বাইজি কন্যা পর্ব ৩+৪

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৩
[৬]
শুক্রবার৷ রাত তখন প্রায় এগারোটা। অলিওর চৌধুরী’র মিত্রগণরা তখন প্রমত্তকর রস পান করে বেহুশের ন্যায় আচরণ করছে। বাইজি চুমকি আর বাইজি রূপসী নৃত্যে নৃত্যে শরীরে ঘাম ঝরিয়ে ফেলছে। শুভ্র দেহের গণ্ডস্থলে, উদরে লেপ্টে থাকা ঘামগুলো মুক্তোর দানার মতো চকচক করছে।নারীদ্বয়ের স্বেদাক্ত উন্মুক্ত উদরের প্রতি তীব্র আকর্ষণে দিশেহারা হয়ে সকলের সম্মুখেই প্রমুখ নামে অলিওয়ের এক মিত্র বাইজি চুমকি’কে একটানে নিজের কোলে বসিয়ে বিকৃত লোভাতুর ওষ্ঠাধর গভীরভাবে ছুঁইয়ে দিলো উদরে। একের পর এক চুম্বন লেপ্টে দিয়ে এক পর্যায়ে হিংস্র পশুর ন্যায় খুবলে খেতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে গৃহ শূন্য হয়ে গেলো। কেউ আতঙ্কিত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো, কেউ অধরে দুর্বৃত্ত হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বের হলো। সকলের সম্মুখে নিজের অর্ধনগ্ন বক্ষে, উদরে বাবার বয়সী এক পুরুষের বিধ্বংসী লীলাখেলার সূচনা হওয়াতে প্রথমে লজ্জায়,ঘৃণায় মূর্ছিত ধরলো চুমকি। কিন্তু সে মূর্ছনা বেশীক্ষণ স্থির রইলো না। সকল চেতনা ভুলে গিয়ে অচেতন, উন্মাদ,ভোগ্য বস্তু রূপে ধরা দিলো প্রমুখ নামক পুরুষটির কাছে। বাইজি রূপসী স্বেচ্ছায়ই অলিওরের এক মিত্র পুত্রের সঙ্গে পাশের ঘরে চলে গেলো। কারণ সে বেশ চতুর নারী। নিজ শরীরের ওপর করা তাণ্ডবগুলোকে কীভাবে উপভোগ করতে হয় তা খুব ভালোভাবেই জানে সে। অন্যান্য ঘর থেকেও ঘুঙুরের শব্দ ভেসে আসছে। নানাবিধ গানে, ঘুঙুরের আওয়াজে, নারী কন্ঠের মৃদ্যু আর্তনাদে মুখরিত পুরো বাইজি গৃহ। প্রধান নৃত্য কক্ষে রয়েছে জমিদার অলিওর চৌধুরী, যেখানে তার সেবায় নিমজ্জিত বাইজি শর্বরী। তার বাম,ডান পাশের কক্ষগুলোতে পল্লব চৌধুরী এবং পলাশ চৌধুরী রয়েছে নিজ পছন্দনীয় বাইজিদের সঙ্গে। বাকি কক্ষগুলোতেও অতিথিরা নিজ আমদে ব্যস্ত, রয়েছে অগণিত বাইজিও। বাইজিদের প্রধান শারমিন বাইজি নিজ কক্ষে মান্নাতের সঙ্গে শুয়ে আছে। শারমিন বাইজিদের প্রধান হলেও সে নৃত্য ব্যতিত অন্যকিছু দিয়ে জমিদার বাড়ির কোন পুরুষ বা জমিদারের কোন মিত্রের মন জয় করার প্রয়োজন মনে করেনা৷ আর না তার ওপর কেউ জবরদস্তি করতে পারে। জমিদার অলিওর চৌধুরী চরিত্রহীন হলেও নিজ প্রতিজ্ঞায় বরাবরই অটল। মান্নাত শারীরিক ভাবে অসুস্থ থাকায় তার কিছুদিন ছুটি। দুই সখীতে শুয়ে আছে একই বিছানায়। চারপাশ থেকে অগণিত আওয়াজ এসে বারি খাচ্ছে ওদের কর্ণে। এক পর্যায়ে শারমিন তাচ্ছিল্য সহকারে মান্নাতকে বললো,
-‘ পুরো দুনিয়া জানে আমরা বাইজি গৃহের বাসিন্দা। অথচ আমরা জানি এটা নাম মাত্র বাইজি গৃহ। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে গৃহের সামনের দেয়ালে বাইজি গৃহ কেটেকুটে লিখে দেই পতিতা গৃহ। চিৎকার করে বলি আমরা পতিতা গৃহের সদস্য। হ্যা জমিদার অলিওর চৌধুরী’র পতিতা গৃহে বাস করি আমরা। শহরের আনাচে কানাচে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মুখোশধারী জমিদার অসহায় নারী’দের ভোগের বস্তু মনে করে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসহায়, নিরুপায় নারীদের বাধ্য করে পতিতা রূপে জীবন কাটাতে! ‘
শারমিনের তেজস্বী বাক্যলাপ শুনে হুহু করে কেঁদে ওঠলো মান্নাত। শারমিন তার মুখ চেপে ধরে বললো,
-‘ চুপ কর, চুপ কর। জানোয়ার’টা আজ এসেছে। নরপিশাচ টা এসেছে আজ। আমি খুব কষ্টে অলিওর’কে বুঝিয়েছি তোর স্ত্রীরজ সমস্যা ঘটেছে। জানিস তখন জানোয়ার’টা ঠোঁট টিপে হাসছিলো।’
-‘ মানুষ এতোটা নির্দয় কেন হয় সখী? এতো নৃশংস!’
-‘ লোভে পাপ পাপে মৃত্যু তুই যে লোভ করেছিলি। ভালোবাসার লোভ জমিদার পুত্রের পত্নী হওয়ার লোভ তোকে মৃত্যুপুরীতে নিয়ে এসেছে। আমাদের মতো মেয়েদের যে ভালোবাসতে নেই হয় যদি উচ্চবংশীয় কেউ সেখানে ভালোবাসা খুবই নগন্য। ‘
-‘ যে ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে আমার দেহ,মন আজ ক্ষতবিক্ষত সে ভালোবাসার ফাঁদে যেনো আর কেউ না পড়ে। আর কারো গর্ভে যেনো না আসে ঐ জমিদার বাড়ির অংশ, আর কোন নিষ্পাপ প্রাণের যেনো না ঘটে মৃত্যু! ‘
মান্নাতের কথা শুনে তাচ্ছিল্য হেসে শারমিন বললো,
-‘ অভিশাপ দিতে হবে না মান্নাত প্রকৃতিই অভিশাপ বয়ে আনবে ওদের জীবনে। তুই কি এখনো টের পাসনি পল্লব চৌধুরী নিঃসন্তান, পলাশ চৌধুরীর স্ত্রীরও বাচ্চা ধরে না। আমার মন বলছে ওরা নির্বংশ হবে। শেষ জামানায় জয় আমাদেরই হবে। ‘
পলাশ চৌধুরী নামটা শুনতেই আবারো বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো মান্নাত। বললো,
-‘ আমি ওকে খুব ভালোবেসেছি সখী। ও কেন আমাকে ধোঁকা দিলো, কেন আমাদের সন্তানটাকে নিঃশেষ করে দিলো। আমি ওর স্ত্রী’র মর্যাদা পাইনি কিন্তু ওর বাচ্চার মা’য়ের মর্যাদাটুকু ও কেন আমায় দিলো না? তোমার মতো ভাগ্য কেন আমার হলো না। কেন আমি কারো মা ডাক শোনার অধিকার রাখিনা।’
-‘ কারণ তুই বাইজি! তুই সেই বাইজি যাকে জমিদারের পুত্র পলাশ চৌধুরী ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে জমিদার বাড়িতে নিয়ে এসেছে। অথচ স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারেনি৷ কি নির্মম ভালোই তোকে বাসলোরে যে স্থান দিলো বাইজি গৃহে। হলি তার ভোগের সামগ্রীমাত্র! ‘
-‘ তাহলে এই সন্তানটাকেও স্বীকৃতি না দিয়ে বাঁচতে দিলেই পারতো। নাই পেলো বাবার পরিচয় শুধু মা ডাকটুকু শুনতে দিতো আমায়। নূরের মতোই মায়ের পরিচয়ে বেড়ে ওঠতো ও। ‘
-‘ এতো বছরেও মানুষ টাকে চিনলি না মান্নাত… ‘
-‘ মন তো মানে না কি করি আমি বলো? ‘
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শারমিন। দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ আবেগটুকু নিঃশেষ করে দে মান্নাত শান্তি পাবি। ‘
আচমকাই উতলা হয়ে মান্নাত বললো,
-‘ সখী আমাদের নুরের কি হবে পলাশ চৌধুরী যে অপেক্ষায় আছে গুণে গুণে আরো সাতটি মাসের অপেক্ষা। ‘
সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো শারমিনের। রহস্যেঘেরা একটি হাসি দিয়ে বললো,
-‘ ওর বাপ’কে দিয়েই আমার মেয়েকে নিরাপত্তা দেবো আমি। ‘
-‘ বাবা, ছেলেতে তাণ্ডব সৃষ্টি হবে সখী, পলাশ যে বড়োই নিষ্ঠুর। ‘
-‘ আমি নুরকে ঢাকা শহরে পাঠিয়ে দেবো মান্নাত। এর জন্য সর্বাত্মক সহোযোগিতা করবে জমিদার অলিওর চৌধুরী। ‘
-‘ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে? ‘
-‘ শেষ করে দেবো ওকে। ‘
-‘ শেয়ালের কাছে মুরগী বাগি দেওয়া কি ঠিক সখী। ‘
-‘ জমিদার আমায় কথা দিয়েছে মান্নাত। তুই ভালো করেই জানিস শয়তান টা কথা দিয়ে ঠিক কথা রাখে। আর যে কথা রাখে না সে কথা রাখবে বলে মিথ্যা প্রতিজ্ঞাও করেনা। এটা জমিদার অলিওর চৌধুরীর বিরাট গুণ। ‘
-‘ নুর’কে ছেড়ে থাকতে পারবে? ‘
-‘ ওর সুন্দর ভবিষ্যৎের জন্য যদি আমাকে বলিও দিতে হয় তাই দেবো। ‘
-‘ কবে চলে যাবে নূর আমাদের থেকে? ‘
-‘ এই তো আর কয়েকটা মাস মায়ের আরেকটু আদর পেয়ে নিক। যত্ন সহকারে আরেকটু কড়া শাসনে মেখে থাকুক। আরেকটু মায়ের বুকে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ুক। মেয়েটা আমার বড্ড অবুঝ, বড্ড ছোট। মানাতে একটু পরিশ্রম তো হবেই বল। ‘
[৭]
পুরো জমিদার বাড়ি প্রস্ফুটিত পুষ্পপুঞ্জে সজ্জিত করা হয়েছে। পাঁচফোড়ন গৃহেও নেমে এসেছে বিষাদ সিন্ধু। নিজ ঘরে দগ্ধ হৃদয়ে বসে আছে মুনতাহা। জমিদার অলিওর চৌধুরী’র দ্বিতীয় পুত্র পলাশ চৌধুরী’র প্রকাশ্য প্রথম এবং একমাত্র পত্নী মুনতাহা চৌধুরী। বাইজি মান্নাতের সঙ্গে পলাশের প্রেমের সম্পর্ক তারপর বিয়ে পুরোটাই অপ্রকাশিত রয়েছে। অত্যন্ত কৌশলে গ্রামের সহজ সরল গরিব ঘরের মান্নাত’কে প্রেমের ফাঁদে ফেলে গোপনে বিয়ে করে পলাশ। তারপর নিয়ে আসে নিজ গৃহে। কিন্তু বউ হিসেবে নয় বাইজি গৃহের এক বাইজি হিসেবে! তার ঠিক তিনমাসের মাথায়ই মা প্রেরণার ভাইয়ের মেয়ে মুনতাহা’কে স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়ে পাঁচফোড়ন গৃহে নিয়ে আসে। মন, প্রাণ দিয়ে পলাশকে ভালোবাসে মুনতাহা। বিয়ের পূর্বে তার চরিত্রের বেহাল দশা দেখে মা প্রেরণা এবং মুনতাহা ভেবেছিলো ঘরে সুন্দরী বউ এলে আর যাই হোক কোন বাইজির প্রতি আসক্তি থাকবে না। গোপন সূত্রে প্রেরণা খবর পেয়েছিলো তার পুত্র পলাশ মান্নাত নামক এক বাইজির প্রেমে মাতোয়ারা। ভিতরের খবর কেউ জানেনা। বাইরে থেকে যতোটুকু অবগত হয় ততোটুকুরই নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করে। চেষ্টা করেছিলো মা প্রেরণা আর মুনতাহাও। কিন্তু লাভ হয়নি। হবে কি করে গোড়ায় গণ্ডগোল থাকলে আগা কি সঠিকভাবে বাড়তে পারে?

মুনতাহার নয়নজুড়ে আজ শোকের ছায়া। কারণ
তার স্বামী আজ বাইজি গৃহে বাইজি শরীরে মগ্ন রয়েছে। যদিও এটা আজ নতুন নয় তবুও ক্ষতগুলো ঠিক নতুনের মতোই যন্ত্রণা দিচ্ছে। ঘরে স্ত্রী রেখে স্বামী বাইজি গৃহে কোন এক বাইজির সঙ্গে মিলিত হচ্ছে… একজন স্ত্রীর কাছে এটা কতো বড়ো অসম্মানের সহিত ক্লিষ্টপূর্ণ ভাবা যায়! বিছানার এক পাশে গুটিশুটি হয়ে অশ্রুপাত করছে মুনতাহা। এমন সময়ই ঘরে প্রবেশ করার জন্য অনুমতি চাইলো পল্লব চৌধুরী’র প্রথম স্ত্রী শবনম চৌধুরী। বললো,
-‘ মুনতাহা, অন্দরে আসবো? ‘
শবনমের কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই শব্দ করে কেঁদে ওঠলো মুনতাহা। তা দেখে দেরি করলোনা শবনম। ত্বরিতগতিতে অন্দরে প্রবেশ করে মুনতাহাকে বক্ষে চেপে ধরলো। বললো,
-‘ কাঁদিস না বোন জেনে শুনে যে অভিশাপকে বুকে ঠাঁই দিয়েছিস সে অভিশাপ সইতেই হবে। ‘
-‘ আপাগো শরীরে আগুন ধরলে পানি দিয়ে নিভানো যায়, বুকের ভিতর আগুন ধরলে কি দিয়ে নিভানো যায় তা তো আমি জানিনা। তুমি কি জানো আপা? ও আপা একটা উপায় বলো…’
-‘ এই আগুনের পূর্বাভাস তো তোরে আগেই দিছি মুন তুই তো বুঝলি না। ‘
-‘ আপা ও আপা ঐ বাইজিদের শরীরে যা আছে আমারও তো তাই আছে উনি কেন বুঝেনা আপা? আমি উনাকে খুব ভালোবাসি আপা। আমি আর সইতে পারছিনা, আর পারছিনা। ‘
স্নেহপূর্ণ বুক’টি পেয়ে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মুনতাহা। আফসোসে সিক্ত হয়ে ওঠলো শবনমের মন। বিরবির করে বললো,
-‘ আমি না হয় না জেনে মরেছি তুই তো জেনে শুনে মরলিরে বোন। অভিশপ্ত এই জীবনের বোঝা যে বড্ড ভারী। দেখ ক’দিন বইতে পারিস। ‘
জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলের প্রথম স্ত্রী, বড়ো বউ শবনম চৌধুরী। অলিওর চৌধুরী’র বন্ধু’র মেয়ে হওয়ার সুবাদেই এই বাড়ির প্রথম পুত্রবধূ হিসেবে পদচারণ হয় তার। বিয়ের পূর্বে জমিদার বাড়ি, জমিদার গৃহিণী, জমিদার পুত্র সর্বজন’কে নিয়েই রূপকথার গল্পের মতোই ভাবনা ছিলো তার। ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি জমিদার বাড়ি,অলিওর চৌধুরী এবং তার পুত্ররা ঠিক মাক্কাল ফলের মতো। সারাজীবন জেনে এসেছে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মাঝে শারীরিক সম্পর্ক হয়। আর এ বাড়িতে প্রবেশ করার পর জানতে পারে, বাইজিদের সঙ্গেও জমিদার’দের শারীরিক সম্পর্ক হয়। আর এই সম্পর্কে যুক্ত তার স্বামী পল্লব চৌধুরীও। না জেনে ভালোবেসে,বিশ্বাস করে সে ঠকেছে। কিন্তু মুনতাহা জেনে বুঝে ঠকলো এটা ভাবতেই শবনমের ভিতর থেকে আফসোসের অবিরত নিঃশ্বাস নিঃসৃত হতে শুরু করলো।
[৮]
বাইজি গৃহের গোপন কক্ষে নরম তোশকে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলো শাহিনুর। নিঃশ্বাসে তার ভীষণ অস্থিরতা। আজকাল মা যখন এই কক্ষে নিয়ে আসে তাকে আনন্দে নেচে ওঠে হৃদয়খানি। যখন এই কক্ষে না নিয়ে আসে তখনই বরং মন খারাপ হয়। ভাগ্যিস আজ বাইজি গৃহে জমিদার বাড়ির মন্দ মানুষ, মন্দ অতিথিরা এসেছে। নয়তো মা তাকে আজ এখানে রেখে যেতো না ঠিক যেমন গত দুদিন রেখে যায়নি। মনের সাথে মনের প্রলাপে হঠাৎ অপেক্ষারত শাহিনুর শোয়া থেকে ওঠে বসলো। গা থেকে চাদর সরিয়ে অধৈর্য সহকারে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পরনের অতি সাধারণ সূতি কাপড়ের শাড়িটির আঁচলখালা দিয়ে পুরো কাঁধ মুড়িয়ে ঢেকে নিলো৷ ভীষণ শীত তাই গা ঢেকে কাঠের বেড়া সরিয়ে জানালা খুলে দিলো। রাতের সময় তখন কতো জানা নেই শাহিনূরের। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলো বাঁশিওয়ালার বাঁশি বাজানোর সময় পার হয়ে গেছে। একরাশ বিষণ্ণতার কালো মেঘে জড়িয়ে গেলো বালিকার শুভ্র মুখশ্রীটি। জ্যোৎস্না আলোতে নিষ্পলক দৃষ্টি জোড়া মেলে ধরলো কৌতুহলী বনটার দিকে। নিস্তব্ধ নিবিড় রজনীতে জমিদার বাড়ির বিস্তীর্ণ অরণ্য থেকে শীতল হাওয়ার পাশাপাশি গুটিকয়েক মনুষের হাসির শব্দগুচ্ছও ভেসে আসছে। নেই শুধু বক্ষস্থলে নৃত্যের ঝর তোলা সুরের মেলা। কিন্তু শাহিনুরের কেন জানি মনে হচ্ছে ঐ হাসিগুলোর মালিকের জায়গায় বাঁশিওয়ালা ঠিক রয়েছে। কিন্তু আজ বাঁশি বাজে না কেন? তবে কি আজ বাঁশিওয়ালার মন খারাপ। কিছুটা বিষণ্নতা জেঁকে বসলো বালিকার নয়নজুড়ে। ললাটজুড়ে পড়লো চিন্তার ভাঁজ। কর্ণদ্বয় খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলো কোন হাসিটি বাঁশিওয়ালার। ভাবলো,
-‘ বাঁশিওয়ালার মন খারাপ হলে সে হাসবে কেন? তাহলে কি আজ বাঁশিওয়ালার মন ভালো? বাসির সুর কি তার কষ্টের প্রতীক? ‘
অজস্র কৌতুল, সীমাহীন উত্তেজনায় আড়ষ্ট হয়ে অপেক্ষায় রইলো শাহিনুর। বক্ষস্থলে কেবল একটি প্রশ্নই ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরতে লাগলো,
– ‘ও বাঁশিওয়ালা তোমার বাঁশি বাজে না কেন? ও বাঁশিওয়ালা তোমার বাঁশি বাজে না কেন? ‘
জানালার অতি নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা শাহিনুর হঠাৎই আনমনে জানালার চৌকাঠে ওঠে বসলো। পাল্লাতে মাথা ঠেকিয়ে অপেক্ষারত নয়ন দু’টি আলতো ভাবে বুজলো। তারপর কতোটা সময় পার হলো জানা নেই। কিন্তু কর্ণকুহরে আচমকাই সে চেনা সুর পৌঁছানো মাত্রই আঁতকে ওঠলো শাহিনুর। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মেয়েটি। আচমকাই ঘুম ভাঙার ফলে মস্তিষ্ক বুঝে ওঠতে পারছিলোনা সে কোথায় আছে। শরীরের পুরোটা ভার ছেড়ে চৌকাঠে বসা ছিলো বিধায় ঘোরের মাঝে বাম দিকে ঘুরতে নিতেই একতলার খোলা জানালা দিয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো ভূমিতলে। সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র ভয়ে, কোমল দেহে অগণিত কাঁটাজাতীয় কিছুর আঁচড়ে অসহনীয় ব্যথায় চোখ,মুখ খিঁচে আর্তনাদ করে ওঠলো,
-‘ ও মা গো! ‘
সেই আর্তনাদ শুনতে পেয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হলো গুটিকয়েক মানব-মানবী। থেমে গেলো বাঁশির সুর।
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৪
সেই আর্তনাদ শুনতে পেয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হলো গুটিকয়েক মানব-মানবী। থেমে গেলো বাঁশির সুর।
[৯]
জমিদার বাড়ির গহীন অরণ্যে রয়েছে একটি ছোট্ট কুটির। কুটিরের চারদেয়াল বাঁশের বেড়া দিয়ে কারুকার্যে শোভিত। কুটিরটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হচ্ছে বিশেষ ভাবে পলিথিন মুড়িয়ে তৈরি ছনের ছাদ। এতে বৃষ্টিপাতের সময় বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পায় কুটিরে অবস্থানরত মানুষ। জমিদার অলিওর চৌধুরী’র কনিষ্ঠ পুত্র রঙ্গন চৌধুরী’র শখের কুটির এটি। কেন জানি বিশাল অট্রালিকার সীমাহীন বিলাসিতার কক্ষটি ফেলে এই কুটিরটাই ভীষণ আরামদায়ক মনে হয় তার কাছে। তাই সারাদিন পর রাতের সময়টুকু এই আরামপ্রিয় জায়গাটিতে কাটিয়ে দেয় একের পর এক দীর্ঘ রজনী। সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় অন্তর গহীন থেকে আসা সুর’কে। যা তার এক জীবনের সমস্ত দহন শুষে নেয়। অঢেল ক্লান্তির পর দেয় সীমাহীন শ্রান্তি। রোজকার মতোই আজও রঙ্গন তার আরামপ্রিয় কুটিরটি মাতিয়ে তুলেছিলো সুরের মেলায়। তবে আজ সে একা ছিলো না। সঙ্গে ছিলো অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজু, খালাতো বোন রোমানা,বড়ো ভাই প্রণয় এবং অঙ্গন। হঠাৎ করেই আজ রোমানা বায়না ধরেছিলো রঙ্গনের ছোট্ট কুটিরে আসার জন্য। কিন্তু রঙ্গন কোনক্রমেই রাজি হয়নি। তাই মা প্রেরণা’কে দিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করে তবুও লাভ হয় না। পরবর্তী’তে মা প্রেরণা বুদ্ধি করে প্রণয়’কে বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করে। প্রণয় যেমন মা’য়ের বাধ্য ভাই’দের মধ্যে রঙ্গনও তেমন প্রণয়ের বাধ্য। সে সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে মা প্রেরণা। তারপর মনের আশা পূরণ করেছে অতি আদরের বোন ঝি’র। সকলেই বিমোহিত হয়ে শুনছিলো বাঁশির সুর। শুধু প্রণয়ই অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বসে ছিলো। যেনো ভীষণ অস্বস্তি জেঁকে ধরেছে তাকে। একটু পর পর হাত উঁচিয়ে কব্জিতে থাকা ঘড়িটির দিকে দৃষ্টি বুলাচ্ছিলো। কতো সময় বাজার অপেক্ষায় ছিলো কে জানে? তার পাশে কাঠের মোড়ায় বসে ছিলো রোমানা৷ প্রণয়ের এক বাহু চেপে ধরে কাঁধে মাথা রেখে পরম আবেশে চোখ বুজে ছিলো সে। ওদের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো অঙ্গন চৌধুরী। রাজু মুগ্ধ চোখে দেখছিলো রঙ্গন’কে। রঙ্গন কেমন চোখ বুজে সুরের ঘোরে চলে গেছে অন্য দুনিয়ায় সেটাই হয়তো ভাবছিলো রাজু। এমনই দৃশ্য তৈরি হওয়ার ঠিক মিনিট কয়েকের মধ্যেই ওদের কর্ণকুহরে ভেসে আসে,
-‘ ও মা গো। ‘
সঙ্গে সঙ্গেই বাঁশিওয়ালা রঙ্গন চৌধুরী’র বাঁশির সুর থেমে যায়। আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে প্রণয়’কে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রোমানা। অঙ্গন, রঙ্গন,রাজু তিনজনই ওদের নিজস্ব টর্চলাইট জ্বালিয়ে কুটির থেকে বেরিয়ে পড়ে। প্রণয়ও ত্বরিত গতিতে টর্চলাইট নিয়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়। কিন্তু রোমানা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তাকে। বিরক্ত হয়ে প্রণয় রোমানার হাত ছাড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ চুপচাপ এখানটায় বসে থাকো। ‘
প্রণয় বেরিয়ে যাওয়ার পর কিছুটা শঙ্কিত হয়ে ঠাঁই বসে রইলো রোমানা। এদিকে রঙ্গন,অঙ্গন,রাজু তিনজনই আর্তনাদকারী ব্যক্তিকে খুঁজতে খুঁজতে পুকুরঘাট অবদি এসে থামলো। পিছন থেকে প্রণয় বললো,
-‘ কাউকে পেলি? ‘
তখনই বাইজিগৃহের বাইরের ঐ জানালার নিচে ভূমিতল থেকে আবারো আর্তনাদের সুর ভেসে এলো,
-‘ ও মা গো… মরে গেলাম আম্মা… আমি মরে গেলাম।’
বিস্মিত হয়ে সকলেই তাকালো বাইজি গৃহের দিকে। সাংঘাতিক আশঙ্কায় সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠলো প্রণয়ের। একই আশঙ্কায় উপস্থিত সকলেই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। আজ শুক্রবারের রাত। বাইজি গৃহে আজ কিসের উল্লাস পুরোটাতেই অবগত প্রণয়,অঙ্গন এবং রঙ্গন৷ তাই কয়েক পল নিশ্চুপ সময় কাটিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো প্রণয়। রঙ্গন’কেও ইশারা করলো ফিরে যেতে। এমনই এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যে অঙ্গন কৌশলে রাজু’কে নিয়ে চলে গেলো পাঁচফোড়ন গৃহে। প্রণয় আর রঙ্গন কিছু সময় পার হতেই অরণ্যে ফিরে যেতে উদ্যত হলো। তখনই স্পষ্ট নারী কন্ঠের ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেলো। রঙ্গন বললো,
-‘ ভাই এটা দেয়ালের ভিতর নয় বাইরের আওয়াজ। ‘
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে প্রণয় বললো,
-‘ চল সামনে আগাই। ‘
ঘুরে দাঁড়িয়ে পুকুরের পাড় ঘেষে আগাতে থাকলো প্রণয়, রঙ্গন। পুকুরের কিনারা শেষ হওয়ার পরই টর্চ লাইট তাক করলো ভূমিতলে। বেল গাছের ডাল কেটে পালা আকারে জড়ো করে রাখা হয়েছিলো সেখানে। সে পালার একপাশে একটা দু’টো কাঁটাযুক্ত ডাল ছিলো। সেখানেই এক পা জড়িয়ে ধরে বসে আছে একটি মেয়ে। শোনা যাচ্ছে তার ক্রন্দনধ্বনি। আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলালো প্রণয় চৌধুরী। ভাবলো,
-‘ এই মেয়েটা নিশ্চয়ই বাইজি গৃহেরই কোন সদস্য। মনে হয় এই অভিশপ্ত গৃহ থেকে মুক্তি পেতেই পালানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু না পালিয়ে এভাবে বসে বসে কাঁদছে কেন? ‘
পরোক্ষণেই টর্চ উপরের দিকে ধরলো। দেখতে পেলো জানালা খোলা। নিজেকে রক্ষা করতে ঐ জানালা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিশ্চয়ই শরীরে বেশ আঘাত পেয়েছে? ভাবামাত্রই রঙ্গন’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘ রঙ্গন, মেয়েটা’কে জলদি তোর কুটিরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর। ‘
বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে নুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রঙ্গন। হাত বাড়িয়ে বললো,
-‘ এই মেয়ে হাতটা ধরো। ‘
নাক কুঁচকে পিছন ঘুরে দাঁড়ালো প্রণয়। গা ঘিনঘিনে এক অনুভূতি’তে সিক্ত হয়ে ওঠলো তার পুরো দেহ। না জানি কতো পুরুষের ভোগ্যবস্তু মেয়েটি। না জানি কতো পুরুষের নোংরা ছোঁয়ায় সিক্ত দেহ মেয়েটির। রঙ্গনের কি আক্কেল জ্ঞান জীবনেও হবে না? বিরবির করে কথাগুলো বলছিলো প্রণয় তখনি রঙ্গন বললো,
-‘ ভাই মেয়েটা তো আমাকে ভয় পাচ্ছে। ‘
প্রণয় ওদের দিকে না ঘুরেই উচ্চকণ্ঠে বললো,
-‘ ওকে বল আমাদের সঙ্গে যেতে কোন ভয় নেই। আমাদের সঙ্গে না গেলেই ওর জন্য বিপদ!’
[১০]
অস্বাভাবিক শঙ্কায় জর্জরিত হয়ে অবিরত কাঁপছে শাহিনুর। অজ্ঞাত দু’টো পুরুষ তাকে কোথায় নিয়ে এলো ভাবতেই গা শিউরে ওঠছে। তার জানা মতে, তার মা’য়ের ভাষ্যমতে সে মন্দ মানুষের হাতে পড়লো না তো! মন্দ মানুষ’রা যে খুব কষ্ট দেয়, তাকেও কষ্ট দেবে না তো? আবছা কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেলো শাহিনুরের –
তখন তার বয়স মাত্র ছয় বছর। মান্নাত’কে বিয়ে করে বাইজি গৃহে নিয়ে আসার পর সেদিনই প্রথম মান্নাতের সঙ্গে রাত কাটায় পলাশ। ছয় বছরের বাচ্চা মেয়েটি দরজায় ঠকঠক শব্দ করতে করতে বললো,
-‘মান্নাত বুবু ও মান্নাত বুবু তুমি কান্না করো কেন? কে মারছে তোমাকে, ও বুবু দরজা খোলো। ‘
-‘আরে খুকি তোমার মান্নাত বুবু সুখে কাঁদে সুখে, বড়ো হও এই সুখ কান্না তোমাকেও কাঁদাবো। ‘
ভিতর থেকে এমন কুৎসিত বাক্য শুনতেই পিছন থেকে শারমিন শাহিনুরের মুখ ছাপিয়ে ধরে টেনে নিয়ে গেলো নিজের ঘরে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। এটুকুন মনে পড়তেই আতঙ্কে বক্ষস্থল ধড়াস ধড়াস করে ওঠলো শাহিনুরের। শুষ্ক গলায় ঢোক গিলতে শুরু করলো অবিরত। ভুলে গেলো ক্ষত হওয়া দেহখানির কথা। কুটিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মৃদ্যু সুরে রঙ্গন বললো,
-‘ ভিতরে প্রবেশ করো বালিকা ভয় নেই আমরা খুবই ভালো মানুষ। ‘
এ’কথায় স্বল্প স্বস্তি পেলো শাহিনুর বারকয়েক ঢোক গিলে ধীরপায়ে প্রবেশ করলো ঘরের ভিতর। সেখানে রোমানা’কে দেখা মাত্রই অনেকটাই স্বস্তি পেলো। রোমানা বললো,
-‘ ও কে, এই মেয়েটাকে কথায় থেকে নিয়ে এলে? ওর গায়ে রক্ত কেন! ‘
ভয়ে শিউরে ওঠলো শাহিনুর। ক্ষতের কথা মনে পড়তেই ব্যথায় দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করলো। জড়োসড়ো হয়ে কম্পিত দেহে মাথা নিচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো গৃহতলে। তার পাশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো প্রণয়। একজন ডক্টর হিসেবে তার প্রথম দায়িত্ব মেয়েটির আঘাত সারিয়ে তোলা। পথমধ্যেই প্রণয় খেয়াল করেছে শাহিনুর লেংড়িয়ে লেংড়িয়ে হেঁটে এলো। তাই পা’য়ের আঘাত কতোটুকু তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কিন্তু বাইজি গৃহের এক সদস্যের শরীর সে স্পর্শ করবেনা। বাইজি, ঘুঙুরের শব্দ, সবটাতেই তার ভীষণ ঘৃণা। তাই হাসপাতালের এক সেবিকা’কে খবর পাঠানোর জন্য পাঁচফোড়ন গৃহের কোন ভৃত্য’কে প্রয়োজন তার। প্রণয় রোমানা’কে বললো,
-‘ রোমানা এখুনি গৃহে ফিরতে হবে আমাদের। ‘
-‘ আগে বলো এই মেয়েটা কে? ‘
রঙ্গন সবটা খুলে বললো রোমানা’কে। সবটা শুনে রোমানা জেদ ধরলো সে যাবেনা। বহুদিনের শখ তার বাইজি দেখবে। আজ এতো কাছে বাইজি পেয়ে এতো স্বল্প সময় দেখেই চলে যাবে? রোমানার জেদের কারণে অধৈর্য্য হয়ে মোড়ায় বসলো প্রণয়। এদিকে শাহিনুরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো রঙ্গন, রোমানা। কুটিরে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা থাকায় এ প্রথম স্পষ্ট ভাবে শাহিনুরের দিকে নজর পড়লো রঙ্গনের। তীক্ষ্ণ নজর দিলো রোমানাও। দু’জোড়া দৃষ্টি আপাদমস্তক ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখতে লাগলো শাহিনুর’কে। অথচ প্রণয় একটুর জন্য স্পষ্টভাবে শাহিনুর’কে দৃষ্টিপাত করেনি। অবাকান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোমানা। তীব্র অস্বস্তি, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে শাহিনুর। ঘনঘন পড়ছে চোখের পলক,কাঁপছে ওষ্ঠাধর। আচমকাই রঙ্গন বলে ওঠলো,
-‘ কে তুমি হৃদমোহিনী! ‘
রঙ্গনের বলা বাক্যটি শেষ হতেই গায়ের সর্বশক্তি শূন্য হয়ে মাটিতে বসে পড়লো শাহিনুর। দুর্বল চিত্তে কয়েক পলক ফেলে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ আমি শাহিনুর। ‘
আচমকাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো প্রণয়। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো,
-‘ বাইজি কন্যা! ‘
প্রণয়ের স্বরধ্বনি কারো কর্ণগোচর হলো না। শাহিনুরের দিকে মুগ্ধ চাহনিতে চেয়ে রঙ্গন বললো,
-‘ আমার ছোট্ট নীড়ে চাঁদের আলোর আগমন ঘটলো তবে…।’
-‘ বাজে বকা বন্ধ কর রঙ্গন এর চিকিৎসা প্রয়োজন। রোমানা ওকে ডিভানে ওঠে বসতে সাহায্য করো। ‘
প্রণয়ের হুকুম পেয়ে রোমানা শাহিনুর’কে ডিভানে নিয়ে বসালো। মেয়েটার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ যন্ত্রণায় ভুগছে। রোমানা খেয়াল করলো শাহিনুরের পরিহিত শুভ্র শাড়িটির কিছু অংশে রক্ত লেপ্টে রয়েছে। তাই বললো,
-‘ শাহিনুর তোমার শরীরে রক্ত কেন কিভাবে আহত হয়েছো তুমি? ‘
শাহিনুর শঙ্কিত হয়ে উত্তর দিলো,
-‘ আমার শরীরে কাঁটা বিঁধেছে আমাকে আম্মার কাছে নিয়ে যাও, আমি আম্মার কাছে যাব।’
ভ্রু কুঁচকে রঙ্গন বললো,
-‘ তোমার শরীরের সব কাটা আমি দূর করে দিব হৃদমোহিনী তুমি প্লিজ আম্মা আম্মা করোনা। ‘
মুগ্ধ চাহনিতে চেয়ে মৃদুস্বরে রঙ্গন কথাটি বলতেই চোখ গরম করে তাকালো প্রণয়। কিন্তু সেদিকে রঙ্গনের কোন খেয়াল নেই। অদ্ভুত হলেও সত্যি রঙ্গনের বক্ষস্থল থেকে অনেক বড়ো পাথর সরে গেছে আজ। এক পলকের দেখাতে যে নারী’টি তার বহুদিনের জমে থাকা বিষণ্নতা দূর করতে পেরেছে নিঃসন্দেহে সে নারী’টি কেবল তারই জন্য সৃষ্টি। এমনই ভাবনা আসা মাত্রই রঙ্গনের মনে পড়ে গেলো এক বাইজি’কে নিয়ে এমন অনুভূতি কি করে আসলো তার মনে? বাইজিরা শুধু তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে কিন্তু প্রিয়জন কি হতে পারে? সমস্ত ঘোর এক নিমিষেই কাটিয়ে ফেললো রঙ্গন। মুখ ভার করে বসে পড়লো মোড়াতে। এদিকে শাহিনুরের সামনে বসে শাহিনুরের বাম পা শূন্যতে তুলে এক মোচড় দিলো প্রণয়। ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠলো শাহিনুর। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-‘ আম্মাগো আমাকে মেরে ফেললো তুমি কই আম্মা!’
চোখ,মুখ শক্ত করে সরে দাঁড়ালো প্রণয়। শাহিনুরের পাশে গিয়ে বসলো রোমানা। মায়ার সুরে বললো,
-‘ আহারে বাইজি কেঁদো না। ও তোমাকে মারেনি তোমার পা মচকে গেছিলো তাই ঠিক করে দিলো। ও যে ডাক্তার ও মানুষ বাঁচায় মানুষ’কে মারে না। ও খুব ভালো। ‘
ঘুরে তাকালো প্রণয় চোয়ালজোড়া শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘ না জেনে কথা বলবে না রোমানা। এ বাইজি নয় বাইজি শারমিনের কন্যা শাহিনুর। আমার জানামতে এর বয়স ষোল হয়নি তাই এখনি এ’কে বাইজি উপাধি দেওয়া সাজে না। ‘
বিস্মিত হয়ে তাকালো রোমানা, রঙ্গন দু’জনেই। একদিকে বিস্ময় অপর দিকে দৃষ্টিজোড়া প্রজ্বলিত হয়ে ওঠলো রঙ্গনের। ক্ষীণ স্বরে রোমানা প্রণয়’কে প্রশ্ন করলো,
-‘বাইজি গৃহের খবর তুমিও রাখো প্রণয়! ‘
চোখ রাঙিয়ে তাকালো প্রণয় মাথা নিচু করে ফেললো রোমানা। প্রণয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শাহিনুরের দিকে। শুভ্রেরাঙা মুখশ্রী’টি আজ লালচে আভা ধারণ করেছে। হরিণাক্ষ দৃষ্টিজোড়াও রক্তিম বর্ণে পরিণত হয়েছে। টকটকে ওষ্ঠাধরের অবিরত কম্পন নাড়িয়ে দিচ্ছে সমস্ত সত্ত্বা। নিজেকে নিজ সত্ত্বায় অটল রাখার তীব্র চেষ্টা করে প্রণয় ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো শাহিনুরের দিকে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো শাহিনুর। ভ্রু কুঁচকে উৎকন্ঠিত মনে দাঁড়িয়ে পড়লো রঙ্গন। গা শিউরে ওঠলো রোমানারও। সকলের মনের তীব্র আশঙ্কাকে দূরে ঠেলে শাহিনুরের কাঁধ চেপে ওকে ঘুরিয়ে বসালো প্রণয়। তারপর পরিহিত শাড়ির আঁচল সরিয়ে রক্তাক্ত পিঠ,কোমড় দেখতে পেলো। কোমল দেহে বিঁধে থাকা কাঁটাগুলো প্রচন্ড ক্ষোভ সহকারে তুলতে শুরু করলো প্রণয়। ব্যথায় কুঁকড়ে গেলো শাহিনুর। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে এক পর্যায় জ্ঞান শূন্য হয়ে ডিভানেই শরীর ছেড়ে দিলো সে। প্রণয় বললো,
-‘ ওহ শীট। ‘
রঙ্গন বললো,
-‘ ভাই আমি এখুনি চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করছি।’

চলবে.
[]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here