বিবর্ণ নীলাম্বরী পর্ব -২৭+২৮

#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

রহস্য উন্মোচনপর্বঃ সাতাশতম

নীলা ড্রয়িং রুম পেড়িয়ে বাগানের দিকে গেলো।বিয়েটা সেখানেই হবে।বাগানের যাদের যাদের চোখে নীলাকে পড়েছে সবাই অবাক হয়ে গেছে। আজিজুর রহমান তার ব্যবসায়ের পার্টনারের সাথে কথা বলছিলো হঠাৎ তার ছোট মেয়েকে সাধারণ সাদামাটা পোশাকে এগিয়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে যায়।

নীলার দাদী উঠে আসে।নীলার হাত টান দিয়ে বলে
-‘কিরে ছ্যামড়ি বাপের নাক কাটতে আসছিস এখানে? দেখাইতে আইছেছ তোর বাপ তোকে কত অনাদরে রাখছে? কেমন সাজ এই তোর?’

এবার সবারই ধ্যান নীলার দিকে পড়লো।তৃণকে কোলে নিয়ে বর্ণ মজা করছিলো সেও এবার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো।

নীলা সাদা ধবধবে একটা থ্রি-পিস পড়া।থ্রি-পিসের উপর চাঁদর গায়ে দেওয়া।এখন তেমন শীতও না।হাঁটুর নীচ অব্দি লম্বা চুল গুলো ছেড়ে রাখা।পায়ে ব্যান্ডেজ। চোখ গুলো লাল টকটকে। চোখের নিচে কাঁজল লেপ্টানো।বিধ্বস্ত রূপ রমনীর।

আজিজুর রহমান এগিয়ে আসেন মেয়ের দিকে।মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন
-‘কিরে মা শরীর অসুস্থ তোর?এমন লাগছে কেন? এটা কেমন রূপ তোর মা? ভয়াবহ লাগছে তোকে? কি জামা পড়েছিস?’

নীলা বাবার থেকে টলমলে পায়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো।দাদী তেড়ে এসে বলল
-‘এই ছ্যামড়ির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওরে এদিক থে সড়া।আমার মাথা গরম হইতাছে।এই মাইয়া নির্ঘাত খারাপ কিছুর মতলব করে আইছে।বড় মাইয়াটার কপাল পুড়তে আইছোছ তুই?’

বর্ণ তৃণকে ওর মায়ের কোলে দিয়ে এগিয়ে আসলো।শান্ত স্বরে বলল
-‘দাদী একটু ঠান্ডা হোন।নীলাম্বরীর নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কি হয়েছে নীলাম্বরী?’

নীলা চোখে জল টইটুম্বুর। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
-‘বাবা বিয়েটা হবে না।’

নীলার কথা শেষ হতে দেড়ি ঠাঁস করে চড় পড়তে দেড়ি নেই।তার দাদীর রক্তচক্ষু নিয়ে উচ্চস্বরে বলল
-‘বিয়া নিয়া কি নাটক হয় এই বাড়িতে? অসভ্য ছ্যামড়ি। নিজের কপালে তো বিয়া নাই তাই বড় বইনের ভাগ্য টা খাইতে আইছোছ?’

দাদীর থাপ্পড়ে ছিটকে পড়ে নীলা।আজিজুর রহমান,বর্ণ ছুটে তাকে ধরতে গেলে সে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় তাদের।

গায়ের চাদরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে তার বোনের কাছে এগিয়ে গেলো।এদিকে রাহাত ঘেমে একাকার। নীলা এমন করছে কেন ভেবে।

নীলা বোনের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল
-‘আপাই এ জীবনে তোমার ক্ষতি চাই নি আমি। মাঝে মাঝে সবার কথায় তিক্ত হয়ে তোমার উপর রাগ ঝাড়তাম কিন্তু আসলে তেমনটা না।তোমাকে আমি বড্ড ভালোবাসি আপাই।এই প্রথম বলছি তোমাকে আমি বড্ড ভালোবাসি আপাই। তোমার ভালোর জন্যই বলছি বিয়েটা বন্ধ করো আপাই।’

নিরুপমা বোনের দিকে এগিয়ে গেলো ধরার জন্য কিন্তু নীলা এবারও পিছিয়ে গেলো।বর্ণ এবার ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নীলা কাউকে ধরতে কেন দিচ্ছে না।

নীলার মা মানুষের মুখে মুখে সবটা শুনে তাড়াতাড়ি বাগানের দিকে আসছে।সে এসেই বলছে
-‘কি বলছো নীলু?বিয়ে ভাঙার তো কোনো কারণ নেই তাহলে এসব বলছে কেন?’

ওদের কথার মাঝেই পিছন থেকে কেউ বলল
-‘বিয়ে ভাঙার অনেক কারণ আছে ম্যাডাম।’

সবাই পিছে ঘুরে আরেক দফা অবাক।পিছে পুলিশের পুরো একটা টিম।মাসুদ এগিয়ে গিয়ে বলল
-‘অফিসার আপনারা এখানে? আর কি কারণ আছে?’

পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে রাহতের কাঁধে হাত রেখে বলল
-‘কারণ হলো আপনাদের বর ভালো না।সে একজন ব্ল্যাকমেইলার।সে চরিত্রহীনও বটে।’

সবার মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ল শুধু কয়েকজন বাদে।বর্ণ অবাক কন্ঠে বলল
-‘কি বলছেন আপনারা? রাহাত কি করেছে?’

নীলা এবার এগিয়ে গিয়ে বলল
-‘রাহাত আমার সাথে প্রতারণা করেছে।শুধু প্রতারণা না সে আমার সাথে জোরজবরদস্তির চেষ্টা করেছিলো।আর আমি জেনো এগুলো না বলি তাই ব্ল্যাকমেইলও করেছে।’

নীলার কথা শেষ হতে দাদী তেড়ে এসে বলল
-‘এই ছ্যামড়ি খারাপ।হুদাই দোষ দিতাছে আমার নাতিরে।চরিত্রহীনা ছ্যামড়ি।’

আবার চড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই নীলা দাদীর হাতটা ধরে ফেলল।এতক্ষণ টইটম্বুর হয়ে থাকা অশ্রু গুলো ঝড়ে পড়ল।নীলা কাঁপা কন্ঠে বলল
-‘দাদী গো দোষ তো আমার ছিলো না।আমি ভালোবেসে ছিলাম এক বিশ্বাসঘাতককে আমি বুঝতেও পারি নি গো।’

তিমা এগিয়ে এসে নীলার মুখ উঠিয়ে বলল
-‘সবটা খুলে বল নীলা।সবাই আমরা অপেক্ষা করছি।’

নীলা এবার চোখের জল গুলো মুছে বলল
-‘আমি রাহাত ভাইয়াকে ভালোবাসতাম সেই ছোট থেকে।কিন্তু বরাবরই রাহাত ভাইয়ের তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনেছি তাই কখনো একপাক্ষিক ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাই নি।কিন্তু আজ থেকে এক বছর আগে রাহাত ভাই নিজে আমায় প্রপোজ করে।ইমোশনাল ভাবে ব্ল্যাকমেইল করে। আমি বাধ্য হয়ে আমার এক পাক্ষিক ভালোবাসার কথা বলি।তখনও সে নাটক টা চালিয়ে যায়। তিন মাস পর একদিন ঘুরতে যাই।সেদিন রাহাত ভাইয়া আমার সাথে জোরজবরদস্তির করার চেষ্টা করে।তখনই এক ফেরেশতার মতন মানুষ আমাকে রক্ষা করে।তারপর আমি লজ্জায় মিইয়ে যাই।কাকে বলবো এই বিশ্বাসঘাতকার কথা কুল-কিনারাহীণ হয়ে যাই।

পরে যখন ঠিক করলাম সবাইকে জানাবো তখনই শুনি রাহাত ভাইয়ের সাথে আপুর বিয়ে ঠিক হয়।আমি রাহাত ভাইয়ের কাছে আকুতি মিনতি করি জেনো বিয়েটা না করে।যখন রাহাত ভাই শুনছিলো না তখন বলেছিলাম আমাদের কথা সবাইকে বলে দিবো।তখনই রাহাত ভাই বিশ্রী একটা ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে।’

টানা এতক্ষণ কথা বলে থামলো নীলা।সবার জেনো রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। আফসানা রহমান এগিয়ে এসে বললেন
-‘কিসের ভিডিও নীলু?’

হাবিবা খানম ঠোঁট বাঁকা করে বললেন
-‘দেখো তোমার মেয়ে কার সাথে শুয়েছে ওটাই আমার ভাইয়ের ছেলে দেখে ফেলেছে তাই এত নাটক।’

নীলা মুখ কুঁচকে “ছিঃ” বলে উঠল।তারপর শক্ত কন্ঠে বলল
-‘রাহাত ভাই তোমার ভাইয়ের ছেলে হলে আমিও তোমার ভাইয়ের মেয়ে তাই এক পাক্ষিক কথা বলো না।আর যেটা জানোনা সেটা নিয়ে তো আরও আগে বলবে না।’

এতক্ষণ পরে তিমা মুখ খুললো
-‘আহ্ মা চুপ করো।নীলু তুই বল কিসের ভিডিও?’

নীলা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘নিরুপমা আপাইয়ের গোসলের ভিডিও।যা রাহাত ভাই আপার অগোচরে তুলেছিলো।এবং সেটাই নেটে আপলোড দেওয়ার হুমকি আমাকে দিয়েছিলো।’

নিরুপমা জেনো দু’কদম পিছিয়ে যায়। তাহলে এই জন্য নীলা সব মেনে নিতে চেয়েছিলো?

রাহাত এগিয়ে এসে আমতাআমতা করে বলল
-‘তোর কাছে প্রমান আছে এসবের?’

এবার পুলিশ অফিসার মুখ খুললেন
-‘হ্যাঁ প্রমাণ আছে মিষ্টার রাহাত।কাল আপনি নীলার সাথে কথা কাটাকাটির সময় সবটা নিজের মুখে স্বীকার করেছেন তার ভিডিও আছে আমাদের কাছে।’

এই বলে সে ভিডিও টা অন করলো।সেখানে সত্যি রাহাত নিজের মুখে সব স্বীকার করছে।রাহাত অবাক দৃষ্টিতে তাকালো নীলার দিকে।নীলা বাঁকা হেসে বলল
-‘অবাক হচ্ছেন রাহাত ভাই? ভিডিও টা কে করলো ভেবে অবাক হচ্ছেন? আপনি কাল এসে দেখে ছিলেন না মোবাইলে চার্জে দিচ্ছি? হ্যাঁ তখন চার্জেই দিছিলাম কিন্তু কি মনে করে ভিডিওটা জেনো অন করছিলাম।অবশেষে আমি সাকসেস।’

আফসানা রহমান ঠাস করে চড় বসালেন।তারপর নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন
-‘তুমি কিছু বলবে না ওকে?’

আজিজুর রহমান এতক্ষণে মুখ খুললেন
-‘আমি জানতাম সবটাই।তবে রাহাত এত ঘৃণিত জিনিস নিয়ে আমার মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করছে আমি জানতাম না।’

আজিজুর রহমানের কথায় উপস্থিত সবাই দ্বিগুণ অবাক হলো।আফসানা রহমান সেই অবাক ভাবটা রেখেই বললেন
-‘তুমি জানতে মানে কীভাবে?’

আজিজুর রহমান শান্ত স্বরে বলল
-‘নিরু বলেছে সবটা।’

তিমা বললো
-‘মামু খুলে বলো সবটা।’

আজিজুর রহমান বললেন
-‘আমি নিরুর কথায় নিরুর আর রাহাতের বিয়ে ঠিক করি।নিরু আমাকে বলেছিলো রাহাত এমন কিছু করেছে নীলার সাথে যা নীলাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।জানতাম এমন কিছুই যা নীলা বলতে পারছে না তাই সব চাল।’

নীলা এগিয়ে এসে বলল
-‘হ্যাঁ নিরু আপু সবটা আগে জানতো।আমি জানতাম না নিরু আপু যে সবটা জানতো।আসলে নিরু আপুকে কেউ সবটা জানিয়েছে আর সে আর কেউ না সে হলো নীড় ভাইয়া।’

শারমিন চৌধুরী এবার বিষ্ময় নিয়ে বললেন
-‘নীড় জানিয়েছে? কিন্তু কীভাবে ও জানলো?’

নিরুপমা এগিয়ে এসে বলল
-‘ঐ যে রাহাত জোরজবরদস্তি করেছিলো তখন একটা ছেলে বাঁচিয়ে ছিলো বলেছে না? ওটা নীড়ই ছিলো।’

সবার কাছে জেনো এক নতুন রহস্য বের হলো।নীড় আর নিরুপমাই তাহলে সবটা করেছে।কিন্তু কীভাবে? ওদের সম্পর্ক কি? আর কিইবা আছে নীলার বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ?
#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

রহস্য উন্মোচনপর্বঃ আটাশ

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ কোনো কিছু বুজছে না।আফসানা রহমান ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে অবশেষে বেশ তেঁতে বললেন
-‘অনেক হয়েছে হেয়ালি এবার নিরুপমা তুমি সব ক্লিয়ার ভাবে বলো।’

নিরুপমা বাবার দিকে তাকালো বাবা তাকে চোখ দিয়ে সম্মতি জানালেন।সবটা বলার অনুমতি পেয়ে নিরুপমাও বলা শুরু করলো
-‘নীড় আর বর্ণ ভাইয়া আমাদের বাসায় এসেছিলো প্রায় একবছর আগে মনে আছে মা?তখন থেকেই নীড়ের সাথে আমার পরিচয়। আর খুব ভালো পরিচয়। তখন নীলু শহরে ছিলো।

নীলু বেশি বেশি বাড়ি আসা শুরু করলো নীলুর হঠাৎ পরিবর্তন আমার চোখে আসা শুরু করলো।রাহাত ভাইয়ের নীলুর সাথে ভালো আচরণ আমার সন্দেহকে আরও তাজা করলো।তারপর যা সন্দেহ করেছি তা ঠিক বের হলো রাহাত আর নীলুর সম্পর্ক আছে।

আমি খুশিই হলাম।কারণ আমি জানতাম নীলু রাহাত ভাইকে পছন্দ করে।নীলুর এক ডায়েরিতে রাহাত ভাইয়ের সম্পর্কে লিখা ছিলো আর সেটা দেখার পর থেকেই বুজেছিলাম নীলুর মনের খবর।কিন্তু রাহাত ভাইয়ের নীলুর সাথে দূরদূর আচরণে আমারও মনঃক্ষুণ্ন হতো।

তো ভাবলাম নীলুকে জিজ্ঞেস করবো ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে।তবে এই কথাটা আমি নীড়কেও বলেছিলাম।খুশি হয়েছিলাম বোন নিজের পছন্দের মানুষকে অবশেষে পেয়েছে ভেবে।

একদিন নীড় আমাকে কল করলো।সেদিনই রাহাত আর নীলু ঘুরতে গিয়েছিলো।নীড়ও সেদিন কোনো কাজে সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় রাহাত আর নীলুকে দেখেছিলো।রাহাতের আচারণ তার সন্দেহজনক লাগে।তাই আমায় কল দেয়।আমি তাকে নীলুর পিছে ঘুরে যেতে বলি।

তারপর ও গিয়ে দেখে রাহাত ভাইয়া নীলুর সাথে জোড়া জুড়ি করছে।তখন ও রাহাত ভাইয়ার হাত থেকে নীলুকে বাঁচায়।ওর হেলমেটের জন্য ওরে নীলা চিনতে পারে নি।

তারপর থেকেই নীলুকে ভেঙে যেতে দেখলাম।সে ঐ ঘটনাটা কাউকে বলে নি।আমি ভেবে ছিলাম নীলু বলবে কিন্তু নীলুর নিরবতায় আহত হলাম।ততদিনে নীলু শহরে চলে গেলো আমি নীড়কে বললাম ওর খেয়াল রাখতে।

দিন যায় মাস যায় নীলু কিছু বলে না।তারপর আমিই বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখি।তখন অবশ্য বাবাকে বলি নি সবটা।ভেবে ছিলাম নীলা সবটা শুনলে রাহাত ভাইয়ের অন্যায়ের কথা প্রকাশ করে ফেলবে।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নীলা চুপ করে রইল।

তারপর বুঝলাম নিশ্চয়ই নীলুর চুপ হওয়ার পিছে কোনো কারণ আছে।সবটা বাবাকে জানাতে হবে।তাই সব বাবাকে জানালাম।বাবাও নীলার ভিতর থেকে সবটা জানার জন্য সাঁই দিলো।কিন্তু আমরা ভাবতে পারি নি রাহাত ভাই এত বিশ্রী কাজ করেছে।’

নিরুপমার কথা থামতেই রাহাতের বাবা ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিলো রাহাতের গালে।চেঁচিয়ে বললেন
-‘ছিঃ তোর মতন কুলাঙ্গার আমি দেখি নি।আরে সব কিছু পরে আগে তো ওরা তোর আপন মানুষ।কীভাবে পারলি এসব করতে? কীভাবে পারলি ছিঃ।

রাহাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।তার কিছু বলার মুখ নেই।আর ও তো সবটা করেছে আরেকজনের কথাতে।অবশ্য নিজেকে নির্দোষ সে দাবি করে না।বরাবরই নীলাকে অপছন্দ ছিলো তার।তাই সে আরেকজনের কথায় রাজি হয়েছে।তার সাথে লোভ তো ছিলোই।

আজিজুর রহমান এতক্ষণে মুখ ফুটে বলল
-‘পুলিশ অফিসার নিয়ে যান ওরে।’

রাহাত এবার কূল কিনারা না পেয়ে বাবার কাছে হাত জোড় করে বলল
-‘বাবা এবারের মতন মাফ করে দেও আমি আর করবো না প্লিজ বাবা।’

রাহাতের বাবা মুখ ফিরিয়ে নিলো রাহাতের থেকে।রাহাত দিশা হারা হয়ে তার মাকে ডাকা শুরু করল
-‘আম্মু কোথায় তুমি প্লিজ বাঁচাও আম্মু তুমিই একমাত্র আমাকে ভালোবাসো।প্লিজ আম্মু বাঁচাও।’

রাহাতের বাবা পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল
-‘ওরে তাড়াতাড়ি নিয়ে যান।আমার ওয়াইফ এসব জানার আগে ওরে এখান থেকে নিয়ে যান।আমরা পরে আমার ওয়াইফকে সামলাবো।এই বিশ্বাসঘাতককে সড়ান এখান থেকে।’

রাহাতকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো।রাহাতের বাবা বসে পড়লো তার পাশের চেয়ারটায়।

নীলা হেলেদুলে কোনো মতে শারমিন চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর দু হাত জোড় করে হাঁটু মুড়ে বসে পরলো।কেঁদে দিয়ে বলল
-‘আন্টি গো আমাকে নিজের বোনের বিয়ে ভাঙার কলঙ্ক থেকে তুমিই বাঁচাতে পারবে।আন্টি হেল্প মি।’

শারমিন চৌধুরী নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘তুমি চিন্তা করো না নীলা।নিরুপমার বিয়ে হবে। এবং আজই হবে।’

আফসানা রহমান অবাক কন্ঠে বলল
-‘বিয়ে হবে?কিন্তু কার সাথে?’

শারমিন চৌধুরী হেসে বললেন
-‘আমার ছোট ছেলের সাথে।নীড়ের সাথে বিয়ে হবে নিরুপমার।আপনারা সম্মতি দিলেই হবে।’

আফসানা রহমান পরম তৃপ্তিতে চোখের জল ছেড়ে দেয়। বর্ণের বাবা এগিয়ে গিয়ে নীলার বাবা মানে আজিজুর রহমানকে বললেন
-‘ভাই সাহেব আপনি রাজি তো আপনার মেয়েকে আমার বাড়ির বউ বানাতে?’

আজিজুর রহমান জড়িয়ে ধরলেন বর্ণের বাবাকে খুশিতে ।নীলা রঙকে পাঠালো নীড়কে ডাকতে।সে এখানে উপস্থিত নেই।বাড়ির পাশে পুকুরের দিকটাতে বসে আছে।তাই এতক্ষণের খবর সে জানে না।অবশ্য নীলা দিগন্তকেও পাঠিয়ে ছিলো সেখানে।গত কাল রাতেই নীলা সবটা দিগন্তকে জানিয়ে ছিলো। নীড় জেনো কোথাও চলে না যায় তাই দিগন্তও সেখানে আছে।

বর্ণ এতক্ষণ পর নীলার দিকে এগিয়ে এসে বলল
-‘সব বুঝলাম নীলা।কিন্তু তুমি কীভাবে নীড় আর নিরুপমার সম্পর্কের কথা জানলে।’

নিরুপমারও এতক্ষণে হুঁশ হলো।সেও এগিয়ে এসে বলল
-‘হ্যাঁ নীলু আমাদের ব্যাপারে জানলি কীভাবে?’

নীলা বাঁকা হেসে বলল
-‘গত দুই তিনদিন যাবত আমার কাছে চিরকুট আসছিলো।যেখানে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ ভাবে বিয়ে ভাঙার কথা বলা ছিলো। লেখা গুলো বেশ চেনা চেনা লাগছিলো কিন্তু বুঝতে পারি নি কার লেখা।গায়ের হলুদে সকালে স্টেজের সামনে এসে দেখলাম আজ নিরুপমার গায়ের হলুদ লেখা আর চিরকুটের লেখাটা সেইম।যখন জিজ্ঞেস করলাম লেখাটা কে টানিয়েছে দিগন্ত ভাই বলল সে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগে দিগন্ত ভাই চলে গেলো।তারপর আবার রাতে দিগন্ত ভাইয়ার শরীরে সেই হুডিটা দেখেছিলাম যেটা ঐ আমাকে বাঁচিয়ে ছিলো সেই ছেলের শরীরে পড়া ছিলো।সব সন্দেহ দিগন্ত ভাইয়ার দিকে যাচ্ছিলো তাই রাতে দিগন্ত ভাইয়াকে ছাদে ডাকি।

কিন্তু তখনই দিগন্ত ভাই বলল লেখাটা নীড় ভাইয়ের আর হুডিটাও নীড় ভাইয়ার। তখনই সব সন্দেহ পরিষ্কার হলো।’

নীলার কথা শেষ হতেই নীড় হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো।এসেই নীলার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিলো।

নীলা এবার জড়ানো কন্ঠে বলল
-‘তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেড়ে ফেলো প্লিজ হাতে সময় নেই আর।’

তিমা ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘সময় নেই মানে?’

নীলা আমতাআমতা করে বলল
-‘আরে মেহমান সব গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে।তাই বললাম আর বিকেলও নেমে আসছে।’

সবাই নীলার কথায় সম্মতি দিয়ে বিয়ে শুরু করল। রাহাতের বাবা নির্জীব বসে রইল।রাহাতের মা এখনো বাড়ির ভিতরে। সে হয়তো শুনে নি সবটা।আজিজুর রহমান ভাইয়ের পাশে ভাইকে শক্ত করে ধরলো।

নীলা তার সাথে থাকা চেয়ারটা শক্ত করে ধরলো।বর্ণ নীলার পাশে এসে দাঁড়াতেই ও একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।বর্ণ নীলার আচরণে ভ্রু কুঁচকে ফেলল।

বিয়ে সম্পন্ন হলো।নীলা তার বাবার কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘বাবা’

আজিজুর রহমান মেয়ের এমন অদ্ভুত ডাকে উঠে দাঁড়ায়।বিচলিত কন্ঠে বলল
-‘মা তোমার কি শরীর অসুস্থ? চোখ এমন লাল হয়েছে কেন আম্মা? ঘামে চুল লেপ্টে আছে পিঠে? কি হয়েছে আম্মা?’

নীলা সবার দিকে একবার তাকালো তারপর আকাশ পানে চেয়ে বলল
-‘যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইবো না,আমি বাইবো না মোর খেয়া তরী,,,
এই হাঁটে গো,
যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
তখন তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে,,,,’

শেষের লাইনটা বলেই নীলা ঠাস করে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।সবাই ছুটে আসলো নীলার দিকে।ততক্ষণে নীলার দু হাতে জড়িয়ে রাখা চাদর টা হাত থেকে ফসকে পড়ে যায়। পুরো পিঠ রক্তে মেখে আছে।সাদা জামা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।

আজিজুর রহমান মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।সবাই আৎকে উঠে বলে
-‘রক্ত?’

এর মাঝেই ঘর থেকে কাজের বুয়া ছুটে এসে বলল
-‘বড় বাবা দেখে যান বড় মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে।বড় মা কথা বলছে না।’

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here