বাসন্তী প্রেম পর্ব ২৬

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ষট্বিংশ_পর্ব

ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমের মধ্যে মেঝেতে হাত পা বাঁধা অবস্থায় নিস্তেজ শরীর নিয়ে পড়ে আছে সিরাত‌। মুখের মধ্যেও টেপ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে‌। মৃদু ক্ষারীয় আলোতে চারপাশে আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে। ঘন্টা দুয়েক পর নিস্তেজ শরীরে জ্ঞান ফিরে আসতেই পিটপিট করে তাকায় সিরাত‌। চোখের দৃষ্টিশক্তি না থাকায় তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটে না তার মাঝে। তবে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতে গিয়ে থেমে যায় না। হাত পা ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করার মাঝেই কারো পদধ্বনি শুনতে পেয়ে হালকা নড়েচড়ে উঠে সে।
কালো হুডি গায়ে, মুখে মাস্কের আবরণ, লাল চোখ জোড়া থেকে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। হাতের মধ্যে থাকা গান ঘুরাতে ঘুরাতে সিরাতের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রিয়ান‌। চোখে মুখে হিংস্রতার আভাস স্পষ্ট। সিরাতের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে সিরাতের মুখ থেকে স্কচ টেপ সরিয়ে নিতেই খুক খুক‌ করে কেশে উঠে সিরাত।
– “কে আপনি? আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? আমি কি করেছি আপনার?”
আতংকিত হয়ে বলে উঠে সিরাত।
– “এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেলে গেলে আমাকে সিরাত পাখি? দিজ ইজ নট ফেয়ার, ইউ নো।”
বলেই নিজের বাম হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে সিরাতের চিবুক ছুঁয়ে দিল রিয়ান‌। এতেই যেন পুরো শরীর জমে হিম হয়ে আসছে সিরাতের‌।

– “র,র্,রিয়ান ভাইয়া, আপনি?”
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো সিরাত। ভয়ে যেন আওয়াজ গলাতেই থমকে গিয়েছে।
– “হ্যাঁ, সিরাত পাখি আমি! কেন আমাকে এখানে মোটেও এক্সপেক্ট করো নি বুঝি?”
– “আপনি এ,এখ্,এখানে কি করে এলেন? আপনার তো এখন জে,,”
– “হাহাহা! হাসালে সিরাত পাখি! আমার এখন জেলে থাকার কথা, তাইতো? বলেছিলাম না এই রিয়ান চৌধুরীকে জেলে রাখা এত সহজ না! আর আমি যেটা বলি আমি সেটাই করি!
গতবার তো তুই আর তোর সো কল্ড ভালোবাসা মাই ফুট, ফাইয়াজ খুব চালাকি করে আমার হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলি। কিন্তু এবার? এবার তোকে কে বাঁচাবে সিরাত পাখি?”
বলেই ভয়ানক হিংস্র অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রিয়ান‌।
– “আপনি এসব কী বলছেন? আমাকে এখানে কোন সাহসে তুলে নিয়ে এসেছেন আপনি? আপনার মতো একটা খুনি মানুষের জন্য আমি আমার বাবা মাকে হারিয়েছি। এতিম হয়েছি আমি, আমার বোন নিশাত! আপনাকে আমি পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছি আমি আপনাকে ভালোবাসি না! আপনার মতো একটা নিকৃষ্ট মানুষের জন্য আমার মনে ঘৃণা ছাড়া কিছুই নেই। আর হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন, আমি ফাইয়াজকে ভালোবাসি, আর ফাইয়াজ ও আমাকে ভালোবাসে!”
তীব্র ঘৃণা আর একরাশ সাহস জুটিয়ে বলে উঠে সিরাত।
– “সাহস খুব বেড়ে গিয়েছে তাইনা তোর? ঐ ফাইয়াজের সঙ্গে সঙ্গে তোকেও মারতে আমার দু সেকেন্ড ও সময় লাগবে না। তবে আসল শিকার আসা এখনো বাকি। যে জিনিস আমার না সে জিনিস আর কারো না। তুই আমার হবি না তো তোকে আমি ফাইয়াজের ও হতে দেব না!”
বলেই সিরাতের গাল সজোরে চেপে ধরে রিয়ান‌। ফলস্বরূপ ব্যাথায় হালকা কুঁকড়ে উঠে সিরাত। কিন্তু ফোন বেজে উঠার কানে পৌঁছাতেই বসা থেকে উঠে পড়ে রিয়ান‌। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করে সে। আর সিরাত সেখানেই থেকে নিজের হাত পা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে।
– “ফাইয়াজ আপনি কোথায়?”

——————————
– “হোয়াট!! রিয়ান জেলে নেই মানে? কি বলছিস এসব?”
অত্যন্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠে ধ্রুব।
– “হ্যাঁ, রিয়ান জেলে নেই। পালিয়ে গিয়েছে জেল থেকে। আর সিরাতের গায়েব হয়ে যাওয়ার পেছনে রিয়ানেরই হাত আছে।”
বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে ফাইয়াজ।
– “কিন্তু কি করে? রিয়ানের তো জেল থেকে পালাবার কোনো সুযোগ ই নেই!”
– “সুযোগ ছিল না ঠিকই। কিন্তু সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। আর সেটা কে করেছে সেটাই বের করতে হবে।”
– “কিভাবে সেটা? বাই এনি চান্স তুই কি এখন কিছু করতে চাচ্ছিস!”
ধ্রুবের কথার প্রত্যুত্তরে ফাইয়াজ শুধু মুচকি হাসলো যাতে লুকানো রয়েছে না জানা কিছু রহস্য।
রাতের মধ্যপ্রহর‌। আহমেদ বাড়িতে সিরাতের কিডন্যাপ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সবার মুখের মাঝে চিন্তার ছাপ। রূপ আর চন্দ্রিকার চোখেও ঘুম নেই সিরাতের চিন্তায়। সবাই একপ্রকার ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একটু আগেই যার যার রুমে চলে গিয়েছে। জাফর সাহেব অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাওয়ায় তার কাছে খবরটি পৌঁছায় নি। দরজার আড়াল থেকে সবটাই একদৃষ্টে দেখে নিয়েছে রিয়া। সিরাতের গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা অদ্ভুত পৈশাচিক আনন্দ পায় সে। আশপাশের জায়গায় ফাইয়াজকে দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে নেয় রিয়া। কিছু একটা ভেবে দরজার দিকে এগোতেই ফোনের ভাইব্রেশন বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে ‘Riyan’ নামটা জ্বলজ্বল করছে।
– “আর ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড! তোমাকে কত বার বলেছি এই নাম্বার দিয়ে আমাকে ফোন করবে না! তোমাকে পুলিশ ফোর্স তন্নতন্ন করে খুঁজছে আর তুমি তোমার ফোন অন করেছ কোন মাইন্ডে? তোমার জন্য যদি আমার বানানো প্ল্যান ফ্লপ হয়, আই সয়্যার আই উইল কিল ইউ বাস্টার্ড!”
চাপা কন্ঠস্বরে সন্তর্পণে রিয়ানকে বলে উঠে রিয়া।
অপর পাশ থেকে রিয়ানের কথা শুনে বিরক্তি মাখা চেহারায় পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠে রিয়ার‌। ফোন রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
– “বলেছিলাম না মুগ্ধ শুধু আমার! মুগ্ধকে আমি তোর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি সিরাতে। আর সেটাও সারাজীবনের জন্য। আর কখনোই মুগ্ধকে কাছে পাবি না তুই; আমি পেতেই দিব না।”

বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর হাতের গিঁট খুলে আসে সিরাতের‌। এতে করে বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। রিয়ান কিছুক্ষণ আগেই দরজা বন্ধ করে বাহিরে চলে গিয়েছে। যার ফলস্বরূপ হাতের বাঁধন খুলে পায়ের রশিটাও অতি সন্তর্পণে খোলা শুরু করে। এই বুঝি রিয়ান এসে পড়ে এমন আশঙ্কা নিয়ে শরীর ক্রমশ অসাড় হয়ে আসছে। কোনোমতে রশি গুলো সরিয়ে উঠে পড়ে সিরাত। আশপাশের জিনিসপত্র হাতড়ে হাতড়ে সামনের দিকে এগোতেই কারো পায়ের শব্দ পেতেই আঁতকে উঠে সে। তড়িঘড়ি করে গোডাউনে থাকে বড় বড় বাক্সগুলোর পেছনে লুকিয়ে পড়ে সে।
দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করতেই মেঝেতে রশি দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয় রিয়ান। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সিরাতকে দেখতে না পেয়ে চিন্তার প্রকোপ আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়।
– “সিরাত! এই সিরাত! কোথায় তুই? আমার থেকে পালিয়ে লাভ নেই সিরাত পাখি, ঘুরেফিরে তোকে আমার কাছেই ধরা দিতে হবে। সোজাসাপ্টা ভাবে বলছি যেখানেই আছিস সেখান থেকে বেরিয়ে আয়।”
হুংকার দিয়ে বলে ওঠে রিয়ান‌। এদিকে বক্সের পেছনে এক হাত দিয়ে মুখ চেপে বসে আছে সিরাত‌। ভয়ে কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে।

ঢাকা শহরের শুনশান রাস্তায় সোডিয়াম বাতির আলোয় হাই স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে ফাইয়াজ। পাশের সিটেই ধ্রুব বসে হাতে ফোন নিয়ে। গাড়িতে লাগানো জিপিএস এ ফাইয়াজ একটু পর পর আড়চোখে তাকাচ্ছে আর গাড়ি ড্রাইভিং এ মনোযাগ দিচ্ছে। জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস অনুযায়ী ঢাকা শহরের শেষ প্রান্তে নীরব জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলতে চলতে একসময় থেমে যায়।
– “ড্যাম ইট! গাড়ির ইঞ্জিন এখনি নষ্ট হওয়ার দরকার ছিল!”
বলেই গাড়ির গিয়ারিং এ সজোরে একটা ঘুষি মারে ফাইয়াজ। ধ্রুব দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে চেক করতে থাকে। গাড়ির টায়ার পাংচার হওয়া সহ ইঞ্জিন ও থেমে গিয়েছে। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে সেগুলো ঠিক করার কাজে লেগে পড়ে ধ্রুব আর ফাইয়াজ দুজনেই‌।

কয়েক মিনিট পিনপতন নীরবতা পেতেই হালকা নড়েচড়ে উঠে সিরাত‌। রিয়ান কি তবে না পেয়ে চলে গিয়েছে নাকি এখনো এখানে আছে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে স্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। বক্সের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সামনের দিকে পা বাড়াতে নিলেই কারো বলিষ্ঠ হাত এসে সিরাতের চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে। যেন চুলগুলো মাথার চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসবে। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে সিরাত‌। কিন্তু তাতে কোনো প্রকার ভ্রূক্ষেপ করে না রিয়ান‌ বরং তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সিরাতকে টেনে হিচড়ে সামনের দিকে নিয়ে যায়।
– “কি করছেন, ছাড়ুন আমাকে। লাগছে আমার!”
– “খুব সাহস বেড়ে গিয়েছে দেখছি তোর। আজ তোর সব সাহস আমি বের করে দিব। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!”
বলেই পকেট থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করে সিরাতের দিকে এগোতে নিলেই সিরাতের কানে একটি চিরচেনা কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
– “সিরাত?”
ফাইয়াজের গলার কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই বিস্মিত হয় সিরাত আর সাথে মনের অজান্তে লুকিয়ে থাকা আশঙ্কা যেন কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে যায়।………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here