বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব ৯

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৯.

রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আদ্রিয়ান একটা একটা করে ঔষধ বেড় করে অনিমার হাতে দিচ্ছে অনিমা শুধু আদ্রিয়ানের দিকেই তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ানের সবগুলো ঔষধ অনিমার হাতে দেওয়া হয়ে গেলে ও অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখল অনিমা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার পর ওকে আবার ডক্টর এসে দেখে গেছে। ওর ব্লাড স্যাম্পেলও নিয়ে গেছে। কি নাকি টেস্ট করাবে। কী করবে সেটা জানেনা অনিমা। আদ্রিয়ান ভ্রু নাচাতেই নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে ‘কিছু না’ বোঝাল অনিমা। এরপর ঔষধ গুলো খেয়ে নিলো। অনিমাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে আদ্রিয়ান বলল,

” শরীরে ব্যাথা আছে এখন আর?”

অনিমা মাথা নেড়ে না করল। আদ্রিয়ান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ওর সামনেই খাটে আসাম করে বসে ল্যাপটপে কাজ করতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর কাজ শেষ করে আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” এবার চুপচাপ শুয়ে পরো।”

অনিমা শুয়ে পরতে নিয়েও উঠে বসে বলল,

” আচ্ছা আপনিতো বলেছিলেন আমি সুস্থ হলে পাশের রুমে শিফট করে দেবেন। আমিতো এখন অনেকটা সুস্হই আছি তাই..”

আদ্রিয়ান এবার অনিমার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,

” তোমার কী ভয় করছে? বাই এনি চান্স আমি তোমার কোন এডভান্টেজ নেব বা এমন কিছু ভাবছ?”

অনিমা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

” না না আমি এমনিই আরকি..”

” আরেকটু সুস্হ হলেই অন্যরুমে শিফট করে দেব। আরো দু-একদিন এখানেই থাকো।”

আদ্রিয়ানের গম্ভীর গম্ভীর মুখ দেখে অনিমা বুঝতে পারল যে ওর কথায় আদ্রিয়ান একটু রাগ করেছে। অনিমা অসহায় গলাত বলল,

” আমি কিন্তু সত্যিই তেমন কিছুই মিন করিনি।”

আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনিমার দিকে। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,

” কীরকম কিছু?”

অনিমা কোন উত্তর দিলোনা। কী বলবে? কিছুই তো বলার নেই এখন। কেমন কিছু বলবে? আদ্রিয়ান বলল,

” বুঝেছি, শুয়ে পরো।”

অনিমা কোন কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে পরল। কারণ আদ্রিয়ান মুচকি হেসে উঠে গিয়ে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অফ করে সোফায় শুয়ে পরল। আদ্রিয়ানের শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পরলেও অনিমার চোখে ঘুম নেই। কারণ ওর মনে পরেছে ওর বাবার মৃত্যুর পর ও কোথায় ছিল। তবে এখন এটা ভাবছে যে হুটহাট এরকম সব ভুলে কেন যায় ও? এটা কী কোন অসুখ? আচ্ছা মাদার কেমন আছেন? ওনার কোন ক্ষতি করে দেয়নি তো ওরা? আর তীব্র, অরুমিতা? ওরা কেমন আছে? কোথায় আছে? হঠাৎ করেই রিকের কথা মনে পরে গেল ওর। রিক কী ফিরে এসছে? যদি ফিরে এসেও থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ওকে খুঁজছে। যদি কখনও খুঁজে পেয়ে যায়? আবারও কী নিয়ে যাবে ওখানে? ও যেতে চায়না ওখানে। একদমই চায়না। কখনও কাউকে ঘৃণা করতে হবে ভাবেও নি ও। ওতো শুধু ভালোবাসায় বিশ্বাস করত। কিন্তু এখন ও ঘৃণা করে। ওই লোকগুলোকে মন প্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে। ওই বাড়িতে ওর মিসেস লিমা আর স্নিগ্ধা ছাড়া আর কেউ ভালোনা। হ্যাঁ রিককেও পছন্দ করেনা ও। একদমই পছন্দ করেনা কিন্তু কেন যেন ঘৃণাও করতে পারেনা। হয়ত এই কারণে যে রিকের জন্যেই ও আজও বেঁচে আছে। কিন্তু তাতে রিকের দোষ কমে যাচ্ছে না। প্রথমদিকে রিককে খুব ভালোলাগতো ওর। নিজের খুব ভালো বন্ধু মনে হত। কিন্তু রিক ভালো ছিলনা। রিক তো জানতো ওর সাথে রিকের বাবা রিকের মামা ওর সাথে কী কী করতো। সব জেনে শুনেও কোনরকম বাধা দেয়নি সে। বরং নিজেও অনেকবার ওর গায়ে হাত তুলেছে। এসব কিছু মিলিয়েই রিক নামটা আজকাল সহ্য করতে পারেনা ও। একদম পারেনা। তার চেয়েও বেশি অসহ্য লাগে ‘নীলপরী’ ডাকটা। এসব ভাবতে ভাবতে আদ্রিয়ানের দিকে চোখ পরল ওর। আদ্রিয়ানের সাথেতো ওর আগের কোন আলাপ নেই, কোন সম্পর্কও নেই। তবুও ছেলেটা ওকে সযত্নে নিজের কাছে আগলে রেখেছে। আজকালকার দিনে এরকম অসহায় একটা মেয়েকে একা পেলে হয়তো ঝাপিয়ে পরতো তার ওপর, নিজের পুরুষত্ব দেখাতে ভুলতো না। কিন্তু আদ্রিয়ান পরপর তিনটা দিন এই ফাঁকা বাংলোতে ওকে নিজের বেডরুমে রেখেও একবারের জন্যেও বাজেভাবে স্পর্শ করেনি। চাইলেই তো যেকোনভাবে যেকোনরকম সুযোগ নিতে পারত সে। কই নেয় নি তো। লোকটা কী সত্যিই এতটা ভালো? নাকি ভালো মানুষের মুখোশ পরে আছে। সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও নেই অনিমার কাছে।

____________

সুইডেনে সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে রোদের উজ্জ্বল আলো এসে সাদা পেন্ট করা রুমের চারপাশটা আলোকিত হয়ে আছে। রোদের আলো চোখ বরাবর পরতেই ভ্রু কুচকে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল রিক। উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল যে সাড়ে এগারোটা বাজে। লম্বা একটা হাই তুলে টিশার্ট টা খুলে ফেলল। আড়মোরা ভেঙ্গে ঠিকঠাক হয়ে বসে কিছু একটা ভেবে ফোনটা হাতে নিল। উঠে বসে ব্যালকনিতে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সবার আগে স্নিগ্ধাকে ফোন করল। কিন্তু এখনও ফোন বন্ধ পেয়ে বিরক্ত হলো সে সাথে রাগও করল। কী সমস্যা কী ফোন বন্ধ করে রাখার মানেটা কী? কিছু একটা ভেবে এবার নিজের মা কে ফোন করল।

ফোন বেজে উঠতেই মিসেস লিমা চমকে উঠলেন। স্ক্রিনে তাকিয়ে রিকের নাম দেখে বুক কাঁপছে ওনার। কী জবাব দেবেন নিজের ছেলেকে? অনেকটা ভয় নিয়ে ধীরে ধীরে ফোনটা রিসিভ করলেন উনি। রিসিভ করার সাথেসাথেই ওপাশ থেকে রিক বলে উঠল,

” হ্যালো মম্ ভালো আছো?”

মিসেস লিমা কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” হ্যাঁ বাবা, আমি ভালো আছি। তুই ভালো আছিস?”

” আছি। নী.. অনি কোথায়?”

মিসেস লিমা এবার প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলেন। কী বলবেন এখন? ওনার যে হাতপা বাঁধা, চাইলেও রিককে সবটা বলতে পারবেন না। অপাশ থেকে রিক বলে উঠল,

” কী হল মা? অনি কোথায়?”

” ও তো এখন ঘুমাচ্ছে।”

রিক ভ্রু কুচকে ফেলল। তারপর সন্দিহান কন্ঠে বলল,

” কী ব্যাপার বলোতো এই ছয়দিন যাবত আমি যখনই ফোন করেছি তখনই হয় ও ঘুমোচ্ছে, নয়ত শাওয়ার নিচ্ছে কখনও তুমি কাছে নেই। কী ব্যাপার? কী লুকোচ্ছো বলোতো? ও অসুস্থ নয়তো। আই মিন ঠিক আছে তো?”

মিসেস লিমা এবার ভীষন জ্বালায় পরলো। কীকরে সামলাবে এবার নিজের ছেলেকে? যদি একটুও টের পায় তাহলে সব শেষ করে দেবে। উনি নিজের ঘাম মুছে ভীত গলায় বলল,

” আসলে ও কথা বলতে চাইছেনা তোর সাথে।”

রিকের এবার বেশ রাগ হল। কথা বলতে চাইছেনা মানে কী? এখন কি করেছে ও? মেয়েটাকি বোঝেনা ওর গলা না শুনলে রিকের কষ্ট হয়, সব ফাঁকা লাগে। ওর ব্যবস্থা তো বাড়িতে গিয়ে করবে। রিক দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” স্নিগ্ধু কোথায়? ফোন বন্ধ কেন ওর?”

” আছেতো বাড়িতেই আছে। অনিমার সাথেই আছে।”

” ওকে বলো ফোন অন করতে, কথা আছে ওর সাথে।”

” আচ্ছা বলে দেব।”

” হুম রাখছি।”

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ রেলিং শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল রিক। ওর ভালোলাগছে না কিছূ এই মুহূর্তে। কথা বলতে চায়না মানে কী? জেনেশুনে মানসিক টর্চার করছে মেয়েটা ওর ওপর। রাগ কমাতে একটা লম্বা শাওয়ার প্রয়োজন এইমুহূর্তে ওর। তাই ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ালো রিক।

_____________

বিকেল হয়েছে। কিন্তু চারপাশটা এতোটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কালো মেঘে চারপাশটা ঢেকে গেছে। তীব্র বাতাসে শো শো করছে চারপাশটা। একটু পরপর আলোর ঝলকানি দিয়ে গগন কাঁপিয়ে বজ্রপাত হচ্ছে। অনিমা গুটিয়ে খাটে বসে আছে। জানালা, ব্যালকনির দরজা সব খোলা। কিন্তু গিয়ে লাগানোর সাহস হচ্ছেনা ওর। বারবার বজ্রপাতের আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ও একজন সেরানোফোবিক। এরকোন বিশেষ কারণ নেই ছোটবেলা থেকেই সেরানোফোবিয়ায় আক্রান্ত ও। আগে ঝড়, বজ্রপাত হলেই ওর আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকত। অনিমা বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। আদ্রিয়ান আসছে না কেন? সেই কখনো নিচে গেছে এখনও আসছে না। ওর তো খুব ভয় করছে। ভয়ে কান্না করে দিয়েছে ও।এরমধ্যেই আদ্রিয়ান রুমে এসে দেখে ব্যালকনির দরজা, জানালা সব খোলা। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে না তাকিয়েই শুধু ব্যালকনির দরজা লাগাতে লাগাতে বলল,

” এগুলো খুলে রেখেছ কেন? বাইরে তো..”

এটুকু বলে অনিমার দিকে তাকাতেই থেমে গেল আদ্রিয়ান। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও হালকা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে যে অনিমা অন্ধকারে একদম গুটিয়ে বসে আছে। আদ্রিয়ান বুঝতে পারল অনিমা ভয় পাচ্ছে। তাই দ্রুত গিয়ে ওকে ওর সামনে বসে বলল,

” কিচ্ছু হয়নি আমি চলে এসছি দেখো?”

এটুকু বলতে না বলতেই চারপাশটা কাঁপিয়ে ভয়াবহ বজ্রপাত হলো। অনিমা জোরে চেঁচিয়ে উঠে গিয়ে আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ের জন্যে কী করছে ওর নিজেই খেয়াল নেই। এতোটা শক্ত করে ধরেছে আদ্রিয়ানকে যেন আদ্রিয়ানের মধ্যেই ঢুকে পরবে। আদ্রিয়ান হতভম্ব হয়ে গেছে। কখনও কোন অন্য মেয়ের এত কাছে কাছে আসেনি ও। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে। বুকের মধ্যে যেন হাতুরি পেটাচ্ছে কেউ। এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে যার কারণ ওর অজানা। ও আস্তে আস্তে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল অনিমাকে। জানালা দিয়ে আসা প্রবল বাতাসে অনিমার খোলা চুল এলোমেলোভাবে উড়ছে। আদ্রিয়ান দারুণভাবে উপভোগ করছে সেটা। আবার বজ্রপাত হতেই অনিমা আদ্রিয়ানের টিশার্ট খামচে ধরল। ওর মনে হচ্ছে ও পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্হানে আছে। আদ্রিয়ানও আপাতত একটা ঘোরে আছে। ওর কাছেও এই অনুভূতি নতুন। কিছু না ভেবেই ও অনিমার চুলে নিজের নাক ঢুবিয়ে দিল।

#চলব‍ে..

[ এত চাপের মধ্যে থাকার পরেও সময় বেড় করে গল্প দিচ্ছি আপনারা চান বলে। কিন্তু আপনাদের রেসপন্সে আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। রিঅ‍্যাক্ট অনেক বেশি থাকলেও কমেন্ট সেই তুলনায় একটু কম। রিঅ‍্যাক্ট করার সাথে সাথে মন্তব্যও করতে হয় নয়তো আমি বুঝতে পারব না গল্পটা কেমন এগোচ্ছে। হ্যাপি রিডিং।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here