বৃষ্টি থামার শেষে পর্ব -০৬

#বৃষ্টি থামার শেষে
#পর্ব-৬

“স্যরি স্যরি অনেক বেশী অপেক্ষা করালাম তোমায়”!

তূর্য স্মিত হেসে বলল, কফি দিতে বলি?”

“ইয়া শিওর। তারপর বলো লাদাখ কেমন লাগছে”

“ভালো লাগছে বলেই না বারবার ছুটে আসি”!

“আর লাদাখের লোকজন! ”

তূর্য আড়চোখে সিন্থিকে দেখলো। সিন্থি মিটিমিটি হাসছে। গায়ের পশমী জ্যাকেট আর ব্রাউন কালারের টুপিতে বেশ লাগছে দেখতে। শেষ বিকেলের কন্যাকুমারী আলোটা মুখে যেন ঝলমল করছে। কানের পাশের কয়েক গোছা চুল বেরিয়ে আসছে। দেখতে ভালো লাগছে।

“কী হলো প্রেমে পড়ে গেলে নাকি”?

তূর্য শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, তোমাকে দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে।

সিন্থি ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থ্যাংকস ফর ইউর কমপ্লিমেন্ট। তুমি কলকাতা কবে ফিরবে?

“কাল ই”।

“এবার তোমার সাথে আমিও যাব ভাবছি”।

“আচ্ছা”।

সিন্থিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভেবেছিল ওর যাওয়ার কথা শুনে তূর্য খুশি হবে।

তূর্য বলল, আমি কিন্তু খুশি তুমি যাবে বলে!”

“আচ্ছা”।

তূর্য হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, তুমি আমার বন্ধু সিন্থিয়া। বন্ধুদের প্রেমে পড়া উচিত না। প্রেম হলে বন্ধুত্বটা থাকে না।

সিন্থি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আচ্ছা।

“চলো তাহলে ওঠা যাক। আমার কিছু কাজ আছে।

গাড়িতে বসে সিন্থিয়া জিজ্ঞেস করলো, তূর্য তুমি কী কোনোদিন বিয়ে করবে না?

“করব না কেন?”

“আমার মনে হলো তুমি বিয়েশাদি করতে চাচ্ছ না।

“সেরকম কিছু না। আসলে এই লাইফ টা আমি ভীষণ রকম এনজয় করছি। যখন মনে হবে এবার নীড়ে ফেরা দরকার তখন ই একদিন বিয়ে করে ফেলব হুট করে”।

সিন্থিয়া চুপ করে বসে রইলো। মোবাইলে কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।

তূর্য সিন্থির ভাবগতিক টের পেয়ে বলল, তোমার কী মন খারাপ?

“হ্যাঁ ”

“কেন?”

“কারন টা বলতে চাচ্ছি না”

“মন খারাপের কারন কী কোনোভাবে আমি”?

“হ্যাঁ”।

তূর্য হেসে ফেলল। বলল, তোমার এই স্ট্রেইটফরোয়ার্ড স্বভাবের জন্য তোমাকে আমার এতো পছন্দ!

সিন্থিয়া আবারও চুপ করে রইলো। এখনো অনেক টা রাস্তা বাকী রিসোর্টে পৌছানোর। গম্ভীর পরিবেশ হালকা করার জন্য তূর্য বলল, তুমি কলকাতায় কেন যেতে চাচ্ছ?

“বর্ধমানে একটা ডকুমেন্টারির কাজ আছে”।

“আমি ভাবলাম আমার জন্য যাচ্ছ”।

কথাটা বলে তূর্য মুখটিপে হাসলো।

সিন্থিয়া খিলখিল করে হেসে উঠলো।

তূর্য রিসোর্টে ফিরে কিছুক্ষন ঘুমালো। ঘুম থেকে উঠে দেখলো সিন্থি ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ম্যাসেজ টা ওপেন করে আপনমনে হেসে ফেলল।
তূর্যর সাথে সিন্থিয়ার আলাপ হয়েছিল বছর দেড়েক আগে লাদাখেই। ফূর্তিবাজ তূর্য তখন অনেক টা গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়, ফটোগ্রাফি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কারও সাথে যেচে বন্ধুত্ব করেনা। সিন্থিয়ার সাথে আলাপ হলো বাঙালি বলে। স্বপ্নবাজ, সুন্দরী তরুনী খুব দ্রুত ই তূর্যর প্রেমে পড়ে গেল। আর দশটা মেয়ের মতো প্রেমে পড়ে সেটাকে নিজের মনে চেপে রাখলো না। তূর্য কে একদিন এসএমএস করে জানালো, আই এম ইন লাভ উইথ ইউ।
তূর্য সরাসরি রিজেক্ট করলেও এই ব্যাপার টা সিন্থি পজিটিভলি নিয়ে আর জানতে চাইলো না কারন টা কী!
এরপর থেকে দুজনের চ্যাট হতো, কথা হতো, এমনকি লাদাখে এসেও দুজনে অনেক টা সময় একসাথে কাটিয়েছে।

তূর্যর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটা সম্পর্কে জড়াতে। তারপর আবার ভাবে কী দরকার আবারও কারোর কষ্ট কিংবা উপেক্ষার কারন হওয়ার।
তারচেয়ে এখন যেমন আছে তেমন ই থাকুক।

———- ———- ———- ———- ——-

ইশা আজ শাড়ি পরে বেরিয়েছে। আর আজ ই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। অর্ধেক ভেজা শাড়ি পরেই অফিসে এসেছে আজ। কম্পিউটারের সামনে বসে আজও দুটো নাম অনলাইনে সার্চ করলো। এমনটাই চলছে আজকাল। সকালের শুরু টা’ই হয় দুজন মানুষের নাম জপে। একগাদা ফাইল নিয়ে বসের রুমে পা বাড়ালো ইশা, আজ হাফবেলার ছুটি দরকার।

অফিসের বস ভদ্রলোক অবিবাহিত। কোনো এক বিচিত্র কারনে সে ইশা কে পছন্দ করেন না। ভদ্রলোকের নাম শিহাব। শিহাব ইশাকে দেখেই বলল, একে তো দেরি করে এসেছেন আবার হাফবেলার ছুটিও চান?

ইশা আমতা আমতা করে বলল, আমার ছুটির আজ ভীষণ দরকার স্যার।

“দেখুন মিস ইশা। অফিস তো আর আপনার নিয়মে চলে না যে আপনার যখন ইচ্ছে তখন আসবেন আবার যখন ইচ্ছে হবে চলে যাবেন।

ইশা কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। মন টা খারাপ হয়ে গেল। আজ অনির জন্মদিন। শাড়িও পড়েছে আজ সেজন্য। অফিস শেষ করে যেতে যেতে তো রাত হয়ে যাবে তাই ছুটি চেয়েছিল।
কোনোকিছু না ভেবে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল ইশা। বাইরে তখন ঝুমঝুম বৃষ্টি পড়ছে। ভিজতে ভিজতে সিএনজি তে উঠে পড়ল। তূর্য কী আজ ও একবার ফোন করবে না! এখনো অভিমান করে থাকবে! নাকি তূর্য ভুলে গেছে যে ইশা নামে কেউ একজন ছিলো।

“ও রুপু আজ একটু খিচুড়ি করবি? ইলিশ ভাজাও?” অনিটা খেতে পছন্দ করতো।

“অনিকে কোথায় পাবে মা”?

সুরাইয়ার উচ্ছাস টা নিভে গেল। বলল, ধুর! বৃষ্টি দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অনিটা যে নেই সেটা মনেও থাকে না।

রুপা কোনো উত্তর দিলো না। একমনে তরকারি কেটে যাচ্ছে। সুরাইয়া রান্নাঘরের চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছে।

” তুমি কী একটু চা খাবে মা”?

“না। তোর বাবাকে দিতে পারিস”।

“বাবাকে ডাক্তার চা দিতে বারন করেছে”।

“ডাক্তারের কথা এতো শুনতে হবে না। মানুষ টা বেঁচে থাকবে ক’দিন!”

হঠাৎ খেয়াল করলো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা মেয়ে আসছে। মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দেয়া। সুরাইয়া মুগ্ধ গলায় বলল, অনির জন্য এমন একটা মেয়ে দরকার ছিলো।
রুপা উঁকি দিয়ে ইশাকে দেখে বলল, তোমার ছেলে এই মেয়েটাকে ই বউ বানাতে চেয়েছিল মা।

সুরাইয়া বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রুপা বলল,

“ওটা ইশা মা”।

সুরাইয়া বিস্মিত গলায় বলল, এই বর্ষা বাদলে এতোদূর ছুটে এসেছে কেন!

“আজ তোমার ছেলের জন্মদিন মা”।

সুরাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বয়স হয়ে গেছে বলে ছেলেমেয়ের জন্মদিন ও মনে রাখতে পারি না”।

ততক্ষণে ইশা দরজায় খট খট আওয়াজ করলো। সুরাইয়া দরজা খুলে বলল, এতো বৃষ্টির মধ্যে আসতে গেলে কেন?

ইশা স্মিত হেসে বলল, আন্টি কেমন আছ?

সুরাইয়া জবাব দিলো না। ভিতরের ঘরে চলে গেল। রুপা এলো সাথে সাথে। এক কাপ আদা চা হাতে দিয়ে বলল, তোকে আসতে বারন করার পর ও কেন আসিস বলতো?

ইশা জবাব না দিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। চায়ে চুমুক দেয়ার সাথে সাথে মন টা ভালো হয়ে গেল। এতো জার্নি, অফিসের টেনশন সব ভুলে গেল।
রুপা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ভাত, ডাল, রান্না হচ্ছে। মাছের তরকারি টা হলে ভাত খেয়ে বিদেয় হ।

ইশা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, আজকে ভালো মন্দ কিছু রান্না করলে না যে!

“কার জন্য করব! যার জন্মদিন সে কী আছে এখানে!

ইশার মুখ টা মলিন হয়ে গেল। রুপা খেয়াল করলো। বলল, ইশা তুই তো জানিস যেকারনে তুই এসেছিস সেটা হবে না।

“আমি একবার ওর কন্ঠস্বর শুনে তারপর যাব”।

“সেটা কোনোভাবে যে সম্ভব না সেটা তুই জানিস কিন্তু!”

“একটু সম্ভব করে দাও”।

“না। অনি কিন্তু বারবার বলেছে যে ওর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ না করতে”। তুই তারপর ও যে আসিস লজ্জা করে না?

ইশা একমুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে যায়।

বৃষ্টির পানিতে চোখের জল ধুয়ে যাচ্ছে। এটার একটা সুবিধা হলো কেউ জানতে পারছে না যে ইশা কাঁদছে। তূর্যর অভিমানের কারন তাও জানা। কিন্তু অনিক! অনিক কেন এভাবে দূরে দূরে আছে! ইশা আজও ভেবে পায় না। সময় পেলেই উত্তর খুঁজে বেড়ায় কিন্তু কোনো উত্তর মেলে না।

এক বিকেলে অনি একটা সাদা খাতা পাঠিয়ে দুটো লাইন লিখেছিল। যেখানে লেখা ছিলো, ইশা যদি আমায় ভালোবেসে থাকিস তবে আর কোনোদিন খুঁজবি না আমাকে। যেভাবে পারিস তূর্যকে খুঁজে বের করে ওকে বিয়ে করবি। তুই আমাকে না, তুই ভালোবাসিস তূর্যকে।

এরপর আর অনির কোনো দেখা মেলে নি ইশার। না দেখা আর না কোনো কথা।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here