বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব ৭

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৭.

আদ্রিয়ানের নিঃশ্বাস অনিমার মুখে পরতেই ও চাদরটা আরও শক্ত করে খামচে ধরল। কিছক্ষণ পর নিজের নাকের নিচে স্পর্শ পেতেই চমকে চোখ খুলে ফেলল। সামনে তাকিয়ে দেখল আদ্রিয়ান রুমাল দিয়ে ওর মুখ মুছে দিচ্ছে। অনিমা এসব ভাবতে ভাবতেই আদ্রিয়ানের কাজ হয়ে গেল। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” মানছি যে সেলিব্রিটি সম্পর্কে সবার একটা ধারণা থাকে যে তারা নিশ্চয়ই বেশিরভাগ বাজে চরিত্রের হয়। কিন্তু এটা কিন্তু সব ক্ষেত্রে একেবারেই ঠিক নয়।”

অনিমা বেশ অনেকটাই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রইল। সত্যিই কী ভাবছিল ও? ওর চিন্তাধারা এতো নিচু কবে থেকে হলো? কিন্তু ওরই বা কী দোষ? আদ্রিয়ান যেভাবে ওর দিকে ঝুকেছিল তাতে তো ওমন কিছুই মনে হচ্ছিল ওর। আদ্রিয়ান গলা ঝাড়তেই অনিমা ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। আদ্রিয়ান আবার বলল,

” তুমি নিতান্তই ছোট একটা মেয়ে বলে আমাকে ঝুকে নিতে হয়েছে। বুঝলে ম্যাডাম?”

অনিমা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। লোকটা কী ইনডিরেক্টলি ওকে বেটে বলল? কিন্তু আপাতত কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিল। আদ্রিয়ান গ্লাসটা রেখে বলল,

” গোসল করবেনা আজকে?”

গতকাল রাত থেকে আর বৃষ্টি হয়নি তাই গরম পরেছে একটু। অনিমারও অনেক অস্হির লাগছে। শাওয়ার নিলেই ভালো হয়। তাই ও মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান উঠে একটা টাওয়েল এনে ওর হাতে দিয়ে এরপর গিয়ে হালকা গোলাপি রঙের একটা জামা এনে দিয়ে বলল,

” আপাতত এই ঢিলেঢালা কুর্তিতেই চালাতে হবে। তোমার এক্সাক্ট মাপ আর পছন্দ জানিনা আমি। তাই চার পাঁচটা জামাই এনেছি। তাও এগুলো বাইরে পরার মত নয়। পুরোপুরি সুস্থ হলে আমি তোমাকে নিয়ে শপিং মলে গিয়ে মাপ অনুযায়ী কিনে নেব।”

অনিমা অবাক হয়ে তাকাল। চার পাঁচটা জামা? আবার আরও কিনে দেবে? ওর বলতে ইচ্ছে করছে ‘এগুলোর কী দরকার ছিল?’ কিন্তু কোন মুখে বলবে? ওর তো পরার মত কোন পোশাকও নেই, আর না কেনার জন্যে টাকা আছে। তাহলে কী আর করবে ও? তবুও ইতস্তত করে বলল,

” আর দরকার নেই এতেই হবে।”

আদ্রিয়ান অনিমার কথায় একেবারেই পাত্তা না দিয়ে অনিমার হাতে পোশাক ধরিয়ে দিয়ে বলল,

” ওয়াশরুমে তোমার জন্যে লেডিস বডিওয়াস, ফেসওয়াস যা যা লাগে সব রেখে দেওয়া আছে। তুমি তোমার প্রয়োজন অনুযায়ী সব ইউস করে নিও।”

অনিমা মাথা নেড়ে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান ওকে আটকে দিয়ে বলল,

” আজকে বেশি পানি ইউস করার দরকার নেই। শরীরে এখনও হালকা জ্বর আছে। বুঝেছ।”

অনিমা আবারও মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আদ্রিয়ান অনিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বিছানায় বসে ফোন বেড় করে নিজের বন্ধু আদিবকে ফোন করল। আদিব ওর একজন বেস্ট ফ্রেন্ড। খুব দায়িত্বশীল, সিরিয়াস একজন মানুষ। আদ্রিয়ান ওর ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারে। ফোন বাজার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে আদিব বলল,

” হ্যাঁ বল। তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। কী হয়েছে তোর দু-দিন যাবত ঘরে বসে আছিস?”

” বিকেলে আশিসকে নিয়ে বাড়িতে আয় লাইভ দেখিয়ে দিচ্ছি।”

আদিব হেসে দিয়ে বলল,

” আশিস? সে এখন নিজের মত বিন্দাস আছে। তুই নেই শাসন করারও কেউ নেই তাই সাপের পাঁচ পা দেখেছে।”

আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে ফেলল। এই ছেলেটাকে কী বদলাবে না? এরকম কেন ও? ছোট্ট একটা হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করে আদ্রিয়ান বলল,

” ছ্যাঁচড়াটাকে খুঁজে বেড় করে ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে আয় তাহলেই হবে।”

” আচ্ছা দেখছি কোথায় আছে। বিকেলে দেখা হচ্ছে তাহলে?”

” হ্যাঁ রাখছি।”

বলে আদ্রিয়ান কল কেটে বসে বসে ফোন স্ক্রোলিং করতে শুরু করল আর অনিমার বেড়োনোর অপেক্ষা করতে শুরু করল অনিমা বেড়োলে ও শাওয়ার নিতে যাবে। বেশ অনেকটা সময় পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজে তাকিয়ে দেখল অনিমা বেড়িয়ে গেছে। না চাইতেই আদ্রিয়ানের চোখ আটকে গেল। কী মায়া আছে এই শ্যামবর্ণা রমনীর মধ্যে? যেটাতে আদ্রিয়ানও বারবার ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে? না এভাবে তাকিয়ে থাকলে আর এই মায়াজাল থেকে বেড়োতে পারবেনা তাই টাওয়েল নিয়ে হনহনে পায়ে ওয়াসরুমে চলে গেল।

______________

আদ্রিয়ান দুপুরের লাঞ্চ করা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। অনিমা চুপচাপ বসে আছে খাটে আর আদ্রিয়ান সোফায় ল্যাপটপে কাজ করছে। আদ্রিয়ান চোখ তুলে অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখে অনিমা একেবারেই চুপচাপ বসে আছে। সেটা দেখে আদ্রিয়ান হালকা করে কাশি দিল। কাশির আওয়াজ পেয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকাল অনিমা। অাদ্রিয়ান বলল,

” এভাবে বসে বসে বোর হচ্ছ? টিবি দেখবে? বা কোন সিরিজ চালিয়ে দেব?”

অনিমা একটু ভেবে বলল,

” বই আছে আপনার কাছে? গল্প বা উপন্যাসের বই?”

” তুমি কেমন বই পছন্দ কর?”

অনিমা ঝটপট বলে ফেলল,

” থ্রিলার টাইপ।”

আদ্রিয়ান একটু হাসল। তারপর বলল,

” আচ্ছা বসো আমি নিয়ে আসছি।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই আদ্রিয়ান একটা বই এনে অনিমার হাতে দিয়ে বলল,

” এটা পড়ে দেখতে পারো।”

অনিমা মাথা নেড়ে বই খুলে পড়া শুরু করল। কিছুক্ষণ পর কিছু একটা মনে পরতেই আদ্রিয়ান বলল,

” তোমার কী স্টাডি কনটিনিউ আছে? মানে..”

অনিমা মুখ তুলে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এবার ওনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হতাম। কিন্তু..”

” কোন সাবজেক্ট?”

” জার্নালিস্ম।”

আদ্রিয়ানের কিছু না বলে নিজের কাছে মন দিল। অনিমাও মলিন হেসে বইরের দিকে তাকাল। আদ্রিয়ানের মাথায় অন্যকিছু ঘুরছে। কিন্তু সেটা করতে অনেক অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে ওকে।

______________

রঞ্জিত চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস লিমা কিচেনে দাঁড়িয়ে রান্না করছেন। হঠাৎ করেই একটা মেয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ওনাকে। প্রথমে চমকে উঠলেও পরে যখন বুঝতে পারল স্নিগ্ধা এসছে তখন খুশি হয়ে গেল মিসেস লিমা। কারণ এটা আর কেউ না ওনার বান্ধবীর মেয়ে স্নিগ্ধা। তাই ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে তরকারি নাড়তে নাড়তে মিসেস লিমা বললেন,

” এতদিন পর আসলি যে এবার? নিজের বাড়ি গেলে আর এই বাড়ির কথা মনে পরেনা তাই না?”

স্নিগ্ধা হেসে বলল,

” নাহ তেমন কিছুই না আসলে এবার একটু বেশি ছুটি পেয়েছিলাম তো। তুমিতো জানোই মেডিকেল লাইফে কী প্যারা? যাই হোক, আজ তুমি রান্না করছ যে?”

” এমনিই মন চাইল। ”

স্নিগ্ধা মুখ কালো করে বলল,

” তোমার ঐ ছেলের জন্যে ছুটিটা ভালো করে কাটাতে পারলাম না। ওনার পেয়ারের অনিমা কটা দিন একা থাকলে মরেই থাকলে মরেই যাবে হুহ! একটা দিন শান্তিতে থাকতে দেয়নি আমাকে জানো? ‘কবে যাবি? কবে যাবি? ও একা আছে ওর কষ্ট হচ্ছে? কতদিন থাকা লাগে? তাড়াতাড়ি যা।’ এসব বলতে বলতে আমার কান পুরো ঝালাপালা করে দিয়েছে তোমার ছেলে। না করব তারও তো উপায় নেই। না করলেই বলবে ‘রিক চৌধুরী রিকোয়েস্ট করেনা ওর্ডার করে। ”

শেষের কথাটা একটু পুরুষ পুরুষ কন্ঠের মত কথা বলল। অনিমার কথা তুলতেই মিসেস লিমার গলা শুকিয়ে এলো। রিক দেশে চলে আসলে কী হবে সেটা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত সে। স্নিগ্ধা হেসে বলল,

” যাই হোক অনি কোথায়? ওপরে রুমে আছে নিশ্চয়ই আমি যাচ্ছি হ্যাঁ? দেখা করে আসি ওর সাথে।”

বলে যেতে নিলেই মিসেস লিমা বলে উঠলেন,

” অনিমা বাড়িতে নেই।”

স্নিগ্ধা অবাক হয়ে ফিরে তাকাল। নেই মানে কী? অনিমা তো মন চাইলেই এভাবে হুটহাট বেড়োতে পারবেনা, সেই অধিকার ওকে দেওয়া হয়নি। তাহলে কী পালিয়ে গেছে? রিক জানলে কী হবে? মেয়েটাকে মেরেও ফেলতে পারে রাগে। নিজের পায়ে নিজে এভাবে কুড়াল মারে কেউ। স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে মিসেস লিমাকে ধরে বলল,

” কী বলছ? বাড়িতে নেই মানে কী হ্যাঁ? ওর তো ওনার্স ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে? এখনও ও সেকেন্ড ইয়ারের ভর্তি বা ক্লাস কোনটাই শুরু হয়নি তাহলে? গেল কোথায়?”

মিসেস লিমা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,

” রিক না থাকার সুযোগে অনিমাকে ওরা বেঁচে দিয়েছে একটা গ্যাং এর কাছে। অনেক চেষ্টা করেছিলাম মেয়েটাকে বাঁচানোর কিন্তু পারলার না।”

স্নিগ্ধার কলিজা কেঁপে উঠল। শরীর ঘেমে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। রিকের কথা আপাতত মাথায় নেই ওর শুধু অনিমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিচেনে রাখা টুলটা ধরে বসে পরল ও। কী করেছে কী ওরা? মেয়েটাকে বিক্রি করে দিল? ঐ মুখের দিকে তাকালে তো পাথরও গলে যায়, ওদের একটুও মায়া হলোনা? এতটা নিষ্ঠুর কীকরে হয় মানুষ? এরা কী আদোও মানুষ? দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল স্নিগ্ধা। এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেন গেল ও ঐ বাড়িতে কেন? ও যদি এখানে থাকত তাহল হয়ত এতবড় অঘটন ঘটতো না। কিন্তু সত্যিই কী ও পেরে উঠত ওদের সাথে? না-জানি কী কী হচ্ছে এইমুহূর্তে মেয়েটার সাথে। কোথায় আছে, কীভাবে আছে? কিচ্ছু ভাবতে পারছেনা ও। কী করবে কী এখন ও? এখন কী করা উচিত? রিককে ফোন করে এখনই সবটা বলে দেওয়া উচিত? নাকি রিকের ফিরে আসার অপেক্ষা করবে?

#চলবে…

[ কালকের পর্বে কয়েকজনের ভিলেন ক্রাশ রিক চৌধুরীর এন্ট্রি হবে। এই ছয় পার্টে রিক কবে আসবে বলতে বলতে মাথা ব্যাথা করে ফেলছে 🙄।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here