বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি পর্ব ৪+৫

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৪

ঘরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা জুড়ে সেহের পায়চারী করছে।চোখ মুখ চিন্তায় কাতর ।লিয়া সেহেরের এই উত্তেজনা প্রবল চেহারা দেখে মিটমিট করে হাসছে।
“আরে এতো নার্ভাস হচ্ছো কেন? ভাবাভাবির কি আছে? ভাইয়ার রুমে যেয়ে টেবিলের উপর লেটার গুলো রাখবে তারপর সোজা চলে আসবে সিম্পল ”
লিয়ার কথায় সেহের থামলো।সরু চোখ করে তাকিয়ে বলল ,”ব্যস! এতোটুকুই? তোমার কাছে সবটা এতো সিম্পল মনে হচ্ছে! যদি তোমার রাক্ষস ভাইয়ের খপ্পরে পরি তখন? ”
“তখন আর কি কান ধরে মিষ্টি করে সরি বলবে।তোমার বাচ্চা বাচ্চা চেহারা দেখে ভাই একদম আইসক্রিমের মত গলে যাবে। ”
লিয়া এতোটুকু বলে শব্দ করে হাসতে লাগে।সেহের গাল ফুলিয়ে নেয়।গলায় অভিমানের সুর টেনে বলে,”আমার সাথে মজা করা হচ্ছে? আমি এতো বড় এক প্রব্লেমে ফেসেছি আর তুমি তা নিয়ে মজা করছো? ”
“এ মা মজা কি? আমি একদম মজা করছি না।সিংহিনী মত যেয়ে লেটার গুলো রেখে আসো।আমি চললাম!”
“আমাকে একা রেখে তুমি কোথায় চললে? ”
“বললাম না আমার ডিপার্টমেন্টের এক ফ্রেন্ডের বার্থডে । কি ভুলে গেলে? ”
“ওহহ! তুমি সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছো? ”
সেহের মন খারাপের স্বরে বলল।লিয়া আশ্বস্ত গলায় বলল,”কাছে্র বন্ধু না হলে সত্যি যেতাম না। ”
“যাও ,তাড়াতাড়ি ফিরে এসো! ”
“তোমাকেও অল দ্যা বেস্ট! ”

লিয়া বেরিয়ে যায়।সেহের সারা দুপুর চিন্তায় বিভোর থাকে।বিকাল হতেই আকাশ কালো মেঘে ভরে যায়।পৃথিবীতে আঁধার ঘনিয়ে আসে।আকাশের লাল আগুনজ্বলা সূর্যটা মেঘের আড়ালে কোথাও হারিয়ে যায়। আষাঢ়ের আকাশ কখনো রোদ ,কখনো মেঘ! রোদ মেঘের লুকোচুরির মাঝে ঝপঝপ বৃষ্টি শুরু হয়।দূর মসজিদে মাত্রই আছরের আজান পরেছে অথচ বাহিরে দেখে মনে হচ্ছে দিনের শেষভাগের সামান্য আলো কাটিয়ে সন্ধ্যার আঁধার নামবে বলে।সেহের ছোট ছোট পা ফেলে সতর্কতা অবলম্বন করে তার রাক্ষস প্রতিবেশীর রুমের দিকে পা বাড়াচ্ছে। মনে মনে পণ করে নিয়েছে যে করেই হোক লেটার গুলো ঐ রুম অবধি পৌছাবেই পৌছাবে।দরজা সামান্য ফাঁকা করে পুরো রুমে চোখ বুলায়।রুমে কেউ নেই।সেহের এই সুযোগে আলতো পায়ে রুমে ডুকে।পুরো রুম আঁধারে ডাকা।ভারী ভারী পর্দার আড়াল থেকে সামান্য আলোক রশ্মি দেখা মিলছে।এ কোন সাধারণ রুম নয় যেন কোন রাজপ্রাসাদের বিলাসকক্ষ । পুরো রুমে অভিজাত্বের ছোঁয়া।ওয়াশরুম থেকে শাওয়ারের শব্দ আসছে।সেহের ভাবলো , রাক্ষস প্রতিবেশী নিশ্চয় শাওয়ার নিচ্ছে! এটাই সুযোগ লেটার গুলো রাখার।বিছানার পাশে ছোট টেবিলটার উপর লেটার গুলো রেখে ,যেই না পিছনে ঘুরবে এমন সময়ই কারো শক্ত চওড়া বুকের সাথে ধাক্কা লেগে সেহের টেবিলের উপর পরে।নিজেকে সামলিয়ে সামনে তাকাতেই সেহের ভয়ে কেঁপে উঠে।ভেজা শরীরে সাদা তয়লা প্যাঁচানো কেউ দাড়িয়ে ।হালকা লোমশ বুকে বিন্দু বিন্দু জলকণা। গাঁ থেকে কেমন যেন মাতাল মাতাল মিষ্টি ঘ্রাণ ।সেহের মুখ না দেখে বলতে পারছে”এটাই তার রাক্ষস প্রতিবেশী আরহাম খান”সেহের ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।চাইবে না এই মানুষটার দিকে।এই মানুষটার মাঝে কেমন যেন এক মায়া আছে যা মুহূর্তেই মোহিত করে ।আর চোখের দিকে তো একদম তাকাবে না। গুরুজন বলেন,”কাউকে মায়ায় ঘয়েল করার জন্য চক্ষু হলো মুখ্য প্রহরণ ।” যেই মানুষটা দেখতে এতো সুন্দর ,না জানি তার চোখ কতটা সুন্দর হবে? সেহের ভেবেই নিলো দুনিয়া উল্টে যাক,তবুও সে এই মানুষটার চোখের পানে চাইবে না।না মানে একদম না।পরবে না তার মায়াবী চোখের নেশায়।সেহের ভেজা কবুতরির মত দেয়ালের সাথে ল্যাপটানো। চোখ মুখ তখনো শক্ত ভাবে খিঁচে । নিজের খুব কাছে আরহামকে অনুভব করে। আরহামের ভারী ভারী উষ্ণ নিশ্বাস তার ঘাড়ের উপর পরে মনে ভয়ংকর শিহরন তুলছে । সেহের ছোট ঢোক গিলে সরে যেতে নিলে আরহাম শক্ত করে তার কোমর চেপে ধরে। শক্ত গলায় বলে,”চুরি করতে এসেছো মিস. চাশমিস? ”
আরহামের কথায় থতমত খায় ।সে কি দেখতে চোরের মত ? এই রাক্ষসটা তাকে চোর উপাধি দিলো?আর চাশমিস কি?
সেহের চোখের চশমা ঠিক করে রেগে গাল ফুলিয়ে উত্তর দিলো ,”জি না,আমি চোর না। ভয় পাবেন না আমি আপনার খাজানা লুট করতে আসিনি। ”
“তবে কেন এসেছো? প্রেম নিবেদন করতে? ”
“জি না ”
“তো ”
“এই লেটার গুলো দিতে! ”
“আই নো আমি হ্যান্ডসাম ।মেয়েরা আমার জন্য পাগল । তাই বলে প্রথম দেখাতেই লাভ লেটার? কেমন দেখায় না মিস চাশমিস! ”
“ও হ্যালো! আমার এতো খারাপ দিন আসেনি আপনাকে লাভ লেটার দিবো।ভার্সিটিতে রেগিং এর পাল্লায় পরে টাস্ক স্বরূপ আপনার কাছে লেটার গুলো পৌছিয়ে দিতে বলেছে। তাই আমি এখানে।তাছাড়া আমার কোন শখ নেই আপনার মুখোমুখি হওয়ার আর পিয়নের চাকরি নেওয়া ।আপনার প্রতি আমার কোন প্রকার ইন্টারেস্ট নেই । “এক নিমিষে সেহের সবগুলো কথা শেষ করে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে।রাগের মাথা কি কি বলেছে এখনো সে বুঝে উঠতে পারেনি ।
“বাহ! দেখছি কথাও বলতে জানো ।মুখে বুলি ফুটেছে নাকি! “আরাহামের গাঢ় আওয়াজে সেহের ভয় পেয়ে যায়।গলার স্বর শুনে বুঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে গেছে।এই মুহূর্তে জান নিয়ে পালাতে পারলেই বাঁচে ।কে চাইবে এই রাক্ষসটার নৈশভোজ হতে!
সেহের ছোট ডোক গিলে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আরহাম খপ করে তার হাত টেনে ধরে।বিছানার মাথার সাথে চেপে ধরে।পিছনেই দেয়াল সেহেরের হাত নিজের আঙ্গুলের ভাজে নিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরতেই। দেয়ালে ছবি টানানোর পিন গিয়ে সেহেরের হাতে চুবে।সেহের ভয়ে অনুভূতি ভুলে গেছে।অজান্তেই চোখের পানিতে গাল ভিজছে ।অন্যদিকে হাতের রক্ত দেয়া্ল বেয়ে পরছে। সেহেরের কথায় আরহামের আত্মসম্মানে বেঁধেছে ।ইগো হার্ট হয়েছে। আরহাম রাগী গলায় বলল,”ইন্টারেস্ট নেই মানে কি? হ্যা? তোমার সব ইন্টারেস্ট আমার উপরই থাকতে হবে।তোমার ত্রিসীমানায় অন্যকারো কোন স্থান নাই! ক্লিয়ার? ”
আরহামের ধমকে সেহের কেঁপে উঠে।কোন কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না।আরহাম আরো শক্ত করে হাত চাপতেই সেহের ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। চোখ বন্ধ করে কষ্ট কাতর নিশ্বাস ফেলছে।আরহাম ভেজা হাত অনুভব করে সেহেরের হাত সামনের আনে।হাতের পিঠ কেটে রক্তে ভিজে আছে ।আরহাম উত্তেজিত হয়ে পরে । অস্থির ভীতু চোখ মুখ তার । সেহেরকে বিছানায় বসিয়ে ।দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স এনে ঔষধ লাগাতে নিলে সেহের ঝাড়ি মেরে হাত সরিয়ে নেয়।চিৎকার করে বলে,”গরু মেরে জুতা দান করা হচ্ছে?আমার মেডিসিন চাই না।”
রেগে বড় বড় পা ফেলে আরহামের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।হুট করে কঠোর মানুষটার এমন ভিতু হওয়ার কারণ সেহের খুঁজে পেল না।আরহামের এমন অদ্ভুত আচরণ সেহেরর মনে ভয়ের দাগ কাটে ।রাজপুত্রের মত দেখতে মানুষটাকে মুহূর্তেই রহস্য মানব মনে হলো।

গভীর রাত চারদিকে শুনশান নীরবতা । সেহের বিছানায় এলোমেলো ভাবে ঘুমাচ্ছে।হাতের ব্যান্ডেজটায় রক্ত ফুটে আছে।হাতে প্রচণ্ডরকম ব্যথা নিয়ে সেহের সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পরেছে।শরীর খানিক দুর্বল লাগছে । জ্বর আসবে কি? হয়তো। মনিটর স্কিনে অজ্ঞাত সেই ব্যক্তি গভীর চোখে সেহেরকে দেখছে।তার গাঢ় বাদামী চোখের মণি অস্বাভাবিক ভাবে নড়চড় করছে।কপাল বাড়তি চুল গুলো চোখ ছুঁই ছুঁই।সেহেরের ব্যথায় সে যেন গভীর ভাবে ব্যথিত । ক্ষিপ্ত মুখে টলটল রক্তিম চোখে সেহেরের হাতের ব্যান্ডেজটা জুম করে দেখছে।
“খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার তাই না! খুব ব্যথা।ছয়টা বছর নিজের চোখে চোখে রেখেছি।ফুলের টোকা পর্যন্ত লাগতে দেই নি।আর সে কিনা তোমাকে এতো বড় আঘাত দিলো? এতো বড়? এর শাস্তি ওকে পেতে হবে।কঠিন শাস্তি । তোমাকে আঘাত করা প্রত্যেকই শাস্তি পাবে।তাকেও পেতে হবে! ”
শেষের কথা গুলো রাগে গরগর করতে করতে বলে।

বাগানের পাশে ছাই রাঙা পুরানো বাংলোটার অন্ধকার রুম থেকে শা শা চাবুলের ঘায়ের শব্দ আসছে। সেই সাথে কারো ব্যথায় জর্জরীত কষ্ট ভরা আর্তনাদ।
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৫

ঘন বর্ষণের কালোরাত কাটিয়ে নতুন দিনের উদয় হয়েছে ।সূর্যের উষ্ণতর ছোঁয়ায় ঝড়বৃষ্টিতে নেতিয়ে যাওয়া বিশ্ব পুনরায় মাথা উঁচু করে দাড়াচ্ছে। সোনালি আলোর মায়ায় প্রজাপতিরা রঙিন ফুলে ফুলে পাখা ঝাপটাচ্ছে । চারদিকে মিষ্টি পাখির কিচিরমিচির । বাগানের নানা রকম ফুলের ঘ্রাণে পুরো বাড়ী সুভাষিত।বাগানের মধ্যমণিতে সোফা বিছানো ।মালিহা খানম সেখানে চা নিয়ে অধীর চোখে স্বামী আর নাতির পথ চেয়ে আছে। আশরাফ খাঁন জগিং শেষে মালিহার মুখোমুখি বসে।আশরাফ খাঁন পেপার নিয়ে বসেছেন।পেপার খুলতেই চোখে মুখে বিষের ন্যায় তেতো ভাব ফুটে উঠে।আজকের হেডলাইন তাকে নিয়ে। গতকাল এক এতিমখানায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছেন।তা নিয়ে লেখালিখি চলছে।শত গুনগান হাজারো প্রশংসা । তিনি না চাইবার শর্তেও কিভাবে যেন সবকিছু ফাঁস হয়ে যায়। এসব তার মোটেও পছন্দ না। এসব দানখয়রাত তিনি লোকদেখানোর জন্য করেন না।মূলত মন আত্মার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকেন ।দান তো এমন হওয়া উচিত ডান হাতে দান করলে বাম হাত যেন টের না পায়।কিন্তু আজকাল সাহায্য দানখয়রাতকে মানুষ লোকদেখানো প্রবণতা বানিয়ে নিয়েছে।
দীর্ঘ অনেক বছর ধরে আশরাফ খানের পরিবার রাজনীতির সাথে যুক্ত।দাদা বিত্তশালী ক্ষমতাবান জমিদার ছিলেন।উনাদের কাছ থেকেই শিক্ষা পেয়েছেন সুখেদুঃখে সব সময় অসহায়দের পাশে থাকা।পূর্বজের দেখানো পথে- ই তিনি চলেন।এই নিয়ে দু দুবার তিনি মন্ত্রী হলেন।সবই জনগনের ভালোবাসা আর দোয়ার ফলস্বরূপ!
বড় ছেলে বউমা ভিনদেশে একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। ছোট ছেলে মানুষিক ভাবে খুব একটা সুস্থ নয়।ছোট বউমা রাজনীতিতে যুক্ত মোটামুটি ভালো একটা পদে আছেন। বাকি রইলো বড় নাতি আরহাম।আশরাফ খাঁনের শেষ বয়সের লাঠি। তাকে নিয়েই যত আশা।তিল তিল করে নিজ হাতে মানুষ করেছেন।ঠিক যেন তারই প্রতিচ্ছবি! আশরাফ খাঁনের অগাধ বিশ্বাস তার মৃত্যুর পর আরহাম বংশের নাম ধরে রাখবে!

মর্নিং এক্সারসাইজ সেরে আরহাম দাদাজানের পাশে এসে বসেন।রোজ সকালে দাদাজানের সাথে চায়ের আড্ডা না জমলে তার দিন শুরু হয় না।দুনিয়ায় এই মানুষতার উপর সে সবচেয়ে আশ্বস্ত । গতরাতের ঘুম খুব একটা ভালো হয়নি।মাথাটা এখনো ভার ভার হয়ে আছে।ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ নিয়ে আরহাম খবরের কাগজ খুলে।হেডলাইন দেখে মৃদু বাঁকা হাসে।আশরাফ খাঁন গলায় বিরক্তির স্বর টেনে বলে,

“আবারো এসব নিয়ে লিখালিখি শুরু হয়েছে! ”
“এরা পার্সোনাল আর পলিটিকাল মাঝেকার তফাত বুঝে না। এদের শুধু নিউজ চাই! চিন্তা করবেন না দাদাজান আমি সামলে নিবো ।”
“তোমার উপর পূর্ণ ভরসা আছে”

আরহাম আর তার দাদাজানের মাঝে রাজনীতি সম্পর্কীয় আলোচনা চলছে।আশরাফ খাঁনের দৃষ্টি আরহামের ঘাড়ের কাছে বাহুর দিকে লালচে দাগের উপর পরতেই ভ্রু কুঁচকে আসে।
“শরীরে এসব দাগ কিসের? “আরহামের দিকে প্রশ্ন।আরহাম চায়ের কাপ ছেড়ে দাদাজানের দিকে তাকিয়ে ভাবুক স্বরে উত্তর দেয়,”জানিনা ,গতরাতে ঘুমানো অবধি ঠিক ছিলো।ঘুম থেকে উঠার পর শরীর ব্যথা অনুভব করি। আয়নার সামনে দাড়াতেই নিজেকে অদ্ভুত বেশভূষায় পাই। সেই সাথে গায়ে চাবুকের ঘা! ”
“এসব নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।কোন কারণে হয়েছে হয়তো।তুমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রোপার রেস্ট নেও।”পাশের থেকে মালিহা খানম আরহামের কথা কেটে বলল।আরহাম এসবে তেমন গুরুত্ব দিলো না।চা শেষ করে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। আরহামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আশরাফ খাঁন বললেন ,”আবারো সেই সমস্যা শুরু হয়েছে? ”
“হ্যা ,ওই মেয়ে আশেপাশে ।সে ক্ষান্ত কি করে থাকবে? ”
“কে সেহের? সে এখানে! ”
“হ্যা দুদিন হলো এসেছে । ”
আশরাফ খাঁনের মুখে চিন্তা ভাব ফুটে উঠে।হতাশা ভরা নিশ্বাস ছেড়ে বিরবির করে বলে ,”সে আবার মৃত্যু খেলায় নতুন রুপে মাতবে । এবার তাকে আটকানোর সাধ্যি কার! ”

সেহের ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে।আজ ঘুম থেকে উঠতে ভীষণ দেরী হয়েছে।কোন ভাবেই ক্লাস মিস করতে চায়না ।এমন সময় দরজার কড়া নড়ে।অপর পাশ থেকে মিষ্টি পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে”ভিতরে আসবো মা? “সেহেরের ব্যস্ত হাত থেমে যায়। আওয়াজটা তার অপরিচীত নয়।আয়না থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকায়।হাতে একটা বক্স নিয়ে মধ্যবয়সী এক পুরুষ দাড়িয়ে।মায়ের দ্বিতীয় স্বামী ।সেহের জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলে,”আরে আঙ্কল আপনি! ভিতরে আসেন”
“ডিস্টার্ব করলাম কি? “হেলে দুলে ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বললেন।সেহের সৌজন্য সূচক হাসি টেনে বলল,”একদম না । আঙ্কল আপনি এখানে? জরুরী কোন তলব কি? ”
“না তেমন কিছু না।আসলে গতরাতে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছি।তোমার জন্য কিছু গিফট এনেছিলাম। তা দিতে এসেছি।খুলে দেখো তো তোমার পছন্দ হয় কি না? ”
সেহের মুচকি হেসে গিফট গুলো নিলো।একজন মানুষ হিসাবে আমান আঙ্কল খুব ভালো ।সেহেরকে খুব স্নেহ করেন।দেখে মনে হয়না তিনি মানুষিক ভাবে অসুস্থ।কিন্তু তবুও সেহের এই মানুষটাকে ভীষণ অপছন্দ।কারণ মানুষটা তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী মায়ের প্রথম ভালোবাসা । এই মানুষটার টানেই মা তাকে আর তার বাবাকে ফেলে এসেছেন ।এই মানুষটা যদি তার মায়ের জীবনে না থাকতো তাহলে বাবা মাকে নিয়ে তাদেরও একটা সুন্দর পরিবার হতো।আমান সাহেব বললেন,
“মা একটা আবদার করবো? ”
“জি আঙ্কল অবশ্যই ”
“আমাকে কি বাবা বলে ডাকা যায় না? ”
সেহেরের মুখ কালো হয়ে আসে।মৃদু স্বরে বলে,
“আপনি মানুষ হিসাবে খুব ভালো একজন ।কিন্তু আমার বাবার জায়গা আমি অন্যকাউকে দিতে পারবো না।সেই স্থান একান্তই তার। বায় দ্যা ওয়ে আঙ্কল গিফটের জন্য ধন্যবাদ। ”
আমান সাহেব মলিন হেসে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হয়।মেয়েটার জীবন এমন ছন্নছাড়া হওয়ার পেছনের তার অবদানও কম না!

ব্রেকফাস্ট টেবিলে আরহাম ,মালিহা,দিশা,আমান আগে থেকে বসে।সেহের দ্রুত পায়ে কোনরকম টেবিলে এসে পৌছায়।দিশা মেয়ের এমন তড়িঘড়ি দেখে প্রশ্ন ছুড়ে,

“কি হয়েছে? এমন তড়িঘড়ি করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে ? ”

সেহের কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,”ক্লাসে,অলরেডি অনেক লেট হয়ে গেছে। লিয়া কই সে যাবেনা? ”

“বলল তো আজ যাবেনা । কাল দেরী করে বাড়ী ফিরেছে। আসার পর থেকেই মাথা ব্যথা ”

মায়ের কথায় সেহেরের মন খারাপ হয়।তাহলে কি আজ ক্লাসে যাওয়া হবে না! খামাখা এতো তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়েছে। মলিন স্বরে বলল,”ওহ আচ্ছা।”

“মন খারাপ করছো কেন! আরহাম ওই দিকেই যাচ্ছে । সাথে চলে যেও।আরহাম সেহেরকে ভার্সিটিতে ছেড়ে আসতে তোমার কোন সমস্যা হবে কি? ”

“না আন্টি “আরহাম খাওয়ায় মন দিয়ে গম্ভীর মুখে বলল। সেহের চিকন সরু চোখে আরহামের দিকে একবার তাকিয়ে ।মাকে বলল,”প্রয়োজন নেই মা। আমি একা যেতে পারবো ”
“এ শহরে নতুন তুমি। রাস্তাঘাট জানা নেই । একা কি করে যাবে? ডোন্ট ওয়ারী আরহাম ভার্সিটিতে ছেড়ে আসবে! ”

মায়ের কথায় না পেরে সেহের চুপ করে যায়।শেষে কিনা এই মানুষটার সাথেই তাকে যেতে হবে? রাগে কোন রকম ব্রেকফাস্ট চিবালো।ব্রেকফাস্ট করে দুজন বেরিয়ে পরে।দিশা মেয়েকে বিদায় জানাতে সদর দরজায় আসে।

“ক্ষমতার লোভে নিজের মেয়েকে আগুনের দিকে ধাবিত করছো? কেমন মা তুমি? ”

শাশুড়ির তীক্ষ্ণ গলার স্বরে দিশা ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাইলেন। মুখে হাসি রেখে বললেন,”ক্ষমতার খেলায় কেউ নিষ্পাপ নয়। না আপনি না আমি! ”

“তোমার মেয়ে ত নিষ্পাপ । তাই না? তাকে কেন আগুনে ফেলছ? ”

“কোন আগুনের কথা বলছেন আপনি? আরহাম যথেষ্ট ভালো ছেলে তাদের মাঝে যদি কোন সম্পর্ক তৈরি হয় এতে ক্ষতি কোথায়? আর তাছাড়া আস্তে আস্তে সেহের সব শিখে যাবে।ঠিক যেমন আমি শিখেছি! ”

“চোখের দেখা সবসময় সত্যি হয় না । এর আড়ালেও অনেক কিছু থাকে।সময় থাকতে সামলে যাও পরে এমন না হয় নিজের কর্মের উপর নিজেই অনুতপ্ত হও।আর মেয়ের চোখে ঘৃণার পাত্র ”

শাশুড়ির কথা গুলো কানে না নিয়ে দিশা হন হন করে রুমের দিকে পা বাড়ায়। মালিয়া খানম মৃদু স্বরে বলে,”আমি যেই হিংস্র আরহাম কে চিনি তোমরা কেউ তাকে চিনো না।তোমার লোভের কারণে নিষ্পাপ মেয়েটাকে বিষাক্ত যন্ত্রণা ভুগতে দিবো না। ”

ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি শা শা করে চলছে।আশেপাশের সব কিছু চোখের পলকে গায়েব হচ্ছে।গত রাতের বৃষ্টিস্নাত হিম শীতল হাওয়া রোদের তাপে উষ্ণ রূপ নিয়েছে।সূরের সোনালি আলো সেহেরের চশমার গ্লাসের উপর চকচক করছে।বাহিরের উষ্ণ হাওয়া তার উষ্ণতা ছুঁয়ে দিচ্ছে।গাড়িতে পিনপতন নীরবতা । সেহের চোখ মুখ শক্ত করে যন্ত্রের ন্যায় বসে আছে। আরহামের দিকে একবারের জন্যও তাকাচ্ছে না। বাহিরের উষ্ণ হাওয়া তার অবাধ্য চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। বার বার মুখের উপর পরছে। এদিকে আরহাম প্রতি মুহূর্ত সানগ্লাসের আড়াল থেকে দেখে যাচ্ছে।সেহেরের নীল উড়নার কোণাটা নিজের হাতের মুঠোয় ব্যান্ডেজের মত পেঁচিয়ে রেখেছে।গায়ের মিষ্টি মাতাল মাতাল ঘ্রাণটা আরহামকে ঘোরে টেনে নিচ্ছে।যার জন্য সে এতোটা মাতোয়ারা বেখেয়ালি সে কি তা বুঝছে? উহু একদম । চোখে মুখ দেখে বুঝাই যাচ্ছে সে ভীষণ রেগে। রাজ্যের সব রাগ নিজের মাঝে সমাহিত করে রেখেছেন ।আরহাম নরম স্বরে বলে,” সরি ” সেহের কথাটা শুনেও না শুনার ভঙ্গিমা করে বসে থাকে।আরহাম বেশ কিছুক্ষণ উত্তরের আশা করে গলা পরিষ্কার করে বলে,”হাতের ব্যথা কমেছে? ” এবারো কোন উত্তর মিলল না।আরহাম চটে যায়।সহজ রাস্তায় না গিয়ে বাঁকা ত্যাড়া রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে দ্রুত গতিতে চলতে থাকে।সেহের ভয়ে সিটের সাথে লেগে থাকে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কান্না করে দিবে, তবুও সে আরহামের সামনে মুখ খুলবে না।ভাঙবে তবুও মচকাবে না! আরহামও কম যায়না আধঘণ্টার পথ দেড় ঘন্টা ঘুরিয়ে ভার্সিটির সামনে আসে।

“এটা তোমার জন্য “আরহামের থমথমে আওয়াজ । সেহের নামতে যেয়েও থেমে যায়।ভ্রু কুঁচকে পিছনে ফিরে বলে,”এটা কি? ”
“তোমার সরি গিফট ”
সেহের মুখ ফিরিয়ে গাড়ি দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,”না আপনার সরি চাই ,না সরি গিফট!”
বলে গাড়ি থেকে নামতে নিলে উড়নায় টান পরে।পিছনে ফিরে দেখে উড়নার অনেকটা অংশ আরহামের হাতে পেঁচানো ।সেহের প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকানোতে আরহাম বাঁকা হেসে উত্তর দেয়,”উড়না তো চাই? তাই না! ”
সেহের ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,”এ কেমন অসভ্যতা! আমার উড়না ছাড়ুন । লেট হচ্ছে । ”
“ছাড়বো না । যতক্ষণ না গিফট এক্সেপ্ট করছো! ”
সিটে হেলান দিয়ে আরহাম ভাবলেশহীন স্বরে বলল।সেহের বেশকিছুক্ষণ ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। কোন গতি হলো না।আরহামের সামনে তাকে নত হতেই হলো।গিফট বক্স হাতে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”ওকে ফাইন ,নিয়েছি।এবার ছাড়ুন ”
আরহাম উড়না ছাড়তেই সেহের গাড়ী থেকে চটজলদি নেমে পরে।ভার্সিটি গেটের ভিতর ডুকে গিফট খুলে । ভেতরে বড় চকলেট বক্স।তার উপর চিরকুটের সাথে আর্টিফিশিয়াল কাঠগোলাপ লাগানো । লিখা,

“তোমার জন্য নীলচে তারার
একটুখানি আলো,
ভোরের রং রাতে মিশে কালো।
কাঠ গোলাপের সাদার মায়া
মিশিয়ে দিয়ে ভাবি,
আবছা নীল তোমার লাগে ভালো!

সরি মিস. চাশমিস”

চিরকুট পড়ে সেহে্রের ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি ফুটে উঠে।নিজের দিকে চোখ বুলায় সে আজ নীল ড্রেসে। মাথা ঘুরিয়ে মুচকি হেসে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়াল থেকে গেটের বাহিরে তাকাতে আরহামের সাথে চোখাচোখি হয়।আরহাম তখনো সিটে হেলান দিয়ে বাঁকা হেসে তাকিয়ে । তবে এটাই কি বিষাক্ত প্রেমের শুরু?

চলবে….❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here