বৃত্তের বাইরে পর্ব ৭(শেষ)

#বৃত্তের_বাইরে
#পর্বঃ ৭(শেষপর্ব)
লিখাঃ #Sifat_Arnab_Rehan.
.
অর্ণব আমার ব্লাকমেইলের শিকার ৷ তার গোপন রহস্য জানি আমি ৷ ফাঁস করে দিলেই সে শেষ! .
.
থমকে গিয়ে বললাম,
-কি রহস্য?
বলবেন তো ৷ কি এমন কাজ করেছে যে সে শেষ হয়ে যাবে?
-বলা যাবেনা ৷ ফোন রাখলাম!
.
.

রবিন ফোন কেটে দিলো ৷ এরপর তাকে ফোন দিলে রিসিভ হলোনা ৷
প্রখরভাবে রাগের উদ্ভব হলো ৷ রবিনের প্রতি যতটা না রাগ হলো তারচেয়ে বেশি রাগ হলো অর্ণবের প্রতি ৷ মানুষটা আর কতগুলো অপকর্ম করেছে যেসবের রহস্য শুধু রবিনই জানে? তীব্র রাগ ও বিষন্নতা নিয়ে বালিশে মুখ চেপে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম ৷ মনে মনে নানান চিন্তা-ভাবনা করতে করতে একপর্যায়ে চোখের পানে ঘুম চলে এলো ৷ গাঢ়ভাবে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলাম!
.
.

ঘুম ভাঙ্গল অর্ণবের ডাকে ৷ সে আমার পিঠে ধাক্কা মেরে বলছিল,
“কি ব্যাপার সন্ধ্যা পরপরই ঘুমিয়ে গেলি?
.
ঘুমে জর্জরিত মস্তিষ্ক অর্ণবের কথা ঠিকভাবে স্মৃতিতে রাখলোনা, কানও যেন ঠিকমত শুনতে পেলোনা তার কথা, অগ্রায্য করলো ৷ যখন সে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো তখন বুঝতে পারলাম কি বলছে সে! তার দিকে কপাল কুঞ্চিয়ে তাকিয়ে ঘুমজরানো কন্ঠে বললাম,
-তুমি কখন এলে?

অর্ণব ক্ষীণস্বরে জবাব দিলো,
-এইতো মাত্রই এলাম ৷ তুই বিছানা ছাড় ৷ কক্সবাজারের দিকে রওনা দিতে হবে তো!
-কিন্তু আমি তো যাবোনা ৷
-কেন? তখন রাগ করে বলছি বলে?
-না ৷
-তাহলে?
-এমনিই যাবোনা ৷
-এখন কিন্তু সত্যি সত্যি রেগে যাবো আমি!
-তাতে আমার কি?
-হঠাৎ তোর কি হলো?
-রবিন কিসের জন্য আরো ৫০ হাজার টাকা পাবে বলো?
-মানে? সে কেন আমার থেকে টাকা পাবে?
-সেটা তুমিই ভাল জানো!
-রবিন বলেছিল আমি ধার নিয়েছি ৷ এটা তো সম্পূর্ণ মিথ্যা ৷
-ধারের টাকার কথা বলছিনা ৷৷ তুমি কি এমন অপকর্ম করেছিলে যা ঢাকার জন্য রবিনকে ৩লক্ষ টাকা দিবে বলে রাজি হয়েছিলে?
-ধ্যাত্তেরি! তুই রবিনের কথা বিশ্বাস করে থাক ৷ তোকে কক্সবাজারও যেতে হবেনা, আমাকেও লাগবেনা!
.
চেহারায় অভিমানের কালো ছায়া লেপন করে, কপট রাগ দেখিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে অর্ণবকে আপনি সম্বোধন করে বললাম,
-যা খুশি করেন ৷ আমি আপনাকে অনেক সহ্য করেছি, আর না!
.
অর্ণবের চেহারায় যেন আগুনের ফুলকি এসে জমাট বাঁধলো ৷ তার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না ৷ রেগে অগ্নিশর্মা সে ৷ মনে হচ্ছিল অগ্নিকুন্ডলী তার আঁখি থেকে তীরের গতিতে আমার বুকে এসে বিদ্ধ হবে ৷ ভয়ে কাতর হয়ে গেলাম ৷ মনে মনে বললাম এভাবে রাগ দেখিয়ে কথা বলাটা কি ঠিক হয়েছে? এক মন বললো, ঠিক কাজ হয়েছে ৷ স্বামীর প্রতি এত ভালবাসা দেখাতে নেই, নইলে মাথায় চরে বসে বানরের মত ৷ পুরুষ জাতি বানরের বংশধর ৷ মেয়েরা গোলাপের ৷ তাইতো সময় মত পুরুষকে ফুলের সুভাস ছড়িয়ে ভালবাসা আদায় করতে হয়, কখনো কাঁটা দিয়ে ৷ শুধু সুভাসে তাদের ঘায়েল করা সম্ভব নয় ৷ কাঁটার ব্যবহারও করা জরুরি ৷ অর্ণবের উপর রেগে যাওয়ার উপযুক্ত সময় ছিল এটা ৷ আরেক মন বললো একদম বাজে কাজ হয়েছে, স্বামীর উপর এত রাগ দেখাতে নেই ৷ স্বামী হলো ভালবাসা ও সম্মানের প্রতীক ৷ এদের যত ভালবাসা যাবে নারীর ততোই মঙ্গল ৷ এখনো সময় আছে তার নিকট মাফ চাওয়া ৷ নইলে সে আরো তীব্রভাবে রেগে যাবে ৷ কেন যেন দ্বিতীয় মনের কথা মেনে নিতে পারলাম না ৷ প্রথম মনের কথাই পছন্দ হলো ৷ এমনকি যুক্তিযুক্ত মনে হলো ৷ মানুষের মধ্যে দুটা মনের বাস ৷ একটা নেগেটিভলি ভাবে, আরেকটা ভাবে পজেটিভ! কিংবা কোনোটা পক্ষ নেয়, কোনোটা বিপক্ষ ৷ আমার দ্বিতীয় মনটা খুবই পাঁজি!
শত্রুও বটে!
.
মনের সাথে গবেষণা শেষ করে অর্ণবের দিকে শুরুতে নিরিহ হরিণের বাচ্চার মত করে তাকালেও পরক্ষণে চোখদ্বয় রক্তচাঁপার মত রক্তিম বানিয়ে, আমার নিশ্বাসের শব্দকে সাপের বিষাক্ত শব্দের মত বানিয়ে দৃষ্টি স্থাপন করে তাকিয়ে রইলাম ৷ সে থাপ্পর মারতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু আমার ভয়ংকর রুপ দেখে থেমে গেলো ৷ সে তার রাগটাকে থাপ্পরের মাধ্যমে বিলিন করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি ৷ একারণে, তার চেহারায় রাগের ছাঁপ আরো গাঢ়ভাবে দৃশ্যমান হলো ৷ সে ফোঁসফোঁস শব্দ তুলে দাঁত কটমটিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল!
সে রুম থেকে বের হতেই তাকে মনে মনে ইচ্ছামত খায়েশ মিটিয়ে গালি দিলাম ৷ তন্মেধ্যে একটি গালি ছিল শালা অরু ৷ অর্ণবকে অরু বলে ডাকি ৷
৷ গালিটা প্রয়োগ করে বলতে লাগলাম, শালা অরুর ঘরের গরু, আমার সাথে ভাব নাও, আমি কি তোমার ভাবের কামাই খাই? আমায় বিয়ে করলে একদিনও হলোনা এখনই ভিলেনগিরি মারাও, তোমার ভিলেনগিরি ছুটিয়ে দিবো ৷”
মনে মনে গালিটা দিয়ে অনেক খুশি খুশি লাগছিল ৷ এখন খুব করে ইচ্ছা করছে গরুটার প্রতিক্রিয়া দেখা ৷ সে রাগ সহ্য করতে না পেরে হয়তো কান্না করছে ৷ ওর স্বভাব মাত্রাতিরিক্ত রেগে গেলে রাগটা বিলিন করতে না পারলে বাচ্চাদের মত করে কান্না করবে ৷ তাও, শাওয়ার নিতে নিতে ৷ কি এক অদ্ভুত কান্ড! এখনও বোধহয় সে এমনটাই করছে ৷ ভাবা শেষে, এখন তার কাছে গিয়ে দেখা যে সত্যি সে এমনটা করছে কিনা! রুম থেকে বের হতে যাবো, ওমনি অর্ণব রুমের ভেতর ঢুকলো হিংস্র বাঘের মত ক্ষিপ্ততা নিয়ে ৷ আমার হাতটা ধরলো ৷ অকস্মাৎ, আমাকে অবাকের চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে দিয়ে তার বাহুতে তুলে পাছাকোলে করে বেডের উপর ধপাস করে ফেলে দিলো ৷ আতঙ্ক, ভয়, লজ্জা তিনটার মিশেলে থম মেরে অদ্ভুত চাহনীতে তার দিকে দৃষ্টির যোগসূত্র করলাম ৷ সে আমাকে আরো গাঢ়ভাবে অবাক করে দিলো, যখন সে আমার দেহের উপর হুমড়ি খেয়ে পরলো ৷ যেন মনে হলো ক্ষুধার্ত বাঘ সে, তার বুভুক্ষতার অবসান ঘটাতে আমার দেহে যেন হামলা চালানো খুব জরুরি ৷ সেই তাগিদে তার এমন অগ্রসরতা ও ক্ষিপ্ততা ৷ কোনোরুপ কথা না বলে অর্ণব আমার গলায় তার ঠোঁট স্থাপন করে আলতো পরশ বুনে দিলো ৷ অতঃপর, তার দু আঙ্গুল দিয়ে আমার গালে মৃদ্যু পরশ লাগালো ৷ তার পরশে শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, কিন্তু ভয়ের অবসান হচ্ছেনা ৷ যখন অর্ণব তার ঠোঁট আমার কোমল ঠোঁটে স্থাপন করলো তখনই পুরো দেহ ঝাঁকি মেরে উঠলো, যেন আমি কারেন্টের শক খেয়েছি ৷ শিহরণের আবেশে আমার দেহের মাঝে ভাললাগার জোয়ার বইতে লাগলো ৷ অস্বাভাবিক কাঁপন ও শরীরের নিস্তেজস্বতা বেড়ে চললো ৷ হ্নদস্পন্দন বাড়লেও রুদ্ধশ্বাসে দম আটকে যাবার উপক্রম হচ্ছিল ৷ অর্ণবকে থামানোর জন্য এক মন বলে উঠলো- না, এতে সম্মতি দেওয়া একটুও ঠিক হবে না ৷ ব্যক্তিত্ববোধকে মাটির ধুলোর সঙ্গে বিলিন করে দেওয়া মানে নিজের সঙ্গে অন্যায় করা, অাত্মমর্যাদায় ব্যাঘাত ঘটানো ৷ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্ত্রী স্বামীর ভালবাসা পায় মধুর ভাবে, জোরজবরদস্তি করে নয় ৷ তাই তাকে সরিয়ে ফেলতে হবে পাথর নামক দেহ থেকে ৷ এ দেহটা যখন নারীর দেহ হবে তখনই তাকে জায়গা দিতে হবে ৷ এখন তো নারী দেহ অনুপুস্থিত, দেহটা এখন পাথরের মূর্তি ৷ নারী দেহ উপস্থিত হবে মানুষটা ভালবাসার সূচনা দিয়ে আড়ম্ভ করলে!

অন্য মন বলল, যা করছে এটাই ভাল ৷ স্বামীর আদর এক ভাবে পেলেই হয় ৷ তার যখন ইচ্ছা স্ত্রীকে ভোগ করবে ৷ অনিচ্ছা সত্বেও স্বামীকে সবসময় তৃপ্ত করায় হচ্ছে স্ত্রীর ধর্ম!
.
দ্বিতীয় মনের কথা এবারও মেনে নিতে পারলাম না, অগ্রায্যকর অবান্তর ও সম্পূর্ণ নারীবিদ্ধেষী কথা বলেছে ৷ প্রথম মনের কথাকে সাদরে গ্রহণে করে নিয়ে অর্ণবের সঙ্গে জোরাজুরি করতে লাগলাম তার দেহকে সরিয়ে দিতে ৷ দেহের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে তাকে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম কিন্তু তার বলিষ্ঠ দেহের জন্য পেরে উঠলাম না ৷ এবার উপায় কথার দ্বারা তাকে পরাজিত করা ৷ রাগান্বিত স্বরে বললে সে ক্ষেপে যাবে আরো ৷ ভালবাসামাখা মধুর মতন মিষ্টি ও সুরেলা কন্ঠস্বরে কথা বলে তার হ্নদয়কে ঘায়েল করতে হবে ৷ তবেই সে ক্ষান্ত হবে ৷ তাকে আদুরে গলায় মোলায়েম কন্ঠস্বরে বললাম,
-প্লিজ অর্ণব, এভাবে নয় এবং এই সময় নয় ৷ আমার অনিচ্ছায় ও মধুর প্রস্তুতি ছাড়াই এমনটা করতে দিতে পারিনা আমি ৷ ভুলে যেওনা আমি তোমার স্ত্রী ৷ পতিতা নই ৷ পতিতাদের সাথেও হয়তো প্রস্তুতিবিহিন কেউ মিলন করতে পারেনা ৷ আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে কবুল করার পর হ্নদয়ে জায়গা দিয়েছি ভালবাসার মানুষ হিসেবে ৷ তাই আমি চাই আমাদের প্রথম মিলন হবে আনুষ্ঠানিকভাবে ৷ না, আমি তুমি বাদে কেউ জানবেনা অনুষ্ঠানের কথা ৷ আমরা তো বাসর রাত পালন করিনি ৷ কেউ কাউকে সেইভাবে স্পর্শও করিনি ৷ বাসর রাত, মধুচন্দ্রিমা বাসাতেই করবো, নির্দিষ্ট দিনে ৷ সেটা সেদিনই করবো যেদিন তুমি সমস্ত রহস্যের কথা খুলে বলবে ৷ হয়তো বলবে এতসব কিসের জন্য? এমন প্রশ্ন করবে এবং গা ঢাকা দেবার চেষ্টা করবে ৷ সত্যকে মাটিচাপা দেবার বৃথা চেষ্টা করে যাবে ৷ কিন্তু না, সেটা হতে দিবোনা আমি ৷ ভাববে, রবিনের কথাকে বিশ্বাস করে তোমাকে রহস্য উন্মোচনের জন্য জোর দিচ্ছি, মোটেও তার কথাকে বিশ্বাস করে নয় ৷ সকালে পুলিশের আগমণ ও তোমার মুখে চৈতি ও সামান্তার বিষয়গুলো নিয়ে গোলক ধাঁধার মধ্যে পরে ঘুরপাক খাচ্ছি লাটিমের মত করে ৷ এর থেকে আমি বের হতে চাই ৷ যদি সমস্ত রহস্যের জাল ছেদন করে সত্যটা প্রকাশ করো তবেই আমি তোমার সঙ্গে বাসর রাত উৎযাপন করবো ৷ এরপূর্বে নয় ৷ খবরদার , তুমি জোরজবরদস্তি করবেনা!
.
.
অর্ণবের বুভুক্ষতার ইতি ঘটলো, হিংস্র প্রাণীর রুপ হারিয়ে সুবোধ বালক হয়ে গেল ৷ কোনো কথা না বলে সে উদাস মনে রুম থেকে বেরিয়ে গেল!
.

.

পরদিন সকালে অর্ণবের অনুরোধে কক্সবাজারে যেতে রাজি হলাম ৷ শর্ত দিয়েছিলাম আমার অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করবেনা, সে এতে রাজি হয়েছিল ৷ তার নাকি অনেকদিনের ইচ্ছা আমাকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করবে ৷ সেই মোতাবেক আব্বুর গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি দুজনে!
কক্সবাজার পৌঁছলাম ঠিক তখন যখন পশ্চিমাকে সূর্যটা লাল রক্তিম আভায় নীল আকাশের গহীনে ডুবতে শুরু করছিল ৷ একটি প্রসিদ্ধ ও অভিজাতিক হোটেলে দুই বেডের একটি রুম নেওয়া হলো দুদিনের জন্য! সুদীর্ঘ পথ পারি দিয়ে এসে ক্লান্ত আমি ৷ অর্ণবেরও একই অবস্থা ৷ দুজনই কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম ৷ আমি ঘুমিয়ে গেলাম কিন্তু অর্ণব জেগেই রইলো, যখন ঘুম ভেঙ্গে গেল তখন দেখতে পেলাম সে হাস্যজ্জ্বল চেহারায় মোবাইলে কি যেন দেখছে ৷ তীব্র কৌতূহল নিয়ে তার কাছে গেলাম ৷ এবং ফাঁকি দিয়ে ফোনটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ফোনে চলতে থাকা ভিডিও দেখতে লাগলাম ৷ হতবাক আমি! বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে অর্ণবের দিকে কৃত্তিম রাগের ভাব দেখিয়ে বাকা চোখে তাকিয়ে রইলাম ৷ আমি যতক্ষণ ধরে ঘুমের মধ্যে ছিলাম, সে সেসব ভিডিও করেছে ৷ পুরো শরীরটা সে ভিন্নভিন্ন কোণ থেকে ধারণ করেছে ৷ যদিও আপত্তিকর লাগছেনা ৷ কারণ, অনেকটা ঢিলঢিলা টাইপের থ্রি-পিস পরে শুয়েছিলাম ৷ অর্ণবের ফোন থেকে ভিডিওটা কেটে দিয়ে তীর্যককন্ঠে বললাম এইবারই এসব দেখলাম, এরপর আমার অনুমতি ছাড়া ভিডিও তো দূর একটা পিকচারও তুলবেনা ৷ কি কানে গেল আমার কথা? অর্ণব শুধু মাথা নাড়লো ৷ তাকে আর কিছু না বলে তার ফোনটা নিয়ে ভিডিও গেম খেলা শুরু করলাম ৷ আচমকা , দরজায় কড়া নাড়লো কে যেন? দরজা খুললো অর্ণব ৷ দেখতে পাওয়া গেল উক্ত হোটেলের রুম ম্যানেজারকে ৷ সে বললো ডিনারের টাইম হয়েছে, ডিনারে উপস্থিত হতে হবে, বলেই চলে গেল!

নৈশভোজের সমাপ্তি হলে অর্ণব তার বেডে, আমি আমার বেডে শুয়ে রইলাম ৷ বেশকিছুক্ষণ পর চোখে ঘুম চলে এলো ৷ আচমকা, ঘুম ভাঙলো অর্ণবের হাতের পরশে ৷ চোখ তুলে তাকাতেই সে আদুরে গলায় বলল,
– “সোনু, প্লিজ; আমার সঙ্গে এখন একটু যাবি?”
ঘুমকাতরে ভাব নিয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেসা করলাম,
-“কই যাবো?”
.
-সমুদ্র সৈকতে যাবো, প্লিজ চল আমার সাথে!’

অর্ণবের কন্ঠস্বরে নমনীয়তা ছিল, ছিল ভালবাসার পরশ ৷ আবদারের সুর আমার হ্নদয়কে আন্দোলিত করলে তার কথায় রাজি হয়ে গেলাম ৷ সে শাড়ি পরতে বললো ৷ তার পছন্দের গোলাপী রংয়ের শাড়ি পরে তার হাত ধরে সমুদ্রে সৈকতের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম ৷ আকাশে পূর্ণ চাঁদ ৷ সে মনপ্রাণ উজার করে আলো ছড়াচ্ছে ৷ চাঁদের আলো যেন পুরো সমুদ্র সৈকতের চারপাশ ও আকাশ ডুবে আছে ৷ আলো ভাসছে ৷ বাতাসে বাতাসে জোৎস্নার উপভোগ্যকর আলো মিশে যাওয়ায় চারপাশটাকে মনমুগ্ধকর লাগছে ৷ ভাললাগাটা প্রখর হয়েছে অর্ণব পাশে থাকায় ৷ প্রিয়জন পাশে থাকলে প্রকৃতির সৌন্দর্য মনে ধরা পড়ে, চোখের তৃপ্তি দেয় ৷ প্রকৃতির মাঝে মিশে যেতে ইচ্ছা করে ৷ অর্ণব পাশে থাকায় আমারও তেমনটা করতে মন চাচ্ছে ৷ অর্ণব আচমকা বলে উঠলো, “বুঝছিনা, কে বেশি সুন্দর! নিশিরাতের একপ্রান্তে ভাসতে থাকা জোৎস্নার তীব্র আলো ছড়ানো ঐ রুপালী চাঁদ, নাকি আমার পাশে দাঁড়ানো স্বর্গ থেকে নেমে আসা শ্যামবর্ণের মায়াবী এই রমনী? যাকে আমি আদর করে নাম দিয়েছি সোনু! আমার অবেচতন মন তো একবার নয়, বারবার বলছে সোনুই সবচেয়ে সুন্দর ৷ চেয়ে দেখো, অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখো; তার চেহারায় বিন্দুমাত্র কালিমা নেই; চাঁদের মাঝে দাগ রয়েছে ৷ কিন্তু সোনু পরিপূর্ণ পবিত্র, তার মাঝে দাগ নেই!”
আমি মনের কথাটাকে মেনে নিয়ে বলছি আমার সোনুই সবচেয়ে সুন্দর ৷ বিনাদ্বিধায় তার চোখের জাদুতে ঘায়েল হওয়া যায় ৷ চাঁদ মেঘের আড়ালে ডুবে গেলে তার দিকে তাকাতে মন চাইনা, কিন্তু সোনু দূরে চলে গেলে আক্ষেপ বাড়ে, সে কখন দেখা দিবে, এরজন্য হাহুতাশ করি; কারণ সোনুকে দেখতে পেলে প্রচন্ড রকমের ভাললাগা কাজ করে! সোনু তোকে আমার অনেক অনেক অনেক বেশি ভাললাগে!
.
.
অর্ণবের কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করছিলাম ৷ অবাক নয়নের তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম ৷ তার চেহারায় চাঁদের আলো পরায় মায়া জাগলো দেখে ৷ অর্ণব আচমকা আমার হাতটা স্পর্শ করলো ৷ কেঁপে উঠলাম ৷ অন্যরকম সুখপ্রাপ্ত হলাম ৷ সে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সমুদ্রের ঢেউ খেলানো ঈষৎ শীতল পানিতে ৷ বাকরুদ্ধ হয়ে তার চোখে দৃষ্টি বিনিময় করতে করতে চলছিলাম তার সঙ্গে ৷ কখন যে হাটু পানিতে পৌঁছে গেছি খেয়াল নেই ৷
হাঁটু পানি থেকে উড়ু পর্যন্ত পানিতে ৷ অতঃপর অর্ণব থামলো ৷ সে চুপচাপ ৷ চারপাশ নীরব নয়, সমুদ্রের গর্জন ও ঢেউয়ের শব্দমালা আমার ভেতরে সুখের ঝড় বয়ে দিচ্ছিল, এমন সুখ তৈরির মূল কারণ অর্ণব ৷ বেশকিছুক্ষণ অর্ণব নীরব নিস্তব্ধ থেকে তার মুখে কথা ফুটলো ৷ সে নিচুস্বরে বলল,
-এখন কি করতে মন চাচ্ছে জানিস?

কাঁপা ঠোঁটের কম্পমান কন্ঠস্বরে বললাম,
-কি করতে মন চাচ্ছে বলো?
-তোকে পানিতে চুবিয়ে মারতে মন চাচ্ছে!
কথাটি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম ৷ মুহূর্তেই ভয় আঁকড়ে ধরলো আমায় ৷ ঢোক গিলে ভয়ার্ত কন্ঠস্বরে বললাম,
-কি বলছো এসব?
অর্ণব ক্ষিপ্তস্বরে নয় হিমশীতল কন্ঠস্বরেই বলল,
-খুব ইচ্ছা আমার সোনুকে পানিতে চুবিয়ে মারার ৷
-দয়া করে মজা করোনা ৷
-মজা কেন করবো?
-এসব মজা নয়?
-একশ পার্সেন্ট সত্য ৷৷
-তো দেরি করছো কেন?

কথাটি বলতে না বলতে অর্ণব আমার হাতটা আরো শক্তভাবে ধরে এত তীব্রভাবে চাপ দিলো যে ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম ৷ মনে পরে গেল সেই রাতের দুঃস্বপ্নের কথা ৷ তীব্র ভয় আমাকে পিষিয়ে মারা শুরু করলো ৷ অর্ণব আমার কোমড়ে সজোরে থাপ্পর মারতে লাগলো ৷ অতঃপর, হাত ধরে গভীর পানির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল ৷ আমি আর মুখ বুজে থাকতে পারলাম না ৷ ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে প্রাণভিক্ষা চাইতে চাইতে বলতে লাগলাম,
-প্লিজ, অর্ণব আমাকে মেরোনা; আমি তোমার জীবন থেকে এমনিতেই চলে যাবো ৷ আমার প্রাণভিক্ষা দাও!

বেশ কয়েকবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে সে থামলো ৷ তখনো উড়ু পানিতেই আমরা ৷ অর্ণব কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে খিলখিল করে হাসতে লাগলো ৷ অতঃপর, আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে শক্তভাবে চাপ দিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
-তুই, কেমনে ভাবলি আমি তোকে পানিতে চুবিয়ে মারবো, বোকা মেয়ে!
আমি তো তোর সঙ্গে মজা করছিলাম ৷ তোর ডায়েরীতে লিখা ছিল বাসর রাতের স্বপ্নের কথা ৷ স্বপ্ন নিয়ে লিখাটা পড়ে ভেবেছিলাম তোকে একটু ভয় দেখাবো ৷ ভয় দেখিয়েছি ৷ তবে, ভাবিনি এতটা ভয় পাবি ৷ যদি বুঝতাম তাহলে এমনটা করতাম না ৷ মাফ করিস রে!
আর শোন,
আজকে তোকে সব সত্য খুলে বলবো!
.

.
নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে কান্না জুড়ে দিলাম ৷ চেঁচিয়ে কান্না করতে লাগলাম ৷ যেন মনে হলো সমুদ্রের প্রতিটা জলরাশির বিন্দুকণা আমার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে ৷ কান্নামিশ্রিত কন্ঠে অর্ণবকে বললাম,
-এত নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির মজা তুমি করতে পারলে? তোমার চাচাতো বোন হই বলে এতটা মজা করবে? আমি যে তোমার স্ত্রী সেটা কি ভুলে গেলে?
.
অর্ণবের বুকের সাথে আমার মাথা চেপে ধরে সান্ত্বনার প্রতিধ্বনিতে তুই থেকে তুমি সম্বোধন করে সে বলতে লাগলো,
-তোমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী! বিশ্বাস করো, তুমি এতটা ভয় পাবে ভাবিনি ৷ মজাটা বেশিই করে ফেলছি!
অভিমানের কন্ঠস্বরেই
বললাম,
-আমাকে ফালতু বুঝ দিওনা ৷
-প্লিজ, মাফ করো ৷ তুমি বলেছিলে আমার সমস্ত রহস্য খুলে বললে তুমি আমাকে মেনে নিবে, তবে শোনো সেসব সত্য ৷ আমি বলছি!
-শুনতে চাইনা!
-তবুও বলছি,
অর্ণব নামে একটি ছেলে তার কাজিন সোনুকে মনেপ্রাণে ভালবাসতো!
.
হকচকিয়ে গেলাম অর্ণবের কথায় ৷ উত্তেজিত কন্ঠস্বরে বললাম,
-কিহ?
অর্ণব নিচুস্বরে বলল,
-হুম সত্য! এটা আজকে তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে ৷ আমি তোমাকে ছোটবেলা থেকে ভালবাসতাম ৷ তাইতো, লেখাপড়া শেষ হয়ে জবে ঢুকলেও কারো সঙ্গে সম্পর্ক করেনি এই আশায় যে একদিন তুমি আমার ভালবাসা বুঝতে পারবে!
-এতদিন এই সত্যটা বলোনি কেন? রবিনের আগে সম্পর্ক হবার আগেই বা কেন বলোনি?
-রবিনের সঙ্গে সম্পর্ক হবার আগে ভয়েই বলতে পারিনি ৷ কিন্তু যখন সাহস হলো তখন তুমি রবিনের হয়ে গেলে ৷ প্রচন্ড ও সীমাহীন রাগ হয়েছিল তোমার প্রতি ওর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলে বলে!
-এটা মনের মধ্যে চেপে রেখে তো ভুল করছো ৷ আমি তো তোমার কাজিন, সেইসাথে বন্ধুও ছিলাম ৷ কেন মনের কথা বলোনি, কি এমন ভয় ছিল তোমার?
-বলতে পারিনি কিসের জন্য যে নিজেও জানিনা ৷ সাহস হয়ে উঠতোনা ৷ যখন বলতাম তখন তোমার প্রতি ক্রোধ ছিল ৷ তাই ভালবাসি বলার চেয়ে কৌশল অবলম্বন করলাম ৷ তাছাড়া, তুমি রবিনের প্রেমিকা হয়ে যাবার পর আমার মনে সবসময়ের একটি সুপ্ত লক্ষ্য বাস্তবায়ণের নেশা নতুন করে জাগ্রত হয়ে যায়!
-কি লক্ষ্য?
-সমস্ত পথশিশুদের বাসস্থান করিয়ে দেওয়া, তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর ব্যবস্থা করতে পারবো আমি!
-তো, সেটা কি করতে সমর্থ হয়েছো?
-হুম, তোমার বাবার মাধ্যমে ৷
-আমার বাবার মাধ্যমে মানে?
-শোনো, বলছি!
-হুম বলো!
– কয়েক বছর আগে তথা যখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে অধ্যয়নরত তখন তােমার বাবাকে পথশিশুদের আশ্রম নিয়ে একটি পরিকল্পনার কথা বলেছিলাম ৷ সে আমার পরিকল্পনার কথা শুনে রেগে গিয়েছিল ৷ এজন্য বিষয়টা নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছিলাম ৷ ভেবেছিলাম কর্মজীবনে ঢুকে নিজের অর্থ দিয়ে সব করবো ৷ কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করে ভাল চাকরি পাচ্ছিলাম না ৷ যেকারণে স্বপ্নটা অধরায় থেকে যায় ৷ যেসব চাকরি পেতাম তাতে নিজের পরিবারের খরচ চালাতেই শেষ হয়ে যেতো ৷ অল্প আয়ে ৫০ এর অধিক বাচ্চার লালন পালন করা সম্ভব হবেনা ৷ বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত, তোমার বাবার অফিসে অ্যাকাউন্ট অফিসার হিসেবে জয়েন করলাম ৷ স্যালারি ভাল ৷ কিন্তু এতেও শিশুদের আশ্রম তৈরি করার মত সুযোগ পেলাম না ৷ তুমি তখন রবিনের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু করে দিলে ৷ মেজাজ গেলো বিগড়ে ৷ এমন প্ল্যান করলাম যাতে তুমি আমার হাতের নাগালে চলে আসো!

প্রথমে সিদ্ধান্ত নিই অফিসের টাকার হিসেবে গোলযোগ বাঁধিয়ে টাকা হাতিয়ে নিবো ৷ কারণ আমার দরকার প্রচুর টাকা ৷ ইচ্ছা করে অফিসের টাকার হিসাবে গোলমাল লাগাই, এমনভাবে সেটা করি যে আঙ্কেলও টের পায়নি ৷ কিন্তু অফিসের ম্যানেজার রবিন বিষয়টা ধরে ফেলে ৷ এবং সে আমাকে ব্লাকমেইল করতে অর্ধেক টাকা চেয়ে বসে ৷ রবিনের শর্তে রাজি হই ৷ তাকে ১কোটি টাকার অর্ধেকটাই দিয়ে ফেলি!
.
.
ভাবতে থাকি রবিন তো লোভী, সে আঙ্কেলকে সত্যটা বলে দিতে পারে ৷ এজন্যই সিদ্ধান্ত নিই নতুন একটা প্ল্যান করবো ৷ তোমার বাবাকে ব্লাকমেইল করার প্ল্যান করে ফেলি নিখুঁতভাবে ৷ খুঁজতে থাকি আঙ্কেলের দুর্বলতাকে ৷ চিন্তায় পরে যাই বিষয়টা নিয়ে ৷ কোনটা হতে পারে তার দুর্বলতা সেটা নিয়ে ভাবনার শেষ হয়না ৷ অবশেষে জানতে পারি তার দুর্বলতার কথা ৷ তিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট মিস হলেই অ্যাডাল্ট ক্লাব অথবা পার্টিতে যায় মদ খেতে ৷ নারীদের প্রতি আকর্ষণ না থাকলেও মদে আসক্ত ছিল সে ৷ শেষবার ১৫ কোটি টাকার প্রজেক্ট হাতছাড়া হলে তিনি মদ খেতে যান ৷ আমিও ঐ রাতে তার পিছু নিই ৷ সে মদ খেতে থাকে ৷ নেশায় ডুব দেয় ৷ একপর্যায়ে সে মাতাল হয়ে পরে থাকে ৷ আচমকা পার্টিতে একজন লোক খুন হয় ৷ কেউ একজন খুন হওয়ায় সমস্ত লোক পার্টি থেকে চলে যায় ৷ শুধু তিনজনই পার্টিতে অবস্থান করি, আঙ্কেল, আমিও ও সেই খুন হওয়া লোকটির লাশ ৷ আমি সুযোগ পেয়ে যাই, মৃত লাশের পাশে আঙ্কেলকে শুয়ে দিই ৷ আমার হাতে পূর্ব থেকে গ্লাভস লাগানো ছিল বলে লাশের পেট থেকে চাকুটা বের করে আঙ্কেলের নিথর হাতে ধরিয়ে দিই ৷ অতঃপর কয়েকটা ছবি ও একটি ভিডিও মোবাইলে ধারণ করি ৷ দ্রুত সহকারে কাজ সম্পন্ন করতে থাকি ৷ প্রথমে লাশটাকে লুকানোর জন্য ওয়াশরুমে ফেলে রাখি পানির ট্যাব চালু করে যাতে দেহের ছাঁপ চলে যায় ৷ অতঃপর আঙ্কেলকে নিয়ে গাড়ির নিকট যাই ৷ ঠিক তখনই পুলিশ চলে আসে ৷ ভাগ্য ভাল যে আর একটু হলে আমাদের ধরে ফেলতো!
এরপর সুযোগ বুঝে আঙ্কেলকে ঐ ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে তাকে ব্লাকমেইল করতে থাকি ৷ প্রথমেই তাকে বলি সোনুকে আমার হাতে তুলে দিতে হবে, সোনু হবে আমার স্ত্রী ৷ আঙ্কেল এতে রাজি হয়ে যায় ৷ কিন্তু রবিন এসে এখানে ঝামেলা পাকায় ৷ সে পার্টিতে সেদিন উপস্থিত ছিল আমাদের লোকচক্ষুর আড়ালে ৷ পার্টিতে যে লোকটা খুন হয় সে একজন ধর্ষক ছিল ৷ অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য যে লোকটাকে আমিই লোকচক্ষুর আড়ালে খুন করে ফেলি ৷ সে ছিল পথশিশু সামান্তার বড় বোনের ধর্ষণকারী ৷ হ্যাঁ, সোনু; তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম যে সামান্তা আমার মনের মানুষ ৷ আসলে সে ছিল ৭ বছরের শিশু, তার বোন ছিল ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ৷ তাকে ধর্ষণ করে সেই জানোয়ার, যাকে আমি খুন করতে বাধ্য হই ৷ সামান্তার বোনের ব্লাড ক্যান্সারের জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিল যা জোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা ৷ সামান্তার বোন তিথি হাল ছেড়েছিল যখন সে ধর্ষণ হয় ৷ এতে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ৷ এটা এইতো মাত্র ৭ মাস আগের ঘটনা ৷৷ আর তার কয়দিন পরই প্ল্যান করেছিলাম তোমার বাবাকে কেমনে ব্লাকমেইল করে আমার চাওয়াগুলো পূরণ করবো ৷ ঐদিন সুযোগও পায় একটা ৷ আঙ্কেল যে ক্লাবের পার্টিতে মদ খেতে যেতো সেই পার্টিতে সেই ধর্ষকও যেতো ৷ এক ঢিলে দুই পাখি মারার প্ল্যন ভালভাবে রপ্ত করায় ছিল আমার ৷ তাতে সফলও হই ৷ কিন্তু, রবিন ঝামেলা করে পার্টিতে ধর্ষককে খুন করি সেটা ভিডিও ধারণ করে ৷ এতে সে আমার থেকে ৫০ লক্ষ টাকা দাবী করে ৷ আমার নিকট ৪০ লক্ষ টাকা ছিল ৷ বাকি টাকাগুলো দিবো বলে সময় চাই ৷ কিন্তু রবিন সময় না দিয়ে একটা অফার দেয় ৷ অফারটি হলো তার অন্ধ বোনকে বিয়ে করতে হবে, এতে সে বাকি ১০ লক্ষ টাকা মওকুফ করে দিবে ৷ আমি রাজি হয়ে যাই ৷ কিন্তু তার বোন আত্মহত্যা করে মারা যায় ৷ রবিনের ভাষ্য তার বোন একজনের নিকট প্রতারিত হয়ে জীবননাশের সিদ্ধান্ত নেয় ৷ তার বোন মারা যাওয়ায় সে আমাকে ১০ লক্ষ্যের বদলে ৫ লক্ষ টাকা পরিশোধ করার সুযোগ দেয় ৷৷আমি তাতে রাজি হয়ে যাই!
রবিন জানতোনা যে আমি আঙ্কেলকে একটি চালে আটকে রেখেছি, ব্লাকমেইলের জালে ফাঁসিয়েছি ৷ সে এটা জানতে পারলে সোনু, তোমাকে কখনই সে ছাড়তোনা ৷ আঙ্কেল আমার ব্লাকমেইলের চাপে পরে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করে গোপনে ৷ কিন্তু সবাই জানতো বিয়েটা রবিনের সঙ্গে হতে যাচ্ছে ৷ রবিনও জানতো ৭ মার্চে বিয়ে ৷ কিন্তু বিয়ের দিন সকালে গল্প পাল্টে যায় ৷ আঙ্কেল রবিনকে ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় ৷ একারণেই রবিন বিয়ের দিন উধাও হয় তার বাসা থেকে ৷ অথচ ভাইরাল করা হয় যে সে তার অন্য প্রেমিকা নিয়ে ভেগে গেছে!

.
রবিন এত টাকা পেয়েও আমার পিছু ছাড়েনি ৷ যেকারণে, গতরাতে তাকে খুন করে ফেলি ৷ ঠিক তখন খুন করি যখন সে তোমার সাথে কথা বলা শেষ করে ফোনটা কেটে দিয়েছিল!

.
এই ছিল আমাকে নিয়ে তৈরি হওয়া রহস্য!
.
.
অর্ণবের সত্য ঘটনা শুনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, না তাকে ভাল বলতে পারছি; না মন্দ ৷ তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে মনে ৷ পুলিশ অফিসার বলেছিল অর্ণব একটা মেয়েকে প্রথমে ধর্ষণ অতঃপর হত্যা করেছে ৷ কিন্তু অর্ণব এই সত্যকে ঢেকে ফেলেছে! তাকে বললাম,
-তুমি একটা সত্য লুকাচ্ছো!
অর্ণব বলল,
-কোনটা?
-সেদিন সকালে বাসায় পুলিশ এসে তোমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল ৷ কিন্তু পুলিশকে ঘুষ দেওয়ায় সে থেমে যায়!
.
-ওগুলো ভুয়া পুলিশ ছিল ৷ অভিনয় শিল্পি ছিল তারা ৷ সামান্তার বোন তিথির অপারেশনের জন্য নতুন করে আরো ৪ লক্ষ টাকা লাগতো ৷ সেই টাকার চিন্তায় মশগুল ছিলাম ৷ যে কারণে টেনশনে বিয়ের রাত্রে বাসর রাতটাও উৎযাপন করতে পারিনি ৷ সারারাত ভেবেছিলাম কি করলে টাকার সন্ধান মিলবে ৷ পরে প্ল্যান বের করি নিজেকে ছোট করে হলেও একটা নাটক সাজাতে হবে ৷ ৪জন অভিনয় শিল্পীর সাহায্য নিলাম, তাদের স্ক্রিপ্ট বলে দিলাম বিয়ের রাত্রেই ফোনের মাধ্যমে ৷ তারা আমার বিশ্বস্ত ছিল বিধায় পরদিন প্ল্যানমত পুলিশ বাসায় চলে আসে ৷ এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে ৷ এবং তুমি ৩লক্ষ টাকা দিতে রাজিও হও ৷ আর তার আগে তো তোমার থেকে ১লক্ষ টাকা নিয়েছিলাম ৷ এই টাকা দিয়ে তিথির অপারেশনে কাজে লাগিয়েছিলাম! হয়তো বলবে তোমার বাবাকে ব্লাকমেইল করেও তো টাকা নিতে পারতাম ৷ সেই সুযোগ ছিলনা কারণ ভিডিও, ফটো ডিলিট করেছিলাম ৷ তবুও তোমার বাবাকে ঠকানো যেতো কারণ সে দুনিয়ার বোকার বোকা!

.
কপালে কৌতূহলের ছাঁপ ফেলে অর্ণবকে ফের বললাম,
-কিন্তু রবিন তো বলেছিলে সে তোমার থেকে সকালে ৫০ লক্ষ টাকা নিয়ে চলে গিয়েছিল!

নিচুস্বরে অর্ণব জবাব দিলো,
-ঠিকই শুনেছো ৷ তবে সে তোমাকে অনেক কিছু মিথ্যা বলেছে ৷ পুরো সত্যটা বলেনি ৷ যা আমিই বলে দিলাম!
.
-শেষ প্রশ্ন করবো, তুমি বলছো আমাকে ভালবাসো, তাহলে চৈতির সঙ্গে কেন সম্পর্ক করেছিলে? এবং বিয়ে করার পরও কেন এত বাজে ব্যবহার করলে?

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-চৈতির সঙ্গে মাত্র ১ মাসের সম্পর্ক ছিল ৷ সেটা তোমাকে জেলাস ফিল করার জন্য ৷ তুমিতো বুঝোনি ৷ আমাকে তো সবসময় শুধু বলতা আমার সঙ্গে রিলেশন করো, মেনে নিবো ৷ এসব তোমার মনের কথা ছিলনা, মজায় ছিল ৷ মজা ছিল কিনা এটা প্রমাণিত হয় চৈতির সঙ্গে ১ মাসের সম্পর্ক চলমান থাকায়, যদিও তুমি জানতে ২ আড়াই মাসের সম্পর্ক ছিল আমাদের, যা মিথ্যা ৷ তুমি আমার ভালবাসা বুঝতে পারলে চৈতির সঙ্গে সম্পর্ক করিয়ে দিতে না!
আর বিয়ের পর ওরকম মিসবিহেভ করেছি একটাই কারণে, এটা দেখার জন্য যে তুমি আমাকে কতটা গুরুত্ব দাও ৷ যেটা আমি জানতে পেরেছি!
.
-তো, কি জানতে পারলে?
.
অর্ণব উত্তর দিতে যাবে ৷ ঠিক তখনই বিশাল একটা ঢেউ এসে তাকে সহ আমাকে সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে ফেললো! অতঃপর কিছুই মনে নেই!

.

জ্ঞান ফিরলে নিজেকে দেখতে পাই হসপিটালের বেডে!
আমার পাশে বড় বোনের ছেলে পাবেল বসা ৷ সে কাঁপা গলায় বলল,“খালা তোমার অর্ণব আইসিউতে ৷ অতিরিক্ত কৌতূহল উৎসাহ, উদ্ধিপণা, উৎকন্ঠা, আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে অর্ণবের রুমের দিকে গেলাম ৷৷ দরজার সামনে গিয়ে থামতে হলো ৷ রুমের ভেতর যাওয়া নিষেধ ৷ দরজার সাদা গ্লাস দিয়ে দেখত পেলাম অর্ণবকে, তার চোখ বন্ধ ৷ অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে তাকে ৷ অকস্মাৎ, একজন ডাক্টার অর্ণবের মাথাটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলো!

আমার চোখে কেন যেন পানি চলে এলো ৷ অশ্রুতে ভিজে একাকার হলো ৷ ঝরতে লাগলো টপটপ করে অশ্রুর বারিধারা ৷ এই পানি ঝরার কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না ৷ বুকের ব্যথা কেন যেন বেড়ে গেলো আপনাআপনি ৷ আমি কষ্ট পাচ্ছি কোনো কারণে? কিন্তু কেন? হাউমাউ করে কাঁদতে মন চাচ্ছে তীব্র কষ্ট বুকে জমাট বাঁধায় ৷৷কলিজা ফেঁটে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ৷ আচ্ছা, অর্ণবের মাথা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকলো কেন? সিনেমাতে দেখতাম মরে গেলে মুখটা ঢেকে দেয় ৷ তবে কি? না না, এটা কেন হতে যাবে? আমার অর্ণব আমাকে ছেড়ে অচিনগ্রহে পারি জমাতে পারেনা ৷ সে তো আমার সঙ্গে জোৎস্নাবিলাস করবে, বাসর রাতের মধুর লগণে আমাকে সুখের পরশে ভিজিয়ে দিবে ৷ এসব না করেই কেন সে শ্বাস বন্ধ করবে চিরতরে? তার নিশ্বাস তো আমার থেকে ধার নেওয়া ৷ আমার নিশ্বাস সচল থাকতে সে কেন নিশ্বাস হারাবে?
অকস্মাৎ, ডাক্টারটি অর্ণবের মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে দিলো ৷ বুক থেকে বিশাল পাথর সরে গেল ৷ তবে ভোঁতা কষ্ট এখনো দূরভূত হয়নি ৷ ডাক্টারটি রুম থেকে বের হয়ে আমাকে তীক্ষ্ণকন্ঠে বলল,
-মিসেস সোনু আপনি রুম ছেড়েছেন কেন? আপনার হাজবেন্ডকে কি পরে দেখতে পারতেন না? তার অবস্থা একটু জটিল হলেও বিপদ কেটে গেছে ৷ তাই চিন্তার কারণ নেই ৷ কিন্তু আপনার এই কন্ডিশনে রুম ছাড়া ঠিক হয়নি!
.
ডাক্তারের কথায় গালভর্তি হাসি হেসে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে আমার কেবিনে চলে গেলাম!

.

আমাদের বাসর হবে বিশাল একটা জাহাজে ৷ এখন অর্ণবকে নিয়ে জাহাজে অবস্থান করছি ৷ জাহাজের দ্বিতীয়তলার একটি রুমের ভেতরে গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে ডোবানো বেডের উপরে একই চাদরে একেঅপরকে বুকের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি ৷ অর্ণবের মুখে কথা নেই ৷ সে বাকরুদ্ধ ৷ তবে তার গরম নিশ্বাস বের হচ্ছে অনবরত ৷ সেই নিশ্বাসের ভাষা আমি পড়তে পারছি ৷ অর্ণবের নিশ্বাসের প্রতিটা ধ্বনি আমার কানে বাজছিল আর লজ্জায় লাজরঙ্গা হচ্ছিলাম ৷ সেসব লজ্জার কথা প্রকাশ করতে নেই!

তবে এটা প্রকাশ করছি যে বেডের উপরে যতগুলো গোলাপের পাপড়ি ছিল, প্রতিটা পাপড়ির গায়ে লিখা আছে বৃত্তের ভেতরে অরুর সোনু! অর্ণবকে শাস্তিস্বরুপ এটাই করতে বলেছিলাম ৷ সে পেরেছে!

.

.
#The_End. (গল্প শেষ)

গল্প পড়ে কেমন লাগলো অনুভূতি শেয়ার করুন প্লিজ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here