বিচ্ছেদ পর্ব -০৯

#বিচ্ছেদ – ৯

রিয়া ভিপি ম্যাডামের রুমে বসে আছে। ম্যাডাম ডেকেছেন। স্কুলে নতুন চেয়ারম্যান আসবেন। উনার রিসিপশন প্রোগ্রামটা বেশ বড় করেই হবে। স্কুল ও কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্হাপনা করতে হবে তাকে। রিয়া খুব সুন্দর উপস্হাপনা করে। গত সাত বছরে এটা স্কুলের সবাই জেনে গেছে। তাই যখন বড় কোন প্রোগ্রাম বা ভিআইপি কোন ব্যক্তি আসেন স্কুলে,তখন উপস্হাপনার জন্য রিয়ার ডাক পড়ে।

নতুন চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহফুজ, তিনি নাকি বাচ্চাদের খুব পছন্দ করেন।গান-বাজনাও পছন্দ করেন। তাই প্রিন্সিপ্যাল স্যার (কর্নেল জাহিদ) বলে দিয়েছেন,সর্বোচ্চ ভাল প্রোগ্রাম হওয়া চাই।
ভিপি ম্যাডাম সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। কারো কাজেই কোন ত্রুটি থাকা চলবে না। সবাই যার যার দায়িত্ব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
সেনাবাহিনীর স্কুলে চাকুরী করে রিয়া একটা জিনিস খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছে,সেনাবাহিনী তার যেকোন অনুষ্ঠান বা কাজ নিখুঁত থেকে নিখুঁততর করতে পারদর্শী।
খুব অল্পসময়ে তারা নিখুঁত একটা আয়োজন করে ফেলতে পারে।
যেহেতু এই কলেজের প্রিন্সিপাল সহ গভঃর্নিং বডির সকলেই সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই এখানেও একই নিয়ম চলে।
এটা অবশ্য রিয়ার ভাল লাগে।
ভিপি ম্যাডাম বললেন, রিয়া তোমার স্ক্রিপ্ট লেখা হয়ে গেলে আমাকে একটু দেখিয়ে নিও।
আর ইভেন্ট গুলো তুমি কারচারাল ক্লাবের ইনচার্জ ( সিরিন ম্যাডাম) র সাথে বসে সেট করে নিও। আমি পরে একবার দেখে নেবো।
রিয়া ‘জ্বি ম্যাডাম’ বলে বেরিয়ে এলো ভিপির রুম থেকে। ম্যাডাম ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন
কারো সাথে।
এই মানুষটাকে খুব সম্মান করে রিয়া।
এত সৎ,এত দক্ষ,এত আন্তরিক একজন মানুষ,যে শ্রদ্ধা চলে আসে উনাকে দেখলেই।
সবদিকে তিনি নজর রাখেন সমান ভাবে।
কি করে পারেন কে জানে !
ভিপি ম্যাডামও একজন রিটায়ার্ড মেজর সাহেবের পত্নী। শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্তীতার ব্যাপারে তিনিও কম যাননা।
আশিকের আবার যোগাযোগের বিষয়টা রিয়া ম্যাডামকে বলবে ভেবেছিল।
আপাতত চেয়ারম্যান স্যারের রিসেপশন প্রোগ্রামের আগে বলার সুযোগ নেই।
কারন, রিয়া এ ক’দিন প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আর ম্যাডামের তো কত শত ব্যস্ততা আছেই।

পুরো অনুষ্ঠানের লিস্ট পেয়ে গেছে রিয়া। নাচ, গান,কৌতুক,আবৃতি ইত্যাদি। তবে গান আর নাচ থাকবে বেশী।
একটি মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। সে খুব ভাল নাচে। যদিও পিএসসি ও জেএসসি র কারণে ফাইভ ও এইটের ছাত্রীদের পড়ার ক্ষতি করে কোন প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করার কথা নয়। তবুও এই মেয়েটির একটি একক নৃত্য যেন থাকে,সেকথা প্রিন্সিপ্যাল স্যার ও ভিপি ম্যাডাম বিশেষ ভাবে বলে দিয়েছেন।
মেয়েটি অসাধারণ নাচে।
রিয়া আজ ওর নাচ দেখছিল রিহার্সালের সময়। কি চমৎকার এক্সপ্রেশন দেয়।
ভাল একজন নাচের টিচার তাকে বাড়ীতে এসে নাচ শেখায় ছয় বছর বয়স থেকে।
তাই ওর রিহার্সাল লাগবেনা খুব একটা।
আজ ওর নাচ দেখে সিরিন ম্যাম বললেন, আরিয়া, তুমি বাসায় প্রাকটিস করে নিও। ক্লাস মিস করে তোমাকে রিহার্সালে আসতে হবেনা।
মিষ্টি হেসে চলে গেল আরিয়া।
রিয়া ওকে ডেকে কথা বলেছিল।
খুব পছন্দ করে রিয়া মেয়েটিকে।
ওর নাচের জন্য চমৎকার একটা স্কিপ্ট লিখলো সে। বাসায় ফিরে সব কাজ শেষে স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসেছে রিয়া।

রায়না গানের ক্লাসে গেছে।
রহিমা খালা নিয়ে গেছে।
রায়না গানটা খুব ভাল গায়। এক সময় রিয়াও খুব ভাল গান করতো। গানটা ছেড়েছে রিয়া ডিভোর্সের পর থেকেই।
রায়নার গান শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
রায়নার একটা গানও থাকছে প্রোগ্রামে।
সন্ধ্যার আগেই ফিরলো রায়না।
দুধের মগে চুমুক দিয়েই বললো,বাবার ফ্লাইট কনফার্ম হয়েছে। আর পনেরো দিন পরেই বাবার সাথে দেখা হবে।
রিয়া অবাক হয়ে স্ক্রিপ্ট থেকে মুখ তুলে তাকালো, তোমার বাবা বাংলাদেশে আসবে ?
হুম .. আসবে মা, আমাকে দেখতে আসবে।
রায়নার চোখে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলা করছে,সেখানে অনেক আশা আর সপ্নের ছড়াছড়ি!
রিয়ার খুব কষ্ট হলো।
মেয়েটা বাবা না থাকার কষ্টে ছটফট করে।
তবে মুখ ফুটে সবসময় বলেনা কিছু।
আহা.. এখনো ছোট, তাই আশিকের অবহেলার হিসেব করছে না।
কেবল বাবাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে বিভোর হয়ে আছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রিয়া।
থাকুক না বিভোর হয়ে বাবাকে নিয়ে।
রিয়া তাকে কিছুই বলবে না।
এবার তাদের বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মাঝখানে সে আসবে না।

আশিক আমেরিকায় যাওয়ার সময় রায়নার নাম চেয়েছিল। কাগজ-পত্রে সন্তান হিসেবে রায়নার নাম দিতে চেয়েছিল।
তীব্র রাগে,অপমানে রিয়া না করে দিয়েছিল।
কিন্তু এবার সে সেরকম কিছুই করেনি।
অনেকটা সময় পার করে রিয়াও এখন অনেক সহনশীল এবং বাস্তববাদী হয়ে উঠেছে।
আশিক যদি তার ভুল বুঝতে পেরে থাকে তাহলে রায়নাকে দূরে সরিয়ে রাখার কোন কারণ নেই। আশিককে একটা সুযোগ দেয়া যায়। তাছাড়া কোন ধরনের আইনি ঝামেলায় রিয়া জড়াতে চায়না।
রায়না সম্পর্কের এত জটিলতা বুঝতে পারে না। সে শুধু বোঝে সবার বাবা তাদের সাথেই থাকে,কেবল তার বাবা কোন এক অজানা কারণে তাদের পাশে নেই।
বন্ধুরা যখন বাবাকে নিয়ে গল্প করে, সে বিষর্ন্ন মুখে চুপচাপ ওদের গল্প শোনে।
কতদিন উদাস গলায় রিয়াকে বলেছে,বাবা থাকলে কত ভাল হত, তাইনা মা ?
রিয়া মেয়েকে বুকে চেপে ধরে বলতো,
একদিন তুমি সব পাবে।
কেন বলতো রিয়া জানেনা।
হয়তো মেয়েকে সাহস দেয়ার জন্যই বলতো।

আশিক আসবে মেয়েকে দেখতে।
রিয়া অবাক হয়েছে। এত জলদি আশিক আসবে সে ভাবেনি। পনেরো দিন পরেই।
ইভা ফোন করেছিল।
প্রচন্ড খুশী সে। আশিক এক মাস থাকবে।

স্কুলের প্রোগ্রামটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। এক দায়িত্বের সাথে ছোট ছোট আরো এটা সেটা দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়ে।
চেয়ারম্যান স্যার সপত্নীক আসবেন।
উনাদের ড্রাই ফুলের বুকে দিয়ে রিসিভ করতে হবে। সেজন্য চাই ফুটফুটে দু’জন ছোট্ট ছোট্ট ছাত্রী।
তাদের পোশাক নির্বাচন ও পোষাকের ব্যবস্হা করা এবং কিভাবে চেয়ারম্যান স্যার ও ম্যামের হাতে ফুলের বুকে তুলে দেওয়া হবে সেই রিহার্সালও রিয়াকেই করাতে হচ্ছে।
আগামীকাল প্রোগ্রাম।
আজ তাই খুব দৌড়া-দৌড়ির উপর থাকলো রিয়া। নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই।
রায়না তার বাবার সাথে প্রতিদিনই কথা বলে অল্প সময়ের জন্য হলেও।
রায়নার সাথে গল্প করে করে সম্ভবত আশিক মোটামুটি একটা ধারনা করতে পেরেছে।
এবং সে অনুযায়ী শপিং করেছে।
আর দশদিন পরই রায়নার বাবা আসবে।

রায়না বিকেলে রহিমা খালার সাহায্যে ফ্রুট জুস বানালো। ছবি তুলে বাবাকে পাঠালো।মেসেজে লিখলো,
baba salam.I made fruit juice at home. I wish you could try some. my mom told me my dida was great cook,and I like it as well.

ছবি ও টেক্স পাঠানোর পরও অনেকক্ষণ বাবার কোন মেসেজ না পেয়ে রায়নার মন খারাপ হলো। সেকথা রিয়াকে বলেছেও কয়েকবার।

ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে বাবাকে টেক্স করলো, baba are you ok ? you didn’t text me for a long time.

সকালে ঘুম থেকে উঠে আশিকের রিপলাই পেলো, sorry ma.I’m so so busy at office.One more hour then get
home. I’ll write a lot then,love u ma.

রায়না উত্তরে লিখলো, It’s ok baba, stay safe. Love you baba.

আশিকের মেসেজ।
রিয়া অডিটোরিয়ামে রিহার্সালে ছিল।
বেশ বড় মেসেজ দেখে ওপেন করলো।
রায়নার জন্য তার বাবা লিখেছে,
Sorry ma,I had long day. Just finish my diner. your homemade juice looks pretty,testy as well I believe.Always try to have
homemade juice. My Dr, said homemade juice much better than store juice. When I come to see you,would u make for me ma ?
Yes my darling, in my eyes – your dida (my mom) was the best chef in the world. Before she passed
away, she used to cry to see you but it was my great sin,couldn’t put you in her chest. Forgive me both of you ma !

রিয়ার মনটা বিষর্ন্ন হয়ে উঠলো।
মেয়েকে লেখা বাবার মিষ্টি চিঠিতে অপূর্ণতার সুক্ষ্ম বেদনাও ফুটে উঠেছে।
রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, আরো আগে যদি
তুমি নিজের ভুলগুলো বুঝতে, তাহলে আজ রায়নার জীবনটা এমন হতনা।

স্কুল থেকে ফিরে রায়না বাবার মেসেজ পড়ে খুশী হলো। দিন গুনছে রায়না। কবে বাবা আসবে ? সব বন্ধুদের বলেছে সে তার বাবার কথা।

স্কুলের প্রোগ্রাম খুব সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হলো।
কোথাও কোন ঝামেলা হয়নি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বরাবরের মত খুব ভাল হয়েছে। চেয়ারম্যান অত্যন্ত খুশী হয়েছেন। চেয়ারম্যান পত্নী রিয়ার উপস্হাপনার খুব প্রশংসা করলেন। রানার গান এবং আরিয়ার নাচেরও বিশেষ প্রশংসা করলেন।
প্রিন্সিপাল স্যার সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। রিয়া এবার ভিপি ম্যাডামের রুমে উঁকি দিল। ম্যাডাম খুশী হয়ে ডাকলেন।
অনুষ্ঠান নিয়ে কথা-বার্তার পরে রিয়া আশিকের কথা বললো।
ভিপি ম্যাডাম অবাক হলেন,এতদিন পর ?
তবে বললেন,বাবা যেমনই হোক, মেয়ের সাথে দেখা করার অধিকার তার আছে।
আর যদি সে নিজের ভুল বুঝতে পারে,ভাল কথা।

আজ আশিক আসবে। বিকালে এসে পৌঁছাবে। এয়ারপোর্টের ফর্মালিটি শেষ করে বাসায় আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
বিকেলেই ইভা গাড়ী নিয়ে রিয়ার বাসায় চলে এসেছে রায়নাকে নেয়ার জন্য।
ইভাও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেই থাকে।দু’মাস হলো ওর হাসবেন্ডের পোস্টিং ঢাকায় হয়েছে।
ওরা নেভাল অফিসার্স কোয়ার্টারে থাকে।
নতুন হাইরেইজ বিল্ডিং গুলোতে।
আগে চিটাগং পোস্টিং ছিল।
রায়না জিনস আর টিশার্ট পরেছে।
ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
সাত বছর পর ইভাও আজ প্রথম দেখছে তাকে। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো রায়নাকে।
ইভা জালালো,আশিক আর দু’তিন ঘন্টার মধ্য চলে আসবে।
রায়নাকে নিয়ে এখন ইভার বাসায় যাবে।
রাশিক ও মামুন এয়ারপোর্টে গেছে আশিককে রিসিভ করতে।ওরা আসলে সবাই মিলে ধানমন্ডির ফ্লাটে যাবে।
রিয়া রায়নাকে বেস্ট অব লাক বললো।
আদর করে দিল।
রায়না বললো,মা তুমি যাবেনা ?
রিয়া হেসে বললো, আজ তো বাবা-মেয়ের দেখা হবে। সেখানে আমি গিয়ে কি করবো ?
রায়নার দু’চোখে বিষর্ন্নতা খেলে গেল মূহুর্ত্যের জন্য। সে তার ফুপির হাত ধরে গাড়ীতে উঠলো।রিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলো।
রায়না সহজ হতে পারবে তো তার বাবার সাথে ?
মা ছাড়া ওর পৃথিবীটা তো অন্ধকার !
মাকে ছাড়া একা একা রায়নার জীবনের আজ
প্রথম পথচলা….

রায়নার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরতে আসছে.. তার বাবা।
বাকীটা পথ ছোট্ট হাতটা শক্ত করে ধরে থাকবে তো…আশিক ???

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here