বৈধ সম্পর্ক সিজন ২ পর্ব ২১

#বৈধ_সম্পর্ক
#সিজন_২
#পর্ব_২১
#Saji_Afroz
.
.
.
মিশিকারা খান বাড়ি ছেড়ে বের হবার পরেই ড্রয়িংরুমে বসলো সায়নী ও মুনিরা।
মেহেনুবা উপমার ব্যাপারে সবটা জানে।
কথাটি শুনে যেনো বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো মুনিরা। যে বিষয়টা সে আড়াল করতে চেয়েছিলো সেই বিষয়টা মেহেনুবা আগে থেকেই জানতো!
আর সবটা জেনেও সে এই বিয়েতে রাজি হয়েছে!
-আপু এসব তোমাকে আরাফ বলেছে?
.
মুনিরার কথা শুনে সায়নী জবাব দিলো-
হ্যাঁ।
-দেখেছো আপু, মেহেনুবা মেয়েটা একটা হিরার টুকরো।
-হুম। তাই তো সে আরাফ কে আরো ১মাস সময় দিয়েছে।
-এটা ঠিক হয়নি। আমি কথা বলবো মেহেনুবার সাথে। ওকে বোঝাবো, ১মাস সময়ের কোনো প্রয়োজন নেই।
-প্রয়োজন।
-কেনো?
-উপমা যদি ফিরে আসে!
-তো!
-তো মানে?
-তো মানে কি! তুমি এখনো উপমার নামের বিষটার কথা বলছো? যে আরাফের আসল মা কে জিজ্ঞাসা করে তোমাকে অপমান করেছে, যে আমাদের ছেলেকে কষ্ট দিয়েছে।
-কিন্তু তার মাঝেই আমাদের ছেলে সুখ খুঁজে পায়।
-আরাফ বলেছে?
-মা হয়ে এটাই বুঝছিস না?
-সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। মেহেনুবার সাথে কথা বলবোই আমি।
-সেটা আমিও জানি। কিন্তু আরাফের মনে যে আফসোস রয়ে যাবে।
-মেহেনুবা কে পেয়ে সব ভুলে যাবে।
-বিয়ের পরেই যদি উপমা ভুল বুঝে ফিরে আসে?
-আসবেনা।
-আসতেও তো পারে। তখন আমাদের আরাফের কি হবে চিন্তা করেছিস? দু টানায় পড়ে যাবে সে। একদিকে দায়িত্ব আর অপরদিকে ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষ যাই করুক না কেনো। তার চোখের পানি, আকুতি সহ্য করা যায়না। এটা তো মানিস?
-হুম।
-আরাফের ক্ষেত্রেও এটি হবে। এতো সহজে সে উপমা কে ভুলতে পারবেনা। মনে হবে এই বিয়েটা না করলে হয়তো ফিরে আসতো উপমা। এক সময় আমাদেরও দোষারোপ করতে পারে যে আমাদের জন্য তার ভালোবাসা হারিয়েছে। তাই বলছিলাম এই একটা মাস সময় আরাফ কে দেওয়াই উচিত। উপমা যে তার জন্য নয়, এটা নিয়ে যেনো মনে সংশয় না থাকে সেটার জন্য হলেও সময় দেয়া উচিত।
-আর যদি সত্যিই ভুল বুঝে ফিরে আসে উপমা?
-ক্ষমা মহৎ গুণ। কিন্তু আমার যা মনেহয়, উপমা ঠিক হবার নয়। আমি শুধু আরাফের জন্যই করছি এটা। নতুন জীবনে যেনো কোনো সংশয় না থাকে তাই করছি।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুনিরা বললো-
হুম আপু। আরাফ কোনোদিন উপমার জন্য হা হুতাশ করুক আমিও চাইনা।
.
.
.
৮দিন পর……
মেহেনুবা বসে আছে নিজের রুমে।
এই ৮ দিনে আরাফের সাথে তার না হয়েছে দেখা, না হয়েছে কথা।
তাকে মনে যে পড়েনি এমন নয়। কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রেখেছে মেহেনুবা।
উপমা ফিরে আসলে দূরে তো এমনিতেই যেতে হবে। এখন থেকেই হোক না সেই দুরুত্ব!
.
.
মেহেনুবাকে চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাসুর মনে হলো তার মনটা ভালো নেই।
তাই হাতে মোবাইল নিয়ে আরাফের ফোনে ডায়াল করলো তাসু।
তাসুর ফোন নাম্বার অচেনা নয় আরাফের।
রিসিভ করে বললো-
হ্যালো?
-হ্যালো ফিউচার দুলাভাই। কি অবস্থা?
-ভালো। তোমার?
-আমার তো ভালো। কিন্তু আপুর তো ভালোনা।
-কেনো! কি হয়েছে?
-হবু বর যদি খবর না নেই মন ভালো থাকার কথা?
-এসব সে বলেছে?
-নাহ! আমি বলছি। এখন আমি আপু কে ফোন দিবো। তুমি কথা বলবে। আর বলবে তুমিই আপুকে চেয়েছো।
-কিন্তু…
-যা বলছি করো তো। কেমন কাপল তোমরা বুঝিনা আমি। কোথায় বিয়ের আগে চুটিয়ে প্রেম করবে তা না, কথা পর্যন্ত হয়না। একজনের ফোন নাম্বার অন্য জনের কাছে আছে কিনা সন্দেহ।
উফফ…
সবটা আমাকেই সামলাতে হবে!
.
তাসুর কথা শুনে হাসলো আরাফ।
বারান্দায় এসে মেহেনুবার উদ্দেশ্যে তাসু বললো-
আরাফ ভাই তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। ফোন দিয়েছে ভাইয়া।
.
অবাক হলেও তাসুর হাত থেকে মোবাইল টা নিলো মেহেনুবা।
তাসু ভেতরে চলে গেলে আরাফের উদ্দেশ্যে সে বললো-
ভালো আছো?
-যেমন থাকার কথা আছি। তুমি?
.
৮দিন পর আরাফের গলার স্বর শুনে মনের মাঝে ভালো লাগা কাজ করছে মেহেনুবার।
শান্ত স্বরে বললো-
-ভালো আছি।
-সত্যি?
-না থাকার কারণ নেই।
-তা অবশ্য ঠিক।
-আন্টিরা, আঙ্কেল ভালো আছেন?
-হুম। তোমরা আসোনা কেনো? বেড়াতে এসো।
-ঠিক আছে।
-আচ্ছা রাখি। ভালো থেকো।
-তুমিও।
.
.
৫০সেকেন্ড কথা হয়েছে। তবুও কতোই না ভালো লাগছে!
ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়!
.
তাসুর পাশে এসে বসলো মেহেনুবা।
মৃদু হেসে বললো-
ধন্যবাদ।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে তাসু জিজ্ঞাসা করলো-
হোয়াই?
-আমি জানি ফোনটা তুই দিয়েছিস। মোবাইলে তো দেখা যায় তাইনা?
.
জিভে কামড় দিয়ে তাসু বললো-
হ্যাঁ!
-তবে দরকার ছিলোনা।
-আরাফ ভাইয়াই কিন্তু দিতে বলেছে…
-হয়েছে আর মিথ্যে বলতে হবেনা।
-আতিক ভাইয়ার বিষয়টা আমি বুঝলেও এটা বুঝছিনা। কি সমস্যা তোদের?
-কিছুই না। বিয়ের পরেই চুটিয়ে প্রেম করবো।
.
কথাটি বলেই মেহেনুবা বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে।
তাসুর উচ্চ শব্দে বললো-
অদ্ভুদ কান্ডকারখানা!
.
.
.
৫০সেকেন্ডে ফোন রেখে দেয়াটা কি ঠিক হয়েছে!
কিইবা বলবে আরাফ মেহেনুবাকে!
কথা যেনো খুজেই পাচ্ছিলো না।
দাঁড়িয়ে পড়লো আরাফ।
দাড়ি গুলো শেষ কবে কেটেছে মনে নেই আরাফের।
আয়নায় চোখ পড়তেই হেসে উঠলো সে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো-
এই যুগে দেবদাস হবার কোনো মানে হয়?
.
উপমার কথা মনে হতেই মুহুর্তে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো তার।
উপমা কি পার্বতী না, তবে সে কেনো দেবদাস হবে!
.
আপনমনে এসব বলে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে দাড়ি ছাটার জন্য।
উপমা বলতো, চাপ দাড়িতেই ভালো মানাই তাকে।
.
.
.
সাদার মাঝে সোনালী কাজ করা লেহেঙ্গা পরেছে উপমা।
চুল গুলো খুলে এক পাশে এনে দেয়া, শরীরে ভারী গহনা। পুরো বাড়ি জমকালো ভাবে সাজানো সাথে নিজেও সেজেছে প্রচুর।
সবে মাত্র পার্লার থেকে এসে নিজের রুমে আসলো উপমা।
কেউ দেখলে বলবেনা, আজ তার এনগেজমেন্ট।
বলবে, আজ তার বিয়ে!
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে চলেছে উপমা।
আজ রোমানের জায়গায় আরাফ থাকলে কি হতো?
সে বলতো, এতো সাজগোজের কি দরকার বলো তো?
তোমাকে এমনিতেই ভালো বেশি লাগে৷ বিয়েতেও সিম্পল সাজবে তুমি।
.
না চাইতেও আরাফের কথা হুট করে মনে এলো উপমার।
কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, আরাফ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যে সময়ে তার পাশে থাকার কথা ছিলো সে থাকেনি।
তবে তার জন্য খারাপ লাগার কোনো মানেই হয়না।
.
-আপু চলো। রোমান ভাইয়ারা চলে এসেছে।
.
খালাতো বোনের ডাকে ঘোর কাটলো উপমার।
শান্ত গলায় বললো-
হু, চলো।
.
.
.
ডায়মন্ডের একটা রিং উপমার আঙ্গুলে রোমান পরিয়ে দিতেই মুখে হাসির ঝলক ফুটলো তার।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলো,
মা বাবা সহ সকলের মুখেও হাসি।
রোমানের সাথে এনগেজমেন্ট হচ্ছে বলে পরিবারের সকলে খুশি। সেখানে আরাফের কথা ভেবে উপমার অখুশি থাকার প্রয়োজনই টা বা কি!
ভাববেনা উপমা আর আরাফের কথা। এখন থেকে শুধু রোমান কে নিয়েই ভাববে।
নতুন করে স্বপ্ন সাজাবে এবং তা বাস্তবে পূরণ ও করবে।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রোমানের আঙ্গুলেও রিং পরিয়ে দিলো উপমা।
সকলের হাতের তালিতে মুখোরিত হয়ে উঠলো পুরো ঘরটা।
উপমা আজ হাসছে। তার ভালো থাকার মাধ্যম সে পেয়ে গিয়েছে।
একটা ভুল আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয়না।
সে কোনো অসহায় মেয়ে নয় যে আরাফের জন্য তার সব সহ্য করতে হবে। তার প্রাপ্য সে পেয়ে গিয়েছে, হ্যাঁ রোমানই তার উপযুক্ত জীবন সঙ্গী।
রোমান উপমার পাশে এসে ফিসফিস করে বললো-
লন্ডন থেকে এসেই বিয়েটা করে ফেলবো। অপেক্ষা করতে পারবেনা সুন্দরী কিছুদিন?
-কেনো নয়!
-ধন্যবাদ। আসো একটা সেলফি হয়ে যাক।
-হু।
.
.
.
ফেইসবুকিং করছিলো রুমানা।
উপমার সাথে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে।
কথাও হতো মাঝেমাঝে। সেই সুবাদে ফেইসবুকে এডও আছে সে।
উপমাকে ট্যাগ করে রোমান এনগেজমেন্ট এর ছবি আপলোড করেছে।
ছবিটা দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ ছিলো রুমানা।
যে উপমার আশায় আরাফ এখনো আছে আর সে কিনা মাত্র ৮দিন পরেই এনগেজমেন্ট করে ফেললো!
রোমান ছবির ক্যাপশনে লিখেছে-
৮দিন আগে উপমার ইচ্ছে ছিলো, আজকের দিনেই যেনো বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে যায়। এতো তাড়াতাড়ি তো আর রাজকুমারী কে রাজরানী করার আয়োজন শুরু করতে পারিনা! তাই আজকে এনগেজমেন্টে আবদ্ধ হয়ে সম্পর্কে আরো এক ধাপ আগালাম। খুব তাড়াতাড়ি বিয়েটা হতে চলেছে আমাদের।
দোয়াপ্রার্থী সকলের কাছে।
.
ছবি আর ক্যাপশন দেখে রুমানার চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো।
উপমার ইচ্ছে তে এনগেজমেন্ট টা হয়েছে!
আরাফের জন্য তার কি একটুও কষ্ট হচ্ছেনা?
হলে নিশ্চয় এভাবে ৩২দাঁত দেখিয়ে, এক গাল হেসে ছবি তুলতো না!
রুমানা উঠে দাঁড়ালো।
ছুটে গেলো সে আরাফের কাছে।
.
.
.
মাত্রই ওয়াশরুম থেকে বের হলো আরাফ।
নিচ থেকে শোরগোলের শব্দ ভেসে আসছে।
নিচে আসতেই সায়নীদের সাথে রুমানা কে দেখে সে বললো-
তুই আসলেই এইরকম শোরগোল শুরু হয়ে যায়, এটা কি করে ভুলে যাই আমি!
.
আরাফের উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
যার জন্য অপেক্ষা করছিলি সে তো উড়াল দিলো।
-মানে?
-আজ উপমার আন্টি বদল হয়েছে। খুব ঘটা করে অনুষ্ঠান করলো।
.
আরাফের যেনো বিশ্বাসই হচ্ছেনা কথাটি।
রাগের বশে হয়তো উপমা অনেক কিছুই বলেছিলো তাই বলে এনগেজমেন্ট!
.
আরাফকে অবাক করে দিয়ে রুমানা বললো-
তুই তার নাম্বার ব্লক দিয়েছিলি আর সে তোকে সব কিছু দিয়েছে। তাই হয়তো আপলোডকৃত পিক গুলো চোখে পড়েনি তোর।
.
রুমানা এগিয়ে এসে আরাফকে ছবি দেখালো উপমা ও রোমানের।
সবটা দেখে চুপচাপ সে নিজের রুমে চলে আসলো আরাফ।
মেঝের উপর বসে পড়লো সে।
উপমার ছবি দেখে বড্ড আঘাত পেয়েছে সে।
তার হাসি, সাজগোজ এখন থেকে অন্য কারো জন্য।
তার বিয়ে করার এতো তাড়া!
এতোটা অসহ্য হয়ে গেলো আরাফ তার কাছে!
উপমা নতুন পথে পা বাড়িয়ে দিলো কিন্তু সে কেনো পারছেনা! এখনো কিসের আশা!
-আফসোস না হবার জন্য তোকে একটা মাস অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। যাতে নিজেকে দোষী না ভাবিস তুই। আজ যদি তোর বিয়ের পরে উপমার এনগেজমেন্ট হতো, তুই ভাবতি তুই বিয়ে করেছিস বলেই সেও নিজের পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু দেখ, এমনটা কিন্তু নয়। হয়তো উপমা তোকে ভালোবাসে কিন্তু তোর মতো নয়। তার ভালোবাসায় খাদ রয়েছে।
.
সায়নীর কথার কোনো জবাব আরাফ দিলোনা।
মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো সে এক দৃষ্টিতে।
সায়নী আবারো বললো-
তুই চাইলে এবার মেহেনুবাকে বিয়েটা করে ফেলতে পারিস।
.
এপর্যায়ে মুখ খুললো আরাফ।
সায়নীর উদ্দেশ্যে বললো-
এতোটুক যখন সাথে থেকেছো আরেকটু থাকো বড় আম্মু। নিজেকে এক মাস সময় দিয়েছি। এর আগেই বিয়েটা করে ফেলতে চাইনা। এনগেজমেন্ট হয়েছে উপমার, বিয়ে না। আমি আরো ২২টা দিন দেখতে চাই। নাহলে তুমি যে বলেছিলে আফসোস? সেটা থেকে যাবে মনের মাঝে।
-হুম।
-তবে হ্যাঁ। আজ থেকে ঠিক ২২দিন পরেই বিয়েটা করবো আমি। আয়োজন শুরু করে দাও৷ যেমনটা তোমাদের ছেলের বিয়েতে করার ইচ্ছে ছিলো তেমন ভাবেই করো।
.
কোনো কথা বললো না সায়নী।
আরাফের জীবন। সে যা সিদ্ধান্ত নিবে তা মানতেই রাজি সে।
উপমাকে কতোটা ভালোবাসতো আরাফ, সে বুঝলো। এনগেজমেন্ট এর পরেও আরাফ আশা করছে তাকে নিয়ে!
ভালোবাসা ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
আদৌ কি বুঝবে উপমা আরাফের ভালোবাসা? নাকি ২২দিন পরেই আরাফের জীবনে আসবে মেহেনুবা?
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here