রেসপন্স করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here