বিবর্ণ নীলাম্বরী পর্ব -২৯+৩০

#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ ঊনত্রিশ

রক্তাক্ত নীলাম্বরীকে দেখে একটুর জন্য থমকে যায় বর্ণ।সবাই যখন নীলাম্বরীর পিছে ব্যস্ত তখন কাজের মেয়েটা এসে আরেক খবর দিলো।মানুষ দিশেহারা হয়ে গেলো। আকষ্মিক ঘটনায় নিরব হয়ে যায় সব।

আজিজুর রহমান তার কলিজার টুকরা মেয়েকে রেখে ছুটে যায় ভাবির কাছে সাথে তার পিছে রাহাতের বাবা, দাদী,ফুপি সাথে আরও আত্মীয় স্বজন ছুট লাগায়।

নীলাম্বরীর নিথর দেহটা পরে থাকে মাটিতে।শারমিন চৌধুরী নীলার পিঠ উল্টে দেখে কোনো ধারালো কিছু দিয়ে বেশ জোড়ে আঘাত করেছে কেউ।হয়তো পিঠের মাংস ভেদ করে ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।নিরুপমা তার আদরের বোনের এ দশা দেখে পাগল প্রায়। আফসানা রহমান জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়।

অনেক মহিলারা মিলে আফসানা রহমানকে রুমের ভিতর নিয়ে যায়। বর্নের ধ্যান ভাঙে তার মায়ের চিৎকারে।সে তার প্রেয়সীর নিথর দেহটার পাশে বসে পরে।গালে কয়েকবার চড় মারার পর জোড়ে নিশ্বাস নেয় নীলা।বর্ণ টলমলে চোখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘ও নীলাম্বরী আপনি এমন করবেন না প্লিজ।আপনাকে আমাদের বড্ড প্রয়োজন। ও নীলাম্বরী তাকান।আমাদের তো এখনো কত গুলো বসন্ত একসাথে কাটানো বাকি তাই না! প্লিজ তাকান নীলাম্বরী।’

নীলাম্বরী ফেলতে পারে নি হতভাগা বর্ণের কথা।হয়তো যমের সাথে তমুল লড়ে পিটপিট করে চোখ তুলে তাকাল।

নীলাম্বরীকে তাকাতে দেখে উপস্থিত সবার শ্বাস জেনো আটকে গেলো।বর্ণ চোখের জল টা আর আটকে রাখতে পারলো না।চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলল

-‘ ও নীলাম্বরী চোখটা খুলে রাখুন প্লিজ।আপনার কিছু হবে না।সবার আপনাকে যে প্রয়োজন নীলাম্বরী।প্লিজ আমাদের মাঝে থাকুন।’

নীলাম্বরী তার রক্তলাল চোখটা দিয়ে সবার দিকে তাকালো। হয়তো খুঁজছে কাউকে।তার বাবাকে হয়তো।তার কন্ঠ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তবুও অনেক কষ্টে উচ্চারণ করে বলল
-‘আ আমাকে কারো প্র প্রয়োজন নেই।পুরো দু দুনিয়াটা বড্ড স্বার্থপর বর্ণ।বাবাকে ব বলবেন পুরো দুনিয়াটা বড্ড স্বার্থপর।বর্ণ চারদিকে সব,মিথ্যে কলরব।আমার বাবাকে দেখে রাখবেন ডাক্তার সাহেব।’

কথা সমাপ্ত হওয়ার আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলে নীলা।বর্ণ পাগলের মতন নীলাকে ডাকতে থাকে
-‘নীলা ও নীলা উঠেন না। কেউ স্বার্থপর না। এই যে আমাদের আপনাকে প্রয়োজন।উঠেন না।’

তারপর বর্ণ তার মায়ের হাতটা ধরে নীলাকে দেখিয়ে বলছে
-‘মা ওরে বলো না উঠতে।মা আমি কি করবো ওনাকে ছাড়া।প্লিজ মা ওরে বাঁচাও।মা কিছু করো প্লিজ।’

নীড় তার ভাইয়ের কাছে এসে পাঁজাকোলে তুলে নিলো নীলাকে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘ছোট আপুর এমনেতেই অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে।যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।আর করা যাবে না।ভাইয়া তুই তো ডাক্তার। তুই এমন করছিস কেন? ওরে হসপিটালে নিতে হবে।তুই তো জানিস এত রক্ত বের হওয়ার ফল কি হবে?’

বর্ণের এতক্ষণে হুঁশ হলো।নীড়ের পিছে ছুট লাগালো সবাই।বড় মাকেও বের করে আনা হয়েছে বাড়ি থেকে।তাকেও হসপিটালে নেওয়া হবে।

_______

কেউ প্রিয় মানুষ হারানোর আত্মচিৎকারে ভেঙে পড়ছে কেউবা নতুন একটা প্রাণ জন্ম নেওয়ার খুশিতে উদ্দাম আনন্দে মেতে উঠছে।একই সাথে হাসি কান্নার বিচিত্র দৃশ্য যেখানে দেখা যায় সেটা হলো হসপিটাল।তীব্র ফিনাইলের গন্ধ বারবার প্রিয় মানুষকে হারানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।ফিনাইলের গন্ধে সবসময় ততটা আমাদের সমস্যা না হলেও হসপিটালেন এই ফিনাইলের গন্ধটা আমাদের মৃত্যু নামক শব্দটা স্মরণ করিয়ে দেয়।এটার কোনো সঠিক লজিক বা ব্যাখ্যা নেই তবে ফিনাইলের গন্ধ টা প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় ঢুকিয়ে দেয়।

তেমনই দু দুজন প্রিয় মানুষকে হারানোর আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে কত গুলো মানুষ।তাদের প্রিয় মানুষ গুলো লড়াই করছে মৃত্যুর সাথে। তারা আবার ফিরে আসতে পারবে কি না জানা নেই কারো।তবে সবাই আলাদা আলাদাভাবে একজনকেই স্মরণ করছে সে হলো ঐ সৃষ্টিকর্তা।

প্রতিটা মানুষের বিধ্বস্ত অবস্থা। রাহাতের মা আর নীলাকে আলাদা আলাদা রুমে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে।আজিজুর রহমান মূর্তির ন্যায় বসে আছে সাথে তার বড় ভাই মানে রাহাতের বাবা।

শারমিন চৌধুরী আর তিমা বসে আছে অপর পাশে।নিরুপমা মায়ের কাছে থেকে গেছে।বর্ণ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। বর্ণের পাশে নীড় এসে দাঁড়ালো।তিমার স্বামী মাসুদও এসে দাঁড়ায়।

নীড় বর্ণের বাহুতে হাত রেখে বলল
-‘ভাইয়া তুই একটু বস।ছোট আপুর কিছু হবে না।তুই ভেঙে পড়লে কীভাবে হবে?’

মাসুদ বর্ণের বাহু আকড়ে ধরে আজিজুর রহমানের আঙুল তাক করে বর্ণের উদ্দেশ্যে বলল
-‘আমার ছোট গিন্নি তোমাকে কি বলেছিলো বর্ণ? ঐ মানুষটাকে সামলানোর দ্বায়িত্ব তোমার উপর দিয়ে গিয়ে ছিলো তাই না? তুমি ভেঙে পড়লে কীভাবে হবে।স্ট্রং থাকতে হবে এখন সবকিছুর জন্য।’

বর্ণ মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলে দেয়। আমাদের সমাজে অতি পরিচিত একটা কথা প্রচলিত আছে।ছেলেদের কাঁদতে নেই।আজ সেই ধরা বান্দা নিয়ম ভেঙে বর্ণ কেঁদে দিয়েছে।আচ্ছা ছেলেদের কান্না নিষেধ কেনো?তাদের কি কষ্ট নেই? সৃষ্টিকর্তা তো সব মানুষকে একই নিয়মে তৈরী করেছে তাহলে মেয়েদের ক্ষেত্রে কোমল আর ছেলেদের ক্ষেত্রে কঠিন বৈশিষ্ট্য টা তৈরী করেছে কেনো? সৃষ্টিকর্তা তো এমন কোনো নিয়ম সৃষ্টি করে নি সব ধরাবান্দা নিয়ম সৃষ্টি করেছে তো মানুষ।ছেলেদেরও মন আছে, তাদেরও কষ্ট হয় মানুষ ভুলে যায় কেনো?কান্নার চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছু নেই।কষ্ট পেলে কান্না করলে কষ্ট কমে,সৃষ্টিকর্তার সামনে কান্না করে মন থেকে কিছু চাইলে সেটা পূরণ হয়,ডিপ্রেশন কমায় আর সেখানে ছেলেদের কান্না করা মানায় না বলে তাদের কষ্ট কমানোর ব্যবস্থাকেও শেষ করে দেওয়া হয়।

এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিকে শান্ত করতে ওটি থেকে ডাক্তার বের হয়ে আসলো।নীড় দ্রুত ছুটে গেলো ডাক্তারের কাছে।ডাক্তার জানালেন
-‘সরি।আপনাদের রোগী বেশ উঁচু থেকে পড়ে যাওয়ায় ভয়ে আতঙ্ক আর অতিরিক্ত ব্যাথায় স্ট্রোক করেছে।আর তাই তার দেহের এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। এবং মুখ বাকা হয়ে যাওয়ার কারণে বাক্ শক্তি হারিয়েছে।’

নিজের স্ত্রীর এমন দশা শুনে আমজাদ আলী মানে রাহাতের বাবা ধপ করে বসে পড়ে। মাসুদ গিয়ে ধরে তাকে।আজিজুর রহমান নির্বাক হয়ে যায়। কি হয়ে গেলো তার পরিবারের সাথে এটা? তার মেয়েকে ক্ষতবিক্ষত করেছে কেউ তার বড় ভাবিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।মেয়েটা বাঁচবে কিনা সে জানেনা।ধ্বস নেমে গেছে পরিবারে।এই পরিবারকে সামলে উঠবে কীভাবে। সে নিজেকে সামলাবে কীভাবে? তার মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে যে শেষ হয়ে যাবে।

বর্ণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছুই বুজছে না।রাহাত সবটা করেছে ঠিক আছে।কিন্তু যখন নীলাকে আহত করা হয় তখন রাহাত ছিলো বিয়ের আসরে।আর নীলাকে যে আঘাত করেছে সে-ই বড় মাকে ধাক্কা দিয়েছে।নিজের মাকে নিশ্চয় রাহাত ধাক্কা দেওয়ার কথা ভাববে না কোনো মতেই।তার মানে রাহাতের পিছেও কেউ আছে।আবার এমন হতে পারে রাহাত ছাড়াও নীলার আরেকজন শত্রু আছে যে নীলাকে মারতে চায়।কিন্তু কে সে?

বর্ণের ভাবনার মাঝেই কেউ একজন ছুটে আসলো।বর্ণ তাকিয়ে দেখে আফসানা রহমান আর নিরুপমা।আফসানা রহমান এসে তার বড় জা এর কন্ডিশন শুনে থমকে যায়। সে সবাইকে একবার ঘুরে দেখে।এখানে উপস্থিত সবাই ভেঙে পড়েছে।আফসানা রহমান দেয়ালেে সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বর্ণের দিকে তাকায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তার কাছে।শান্ত স্বরে বলল
-‘বর্ণ?’

বর্ণ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘জ্বি আন্টি?’

আফসানা রহমান শান্ত কিন্তু শক্ত কন্ঠে বলল
-‘এখানে সবার দিকে তাকিয়েছো? সবাই ভেঙে পড়েছে। আচ্ছা তুমি বলো এখন ভেঙে পড়ার সময়?একদমই না।সবাই ভেঙে পড়লে হবে কীভাবে? আর এখন নীলার জন্য তোমার নিজেকে শক্ত রাখা জরুরী। নীলা তার পরিবারকে তোমার দ্বায়িত্বে দিয়ে গেছে না? তাহলে তোমার এমন ভেঙে যাওয়া মানায়।’

বর্ণ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে টলমলে চোখে ডানেবামে মাথা নাড়ায় যার অর্থ “মানায় না।” আফসানা রহমান চোখ দিয়ে ভরসা দেয়।কিন্তু তার নিজের ভিতরে কি যাচ্ছে শুধু সে জানে।

এর মাঝেই নীলার ডাক্তার বের হয়।বর্ণ এগিয়ে গিয়ে কিছু বলার আগেই ডাক্তার চাকচক্যময় একটা খবর দিলেন।সবাই বেশ অবাক হয়ে যায়। ডাক্তার বললেন
-‘আপনাদের পেশেন্টকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।আর মনে হয় আঘাত করার পর তাকে ইনজেকশন পুশ করা হয়।যেটা এক ধরনে বিষ ধরতে পারেন।আর এই ওষুধটা আপনাদের পেশেন্টকে বেশ আগে কয়েকবার দেওয়া হয়েছিলো মনে হয়। যার জন্য আপনাদের পেশেন্টের ব্রেণের সমস্যা ধরা দিয়েছিলো।আর যতটুকু মনে হয় সে ওষুধও নিতো। কিন্তু সে চিকিৎসা শুরু করে নি।আর আজ ডোজ টা হাই পাওয়ারের হওয়াতে তার ব্রেণ একবারে কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে বললেই চলে।অতিরিক্ত রক্তও বের হয়ে গেছে।আমরা কোনো রূপ আশা দিতে পারছি না।’

ডাক্তার কথা শেষ করে চলে যায় আর উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায়। আজিজুর রহমান, আফসানা রহমান বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে।বর্ণ মেডিসিনের ব্যাপারটা জানতো তাই সে সবটা সবাইকে খুলে বলে।সবটা শুনে সবাই আরেক দফা অবাক হয়।তাদেরই অগোচরে তাদের মেয়েকে কেউ মারার জন্য এই জাল ফেলে রেখেছিলো।তাদের মেয়ে সবাইকে কিছু জানায় নি ভেঙে যাবে বলে!কিন্তু বর্ণ এটা ভেবে অবাক হয় আজও নীলাকে সেইম ওষুধ দেওয়া হয়েছে।তার মানে কাজটা খুব পরিচিত কেউ করেছে। যে আগেও নীলার ক্ষতি করার জন্য এই ওষুধ গুলো দিয়েছে।কিন্তু সে কে?
#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ ত্রিশ

দীর্ঘ আটচল্লিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখার পর জ্ঞান ফিরলো নীলার।নীলার অবস্থা বেশ শোচনীয়। তার ব্রেণ একবারেই ড্যামেজ হয়ে গেছে যে অপারেশন করা ছাড়া গতি নেই।নীলাকে বাহিরের দেশে নিয়ে যেতে হবে।

নীলা নির্জীব শুয়ে আছে হসপিটালের বিছানায়। নীলার জ্ঞান ফিরেছে বলে সবাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেলো তার কেবিনে।

রুমে অন্য কারো উপস্থিতি পেয়ে চোখ খুলে তাকায় নীলা।দেখে তার সামনে তার পুরো পরিবার, বর্ণ ওর মা,নীড়,তিমা আপু,মাসুদ ভাইয়া।

সবাইকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে মুচকি হাসে নীলা। নীলার হাসি দেখে সবার জেনো প্রাণ ফিরে এলো।নিরুপমা অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছিলো কিন্তু তার নির্জীব, নিষ্প্রাণ বোনটাকে দেখে আর কান্না আটকিয়ে রাখতে পারে নি।এতটুকু একটা মেয়ে কত কিছু সহ্য করলো।

নীলার অনেক কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে তবুও সে বেশ ধীর কন্ঠে বলল
-‘আপাই কাঁদছো কেন?আমি তো সুস্থ হয়ে গেছি।কেঁদো না আপাই।’

নীলার কথা শুনে নিরুপমা আরও ভেঙে পড়েছে।তার বোনটা জানেও না তার ভিতরে কত বড় রোগ নিয়ে বসে আছে সে।

আজিজুর রহমান বড় মেয়ের কান্নার কারণ বুঝতে পেরেছে।সে তার মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘নিরু এটা একটা রোগীর রুম। এখানে কান্নাকাটি করা মানায় তুমিই বলো?না রোগী এটা মানতে পারবে?’

নিরুপমা বাবার কথার ইঙ্গিত বুঝে অনেক কষ্টে নিজেকে চুপ করালো।তারপর ধীর গলায় বলল
-‘তুই এমন কেনো করলি নীলু?তুই যদি প্রথমে এসেই তোর ক্ষতটা দেখাতি তাহলে হয়তো এতটা ক্ষতি তোর হতো না।আর না বড়মায়ের ,,, ‘

বাকি কথা শেষ করার আগে বর্ণ নিরুপমাকে থামিয়ে দেয়। নীলা ভ্রু কুঁচকে বলে
-‘বড়মার কি হয়েছে আপাই? বলো আমাকে বড়মা কোথায়? তুমি চুপ হয়ে গেলে কেনো?’

আমজাদ আলী মানে রাহাতের আব্বু অবস্থা বেগতিক দেখে নীলার পাশে গিয়ে বসে।নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
-‘কিছু হয় নি তোমার বড় মায়ের।তুমি অসুস্থ হয়েছো তাই তোমার বড় মা অনেক চিন্তায় পড়ে গেছে। চিন্তায় চিন্তায় সে-ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।সেটাই নিরুপমা বলতে চেয়েছে।আর সত্যিই তো তুমি কেনো আগে এই দুর্ঘটনার কথা না বলে বিয়ে নিয়ে এত উঠেপড়ে লেগে ছিলে? তোমার কতটা ক্ষতি হয়েছে জানো?’

নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘তখন আমার বেঁচে থাকার চেয়েও আপাইয়ের সুন্দর জীবনটা বেশি প্রয়োজন ছিলো।’

-‘আর তোরে যে আমাদের সবার প্রয়োজন সেটা জানিস না? এমন বোকামী কেউ করে?’

নিজের মায়ের কথায় নীলু মায়ের দিকে ঘুরে তাকালো।আফসানা রহমান এগিয়ে এসে বলল
-‘নীলু তুমি কি জানো না তুমি আমাদের কাছে কী?তোমাকে আমি বা আমরা কতটা ভালোবাসি।তোমার এত বড় বোকামী করাটা একদমই উচিত হয় নি।এখানে উপস্থিত প্রত্যেক টা মানুষ জানো কীভাবে ভেঙে পড়েছিলো?সবার কথা ভাবলে নিজের কথা ভাবলে না?’

আজিজুর রহমান তার স্ত্রীকে চুপ করিয়ে দিলেন।নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন
-‘আম্মু তোমার এখন কেমন লাগছে?আমরা কতটা চিন্তায় পড়ে গিয়ে ছিলাম জানো? এমনটা আর কখনোই করো না।’

নীলা মুচকি হেসে বলল
-‘আমার বাবাই তো শিখালো অন্যের খুশি নিজের খুশি আজ আবার বাবাই অন্য কথা বলছে? ইট’স নট ফেয়ার বাবা।’

নীলুর কথায় সবাই হেসে দিলো।সবাই নীলুকে দেখে দেখে বের হয়ে গেলো। শারমিন চৌধুরী নীলুর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। পুরো কেবিনে শুধু একজন উপস্থিত সে হলো বর্ণ।নীলু বেশ ক্ষানিক সময় বর্ণকে খেয়াল কর ছিলো।বর্ণ কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া করে নি।অবশেষে নীলা বাধ্য হয়ে ডাক দিলো
-‘ডাক্তার সাহেব।’

বর্ণ মুখ তুলে তাকায় নীলার মুখপানে।তার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে এ মেয়েটা এত কিছু সহ্য করছে বা ভবিষ্যতে করবে।তার বুক কাঁপছে।বরাবরই সে শক্তপোক্ত মনের অধিকারী। কিন্তু আজ তার কি দশা।এতটা ভেঙে সে কখনোই যায় নি।

বর্ণের কোনো হেলদোল না দেখে নীলা আবারও ডাক দিলো
-‘ডাক্তার সাহেব কথা বলবেন না?’

বর্ণের ধ্যান ভাঙলো।সে ধীর গতিতে নীলার পাশে এসে বসলো।নীলার হাতটা ধরতে নিয়েও আবার কোনো একটা কারণে সে নিজের হাতটা আবার পিছিয়ে নেয়।নীলা সবটাই খেয়াল করেছে।মুচকি হেসে সে ক্যানাল লাগানো হাতটা এগিয়ে বর্ণের হাতটা ধরলো।

বর্ণ খুব যত্ন সহকারে নীলুর হাতটা নিজের হাতের ভাজে আটকে নেয়।মনে হয় ছেড়ে দিলেই হয়তো তার নীলাম্বরীকে কেউ নিয়ে যাবে।

নীলাও ভরসা পায় এই হাতটার মাঝে।

_________

আজ চারদিন হলো নীলা নিজের ফ্লাটে এসেছে। হসপিটাল থেকে রিলিজ হওয়ার পরই নীলাকে নিয়ে তার পরিবার ঢাকা চলে আসে। নীলার ফ্লাটে তার বাবা মা চলে আসে।আর নিরুপমাকে বর্ণদের ফ্লাটেই তোলা হয়।

নীলার ক্ষত সেড়ে যাচ্ছে কিন্তু আরেকটা রোগ যেটা শরীরের ভিতরে সেটা ধীরে ধীরে তাজা হয়ে উঠছে।আজকাল বেশিরভাগ সময় নীলা নিজের রুমে শুয়ে থেকেই কাটায়।মাথা যন্ত্রণায় তার কিছু ভালো লাগে না।

এখন চারদিকে সন্ধ্যা নেমেছে।প্রতিদিনের ন্যায় আজও নীলা শুয়ে আছে।হঠাৎ ই তার রুমে কেউ প্রবেশ করলো।নীলা ঘাঁড় ঘুরিয়ে দেখে তাে বাবা। নীলা বাবাকে দেখে উঠে খাটের সাথে ভর দিয়ে বসলো।

আজিজুর রহমান মুখে হাসি বজায় রেখে মেয়ের দিকে এগিয়ে আসলো।নীলাও বাবার হাসির পরিবর্তে হাসি ফিরিয়ে দিলো।আজিজুর রহমান মেয়ের পাশে বসে বলল
-‘কেমন আছে আমার আম্মাটা?’

-‘অনেক ভালো আছে বাবা।’

মেয়ের উত্তরে আজিজুর রহমান খুশি হওয়ার বদলে মনে মনে ব্যাথা অনুভব করলো।মেয়ে ভালো আছে বলছে ঠিকিই কিন্তু মেয়ে টা যে তার সত্যি ভালো নেই।

আজিজুর রহমানকে চুপ থাকতে দেখে নীলা হেসে বলল
-‘কি ভাবছো বাবা?’

আজিজুর রহমান জোড় করে মুখে হাসি টেনে বলেন
-‘কিছুই না মা।তুমি একা একা রুমে শুয়ে না থেকে একটু ড্রয়িং রুমে বসতে পারো তোমার আপাইয়ের সাথে কথা বলতে পারো সেটা করলে তোমার মন বেশ ফুরফুরা থাকবে।’

নীলা মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘হ্যাঁ বাবা তা তো পারি।কিন্তু মাথা ব্যাথার জন্য উঠতে পারি না।’

আজিজুর রহমান এবার কতক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলল
-‘আচ্ছা মা একটা সত্যি করে কথা বলো তো, সেদিন ঠিক কী কী হয়েছিলো?’

নীলা চুপ হয়ে যায়। এতদিন তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে নি।হয়তো অসুস্থতার জন্য।

আজিজুর রহমান মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে বলল
-‘মা তোমার মাথায় চাঁপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।যদি মনে না করতে পারো তাহলে মনে করারও প্রয়োজন নেই।’

নীলা কতক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
-‘আমার মনে আছে বাবা সব।সেদিন আমি পুলিশকে কল দিয়ে কথা বলার পর দেখি আমার দরজার বাহিরে কেউ ছিলো।আমি কে কে বলে সেখানে গিয়ে দেখি কেউ নেই।আমি আবার রুমের ভিতরে ঢুকতে নিলেই হঠাৎ কেউ আমাকে পিছন থেকে ছুড়ি মারলো।আমি পিছে ঘুরার আগেই আমার হাতে মনে হলো ইনজেকশন পুশ করলো।আমি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।সে কি অসহ্য যন্ত্রণা। মনে হচ্ছিলো আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে।কিন্তু আপাইয়ের কথা মনে পড়তেই উঠে দাঁড়ালাম। তারপর তো সব জানো।আমি তার চেহারা আর দেখতে পারি নি।’

নীলা কথা বলতে বলতেই বেশ উত্তেজিত হয়ে গেলো।আজিজুর রহমান মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাত বুলালো মেয়ের মাথায়। নীলা উত্তেজিত হয়ে বলল
-‘বাবা তুমি আমাকে আমাদের বাড়ি নিলে না কেনো? আমাকে বড় মা দেখতে আসলো না কেনো? কই বড় মা? সবাই এখানে চলে আসছো কেনো? বড়মা আসে নি কেনো?’

আজিজুর রহমান ভড়কে যায় নীলাকে উত্তেজিত হতে দেখে।আফসানা রহমানও মেয়ের কন্ঠ শুনে ছুটে এসে মেয়েকে ছটপট করতে দেখে দিশেহারা হয়ে যায়। কতক্ষণ ছটফট করতে করতে একসময় জ্ঞান হারায় নীলা।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here