হলুদ খামের চিরকুট পর্ব ১+২+৩+৪

#হলুদ_খামের_চিরকুট ”
পর্ব (১-৪)

খালাতো বোন মুমুর বিয়েতে এসেছি,
কালকে মুমুর গায়ে হলুদ।
আরো আগে আসিনি বলে খালামনির সেকি রাগ। আমার এসব বিয়েবাড়ির হৈচৈ একদম ভালো লাগছে না। তাই চুপচাপ সোফায় বসে আপন মনে একুরিয়াম এর মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। কিন্তু এতো শান্তি করে মাছ দেখা হলো না। নানিমা এসে গল্প শুরু করে দিলো।
– জানিস অর্থী মুমুর ভাগ্য কত ভালো।অনেক ভালো একটা জামাই পেয়েছে।দেখতেও যেমন সুন্দর,চাকরিও করে সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদে। ওই কি যেন লেফটেনেন্ট না কি একটা পদে
-জানি নানিমা, সেকেন্ড লেফটেনেন্ট। আব্বুর বন্ধুর ছেলে,আব্বুই প্রস্তাব দিয়েছে।
-হ্যা হ্যা।যাই বলিস ছেলে কিন্তু লাখে একটা।আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে। একদম সোনার টুকরো।
– তোমার যখন এতই পছন্দ হয়েছে মুমু আপুর জায়গায় তুমিই বিয়েটা করে ফেলো।
– চুপ কর।শয়তান মেয়ে, সবসময় শয়তানি। ঘারে ইবলিস নিয়ে ঘুরিস।
– আরে কি বলো নানিমা, শয়তানি না। সত্যি বলছি তোমার পছন্দ হলে বলে ফেলো, আমি মুমু আপুকে বলে তোমার লাইন ক্লিয়ার করে দিবো।
নানিমা আমার কান টেনে ধরে বলল
– ওরে শয়তান মেয়ে। বেশি পাকনামি শিখে গেছিস তাই না।
এমন সময় খালামনি এসে বলল,
– অর্থী, এই খালামনি কে তো ভুলেই গেছে আসতেই চায় না।
– না খালামনি, তুমি জানো তো কিছুদিন পর ভর্তি পরীক্ষা দিবো।
– হয়েছে হয়েছে, দুই একদিন পড়াশুনো না করলে কিছুই হবে না।
আমি মুমু আপুর কাছে গেলাম। আপু চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।
– আপু তোমার মন খারাপ?
– না মন খারাপ হবে কেন? আমার মন খারাপ নেই।
– হ্যা,আমি বুঝতে পারছি তোমার মন খারাপ। মন খারাপ থাকাটা স্বাভাবিক। পরিচিত মানুষদের ছেড়ে অপরিচিত নতুন জায়গায় যাবে।
– আমার কোন মন খারাপ টারাপ নেই। মন খারাপ তো সবার হবে বিয়ের দিন।
– হুম হবেই তো, তুমি যে সবার আদরের। তুমি এ বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে সবারি মন খারাপ হবে।
– বড়মানুষের মত কথা বলা বন্ধ কর। বুঝলি
– আপু শেষমেশ কিনা একজন আর্মিকে বিয়ে করতে চলেছ
– কেন? আর্মি হয়েছে তো কি হয়েছে?
– কি হয়েছে! তুমি আমার আব্বুকে দেখো নি, প্রতিটা মুহূর্তে কেমন চড়া মেজাজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।বাসায় যতক্ষণ থাকে আম্মুসহ তটস্থ থাকে। আর ডিসিপ্লিন এর একটু যদি এদিকওদিক হয়েছে তাহলে তো পুরো বাড়ি মাথায় উঠিয়ে নেয়। সবসময় রেগে থাকে এমনকি বাসাতেও যেন আমরা তার পরিবারের নয় ব্যাটেলিয়ন এর কেউ।
– হা হা হা,দেখিস তোর কপালেও আর্মড ফোর্স এর লোকই জুটবে। তোর আব্বু তোর জন্য সেনাবাহিনীই চয়েস করবে।
– আপু খবরদার বদদোয়া দিবে না।আর আমার বিয়ের অনেক দেরী আছে।সবেমাত্র এইচ এস সি দিয়েছি।
রাতে খাওয়া করে আপুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে ঘুমিয়ে পড়লাম। আজকে গায়ে হলুদ। চারিপাশ এ লোকজন গিজগিজ করছে। আমি আপুর পাশে স্টেজ এ বসে আছি। আপুর হাতে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে দুটো মেয়ে। কিছুক্ষণ আগে বরপক্ষের লোকেরা হলুদ এর ডালা নিয়ে এসেছে। হলুদের দিনের সব কর্মসূচি খুব সুন্দরভাবে মিটে গেলো। আজ বিয়ে।
সকাল থেকে সবাই কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। আমিও খালামনিকে সাহায্য করছি। মুমু আপু পার্লার গেছে সাজার জন্য সাথে তার ফুপুতো বোন নিহা। আমাকেও বলেছিল যাওয়ার জন্য কিন্তু আমার ভালো লাগে না, ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ একরকম ভাবে বসে থাকতে। তাই যাইনি।
বিকেল হয়ে গেছে কিছুক্ষণ পর বরপক্ষ চলে আসবে কিন্তু মুমু আপু এখনো পার্লার থেকে ফিরে নি। খালামনি রেগে গেছে।
বরপক্ষ চলে এসেছে কিন্তু আপুর কোন খোজ নেই। ফোনও অফ। নিহার ফোন বাসায় ফেলে গেছে।
আমার দুই মামাতো ভাইয়া পার্লার গেছে আপুকে নিয়ে আসতে।
বরপক্ষের সাথে কুশল বিনিময় করছে মুরুব্বিরা।
কিছুক্ষণ পর ভাইয়ারা এলো তাদের মুখ চিন্তায় শুকিয়ে গেছে সাথে শুধু নিহা।
মুমু আপু পালিয়েছে।
খবরটা শুনার সাথে সাথেই খালামনি অজ্ঞান হয়ে গেছে আর খালু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ঘর ভর্তি মেহমান, আজ তার সম্মান ধুলোয় মিশে গেলো।
বরপক্ষের কেউ এখনো বিষয়টা জানে না। সবারি মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
এর মধ্যে আমার আব্বু গিয়ে পাত্র এর বাবা আমার আব্বুর বন্ধুকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলল। তাদের মধ্যে কি কথা হলো জানিনা, কিছুক্ষণ পরেই আব্বু এসে আমায় বলল,
– অর্থী, তৈরী হয়ে নে মা। আজ তোর বাবার ও তোর খালুর সম্মানটা তোকেই রাখতে হবে।

আমি অবাক হয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে আছি। পাশে খালু দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে অসহায়ত্বের ছাপ।
রুমের ভিতর যারা ছিলো তারা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আব্বুর এই কথাটি শুনার পর থেকে নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হচ্ছে।
দরজার কাছে আম্মুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তার চোখে পানি ছলছল করছে। আজ পর্যন্ত আব্বুর কথার উপরে কখনো কোন কথা বলি নি, কিন্তু আজ বলতে ইচ্ছে করছে।
মনের ভিতরের সবটুকু সাহস একত্রে করে অনেক কষ্টে বললাম,
– কিন্তু আব্বু, আমার পড়াশুনা….
আব্বু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোর পড়াশুনা তো থেমে থাকছে না।
পিছন থেকে আম্মু বলে উঠলো
– তাই বলে, এতো অল্প বয়সে…..
আব্বু এবার অনেকটা রেগে গিয়ে বলল
– বাচ্চা নেই সে, কিছুদিন আগেই আঠারো বছর বয়স হয়েছে তার।
এরি মধ্যে খালু আমার হাত ধরে অসহায় চাহনিতে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থায় বলল,
– মা’রে,অন্তত তুমি আমার মান সম্মানটা বাচাও। নিজের সন্তান তো সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গেলো।
বাইরে কিছুটা শোরগোল এর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
আব্বু একবাক্যে কোন ভণিতা ছারাই আম্মুকে আদেশের সুরে বলল,
– অর্থীর মা, তোমার মেয়েকে সাজিয়ে দেও।
অদ্ভুত হলেও এটাই সত্য হলো, কিছুক্ষণ আগে যেই আমি মুমু আপুকে বিয়ে নিয়ে টিটকারি দিচ্ছিলাম।
সেই আমিই এখন কনে সাজে বসে আছি মুমু আপুর জায়গায়।
নিজেকে আজ বড্ড অসহায় লাগছে। মনে হচ্ছে আমি সার্কাস এর জোকার। সঙ সেজে বসে আছি আর সবার নজর আমার উপর, সবাই যেন হাসছে আমাকে দেখে। জীবনটা এক মুহূর্তে হাসির পাত্রে পরিণত হলো।
সব কিছুই যেন এক ঝড়ো হাওয়ার মতো। এক কালবৈশাখী ঝড় এলো আর এক মুহূর্তে সবকিছু বদলে দিলো।
খুব ইচ্ছে হচ্ছে, মুমু আপুকে একবার জিজ্ঞেস করার যে কেন এমনটা করলো সে। তার জন্য আজ আমার জীবনটা দাবা খেলার গুটিতে পরিণত হলো।
আমি চুপ হয়ে আছি।
আশেপাশে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে কিন্তু সেসবে আমার মাথাব্যথা নেই। প্রতিটা মেয়েরই তার বিয়ে, স্বামী এসব নিয়ে স্বপ্ন থাকে।
একটা সময় আছে যেই সময়টাতে প্রতিটা মেয়ে এসব নিয়ে ভাবে। কিন্তু আমি এখনো সেই স্বপ্ন সাজাতেও শুরু করি নি।
বিয়েটা হয়ে গেলো।
খুব কান্না পাচ্ছিলো, আম্মুও খুব কাঁদছিল। যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে সেই লোকটাকে আমি চিনি না জানি না। নামটা জানি আলভী।
এই নামটা নিয়ে মুমু আপুকে খুব খেপিয়েছিলাম, আলুর বউ বলে ডেকেছিলাম আপুকে।
কে জানতো? সেই ডাকটা আমার ভাগ্যেই এসে জুটবে।
গাড়িতে বসে আছি। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কিছুক্ষণ পর পৌছে গেলাম। আমার শ্বশুরালয়ে।।
শ্বশুরালয়!! মনে মনে নিজেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম।
আমি বসে আছি আর প্রায় সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে কুরবানির পশু মনে হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর এই ভীর একটু কমলো। আমার শাশুড়িমা আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে এলেন। তিনি আমার হাত ধরে বললেন,
– জানি মা, তোমার হয়ত এই বিয়েটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এভাবে হঠাৎ করে এসব হয়ে গেলো।
মাঝে মাঝে নিজের পরিবার, পরিবারের সম্মান এর জন্য কখনো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তুমি এখন এ বাড়ির মেয়ে। আমার কোন মেয়ে নেই। আজ থেকে তুমিই আমার মেয়ে।
আমাকে তোমার মায়ের মতো একজন ভালো বন্ধু ভাববে।
আমি অবাক হয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে আছি।
তার এমন আচরণ সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করছে।
আমাকে বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। চুপচাপ বসে আছি। চারিপাশ রজনীগন্ধা ও বেলীফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে।
কিছুক্ষণ পর দরজায় আওয়াজ পেলাম। আজকের ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা আমার কাছে এক দুঃস্বপ্নের মতো।
তাই এসব নিয়ে কোন ভাবান্তর আমার মাঝে নেই।
কিংবা নতুন বৌ যেভাবে বাসর রাতে একহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে থাকে সেভাবেও আমি নেই।
আমি চুপচাপ পা ঝুলিয়ে বসে আছি। আমার বর আলভী মানে মিঃ আলু রুমে ঢুকলো। এবং ঢুকেই একটি কথা বলল যা শুনে আমি যেন এই মুহূর্তে আকাশ ভেঙে পরে গেলাম,
.
2
.
আলভী রুমের ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই কোন ভণিতা ছাড়া বলল
– এই মেয়ে, তুমি কেন এ বিয়ের জন্য রাজি হয়েছ।
এমনিতেই আজকের সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই এখনো ঠিকমতো হজম করতে পারি নি, তার উপর এমন কথা শুনে অবাক হওয়ার মাত্রাটা শতগুন বেড়ে গেলো।
আমি প্রায় একরকম হা করেই তার দিকে তাকালাম।
বাহ! এতক্ষণ লক্ষ্য করি নি, দেখতে শুনতে মাশাল্লা ভালোই।
সেনাবাহিনীর লাইফস্টাইল টা অনেক ভালো লাগে। স্মার্টনেস থাকে তাদের ভিতরে।
আমাকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে আলভী বলল
– এই মেয়ে চুপ হয়ে আছো কেন?
– আমি তার কথা শুনে ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে বললাম
– মানে!!! কি বলছেন আপনি?
– খাটি বাংলায় বলেছি, বুজতে পারো নি। এই বিয়েতে রাজি হয়েছ কেন?
– আমি রাজি হয়েছি!!!!
– তুমি রাজি না হলে তোমাকে তো আর জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না।
আজব লোক তো, কোথায় এই হুট এবং এক্সিডেন্টলি বিয়েটার জন্য কিছু সহানুভূতিশীল কথা বলবে তা না, বলছে কিনা আমি বিয়েতে রাজি কেন হয়েছি। এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই। আজকে কি থেকে কি হয়ে গেলো। তার উপর এই ধরনের কথা শুনলে কার না মাথার টেম্পারেচার বারবে।
– এই কি বলতে চাইছেন কি আপনি হু? আমি কি স্ব- ইচ্ছায় এই বিয়েতে রাজি হয়েছি নাকি।
আপনার মতো একটা হাইব্রিড ছাগল কে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে। (কিছুটা মিনমিনিয়ে)
– এই কি বললে, কি বললে!
– কই কিছু বলি নিতো
– না না, আমি কিছু একটা শুনেছি। ছাগল না কি যেন বললে।
এইরে, ইনি কি কানে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে রাখে নাকি।
– কিছুই বলি নি আমি। আর শুনুন আমাকে আপনার বউ হিসেবে নিজেকে মেনে নিতে সময় লাগবে।
– কিহ”!!!!!
– না মানে, আপনাকে আমার বর হিসেবে মেনে নিতে ও এই বিয়েটা মেনে নিতে আমার টাইম লাগবে।
– এই মেয়ে, কি মনে কর তুমি?
আমি তোমাকে বউ হিসেবে মেনে নিয়েছি নাকি।
আমি অবাক হয়ে আলভীর দিকে তাকালাম
– মানে”!!!!!!!
আমার দিকে না তাকিয়ে নিজে নিজেই বলতে লাগলো
– বিয়ে করবোনা বলে, কত কি প্লান করলাম। মুমুকেও পালাতে সাহায্য করলাম।
আলভীর কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠলো
– কিহ!!!!! আপনি মুমু আপুকে পালাতে সাহায্য করেছন!!!!
আমার কথা শুনেই নি এমন ভান করে আলভী বলল
– এই মেয়ে সরো আমার বিছানা থেকে আমি ঘুমাবো।
এই ঘুমাবেন মানে কি । আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
আলভী আমার কথা কানে না নিয়ে বিছানার অপর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
খুব অসহ্য লাগছে।
এমনিতেই সারাদিন স্ট্রেস এর মধ্য দিয়ে একপ্রকার মানসিক চাপে কেটেছে, তার উপর এসব শুনার পর মাথা আরও খারাপ হয়ে গেছে।
লোকটা মুমু আপুকে পালাতে সাহায্য করেছে। নিজের বিয়ে নিজেই ভাঙতে চেষ্টা করেছে।
এই লোকের প্রেমিকা ট্রেমিকা নেই তো আবার।
হ্যা খোদা, যদি প্রেমিকা থাকার জন্যই এ বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে থাকে। তাহলে তো আমি মনের দিক থেকে আজীবন বিধবা থেকে যাবো।
আমি তার দিকে তাকাতেই দেখি, ঘুমাচ্ছে। এতো জলদি মানুষ ঘুমায় কেমনে।
মনে মনে মুমু আপুর ও আব্বুর উপর রাগ ঝাড়ছি।
এই ছিল আমার কপালে। তার ঘুম দেখে আমার রাগ উঠছে।
আর এই লোকের ঘুমানো দেখে তো আরও পায়ের রক্ত মাথায় চরে যাচ্ছে।
দাড়াও বাছাধন তোমার আরামের ঘুম আমি হারাম করে দিচ্ছি।
আমি রুমের লাইট ফ্যান, সবকিছুর সুইচ অফ করে দিলাম।
এই গরমে এখন সিদ্ধ হও। আমি গিয়ে বারান্দায় বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শীতলতা নিতে লাগলাম।
আমি বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ার টায় বসে আছি।
আকাশটা অনেক সুন্দর।
আবহাওয়া অনেক শান্ত, নির্মল। শীতল বাতাস বইছে।
আর আমি ইজি চেয়ারে বসে ভাবছি।
মুমু আপু সেদিন এই কারনেই তাহলে বলেছিল যে বিয়ের দিন সবারি মন খারাপ থাকবে।
কিন্তু মুমু আপুর যদি পালানোরই থাকতো তাহলে বিয়ের আগেই তো পালাতে পারতো।
বিয়ের দিনই কেন পালাতে হলো। মাঝখান থেকে আমি ফেসে গেলাম।
তাও কপালে কিনা আর্মড ফোর্স এর লোকই জুটলো।
লোকটা মুমু আপুকে পালাতে সাহায্য করেছে।
নিশ্চই কোন প্রেমিকা ট্রেমিকা আছে বোধহয়।
নইলে বিয়ে কেন করতে চাইবে না। কপাল আমার।
এখন নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
কি হচ্ছে আমার সাথে। এখন যদি লোকটা এসে বলে যে সে এই সম্পর্ক কখনওই মানতে পারবে না, সে ডিভোর্স চায়। তখন?
যেই সম্মান বাচাতে আমি এই বিয়ে করতে রাজি হয়েছি সেই সম্মান তো আবার ধুলোয় মিশে যাবে।
এসব আকাশ পাতাল ভাবছিলাম, এমন সময় রুমে লাইট অন করার শব্দ পেলাম। তারমানে লোকটা উঠেছে।
কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ পেলাম।শব্দটা এই দিকেই এগিয়ে আসছে।
আলভী এসেই কিছুটা রাগী ভাবে বলল
– এই মেয়ে সমস্যা টা কি তোমার। মানুষের আরাম সহ্য হয় না নাকি। রুমের সব সুইচ অফ করে দিয়েছ কেন।
– আমার মন চেয়েছে আমি দিয়েছি।
– কিহ!!! এই মেয়ে তোমার মাথায় কি সমস্যা আছে নাকি?
– এইযে মিঃ কি এই মেয়ে এই মেয়ে করে যাচ্ছেন।
আমার একটা সুন্দর নাম আছে।
নাকি বউয়ের নাম ধরে ডাকতে লজ্জা লাগছে।
যদি লজ্জা পান, তাহলে নাম নিয়ে ডাকতে হবে না। বউ বলে ডাকবেন।
– কিহ!!!!
এতক্ষণে আমার বোধগম্য হলো, এসব কি বলছি আমি। আমিতো এই লোকটাকে এখনো বর হিসেবে মানিই না।
– যাই হোক, নাম নিয়ে বা বউ বলে ডাকলে প্রব্লেম নাই তবে এই মেয়ে এই মেয়ে বলে ডাকবেন না।
এটা বলে আমি তার পাশ কাটিয়ে বারান্দা থেকে রুমে চলে আসতে লাগলেই আলভী বলে উঠলো
– এই এই দাড়াও, নিজেকে কি মনে করো তুমি?
– আপাতত আপনার বউ।
– কিহ!!! আমি তোমাকে বউ হিসেবে মানি না। আব্বু জোর করেছে তাই এই বিয়েতে রাজি হয়েছি।
– আপনি তো কচি খোকা নয়।
একজন লেফটেনেন্ট যদি বলে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা শুনলে যে কেউ হাসবে।
আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এই বয়সে কেউ আপনার উপর তার সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিতে পারবে না।
আমি নাহয় আমার আব্বুর সম্মান রক্ষা করতে এই বিয়েতে রাজি হয়েছি।
আপনার অমত থাকা সত্ত্বেও কেন রাজি হয়েছেন।
আলভী আর কিছুই বলল না। সে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
– আচ্ছা আপনি মুমু আপুকে সাহায্য করার আগে একবারের জন্য কি ভাবেন নি যে আমার পরিবার এবং আপনার পরিবারের সম্মানহানি হবে।
আমি এই বিয়েতে রাজি না হলে আপনার আমার পরিবার কত বড় একটা ভোগান্তির শিকার হত, ভেবে দেখেছেন?
আমি খুব শান্তভাবে কথাগুলো বলে রুমে চলে এলাম। আলভী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আলভী বিছানার একপাশে শুয়ে আছে। আমি পাশে শুতে যাবো ঠিক তখনি আলভী বলে উঠলো
– এই মেয়ে কি করছ কি?
– কি করছি?
– তুমি বিছানায় কেন ঘুমোতে আসছো
– মানুষ বিছানায় ঘুমায় নাতো কোথায় ঘুমায়।
– তুমি বিছানায় ঘুমোতে পারবে না। আমি তোমার সাথে এক বিছানায় ঘুমোতে পারবো না।
– সেটা আপনার সমস্যা, আমার না।
এমনিতেই সারাদিন অনেক স্ট্রেস এর মধ্যে কেটেছে, এখন ঘুমাবো।
– তুমি বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। যাও সোফায় যাও।
– আমি কেন সোফায় যাবো? একসাথে একই বিছানায় ঘুমোতে আমার প্রব্লেম নেই, প্রব্লেম আপনার। তাই আপনি গিয়ে সোফায় ঘুমান।
– কিহ!!! এই রুম আমার আমি ডিসাইড করবো কে কোথায় ঘুমাবে?
– হ্যালো, বর্তমানে এই রুমে আমার সমান অধিকার আছে।
এই বলে আমি শুয়ে পড়লাম। সবেমাত্র চোখ বন্ধ করেছি, আলভী এসে আমাকে কোলে তুলে নিলো। সোফার দিকে এগোচ্ছে
আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আমিও বললাম
– স্ব-সম্মানে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিন নইলে
– নইলে কি?
– নইলে আমি সবাইকে বলে দিবো যে, আপনি মুমু আপুকে পালাতে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে আপনার আব্বুকে আগে বলবো
এটা বলার সাথে সাথে আলভী আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।
আমিও চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
.

আজানের শব্দে ঘুম ভাঙল। আমি ঘুম থেকে উঠতে চাইতাম না।
আম্মু প্রতিদিন এই সময়ে আমাকে ডেকে দিতো। সেই অভ্যাসটায় ঘুম ভেঙে গেলো।
উঠে নামাজ পরে নিলাম। নামাজ শেষে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
মনে হলো আলভী উঠেছে। সেনাবাহিনীরা অনেক ডিসিপ্লিন হয়। সেই সুবাদে ঠিক টাইম এ নামাজ আদায় করাটা তাদের বাধ্যগত রুটিন।
সেনাবাহিনীর এই বিষয়টা আমার খুব ভালো লাগে।
আলভী উঠে নামাজ পরে আবার শুয়ে পড়লো। আমি বারান্দাতেই বসে আছি। লোকটা ভারী অদ্ভুত আমি একজন জলজ্যান্ত মানুষ রুমের মধ্যে নেই। সেই বিষয়টা একবারের জন্যও খেয়াল করলো না। অদ্ভুত।
আমি চুপচাপ বসে ভাবছি আর কিছুদিন পর আমার এডমিশন টেস্ট। এরা কি পরিক্ষা দিতে দিবে? আব্বু তো বলল পড়াশোনা করাবে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সেই সাথে আমার জীবনেও নতুন আলো নতুন সকালের শুরু হয়েছে।
এখন আমাকে এ বাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলতে হবে। নিজের কতগুলো স্বাধীনতা কতগুলো স্বপ্ন, করগুলো ইচ্ছেকে মেরে ফেলতে হবে।
মেয়েরা জন্মের পর অনেক স্বাধীনতা থেকে জন্মের শুরু থেকেই বঞ্চিত হয়ে আসে। সেটা কৈশোরে পা দেওয়ার পর আরও কমে যায়।
এটা করা যাবে না, এখানে যাওয়া যাবে না, রাতে বাইরে থাকা যাবে না, এভাবে চলা যাবে না, অনেক কিছু এমন আছে যেই স্বাধীনতা থেকে জন্মলগ্ন থেকেই বঞ্চিত হয়ে আসে।
আর যেটুকু স্বাধীনতা বাবার বাসায় পায় সেই স্বাধীনতা বিয়ের পর একেবারেই কমে আসে। তখন সবকিছুতেই কৈফিয়ত দিয়ে চলাফেরা করতে হয়।
এসব কথা ভাবছিলাম। সে সময় দরজায় কারো আওয়াজ পেলাম। আমি দরজা খুলেই দেখি আমার শাশুড়ি মা। আমি তাকে সালাম দিলাম।
মা আমাকে আর আলভীকে নিচে নেমে নাস্তার টেবিলে যেতে বলল।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, লোকটাকে ডাকবো কি না। ডাকাটা কি ঠিক হবে, যদি রেগে যায়।
আরে আজব তো আমি এসব ভাবছি কেন। মা ডাকতে বলেছে।
কয়েকবার আলভীর নাম নিয়ে ডাকলাম। ঘুমের মধ্যেই উঁহু বলে আবার নড়েচড়ে শুয়ে পড়লো। অসহ্য
আমি আবার ডাকলাম কিন্তু এবার কোন সাড়া দিলো না। এবার হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিলাম। আলভী ঘুমের মধ্যেই বলল
– মা যাও তো। বাসায় এসেছি, একটু শান্তিতে ঘুমোতেও দিবে না।
উফফফ! বুঝেছি এভাবে উঠবে না। থিউরি প্রয়োগ করতে হবে। ফোর্স এর লোকেরা টাইম মেইনটেইন করে। যাস্ট টাইম এ সবকিছু করে। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আব্বু ছুটিতে আসলে যখন ঘুম থেকে উঠতে চায় না তখন আম্মু আব্বুর কানের কাছে এলার্ম বাজায়। তখন আব্বু লাফিয়ে উঠে।
আমিও সেই থিউরি প্রয়োগ করলাম। এবং কাজেও দিলো।
আলভী এক লাফে উঠে বসলো। তার উঠে বসা দেখে আমার হাসি যেন থামতেই চাচ্ছে না।
আমার হাসি দেখে আলভী আমার দিকে রাগী লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি তার তাকিয়ে থাকাকে অগ্রাহ্য করে বললাম
– মা ডাকছে। আমাদের দুজনকেই নাস্তা করার জন্য।
জলদি ফ্রেশ হয়ে আসুন।
আমার কথা শুনে আর কিছু না বলে আলভী ফ্রেশ হতে চলে গেলো আর আমি নিচে নাস্তার টেবিলে চলে এলাম এবং মা কে সাহায্য করতে লাগলাম।
আজ বৌভাতের অনুষ্ঠান। সবাই মিলে নাস্তা করলাম।
নাস্তা শেষে রুমে আসলাম। রুমে এসে আম্মুকে ফোন দিলাম। কেন জানি কথা বলতে খুব কষ্ট লাগছিলো।
কান্না পাচ্ছিলো। খুব কষ্টে কান্নাটা দমিয়ে রেখে কথা বললাম।
ওপাশে আম্মুও যে কাঁদছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আম্মু যে সারারাত কেঁদেছে তার কথা শুনে বুঝাই যাচ্ছে। আমার কথা বলা শেষ হলে চুপচাপ বসে আছি। ভালো লাগছিলো না।
আলভী এসে বলল
– এই মেয়ে শুনো
– এই আপনার সমস্যা কি? কালকেই বললাম আমাকে এই মেয়ে এই মেয়ে বলে ডাকবেন না।
আলভী তেমন কিছু না বলে আমার দিকে একটি আংটির বক্স বারিয়ে দিয়ে বলল
– এটা তোমার জন্য।
আমি অবাক হয়ে আলভীর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার তাকিয়ে থাকা দেখে আলভী বলল
– এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। শুনেছি বাসর রাতে স্ত্রী কে উপহার দিতে হয়। আর কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কি দিয়েছি। তাই এটা রাখো।
আমি তখনো চুপ করে তাকিয়ে আছি। আলভী আমার হাতে বক্সটা দিয়ে রুমের বাইরে চলে গেলো।
আমি বক্সটা খুলে দেখি সিলভার প্লেট এর একটি ডায়মন্ড রিং।
দুপুর হতে হতেই পার্লার থেকে লোক আসলো আমাকে সাজানোর জন্য। যদিও আমার কাছে বিয়েটা আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। তবুও আমার শ্বশুর শাশুড়ির ইচ্ছে জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠান হোক।
বৌভাতের অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। আমাকে সাজানো হয়ে গেলে আমাকে কমিউনিটি সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হলো।
আমাকে আলভীর পাশে বসানো হলো। সবাই আসছে আমাদের সাথে কথা বলছে ছবি তুলছে। আলভীও সবার সাথে সুন্দরভাবে হেসে হেসে কথা বলছে। আমার এসব বিরক্তিকর লাগছে। এই বিরক্তিটা হয়ত চেহারাতেও ফুটে উঠেছে।
আলভী ফিসফিসিয়ে আমার কানের কাছে বলল
– এই মেয়ে হাসতে পারো না নাকি। মুখে একটু হাসি রাখো।
আলভীর এই ফিসফিসানি দেখে পাশ থেকে বলে উঠলো
– কিরে আলভী, কানে কানে কি? এটা বলে হাসতে লাগলো
আর আমি যেন লজ্জায় লাল হয়ে উঠলাম।
আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিলাম। কেউ একজন বলল
– অর্থী, কেমন আছো?
কণ্ঠটা খুব চেনা চেনা লাগছে। আমি মুখ তুলে তাকাতেই দেখি সিয়াম। আমার এক ব্যাচ সিনিয়র। যাকে আমি রিফিউজ করেছিলাম।
.

.
আলভী আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল।
সিয়াম কাছে এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– অর্থী, কেমন আছো?
আমি মাথা তুলে সিয়ামের দিকে তাকালাম। আলভী কিছুটা অদ্ভুত দৃষ্টিততে আমার দিকে তাকালো। তারপর স্বাভাবিকভাবেই বলল,
– তোমরা একে অপরকে চেন নাকি?
সিয়াম কিছুটা রহস্য রহস্য ভাব নিয়ে বলল,
– খুব ভালো করেই চিনি।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই আমি বললাম যে,
– ইনি আমার এক বর্ষ সিনিয়র ছিলেন। আমরা একই কলেজের।
– ওহ আচ্ছা। যাই হোক, অর্থী
সিয়াম আমার খালাতো ভাই।
আমি সিয়ামের দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসলাম।
পুরো অনুষ্ঠান জুরে সিয়াম আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। খুব অস্বস্তি লাগছিলো।
সবাই আসছে আমাদের সাথে কথা বলছে।
নিয়ম অনুযায়ী আজকে আমাদের বাসায় অর্থাৎ আমার বাবার বাসায় যাওয়ার নিয়ম ছিল।
কিন্তু আমাদের বিয়েটা এভাবে আকস্মিকভাবে হওয়ায় বাবা চান অনুষ্ঠান এর মাধ্যমে মেয়ে জামাইকে বরণ করতে। যেহেতু বিয়েটা খালামনির বাসায় হয়েছে আর আমাদের কোন আত্মীয় ছিল না বিয়েতে আর আমি তার একমাত্র সন্তান হওয়ায় আব্বুর ইচ্ছে বড় করে অনুষ্ঠান করবেন।
তাই আর যাওয়া হলো না। অনুষ্ঠান সেরে সাজ তুলে আমি রুমে বসে কানে হেডফোন গুঁজে চুপ করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। এমন সময় আমার শাশুড়ি মা রুমে এলেন। আমি আধশোয়া থেকে উঠে বসে কানে হেডফোন খুলে ফেললাম। আমার শাশুড়ি মা আমার পাশে বসলেন।
– তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই মা;
– জ্বি মা, বলুন
– দেখো মা, বিয়েটা তো তোমার জন্য এখনো স্বাভাবিক হয় নি। হয়ত এখন এইসব কথা তোমার কাছে বিরক্তিকর লাগতে পারে তবুও বলছি, আমার ছেলেটা হয়ত খুব রাগী। তবে তার মনটা অনেক ভালো। মুমুর সাথে এই বিয়েটা যে সেই ভেঙেছে তা আমার অজানা নয়।
আমার শাশুড়ি মা এর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। আমার তাকানো দেখে সে বলল,
– হ্যা, আমি জানি। কাল রাতে বিয়ের পর বাসায় এসে সে অনেক রাগের মধ্যে ছিল। সে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। মুমুকে পালাতে সাহায্য করে সে ভেবেছিলো এভাবে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর অনেকদিন আর তার বিয়ে দেওয়া নিয়ে কথা উঠবে না। কিন্তু সে ধারনাও করতে পারে নি বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার পর তোমার সাথে হঠাৎ করে বিয়েটা হয়ে যাবে। তাই কাল প্রচুর রাগে ছিল। এবং রাগের মাথায় এসে সে আমাকে সব কথা বলে দেয়। আমি অবাক হয়ে গেছিলাম।
সে যে বিয়ে না করার জন্য এমন কিছু করবে তা আমার ধারনায় ছিলো না।
আমি ভাবছি মাকে জিজ্ঞেস করব কি না যে আলভী কাউকে পছন্দ করে নাকি। কিন্তু উনাকে জিজ্ঞেস করাটা কেমন দেখায় তাই জিজ্ঞেস করলাম না।
তিনি আবার বলতে লাগলেন,
– আমি ভেবেছিলাম তার মাথা থেকে সেই চিঠির ভুত নেমে গেছে। কিন্তু না, সে এখনো সেইসব নিয়ে পরে আছে।
তিনি আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুমে আলভীর খালা এসে উনাকে নিয়ে গেলো কোন এক কাজে। আমি চুপ করে ভাবছি,
কিসের চিঠির কথা বলে গেলেন মা। আলভী কি কাউকে পছন্দ করে নাকি কারো সাথে সম্পর্ক ছিল।
কিছুই ভাবতে পারছি না।মাথাটা প্রচুর ব্যাথা করছে। রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে বসে আছি। আলভী রুমে এলো এবং ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে পড়লো।
আমি ভাবছি আলভীকে কিছু জিজ্ঞেস করব কি না। যদি রেগে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে একসময় আলভী নিজেই বলে উঠলো,
– তুমিতো রংপুর এই ভর্তি কোচিং করছ তাই না?
– হ্যাঁ
– ক্লাস তোঁ চলছে।পরশু থেকে ক্লাস শুরু করে দেও। এসব ফালতু অনুষ্ঠান এর জন্য পড়াশুনার ক্ষতি করার দরকার নেই।
আমি আলভীর কথা শুনে কি বলবো বুঝতে পারছি না। এই লোকের হাবভাব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
কিছুক্ষণ এভাবে যাওয়ার পর আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল?
– হুম বলো
– আপনি কি কারো সাথে রিলেশন করেন?
আমার প্রশ্ন শুনে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি কোন অনৈতিক প্রশ্ন করে ফেলেছি। কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর আবার ল্যাপটপ এর দিকে মনযোগ দিলো। আমি চুপ করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাড়িয়ে ভোরের আকাশ দেখছিলাম।
রুম থেকে ফোনের রিংটোন এর আওয়াজ আসছে।
আমি রুমে গিয়ে দেখি আলভী তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে বাইরে চলে গেলো।
ব্যাপারটা কিছুটা হলেও আমার কাছে কেমন অদ্ভুত ঠেকল।
আমি কিছু না বলে নিচে চলে গেলাম মায়ের কাছে।
মা কে সাহায্য করার জন্য। কালকে মায়ের বলা চিঠির কথা ভাবছি। কিসের চিঠির কথা বললেন মা।
সবার সাথে নাস্তা করে রুমে এলাম।
নাহ এই চিঠি দেখছি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না।
এই চিঠির কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই চিঠির বিষয়ে জানতে পারবো না মনের ভিতরে একটা অস্বস্তি কাজ করবে।
কাউকে জিজ্ঞেস করবো সেই উপায় নেই। মাকে জিজ্ঞেস করাটা কেমন দেখায়।
কিন্তু আমি এই বিষয়টাকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছি কেন?
আমি কি ওই লোকটাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি নাকি, নাকি এখন কারো স্ত্রী হওয়ায় স্বভাবতই এমনটা লাগছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
দুপুরে খাওয়ার পর আমার লাগেজ থেকে কাপড় বের করে আলমারি তে রাখছিলাম তখনি কোথা থেকে আলভী এসে বলল,
– এই মেয়ে করছ কি?
– কি করছি দেখতে পাচ্ছেন না!
– তুমি এখানে তোমার কাপড় রাখতে পারবা না।
– কিহ! মানেটা কি হু? কাপড় রাখতে পারবো না কেন?
– যাও যাও অন্য জায়গায় রাখো।
– অন্য জায়গায় কোথায়, আপনার মাথায় রাখবো নাকি, অসহ্য।
– এতো কিছু জানি না তুমি এখানে কাপড় রাখতে পারবা না ব্যাস।
– এই আপনার কি গায়ে পরে ঝগড়া করার অভ্যাস আছে নাকি?
– কি বললা আমি ঝগড়ুটে?
– নাহ! এখনো বলি নি। আপনি নিজেই নিজের গুণ বলে দিলেন। আর শুনুন আমার পুরো অধিকার আছে এখানে কাপড় রাখার। লিগেল অধিকার।
আর কিছু না বলে আলভী দাত কটমট করে আলমারি থেকে একটা বক্স বের করে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
অদ্ভুত লোক একটা। কখন কি বলে তা হয়ত নিজেও জানে না।
আমিও কিছু না ভেবে কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখলাম।
রাতে খাওয়া শেষ করে রুমের দিকে যাওয়ার পথে দেখলাম স্টোর রুমের দরজা খোলা এবং ভিতরে আলো জ্বলছে। আমি একটু এগুতেই দেখি আলভী কি যেন করছে অপর পাশে মুখ ঘুরিয়ে।
আমি সেখান থেকে রুমে চলে আসি। পরেরদিন থেকে নিয়ম করে পড়াশুনা চালু করি, কোচিং এ যাওয়া আসা পড়াশুনার চাপে চিঠির কথা প্রায় ভুলেই গেছি।
রুমের মধ্যে বসে পড়ছিলাম।
হঠাৎ মায়ের ডাকে নিচে গেলাম।
নিচে গিয়ে দেখি ডায়নিং রুম এ সোফায় কেউ একজন বসে আছে। মাথাটা ঘুরতেই দেখি
– সাদিক ভাইয়া তুমি?
– অর্থী, তুই এখানে। আলভী তোকে বিয়ে করেছে।
মা বলল,
– হ্যা, এটাই হচ্ছে আমার বৌমা। আর অর্থী এ হচ্ছে আলভীর সবচেয়ে কাছের ও প্রিয় বন্ধু সাদিক। বিয়েতে আসতে পারে নি।
গল্পে গল্পে সাদিক ভাইয়া বলল,
– আলভীর মাথা থেকে তাহলে চিঠির ভুতটা নেমেছে।
– চিঠি!!!
– আর বলিস না, সেসময় আলভীর উপন্যাস গল্পের বই পড়ার খুব নেশা ছিলো। সেই সুবাদে লাইব্রেরি ছিলো তার প্রিয় জায়গা। আমাকেও টেনে হিচরে নিয়ে যেত। তখন সে হিমু সিরিজের গল্প পড়ছিল। কোন এক বইয়ে সে একটা খাম পায় হলুদ খাম যার ভিতরে চিরকুট। জানিনা কোন পাগল মেয়ে আবেগে উপন্যাস এর নায়িকা রুপা হওয়ার চেষ্টা করেছিলো কে জানে। আর সেই চিঠি আলভীকে এতটাই মুগ্ধ করেছিলো যে সে প্রেমেই পড়ে গেলো সেই চিঠির। আর সেই মেয়েকে খুঁজতে লাগে।
– আচ্ছা সাদিক ভাইয়া কোথাকার লাইব্রেরি এটা?
– আমাদের কলেজের লাইব্রেরি
– কোন কলেজ?
– রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।
আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না। তড়িঘড়ি করে রুমে গিয়ে আলমারি ঘাটলাম। না এখানে কিছুই নেই। তারপর হঠাৎ করে সেই বক্স এর কথা মনে পড়লো। যেটা সেদিন আলভী আলমারি থেকে বের করে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কোথায় রাখতে পারে বক্সটা ভাবতে ভাবতে স্টোর রুম এর কথা মনে পড়লো।
এক দৌড়ে স্টোর রুম এ গেলাম।

স্টোর রুমে গিয়ে একটি ভাঙা আলমারির ভিতর বক্সটি পেলাম। বক্সটি খুলতেই হলুদ খামটি চোখে পড়লো। মনে হচ্ছে খুব সযত্নে রেখে দেওয়া হয়েছে খামটি। সরষে ফুলের মতো খামটিও যেন প্রাণবন্ত হয়ে আছে।
খামটি খুলতেই বেড়িয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত চিঠি। বক্সটিকে সেই জায়গায় রেখে দিয়ে খামটা নিজের কাছে রেখে দিলাম।
আলভী সারাদিন বাসায় ফিরে নি।
সন্ধার দিকে বাসায় ফিরল। তাকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আমার সাথে খুব ভালোভাবে কথা বলছে। রাতের খাবার শেষ করে রুমে এলাম। আলভী এখনো রুমে আসে নি। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সেই চিঠির কথা ভাবছি। হঠাৎ করে নিচ থেকে আলভীর গলার আওয়াজ পেলাম। মা’ মা’ বলে চিৎকার করছে।
কি ব্যাপার হঠাৎ করে এভাবে চিৎকার করছে কেন। আমি রুম থেকে বেড়িয়ে দেখি আলভী স্টোর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে চিৎকার করছে।
কিছুক্ষণ পর দ্রুত পায়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। আমিও আলভীরর পিছন পিছন রুমে আসলাম। দেখি আলভী আলমারির কাপড় জিনিষ সবকিছু ওলটপালট করছে।
– এসব কি করছেন কি আপনি?
আলভী আমার কথার উত্তর না দিয়ে আলমারিরর কাপড় সব বের করতে লাগলো।
– আপনি কি কিছু খুজছেন?
প্রশ্নের কোন উত্তর না পেয়ে হাতের মধ্যে সেই হলুদ খামটা নিয়ে আলভীর পাশে দাঁড়িয়ে বললাম
– আপনি কি এটা খুঁজছেন?
আলভী আমার কথায় আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতে খামটি দেখতে পেয়ে একঝটকায় হাত থেকে নিয়ে নিলো যেন খুব মুল্যবান কিছু খুঁজে পেয়েছেন। তার কিছুক্ষণ পর কিছুটা রেগে বলল,
– কোথায় পেলে তুমি এটা?
– স্টোররুম এ
– তোমার সাহস কি করে হয় আমার পারসোনাল জিনিষ এ হাত দেওয়ার
– আসলে আমি……..
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,
– কোন অধিকারে তুমি এটা হাতে নিয়েছো বলো।
– আমি আপনার স্ত্রী। আপনার সবকিছুতে আমার অধিকার আছে।
– না,কোন অধিকার নেই তোমার।আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মানি না। খবরদার আর কখনো আমার পারসোনাল জিনিশ এ হাত দেবে না।
এটা বলেই আলভী বাইরে চলে যেতে লাগলো
– তাহলে কেন বিয়ে করেছেন আমাকে। স্ত্রীর মর্যাদা যদি দিতে নাই বা পারবেন তাহলে কেন বিয়ে করেছেন। কি আছে এই চিঠিতে যার জন্য এমন করছেন।
– সেই কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই
– আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। আইনত আমার পুরো অধিকার আছে কৈফিয়ত নেওয়ার।
আলভী হয়ত আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু সেই মুহূর্তে তার ফোন আসায় সে বেরিয়ে গেলো।
আমি নির্বাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি।
(চলবে)

.
লেখা- ইশিতা মানহা ইচ্ছে
+মেঘলা রহমান মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here