ভালোবাসার রং মিছিল পর্ব -৩৪+৩৫

#ভালোবাসার_রং_মিছিল💚
#লেখিকা_ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৩৪

সকালে ঘুম ভাঙতেই অর্ষা দেখলো সে ইরহামের বুকে শুয়ে আছে।হাসলো অর্ষা।ইরহামের চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো।ইরহামের কপালে অধর ছুঁইয়ে দিলো।উঠতে নিলেই ইরহাম হাত টেনে ধরে।অর্ষা ইরহামের বুকে গিয়ে পরে।ইরহাম চুলগুলো সরিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলে,,,

—“বউ ঘুমিয়ে থাকলে আদর করো কেনো এখন করো”

—“ছাড়ুন ফ্রেশ হবো”

ইরহাম হেসে উঠে পরে অর্ষাকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।ফ্রেস হয়ে বাইরে আসে।অর্ষা মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে।বাড়ি ভরা মেহমান।কাছের আত্নীয়রা ছাড়া সবাই কালই চলে গিয়েছে।অর্ষা নিজেকে পরিপাটি করে বের হয় রুম থেকে।ইরহাম অবশ্য মানা করেছিলো নিচে আসতে কিন্তু অর্ষা শুনেনি।কালকে কথাও বলতে পারিনি আয়রার সাথে।অর্ষা ঘোমটা টেনে নিচে রান্নাঘরে আসে।আয়রা রান্না করছিলেন।অর্ষা পাশে এসে মিষ্টি হেসে বললল,,,,

—“মামনি আমি কি সাহায্য করতে পারি তোমাকে?”

—“আরে অর্ষা মা যে এতো সকালে উঠলে কেনো আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে।”

—“না না মামনি অনেক ঘুমিয়েছি এখন বলো কি কাজ করবো?”

আয়রা হেসে চা ধরিয়ে দিয়ে বলে,,,,”এগুলো একটা ইরহাম আর একটা শ্বশুর মশাইকে দিয়ে আসো আর কিছু করা লাগবে না।”

অর্ষা মিষ্টি করে হেসে পা বাড়ালো শ্বশুর মশাইয়ের রুমের উদ্দেশ্যে।কেউ এখনো উঠেনি।অর্ষা রুমের সামনে এসে মিষ্টি সুরেলা কন্ঠে বলল,,,

—“আব্বু আসতে পারি?”

ভেতর থেকে ইসফাক বলে উঠে,,,”হ্যাঁ মা আসো”

অর্ষা রুমে ঢুকলো।ইসফাক বসে ছিলেন।অর্ষা চা হাতে দিয়ে বললেন,,,,

—“এই নিন আব্বু”

ইসফাক হাসেন।চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন,,,”এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো মা তোমার”

—“না না আব্বু আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না”

ইসফাক অর্ষার হাতে আরেকটা চায়ের কাপ দেখে বুঝলো ইরহামের জন্য সেইটা।চা ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে তাই অর্ষাকে বলল,,,

—“মা যাও ইরহামকে দিয়ে আসো চা না হয় ঠান্ডা হয়ে যাবে”

অর্ষা ‘জি’ বলে বের হয়ে যায় রুম থেকে।রুমে আসতেই দেখে ইরহাম ফোন ঘাটছে।অর্ষা আজকে দেখেই ছাড়বে এই লোক কি এতো দেখে ফোনে।অর্ষা নিশ্বব্দে ইরহামের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।ইরহাম ফোনে তার আঁকা ছবি দেখছিলো।যা সব কোনো মেয়ের।অর্ষা রেগে ফোনটা কেড়ে নেয় এরপর চিল্লিয়ে বলে,,,

—“আপনি অন্য মেয়েদের ছবি দেখছেন?”

ইরহাম হকচকিয়ে যায় অর্ষার ব্যবহারে।অর্ষা দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে।ইরহাম হাসে মেয়েটা ছবি গুলো ঠিকমতো না দেখেই চিল্লাপাল্লা করছে।ইরহামকে হাসতে দেখে অর্ষার রাগ আরো বাড়ে।ইরহামের কলার চেপে ধরে বলে,,,

—“আপনি এখন অন্য মেয়েদেরকে দেখছেন তার মানে আমাকে ভালোলাগে না আপনার এখন।ফাইন তাতেও সমস্যা নেই আপনার থাকতে হবে শুধু আমার সাথে”

ইরহাম হাসে অর্ষার পাগলামি দেখে।মেয়েটা তাকে অসম্ভব ভালোবাসে।ইরহাম অর্ষার কোমড় টেনে কাছে এনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলে,,,

—“ছবিগুলো ভালো করে দেখা উচিত জান।কারন ওইগুলো তোমার ছবি।আর ইরহামের চরিত্র এতোটাও খারাপ না যে ঘরে সুন্দরী বউ রেখে বাইরের মেয়েকে দেখতে যাবে”

অর্ষা লজ্জা পায়।তার ছবিগুলো আসলেই ভালো করে দেখা উচিত ছিলো।অর্ষা তাকাতে পারছে না ইরহামের দিকে লজ্জায়।ইশশ কতো গুলো কথা বলে ফেললো সে।রাগ উঠলে মাথায় থাকে না কিছুই।যা মনে আসে বলে দেয়।ইরহামকে অন্যকারো সাথে দেখা সম্ভব না।ইরহাম তার শুধুই তার।ইরহাম অর্ষার কপালে নিজের অধর ছুঁইয়ে দেয়।অর্ষা শিউরে ওঠে।লোকটার স্পর্শেও কেমন মাতাল মাতাল লাগে অর্ষার।

—“জান এতোটা হিংসা করো আমায় নিয়ে।আমি শুধু তোমারই বউ”

—“হু অন্যকোনো মেয়ের দিকে তাকালে মেরে দিবো কিন্তু”

ইরহাম অর্ষার নাকে নাক ঘষে বলে,,,,”ওরে আমার গুন্ডি বউরে”

—“ছাড়ুন এখন।ইশ চা তো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।আরেক কাপ এনে দিবো”

—“চা তো খেতে ইচ্ছে করছে না বউ।আমার অন্য জিনিস খেতে ইচ্ছে করছে।আমার মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে”

—“আচ্ছা ছাড়ুন আমি মিষ্টি এনে দিচ্ছি”

ইরহাম অর্ষার ঠোঁটজোরা দখল করে নেয়।অর্ষা চোখ বড়বড় করে তাকায়।ইরহামের শার্ট খামচে ধরে।বেচারি শক খেয়েছে।ইরহাম যে এমন করবে ভাবতে পারিনি।অর্ষাকে ছেড়ে দিয়ে ইরহাম ফিসফিস করে বলে,,,

—“বউ আমি এই মিষ্টির কথা বলেছি।তুমি তো দিতে চাও না তাই নিয়ে নিলাম”

—“অসভ্য লোক”

ইরহাম অর্ষাকে চোখ মেরে বলে,,,”তোমারই তো”

৭৫.

বিয়ের সাত দিন পার হলো।অর্ষার দিনকাল বেশ কাটছে।ইরহামের সাথে দুষ্টমি,খুনসুটিতে মেতে থাকে।আজকে ভার্সিটিতে যাবে।রেডি হচ্ছে অর্ষা।রেডি হওয়ার মাঝেই ইরহাম পেছন থেকে ঝাপটে ধরে অর্ষাকে।অর্ষা আলতো হাসে।ইরহাম ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,,,

—“বউ আই লাভ ইউ”

—“হুম ছাড়ুন রেডি হোন ভার্সিটিতে যেতে হবে”

ইরহাম হুম বলে চলে গেলো।অর্ষা নিচে নেমে দেখে ইসফাক ইলমা,আয়রা ইয়াদ বসে গল্প করছে।ও গিয়ে ধপ করে বসে পরে।সবাই হাসে অর্ষার কান্ড দেখে।মিষ্টি করে হেসে বলে,,,

—“শুভ সকাল আব্বু,মামনি, মিষ্টি পাখি,ভাইয়া”

—“শুভ সকাল অর্ষা মা”(ইসফাক)

ইলমাও হেসে বলে,,,”শুভ সকাল ভাবিমনি”

সবার সাথে গল্প করতে থাকে।ইসফাক আর আয়রার সাথে অর্ষার বন্ডিংটা খুব ভালো হয়েছে এই কয়েকদিনে।তারাও অর্ষাকে নিজের মেয়ের মতো করে রাখে।বুঝতে দিতে চায় না অর্ষা এই বাড়ির মেয়ে না বউ।ইয়াদও স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে অর্ষার সাথে।সে চায় না অর্ষা ব্যাপারটা জেনে তার সাথে কথা বলতে অস্বস্থি ফিল করুক।আগের মতো হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে।যতটা পারে ততটা থাকে।

ইরহাম নিচে আসলে সবাই মিলে একসাথে খাবার খেতে থাকে।অর্ষার চোখ জুড়ায়।এখানে এসে ইসরাকের মতো বাবা,আয়রার মতো মামনি,ছোট বোন,বড় ভাই সব পেয়েছে।ও বাড়ির থেকে এ বাড়ির সবাই তাকে কম ভালোবাসে না।ইয়াদকে বড় ভাইয়ের চোখে দেখে।বড় ভাই না থাকায় অনেক আফসোস ছিলো অর্ষার এখন সেটাও পূরণ হয়েছে।আর কি চাই তার।সব কিছুই পেয়েছে।এতো ভালো পরিবার,পাগল বর।যে তাকে পাগলের মতোই ভালোবাসে।খাওয়া শেষে সকলকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে পরে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

ইরহাম এটা ওটা বলে অর্ষাকে লজ্জা দিচ্ছে।অর্ষাও পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছে।খুনসুটি করতে করতে ভার্সিটিতে পৌঁছে গেলো।অর্ষা নেমে ইরহামকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে ঢুকলো।দৌড়ে বন্ধুদের কাছে গেলো।অনেক দিন হলো দেখা হয় না ওদের সাথে।রুশান মন মরা হয়ে বসে ছিলো।অর্ষা ধপ করে ওর পাশে বসে পরে।সবাই হাসে।অর্ষাকে ছাড়া ভার্সিটিতে আসতে কেমন কেমন লেগেছে রুশানের।বহু বছরের অভ্যাস।দুই ভাই বোন একসাথে যায় আসে সব সময়।হুট করে এমন হওয়ায় রুশানের মন খারাপ হয়েছে।

—“কিরে রুশাইন্না নতুন পাইয়া ভুইলা গেছোস পুরোনো বেস্টফ্রেন্ডরে”

রুশান মলিন হাসে।অর্ষার ভালো লাগে না।রুশান আনমনে বলে,,,
—“নতুন পাবো কোথায়?পুরোনোর জন্যই কষ্ট হয় আবার নতুন”

মুহিব পাশ থেকে বলে ওঠে,,,”মামাহ তোরে এমন ছ্যাকা খাওয়া মার্কা কথায় মানায় না।আর তোর বেস্টু মরে নাই ভাই শুধু বিয়া হইছে”

অর্ষা রুশানের গালে হাত দিয়ে বলে,,,

—“আমি জানি তোর খারাপ লাগছে একা একা ভার্সিটিতে আসতে,বাসায়ও মন টিকছে।কি করবো বল মেয়ে তো পরের বাড়ি যেতেই হবে।এই যে এখন কষ্ট হচ্ছে কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।আর যখন ইলমা তোর কাছে যাবে তখন দেখা যাবে এই অর্ষাকেই ভুলে বসে আছিস”

রুশান অর্ষাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,,,

—“তোকে ভোলা অসম্ভব অর্ষা।তুই আমার বোন আমার বেস্টফ্রেন্ড তোর জায়গা সব সময় সবার থেকে আলাদা”

অর্ষা রুশানের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,,,”জানি আমি আর তুই ও কিন্তু আমার বয়সে ছোট বেস্টফ্রেন্ড হয়েই থাকবি”

সবাই মিলে গল্প করে।আজকে প্রথমে কোনো ক্লাস নেই।তাই গল্প করছে।ক্লাস শেষে ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে সবাই।তার ভেতরে তিশাম আসে।তিশামকে দেখে রুশান কথা বললেও অর্ষা বলে না।ইরহাম পছন্দ করে না জেনেই কথা বলছে না।তিশাম অর্ষার কাছে এসে বলে,,,

—“অর্ষা কেমন আছো?কিছু কাজে ঢাকার বাইরে ছিলাম তাই দেখা করতে পারিনি কিছু বলতে চাই তোমাকে!”

অর্ষা জোরপূর্বক হেসে বলে,,,”জি বলুন আমার তাড়া আছে”

ইরহাম চলে এসেছে ততক্ষণে।অর্ষা ইরহামকে দেখে অর্ষা হাফ ছেড়ে বাঁচে।ইরহাম তিশামকে দেখে বিরক্ত হয়।তিশামকে দেখানোর জন্য একহাতে জড়িয়ে ধরে।সবাই মুখ টিপে হাসে।তিশাম কিছুটা রেগে যায়।ইরহামের প্রতি চাপা ক্ষোভ নিয়ে বলে,,,

—“এটা কে অর্ষা তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে আর তুমি কিছু বলছো না”

অর্ষা ইরহামের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,,,”হি ইজ মাই হ্যাসবেন্ড”

—“হুয়াট তুমি বিয়ে করেছো?”

ইরহাম গম্ভীর আওয়াজে বলল,,,

—“হ্যাঁ তো ওকে কি এখন বিয়ে আপনার কথায় করতে হবে”

ইরহাম অর্ষাকে নিয়ে চলে আসলো সবাই বিদায় দিয়ে।ইরহাম আপনমনে গাড়ি চালাচ্ছে।গাড়ি এসে থামে একটা লেকে।লেকটা অসম্ভব সুন্দর।দুজন ঘাসের উপর বসে পরে।আকাশে মেঘের আনাগোনা।ইরহাম অর্ষাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,,,

—“তোমাতে মত্ত আমি প্রেয়সী,এ জীবনে ছাড়ছি না তোমায়”

#চলবে…!

আসসালামু আলাইকুম।কালকের টুইস্টের জন্য রেডি তো সবাই।ব্যক্তিগত কাজে গতকাল ব্যস্ত ছিলাম তাই দিতে পারিনি দুঃখিত।ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।#ভালোবাসার_রং_মিছিল💚
#লেখিকা_ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৩৫

৭৬.
সময় কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না।দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে তিন বছর।একটা রুমে একজন লোক হাসছে।লোকটার হাতে একটা মেয়ের ছবি।ছবিটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।আর হাসছে।হাসতে হাসতে লোকটা ছবিটার উপর হাত রেখে বলে,,

—“প্রেয়সী প্রেয়সী প্রেয়সী এই প্রেয়সী আমার শুধুই আমার।কখনোই কেউ আমাকে আলাদা করতে পারবে না তোমার থেকে হি হি।তুমি তো আমারই,তুমি তো শুধুই আমারই”

লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইয়াদের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি পরলো।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।সাথে ইলমা আরিশা রুশানও আছে।লোকটা আবারও হাসছে।একটা মানুষকে কতোটা ভালোবাসলে তার অনুপস্থিতে কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন হতে পারে।এই মানসিক ভারসাম্যহীন পা’গ’লটা ইরহাম।সেই জেদী,বদ মেজাজি,গম্ভীর,রা’গচ’টা লোকটা এখন পা’গ’ল।ভালোবাসা বড্ড ভয়ংকর।যেমন সুখী করতে পারে তেমনই সুখ কেঁড়ে নিতেও পারে।

—“ছোট ভাইয়া দা ভাই কি কখনো আর ঠিক হবে না”

ইলমা কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বলল।ইয়াদ বোনকে জড়িয়ে ধরল।গত দেড় বছর যাবত ইরহাম এমন অবস্থায় রয়েছে।উন্নতি হয়নি কোনো।মানসিক ভারসাম্য হারিয়েও প্রেয়সীকে ভুলেনি।ইয়াদ কি ভালোবেসেছে অর্ষাকে।ইরহাম তার থেকেও দ্বিগুণ ভালোবেসেছে।ভয়ংকর ভাবে ভালোবেসেছে ইরহাম।কিন্তু শেষে কি পেলো কিছুই না।

—“কাঁদিস না ইলু দা ভাই ঠিক হবে। ঠিক হতেই হবে দা ভাইকে।কারো জন্য না হলেও তার জন্য হতে হবে।সে অপেক্ষায় আছে দা ভাইয়ের।দা ভাই সুস্থ হবে খুব তাড়াতাড়ি”

আরিশার চোখেও পানি।ভালোবাসা অদ্ভুত বড়ই অদ্ভুত।সে এতোটা ভালোবাসার পরেও ইয়াদকে পাচ্ছে না।বড্ড ইচ্ছে করে তার ইয়াদের বুকে মাথা রাখতে কিন্তু সম্ভব নয় তা।ইয়াদ তাকে গত তিন বছরেও সেই অধিকার দেয়নি।কম তো ভালোবাসে না সে ইয়াদকে।এখন সে আগের মতো ছোটও না তাহলে কেনো এতো বাঁধা,কেনো মানছে না ইয়াদ।ইরহামের করুন পরিণতিও আরিশা মানতে পারে না।তার বোনের সুখের সংসারে কারো নজর লেগেছিলো হয়তো!

—“কিরে কি ভাবছিস চল”

আরিশা আরেকবার তাকালো ইরহামের দিকে।সে নিজের মতো ব্যস্ত আশেপাশে কেউ আছে কিনা তা তার খেয়ালে নেই।সে তো নিজের প্রেয়সীকে দেখতে ব্যস্ত।চুলগুলো বড় বড় হয়ে আছে,চোখের নিচে কালি পরেছে, চেহারায় উজ্জ্বলতা নেই।মলিন চেহায়া।অর্ষার প্রেমিক পুরুষ আর আগের মতো সুদর্শন নেই।এখন সে মানসিক ভারসাম্যহীন এক কথায় পা’গ’ল।আহ ভালোবাসা অদ্ভুত সুন্দর।

—“হ্যাঁ চলো রুশান ভাইয়া”

বের হয়ে যায় রুম থেকে সবাই।রুমটা ঠিক আগের মতোই আছে।ঠিক আগের মতো সাজানো।ইরহাম এখনো কাউকে ধরতে দেয়নি কিছু।অর্ষার জিনিসগুলোও যত্ন করে রেখেছে।কিছুক্ষণ পরপর সেগুলো আনে বুকে জড়িয়ে একা একা কথা বলে।সবাই নিচে নামে।আয়রা কাঁদছে,ইসফাক বসে আছে।ছেলের করুন পরিনতি মেনে নিতে পারিনি।আয়রার রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে কান্না করা।ছেলের বউ নেই,ছেলের মানসিক ভারসাম্যহীন।সারাদিন অর্ষার ছবি নিয়ে পরে থাকে।এমনটা কি হওয়ার কথা ছিলো।তার সুখের সংসারটা এমন কেনো হলো।ছন্নছাড়া জীবন যাপন করছে সবাই।না আরিশা ভালো আছে,না রুশান,না ইলমা,না ইয়াদ,কেউ ভালো নেই।কেউ নাহ!ইয়াদের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চিল্লিয়ে বলতে অর্ষা ফিরে আসো।তোমাকে ছাড়া কেউ ভালো নেই কেউ না।

—“কিরে ইয়াদ তোর ভাইটা কি আজ একটু স্বাভাবিক হয়েছে”

—“আম্মু তুমি বুঝতেছো না কেনো ভাইয়া অর্ষাকে ছাড়া ঠিক হবে না।একমাত্র অর্ষাই পারে দা ভাইকে ঠিক করতে।”

আয়রা চিল্লিয়ে বলে,,,,”সেইটা কিভাবে সম্ভব তুই জানিস অর্ষাকে কোনোদিন পাওয়া যাবে না।ফিরবে না ও কখনো”

—“তাহলে কি হবে আম্মু ছোট্ট অর্নিশার।মেয়েটার বয়স কতো মাত্র ২ বছর।মেয়েটার এখন মা বাবাকে প্রয়োজন না আছে তার মা আর না বাবা”

—“ইয়াদ বাবা তোকে তো ও আব্বু বলেই চিনে তাহলে ওর আম্মু এনে দে।ওকে তো ভালোবাসিস তুই অনেক।তুই যে ওর আব্বু না তা তো ওকে কখনো বুঝতে দিসনি।তাহলে তুই একটা বিয়ে করে মা এনে ওকে।”

—“তুমি কি বলছো আম্মু এগুলো।বিয়ে করলে কে ওকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসবে বলো এমন কেউ নেই”

—“আছে তো তুই আরিশা মাকে বিয়ে করে নে।মেয়েটা তোকেও ভীষণ ভালোবাসে আর অর্নিশা তো তার মামনি বলতে পাগল।তাই বলছি কি বিয়ে করে নে বাবা”

—“এটা হয় না আম্মু”

—“কেনো হয় না তুই কি এখনো সেই আগের স্মৃতি নিয়ে পরে আছিস”

—“এমন কিছুই না আম্মু তাহলে সমস্যাটা কি তোর আরিশাকে বিয়ে করতে আমার অর্নিশা মা পাবে।আর আরিশা মেয়েটা কতো কষ্ট করবে।প্রতিদিন এখানে আসতেও তো কষ্ট হয় নাকি”

—“আচ্ছা ঠিক আছে রাজি আমি।আমার অর্নিশা মায়ের জন্য সব করতে পারি আমি।বিয়ে করবো কালকেই কোনো অনুষ্ঠান হবে না।রাজি থাকলে আমি বিয়ে করতে রাজি আছি”

আরিশার চোখে পানি।যাক শেষ পর্যন্ত সে তার ভালোবাসার মানুষকে পাচ্ছে।অর্নিশার কান্নার আওয়াজে ছুটে যায় ইয়াদের রুমে আরিশা।মেয়েটা কাঁদছে।আরিশা কোলে তুলে নিয়ে বলে,,

—“এইতো অর্নিশা মা তোমার মামনি চলে এসেছে কাঁদে না মা।চলো দাদুভাইয়ের কাছে যাই”

অর্নিশার কান্না থেমে যায়।আরিশার গলা জড়িয়ে ধরে।আরিশা ওকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে।অর্নিশা রুশানকে দেখে আধো আধো গলায় মামু বলে চিল্লিয়ে উঠে।রুশান কোলে তুলে নেয় অর্নিশাকে।অর্নিশা খেলছে মামুর সাথে।আরিশার চোখে পানি।মেয়েটা দেড় বছর যাবত মায়ের সান্নিধ্য পায় না।তাকেই মা ভাবে।আরশিও যে বড্ড ভালোবাসে তার অর্নিশাকে।তার আপুর মেয়ে মানে তার ও মেয়ে।এখন থেকে দু’জন ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকতে পারবে ভাবতেই কিছুটা কষ্ট কমেছে আরিশার।

৭৭.

—‘ইলমা’

ইলমা পিছন ঘুরে বলল,,,”হ্যাঁ রুশান বলুন”

রুশান অসহায় কন্ঠে বলল,,,”আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরবো।জানি অন্যায় আবদার করে ফেলছি তবুও একবার”

ইলমা বোঝে রুশানের পরিস্থিতি।নিজের বেস্টফ্রেন্ড&বোনকে হারিয়েছে।লোকটা তো প্রথম ৬ মাস নিজেকে রুমে আটকে রেখেছিলো।কারো সাথে কথা বলতো না।না কারো সাথে দেখা করতো।ইলমা ততদিনে বুঝে গিয়েছিলো সেও বড্ড ভালোবাসে রুশানকে।কিন্তু তাদের সুখপাখি উড়ে গিয়েছে।সবার সুখে থাকার কারণটাই হারিয়ে গিয়েছে।তার দা ভাই….!

—“আপনি আমায় জড়িয়ে ধরতে পারেন রুশান”

রুশান ঝাপটে ধরলো ইলমাকে।ইলমাও আলতো হাতে জড়িয়ে নিলো তার ভালোবাসার মানুষকে।রুশান কাঁদছে।এতদিন সে কাঁদেনি।অর্ষাকে হারানোর পর কাঁদেনি রুশান কারো সামনে।আজকে ইলমার সান্নিধ্যে পেয়ে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।ইলমার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে।ইলমা কিছু বলছে না।লোকটা কাঁদুক।অনেক তো হলো নিজেকে লুকিয়ে রাখা এখন না হয় তার সামনে কেঁদে নিজেকে একটু হালকা করুক।

—“ইলমা আমার অর্ষার সাথেই কেনো এমন হলো।ইরহাম ভাইয়া অর্নিশা ওদের সাথেই কেনো এমন হলো।আমি নিজেকে বোঝাতে পারছি না ইলমা আমার অর্ষু আর নেই।আর কখনো ফিরবে না।আমাকে আর রুশাইন্না বলে ডাকবে না।কেনো হলো এমন।আল্লাহ আমাকে নিতো কিন্তু আমার অর্ষু বেঁচে থাকতো।তাহলে তো এতো কষ্ট কারো হতো না”

ইলমাও কেঁদে উঠে।ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে অর্ষাকে।তাই তো এখনও মেনে নিতে পারলো না।দুজন মানুষ অর্ষাকে ভীষণ ভালোবাসতো এক ইরহাম আরেক রুশান।একজন তো পাগল হয়েছে।আরেক জন মরার মতো বেঁচে আছে।এতো ভালো কেউ বাসতে পারে কোনো বেস্টফ্রেন্ড বা বোনকে।সবার সম্পর্ক যেনো রুশান অর্ষার মতো হয়।

—“রুশান আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।আপনি কান্না থামান।ভাবিমনি নেই তো কি হয়েছে তার একমাত্র চিহ্ন তো সে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছে।আমরা তাকে নিয়ে বাঁচবো।তাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবো”

রুশান ইলমাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাড়ায়।নাক মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।নাক টানছে।পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুখ মুছে নিলো।ইলমার দিকে অপরাধীর ন্যায় তাকিয়ে বলল,,,

—“আমি খুবই দুঃখিত তোমাকে জড়িয়ে ধরা মোটেও ঠিক হয়নি আমার।একটু ইমোশনাল হয়ে পরেছিলাম।দুঃখিত”

ইলমা হেসে বলে,,,”এতো বার দুঃখিত বলার প্রয়োজন নেই”

রুশান ছাদ থেকে নেমে পরে দ্রুত।আবার আরিশাকে নিয়ে বাড়িতে যেতে হবে।সেখানকার অবস্থাও ভালো না।গত দেড় বছর যাবত সবাই কেমন পাথর হয়ে গিয়েছে।বাড়িতেও শান্তি নেই।আনাচে কানাচে অর্ষার স্মৃতি দিয়ে ভরা।আরিশাকে তাড়া দিয়ে বের হয় বাড়ি থেকে।

৭৮.

লাল একটা শাড়ি পরে বসে আছে আরিশা।ইয়াদ হয়তো একটু পরেই চলে আসবে।মুখে মেকাপ নেই।চুলে শুধু দুইটা গোলাপ গোঁজা।চোখে কাজল দেয়া।এটুকুই যথেষ্ট।মৌ বেগম ইরিনা বেগমকে সাহায্য করছে।ইরিনা বেগমের কষ্ট হচ্ছে।প্রথমে অর্ষা যাকে সে হাজার চেষ্টা করলেও ফিরিয়ে আনতে পারবে না।এখন আবার আরিশাকেও বিদায় দিতে হবে।মনটা হুহু করে উঠছে।তাও নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে এতে তার নাতনিটা ভালো থাকবে।

ইয়াদ এসে পরেছে।সাথে ইসফাক আর ইলমা।অর্নিশাও লাল টুকটুকে ফ্রক পড়া।মেয়েটা দেখতে হুবহু অর্ষার মতো।ইয়াদ গম্ভীর মুখে ভেতরে ঢুকে।আজ দেড় বছর প্রায়ই হাসে না কেউই।শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।অর্ষা যে অতি আদরের ছিলো সবার কাছে।

—“আব্বু মা..মলির কাতে যাবো”

—“হ্যা মা এখনই যাবো”

সবাই ভেতরে ঢোকে।সবাই মলিন মুখে কথা বলে।কাজি বিয়ে পরিয়ে দেয়।আরিশা এখন ইয়াদের বউ।তার বিয়েটা হয়ে গেলো শেষ পর্যন্ত ইয়াদের সাথে।এখন তার অনেক সুখী হওয়ার কথা তবুও পারছে না সে।এতো খুশির মুহুর্তে তার বোন নেই।রুশান দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।দুষ্ট রুশান এখন শান্ত গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।হাসতে ভুলে গিয়েছে।আরিশাকে বিদায় দিলো সবাই।অর্নিশা তো মামনির কোল থেকে সরছেই না।

#চলবে…!

আসসালামু আলাইকুম।প্লিজ কেউ বকা দিয়েন না🤧শেষটা সুন্দর হবে ইনশাআল্লাহ।💙

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here