বাইজি কন্যা পর্ব ৫+৬

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৫
[১১]
শাহিনুরের উন্মুক্ত পিঠে নিজ হস্তে যত্নসহকারে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলো প্রণয়। শঙ্কিত হয়ে প্রণয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। মনে করার চেষ্টা করলো এই মানুষ’টাকে সে কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায় একটুও মনে করতে পারলো না। তাই ঘরে থাকা ব্যক্তিদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সঙ্গে সঙ্গেই পুরো শরীর শিউরে ওঠলো তার। কারণ রঙ্গন, রোমানা দু’জনই তাকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখছে। ইতস্ততভাবে নড়েচড়ে বসলো শাহিনুর। রঙ্গনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেললো। বক্ষঃস্থলে শুরু হলো ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ আওয়াজ। সম্মুখের গৌরবর্ণের সুশ্রী পুরুষ’টির দৃষ্টিজোড়া কতো মোলায়েম… অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে যে পুরুষ লোকটি বেরিয়ে গেলো সে কতোই না কর্কশ! বেরিয়ে যাওয়া পুরুষ’টিকে স্মরণ হতেই আচমকাই শাহিনুরের মনে পলাশের ভয়ংকর মুখশ্রী’টা ভেসে ওঠলো। অদ্ভুত ভাবেই দু’টো মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত মিল খুঁজে পেলো। দু’জনের গায়ের রঙ যেমন গৌরশ্যাম তেমনি মোটা জোড়া ভ্রু। বিশাল দেহের অধিকারী কর্কশময় এই পুরুষ দু’টোর কি কোন সংযুক্তি আছে? ভাবতেই গা শিউরে ওঠলো শাহিনুরের। থমথমে মুখশ্রী’তে তাকালো রঙ্গনের দিকে। ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে হাসলো রঙ্গন, বসে থাকা মোড়াটি আরেকটু এগিয়ে ডিভানের সম্মুখীন হলো। দৃষ্টি তার তখনও পলকহীন। ঐ দৃষ্টি দেখে কিছুটা লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেলো শাহিনুর। তা দেখে রঙ্গন বললো,
-‘ তো মিস.নুর এবার বলা যাবে কি তুমি ঠিক কীভাবে কাঁটার সঙ্গে মাখামাখি হলে? ‘
উৎসুক হয়ে এগিয়ে বসলো রোমানাও। বললো,
-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের পুরো ঘটনাটি খুলে বলো নুর। ‘
অবিরত ঢোক গিলতে শুরু করলো শাহিনুর। একবার রোমানা আরেকবার রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলো সে ভীষণ ভীতু একটা মেয়ে। তার সে ভয়টুকু দারুণ উপভোগ করলো রঙ্গন। মুচকি হেসে বললো,
-‘ আপা নুরমনি যে খুব ভয় পাচ্ছে আমাদের। আচ্ছা আপা আমরা কি বাঘ না ভাল্লুক, এই নুর বনের ভিতর আছি বলে তুমি সত্যি সত্যি আমাদের বন্য প্রাণী ভাবছো না তো! হায় কপাল এই ছিলো আমার কপালে শেষকালে কিনা বন্য প্রাণী বানিয়ে দিলে আমায়? ‘
সকল ভয় জড়তা যেনো এক নিমিষেই কেটে গেলো শাহিনুরের। তার হরিণাক্ষ দৃষ্টিজোড়ায় ভর করলো একরাশ কৌতুহল। রঙ্গনের বলা কথাগুলো কেমন হাস্যরসাত্মক লাগলো তার কাছে। এমন সহজ,সুন্দর হাস্যজনক কথা কোন পুরুষ বলতে পারে! বিস্মিত হলো শাহিনুর। তার হৃদসিন্ধুপারে সৃষ্টি হলো ক্রমাগত ঢেউয়ের খেলা। মস্তিষ্কে কেবল বিচরণ করতে থাকলো কয়েকটি বাক্য –
-‘ এটাই কি তাহলে ভালো মানুষ? সবগুলো মন্দ মানুষের মাঝে কি একটা ভালো মানুষের দেখা মিললো? আম্মার কথা কি তাহলে সত্যি হলো? ‘
রোমানা বললো,
-‘ কি হলো নুর তুমি আমাদের ভয় পাচ্ছো কেন? আমরা খারাপ মানুষ নই আমরা দু’জনই ঐ জমিদার বাড়ির সদস্য। ও জমিদারের ছোট ছেলে আমি ওর খালাতো বোন। ‘
চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো শাহিনুর। অবাকান্বিত হয়ে বললো,
-‘ জমিদার বাড়িতে ভালো মানুষও আছে? ‘
এমন সহজসরল প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললো রঙ্গন। তার গোলাপি বর্ণীয় দীপ্তমান ওষ্ঠাধরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। রঙ্গন সে অবাক দৃষ্টিতে প্রগাঢ় চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে মোহনীয় সুরে বললো,
-‘ তোমার এই হাতটা সামনে ধরে দেখো একহাতে পাঁচ টা আঙুল রয়েছে। কিন্তু এখানে একই সমান দু’টো আঙুল খুঁজে পাবেনা। ঠিক তেমনি জমিদার বাড়িতেও অসংখ্য মানুষজন রয়েছে তারা কেউই কারো মতোন নয়। এ পৃথিবী’তে প্রতিটি মানুষই বিচিত্র শাহিনুর। ‘
ভ্রু কুঁচকে সত্যি সত্যি শাহিনুর নিজের ডানহাতটা সামনে ধরলো। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো নিজের আঙুল গুলো। সত্যি একটি আঙুলও সমান পেলো না। তাই অবাক হয়ে বললো,
-‘ তুমি তো সত্যি কথা বলেছো। তুমি আসলেই ভালো মানুষ। আম্মা বলেছে ভালোমানুষ’রাই সত্যবাদী হয়।’
-‘ তাই আর কি বলেছে তোমার আম্মা? ‘
উৎসুক নয়নে আরো অনেক কথাই বলার জন্য ওষ্ঠ নড়ালো শাহিনুর কিন্তু বলা হলো না। তার পূর্বেই রোমানা বললো,
-‘ রঙ্গন তুই কি উল্টাপাল্টা কথা শুনতে চাচ্ছিস তুই আগে এটা শোন ও কীভাবে এতো ব্যথা পেলো? কি হয়েছিলো ওর সাথে? ‘
রঙ্গন বললো,
-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ নুর তুমি আগে এটা বলো তুমি ওখানে কি করে এলে? ‘
নুর বললো,
-‘ বাঁশির সুর শুনে। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেলো রোমানার, অবাক হলো রঙ্গন। বললো,
-‘ তুমি বাঁশির সুর শুনে ওখানে এসেছো? ‘
-‘ না। ‘
-‘ তাহলে? ‘
হঠাৎই বিচলিত হয়ে ওঠলো শাহিনুর। নিঃশ্বাসে বেড়ে গেলো অস্থিরতা। এদিক সেদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে বললো,
-‘ তোমরা কি বাঁশিওয়ালাকে চেনো? সে কোথায় থাকে কি নাম তার জানো তোমরা? ‘
বাঁশিওয়ালা’কে স্মরণ হতেই শাহিনুরের এমন অদ্ভুত আচরণ শুরু হওয়াতে বিস্মিত হলো রঙ্গন,রোমানা দু’জনই। ওরা কিছু বলবে তার পূর্বেই শাহিনুর নিজে থেকেই বললো,
-‘ বাঁশিওয়ালা আজ কেন দেরি করে বাঁশি বাজালো? তার সুরের অপেক্ষায় জানালার চৌকাঠে বসে থাকতে থাকতেই আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। তারপর হঠাৎ যখন বাঁশির সুর শুনলাম তখনই ওপর থেকে সোজা নিচে পড়ে গেছি। ‘
পুরো ঘটনা এক দমে বিবৃতি করে থামলো শাহিনুর। এটাও বললো সে প্রায়ই রাত জেগে বাঁশির সুর শুনে। অজ্ঞাত বাঁশিওয়ালার প্রতি যে তার অদ্ভুত টান রয়েছে সেটাও স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলো ওদের। রঙ্গনের বক্ষঃস্থলে এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেলো। মাথা দুলিয়ে হাসলো রঙ্গন, পরিহিত প্যান্টের পকেট থেকে ত্বরিতগতি বাঁশি বের করে ওঠে দাঁড়ালো। শাহিনুরের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করলো। তারপর বাঁশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এক হাঁটু স্বল্প ভাঁজ করে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে দৃষ্টিজোড়া বদ্ধ রেখে ধরলো সুর, বাজলো বাঁশি। উৎকন্ঠা হয়ে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। রোমানা মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে বললো,
-‘ বাঁশিওয়ালার কাছেই বাঁশিওয়ালার খবর চাইলে? ‘
দু’চোখ জলে ভরে ওঠলো শাহিনুরের। শারীরিক যন্ত্রণাগুলো নাড়া দিলো খুব। বাঁশিওয়ালার সুর থামিয়ে অভিযোগ করতে ইচ্ছে করলো খুব,
-‘ ও বাঁশিওয়ালা আজ তোমার বাঁশি এতো দেরিতে কেন বাজলো? তোমার এই দেরিটুকুর জন্য আমি কতো ব্যথা পেয়েছি জানো? ‘
ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। তৃপ্তিসহকারে দেখতে থাকলো তার বাঁশিওয়ালাকে। ইশ কতো সুন্দর দেখতে বাঁশিওয়ালা’কে। তার কল্পনার চেয়েও বেশী সুন্দর মানুষ’টা। কল্পনার বাঁশিওয়ালার গায়ের চামড়া এতো সাদা ছিলো না। আর না ছিলো কপালজুড়ে লেপ্টে থাকা অমন বিনীত চুল। নাকটাও কল্পনায় কেমন মোটা গুরুগম্ভীর ছিলো অথচ সম্মুখের মানুষটা পুরোটাই কি প্রাণোচ্ছল। টকটকে চৌকা নাকের অধিকারী। এতো সুশ্রী পুরুষটার মোলায়েম স্পর্শে বাঁশিটাও কত্তো আনন্দে সুর দিয়ে যাচ্ছে… সীমাহীন মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন কিশোরী’র প্রগাঢ় চাহনি’তে চোয়ালজোড়া কঠিন হয়ে গেলো কর্কশময় পুরুষ’টির। আর এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে ধপাধপ পা ফেলে গৃহে পদার্পন করলো। সকল আনন্দ’কে নিরানন্দে পরিণত করে, সকল মুগ্ধতা’কে অসন্তোষে বিলিয়ে দিয়ে শাহিনুরের সম্মুখে দণ্ডায়মান হলো প্রণয়। প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে রোমানার দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ এখুনি চলো এখান থেকে। ‘
তারপর রঙ্গনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-‘ আর তুই,তুইও এখুনি বাড়ি ফিরবি। বাইরে বাইজি গৃহের ভৃত্য রেশমা খাতুন দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়ে’টাকে সেই যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। ‘
শেষ কথাটুকু প্রচন্ড চিবিয়ে চিবিয়ে বললো প্রণয়। তারপর জোরে জোরে বারকয়েক শ্বাস ফেলে তাকালো শাহিনুরের দিকে। দেখলো ভীতিগ্রস্ত একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। ক্রোধে ফেটে পড়লো প্রণয়,ধমকে ওঠে বললো,
-‘ লজ্জা করে না রাতদুপুরে বাঁশির সুর শোনার জন্য উৎকন্ঠা হয়ে জানালা ঝাপটে পড়ে যাও ‘
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৬
[১২]
পাঁচফোড়ন গৃহঃ
চারিদিকে ফজরের আজান ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পাঁচফোড়ন গৃহের সম্মুখে যে বিস্তর বাগানটি রয়েছে তার মাঝবরাবর রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে প্রণয়,রোমানা। এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের গৃহে।স্বভাবসুলভ গম্ভীরতা বজায় রেখেই এগুচ্ছে প্রণয়। তার অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিজোড়া ভূমিতলে স্থির। সেকেণ্ডে কতো কদম ফেলছে হয়তো সেই হিসেব নিকেশে বিভোর সে। আর তার পাশের রমণীটির ওপর অকস্মাৎ কোন বিষণ্নতা জেঁকে বসেছে তা একমাত্র উপরওয়ালা আর সেই জানে। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিলো না প্রণয়। সে তার মতো গৃহে প্রবেশ করে নিজ কক্ষে চলে গেলো। বক্ষঃস্থল দুমড়ে মুচড়ে গেলো রোমানার। এই যে তার ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। এই যে তার হাসিখুশি মুখটায় জমেছে একরাশ কালো মেঘ। সেটুকু কি একটুও খেয়াল করেনি প্রণয়? যদি করে থাকে একটিবার কেন জিজ্ঞেস করলো না ‘ কি হয়েছে তোমার রোমানা? ‘ প্রশ্ন তো দূরে থাক একটি বার ফিরেও তাকালো না। গতকালই তাকে দেখে কিছুটা হেসেছিলো। করেছিলো কিছু হৃদয় জুড়ানো বাক্য বিনিময়। ঐ অল্প বাক্য বিনিময়ও যেনো আজ থেমে গেছে। ঐটুকু পেলেও তো প্রাণটা শীতল থাকে তার। তবে ঐটুকু কেন আজ বন্ধ রইলো?
পাঁচফোড়ন গৃহ আজ বেশ রমরমা। সকাল সকাল জমিদারের পঞ্চ পুত্রেরই দেখা মিলেছে। বহুদিন পর পাঁচ পুত্রকে একসাথে ভোজনে বসিয়ে অলিওরের প্রথম স্ত্রী অরুণা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী প্রেরণার বক্ষঃস্থলে ভীষণ প্রশান্তি লাগছে। পাঁচ ভাই’দের মধ্যে সর্ব প্রথম আহার শেষ করলো প্রণয়। অরুণা কোন পুত্রের কি লাগবে তাই দেখছে। পুত্রদের খাওয়ানোর সময় কোন দাস-দাসীদের সহায়তা নিতে নারাজ অরুণা। দুই মা থাকতে তার অমূল্য রতন’দের দাস-দাসীদের সাহায্যে ভোজন করাতে হবে! ভাবতেই আত্মায় আঘাত লাগে খুব। তাই অরুণার আদেশেই পুত্রদের ভোজন পর্ব দুই মায়ের নেতৃত্বেই শেষ করা হয়। অরুণা তার পুত্রদের পেটপুরে খাওয়ানোতে ব্যস্ত। আর প্রেরণা সম্মুখে বসে দু’চোখ ভর্তি মায়া নিয়ে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে তৃপ্তি সহকারে পঞ্চ পুত্র’কে দৃষ্টিপাত করতে ব্যস্ত। যতোই হোক এরা তার নাড়ী ছেঁড়া ধন। একজন মানুষ সবার চোখে যতোই নিকৃষ্ট হোক না কেন মা’য়ের চোখে সর্বপ্রথম সে সন্তান ব্যতিত অন্য কিছুই নয়। যখন প্রেরণার পুত্র’রা অন্যায় কার্য করে, তখন সে মনে মনে দীর্ঘ প্রতিজ্ঞা করে, যে প্রাণগুলো সে পৃথিবীতে এনেছে সে প্রাণগুলোর বিনাশও সে নিজ হাতে করবে। কিন্তু পাপিষ্ঠ সন্তানগুলো যখন বাইরের নোংরা আবর্জনা গায়ে জড়িয়ে তার সম্মুখে প্রশস্ত এক হাসি নিয়ে দাঁড়ায় কলিজায় ছ্যাঁত করে ওঠে। মনে পড়ে যায় দীর্ঘ প্রসব বেদনার পর নিষ্পাপ এক একটি প্রাণ’কে ভূমিষ্ঠ করার আনন্দটুকু, ওষ্ঠকোণে ফুটে ওঠা তৃপ্তিদায়ক হাসিটুকু। যে সন্তান’দের জন্ম দিয়ে সেদিন নিজেকে সার্থক মনে করেছে আজ এতো সহজে কি করে নিজেকে ব্যর্থ মনে করবে? সে তো কোন মহীয়সী নারী নয় যে নিজেকে কঠিনরূপে পরিণত করে নিজ পাপিষ্ঠ সন্তান’দের শাস্তি দেবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রেরণা। তারপর প্রণয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-‘ তুমি কি আর একটা দিন থেকে যাবে প্রণয়? ‘
-‘ আজ থাকতে পারছিনা। আপনি মন খারাপ করবেন না আম্মা, সামনে সপ্তাহে আসবো ইনশাআল্লাহ দু’দিন থেকেও যাবো। ‘
স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো প্রেরণা এগিয়ে গিয়ে প্রণয়ের কপালে পরপর তিনটে চুম্বন দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ তুমি আসবে বলেছো আমার আর একটুও মন খারাপ হবে না বাবা। ‘
পাশ থেকে রঙ্গন কপাল এগিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ আম্মা আমি এক বছরের নামে বিদেশ চলে যাবো আমাকে একশটা চুমা দিন তাহলে। ‘
নিজের স্থানে বসতে বসতে প্রেরণা বললো,
-‘ বেহায়া ছেলে আমার। বড়ো মা’র থেকে আদর নে, এখন আমার সব আদর শুধু প্রণয়ের জন্য। ও চলে গেলে তোরা চার নাটক’বাজরাই তো সব আদর পাবি। ‘
ঈষৎ হাসলো প্রণয়। প্রশস্তভাবে হাসলো চারভাই’ই। সকলের আহার পর্ব শেষ হতেই অরুণা একজন দাসী’কে ডেকে বললো,
-‘ অন্দরে গিয়ে বউ’দের খেতে আসতে বলো। ‘
গৃহের পুরুষ’রা ভোজন পর্ব শেষ করে চলে যেতেই নারী’রা এলো। দাস-দাসী’রাও সকল বউ’দের খাবার বেড়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সর্বশেষে এলো পল্লব চৌধুরী’র দ্বিতীয় স্ত্রী জেবা। তাকে দেখেই অরুণা মুচকি হাসলো,বিরক্তি’তে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেললো প্রেরণা। কারণ গৃহের সব বউ’ই অতি সাধারণ ভাবে এসেছে। সকলের পরনেই সূতি শাড়ি গায়ে গহনা বলতে – একজোড়া সোনার কানের দুল,গলায় চিকন চেইন,দু’হাতে একজোড়া সোনার চিকন চুড়ি। রোমানা এ বাড়ি এলে সব সময় শাড়ি পড়লেও আজ শাড়ি পরেনি পরনে তার অতি সাধারণ সূতি সেলোয়ার-কামিজ । এ’সকল সাধারণ’দের মাঝে নিজেকে অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য বরাবরের মতোই উপস্থিত হলো জেবা। পরনে গাঢ় সবুজ রঙের একটি কাতান শাড়ি। লম্বা লম্বা কালো রেশম চুলগুলো বেনুনি করে বেনুনির শেষ মাথায় লাল টকটকে একটি কৃত্রিম গোলাপফুলওয়ালা চুলবাঁধার ফিতা। কপালে লাল টিপ,নাকে বেশ মোটা একটি স্বর্ণের নাকফুল। যদিও এটি জমিদার বাড়ির সকল বউ’দের নাকেই রয়েছে। এছাড়াও জেবার বেশভূষায় রয়েছে –
ওষ্ঠাধরে টকটকে লাল লিপস্টিক, গলায় বেশ ভারি সোনার হার,দু’হাতে দু’টো সোনার বালা, দু’পায়ে ঝনঝন শব্দ করা একজোড়া নুপুর। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের এই রমণী’টি নিজেকে অত্যাধিক সুদর্শনীয় করে তোলার জন্য মুখশ্রী এবং গণ্ডস্থল ভর্তি করে মুখে ব্যবহৃত সাদা পাওডার দিয়ে মুখশ্রী এবং গণ্ডস্থল মাত্রাতিরিক্ত সাদা করে ফেলেছে। এতে করে বোঝা যাচ্ছে সে তার চামড়ার ওপর সাদা জাতীয় পাওডারের প্রলেপ দিয়েছে। লম্বা, মাঝারি গড়নের নারী’টি বক্ষঃস্থল সটান করে ঝুমঝুম শব্দ তুলে, কোমর হেলিয়ে,দুলিয়ে ওষ্ঠকোণে আশ্চর্য ধরনের এক হাসি ফুটিয়ে তুলে সকলের সম্মুখে নিজেকে উপস্থিত করলো। তার এই আশ্চর্য ধরনের হাসিটির রহস্য খুঁজতে গেলে বোধহয় এটাই বের হবে সে নিজেকে কৃত্রিম ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য এতোটাই মগ্ন যে হাসিটা’কেও অত্যাধিক সুন্দর করতে গিয়ে কখনো প্রতিবন্ধী বা কখনো আধাপাগলার সরূপ ধারণ করে। চেয়ার টেনে শবনমের পাশে বসলো জেবা। শবনম চোখ রাঙিয়ে মাথায় ঘোমটা দিতে ইশারা করলো। জেবা জিহ্বা কামড়ে চটপটে কন্ঠে বললো,
-‘ ইশ আপা মনে নাই। ‘
এটুকু বলে দাঁত কেলিয়ে হেসে মাথায় কাপড় দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
-‘ আসলে আমি এতো লম্বা, আর আমার শরীর’টা এতো সুগঠিত যে শাড়িটাও আমার খাটো হয়। এই দেখো আঁচল মাথা অবদি আসেই না। আচ্ছা আপা আমি কি উনার সমান সমান নাকি একটু বেশী লম্বা?’
গলায় খাবার আঁটকে গেলো মুনতাহার। তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইলো রোমানা। প্রেরণা ঠাশ করে খাবার প্লেট টেবিলে রেখে বললো,
-‘ এতো সুগঠিত দেহ তোমার তবুও আমার ছেলে রাতবিরাতে বাইজি গৃহে কি করে? ঐ দেহ দিয়ে তো স্বামী’কেই আটকাতে পারো না রোজ রোজ সং সাজতে লজ্জা করে না? ‘
সকলেই কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো। কেবল বোকা বোকা হেসে জেবা বললো,
-‘ তিনি বলেছেন এ বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নারী আমি। তিনি এও বলেছেন এবারে জমিদার বাড়িতে বিশ্ব সুন্দরী পুরষ্কার প্রদান করা হবে। বিশ্ব সুন্দরী জেবা’ই পাবে সেই পুরষ্কার। ‘
এটুকু বলেই লজ্জায় মাথা নত করে খেতে শুরু করলো জেবা। প্রেরণা ক্রোধান্বিত হয়ে কিছু কটুবাক্য উচ্চারণ করতে যাবে তার পূর্বেই অরুণা তাকে থামিয়ে দিলো। ফিসফিস করে বললো,
-‘ বাদ যা ছোট বউ। জানোসই তো মেয়েটা আধপাগল।’
শবনম সহ বাকি সবাই হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জেবার দিকে। আশপাশের দাস-দাসীরাও গোপনে হাসছে। কিন্তু এসবে জেবার কিছু জায় আসে না সে তার মতোই পা দুলিয়ে দুলিয়ে ভোজন করছে। এক পর্যায় শবনম নিজের পা দিয়ে তার এক পা ঠেশে ধরে বললো,
-‘ কতোদিন বলবো খবার সময় পা নাচাবে না। তুমি কি আম্মার কাছে আরো অপমানিত হতে চাচ্ছো? ‘
এবারেও বোকা বোকা হাসলো জেবা জিহ্বা কামড়ে বেশ শব্দ করেই বললো,
-‘ ইশ আপা এক্কেবারে মনেই ছিলো না। ‘
[১৩]
বহুদিন পর পাঁচফোড়ন গৃহে চিরচেনা সুরটি শুনতে পেলো মুনতাহা। আচমকা বুকের ভিতর ধড়াস করে ওঠলো তার। যা নিতান্তই অনুচিত তাই ঘটলো বোধহয়। গোধূলি লগ্নে ছাদে বসে কে বাঁশি বাজাতে পারে এক নিমিষেই বোধগম্য হলো মুনতাহার। সেই সাথে ভীষণ করে অবাকও হলো। সত্যিই আশ্চর্য রঙ্গন চৌধুরী এ বাড়িতে বাঁশি বাজাচ্ছে! সুর বুনছে রঙ্গন চৌধুরী? শুধু যে সুর তা নয় প্রেমের সুরধ্বনি বাজছে। হঠাৎই বিষণ্ন সুরে প্রেমের আগমন যে? শূন্য বুকে তবে কি পূর্ণতা খুঁজে পেলো ? যে প্রেমের ঘরে তালা বন্ধ ছিলো এতোকাল সে তালা ভাঙলো কে? একরাশ কৌতুহল নিয়ে ধীরপায়ে ছাদে গেলো মুনতাহা। রঙ্গনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই থেমে গেলো বাঁশির সুর। মুনতাহার দিকে না ঘুরেই রঙ্গন মৃদ্যু সুরে বললো,
-‘ তুমি কি জানো মোর প্রেয়সী… আমার বাঁশি থামিয়ে দেওয়ার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে তোমার। ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here