বেলা_শেষে_ফেরা পর্ব ৪+৫

#বেলা_শেষে_ফেরা

#পর্ব_৪

#Writer_ Suchona Islam

তূর্ণা আজ নিজের চোখে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জুড়িয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতির এ বিলাস যেন তূর্ণার শেষ’ই হচ্ছে না। বাস থেমেছে বিকেলে। প্রফেসর’রা একটা হোটেল বুক করে নিয়েছে ছেলে-মেয়েদের জন্যে, তাই সবাই একই হোটেলে দু’জনে একসাথে থাকবে বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন সবাই’কে। তূর্ণা আর মুনিয়া তো খুব খুশি, কারণ তারা একই রুমে একসাথে থাকবে। সবাই’ই যে যার মতো রুমে গিয়ে রেস্ট করছে। প্রায় ৯ ঘন্টা জার্নি’র পরে বান্দরবানে পৌঁছায় সকলে। সকলেই খুবই ক্লান্ত, তাই এখন বিশ্রাম নিচ্ছে।

রাতে সকলে’ই হোটেলে’র বাগানে উপস্থিত হয়েছে। সেখানে কেউ কেউ আড্ডা-গল্পে, নাচ-গানে, খেলাধুলায় মেতে আছে। তূর্ণার কাছে এমন দৃশ্য নতুন। সে কখনোই ভ্রমণ করেনি তাই। শুধুই নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছে নারায়ণগঞ্জে, দাদা-দাদী নেই তার। চোখ বুলিয়ে রাতের হোটেলের সৌন্দর্য এবং সকলে’র আনাগোনা তাকে মোহিত করে তুলেছে। তূর্ণা আজ খুবই খুশি এই বনভোজনে এসে।

তূর্ণা একা একটা বড় গাছের নিচে বসে আছে। কারণ মুনিয়া’টা তাকে রেখে একটু রুমে গিয়েছে। সে নাকি ফোনটা ভুল করে রেখে এসেছে রুমে তাই মুনিয়া এখন রুমেই আছে। কিন্তু তূর্ণা তো জানে মুনিয়া এখন তার বিএফের সাথে আছে। ছয় মাস হলো সম্পর্কে জড়িয়েছে মুনিয়া আর আসাদ। আসাদ, তূর্ণা আর মুনিয়াদের ডিপার্টমেন্টে’রই ছাত্র। আর ওরা তিনজনে’ই সমবয়সী। এখন মুনিয়া ও আসাদ হয়তো কোনো এক গাছের আবডালের নিচে বসে চুটিয়ে প্রেম করছে। তাতে তূর্ণার মাথা ব্যথা নেই সে নিজের মতো করে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে হোটেল’টা। হাটতে হাটতে তূর্ণা থমকে যায়। হঠাৎ খুবই সুরেলা একটি পুরুষালো কণ্ঠে কারো গান ভেসে আসা’য় তূর্ণা নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে সেখানে ছুট লাগায়।

“টাপুর টুপুর বৃষ্টি নুপুর
জল ছবিরই গায়,
তুই যে আমার একলা আকাশ
মেঠো সুরের ছায়, রে
মেঠো সুরের ছায়।

রং-বেরঙ এর বেলোয়ারী
সাতরঙা রং মুখ,
তোর মুখেতেই লুকিয়ে আছে
জীবন ভরের সুখ, রে
জীবন ভরের সুখ।

যখন শিমুল পলাশ ঝরবে পথে
দুলবে হাওয়া বুকে,
থাকবো দু’জন দু’জনাতে
শপথ নিয়ে সুখে।
শিমুল পলাশ ঝরবে পথে
দুলবে হাওয়া বুকে,
থাকবো দু’জন দু’জনাতে
শপথ নিয়ে সুখে।
গাইবো তোরই দৃষ্টিপানে এক সুরেরই গান।

টাপুর টুপুর বৃষ্টি নুপুর
জল ছবিরই গায়,
তুই যে আমার একলা আকাশ
মেঠো সুরের ছায়, রে
মেঠো সুরের ছায়।

কেমন করে এমন হলো
যা হতো না আগে,
ছলাৎ ছলাৎ বুকের মাঝে
কোন এক নদী জাগে।
কেমন করে এমন হলো
যা হতো না আগে,
ছলাৎ ছলাৎ বুকের মাঝে
কোন এক নদী জাগে।

বলি ও সজনী…
বলি ও সজনী তোর হাতে যে
আমার জীবনটাই।

টাপুর টুপুর বৃষ্টি নুপুর
জল ছবিরই গায়,
তুই যে আমার একলা আকাশ
মেঠো সুরের ছায়, রে
মেঠো সুরের ছায়।”

তন্ময়ের এমন সুরেলা কণ্ঠ শুনে তূর্ণার ঘোর লেগে গিয়েছে। তূর্ণার মন বারবার চাইছে, গানটা যেন না থামে। সে এই গানের রাজ্যে’ই হারাতে প্রস্তুত। তূর্ণা এবার তন্ময়’কে পর্যবেক্ষন করছে। তন্ময় একটি কালো টি-শার্ট পরে আছে। হাতে কালো একটি ঘড়ি, কালো স্নিকার পরে আছে, সিল্ক চুলগুলো’য় হাল্কা জেল দেওয়া। তন্ময়ের মুখশ্রী দেখার মতো। সুদর্শন যুবক তন্ময়। তার উপর সবচেয়ে বেশি আর্কষনীয় তন্ময়ের নয়ন। সেই চোখে তূর্ণার ডুব দিতে ইচ্ছে করছে। তন্ময়কে দেখে’ও এবার তূর্ণার ঘোর লেগে গেলো, তাকিয়ে আছে আনমনে তন্ময়ের দিকে।

সাদা ড্রেস পরিহিত একটি মেয়েকে দেখে তন্ময়ের যেন হৃদ স্পন্দন থমকে গিয়েছে। এমন আশ্চর্য একটি মেয়েকে সে আগে কখনোই দেখে নি। তন্ময়ের ইচ্ছে করছিলো সেই মেয়েটি’কে নিজের কাছে বসিয়ে তাকে প্রাণভরে দেখতে। কি সুন্দর’টাই না মেয়েটি। তন্ময়ের তো কোনো মেয়ে’কেই ভাল লাগে না। সবার সাথে হাসিভাব থাকলে’ও কোনো মেয়েকে নিয়ে তন্ময় ভাবে নি কখনোই সেভাবে। কিন্তু আজ এই মেয়েটার মুখশ্রী তন্ময়কে অন্য জগৎ-এ নিয়ে গিয়েছে। দু’জনেরই ঘোর লাগা কাজ করছে। দু’জনেই মুগ্ধ চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ!

তূর্ণার নিজস্ব তখনো কোনো ফোন ছিলো না তাই তূর্ণার মা শ্রাবণী মেয়ের খোঁজখবর নিতে মুনিয়াকে ফোন করেছিলো। আচমকা মুনিয়া তো ভয়ে শেষ। কারণ মুনিয়া তখন মিথ্যা বলেছিলো শ্রাবণী তালুকদার’কে। বলেছে তূর্ণা ওয়াশরুমে আছে এবং তারা তূর্ণা আসলেই নিচে সবার সাথে থাকবে বলেছে। এখন তো মুনিয়া বিপাকে পরে গেলো। তূর্ণা হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেলো কোথায়। মুনিয়ার হাত-পা’য়ের কাঁপুনি দেখে আসাদ তো চমকে গিয়েছে। দু’জনেই এবার তূর্ণাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।

“ছাগলের ঘাসের বাচ্চা! তোর জন্যে আমার জীবন তো শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমি আন্টিকে কি জবাব দিতাম যে তুই ঘুরতে এসে হাওয়া হয়ে গিয়েছিস। তোকে না আমি বলেছি তুই গাছের অবস্থান থেকে সরবি না। তবুও তুই হাওয়া হয়েছিস। তোর মতো হারামী তো থাকবেই আমার মতো নিষ্পাপ মেয়ের জীবন তছনছ করে দিতে। শাঁকচুন্নি!” রাগী গলায় তূর্ণাকে কথাগুলো শুনিয়ে যাচ্ছে মুনিয়া। কারণ তখন ওরা আশেপাশের কোথাও তূর্ণাকে না পেয়ে মুনিয়া কেঁদে দিয়েছিলো। সকলেই মুনিয়ার দিকে কেমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে, সেদিকে তার হদিস নেই সে তো কান্না করছেই থামছে না। ঘোরের জগৎ থেকে বেড়িয়ে কারো বিড়ালের মতো কান্নার আওয়াজ শুনে তূর্ণা পিছন ফিরে তাকালে মুনিয়াকে কান্না করতে দেখে। তারপর মুনিয়ার কাছে ফিরে যায় তূর্ণা।
“এই মিয়াও! তুই কাকে কি বলছিস। তুই যে গাছের তলায় বসে বসে প্রেম করছিস তা তো আমার অজানা নয়। জীবনের প্রথম ট্যুর এটা আমার। তাই তো হোটেলটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। কিন্তু তোর বিড়ালের মতো কান্নার আওয়াজ শুনে আমার ভালোলাগা সব নিমিষেই ঘি এর মতো গলে গেলো। তুই-ই সব নষ্টের গোড়া আমার কিছু যায় আসে না। হুহ!” তূর্ণাও এবার আগলা রাগ দেখিয়ে মুনিয়ার ভুল ধরিয়ে দেয়। এতোক্ষনে মুনিয়ার ভুল মুনিয়া উপলদ্ধি করতে পেরেছে। তূর্ণা আর মুনিয়ার চোখাচোখি হতে মিনিট দু’য়েক পরে দু’জনেই জোরে হেসে দেয়, সেই হাসিতে আসাদও যুক্ত হয়।

তূর্ণা আর মুনিয়া দু’জনেই অদ্ভুত পাগল। তূর্ণা মুনিয়াকে “মিয়াও বা বিড়াল” বলবেই। তেমনই মুনিয়াও তূর্ণাকে “ছাগলের ঘাস” বলে ডাকবেই। সে মনে করে তূর্ণা মানে ঘাস, কিন্তু ছাগলটা তারই যুক্ত করা অংশ বিশেষ। আর এইজন্যই তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন টা খুব দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ।

………………………
বান্দরবান থেকে দেবতাখুমে পৌঁছতে প্রায় ২ ঘন্টার মতো সময় লেগেছে। সকালে সবাই রওনা হয়েছিলো দেবতাখুমের উদ্দেশ্যে আর পৌঁছে’ছে ২ ঘন্টা বাদে। সব ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রফেসর’রা পারছিলেন না তাই একটু দেড়ি হয়েছে।

“দেবতাখুম” বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গা। এখানে দুইপাশে উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে স্বচ্ছ পানি প্রবাহিত হতে থাকে। এটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। দেবতাখুম বান্দরবান জেলার “রোয়াংছড়ি” উপজেলায় অবস্থিত। বান্দরবানের স্থানীয়দের মতে এটি প্রায় ৫০ ফুট গভীর এবং প্রায় ৬০০ ফুট দীর্ঘ। এর কাছেই শীলবাঁধা ঝরনা। এই খুমের দুইপাশে রয়েছে বিশাল জঙ্গল। খাড়া পাহাড়ের কারণে খুমের ভিতর সরাসরি সূর্যের আলো পৌঁছায় না। তাই খুমের যত ভিতরে যাওয়া যায়, তত’ই শীতল মনে হয়। জায়গাটি খুব শান্ত এবং কোলাহলমুক্ত। এর পানিও বেশ স্বচ্ছ। বাঁশের ভেলায় চেপে এই খুমের ভিতর যাওয়া পর্যটকদেরকে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেয়।

সকলেই শীলবাঁধা ঝরনা’য় উপস্থিত। কেউ তো পানি দেখে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে, কেউ গোসল করছে আবার কেউ ঝরনার সাথে ছবি তোলায় ব্যস্ত। তূর্ণা সাতার জানে না। তাই পানির থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে আছে। এমন স্বচ্ছ পানি দেখে তার একটু ভয়’ও লাগছে। মুনিয়া তূর্ণাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে ঝরনার পাশে গিয়ে আসাদকে নিয়ে ছবি তুলতে গিয়েছে। পর্যটনদের আজ আনাগোনা একটু বেশিই লাগছে। একে তো পিচ্ছল জায়গায়, তার উপর মানুষের চলাচল তাকে একটু অস্বাভাবিক করেছে। কেউ বলছে একটু সরে দাঁড়াতে তো কেউ বলছে এখানে দাড়িয়ে না থাকতে। একসময় তূর্ণা সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হঠাৎ’ই পা পিছলে যাওয়ায় পানির মধ্যে পড়ে গিয়েছে। “বাচাও! বাচাও!” বলে চিৎকার করছে আর পানির অতল গহ্বর ডুবে যাচ্ছে। চিৎকার শুনে সকলের নজর যায় তূর্ণার দিকে। মুনিয়া তূর্ণার পানিতে পড়ে যাওয়া দেখে সে’ও চিৎকার করে উঠলো। সেদিকে পানির পরিমান একটু গভীরতা থাকায় কারো’রই সাহস হচ্ছে না তূর্ণাকে উদ্ধার করতে। মুনিয়া তো পাগল প্রায়। সব তারই দোষ, এতটা কেয়ারলেস মেয়ে সে। তূর্ণার বাবা-মা’কে কি জবাব দিবে যদি তূর্ণার কিছু হয়ে যায়। সে নিজেও তো নিজেকে কখনোই ক্ষমা করবে না।

তন্ময় তূর্ণার চিৎকার শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তার মনে হচ্ছে সে কিছু হারিয়ে ফেলবে। তাই কোনো দিক-বিদিক না ভেবেই পানিতে ঝাপ দেয় তন্ময়। সে এই অপরিচিতা মেয়েকে হারাতে চায় না।

তূর্ণাকে নিয়ে একটি উঁচু ঢিলায় রেখে তন্ময় তূর্ণার খাওয়া পানি বের করছে। আসলে হুশ না থাকলে মানুষ নিজেকে পাগল মনে করে। আর সেটা যদি হয় প্রিয় জিনিস তাহলে তো কথাই নেই। তন্ময়ের’ও একই অবস্থা এখন। তূর্ণার পেটে অনেক পানি জমা হয়ে গিয়েছে। বেশি পানি খাওয়ার ফলে আর ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে তূর্ণা। পেটে বারবার পুশ করে পানি বের করছে তন্ময় তূর্ণার থেকে। আকাশী রঙের একটি গাউন পরে ছিলো তূর্ণা, তন্ময় যখন টেনে হিচড়ে তূর্ণাকে উঠাচ্ছিলো তখন তা একটু ফেঁটে যায়। কারণ পানিতে শরীর ফুলে যায় তাই একজন মানুষকে ধরতেই হিমসিম খেতে হয়।
তূর্ণার জ্ঞান ফিরেছে। পাশে মুনিয়া তূর্ণাকে ধরে সরি বলে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। প্রফেসর’রা তো তন্ময়ের এমন সাহসিকতা দেখে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সকলেই এবার হোটেলে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেননা, এমন ঘটনা আর কারো সাথে হলে বিপদ ভেবে প্রফেসর’রা সবাইকে নিয়ে রওনা দিলো।

……………………

রাত ১২টা বেজে ৩০ মিনিট। সকলেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। কারণ তারা দু’দিনের ট্রিপে এসেছিলো বান্দরবানে। এখন তাদের চলে যাওয়ার পালা। তূর্ণার বেশ মন খারাপ। সে ঠিক মতো ট্রিপ’টা এনজয়’ও করতে পারলো না আবার তন্ময়কে থ্যাংকস বলতে পারেনি। কারণ তখন তার শরীর দূর্বল থাকায় তাকে কিভাবে কিভাবে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটারই খেয়াল নেই। তাই তূর্ণার মন একটু বেশিই খারাপ। মুনিয়া তো সরি বলতে বলতে মুখ থেকে থুথু’র বুলবুলি বের করে ফেলেছে তারপরও সরি বলা থামাচ্ছে না বলে বিরক্ত লাগছে তূর্ণার। মুনিয়ায় ভাবনা তার জন্যেই এমনটা হয়েছে, সে কেয়ারলেস একটা বান্ধুবী আরও কতো কি!

তূর্ণার বারবার বুঝানোর পরেও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। মুনিয়ার মুখ এখন অটো হয়ে গিয়েছে। শরীর’টাতেও কেমন ম্যাজমেজে ভাব চলে এসেছে এবং মুনিয়ার পকপকের কারণে তূর্ণার ঘুম চলে এসেছে।
তূর্ণার সাথে কি তন্ময়ের আর দেখা হবে ভাবতেই তূর্ণার খারাপ লাগা কাজ করছে। থ্যাংকস কি তন্ময়কে তূর্ণা বলতে পারবে না। ভাবতেই কি কষ্ট’টাই না লাগছে তূর্ণার। কিন্তু কেনো এমন লাগছে, কেনো?
#বেলা_শেষে_ফেরা

#পর্ব_৫

#লেখনীতে_Suchona_Islam

পরদিন তূর্ণার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল ১০ টা বেজে যায়। বাসায় এসেই সকালের নাস্তা করে নিয়ে বিছানায় গা’টা এলিয়ে দেয়। তূর্ণার রুমে তার মা এসে পাশে বসলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, “এতো করে বললাম কেনো যে যেতে গেলি! এখন দেখছি বমি-টমি করে তোর অবস্থা খারাপ।”
“না মা! আমার জার্নি’র জন্যে বমি হয় নি। আর আমি তো বমি’ই করি না কোনো যানবাহনে। আসলে রাতে বসে বসে এসেছি তার-উপর ঠিক মতো ঘুম হয়নি বিড়াল’টার জ্বালায়। ও আমার কোলে ঢলেঢলে পরেছে। আর এখন কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিচ্ছি আমি। পরে যখন ঘুম থেকে উঠবো তখন আমি তোমাদের সেখানে’র সকল সৌন্দর্যের কথা বলবো, কেমন বান্দরবান, দেবতাখুমের রূপ!” তূর্ণা তার মা’কে মিথ্যা বললো। সে পানিতে পরে যাওয়ায় শরীর বেশ দূবর্ল অনেক, আবার রাতে’ও বাসে জার্নি’র জন্যে তার শরীর অনেক’টাই দূর্বল ও ক্লান্ত।
“আচ্ছা যাচ্ছি। তবে বেশি ঘুমাস না যেন। দিনে বেশি ঘুমালে কিন্ত শরীর আসড় হয়ে আসবে, তখন নড়তে’ও কষ্ট হবে।”
“আচ্ছা মা! আমি বেশি ঘুমাবো না। তবে এখন পিঠ’টা ব্যথা করছে যে। এবার কথা না বলে আমাকে একটু বিশ্রাম করতে দাও তো। খুব’ই খারাপ লাগছে মা!” একটু কাঁদো কাঁদো মুখ করে মা’কে কথাগুলো বলছে তূর্ণা। মেয়ের এমন মুখ দেখে মুচকি হেসে দিলেন শ্রাবণী।
“আচ্ছা যাই।” বলে’ই সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলেন শ্রাবণী তালুকদার।

তূর্ণার বেশ ক্লান্ত আর মন খারাপ থাকায় কিছু’ই ভালো লাগছিলো না। তন্ময়ের কথা ভাবতে ভাবতে’ই তূর্ণা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
তূর্ণা কেনো তন্ময়কে নিয়ে এতো ভাবছে। তা’ও আবার প্রথম দেখাতে’ই। এই অল্প সময়ের তন্ময়কে এতো আপন ভাবতে লাগলো কেনো তূর্ণা। নাকি তাকে বাঁচিয়েছে বলে হয়তো ধন্যবাদ না বলায় খারাপ লাগা’টা কাজ করছে। হয়তো তাই’ই হবে! ভাবতে ভাবতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো তূর্ণা।

……………………….

ঘুম থেকে ২ ঘন্টা পরে’ই উঠে গিয়েছে তূর্ণা। কারণ দিনে বেশি ঘুমানো সত্যিই ভালো না। শরীর বেশ ক্লান্ত করে তুলে এবং ঘুমু ঘুমু ভাব’টা থেকে’ই যায়। তূর্ণার এখন’ও ঘুমের রেশ’টা কাটে নি। বিছানাতে’ই ঢুলছে বসে বসে সে। এমনি সময় কেউ একজন তূর্ণার গলা জড়িয়ে ধরেছে।

হঠাৎ গলা জড়িয়ে ধরায় তূর্ণা তো চমকে যায়, তার সাথে ঘুমের রেশ’টাও তো কাটে নি তূর্ণার। পেছনের ব্যক্তি’টিকে সামনে আনতেই তার মন খুশিতে নেচে উঠলো।
“হুমমম! তাই তো বলি। কে এমন করে টুপ করে এসে ঝুপ করে আমার গলা’টা জড়িয়ে ধরলো। আমার কিউটি ভাইটা ছাড়া আর কে’ই বা হতে যাবে শুনি!” কোলে বসিয়ে রেখেছো তামিম’কে তূর্ণা। এখন তামিম ছোট্ট। এবার সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার দাঁত ইদূরের মতো ছোট ছোট। একটু গোলুমলু দেখতে, যেন কিউটের একটা ডিব্বা। ভাইয়ের হাসিতে তূর্ণা’ও মুচকি হাসলো।
“আপু জানো আজ কি হয়েচে (হয়েছে)। ইশতু (ইশতিয়াক) ভাইয়া আচে (আছ) না, সে এটটা (একটা) মেয়ের গালে চুমু দিয়েচে (দিয়েছে),। তাপপর (তারপর) মামা দেখে ফেলেচে (ফেলেছে)। এপপর (এরপর) ঝাঁটা দিতে সারা রাস্তায় দাবড়িয়েচে (দৌঁড়িয়েছে), হিহিহিহি।”

সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না তামিম, ছোট হওয়ায়। তবুও কয়েকটা শব্দ স্পষ্ট ভাবে বলতে পারে। আর যেগুলো স্পষ্ট না হবে তার বোন তো আছে’ই শিখিয়ে দেওয়ার জন্যে।
ভাইয়ের ছোট্ট দাঁত গুলোর হাসিটা দেখে, সে’ও হেসে দিলো। তারপর ভাইয়ের দু’গালে দু’টো চুমু খেয়ে নিলো। কতদিন হলো সে আজ ভাইকে কাছে পেয়েছে। কারণ তামিম তার নানু বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো। সেখানে ছোট্ট ছোট্ট মামাতো কাজিন’রা আছে। তামিম যার কথা তূর্ণাকে বললো, সে তূর্ণার বড় মামার ছেলে ইশতিয়াক। ইশতিয়াক অনেক দুষ্টু। এবার সে এস.এস.সি. দিবে। পড়ালেখা তো লাটে উঠেছে, তবুও তার দুষ্টুমি কম নেই।
“ও’টা দাবড়িয়ে হবে না, দৌঁড়ানো হবে বুঝেছিস টমেটো!” এক গাল হেসে দিয়ে।
“হুমমমমম, মনে থাববে (থাকবে)।”
“থাববে না থাকবে।”
“আস্তে আস্তে শিখে নিবো।”
“আচ্ছা! এবার উঠতে হবে। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে পরে কথা হবে তামিম।”
“ওক্কে!” বলে’ই তামিম দৌঁড়ে মায়ের কাছে চলে যায়। আর তূর্ণা ভাইয়ের মিষ্টি কাণ্ডে মুচকি হেসে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যায়।

……………………

রাতের ডিনারের পরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তন্ময় ফোন ঘাটছে। ঘাটছে বললে ভুল হবে, আসলে সে তূর্ণার ছবি দেখছে। দেখে’ও যেন চোখ জুড়াচ্ছে না। সেদিন যখন তূর্ণার আকাশী রঙের একটি গাউন পরেছিলো, তখন তন্ময়ের চোখ আটকে যায় আকাশী পরীর দিকে। সাথে সাথেই ক্যামেরা বন্ধি করে নেয় তন্ময় তূর্ণাকে।

তন্ময়ের তূর্ণাকে দেখে’ও মন ভরছে না। মনে মনে বলছে, “হে প্রেয়সী! কালই কি পাবো তোমার দেখা নাকি অপূর্ণতা পাবে আমার ইচ্ছে!
আমার যে জানতে হবে তোমাকে। আমি প্রথম দেখাতে’ই তোমাতে ঘায়েল হয়েছি। এই ঘায়েল তো আজীবনে’ও দূর হবে না।”

ফোনে তূর্ণার হাসিমাখা মুখ’টা দেখেই তন্ময় গান ধরলো,

“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই…
চিরদিন কেনো পাই না!

ও হে কি করিলে বলো পাইবো তোমারে…
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে!”

……………………..

আজ ভার্সিটিতে এসে’ই তন্ময় খুঁজে চলেছে তার প্রেয়সী’কে। কিন্তু কোথা’ও তার দেখা মিললো না। তাই তো ডিপার্টমেন্টে ফিরে গেলো উদাস মনে।

দিনে কাল একটু ঘুমের ফলে রাতে ঘুম না আসায় তূর্ণা পড়া কমপ্লিট করেছে। তূর্ণা পড়াশোনায় অনেক ভালো। তবে পড়াশোনায় প্রথম স্থান না পেলে’ও সে তৃতীয় স্থানে থাকবে’ই। তাই তো রাতে পড়তে থাকায় অনেক রাতে তূর্ণার চোখ লেগে আসলে সে ভার্সিটিতে একটু দেরী করে পৌঁছোয়। কিন্তু ক্লাসের প্রফেসর তার দেরী’তে ক্লাসে আসায় তূর্ণাকে আর ক্লাস করতে দেয় নি। তূর্ণার মন এতে বেশ খারাপ হয়ে যায়। তূর্ণা ক্লাস করতে পারবে না বলে আসাদ ও মুনিয়া মিলে প্ল্যান করলো আজকে আর ক্লাস করবে না, কারণ তূর্ণা হীন ক্লাসে দু’জনেইর মন বসবে না।
মুনিয়া সামনের এক মেয়ের মাথার চুল ধরে টান দিলে মেয়েটি বিচার দিয়ে দেয়। ফলে প্রফেসর মুনিয়াকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়। আর আসাদ তো ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে আর ফিরে’ই নি।

ক্যাম্পাসে বটবৃক্ষের নিচে মন খারাপ করে বসে আছে তূর্ণা । হঠাৎ তূর্ণার খেয়াল হলো তার পাশে দু’টি পরিচিত আওয়াজ ভাসছে। পাশ ফিরে তাকাকে’ই একটু ভালালাগা কাজ করছে তূর্ণার। মুনিয়া ও আসাদ তূর্ণার পাশে এসেছে। তিনজনেই এবার একটু জমিয়ে আড্ডা দিবে ভাবছে। আশেপাশে’ও কতকগুলাে ছেলে মেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে বলে তারা’ও আড্ডায় মেতে উঠলো।

তন্ময় ক্লাসের 1st বয় না হলেও, সে 10th স্টুডেন্ট। তন্ময় খুবই দুষ্টু, তবে পড়ালোখায় তেমন হেয়ালী করে না। কিন্তু তন্ময় কখনোই ক্লাসে সামনের বেঞ্চে বসে নি। পিছনের জালানা’র পাশে বাধাই করা বেঞ্চ’টা তেই বসবে। সেখানে কারোর’ই বসার অধিকার নেই। যদি’ওবা ভুল করে কেউ বসে পরে তাহলে ২০ টাকা জরিমানা দিতে হবে তাকে, তাই সে’ই ভয়ে কখনোই কেউ বসে না। অকারনে ২০ টাকা খরচ করে লাভ কি, তাই!

নিজের জায়গায় বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। আড্ডা এক সময় দুষ্টুমিতে পরিণত হয়। তাই তন্ময়ের বন্ধুরা তন্ময়কে কাতুকুতু দেবার জন্যে উঠে পরে লেগেছে। নিজের জায়গায় তন্ময় বন্ধী, উপায়ন্তর না পেয়ে জানালার দিকে ফিরে ঘুরলো। আর তখনই তন্ময়ের চোখ পরে তূর্ণার উপরে। বটবৃক্ষের নিচে বসে আছে তূর্ণা এবং তার সাথে আরও দু’জন। তন্ময় কোনো কিছু না ভেবে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যায় বটবৃক্ষের দিকে। তন্ময়ের বন্ধুরা তো তার কাজে অবাক হয়ে গেলো।

তূর্ণা ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো, এমনই সময় ও খেয়াল করলো কেউ দৌড়ে তার দিকে’ই আসছে। সে আর কেউ’ই নয় তন্ময়। তন্ময়কে দেখে’ই তূর্ণার মনে আনন্দের ঝড় বয়ে গেলো। তন্ময়কে সে পেয়েছে। এবার সে তাকে ধন্যবাদ জানাবে ভেবে খুশিই হলো।

……………………….

“এখন কেমন আছো তুমি!”
“জ্বী কিছুটা ভালো।”
“তোমার শরীরের কোনো ক্ষতি হয় নি তো। খারাপ লাগছে কি খুব!”
“না, খারাপ কাল ছিলো আজ আর হচ্ছে না। এখন আমি ঠিক আছি।”
তূর্ণার সাথে কথা বলে তন্ময়ের মন আনন্দে নেচে উঠেছে। তূর্ণার আওয়াজ’টাও বেশ মিষ্টি। ঘোর লেগে যাওয়া কণ্ঠ তূর্ণার। তন্ময় যে আর কতবার ঘায়েল হবে তা তার নিজে’ও অজানা।

“ধন্যবাদ ভাইয়া! আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আমি আপনার এই উপকার কোনোদিন’ও ভুলতে পারবো না। আবারও ধন্যবাদ!”
তূর্ণার কথাগুলো তন্ময়ের ভালো লাগলে’ও, “ভাইয়া” কথাটা শুনে তন্ময়ের মুখ চুপসে গিয়েছে। শেষে কিনা ভাই হয়ে গেলো তার প্রেয়সী’র। ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তন্ময়। মনে অভিমান নিয়েই তন্ময় তূর্ণাকে বলেছে তার ক্লাস আছে তাই এখন ক্লাসে যাচ্ছে। মন খারাপ করে তন্ময় প্রস্থান করে সেখান থেকে। তূর্ণা অবাক হলে গেলো তন্ময়কে দেখে। এতোক্ষনে তো ৩২’টা দাঁত বের করে তন্ময় তার সাথে কথা বলছিলো। এমন কি বললো তূর্ণা, যে তন্ময়ের মুখটা’ই চুপসে গেলো?

ক্লাসের দিকেই মন খারাপ করে ফিরছিলো তন্ময়। ক্লাসের চৌকাঠে পা রাখতে তন্ময় হঠাৎ করে’ই ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে পরলো। পরোক্ষনেই আবারও ছুট লাগায় তন্ময়। ক্লাসের সকলেই বিস্ময় ভাবে তাকিয়ে আছে তন্ময়ের কাণ্ডে। তন্ময়ের বন্ধুরা তো তন্ময়কে পাগল বলে সম্মতি’ও জানালো।
কেনো এভাবে ছুটলো তন্ময়?
কারণ কি হতে পারে?

#ক্রমশ…

(আপনার মূল্যবান মতামত আমাকে জানান এবং পাশে থাকুন। গল্পটি কেমন হচ্ছে আপনারা না বললে হয়তো আমার আশা হারিয়ে যাবে। ভাববো খারাপ হচ্ছে লেখাটা। সকলকে অশেষ ভালোবাসা আমার।
স্ববিনয়ে পড়ুন এবং ধন্যবাদ সকলকে।)
#ক্রমশ…

(সকলেই গল্পের সাথে আমারও পাশে থাকবেন আশা করি। নতুন অভিজ্ঞ তৈরী হবে আমার এবং আপনারও। অবশ্যই মতামত জানাবেন।
স্ববিনয়ে পড়ুন এবং ধন্যবাদ সকলকে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here