ভালোবাসার রং কালো পর্ব ১

#ভালোবাসার_রঙ_কালো 🖤
#চাঁদনী_নূর_লামিয়া
পর্ব-১
————————————

” এটা কী পরেছো তুমি আরজু?
বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করছিলাম। হঠাৎ কারোর গলার স্বর শুনে পিছনে ফিরে দেখি মিহির ভাই বারান্দার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তার ছোট ছোট চোখ দুটি কুঁচকে আছে। সেই সাথে কপালে সামান্য ভাঁজ পড়েছে। পরনের সাদা পাঞ্জাবিটার বুকের উপরের কয়েকটি বোতাম খোলা। ফলে তার লোমশ বুকের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। আমি দ্রুত তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। তিনি হেঁটে আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
” কালো রঙের শাড়ি পরেছো কেন?
আমি আস্তে করে জবাব দিলাম,
” আম্মা শাড়ি পরতে বলেছিল তাই পরেছি।
” কালো রঙের ছাড়া অন্য কোনো রঙের শাড়ি ছিল না? এটাই কেন পরতে হলো তোমাকে?
মিহির ভাইয়ের ধমকে ঘাবড়ে গিয়ে তার কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালাম। নিজের অজান্তেই না কি ইচ্ছে করে তিনি আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন সেটা আমি বুঝতে পারলাম না। তিনি একবার আমার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
” এমনিতে তোমার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। তার উপর আবার কালো রঙের শাড়ি পরেছো, এখন তোমাকে দেখতে ঠিক কিসের মতো লাগছে জানো?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি আবার বললেন,
” তোমাকে ঠিক কয়লার বস্তার মতো লাগছে দেখতে! তুমি আর তোমার পরনের শাড়ি দুটোই কালো। এই অবস্থায় তোমাকে দেখলে যে কেউই ভয় পেয়ে হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে।
তার কথা শুনে লজ্জায় অপমানে আমার দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি কিছু না বলে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম। মিহির ভাই আমার কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে থমথমে গলায় বললেন,
” এখনি এটা পালটে অন্য যেকোনো রঙের শাড়ি পরবে। ভবিষ্যতে আর কখনো কালো রঙের কাপড় পরবে না তুমি। কথাটা যেন মনে থাকে।
বলেই হনহন করে বারান্দা থেকে চলে গেলেন। আমি এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। এতটা অপমানের পরেও আমি এই শাড়িটাই পরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং কিছুক্ষণ পরে বারান্দা থেকে চলে আসতেই বসার ঘরে এই বাড়ির সবাইকে বৈঠক করতে দেখলাম। এটা পারিবারিক বৈঠক হওয়ায় এই বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই এখানে উপস্থিত আছেন। মিহির ভাইও আছেন। তিনি তার বাবার পাশে দামী সোফায় নরম কোশনে হেলান দিয়ে খুব আরাম করে বসে সবার সাথে কথা বলছেন। আমি এই বাড়িতে থাকলেও এই পরিবারের কেউ না। তাই বসার ঘরে সবার সাথে না বসে আমার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। কেন জানি মনে হলো মিহির ভাই আড়চোখে আমাকে দেখছিলেন। আমি আর সেদিকে না তাকিয়ে সোজা রুমে এসে পড়ার টেবিলের কাঠের চেয়ারটাই বসে পড়লাম। এর কিছুক্ষণ পরেই আম্মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রুমে ঢুকে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
” কিছু বলবে?
” একটু আগে মিহির বলছিল তুই না কি ওর সাথে বেয়াদবি করেছিস। ওর কথার কোনো জবাব দেসনি। তুই কেন এমন করিস আরজু? যেই ছেলেটা আমাদের বিপদের দিনে পাশে এসে দাঁড়ালো। নিজেদের বাড়িতে আমাদের থাকতে দিলো। সেই ছেলেটার সাথে বেয়াদবি কেন করিস তুই? কেন সোজা মুখে কথা বলিস না ওর সাথে?
আম্মার কথা শুনে আমার ভীষণ রাগ হলো। ঝট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে রাগী সুরে বললাম,
” উনার বাড়িতে আমরা আশ্রিত বলেই তো তার কথার জবাব দেই না।
আম্মা আমার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন,
” মানে কী?
আমি আম্মার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটো জিজ্ঞেস করলাম,
” আচ্ছা আম্মা আমরা এখনো কেন এই বাড়িতে থাকছি? আব্বার ব্যবসা তো এখন কিছুটা ভালো চলছে। তাহলে আমরা কেন ভাড়া বাড়িতে যাচ্ছি না?
আমার প্রশ্নটা হয়তো আম্মার পছন্দ হয়নি। তাই হুট করেই আমাকে খেঁকিয়ে উঠলেন,
” ভাড়া বাসায় উঠলে মাস শেষে ভাড়া কি তুই দিবি? রাবেয়া আর শিমুকে বিয়ে দিতে গিয়ে তোর বাবা কত টাকার ঋণে পড়েছে সেটা কি তুই জানিস? এত পাকনামি না করে যা বলছি তাই করবি। মিহিরের সাথে সুন্দর করে কথা বলবি। তোর নামে যেন আর কোনো নালিশ না আসে আমার কাছে।
আম্মা সেখানে আর না দাঁড়িয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার যাওয়ার পরে আমি আবার চেয়ারে বসে পড়লাম।
আমরা পাঁচ ভাইবোন। ইসরাত আপু, আমি, রাবেয়া, শিমু আর নোমান। ইসরাত আপু আমাদের সবার বড়। বিয়ে হয়ে গেছে আরও আট বছর আগেই। দুই ছেলের মা সে। দুলাভাইয়ের বিরাট ব্যবসা। এরপর আমি, গত বছর সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেছি। নোমান আমাদের সবার ছোট আর একমাত্র ভাই। ও এইবার এস এস সি পরীক্ষার্থী। পড়াই ভীষণ অমনোযোগী সে। সারাক্ষণ শুধু ব্যাট বল নিয়েই পড়ে থাকে। ক্রিকেট ওর প্রিয় খেলা। ওর ধ্যান জ্ঞান সবই সেই ক্রিকেট খেলা। রাবেয়া আর শিমু দুজনেই আমার ছোট। বছর দেড়েক আগে ওদের দুজনেরই এক আয়োজনে বিয়ে হয়ে গেছে। বড়বোন রেখে ছোট দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সমাজে আমাদের নিয়ে মানুষ ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আমি আম্মা আর আব্বাকে সেসবে কান দিতে নিষেধ করে দিই। আমার ছোট বোনদের আমার আগে বিয়ে হলে তাদের কিসের সমস্যা?যেখানে আমার নিজের কোনো আপত্তি নেই? মূলত রাবেয়া আর শিমুর বিয়ে দিতে আমিই আম্মা আব্বাকে রাজী করিয়ে ছিলাম। কালো বলে আমার বিয়ে হচ্ছিলো না। শুধু কালো না, কুচকুচে কালো! আমার মাথার চুলের রঙ আর শরীরের চামড়ার রঙ একই, যার দরুন পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ করে না। কে ই বা আর এমন অসুন্দর মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। সবাই যে সুন্দরের বিলাষী! এইদিকে আমার বয়সও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিলো। সেই সাথে ছোট বোন দুটিও বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠছিল। একসাথে তিন মেয়ের বিয়ের বুঝা আব্বার কাঁধে ছিল; যার ওজন প্রায় পাহার সম ঠেকছিল তাঁর কাছে। তাই আমি আব্বাকে রাজী করিয়ে সেই ওজন কিছুটা কমানোর চেষ্টা করি। রাবেয়া আর শিমু দেখতে সুন্দর আর ওদের গায়ের রঙ ফর্সা। তাই ওদের বিয়ে দিতে আব্বার কোনো কষ্টই পোহাতে হয়নি। এক আয়োজনে দুজনকে একসাথে বিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিটাও আমারই ছিল। বিগত কয়েক বছর যাবত আমরা আর্থিক সংকটে ভুগছিলাম বলে আব্বা আমার বুদ্ধিটাকে পরামর্শ হিসেবে গ্রহণ করে কাজে লাগালেন। দুজনের বিয়ে এক অনুষ্ঠানেই সেড়ে ফেললেন। এতে খরচ আর সময় দুটোই সাশ্রয় হয়। ওদের দুজনের বিয়ের পর আমার জন্য বিয়ের সমন্ধ আসা একবারেই বন্ধ হয়ে গেল। অন্যদিকে আব্বার ব্যবসাও খুব নাজুক অবস্থায় চলছিল। তার উপরে রাবেয়া আর শিমুর বিয়ে জন্য আব্বা অনেক টাকা ঋণ করেছিলেন। যার সুদও ছিল অনেক বেশি। মাসে মাসে সেসব সুদের টাকা পরিশোধ সহ সংসার খরচ সামলাতে আব্বা হিমসিম খাচ্ছিলেন। সব মিলিয়ে আমরা যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। তখনি আমাদের তিন রুমের ছোট বাড়িটি বিক্রি করে সব দেনা শোধ করে দিয়ে আব্বা আমাদেরকে নিয়ে এই বাড়িতে এসে উঠেন। মিহির ভাই না কি আব্বাকে জোর করেছিলেন
তাদের বাসায় এসে থাকতে। আব্বাও তখন বাড়ি বিক্রি করে দিশেহারা হয়ে পড়ে ছিলেন। কোথায় থাকবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। বাড়ি ভাড়া নিলে প্রতি মাসে ভাড়াও তো ঠিক মতো দিতে পারবেন না। তাই উনার প্রস্তাবে খুশিমনে রাজী হয়ে গেলেন। এরপর আমাদের নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে চলে আসেন। তাও প্রায় নয় মাস আগে। এগারো তালা ভবনের চার তালার পুরো ফ্ল্যাটটি মিহির ভাই কিনে নিয়েছেন। আমাদেরকে এই ফ্ল্যাটের দুটি রুম থাকার জন্য দিয়ে দেওয়া হয়। একটাতে পার্টিশনের ব্যবস্থা করে একপাশে আব্বা আর আম্মা আর অন্যপাশে নোমান থাকে। আর একটাই আমি থাকি। বাকি পুরো ফ্ল্যাট নিয়ে মিহির ভাইয়ের পরিবার থাকেন। এখানে আসার পরই আমরা বুঝতে পারি মিহির ভাই ছাড়া তার পরিবারের আর কেউই আমাদের তাদের সাথে থাকাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু আর কোনো উপায়ন্তর না থাকায় অনেকটা নিরুপায় হয়েই আমরা এখানে থাকতে বাধ্য হই। অনেক কিছু দেখেও দেখি না, শুনেও শুনি না। নিজেদের অসহায়ত্বকে মেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তাদের কখনো পরোক্ষ ভাবে কখনও বা প্রত্যক্ষ ভাবে করা অপমানগুলো হজম করতে থাকি। কিন্তু সবকিছু মানিয়ে নিলেও একটা বিষয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না আমি। আর সেটা হলো আমাকে করা মিহির ভাইয়ের অপমানগুলো। বিনা কারণে যখন তখন আর যেখানে সেখানে আমাকে অপমান করেন তিনি। আমার গায়ের কালো রঙকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। অথচ তার গায়ের রঙ ও কালো। সাদা পাঞ্জাবিতে তাকেও তো দেখতে ভয়ঙ্কর লাগছিল। কিন্তু আমি তো কখনো তাকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করি না। কটুকথা শোনাই না। নাকি আমাদেরকে তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন বলে সেটার প্রতিদান আমাকে অপমান করে নিচ্ছেন তিনি!
” আপু।
নোমান ক্রিকেট খেলে বাড়িতে ফিরে ব্যাট কাঁধে নিয়ে সোজা আমার রুমে চলে এসেছে।
” তুই বাইরে থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ না হয়ে এখানে কী করছিস?
” আমার তিন হাজার টাকা লাগবে।
” কেন?
” ব্যাচের সবাই কক্সবাজার যাবে ঘুরতে। জনপ্রতি সাত হাজার করে টাকা পরেছে। কিন্তু আমি ক্যাপ্টেন হওয়ায় মাত্র তিন হাজার টাকায় যেতে পারছি।
” তিন হাজার টাকা তোর কাছে মাত্র লাগে?
তুই এখন আর খুব ছোট নেই নোমান। সামনের মাসে তোর সতেরো বছর পূরণ হবে। এতদিনে তোর কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা। কিন্তু তুই ক্রিকেট আর ঘুরাঘুরি নিয়ে মেতে থেকে অমনোযোগী হয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে যাচ্ছিস।
” আহ আপু এত প্যাচাল না করে টাকার ব্যবস্থা কোরো। আমার কিন্তু টাকাগুলো কালকের মধ্যেই চাই।
নোমান আর আমার সামনে দাঁড়ালো না। যেভাবে ব্যাট কাঁধে নিয়ে এসেছিল। সেভাবেই ব্যাট কাঁধে ফেলে চলে গেল।
আমার মন খারাপটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। তিন হাজার টাকা কালকের মধ্যে কোথায় থেকে জোগাড় করবো? নোমানের জন্য খারাপ লাগছে। আব্বা আম্মার একমাত্র ছেলে হয়েও নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারছে না ও। আমাদের আর্থিক অবস্থা আগে এত খারাপ ছিল না। দাদুর বিশাল ব্যবসা ছিল। আর আব্বা ছিল সেই ব্যবসার একমাত্র উত্তরাধিকারী। ইসরাত আপা আর আমার ছোট বেলা খুব বিলাষিতায় কেটেছে। রাবেয়া আর শিমুও সেই বিলাষিতার কিছুটা উপভোগ করতে পেরেছে। কিন্তু নোমানের জন্মের পরই আব্বার ব্যবসায় ধস নামে। সেই রেশ ধরেই আমাদের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। কিন্তু তাও আব্বা আর দাদু হতাশ হোননি। তারা দুজনেই নিজেদের সবটা দিয়ে ব্যবসার হাল ধরেন। কিন্ত তারপরও শেষ রক্ষা হয় না। এক শীতের রাতে দাদু মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে আব্বা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েন। অত্যন্ত দূরদর্শী আর বুদ্ধিমান হিসেবে আব্বা বুঝে গেলেন তার আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হতে এখন অনেকটা কঠিন। তাই তিনি আর ব্যবসার পিছনে টাকা নষ্ট না করে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং অল্প বয়সেই ইসরাত আপার বিয়ে দিয়ে দেন। ভাগ্য ভালো ইসরাত আপার স্বামী অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি আপাকে তাকে মেনে নিতে অনেক সময় দেন এবং আপার পড়াশোনাও চালিয়ে নিয়ে যান। আপার বিয়ের পর আব্বা আমার বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগেন। কিন্তু আমার জোড়া যেন পৃথিবীতে আসেনি। কোনো ভাবেই তিনি আমার বিয়ের জন্য সুপাত্রের সন্ধান পাচ্ছিলেন না। উপরন্তু কেউ আমার গায়ের কালো রঙের জন্য আমাকে পছন্দও করতো না। অবশেষে বছর পাঁচেক অনেক চেষ্টার পর আশাতীত ফল না পেয়ে আমার বিয়ে নিয়ে আব্বা হতাশ হয়ে পড়েন। যেই আব্বা তার ব্যবসার লোকশানের পরেও ভেঙে পড়েননি, সেই আব্বা আমার বিয়ে নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এইদিকে রাবেয়া আর শিমুও বেশ বড় হয়ে উঠছিল। সাথে ওদের কিশোরী বয়সের সৌন্দর্য ফুলের রেনুর মতো প্রস্ফুটিত হচ্ছিলো। একসাথে তিন মেয়ের বিয়ের ভার আব্বার কাঁধে চেপে বসে। আব্বা দিশেহারা হয়ে চারদিকে শূন্য দেখতে লাগলেন। উপায়ন্তর না দেখে আমি আব্বাকে আমার আগে রাবেয়া আর শিমুর বিয়ে দিতে রাজী করাই। যদিও আব্বাকে রাজী করানো খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হবেই। তাই আমার ছোট দুই বোনের বিয়ে আমার আগেই হয়ে গেল। ওদের দুই জনেরই খুব ভালো পরিবারে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো ওদের বিয়ের পর। রাবেয়া আর শিমুর বিয়ের জন্য আব্বা অনেক টাকা ধার করেছিলেন। আর সেই টাকার শোধ দিতে গিয়েই এখন আমরা নিঃস্ব হয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয়ে আছি। তবে এক সময় মিহির ভাইয়ের পরিবারও আমাদের বাড়িতে কয়েক বছর জন্য থেকে ছিলেন। কিন্তু তখন আমরা তাদেরকে আশ্রিত মনে করিনি, বরং মেহমান হিসেবেই গ্রহণ করে ছিলাম। তখন আমি সবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠে ছিলাম। এক সন্ধ্যায় মিহির ভাইয়ের আব্বা তার স্ত্রী এবং চার সন্তান নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হোন। আংকেল তখন চাকরি সূত্রে ট্রান্সফার হয়ে নতুন এসেছিলেন এই শহরে। আর তিনি আব্বার দূর সম্পর্কের আত্বীয়ও ছিলেন। সেই সুবাদে আমার সরল মনের মিশুক আব্বা তাদেরকে আমাদের বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানান। আব্বা সেদিন তাদেরকে মেহমান হিসেবে পরিচয় করে দিয়েছিলেন আমাদের সাথে। মিহির ভাই তখন কলেজে পড়তেন। আমাদের সবার সাথেই উনাদের খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। মিহির ভাইয়ের ছোট দুই বোন রিধি আর নিধি ছিল আমাদের প্রায় সমবয়সী। বয়সের খুব বেশি পার্থক্য ছিল না আমাদের মধ্যে। আর তার ছোট ভাই নাহিদ নোমানের চেয়ে বছর খানেকের বড় ছিল। তিন বছর থেকে ছিলেন তারা আমাদের সাথে। তারপর একদিন নিজেদের বাড়ি করে চলে যান তারা। কিন্তু আজ এত বছর পর মিহির ভাইয়ের পরিবারের সেই সব কথা মনে নেই। তাই তো মাত্র কয়েক মাসেই আমাদের প্রতি অসহ্য হয়ে পড়েছেন তারা। আমাদের এই বাড়িতে থাকা মোটেও পছন্দ না তাদের। কিন্তু নিরুপায় হয়েই আব্বা আমাদের নিয়ে এখানে থাকছেন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ স্বার্থপর হচ্ছি আমরা মানুষেরা। যেখানে আমরা স্বয়ং আল্লাহপাকের নেয়ামতেরই শোকরিয়া আদায় করতে টালবাহানা করি। সেখানে একে অপরের দয়া মায়া আর আন্তরিকতা কীভাবে মনে রাখবো!
.
আর কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। ছাদ থেকে তো এখনো শুকনো কাপড়গুলো আনা হয়নি। আমি শাড়ির আঁচলটা সারা শরীরে জরিয়ে নিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। ছাদে আসতেই মাগরিবের আযান শুরু হয়। তাড়াহুড়ো করে শুকনো কাপড়গুলো নিয়ে চলে আসার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই একটি রাশভারী কণ্ঠস্বর শোনতে পাই,
” তোমার এতবড় সাহস, আমার নিষেধের পরও এখনো এই কালো শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছো!
.
#চলবে ….
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here