বিরহ শ্রাবণ ২ পর্ব – ২৩

#বিরহ_শ্রাবণ(দ্বিতীয় খণ্ড)
#পর্ব_২৩
#লেখিকা_সারা মেহেক

আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এ মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় বোধ হচ্ছে। এতোদিন যাবত নিজেকে কখনো এতিম বলে মনে হয়নি। কিন্তু আজ এ ঘটনা, এ পরিস্থিতি, এ বাড়ির মানুষজন যেনো জোর করে মনে করাচ্ছে আমায়, আমি এতিম। আমি প্রোজ্জ্বল ভাইকে আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। নীরবে কাঁদতে কাঁদতে ওয়াশরুমে চলে এলাম। এ মুহূর্তে এই একটি জায়গাই আমার কান্না করার জন্য সঠিক স্থান মনে হচ্ছে।

কতক্ষণ সময় পেরিয়ে গেলো তা শুধু অনুমান করলাম আমি। হয়তো এক বা দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে বা তারও কম সময়। আমি ভালোমতো মুখমণ্ডল ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ওদিকে বৃষ্টিও কমে গিয়েছে বহুক্ষণ পূর্বে।

ওয়াশরুম হতে বেরিয়েই আমার দৃষ্টি আটকে গেলো প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের উপর। উনি বিছানায় না ঘুমিয়ে মেঝেতে মাদুর ও একটা মোটা কাঁথা বিছিয়ে ঘুমাচ্ছেন। উনার এ কাজে আমি ভীষণ অবাক হলাম। উনি নিচে ঘুমাচ্ছেন কেনো? আমার জানামতে আমি একবারো উনাকে মেঝেতে ঘুমাতে বলিনি বা আমার ঘুমের কোনো সমস্যা হবে এ কথাও জানাইনি। তাহলে উনি স্বেচ্ছায় মেঝেতে ঘুমাচ্ছেন কেনো? আমার আসলে উনাকে জানানো দরকার ছিলো যে আমি নিজের রুমে গিয়েই ঘুমাবো। উনার রুমে ঘুমানোর প্রয়োজন নেই আমার।
এ ভাবনা নিয়েই আমি অনেকটা নিঃশব্দে দরজা খুলে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। স্বভাবতই আমার রুমের সামনে গিয়ে দরজা খুলতে নিলাম। কিন্তু দরজা বন্ধ পেলাম। ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম, দরজা বাইরে থেকে নয় ভিতর থেকে বন্ধ। অর্থাৎ আমার রুমে কেউ ঘুমাচ্ছে। নিমিষের ভাবনায় মনে পড়লো, বাড়িতে এখনও নানুর দুই বোন আছে। হয়তো তারা এ রুম খালি পেয়ে এখানেই ঘুমাচ্ছেন।
আমি আর উপায়ন্তর না পেয়ে গো’ম’ড়া’মুখে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুমে ফিরে এলাম। এ মুহূর্তে আমার ঘুমানোর মতো এই একটা রুমই অবশিষ্ট আছে। ঘুমালে এখানেই ঘুমাতে হবে। নয়তো সারারাত জেগে থাকতে হবে। কিন্তু সারারাত জেগে থাকার মতো শক্তি ও ইচ্ছা কোনোটাই নেই। তাই বাধ্য হয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের খাটে শুয়ে পড়লাম। গায়ে কাঁথা জড়িয়ে জানালার পাশে গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

———–

ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ সেরে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। ভোরের পূর্বাকাশ আগত সূর্যের মৃদু আলোয় রাঙায়িত হতে শুরু করেছে। কাছের নারিকেল গাছের আড়াল হতে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ পর কানে ভেসে এলো সেলিম মামার সাইকেলের টুংটাং শব্দ। প্রতি সকালে উনার সাইকেলের টুংটাং শব্দ কানে আসবে আমার। এ যেনো এক রুটিন হয়ে গিয়েছে আমার জন্য।

দেখতে দেখতে সকাল হয়ে এলো। আমি বারান্দা ছেড়ে উঠে রুমে গেলাম। দেখলাম প্রোজ্জ্বল ভাই ঘুম হতে জেগে গিয়েছেন। আমি উনাকে দেখেও না দেখার ভান করলাম। উনি বারান্দার দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। আমি নীরবে উনাকে পাশ কাটিয়ে রুম হতে বেরিয়ে এলাম। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম মামির সাথে দেখা করা দরকার। স্বপক্ষের যুক্তি দিয়ে মামির ক্ষমা চেয়ে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উনি ক্ষমা না করলে যে আমি কিছুতেই শান্তিতে থাকতে পারবো না। প্রতি মুহূর্ত আমার জন্য অ’তি’ষ্ঠ’ম’য় হয়ে উঠবে।

আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম মামা ও তিন নানুরা মিলে কি বিষয়ে যেনো কথা বলছে। আমি তাদের এক নজর দেখে চুপচাপ রান্নাঘরে চলে এলাম। রান্নাঘরে মামি প্রত্যাশা আপু কাজ করছে। আমাকে দেখেই প্রত্যাশা আপু হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
” উঠেছিস! ঘুম ভালো হয়েছে তো?”

আপুর এ প্রশ্ন শোনামাত্রই মামি কড়াইয়ে ভাজি নাড়তে নাড়তে আড়চোখে আমায় দেখে নিলেন। আমি কিছু বলতে যাবো, এর পূর্বেই মামি বললেন,
” প্রত্যাশা, ওকে এখনই যেতে বল। ওর চেহারা দেখতে মন চাইছে না। সকাল সকাল আমার মেজাজ খারাপ করতে চাই না। প্রয়োজন হলে ওর খাবারদাবার রুমে দিয়ে আসবি। ”

মামির এমন কড়া কথা শোনামাত্র আমার চোখজোড়া নোনা জলে ভিজে উঠলো। কখনো যে মানুষের ঘৃ’ণা, অবহেলা দেখিনি সে মানুষটা আচমকা এক ঘটনার কারণে আমাকে অবহেলা করছে, দু চোখে সহ্য করতে পারছে না। এ আমি কিভাবে মেনে নিবো। কিভাবে সহ্য করবো মামির এ অবহেলা!
আমি করুণ স্বরে মামিকে বললাম,
” মামি? আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? আমি কি এতো বড় অপরাধ করে ফেলেছি যার জন্য আমাকে এভাবে অবহেলা করছেন? আপনার অবহেলা যে আমি সহ্য করতে পারবো না মামি৷ ”

মামি পূর্বের মতোই বললেন,
” আমার সামনে নাটক করতে আসবি না চন্দ্রিমা। আমার মাথা গরম হলে কিন্তু ভালো হবে না বলছি। চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে। ”

প্রত্যাশা আপু বললো,
” আহা, মা, তুমি এমন করছো কেনো? এ ঘটনায় ওর কি দোষ। দোষ দিলে বাবা আর দাদিকে দাও। চন্দ্রিমার সাথে এমন করছো কেন?”

এরই মধ্যে হয়তো আমাদের এ কথোপকথন শুনে মামা, নানু এবং তার বোনেরা ও শাহাদ ভাইয়া রান্নাঘরে চলে এলেন। মামা হয়তো মামির কথাগুলো শুনেছিলেন। তাই তো বললেন,
” চন্দ্রিমার সাথে এমন ব্যবহার করছো কেনো? ও না তোমার মেয়ে?”

মামি এবার ভাজি নাড়া বাদ দিয়ে চুলো বন্ধ করে দিলেন। মামার দিকে ফিরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
” মেয়ে হয়েই থাকতো। কেনো ছেলের বউ হতে গেলো? আমি তো ওকে সারাজীবন মেয়ের মতো রাখতে চেয়েছি। কখনো চাইনি ও আমার ছেলের বউ হোক। তোমাকে কি কখনো বলিনি, আমি শারমিনকে এ বাড়ির বউ করতে চাই? তাহলে কি কারণে তুমি প্রোজ্জ্বলের সাথে চন্দ্রিমার বিয়ে দিলে?”

নানু বললেন,
” সিদ্ধান্তটা শুধু ওর একার না। আমিও মত দিয়েছিলাম এতে। আর এ বাড়ির বড় হিসেবে আমার সিদ্ধান্তকে কি গুরুত্ব দেওয়া উচিত না বউমা?”

” আম্মা, আমি আপনার সিদ্ধান্তকে সবসময় সম্মান জানাই। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি মোটেও তা করতে পারছি না। আমি সবসময় চেয়ে এসেছি শারমিনকে এ বাড়ির বউ করতে। তাহলে চন্দ্রিমা কেনো এখন? আমার বোনকে আমি প্রায় কথা দিয়ে রেখেছি। এখন ওকে আমি কি করে মুখ দেখাবো আম্মা? বলতে পারেন? আপনাদের কারোর সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হয়নি। আপনাদের এ সিদ্ধান্তের জন্য আমি চন্দ্রিমাকে ঘৃ’ণা করতে বাধ্য হয়েছি। আর প্রোজ্জ্বল, ওর কথা বললামই না। ও তো মানুষের সামনে মুখ দেখানোর মতো অবস্থা রাখেনি আমার। ”

ইতোমধ্যে প্রোজ্জ্বল ভাইও চলে এলেন রান্নাঘরে। উনাকে দেখে মামি পূর্বের চেয়েও আরোও আ’ক্রো’শের সহিত বললেন,
” তোরই কমতি ছিলো প্রোজ্জ্বল। আয় আয়, মায়ের সম্মানের তামাশা হতে দেখ। বাপের সাথে মিলে তো একটা সিদ্ধান্ত নিলি। একবারও কি এক্ষেত্রে আমার কথা মাথায় আসেনি তোর? ”

প্রোজ্জ্বল ভাই এগিয়ে এলেন মামির দিকে। উনার দৃষ্টি এলেমেলো। হয়তো বুঝতে পারছেন না কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে এখানে। উনি বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” সকাল সকাল এসব কি বলছো মা? হঠাৎ মাথা গরম হলো কেনো?”

” এমন ভাব ধরছিস যেনো কিছুই জানিস না। যা তো আমার সামনে থেকে। না, তোরা থাক। আমিই যাই। এই রঙ তামাশার মধ্যে থাকতে ভালো লাগছে না আমার। যার যার খাওয়া দরকার সে যেনো নিজ দায়িত্বে খেয়ে নেয়। ”
এই বলে মামি তৎক্ষনাৎ চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই প্রোজ্জ্বল ভাই আমার দিকে তাকালেন। উনার চাহনি হয়তো কিছু বলছে। কিন্তু উনার চাহনির ভাষা পড়ার ইচ্ছে এ মুহূর্তে নেই আমার। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে আমার রুমে চলে এলাম।

————–

কাঁদতে কাঁদতে যে কখন আবার ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। ঘুম ভাঙলো দরজায় কড়াঘাতের শব্দে। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম আপু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
” ঘুমাচ্ছিলি?”

” হুম আপু। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। কিছু বলবে?”

” হুম। শারমিন এসেছিলো। তোর আর প্রোজ্জ্বলের সাথে কিছু কথা বলবে বলে। তোকে খুঁজছিলো। ”

অকস্মাৎ শারমিন আপুর আগমনী বার্তা শুনে আমার বুক ধক্ করে উঠলো। মোটেও আশা করিনি শারমিন আপু চলে আসবে। ভয় হচ্ছে, মামির মতো যদি শারমিন আপুও আমার সাথে এমন করে!

আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম,
” কোথায় উনারা?”

” ছাদে আছে। তোকেও ছাদে যেতে বললো।”

” আচ্ছা আপু। আমি যাচ্ছি। ”

আমি ধীর পায়ে হেঁটে ছাদে চলে এলাম। ডান পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ছাদের ছায়াপূর্ণ জায়গায় প্রোজ্জ্বল ভাই ও শারমিন আপু বসে আছেন। আমাকে দেখেই শারমিন আপু হাসিমুখে বললেন,
” আরে চন্দ্রিমা, এসো এসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ”

শারমিন আপুর এ কথায় আমি আড়ষ্ট হয়ে এলাম। ভেতরে উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগলো। আমি ভীতসন্ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলাম দুজনের দিকে। ওখানে গিয়ে শারমিন আপুর পাশে বসলাম। বসার সাথে সাথেই আপু আমার গাল আলতো করে টেনে মিষ্টি মুখে বললেন,
” কেমন আছো নতুন বউ? কালকে রাতটা ভালো কেটেছে তো?”
এই বলেই শারমিন আপু একগাল হেসে দিলেন। এ মুহূর্তে ও এমন পরিস্থিতিতে উনার এহেন প্রশ্ন আশানুরূপ ছিলো না আমার জন্য। বিশেষ করে এমন প্রশ্নের শেষে হাসি!
®সারা মেহেক

#চলবে

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here