ভালোবাসার রাত ২ পর্ব ১৩+১৪

#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৩+১৪)

রাত চট করে উঠে দাড়ালো। মায়ের রুম থেকে বের হতে হতে বললো,,

“” আম্মু,আমার আর ভালোবাসি শোনা লাগবেনা। আমার এখন কবুল চাই। তুমি বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দাও!””

রাতের চলে যাওয়ার পানে তিয়ামতী হা করে তাকিয়ে রইলো।

~~

রাতের চোখে,মুখে ফুটছে সুখ তারার জ্বলজ্বল আলো। যা পাওয়ার জন্য সে অধির আগ্রহে দিন থেকে রাত পার করে এসেছে,তা তার চোখের সামনেই ছিলো। কিন্তু সে টের পেলোনা। দ্রুতপদে নিজের রুম পেরিয়ে সন্ধ্যার রুমে এগুচ্ছে। এই তো আর কয়েক কদম তারপরই সে এক অন্য সন্ধ্যাকে অনুভব করবে,তার দুষ্টু সন্ধ্যা,তার দুষ্টুবধু,স্বপ্নবধু!

সন্ধ্যার রুমের দরজার কাছে পা ফেলতেই বন্ধ দরজা খুলে গেলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সায়ন। রাত আর সায়ন,দুজন দুজনার মুখোমুখি। একজনের দৃষ্টিতে ফুটছে অবিশ্বাস্যতা,তো আরেকজনের চোখে লুকোচুড়ি। রাত বিস্ময়ের তীব্রঅবস্থায় গিয়ে ছোট্ট করে বললো,,

“” তুই?””

রাতের প্রশ্নে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে সায়ন। বিক্ষিপ্ত চাহনি নিয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। গলা শুকিয়ে এসেছে তার,শুকনো গলাটা ভেজাতে গিয়েও পারলোনা। এক অস্থিরতায় ঘেমে-নেয়ে উঠছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। রাত তখনো ওর দিকেই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রাতের দ্বিতীয় প্রশ্ন,,

“” এতো রাতে এখানে কি?””

এবার সায়নের কেঁদে দেওয়ার অবস্থা। নিজের দুটি হাত দিয়ে শার্টের কলারটা নাড়িয়ে আমতা আমতা করছে। কি বলতে চাচ্ছে? কি বলবে?? তার শব্দ ভান্ডার থেকে কোনো শব্দই খুজে পাচ্ছেনা সে।

“” সন্ধ্যার রুমে কি করছিলি?””

রাতের তৃতীয় প্রশ্নে সায়ন আর চুপ থাকতে পারলোনা। কিছু একটা বলতে যাবে,অমনি সন্ধ্যা চেচিয়ে উঠলো,,

“” রাত ভাইয়া? তুমি বাইরে কি করছো? ভেতরে আসো,জলদি!””

সন্ধ্যার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার সায়নের দিকেই দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে রাতের। আচমকা সায়নের কলার চেপে ধরলো।

“” চুপ করে আছিস কেন? দরজা বন্ধ করে কি করছিলি?””

সায়নের উত্তর শোনার সময়টুকু পেলোনা রাত। সন্ধ্যা দৌড়ে এসে রাতের হাত ধরে টানতে টানতে বললো,,

“” তুমি উনার সাথে কি কথা বলছো? আমার তোমার সাথে কথা আছে। আসোনা। গোপন কথা!””

সায়নের কলার চেপে ধরা অবস্থায় সন্ধ্যার দিকে তাকালো রাত। এই সুযোগে সায়নও নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রস্থান করেছে।

রাতকে টানতে টানতে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে সন্ধ্যা। নিজের বিছানাতে ওকে বসিয়ে নিজেও বসলো। দুজনেই দুজনের মুখোমুখি। একে অপরের দৃষ্টিতে নিরবতা পালন করছে। যে খুশির ঐশ্বর্য নিয়ে হাজির হয়েছিলো রাত তা নিস্তেজ, কিন্তু সন্ধ্যা? ওর চোখে মুখে কোন খুশির আভা?? নিরবতা কাটিয়ে সন্ধ্যা নড়েচড়ে বসলো। মুখে অভিমান নিয়ে বললো,,

“” তুমি এতক্ষন কোথায় ছিলে,রাত ভাইয়া? জানো আজ কি হয়েছে? আমার ওতো সুন্দর করে সাজানো জন্মদিনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। ইশ! আমার কত কষ্ট হয়েছে। আমি তো কান্নাও করছিলাম। তুমি এলেনা কেন? আমাকে একটু শান্তনাও দিলেনা। আমি তো তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসোনা,গিফটও দাওনি!””

সন্ধ্যা নিজের অভিযোগ তুলে দিয়ে একটু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এতে রাতের বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া হলোনা। তার দৃষ্টি তখনো আগের মতোই সন্ধ্যার উপর স্থির। তবে অপেক্ষায় আছে সন্ধ্যার কথা শোনার জন্য। সে এতটুকু ঠিক বুঝতে পেরেছে সন্ধ্যা আরো কিছু বলবে তারজন্য রাতের প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। ও নিজ থেকে বলবে। রাতের ভাবনা সঠিক করেই সন্ধ্যা আবার রাতের দিকে মুখ করে বসলো। তবে এখন ওর মুখে ফুটছে কিছুর ঝিলিক,সাথে লজ্জিত বিণ! সন্ধ্যা রাতের পাশে রাখা বালিশটার দিকে ইশারা করে বললো,,

“” আমি ওখানটায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছিলাম,আর ঠিক তখনি সায়ন ভাইয়া এলো। আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,সন্ধ্যামনি তুমি আমার কাছ থেকে গিফট নিবেনা? আমি তো তখন কেঁদেকেটে কালো হয়ে গিয়েছিলাম,তাও উনি কি সুন্দর আমার প্রশংসা করলেন। আদুরী কথা বললেন,আমাকে একটা জোকসও শোনালেন। আর আমিও হেঁসে কুটিকুটি। তুমি কি জোকসটা শুনবে?””

রাতের কাছ থেকে উত্তর না শুনেই সন্ধ্যা নিজেই বললো,,

“” অন্যদিন শোনাবো,কেমন? যখন তোমার মন খারাপ থাকবে তখন। তারপর কি হলো জানো?? এই যে এখন তুমি যেখানে বসে আছো,এই জায়গাটাই আমাকে বসালো। আর উনি আমার জায়গায়। তারপর…””

রাত সন্ধ্যার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। যেন কথার মাঝ থেকে একটা শব্দও সে মিস করতে চায়না। কিন্তু সন্ধ্যা দম নেওয়ার জন্য একটু থেমে যাওয়াটাও সে সহ্য করতে পারছিলোনা। তার এখনি শুনতে হবে,সবটা। রাত অস্থিরতার সহিত বললো,,

“” তারপর?””

রাতের মুখের তারপরটা শুনে সন্ধ্যা নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে,লজ্জায় রাঙিয়ে নিচ্ছে মুখটা। সন্ধ্যার এই নিশ্চুপটা সে মেনে নিতে পারছিলোনা। অনেকটা সন্ধ্যার দিকে ঝুকে এসে বললো,,

“” কি হলো বল,তারপর কি হলো?””

সন্ধ্যা ধীরে ধীরে চোখের পাতা উল্টিয়ে রাতের দিকে তাকালো। যেন সকল মায়া নিজের চোখে বন্দী করে নিয়েছে। রাতের চোখের পাতা তখনো কাঁপছে। সন্ধ্যার এমন অদ্ভুত আচরনে ওর সবকিছু ভেঙে যাওয়ার অবস্থা।

“” চোখ বন্ধ করো।””
“” কেন?””
“” বন্ধ না করলে বলবো কিভাবে?””
“” বলবি তুই আর চোখ বন্ধ করবো আমি?””
“” হুম,তুমি দেখছোনা,আমি বলার আগেই কেমন লজ্জায় মিশে যাচ্ছি,তাহলে বললে তো আমাকে খুজেই পাবেনা।””
“” তাহলে তুই চোখ বন্ধ করে বল।””
“” দুর,তোমাকে বলবোইনা। তুমি আমার একটা কথাও শুনোনা।””

সন্ধ্যা উঠে চলে যাবে রাত সাথে সাথে বললো,,

“” করেছি,বল।””

রাত চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সন্ধ্যা কি বলবে তা শোনার গাঢ় অপেক্ষায়। পুরো মনোযোগ কানে!

সন্ধ্যা রাতের আরেকটু কাছে এসে বসলো। রাতের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,,

“” নো চিটিং,চোখ খুলবেনা কিন্তু!””
“” ওকে,এবার তো বল।””

সন্ধ্যা আর সময় নষ্ট না করে টুপ করে রাতের ঠোঁটে চুমু খেয়ে নিলো। সাথে সাথে নিজের মুখটা দুহাতে ঢেকে বললো,,

“” এমন করে চুমু খেয়ে বললো,I love you!””

রাত সন্ধ্যার মুখ থেকে হাত সরিয়ে কঠিন সুরে বললো,,

“” সায়ন তোকে ছুয়েছে?””
“” না,চুমু খেয়েছে। তারপর প্রপোস করেছে।””

রাত বসা থেকে উঠে পড়লো।

“” তুই মিথ্যে বলছিস।””

সন্ধ্যাও উঠে দাড়ালো। রাতের সামনে গিয়ে বললো,,

“” আমি কেন মিথ্যে বলবো?””

রাত উল্টোঘুরে বললো,,

“”জানিনা। কিন্তু তুই মিথ্যে বলছিস,সন্ধ্যা।””

সন্ধ্যা রাতকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।

“” তুমি অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছো কেন? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বললে কি তোমার চোখ খসে পড়বে?””
“” ও তোকে ভালোবাসতে পারেনা।””
“” কেন বাসতে পারেনা? তুমি জানো আমাকে কত ভালো ভালো কথা বললো,আদর করলো,চুমুও তো খেলো। চুমু খাওয়ার পর প্রপোস করেছে মানে সত্যি ভালোবাসে। তুমি মুভিতে দেখোনা,নায়ক আগে নায়িকাকে চুমু খায়,তারপর বুঝতে পারে সে নায়িকাকে ভালোবাসে। সায়ন ভাইয়াও তো তাই করলো। তারমানে চুমু খাওয়ার পর বুঝেছে সে আমাকে আসলেই ভালোবাসে,তাই প্রপোসও করেছে। আর আমিও তো..””
“” তুই কি?””

সন্ধ্যা আবার লজ্জায় মেখে গিয়ে বললো,,

“” আমিও তো Lavutu (love you 2)বললাম!””

সন্ধ্যা পুনরায় দুইহাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে নিয়েছে।

রাত সন্ধ্যাকে কিছু বলতে গিয়েও পারছেনা। দোটানায় ভুগছে সে,না দোটানা নয় তিটানায় ভুগছে,মায়ের বলা সন্ধ্যার ভালোবাসার কথা বিশ্বাস করবে নাকি সন্ধ্যার এখন বাস্তবমুখী মুখরোচক কথা আর কান্ডে নাকি সায়নের বন্ধুত্বের?? কোনটাকে সে মিথ্যে প্রমাণ করবে?? যে কেউ একজন তো মিথ্যে বলছে,সেটা কে??

রাতের মাথা, না সারা শরীরের পরপর বিছিয়ে রাখা সকল যন্ত্রগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মাথায় কিছু আসছেনা,কোনো ভাবনা-চিন্তারা উকি দিচ্ছেনা। রাতের ইচ্ছে হচ্ছে নিজের চুল নিজে ছিড়ে ফেলতে,নিজের শরীরের মাংসপিন্ডগুলোকে আলাদা করে পাটাতে পিষে ফেলতে! হায় আল্লাহ! এ কেমন অনুভূতি??

রাতের দ্রুত পায়চারী দেখে সন্ধ্যা মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললো,,

“” তুমি কি আমার রুমটাকে মাঠ বানিয়ে ফেলেছো? এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন?””

রাত সন্ধ্যার দু-গাল আলতো করে চেপে ধরলো। বুকভর্তি আশ্বাসের নিশ্বাস নিয়ে বললো,,

“” বল,তুই মিথ্যে বলছিস!””

সন্ধ্যার ভ্রু নাচিয়ে উত্তর,,

“” কি?””
“” সায়ন তোকে ছুতে পারেনা।””
“” আমি কখন বললাম উনি আমাকে ছুয়েছে? উনি তো আমাকে চুম…””

সন্ধ্যার মুখ চেপে ধরে আছে রাত। তাতে সন্ধ্যা বড়বড় করে চোখ উল্টিয়ে তাকিয়ে রইলো রাতের দিকে। মুখটা খোলা থাকলে,ওর এখনকার কথা হতো,রাত ভাইয়া তুমি পায়ের নিচের থেকে কয়েক ইঞ্চি কেটে ফেলবে প্লিজ? আমার তোমার দিকে তাকাতে হলে,চোখের সব শক্তি শেষ হয়ে যায়। উফ! তোমাকে দেখতে এতো কষ্ট করতে হয় কেন?

চোখের ঘাপটি মেরে থাকা জলকণাদের দেখা কি পাচ্ছে সন্ধ্যা?? যদি ভালোই বেসে থাকে তাহলে এভাবে কষ্ট কেন দিচ্ছে?? ও তো আমার সম্পদ! আমার সম্পদে অন্য কেউ কি করে ছুবে? কেউ তাকালেও যে তার চোখ থেকে মনিদুটো আলাদা করার জন্য,আমি দ্বিতীয়বার ভাববোনা।

রাতের অমন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সন্ধ্যার পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। ঐ চোখে আর তাকিয়ে থাকতে পারছেনা সে। দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে রাতের হাতে খামচাতে লাগলো।

রাত ওকে ছেড়ে দিতেই সন্ধ্যা বুকের ঠিক মাঝ বরাবর ডান হাতটা রেখে হা করে নিশ্বাস খেতে খেতে বললো,,

“” আরেকটু হলেই তো আমি শ্বাসকষ্টে মরে যেতাম। তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন গো রাত ভাইয়া? আমার নয়া প্রেমের বাতি জ্বালানোর আগেই তুমি নিবিয়ে দিতে চাচ্ছো?””

রাত সন্ধ্যার কাছে আর একদন্ডও দাড়িয়ে থাকতে পারলোনা। তোকে মারার মতো দুঃসাধ্য আমার নেইরে,এমনটা ভাবার আগেও যেন আমি পৃথিবী ত্যাগ করি!

~~

সায়ন গভীরঘুমে স্বপ্নে উড়ে বেড়াচ্ছিলো ঠিক তখনি ভূমিকম্পের মতো সবটা কেঁপে উঠেছে। ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে পড়লো। চারপাশে কি হচ্ছে তা বুঝার আগেই বাজ পড়ার মতো শব্দ কানে এসেছে। অনেকটা ব্যাঙের মতো লাফানো ভঙ্গিতে শব্দানুসারে রুম থেকে বের হচ্ছে,এর মধ্যে মায়ের সেই বাজখাঁই কন্ঠ। গুরুতর কিছু একটা হচ্ছে সে আন্দাজে ড্রয়িং রুমে ছুটে এলো সায়ন।

“” রাত, না না ভাই আমার ফ্রিজে হাত দিসনা,তাহলে আমার মায়ের একসাথে তিন/চারটে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। রাত প্লিজ, আমার কথা তো শোন!””

রাত অগ্নিপ্রলয়ের দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে ফ্রিজের মধ্যে কাঠের চেয়ারটা বাড়ি মারলো। সায়ন কোনো প্রতিক্রিয়া করা ভুলে গিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়েছে,আর সাথে সাথে ওর আম্মু মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

সায়ন আম্মুর দিকে ছুটে যাবে তার আগেই ওর কলারটা খামচে ধরে ফেলেছে রাত। কন্ঠে বর্জ্যপাতের মতো গর্জন টেনে বললো,,

“” তুই এতো রাতে আমার বাসায় কি করছিলি?? বল কি করছিলি???””

রাতের চিৎকারে সায়নের কান ফেটে রক্ত বের হওয়ার উপক্রম। নিজের দুটি হাত দিয়ে তার ফাস লেগে যাওয়া রাতের হাতটা আটকে নিবে নাকি কানগুলো চেপে ধরবে?? সায়নের ভাবনার অন্তরে গিয়ে রাত আবার গর্জে উঠে,,

“” আমার সন্ধ্যা,আমার স্বপ্নবধুর রুমে তুই কেন গিয়েছিলি? কেন ছুয়েছিস? তোর এতো সাহস কি করে হলো?? আজ তোকে আমি খুন করে ফেলবো!””

রাত প্রচন্ড রাগী সেটা সায়নের অজানা নয়,কিন্তু এতোটা তার অজানা। সে জানা-অজানার মাঝে এতোটাই প্রভাবিত যে সে পাথরের মতো শক্ত হয়ে পুরো শরীর তার অসার হয়ে আসছে। ভয়ে চোখদুটো ঠিকরে বের হয়ে আসবে এমনি বড়বড় করে প্রাণহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাতের দিকে,গলাটা তার জলশূন্য হয়ে মরুভূতির খড়খড়েতে ডুবে যাচ্ছে।

~~

ঘুম থেকে উঠে,সন্ধ্যা প্রথম যে কাজটা করলো তা হলো রাতের রুমে একটু ঢু মারা। দরজার চিকন ফাঁকা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে যখন কারো কোনো দেখা পেলোনা তখন দরজাটা ধাক্কা দিয়ে পুরোটা খুলে নিয়েছে। রুমের ভেতরে ঢুকে এদিক-সেদিক,খাটের উপরনিচ,বাথরুমসহ চারপাশটা চোখ বুলিয়ে কোথাও পেলোনা। ল্যাম্পসেটের পাশেই রুপোলি রঙের ছোট্ট এলার্মঘড়িটা কটকট করে বেজে উঠেছে। সন্ধ্যা কিছুটা ছিটকে গিয়ে ঘড়িটার দিকে তাকালো। ঘড়ি তার কটকট বাজনা দিয়ে জানান দিচ্ছে ৬ঃ৩০ বাজে। সন্ধ্যা ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুব দিলো। কালকের ঘটে যাওয়া সবটা মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠেছে। ডোজটা কি বেশি পড়ে গিয়েছিলো?? নাহলে সকাল সকাল এমন লাপাত্তা কি করে হলো?

~~

সন্ধ্যা বেশ উদাসহীন চিন্তিত হয়ে আনমনে পা ফেলে নিজের রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ভালো লাগছেনা তার,উশখুশে মনটা কিছু তো আন্দাজ করতে পারছে কিন্তু সেটা কি?? রাত ভাইয়া আবার ভুলভাল কিছু করে বসেনি তো??

সন্ধ্যার ভাবনার রাজ্যে বাধা দিলো তার ফোনের তীব্র সুরেলা রিংটোন। অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা হাতে নিতেই দেখে রাত কল করেছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,,

“” তাড়াতাড়ি,আশামনি ক্লিনিকে চলে আয়।””

হসপিটাল শব্দটা শুনেই সন্ধ্যার পিল চমকে উঠেছে। হসপিটাল শব্দের প্রত্যেকটা অক্ষর যেন তার বুকে ছিদ্র করে রক্তপাত বয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যা ভয়ার্ত নিশ্বাস টেনে তখনি ছুটলো হসপিটালের উদ্দশ্যে।

~~

সন্ধ্যা শ্বাসরুদ্ধকর আতংক নিয়ে হসপিটালে পৌছিয়েছে। ভেতরে ঢুকে এদিকওদিক তাকাতেই রাতকে দেখতে পেলো। একটি মেয়ে ডাক্তারের সাথে বেশ গাম্ভীর্যের সাথে ভাব বিনিময় করছে। সন্ধ্যা দৌড়ে গিয়ে রাতকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। এবার তার থমকে রাখা নিশ্বাসটা ছাড়ার পালা।

রাত স্বাভাবিক গলায় বললো,,

“” এভাবে কেউ ধরে? আমিতো টাল সামলাতে না পেরে ডক্টরনীর উপর পড়ে যাচ্ছিলাম।””

সন্ধ্যা রাতকে ছেড়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। পা হতে মাথা অবধি সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে বললো,,

“” কই তোমার তো কোথাও কিছু হয়নি,দিব্যি দাড়িয়ে আছো,শ্বাসকষ্ট,বুক ব্যথা,পেট ব্যথারও তো লক্ষণ দেখছিনা। তাহলে আমাকে এখানে ডাকলে কেন?””
“” হয়েছে তো,হৃদব্যথা ঐ ডক্তরনীকে দেখে। তুই এমন সময় এন্ট্রি নিলি তাও সোজা এমনভাবে ঝাপটে ধরলি যে উনি বিরক্ত হয়ে চলে গেলো। যাহ! নাম্বারটাও নেওয়া হলোনা।””

সন্ধ্যা নাক,মুখ কুঁচকিয়ে রাতের দিকে তাকালো। বিদ্রুপ করে কিছু বলতে যাবে তখনি সায়নের কথা মনে পড়ে গেলো। সন্ধ্যা কাঁপুনি স্বরে বললো,,

“” সায়ন ভাইয়া কোথায়?””

রাত সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তরে ওর পেছনে তাকালো। সন্ধ্যাও দৃষ্টানুসারে সেদিকে তাকিয়েছে। সায়ন ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। সন্ধ্যা এবার সন্দেহিভাবে বললো,,

“” তুমি সায়ন ভাইয়াকে কিছু করোনি?””

রাতের পাল্টা প্রশ্ন,,,

“” কিছু করার কথা ছিলো নাকি?””

সন্ধ্যা ওদিকওদিক চোখ বুলিয়ে নিলো। সন্দেহে তার পেটভর্তি। এতোবড় কাহিনির ঘোলটা এতো সহজে কি করে হজম করে নিয়েছে? এতো স্বাভাবিকই আচরন করছে কিভাবে?? কিছু তো একটা হয়েছে,কিন্তু সেটা কি??

সন্ধ্যা ভাবনার তালে ডানহাতের বৃদ্ধা আঙুলটি অজান্তেই মুখে দিয়ে ফেলেছে,দাঁত দিয়ে নখ চিড়ে নিচ্ছে।

“” তুই কি নখ খাওয়ার জন্য ক্লিনিকে এসেছিস?””

রাতের প্রশ্নের সাথে তাল মিলিয়ে সন্ধ্যা একটু জোরগলায় বললো,,

“” ঐটাই তো,আমি এখানে কেন এসেছি?””
“” সেবা করতে।””
“” সেবা? কার??””

সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বদলে ওর একটা হাত ধরে টেনে ডানপাশের লম্বা করিডোরে হাটা ধরেছে রাত। কিছুদুর এগিয়ে সোজা একটা কেবিনে ঢুকে পড়লো। সন্ধ্যা তখনো রাতের দিকেই তাকিয়ে আছে। রাত রহস্যময়ী কন্ঠে বললো,,

“” সামনে তাকা!””

সন্ধ্যা সাদা বেডের উপরে একজন বয়স্ক মহিলাকে শুয়ে রয়েছে দেখতে পাচ্ছে। রাতের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকাতেই ও বললো,,

“” তোর শ্বাশুড়ি,এখনো হয়নি,হবুতে আটকে আছে।””
“” মানে?””
“”তোর চুমুপ্রেমির আম্মাজান হয় উনি। শুধু তো চুমু খেয়ে লজ্জা পেলেই বউ হয়ে যাবিনা,শ্বাশুড়ির সেবাও করতে হবে।””
“”শ্বাশুড়ি?””
“” কাল কি বার রে?””
“” আমি কি জানি!””
“”তোর জানতে হবেনা,আমি জানলেই হবে। কাল তোর আর সায়নের আংটি বদল হবে আর পরশু মানে শুক্রবার বিয়ে।””

রাতের কথাতে সন্ধ্যা হা হয়ে দাড়িয়ে রইলো। সে কি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে?

রাত তার নিজের বক্তব্য শেষ করে ক্লিনিক থেকে বের হওয়ার জন্য দ্রুত পদে হেঁটে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নিজের মুখটা বন্ধ করে রাতের পিছু পিছু হাঁটছে।

“” রাত ভাইয়া,শুনোনা। আমি বিয়ে করতে পারবোনা।””

রাত চলতি পথেই বললো,,

“” কেন?””
“” আমার তো এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।””
“” প্রেমের বয়স হয়েছে তো তাতেই হবে।””

রাতের হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে উঠতে পারছেনা সন্ধ্যা। মাঝে মাঝেই পায়ে পায়ে বাড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। একটু পিছিয়ে পড়লে দৌড়ে আবার রাতের পাশাপাশি ছুটতে ছুটতে বললো,,

“” প্রেম আর বিয়ে কি এক হলো?””
“” অবশ্যই এক,বিয়ে হলেও চুমু খায় প্রেম করলেও চুমু খায়। তাহলে এক হলোনা? তোদের প্রেম শুরু হওয়ার আগেই চুমু হয়ে গিয়েছে,পরে দেখা যাবে বিয়ের আগে বাবু হয়ে গিয়েছে,বিয়ে ছাড়া বাচ্চার মা হবি তুই। ছি! শুনতেই কেমন লাগছে,আর হলে কেমন দেখাবে ভাব।””

সন্ধ্যা এবার কড়া গলায় বললো,,

“” রাত ভাইয়া!””

সন্ধ্যার ডাকে রাত স্থির হয়ে দাড়িয়ে বললো,,

“” আমি ভুল কিছু বলেছি? তুই মুভিতে দেখিসনি বিয়ের আগে বাবু হতে?””

সন্ধ্যা মাথা নিচু করে বললো,,

“” আমি বিয়ে করতে পারবোনা।””
“” কেন পারবিনা? এখন তো তোর আঠারো হয়ে গিয়েছে,তুই তো বলেছিলি আঠারো হলেই যেন তোকে..””
“” ওটাতো আমি তোমাকে..””
“” আমাকে কি?””
“” আমি বলছি বিয়ে করবোনা মানে করবোনা। আমি আরো পড়াশুনা করবো,বড় বড় দালানে চাকরী করবো,দুর শহরে ঘুরতে যাবো। তারপর বিয়ে করবো।””
“” আগে বিয়ে কর তারপর যা খুশি করিস!””

রাত আবার হাঁটা ধরলে সন্ধ্যাও আবার পিছু নিয়েছে। ওর আকুতি শোনার সময়টুকুও যেন রাতের নেই। রাত ক্লিনিক থেকে বেড়িয়ে উল্টো হয়ে দাড়াতেই সন্ধ্যার সাথে ধাক্কা খেলো।

“” আমার পিছু পিছু না ঘুরে তোর চুমুপ্রেমীর সাথে বিয়ের প্ল্যান কর,আর শ্বাশুড়ির সেবাযত্ন কর।কাজে লাগবে।””

চলবে

#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৪)

রাত আবার হাঁটা ধরলে সন্ধ্যাও আবার পিছু নিয়েছে। ওর আকুতি শোনার সময়টুকুও যেন রাতের নেই। রাত ক্লিনিক থেকে বেড়িয়ে উল্টো হয়ে দাড়াতেই সন্ধ্যার সাথে ধাক্কা খেলো।

“” আমার পিছু পিছু না ঘুরে তোর চুমুপ্রেমীর সাথে বিয়ের প্ল্যান কর,আর শ্বাশুড়ির সেবাযত্ন কর।কাজে লাগবে।””

~~

নাকে ঘামের বদলে বিরক্ত লেগে রয়েছে রিমার। আজ রিনাটা আসেনি। একা একা সে কতটা সামলাবে?? রান্নাঘরের চুলার আঁচে শরীর ভিজে গিয়েছে তার। তরকারির তীব্র ঝাঝালো গন্ধ তার একদম সহ্য হয়না,গন্ধ নাকে বাড়ি খেলেই লাগাতার হাঁচি শুরু হয়ে যায়। অথচ তাকেই রান্নার দায়ভারটা সামলাতে হয়। নাকের সামনে শাড়ীর আঁচলটা চেপে নিয়ে মশলা কষাচ্ছেন আর নানা ত্যক্তকথা আউড়াচ্ছিলেন রিমা। কিন্তু সুতি কাপড়ের সরু সুতার ফাঁক দিয়ে গন্ধ নাকে বাড়ি ঠিকই লাগছে। হয়তো অতোটা তীব্র নয়,তবুও সে আর হাঁচি আটকিয়ে রাখতে পারলোনা। কাঁপুনি দিয়ে হাঁচি দেওয়া শুরু হয়ে গেলো। পাশ থেকে তিয়ামতী নাড়ুনীটা নিয়ে মশলায় নাড়া দিতে দিতে বললো,,

“” তুই যা,আমি বাকিটা করে নিচ্ছি।””

রিমা শক্ত চাহনিতে তাকালেও কিছু বলে উঠতে পারেনি,পরপর দু/তিনটে হাঁচির দান শেষ করে মশলার মতো ঝাঝ নিয়েই বললেন,,

“” তুই আবার রান্নাঘরে এসেছিস? আমার কথা শুনতে তোর ভালো লাগেনা?? কি ভেবেছিস,সব দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে ভাইয়ার মতো পালিয়ে যাবি?””

রিমা ঝাড়ির সাথে সাথে তিয়ামতীর হাত থেকে নাড়ুনিটা ছো মেরে নিয়ে নিলেন।

“” আর কত দায়িত্বের বোঝা আমার উপর দিবি বল তো? আমি যে নুয়ে পড়ছি সে খেয়াল কি তোদের নেই?””

তিয়ামতী রিমার দিকে শান্তদৃষ্টিতে চেয়ে মুচকি হাসছে। দুটো ভাইবোন এমন কেন? ভালোবাসাগুলো সবসময় ঝাঝালো জিনিসের পেছনেই রাখে। একটু সামনে রাখলে কি খুব খারাপ হবে??

কষানো মশলাতে সবজি ঢেলে দিয়ে ঢাকনা ঢেকে বললো,,

“” এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন? আবার হাঁসছিসও। সমস্যা কি তোর? আমাকে দেখে তোর হাঁসি পাচ্ছে?? আমি কি রঙ মেখে সঙ সেজে আছি? তোকে সার্কাস দেখাচ্ছি?””

তিয়ামতী ওর কথার বিপরীতে রিমাকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,,

“” তোরা আমাকে এতো ভালোবাসিস কেন বলতো?””
“” এখানে ভালোবাসা কোথা থেকে আসলো?””
“” আমার না মাঝে মাঝে তোকে জড়িয়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করে। সেই যে ৮ বছর আগে আম্মুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলাম তারপর তো আর এ সুখটা পাওয়া হয়নি। ইদানিং আমার বাচ্চাদের মতো ইচ্ছে জাগে। এই যেমন এখন তোকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।””

তিয়ামতী নিজের ইচ্ছে পেশ করার সাথে সাথে রিমার গালে চুমু খেয়ে আবার ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে রিমার। মেয়েটা স্বামীসুখটাও পেলোনা! আমার বান্ধবীটাই কেন এমন অভাগী হয়ে জন্মালো?? ওর কপালে একটু কি স্বামীসুখের ফোঁটা পড়েনি?? পড়লে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?? কেন এমনটা হলো? আজ ভাইয়া থাকলে দিনগুলো অন্যরকম হতো!

চোখের কোনের পানিটা চোখেই শুকিয়ে নিলেন রিমা। ধরা গলাটা স্বাভাবিক করে বললেন,,

“” এমনি গরমে মরি মরি অবস্থা,আর তুই জড়াজড়ি শুরু করে দিয়েছিস। ছাড় তো আমাকে।””

তিয়ামতীকে জোর করে নিজ থেকে ছাড়িয়ে ওর কপালে হাত দিলো,,

“” জ্বরটা তো মনে হয় তুরতুর করে বাড়ছে। রাত কি জানে?””
“”জেনে কি হবে শুনি? ঐ তো গাদাগাদা ঔষধ ধরিয়ে দিবে। আর কত ঔষধ খাবো বল তো। আমার তো মনে হচ্ছে পুরো বিশ্বের সকল ঔষধ আমার পেটে জমে,পঁচে গলছে!””
“” তুই কি চাচ্ছিস,এই বয়সে আমার হাতে থাপ্পড় খেতে?””

তিয়ামতী নাক উচিয়ে বললো,,

“” যেমন ভাই তার তেমনি বোন। শুধু বকেই গেলো,জোর দেখিয়েই গেলো,একটু ভালোবাসলোনা!””
“” ভালোবাসার মতো কাজ করিস নাকি যে ভালোবাসবো?””

রিমা তরকারীতে ঝোল দিয়ে তিয়ামতীর দিকে এগুলো। ওকে নিয়ে সোজা ওর রুমের দিকে এগুচ্ছে।

~~

দুপুরের খাবার শেষ করে সবেই শুয়েছিলো তিয়ামতী। চোখে তার ঘুম নেই কিন্তু ঘুমেরা তাকে বড্ড জ্বালাতন করছে,চোখের পাতা ভারী করে রেখেছে অথচ পাতা বন্ধ করলে নাই। আজকাল ঘুমেরাও তার সাথে লুকোচুড়ি খেলে। তিয়ামতী চোখটা বন্ধ করে ভাবনা দুয়ারে পা ফেলবে তখনি সন্ধ্যার আগমন। বিছানার উপর ধপাস করে বসে পড়লো। তিয়ামতীর মুখের কাছে বসে শাসিয়ে বললো,,

“”তোমার ছেলেকে তুমি কিছু বলবে নাকি আমি সরবত বানিয়ে খেয়ে ফেলবো?””
“” কিসের সরবত বানাবি রে?””

সন্ধ্যার শাসানিসুর মিলে গিয়ে অভিমান বাসা বেধেছে,,

“” মামি!””
“” শুনছি বল।””
“”আমি একটা গুরুতর কথা নিয়ে এসেছি আর তুমি শোয়া থেকে উঠলেও না?””
“” রাতের নামে নালিশ দিতে এসেছিস তো? একজনের নামে আর কত নালিশ দিবি বল তো? আমি তো বিরক্ত হয়ে পড়েছি,তুই হচ্ছিস না?””
“” হতে দিলে তো হবো। তোমার ছেলে কি আমাকে একটু শান্তি দেয়?? উফ!””

তিয়ামতী এবার শোয়া থেকে আধশোয়া হলেন।

“” এবার কি হয়েছে বল তো।””
“”তোমার ছেলে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আমাকে বিয়ে দিবে।””
“” কার সাথে?””
“” মনে হচ্ছে তুমি বেশ খুশি?””
“” তাই বললাম নাকি?””
“” তাহলে কার সাথে বিয়ে সেটা জেনে তোমার কি কাজ? তুমি তোমার ছেলেকে কিছু বলবে নাকি তাই বলো।””
“” এভাবে কিভাবে বলবো? আগে তো আমায় সবটা জানতে হবে তাইনা?””

সন্ধ্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিয়ামতীকে সবটা খুলে বলছে। তিয়ামতীও বেশ মনোযোগী ভঙ্গিমায় শুনে যাচ্ছে,সাথে তাল দিয়ে মাথাটা ডানে-বায়ে,উপর-নিচ করছে। মাঝে মাঝে কপালে ভাজ ফেলে,ভ্রু সংকুচিত করে ভাবও প্রকাশ করছে।

তিয়ামতী সবটা শোনার পর আগের ন্যায় শুয়ে পড়ে বললো,,

“” যাওয়ার পথে জানালার পর্দাটা নামিয়ে দিয়ে যাস তো,আজকে রোদের তাপটা বেশিই তীব্র!””

সন্ধ্যা বসা থেকে উঠে দাড়ালো। নাক ফুলিয়ে বললো,,

“” আমি কি তোমাকে রুপকথার গল্প শোনালাম যে তুমি ঘুমাতে যাচ্ছো?””
“” আমার তো তাই মনে হলো।””
“” মামি! বুঝছি তোমরা আমাকে কেউ ভালোবাসোনা। থাকবোনা আর এ বাসায়। যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই চলে যাবো।””

সন্ধ্যা অভিমান নিয়ে বের হতে চাইলে ওকে জোর করে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়েছেন তিয়ামতী। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,

“” আমার পাগলাটাকে এতো ক্ষেপাস কেন বল তো? হয় তো সে তোর সামনে কঠিনভাবে কখনো আসেনি কিন্তু তোর তো অজানা নয় তাও এমন করিস? দেখিস লাগাম ছেড়ে যখন টগবগিয়ে উঠবে তখন কপাল চাপড়িয়ে মরবি!””
“” তাহলে আমি যা চাই সে তা দেয়না কেন?””
“” তুই কি তাকে দিয়েছিস? এভাবে চললে তো দেখা যাবে দুজন দুপথের বাসিন্দা হয়ে যাবি। তুই তো জানিস রাত তোকে কত ভালোবাসে তাও কেন ওকে এভাবে জ্বালাচ্ছিস? এবার তো বন্ধ কর!””
“” করবোনা। তোমার ছেলে যদি রিদ মামার ছেলে হয়,আমিও রিদ মামার ভাগ্নি। তার জেদ থাকলে আমারও আছে। দেখি কার জিত হয়।””

সন্ধ্যার কথায় তিয়ামতী হতবিহ্বল। সন্ধ্যা ভালোবাসার বাধন ছেড়ে উঠে পড়লে তিয়ামতী বলে উঠলো,,

“” অতি জেদ ভালোনা,হিতে বিপরীত হয়ে গেলে সামলাতে পারবিতো?””

সন্ধ্যা থমকে গেলেও আবার পা চালিয়েছে। দরজার কাছটাতে গিয়ে বললো,,

“”তোমার ছেলেকে সাবধান করে দিয়ো। ফের যদি আমার সামনে বিয়ের কথা পারতে আসে,আমি কিন্তু গলা টিপে দিবো। আর হ্যা,আমি যা চাই তা না নিয়ে তোমার ছেলের চাওয়া আমি দিবোনা। এখন সে যতই ছলছাতুরী করুকনা কেন। এই বিয়েও হবেনা আর তোমার ছেলে জিততেও পারবেনা। আগে আমার পাওনা চাই।””
“” এমনটা করা কি ঠিক হচ্ছে?? তোর কি মনে হচ্ছেনা বেশি বেশি করছিস?””

সন্ধ্যা এবার তিয়ামতীর দিকে ঘুরে দাড়ালো। দরজা ছেড়ে ওর কাছে এসে কাঠ গলায় বললো,,

“” তোমার ছেলে করতে পারলে আমিও পারি।””
“” আরে বাবা ও তো তোর কথা ভেবেই…””
“” আমি বলেছি ভাবতে? সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছি,তোমার ছেলে আমার জীবনের অতি ক্ষুদ্র পদক্ষেপের সিদ্ধান্তটাও সে নেয়। আমি কোথায় থাকবো,কিভাবে থাকবো,কোন পথে পা চালাবো,কোন জামাটা পড়বো,কোন খাবারটা খাবো,সব! সবটা তার মতে চলে আসছে। মামি,সে কেন এমন করছে এতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই,তার ইচ্ছে হলে আমি ছোট্টরুমে বন্দী থাকতেও প্রস্তুত,কিন্তু সেটা তার আমাকে বলতে হবে। অন্য কারো দ্বারা নয়। তোমার ছেলে কেন আমাকে এসে বলেনা,সন্ধ্যা তুই এমনটা করবিনা,ওমনটা করবিনা,তোকে গার্লস কলেজেই পড়তে হবে,কোনো ছেলের সাথে কথা বলবিনা। এমনটা কেন বলেনা?? কেন আব্বুর মাধ্যমে,আম্মুর মাধ্যমে নাহয় তোমার মাধ্যমে জানতে হয়?? তোমাদের হুকুম ভেবে পালন করতে হয়?? আমি তো তার হুকুম মানতে চাই। সে এটা কেন বুঝেনা?? কেন কেন কেন?””

তিয়ামতী একটু ভাব নিয়ে বললেন,,,

“” এবার তো বলেছে তাইনা? যা বিয়েটা করে ফেল,তোর ইচ্ছেও পুরন হবে আর রাতেরও!””

সন্ধ্যা চোখগুলো ছোটছোট করে রাগ রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে তিয়ামতীর দিকে। কিন্তু রাগটা পড়ার আগেই সেখানে আদ্রমায়া জায়গা করে নিয়েছে,,,

“” মামি,তোমার গলাটা এমন ফুলো ফুলো লাগছে কেন? দেখি দেখি!””

সন্ধ্যা হাত বাড়িয়ে দেখতে গেলে তিয়ামতী আটকিয়ে বললো,,

“” আরে বেহারে শুলে ঐ একটুআধটু হয়।””

তিয়ামতীর অযুহাত গায়ে মাখেনি সন্ধ্যার। দ্রুত গলায় নরম কাপড় পেচিয়ে দিতে দিতে বললো,,

“” মামি,আমি তোমার সেবা করতে চাই। অন্যকারোনা। তোমার ছেলেটাকে একটু বুঝাবে প্লিজ? নাহলে আমি কি থেকে কি করে বসবো,আমি নিজেও জানিনা। তাকে ছাড়া তো আমার দুনিয়া শুন্য!””

তিয়ামতী সন্ধ্যার গালে হাত রেখে বললো,,

“”তোদের দুটোর পাগলামি দেখলে আমার শুধু হাঁসি পায়। তুই ক্ষেপিয়েছিস,তুই শান্ত কর। লাগামটা ঠিকমতো ধরে রাখিস।””

~~

ফ্যানের ঠিক মাঝ বরাবর বিছানাতে আরাম আসনে বসে আছে রাত। কোলে ল্যাপটপ,চোখে অনুসন্ধান আর হাতের আঙুলের পায়চারী। এমন মনোবিক্ষণ হয়ে কি দেখছে?? দরজায় ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তাই ভাবছিলো সন্ধ্যা।

“” তোর বরের জন্য রিং সিলেক্ট করছি। কোনটা চায় তোর? হিরা নাকি সোনা?””

রাতের এমন দ্রুত বয়ে যাওয়া প্রশ্নে সন্ধ্যা ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। অন্যমনস্কটা ছাড়িয়ে ধপধপ পা ফেলে রাতের দিকে তেড়ে এসে বললো,,

“” তোমাকে বলেছিনা আমি বিয়ে করবোনা?””

রাত সন্ধ্যার কথা হাওয়াই উড়িয়ে দিয়েছে এমন ভাব করে নিজের ল্যপটপটাতে মনোযেগি হলো। এটাওটা টিপে সন্ধ্যার দিকে বাড়িয়ে ধরলো,,

“” দেখ এই পেজটার কালেকশান বেশ ভালো,এক্সক্লুসিভ। আমি ভেবেছি তোদের দুজনের রিং আমার পক্ষ থেকে গিফট হবে। অনলাইনেই অর্ডার করবো। এদের ডেলিভারি রেটিংও বেশ চাঙ্গা। কোনটা পছন্দ জলদি বল।””

সন্ধ্যা রাতের হাত থাকে ল্যাপটপটা কেড়ে নিতে যাবে তা বুঝতে পেরে চট করে সরিয়ে নিলো,রাত। এতে যেন সন্ধ্যার রাগ তরতর করে বেড়ে গিয়ে মাথার তালু ফুটো হয়ে যাওয়া অবস্থা। ইচ্ছে হচ্ছে ল্যাপটপকে নয় রাত ভাইয়াকে তুলে একটা আছাড় মারতে,এই গাম্বুসটাকে তো একটা মারলে হবেনা,অনেকগুলো মারতে হবে,কম করে হলেও শতাধিক।

রাত ল্যাপটপটা অন্যপাশে রেখে বললো,,

“” কি করতে যাচ্ছিলি এটা? আমি পুরো দুঘন্টা ধরে এই দুটো আংটি খুজে বের করেছি। আমার এতো পরিশ্রম তুই এভাবে মাটিতে আছাড় মারতে চাইছিলি?””

সন্ধ্যা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলোনা, সোজা রাতের আরাম আসনের উপর নিজেই ল্যাপটপের ন্যায় বসে পড়েছে। রাতের ছোটছোট ঝাকড়া চুল মুঠিতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। রাগে ফেটে পড়ে চুল টানতে টানতে বিলাপ করে যাচ্ছে,,

“” আমি বিয়ে করবোনা করবোনা করবোনা করবোনা।””
“” সন্ধ্যা,ছাড় আমাকে। এইরে,আমার সব চুল আজ মরণদেশে পা ফেলবে নাকি? তখন তো আমি টাকলু বনে যাবো। ছাড় না,লাগছে খুব!””

সন্ধ্যা চোখের সাথে সাথে যেন কানের পর্দাও বন্ধ করে নিয়েছে। রাতের আর্তনাদ তার কর্ণদ্বয়ে পৌছাচ্ছেনা৷ সে তার কাজ আরো সুক্ষ ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে সন্ধ্যার হাত নিজের হাতের মুঠোয়পুরে নিলো রাত। বেশ শক্তিপ্রয়োগে দখলে এনে ওর পিঠে ঘুরিয়ে নিয়েছে। দুহাত একে অপরের উপরে পড়ে আছে রাতের হাতের শক্ত বাধনের চাপে। সন্ধ্যা তখনো চোখ বন্ধ করে আছে। বন্ধাবস্থায়ও চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভেতরের মনিগুলো হয়তো অস্থির হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত রাগের ফলে নিশ্বাসটাও কেমন গরম হয়ে উঠেছে। রাত মন্ত্রমুগ্ধের মতো সন্ধ্যার বদনখানি দৃষ্টিপাত করছে। আমাকে অনেক জ্বালিয়েছিস,এবার নিজে একটু জ্বলে নে। তারপর দুজন একসাথে জ্বলবো,আদরের দহনে। রাত নিজের অন্তর্কন্ঠে কথা শেষ করে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বললো,,

“” ছি! ছি!!ছি!!! সন্ধ্যা এভাবে পরপুরুষের কোলে চড়ে আছিস?? সায়নের তো কপাল পুড়বে মনে হচ্ছে। এভাবে যারতার কোলে বসে পড়লে তো সর্বনাশ!

সন্ধ্যা তাৎক্ষনিক চোখ খুলে বললো,,

“” তুমি পরপুরুষ?””
“” পরপুরুষ নই?””
“” না।””
“” তাহলে কি?””
“” তুমি তো আমার ভালো..””

সন্ধ্যা ঠোঁটদুটোকে বৃত্তের মতো গোল করেই আটকে গিয়েছে। রাত উৎকন্ঠে বললো,,

“” ভালো কি?””

সন্ধ্যা নিজের হাতের বাধন খুলার জন্য ছটফট করতে করতে বললো,,

“” ভালো ভাইয়া! ছাড়ো আমি ঘুমোতে যাবো।””

সন্ধ্যার কথার প্রেক্ষিতে রাত বাধ্যছেলের মতো হাত ছেড়ে দিয়েছে। সেও রাতের কোল থেকে নেমে রাতের রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো।

সন্ধ্যার চলে যাওয়ার পথে চেয়ে আছে রাত। ভেবেছিলাম ভালোবাসা নয় কবুল শুনবো। কিন্তু তুই মনে হয় তা চাস না। তাহলে যেটা চাস সেটাই হোক,আমি আবার সেই পুরনো চাওয়াতেই ফিরে গেলাম,আমার এখন ভালোবাসা চাই,তারপর কবুল!

~~
বিয়ের টেনশনে সারারাত ঘুম হয়নি সন্ধ্যার। বিয়েটা কিভাবে ভেস্তে দিবে তার ছককাটায় ব্যস্ত ছিলো। কিন্তু তার ছকে তো লাল বাতি,সবুজ বাতি পড়েনি। এখন কি হবে? কিভাবে আটকাবে সে এই বিয়ে?? রাতের কাছে নিজের সব কুকীর্তির গল্প বিনষ্ট করে নিজের মনের কথা জানানো ছাড়া আর কোনো উপায় মেলেনি সন্ধ্যার। কিন্তু এইভাবে হেরে যাবে এটাও যেন মেনে নিতে পারছেনা। করবেটা কি??

সন্ধ্যা সারাটারাত বিছানায় ছটফট করে শুয়ে থাকলেও ভোর হওয়ার পর আর পারছেনা। সকালের মিষ্টি আলোর রোদটা যতটা কড়া হচ্ছে তার বুকের ভেতরটায় ততটাই তোলপাড় শুরু হয়ে যাচ্ছে। করবেটা কি?? বিছানা ছেড়ে খালিরুমে পায়চারী শুরু করে দিয়েছে। কয়েকবার এপার থেকে ওপারে হাঁটাচলা করতেই রুমে কারো আসার প্রতিধ্বনি পাচ্ছে। সন্ধ্যা দৌড়ে বিছানায় উঠে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। চোখদুটো গভীরভাবে বন্ধ করে কানখাড়া করে আছে।

“” কিরে,এখনো বিছানা ছাড়িসনি? তোর চুমুপ্রেমীতো এসে পড়েছে।””

রাতের কন্ঠে সন্ধ্যা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে,তবে এখন সে ঝাঝটা দেখাবেনা। তাই ঝাঝটা নিজের মাঝে আটকে নিয়েই চোখ টিপে বন্ধ করে শক্ত হয়ে শুয়ে রইলো।

রাত সন্ধ্যার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,,

“” আজকের অভিনয়টা অনেক বেশিই কাঁচা। উঠবি নাকি আমি কোলে তুলে সায়নের কোলে বসিয়ে দিয়ে আসবো?””

সন্ধ্যা চট করে উঠে পড়লো। রাত মুচকি মুচকি হাঁসছে। সন্ধ্যা সেদিকে তাকিয়ে ভাবছে,

*যার বিয়ে তার খবর নাই,পাড়া পড়শির ঘুম নাই এবং উঠ ছেরি তোর বিয়ে* এই দুটো প্রবাদবাক্য যেন একমাত্র তার জন্যই গুনীজনরা আউড়িয়ে ছিলেন!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here