বাইজি কন্যা পর্ব ৭+৮

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৭
-‘ তুমি কি জানো মোর প্রেয়সী আমার বাঁশি থামিয়ে দেওয়ার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে তোমার। ‘
-‘ ক্ষমতাটুকু না দিলেই হয়। ‘
-‘ মায়া,অনুভূতি, প্রেম এগুলোর জন্য কাউকে ঘটা করে ক্ষমতা দিতে হয় না মোর প্রেয়সী… আপনাআপনিই তৈরি হয়ে যায়। ‘
চোয়াল শক্ত করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে মুনতাহা। ছাদের রেলিংয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুনতাহার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রঙ্গন। ওষ্ঠাধরে মিলছে কিঞ্চিৎ পরিমাণ হাসি। কে জানে এই কিঞ্চিৎ হাসিটুকুর অর্থ কী? আশেপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে রঙ্গনের দিকে দৃঢ় চোখে চেয়ে মুনতাহা প্রশ্ন করলো,
-‘ নিশ্চয়ই তোমার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে রঙ্গন। নিশ্চয়ই পেয়েছো সেই নারী’র দেখা, যে নারী ফিরিয়ে এনেছে তোমার বাঁশির সুর। ‘
-‘ উহুম আমার বাঁশির সুর ক্ষণস্থায়ী ছিলো না এটা দীর্ঘস্থায়ী, সুরের মাঝে শুধু প্রেম সাদ্ধের বাইরে চলে গিয়েছে। তবে নতুন প্রেমের সূচনা হয়ে গেছে বোধ হয়৷ ‘
-‘ প্রেমের আবার নতুন পুরানোও হয়? ‘
-‘ কেন নয়? আমরা যেমন বহুবার হাসি তেমন বহুবার কাঁদিও৷ আমাদের জীবনে যেমন বহুবার হাসি আসে,বহুবার কান্না আসে, ঠিক তেমনি বহুবার প্রেমও আসে। ‘
কিছু বললো না মুনতাহা বরাবরই রঙ্গনের কাছে হেরে এসেছে সে আজও জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-‘ কে সে? ‘
-‘ বলবো তার আগে তুমি বলো চোখের নিচের এই কালোদাগ কীসের প্রতীক স্বামী’র সোহাগের নাকি অবজ্ঞা’র? ‘
কথোপকথনের এ পর্যায়ে মুনতাহা’র পিছনে এসে দাঁড়ালো পলাশ চৌধুরী। অকস্মাৎ পলাশের উপস্থিতি’তে সংযত হয়ে দাঁড়ালো রঙ্গন। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে রক্তিম হতে লাগলো তার ধবধবে ফর্সা মুখমণ্ডল। করুণ দৃষ্টিতে একবার মুনতাহা আরেকবার পলাশের দিকে তাকালো। বললো,
-‘ মেজো ভাইয়া ভাবি বোধহয় শুকনো কাপড়গুলো তুলতে এসেছিলো। আমার সাথে দেখা হওয়াতে কেবলই দাঁড়িয়েছে। ‘
মুচকি হাসলো পলাশ। বললো,
-‘ আমি আমার অতিশয় স্নেহের ভাই’য়ের থেকে কোন জাবাব চাইনা। কেবল অতি আদরের সহধর্মিণী’কে নিজ কক্ষে দেখতে চাই। ‘
সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো মুনতাহার। চোয়ালজোড়া কঠিন হতে শুরু করলো রঙ্গনের। এ মূহুর্তে তার ভাই’য়ের জায়গায় অন্য কোন পুরুষ থাকলে বিষয়টা তাণ্ডবে মোড় নিতো। কিন্তু ঠেঁকে গেছে এক জায়গাতেই মানুষ টা তার শ্রদ্ধেয় বড়ো ভাই। নিজ ভাই এবং ভাই’দের স্ত্রী’র প্রতি জমিদারের সকল পুত্রই অগাধ শ্রদ্ধাশীল। সেই সাথে ছোট ভাই’রা বড়ো ভাই’দের ওপর একটা কথাও বলার সাহস রাখে না। এদের মাঝে কেবল প্রণয় ভিন্নধর্মী স্বভাবের বলে এক গৃহে থাকাই তার জন্য কষ্টসাধ্য। না সে এ গৃহে থাকে আর না এসব অদ্ভুত বিষয় মেনে চলতে হয় তাকে৷ তার মধ্যে নীতি একটাই সঠিক সঠিক’ই। আর ভুল ভুল’ই। বড়োরা ভুল করবে বলে ছোটরা চুপচাপ থাকবে সঠিকটা বুঝাবে না এই নীতি সে মানতে পারে না। কখনো কখনো ছোটদের মতো বয়সে বড়োরাও ভুল করতে পারে এই জ্ঞান ধারণ করে ভুল পথে চালিত বড়ো’দের ছোটরাও সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে বা সঠিক জ্ঞান দিতে পারে এই ধর্মে সে প্রবল বিশ্বাসী। কিন্তু তার এ বিশ্বাস’কে জমিদার বাড়িতে মূল্যায়ন করা হয় না,ভবিষ্যৎে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তাই যা সহ্য করতে সে অক্ষম প্রতিনিয়ত তা সহ্য করে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাই গৃহ ত্যাগ করে পরিবার পরিজন ছেড়ে নিজ যোগ্যতায় দূরে থাকে সে। এতে জমিদার বাড়ির অপকর্ম থেকে যেমন দূরে থাকে তেমন ভাই’য়ে ভাই’য়ে দ্বন্দ, পিতা-পুত্রের দ্বন্দ ঘটারও শঙ্কা থাকে না৷ কিন্তু সব মানুষ তো একই বৈশিষ্ট্যের হতে পারেনা৷ পারেনি রঙ্গনও। তাই তো নিজের ভালোবাসার মানুষ’টির থেকে প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েছিলো সে৷ মেনে নিয়েছিলো সে প্রাণ প্রেয়সী’কে নিজের বড়ো ভাই’য়ের বউ রূপেও। এবং প্রতিনিয়ত মেনে নিতে হচ্ছে এক প্রিয়জন দ্বারা অপর প্রিয়জনের প্রতি হওয়া অন্যায় গুলো’কে। রঙ্গনের চক্ষের সম্মুখে মুনতাহার একটি হাত গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেপে ধরে নিজ কক্ষে গেলো পলাশ৷ বদ্ধ ঘরে স্বামী-স্ত্রী’র অসংখ্যবার প্রেমময় উত্তাপ সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু পলাশ মুনতাহা দম্পতির বদ্ধঘরে সৃষ্টি হয় বিধ্বংসী লীলাখেলা। যেই লীলাখেলার হাহাকার থেকে বাঁচার প্রয়াসে ঘন অন্ধকারের নিস্তব্ধ অরণ্য’কেই বেছে নিয়েছে রঙ্গন। কিন্তু আজ নিরুপায় সে। যা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার’ই ভয়ংকর সাক্ষী হলো আজ! পলাশের কক্ষের পাশের সিঁড়িতে ধপ করে বসে পড়লো সে। ভিতর থেকে হঠাৎই থেমে গেলো মুনতাহার আর্তনাদ। শঙ্কিত হয়ে ওঠে দাঁড়ালো রঙ্গন৷ আশঙ্কা হলো অত্যাধিক শারীরিক অত্যাচারে জ্ঞান হারায়নি তো মুনতাহা? বদ্ধ উন্মাদ হয়ে আশপাশে ঘুরতে শুরু করলো রঙ্গন।
এক পর্যায়ে নজর পড়লো পলাশের কক্ষের জানালা খোলা, পর্দাগুলোও মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। কোন দিক না তাকিয়ে কোন কথা না ভেবে কেবলমাত্র মুনতাহা ঠিক আছে কিনা এটুকু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছুটে দাঁড়ালো জানালার পাশে। দুরুদুরু বুকে শুধুমাত্র একনজর বিছানায় তাকালো। শুভ্র রঙের মোটা রশি দিয়ে বিছানার সঙ্গে চার হাত,পা বেঁধে মুনতাহার নগ্ন শরীরে তাণ্ডব করছে পলাশ৷ ওষ্ঠাধর ফাঁক করে মাঝবরাবর ওড়না জাতীয় একটি সূতি কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে রেখেছে যাতে ভিতরে শব্দ বাইরে না পৌঁছাতে পারে৷ কিন্তু কান্নার শব্দ গোঁ গোঁ স্বরে স্বল্প পরিমাণ ঠিক ধাক্কা খেলো রঙ্গনের কর্ণকুহরে,ধ্বংসাত্মক এক দৃশ্য দেখলো অসহনীয় চক্ষুদ্বয়ে। অভিঘানিত হয়ে সরে দাঁড়ালো রঙ্গন৷ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। রাগে,দুঃখে জর্জরিত হয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। বেখেয়ালি হয়ে পুরো দেহ কোন রকমে চালিত করে বেরিয়ে গেলো পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে। মুনতাহা ভাবে রঙ্গন’কে প্রত্যাখ্যান করার শাস্তিই সে পাচ্ছে। রঙ্গনের অভিশাপেই আজ তার জীবনের এই অধঃপতন। এ’কথা একদিন নিজ মুখেই রঙ্গন’কে জানিয়েছিলো মুনতাহা৷ সে কথা স্নরণ হতেই রঙ্গন আকাশপানে তাকালো। বিরবির করে বললো,
-‘ হে প্রভু তুমি তো জানো আমি কোন অভিশাপ দেইনি। তাহলে ঐ নিষ্পাপ মেয়েটা কোন শাস্তি ভোগ করছে কোন শাস্তি? ‘
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে পাঁচফোড়ন গৃহের সম্মুখে বাগানের মাঝবরাবর হাঁটু গেড়ে বসে শেষ বাক্যটুকু চিৎকার করে বললো রঙ্গন। পুরো পাঁচফোড়ন গৃহ’ই যেনো কেঁপে ওঠলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো কিছু হাহাকার,
-‘ এই ভালোবাসার জন্য তুমি আমায় প্রত্যাখ্যান করলে মুনতাহা এই ভালোবাসা? আমার জীবনে যাই ঘটুক তোমার এই ক্ষতটা আজীবন পুরাবে আমায়। তোমার ঐ দৃষ্টিতে আমি অভিযোগ ব্যতিত কিছুই খুঁজে পাইনা। আজকের পরও হয়তো অভিযোগ পাবো,ধ্বংসাত্নক এক অভিযোগ। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার কেবল একটাই অভিযোগ কেন ভালোবাসলে না আমায়? একটু ভালোবাসা, একটু অধিকারই তো চেয়েছিলাম, বিনিময়ে আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকতাম। বিশ্বাস করো একটুও ছলনা করছি না একটুও না৷ এই রঙ্গন পুরো পৃথিবীর সাথে ছলনা করতে পারে কিন্তু মুনতাহার সঙ্গে চুল পরিমাণ ছলনার কথা সে ভাবতেও পারে না। নিয়তির কাছে আমার একটাই অভিযোগ আমি কেন তোমার গোলাম হওয়ার সুযোগটুকু পেলাম না, কেন? ‘
আহত হৃদয়ে ওঠে দাঁড়ালো রঙ্গন। ভাঙাচোরা শরীরের ন্যায় চলতে শুরু করলো নিজ গন্তব্যস্থলে। অরণ্যের কুটীরে প্রবেশ করে ডিভানে গা এলিয়ে দিলো রঙ্গন৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখজোড়া বন্ধ করলো। দু’ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো চোখের কোণা দিয়ে। মুখ দিয়ে অস্ফুটে স্বরে আওড়ালো,
-‘ আমি তোমায় অভিশাপ দেইনি মুন বিশ্বাস করো আমি তোমায় একটুও অভিশাপ দেইনি। ‘
[১৪]
ফজরের আজানের পরপরই বাইজি গৃহের মহিলা ভৃত্য রেশমা খাতুনের মেয়ে সখিনা শাহিনুর’কে ডেকে তুললো। বললো,
-‘ নুর এই নুর ওঠ ওঠ তাড়াতাড়ি ওঠ জমিদারের বাগান বাড়ি যাবি না? ‘
ঘুমকাতুরে কন্ঠে শাহিনুর বললো,
-‘ আরেকটু পর যাই সখী আরেকটু ঘুমাই। ‘
-‘ না না আর ঘুমানো যাবোনারে তাহলে আমরা ধরা পড়ে যাব তাড়াতাড়ি ওঠ নুর এখনি সময়। ‘
আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসলো শাহিনুর। দু’হাতে দু’চোখ কচলে বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো সখিনার দিকে। বললো,
-‘ চল সখী চল আজ আমরা জমিদার বাড়ির ফুল চুরি করবো। জমিদারের ছেলে আমার মন চুরি করেছে আমার তো তার মন চুরি করার দুঃসাহস নাই। আমি বরং ফুল চুরি করেই মন’কে স্বান্ত্বনা দেই। ‘
এটুকু বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করলো শাহিনুর। সখিনা অপলক চেয়ে রইলো তার মুখপানে। শাহিনুরের স্নিগ্ধ মুখশ্রী,প্রাণখোলা নিষ্পাপ হাসি বরাবরই মুগ্ধ করে তাকে৷ সমবয়সী হওয়ার সুবাদে সখিনার সাথে শাহিনুরের বেশ সখ্যতা রয়েছে। শাহিনুর বাইজি কন্যা, সখিনা এক ভৃত্য কন্যা এতে বিন্দুমাত্র বিভেদ নেই তাদের মধ্যে। বরং গড়ে ওঠেছে অতুলনীয় বন্ধুত্ব। প্রায় সময়ই একসাথে কাটায় তারা। মাঝে মাঝে রাতেও এক সঙ্গে ঘুমায়। গতরাতেই দুই সখী মিলে পরিকল্পনা করেছে জমিদার বাড়ির বিশাল বাগান থেকে ফুল চুরি করবে তারা। দিনের আলোতে সেখানে যাওয়ার সাহস নেই। শারমিন তাকে যেতেও দেবেনা৷ তাই সবার অগোচরে দুই বান্ধবী মিলে চললো জমিদার বাড়ির বাগানের ফুল চুরি করতে….
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৮
সূর্যোদয় ঘটা মাত্রই জমিদার বাড়ির ভৃত্যগণরা (চাকর) নিজেদের দায়িত্ব পালনে তৎপর হয়ে ওঠেছে। রোমানা ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের দিকে চলে এসেছে। নানা প্রজাতির ফুল ফুটেছে বাগানে। তরতাজা ফুলগুলো দেখে মনটা প্রশান্তি’তে ভরে গেলো রোমানার। এক নিমিষেই ভুলে গেলো তার সকল বিষণ্নতাগুলো’কে।সদ্য ফুটে ওঠা বিভিন্ন রঙের গোলাপফুল গুলো বারে বারে ছুঁয়ে দেখতে থাকলো। পুরো বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছিলো সে। এক পর্যায়ে পাঁচফোড়ন গৃহের বাম পাশের শেষ কিনারায় শিউলি ফুলগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। শিউলি ফুলের গন্ধে ঘিরে আছে চারপাশ। মারাত্মক মোহনীয় এই ফুলের ঘ্রাণে যেনো অন্তর আত্মাও তাজা হয়ে ওঠে। গায়ে পরিহিত চাদরটা আরো গভীর ভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে চোখ বুজে লম্বা এক শ্বাস নিলো রোমানা। তারপর চোখ খুলতেই দেখতে পেলো কিনারার দেয়ালের নিচে দু’জোড়া হাত। টপাটপ একটি, দুটি করে শিউলি ফুল কুড়াচ্ছে। জমিদার বাড়ির পুরো দেয়ালই ভূমিতল থেকে কিছুটা উপরে। যার ফলে নিচ দিয়ে অনায়াসে হাত দিয়ে ফুল কুড়ানো যাচ্ছে। এটুকু দেখে মৃদু হেসে ফেললো রোমানা। তারপর চুপিচুপি ফুলচোর গুলো’কে ধরার জন্য মেইন গেটে দিয়ে বের হয়ে সোজা চলে গেলো বাম পাশে। শাহিনুর আর সখিনার পিছন গিয়ে বেশ গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ এই মেয়েরা তোমাদের স্পর্ধা তো কম নয়, জমিদার বাড়ির ফুলচুরি করতে আসো!’
চোখ বড়ো বড়ো করে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ওঠে দাঁড়ালো দু’জন। কিন্তু পিছন ঘুরতেই গাঢ় সোনালি রঙের সূতি শাড়ি, দু’কাধ জড়িয়ে রাখা পশমি চাদর পরিহিত রোমানা’কে দেখেই চোখজোড়া চকচক করে ওঠলো শাহিনুরের। সখিনার বাহুতে কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-‘ সখী ভয় পাস না এই আপা’কে আমি চিনি। ‘
রোমানার হাসিটা বেশ চওড়া হয়ে গেলো,অবাকান্বিত কন্ঠে বললো,
-‘ নুর! তুমি এখানে? আমি ভাবতেই পারিনি তোমার সাথে আবারও দেখা হবে। ‘
দু’কদম এগিয়ে এলো রোমানা। নুরের একটি হাত ধরে বললো,
-‘ তুমি মাটিতে পড়া ফুল নিচ্ছো কেন নুর? চলো আমি তোমাকে গাছ থেকেই ফুল ছিঁড়ে দেবো। ‘
আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সখিনা। জমিদার বাড়ির কোন মানুষ তাদের এতো সমাদর করে কথা বলছে! ভাবতেই গা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার৷ এদিকে শাহিনুর তো খুশিতে আটখানা হয়ে নিজের শাড়ির আঁচলে টোপলা বাঁধা ফুলগুলোর দিকে তাকালো। বললো,
-‘ আমিতো আজ অনেক ফুল নিয়েছি বকুল ফুল, জবা ফুল,শিউলি ফুল আজ আর লাগবে না। ‘
রোমানা কিছুটা মন খারাপ করে বললো,
-‘ আর একটা ফুল নাও না নুর, তুমি তো গোলাপ ফুলই নাও নি। চলো আমার সাথে আমি অনেক ফুল দেবো তোমাকে চলো না… ‘
-‘ কেউ বকবে না তো? ‘
-‘ না নুর কেউ বকবে না তুমি চলো আমার সঙ্গে। ‘
নুর এবার তার ডাগর ডাগর দৃষ্টিজোড়া দিয়ে সখিনার দিকে তাকালো। বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে অধরে কিঞ্চিৎ কামড়ে ধরে বললো,
-‘ তুই আম্মাকে বলবিনা তো? ‘
সখিনা বামদিক,ডানদিক মাথা ঘুড়িয়ে না বোঝালো। শাহিনুর ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে হাসলো। রোমানার দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ ভালো আপা তুমিও কিন্তু আম্মাকে কিছু বলবে না।’
-‘ আমি তোমার আম্মাকে চিনিই না। ‘
দু’হাত উঁচিয়ে কথাটা বলতেই শাহিনুরের ওষ্ঠকোণে দুষ্টু হাসির দেখা মিললো। বললো,
-‘ তাহলে চলো আপা যাই। ‘
শাহিনুর আর সখিনাকে পুরো বাগান ঘুরে ঘুরে দেখাতে শুরু করলো রোমানা৷ শাহিনুর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলো। কখনো কখনো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকলো একেকটা ফুলকে। যেনো সে ফুল ছুঁয়ে সার্থক আর ফুলগুলো তার ছোঁয়া পেয়ে সার্থক। সখিনা ভয় পাচ্ছে, প্রচুর ভয় পাচ্ছে। তাই বাগানের কোন সৌন্দর্যই সে উপভোগ করতে পারছে না৷ আর রোমানা অবাক চোখে শাহিনুর’কে দেখছে,আর ভাবছে,
-‘মেয়েটা এতো সুন্দর কেন? এতো ভালো কেন লাগে ওকে আমার? এমন স্নিগ্ধ মুখশ্রী এই তল্লাটে আর একটিও নেই বোধহয়। ‘

শাহিনুরের ঢেউ খেলানো কৃষ্ণবর্ণ চুলগুলোর দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে ভাবলো, তার চুল যদি ঢেউ খেলানো হতো তাকেও কি এমন সুন্দর লাগতো? পরোক্ষণেই ভাবলো এমন লাগবে কি করে? সে তো এই মেয়েটার মতোন অমায়িক ভাবে হাসতে পারেনা। তার তো অমন হরিণীর মতো চোখ নেই। ইশ চোখজোড়া যেনো কারো নিজ হাতে এঁকে দেওয়া…
-‘এতো সুন্দর কেন নুর? আমি মেয়ে হয়েও ওর রূপে বিমোহিত হয়ে যাচ্ছি। ইচ্ছে করছে দীর্ঘসময় চেয়ে থাকতে, মেয়েটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। ‘
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজ হাতে একটি লাল গোলাপ ছিঁড়ে শাহিনুরের হাতে দিলো রোমানা। বললো,
-‘ এই গোলাপটার চেয়েও তুমি বেশী স্নিগ্ধ নুর। ‘
আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো নুর। ভেঙে ভেঙে বললো,
-‘ স্নিগ্ধ মানে কি আপা? ‘
হেসে ফেললো রোমানা শাহিনুরের কাঁধ চেপে ধরে বাগানের এক পাশের দোলনাতে গিয়ে দু’জন বসলো। সখিনা বসলো পাশের দোলনাতে। তারপর রোমানা বললো,
-‘ স্নিগ্ধ মানে পবিত্র তুমি খুব পবিত্র নুর। তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে, বড্ড লোভ হয় তোমাকে আমার। ‘
কিছুই বুঝলো না শাহিনুর কিছুক্ষণ রোমানার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
-‘ আপা গোলাপ’কে ফুলের রাণী বলা হয় তাইনা…আমি জানি। ‘
সম্মতি প্রকাশ করে রোমানা বললো,
-‘ তুমি ফুল খুব ভালোবাসো? ‘
-‘ আমার তো সবই ভালো লাগে। ‘
মাথা হেলিয়ে কথাটা বলতেই সখিনা বললো,
-‘ নুর আয় যাই গা। ‘
রোমানা বললো,
-‘ আরেকটু বসো না তোমরা, আমার তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে ভালোই লাগছে। এতো বড়ো বাড়িতে একটু আলাপ করার মানুষের খুব অভাব। ‘
শাহিনুর বললো,
-‘ কেন এই বাড়িতে কেউ গল্প করে না বুঝি? ‘
-‘ সে গল্প না হয় আরেকদিন দেখা হলে করবো। আজ তোমার কথা শুনি, তোমরা হঠাৎ এখানে এলে কেন ভয় করলো না? যদি দাঁড়োয়ান চাচা দেখতো খুব বকতো জানোনা? ‘
-‘ ফুল কুড়ানোর শখ ছিলো কিন্তু আম্মাতো বের হতে দেয় না৷ তাই চুরি করে বেরিয়ে চুরি করেই ফুল কুড়াচ্ছি৷ ‘
কিছুটা মন খারাপ করে আবার বললো,
-‘ আম্মা যখন আমাকে ছড়া পড়াতো তখন থেকেই আমার খুব ফুল কুড়ানোর ইচ্ছে হয়েছিলো। কতো আনন্দ হয় ফুল কুড়ালে, আম্মা আমাকে এমন আনন্দ পেতেই দেয় না। ‘
শাহিনুরের মন খারাপ দেখে রোমানা বললো,
-‘ আরে আরে মন খারাপ করছো কেন মা’য়েরা এমন শাসন করেই। আচ্ছা নুর কোন ছড়া পড়ে তোমার ফুল কুড়ানোর ইচ্ছে হলো শুনি আমিও তাহলে সেই ছড়া পড়ে তোমার মতোন সক্কাল সক্কাল ফুল কুড়াতে চলে আসবো। ‘
কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো শাহিনুর। তারপর বললো,
– ‘ আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা,
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই।
মামার বাড়ি পদ্মপুকুর
গলায় গলায় জল,
এপার হতে ওপার গিয়ে
নাচে ঢেউয়ের দল।
দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে
লাল শালুকের ফুল,
রাতের বেলা চাঁদের সনে
হেসে না পায় কূল।’
এটুকু ছড়া আবৃত্তি করেই খিলখিলিয়ে হাসলো শাহিনুর। হাসলো সখিনা আর রোমানাও। শাহিনুর বললো,
-‘ এক ঝাঁক ছেলে মেয়ে হলে বেশ মজা হতো তাইনা সখী, তাইনা আপা? ‘
রোমানা বললো,
-‘ সত্যি তোমার কথা শুনে ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা নুর তুমি কি স্কুলে যাও? ‘
মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো শাহিনুর। রোমানা বললো,
-‘ তাহলে তুমি এসব তোমার আম্মার কাছেই পড়ো? ‘
-‘ হ্যাঁ। আম্মা বলেছে মা’ই প্রধান শিক্ষক। আমার আর কোন শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। ‘
কথোপকথনের এ’পর্যায়ে অলিওর চৌধুরী’র দ্বিতীয় স্ত্রী প্রেরণা ফুলের ডালা হাতে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে বললো,
-‘ রোমানা তুই এখানে? ওরা কে? ‘
-‘ ও শাহিনুর আর ও সখিনা। নুর’কে খুব সুন্দর দেখতে তাইনা খালামুনি? ‘
এবারে প্রেরণা শাহিনুরের দিকে বিচক্ষণ দৃষ্টিতে তাকালো। পাতলা গড়নের শুভ্রবর্ণীয় দেহে হলুদ রঙের লাল পাড়ের সূতি শাড়ি পরিহিত শাহিনুর। অর্ধেক আঁচল কোমড়ে বাঁধা বাকি আঁচলে ফুল সংরক্ষিত করা। প্রেরণা বেশ ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-‘মাশাআল্লাহ বাড়ি কোথায় তোমার? ‘
-‘ এখানেই ঐ যে বাইজি গৃহে। ‘
বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো প্রেরণা। এক চিৎকার দিয়ে ডাকলো দ্বাররক্ষী চন্দন দাস’কে। চন্দন এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ রোমানা অবাক হয়ে প্রেরণার কাঁধ চেপে ধরলো। বললো,
-‘ খালামুনি চন্দন চাচার কোন দোষ নেই ওদের আমি নিয়ে এসেছি। ‘
-‘ তুই! তুই! আমাকে ছুঁবিনা, ছুঁবিনা আমাকে তুই। সর, সর,যা এখনি বাড়ি গিয়ে গোসল সারবি। নয়তো আজ আমি তোকে মারবো রোমানা! ‘
খালামুনির অকস্মাৎ আচরণগুলোতে বড্ড আহত হলো রোমানা। বললো,
-‘ এমন করছো কেন খালামুনি ওরা খুব ভালো। ‘
এবারে আরো চেঁচামেচি শুরু করলো প্রেরণা। গৃহের ভিতর থেকে ত্বরিতগতি’তে বেড়িয়ে এলো শবনম। তার সাথে দু’জন কাজের মহিলাও এলো। শাহিনুর আর সখিনা প্রচন্ড ভীতিগ্রস্ত হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রেরণা এবার কেঁদেই ফেললো। শবনম’কে দেখামাত্রই বললো,
-‘ সর্বনাশ হয়ে গেছে বউ ঐ কলঙ্কিনীদের পা এ বাড়ি’তেও পড়ে গেছে। আমার সোনার সংসারে এই কলঙ্কের ছাঁয়া এখন আমি কীভাবে দূর করবো! ‘
দৃষ্টিজোড়া বড়ো করে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে শাহিনুর আর সখিনার দিকে তাকালে শবনম। রোমানা’কে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
-‘ কি হয়েছে? ‘
রোমানা কম্পিত কন্ঠে বললো,
-‘ বড়ো ভাবি ওদের কোন দোষ নেই আমিই ওদের নিয়ে এসেছি। ‘
-‘ কিন্তু ওরা কারা রোমানা? ‘
-‘ ও শাহিনুর আর ও সখিনা। ‘
শবনম সখিনার দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ তোমাদের বাড়ি কোথায়? ‘
সখিনা কাঁপা গলায় বললো,
-‘ আমার বাড়ি পশ্চিমপাড়া আর ও বাইজি গৃহে থাকে। বাইজি গৃহের কাজের মানুষ আমার আম্মা। ‘
সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠলো শবনমের। ভয়ংকর ক্রোধ দেখিয়ে বললো,
-‘ ওদের ভেতরে নিয়ে এসে একদম ঠিক করোনি রোমানা। কোন নোংরা মেয়ে মানুষের পা এ বাড়ি পড়ুক এটা আমরা কেউ চাইনা। চাইনা বলেই আমাদের গৃহে এদের স্থান দেইনি। ‘
দু’চোখ বেয়ে অঝড়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করলো শাহিনুরের। এবার সে হারে হারে টের পাচ্ছে তার আম্মা কেন তাকে নিষেধ করতো। কেন তার আম্মা এ বাড়ির মানুষ জন থেকে আড়ালে থাকে, তাকে আড়ালে রাখে। কিন্তু জমিদার, জমিদারের ছেলেরা তো ঠিক তাদের গৃহে যায় তখন তো কিছু হয় না!
প্রেরণা অসম্ভব পরিমাণে রাগান্বিত হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সকল’কে ভিতরে যাওয়ার আদেশ দিয়ে চন্দনকে বললো,
-‘ চন্দন এদের’কে এদের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আয়। আর বুঝিয়ে দিয়ে আয় পরবর্তী’তে যেনো এই ভুল না হয়। ‘
রোমানা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-‘ খালামুনি ওদের কোন দোষ নেই ওদের কিছু বলো না। ‘
প্রেরণা বললো,
-‘ বড়ো বউ ওকে ভিতরে নিয়ে যাও আর জলদি গোসল সেরে নিতে বলো। নোংরা মেয়েটার সঙ্গে বসে ছিলো ছিঃ!’
চোখ, মুখ রক্তিম হয়ে গেলো শাহিনুরের নত হওয়া মাথাটা হঠাৎই উঁচিয়ে প্রেরণার দিকে কোমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বললো,
-‘ আমি নোংরা না, দেখো আমার শরীরে একটুও ময়লা নেই। আমি কোন নোংরা কাজও করিনি। আমি খুব ভালো মেয়ে বিশ্বাস করো। ‘
-‘ এ্যাহ ভালো মেয়ে তুই কি করে ভালো হলিরে থাকিস তো বাইজি গৃহে ভালো হলি কি করে শুনছি এক বাইজির মেয়ে তুই না না কিসের বাইজি এক পতিতার মেয়ে তুই। ‘
পতিতা শব্দের অর্থ বুঝলোনা শাহিনুর কিন্তু বাকিটুকু ঠিক বুঝলো তাই এক কদম এগিয়ে এসে বললো,
-‘ বাইজি গৃহে যারা থাকে তারা ভালো নয়? ‘
-‘ না তোরা নোংরা, পাপিষ্ঠ তোদের মতো পাপিষ্ঠদের পা এই গৃহে পড়া মানে এই গৃহটিও অপবিত্র হয়ে যাওয়া। ‘
-‘ তাহলে এ বাড়ির জমিদার, জমিদারের ছেলেরা যে বাইজি গৃহে যায়? ওরা তো আমাদের নোংরা বলে না। তুমি মিথ্যা বলছো আমরা নোংরা না, আমার আম্মা নোংরা না, আমার মান্নাত বুবু নোংরা না। নোংরা হলে জমিদার সাহেব কোনদিন সেখানে যেতো না। ‘
বিস্মিত হয়ে শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে রইলো সকলেই। আজ তাদের কোন দিন এলো যে এক বাইজি কন্যা জমিদার গিন্নি’কে প্রশ্ন করে! প্রেরণা কিছুটা দমে গেলো এবার। ক্ষীণ স্বরে চন্দন’কে বললো,
-‘ এই মেয়ে’কে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যা চন্দন। ‘
চন্দন ধমকে ওঠলো শাহিনুর’কে। কেঁপে ওঠলো শাহিনুর। চন্দন বেশ শক্ত হাতে তার ছোট্ট নরম হাতটা চেপে ধরলো। ব্যথায় কুঁকড়ে গেলো শাহিনুর। দু’হাতে চন্দনের থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করলো। আঁচলে টোপলা বাঁধা খুলে গিয়ে সব ফুল ঝরঝর করে নিচে পড়ে গেলো। চন্দন শাহিনুর’কে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো বাইজি গৃহের পথে। শাহিনুর পিছু তাকিয়ে প্রেরণা’কে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
-‘ ও জমিদার গিন্নি তুমি খুব মিথ্যা বলো, তুমি খুব মিথ্যাবাদী। বাইজি গৃহ নোংরা হলে তোমার স্বামী,তোমার ছেলেদের যেতে দাও কেন? তারা বাইজি গৃহে গেলে তো তাদের অপবিত্র বলো না, আমি একদিন ফুল কুড়াতে এসেছি বলে আমাকে নোংরা, অপবিত্র বললে? আমি কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছি। আমি নোংরা না বিশ্বাস করো! ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here