বৃত্তের বাইরে পর্ব ১

আজকে আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি ৷ তিন বছরের সম্পর্কের মানুষটির সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল আমার বাবা মা ৷ কিন্তু একটু আগে আমার বয়ফ্রেন্ডের বাবা ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো যে বিয়েটা হবেনা ৷ কারণ, আমার বয়ফ্রেন্ড নাকি বাসা থেকে উধাও ৷ তার অন্য একটি গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ভেগেছে ৷ এমন খবর শুনবো কল্পনাতেও ভাবেনি ৷ এমন হ্নদয়ভাঙ্গা খবর শোনার পর থেকে নিজেকে জীবিত মনে হচ্ছেনা ৷ মনে হচ্ছে প্রাণহীন এক জড় পদার্থ আমি ৷ পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে ৷ দাঁড়িয়ে আছি যেন উত্তপ্ত ভাসমান অগ্নিসাগরে ৷ বুকে হাজারো বিষাক্ত তীরের আঘাত নিয়ে এখনো জ্যান্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি ৷ চোখ বিদীর্ণ করে বিন্দু বিন্দু নোলাজল ঝরতে ঝরতে সেই অশ্রুসজল এখন ঝর্ণার মত করে প্রবাহিত হচ্ছে ৷ আমি যে একজন মানুষ, আমারও যে কষ্ট হয় সেটা হয়তো আমার বয়ফ্রেন্ড ভুলে গেছে ৷ তাইতো সে এমন নির্মম ও পাষবিক কাজটা করতে পারলো ৷ এতটা নির্দয় সে আগে কখনো ভাবিনি!!

আব্বু কয়েক লাখ টাকা খরচ করে বিয়ের আয়োজন করেছে, বাসায় মেহমান দিয়ে ভর্তি ৷ অপমানিত হয়ে বাসা থেকে চলে যেতে হবে মেহমানদের ৷ এসব ভেবে আব্বু চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে ৷ আম্মু তো বড় বোনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে ৷ আব্বুর প্রেশার হাই বিধায় তার মাথায় পানি ঢালা হয়েছে কয়েকবার ৷ অনেক ভাবার পর আব্বু সিদ্ধান্ত নেয় আমার বিয়েটা আজই হবে যেকোনো ক্রমে ৷ মেহমানদের অপমানিত করে বাসা থেকে চলে যেতে দিবেন না ৷ এজন্য আব্বু সিদ্ধান্ত নেয় ছোট চাচার একমাত্র ছেলে অর্ণবের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিবে ৷ এমন সিদ্ধান্ত শুনে আমি থমকে গেলাম ৷ স্তম্ভিত ও নির্বাক আমি ৷ চোখের পানি ঝরাও বন্ধ হয়েছে ৷ এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিনা আমি ৷ কারণ, অর্ণব কখনই আমাকে মেনে নিতে পারবেনা ৷ সে তো অন্য একজনকে ভালবাসে ৷ এবং তার প্রেমটা আমিই করে দিয়েছিলাম ৷ আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে অর্ণবের প্রেম চলছে ৷ সেই আমি কি করে অর্ণবের বউ হই? সে কেমনে আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারে?

.
শেষপর্যন্ত অর্ণবের সঙ্গেই আমার বিয়েটা হয়ে গেল ৷ আব্বুর উপর দিয়ে কথা বলার সামান্যতম অধিকার আমার নেই ৷ ওদিকে অর্ণবও পারলোনা আমার বাবার উপর দিয়ে কথা বলতে ৷ অর্ণবের পরিবার আর্থিক দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ৷ তাই আঙ্কেল, আন্টি আমার বাবার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে বাধ্য হয় ৷ তাদের নিকট এই সিদ্ধান্ত সঠিক ৷ আমি অতীতকে ভুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি ৷ যে বদমাইশটার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে মূল্যবান ৩টা বছর নষ্ট করেছিলাম এমন ভুলের জন্য অনুতাপ করছি ৷ অনুশোচনায় যেন পুড়ছি ৷ মন থেকে মুছে ফেললাম পশুটাকে ৷ অর্ণবকে মনেপ্রাণে স্বামী হিসেবে মেনে নেবার চেষ্টা করছি ৷ মেনে তো নিতেই হবে তাকে ৷ এখন থেকে সে তো আমার স্বামী ৷ ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি সারাজীবনের জন্য তার সঙ্গে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলাম!

.
.
বাসর ঘরে বসে আছি দীর্ঘ ২ ঘন্টা ধরে ৷ অথচ অর্ণব আসছেনা ৷ বাধ্য হয়ে রুম থেকে বের হয়ে অর্ণবকে খুঁজতে লাগলাম ৷ বাসার সবাই ঘুমে জর্জরিত ৷ শুধু আমিই জেগে আছি ৷ অর্ণব জেগে আছে কিনা জানিনা ৷ তাকে খুঁজতে গেলাম ছাদে ৷ দেখলাম সে ছাদের এককোণে ঘণকালো অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আরাম করে সিগারেট খাচ্ছে ৷ আশ্চর্য হলাম! যে মানুষটা ভুলেও সিগারেট খেতোনা অথচ সেই মানুষটা আজ সিগারেট খাচ্ছে ৷ এর অর্থ সে আমাকে মেনে নিতে পারছেনা ৷ তার প্রেমিকাকে ভুলতে না পেরে মানসিক যন্ত্রণায় আছে ৷ অসহ্যকর কষ্টগুলোকে ভুলতে সে সিগারেটকে আপন করে নিয়েছে ৷ ধীর পায়ে মনে কপট দুর্বলতা ও ভয় নিয়ে চললাম তার নিকট ৷ তার সামনে দাঁড়াতেই অর্ণব হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে ইতস্তত করতে করতে তোড়জোর কন্ঠে বলল,
-সনু তুই? তুই ছাদে কেন? যা ঘুমিয়ে পর!
.
অর্ণবের কথায় বুকটা ঈষৎভাবে কেঁপে উঠলো ৷ বিস্ময়ের চাহনীতে তাকিয়ে কোমল স্বরে বললাম,
-তুমি যাবেনা রুমে? আজ আমাদের বাসর রাত ভুলে গেলে?
-লজ্জা দিচ্ছিস? আমরা ভাল করে জানি আমাদের সেক্রিফাইজের কথা ৷ তুই ও আমি আঙ্কেলের কথা রাখতে বিয়েটা করেছি,এর বাইরে কিছু না!
.
ঝাঁকি মেরে উঠলো পুরো দেহ ৷ কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে মরা গরুর মত চোখ বানিয়ে হতভম্বের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম অর্ণবের দিকে এবং ভাবনায় ডুব দিলাম ৷ অনেক ভাবার পর সম্ভিত ফিরে পেয়ে শীতল কন্ঠস্বরে বললাম,
-হুম,ঠিকই তো ৷ আমরা তো এজন্যই বিয়ে করেছি!
অর্ণব নতুন একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে বলল,
-এটা আজ থেকে খাওয়া শুরু করলাম ৷ তুই আবার নিষেধ করিস না ৷ চৈতির সঙ্গে কথা হয়েছে ৷ সে বলেছে আপাতত ধৈর্য্য ধরতে ৷ আমাকে তোর থেকে দূরে থাকতে বলেছে ৷ ৬মাস পর নাকি চৈতিকে বিয়ে করতে পারবো ৷ এর অর্থ দাঁড়ায় আজ থেকে তোর সঙ্গে ৬টা মাস স্বামীর মত করে কাটাতে হবে ৷ তবে সেটা পরিবারের মানুষজনের সামনে, তাদের অগোচরে নয় ৷ বিষয়টা সিনেমাটিক হয়ে যাচ্ছে, তাইনা রে?
.
আমার কথা বলার শক্তি বিলিন হয়ে গেছে ৷ কেউ হয়তো গলার ভেতর টুকরো টুকরো কাচদন্ড ঢুকিয়ে দিয়ে ভেতরটা রুদ্ধ করে দিয়েছে ৷ অর্ণবকে মুখে না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম তার সমস্ত কথাতেই একমত আমি ৷ অর্ণব কথা বলেই যাচ্ছিল ৷ অকস্মাৎ সে বলল,
-তো, তুই কি রবিনকে ভুলতে পারছিস? জানি কখনই পারবিনা ৷ এজন্যই বলি মেয়েদের এতটা সিরিয়াস হতে নেই প্রেমে ৷ তারা পুরুষদের প্রকৃতভাবে ভালবাসলেই কষ্ট পাবে, দুদিন আগে কিংবা দুদিন পরে ৷ মনের মানুষকে ভালবেসে বিয়ে করলেও মেয়েরা কষ্ট পাবে ৷ এটা আসলে প্রকৃতগত ৷ গুরুত্ব সহকারে ভালবাসবে তো ছেলেরা ৷ এই দেখ আমাকে, চৈতিকে কখনই ভুলতে পারবোনা, কখনই না ৷ ধর চৈতির বিয়ে গেলো আমার মত, তবুও তাকে ভুলতে পারবোনা ৷ আসলে হবেনা তাকে ভুলতে পারা ৷
.
অর্ণবের কথা ভ্রুক্ষেপ না করে ক্ষীণস্বরে বললাম,
-ঠিকআছে, আমি গেলাম; আমার খুব ঘুম পাচ্ছে ৷
অর্ণব ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট স্থাপন করে একটা টান দিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়িয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে বলল,
-হুম যা, আবার কাঁদিস না গাধাটার জন্য!
.
অর্ণবের কথায় কৃত্তিম হাসি হেসে মনে মনে বললাম, “কাঁদবো তো তোর জন্য রে বোকা, না পেয়ে হারানোর কষ্টটা হয়তো ভুলতে পারা যায় সহজে; কিন্তু পেয়ে হারানোর সীমাহীন কষ্টটা ভুলবো কেমনে? তোকে স্বামী হিসেবে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম এই বাসর রাতেই ৷ এই কষ্টে যে বুকটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, সেটা কি তুই বুঝতে পারছিস? বুকের এই আগুন পৃথিবীর কোনো পানিতে নিভবেনা ৷ নিভবে, যদি তোর হিমশীতল পরশ আমার কপালে লাগে! ভাল থাক তুই!”

.
অর্ণবের দিক থেকে চেহারা ঘুরিয়ে নিয়ে মর্মাহত ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধীর পায়ে ছাদ থেকে চলে যেতে লাগলাম ৷ মন বলছিল সে আমাকে ডাকবে ৷ আমাকে থামিয়ে দিয়ে কষ্টে জর্জরিত মনটাকে শান্ত করবে ৷ এরপর আমার চোয়ালে হাত রেখে দৃষ্টি তার চোখ বরাবর স্থাপন করিয়ে দিবে ৷ অতঃপর আমার নিথর হাতটা আলতোভাবে ধরে শিহরণ তৈরি করে দিবে ৷ শেষমুহূর্তে বলবে,
“আজ রাতটা এই জোৎস্নালোকিত রাতে দুজনে পাশাপাশি গা ঘেঁষে দলনাতে বসে দুলতে দুলতে মধুর সব গল্প প্রকাশ করতে করতে কাটিয়ে দিই! কি আমার সঙ্গে জোৎস্নাবিলাস করবি?”
কিন্তু না অর্ণব আমাকে ডাকলোনা, এবং আমার অলিক স্বপ্ন ও কল্পনাও পূরণ হলোনা ৷ ছাদের শেষপ্রান্তে পৌঁছে তার দিকে চেহারা ঘুরিয়ে দেখলাম সে নির্বিগ্নে সিগারেট পান করে যাচ্ছে ৷ আমাকে ছাদ থেকে প্রস্থান গ্রহণ করতেই হলো ৷ মনে হলো এই মুহূর্তে আমি চিরদিনের জন্য অর্ণবের হ্নদয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি ৷ আল্লাহতায়ালা না চাইলে বোধহয় তার হ্নদয়ে স্থান হবেনা!
.

#চলবে
.
#বৃত্তের_বাইরে (পর্বঃ ১)
লিখাঃ #Sifat_Arnab_Rehan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here