ভালোবাসার স্পর্শানুভুতি পর্ব ২১+২২

#ভালোবাসার_স্পর্শানুভূতি
#রাইমা_মিমি
#পর্ব_২১

তারা- কেন? কেন আমি আপনার কথা শুনে চলবো? আমি আপনার খাই না আপনার পড়ি যে আপনি যেমন বলবেন ওমন করেই চলতে হবে? কে আপনি আমার? কি অধিকার আছে আপনার আমার উপর হ্যা?(রেগে)

রাত- আমি কে জানো না? আমি কে জানো না তুমি?(রাগে দাতে দাত চেপে)

তারা- না জানি না। কে আপনি? হু দা হেল আর ইউ?

রাত- তাই? আমি কে জানো না? তাহলে হোটেলের ওই রুন কেন?(শান্ত সুরে)

তারা- র রুম ম মানে? ক কিসের র রুমের ক কথা ব বলছেন আ আপনি?(ঘাবড়ে গিয়ে)

রাত- তা তো তুমিই ভালো করে জানো। তোমার বুক করা রুম৷ তোমার কথা মতো সাজানো। ভিতরে লেখা আই লা………..

রাতকে আর কিছু বলতে না দিয়ে।

তারা- স্টপ। প্লিজ স্টপ। আমি কিছু বলতে চাই না। আর না কিছু শুনতে চাই। প্লিজ আমাকে ছাড়ুন। আই হেভ টু গো।

রাত- নো। আমি জানতে চাই সমস্যাটা কি তোমার? কেন এমন করছো? আমাকে বলো কি হয়েছে। আচ্ছা আচ্ছা তুমি কি কালকে আমাকে আর এনিকে দেখে ভুল ভেবেছো? যদি ভেবে থাকো তাহলে তুমি এখানে দাড়াও আমি এখনি এনিকে নিয়ে এসে সব মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্লিয়ার করে দিচ্ছি।

তারা- ওয়েট মিস্টার রাত। আমার কিছু জানার নেই। কিছু শুনার নেই। যা জানার আমি জেনে গেছি। আর যা শুনার তা আমি নিজের কানে শুনেছি। সো প্লিজ এসব ড্রামা বন্ধ করুন।(চাপা স্বরে)

রাত- কি শুনেছো তুমি? কি শুনেছো? বলো আমাকে কি শুনেছো? আই সেইড স্পিক আপ ডেম ইট।(রেগে তারাকে ঝাকিয়ে)

তারা- কি শুনতে চান আপনি? হ্যা কি শুনতে চান? না করতে পারবেন আপনি এনি আপুকে কিস করেন নি? না করতে পারবেন যে আপনি এনি আপুকে আই লাভ ইউ বলেন নি? বলুন না করতে পারবেন?(দ্বিগুণ রেগে)

রাত তারার কথা শুনে অবাক। সে ভাবতেই পারছে না তারা এসব কি বলছে তার ব্যাপারে। এসব কি করে বলতে পারে তারা? কি করে?

তারা- কি হলো? না বলতে পারবেন না তো?(বলেই ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে রাতের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে নিল)

কিন্তু রাত তারার হাত ধরে আটকে দিল।

রাত- এসব কি বলছো কি তুমি তারা? তোমার মাথা ঠিক আছে? কি আজে বাজে বকছো তুমি এসব?

তারা- আজেবাজে নয়। যা নিজের চোখে দেখেছি আর যা নিজের কানে শুনেছি তাই বলছি।

রাত- না তুমি ঠি দেখনি। যা দেখেছো ভুল দেখেছো যা শুনেছো ভুল শুনেছো।

তারা- দেখুন আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। প্লিজ ছাড়ুন আমাকে।

রাত- তা বললে তো হবে না। আমার কথাটাও তোমাকে শুনতে হবে।

তারা- ব্যাস অনেক হয়েছে। আর না আর কিছু বলবেন না। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। একটা কথা রাখবেন প্লিজ? আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। আমি আর কখনো দেখতে চাই না আপনাকে। আপনি যদি কখনো আমার সামনে আসেন তাহলে কিন্তু মরা মুখ দেখবেন আমার।(বলেই চলে গেল তারা)

তারার শেষের কথাগুলো গিয়ে রাতের কলিজায় লাগলো। ভিতর থেকে যেন তাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল।

রাত- এ কথা বলতে পারল তারা আমাকে? পারল বলতে? আমি তার সামনে আসলে মরে যাবে সে? আমি কি এতোই খারাপ যে আমার মুখ মানুষের মৃত্যু এনে দিতে পারে? তাও আমার প্রিয়তমার? কি করে পারল তারা বলতে? আর কিসব আজেবাজে কথা বলছিল সে? আমি এনিকে….। তারা আমার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলল। আমাকে চরিএহীন বলে গেল? আর কখনো দেখতে চায় না সে আমাকে?(দু কদম পিছিয়ে গিয়ে)

রাত- আচ্ছা ঠিক আছে। আর আসব না আমি তোমার সামনে। যতদিন না তুমি নিজে চাইবে। তবে ভেবো না তোমাকে ছেড়ে দিব আমি। তোমার উপর সব সময় আমার নজর থাকবে। ফিরে আসব আমি তোমার মেডন্যাস লাভার হয়ে। তখন দেখব কি করো তুমি? জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। (নিজেকে সামলে কথা গুলো ভেবেই চলে গেল)

বর্তমান,

দেখতে দেখতে চলে গেল ছয়টা মাস৷ এই ছয় মাসে অনেক কিছু বদলে গেছে। সামির আর তারা এখন অনেক ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে সামিরের ব্যবহারে কিছুটা বিরক্তবোধ করে তারা। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সামির তাকে বন্ধুর থেকে বেশি কিছু ভাবে।

সামির এতোদিনে এহসান আর তানিয়ার প্রিয় হয়ে গেছে। ছেলের অভাব যেন তারা সামিরকে দিয়ে পুরণ করে নিচ্ছে। কিন্তু মেয়ের জন্য খুবই চিন্তায় আছে তারা।

ওইদিনের পর থেকে তারা হাসি ভুলে গেছে। কিন্তু তাও পরিবার আর বন্ধুদের সাথে যখন থাকে তখন মুখে সবসময় জোরপূর্বক হাসি টেনে রাখে। তার এই জোরপূর্বক হাসি আর কেউ বুঝতে না পারলেও তারার বাবা মা ঠিকি বুঝেছে।

ওইদিন আসার পর সারাদিন আর তারা ঘর থেকে বের হয় নি। তানিয়া এহসান বারবার তাকে ডেকে গেছে কিন্তু সে নানা বাহানায় তাদের এড়িয়ে গেছে। পরেরদিন থেকে তারার মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। তারা আগের মতো স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেও কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। রাতের স্মৃতি তাকে বারবার তাড়া করে বেড়ায়। যা তার মনে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে।

এদিকে রাত বিদেশ গেছে ৬মাস হলো। কেন গেছে? কি কারণে গেছে তা কারো জানা নেই। এমন কি তার বন্ধুদেরও না৷

রাত ওইদিন বাসায় গিয়ে তার বাবাকে বলেছে লন্ডনের যাবে৷ কবে ফিরবে জানে না। শুধু টিকিট কাটতে বলেই কাউকে কিছু বলার সু্যোগ না দিয়েই চলে গেছে।

১সপ্তাহ রাত কারো সাথে কথা বলে নি। ভালো করেই খায় নি। সারাদি৷ বাসায় থাকতো না। রাত করে বাসায় ফিরত৷ ১সপ্তাহ পরে সবাই কে বিদায় জানিয়ে, শুধু তারাকে ছাড়া পাড়ি জমায় সুদূর লন্ডনে। এখন পর্যন্ত মা বাবা ছাড়া আর কারো সাথে কথা হয় নি তার। আসলে ইচ্ছা করেই কারো সাথে যোগাযোগ করে নি সে।

এই ছয় মাসে অন্যদিক দিয়েও যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি পরিবর্তন এসেছে তাদের বিজনেসেও। আজ আহমেদ বিজনেস এক নাম্বারে আর মাহমুদ দু নাম্বারে। কালের ব্যবধানে তাদের মধ্যেই এই ক্ষেত্রেও পরিবর্তনটা বিরাট। যেখানে মাহমুদ কোম্পানি সবসময় এক এ থাকে। আজ সেখানে মাএ ছয় মাসে তা দুই এ নেমে এসেছে।

সবার কাছেই এই জিনিসটা ভিষণ আশ্চর্যের। তবে শুনা গেছে মিস্টার রায়হান আহমেদের একমাত্র ছেলে রাত আহমেদ নাকি সুদূর লন্ডন থেকে ব্যবসার হাল ধরেছে। আর তারই ফল এই সাফল্যতা। যা তার বাবা মায়ের দেওয়া বয়ান।

ছেলের মধ্যেই বিজনেসের এই নেশা দেখে রায়হান আর অনিমাও অবাক। কারণ রাত কখনোই বিজনেসে হাত দিতে চায় নি। সবসময় নিজেকে অন্যরকম একটা অন্য পেশার মানুষ হিসেবে তৈরী করতে চেয়েছিল। তার পছন্দের বিষয়েও লেখাপড়া করছিল। প্রথমে ছেলের কাছ থেকে আশানুরূপ মতবাদ না পেয়ে রায়হান হতাশ হলেও পরে ছেলের মত আর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয় আর কখনো বলে নি বিজনেসের কথা।

কিন্ত হুট করেই ছেলের মধ্যে অন্যরকম পরিবর্তন সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। হুট করেই ছেলের বিদেশ চলে যাওয়া, তারপর বিজনেসে যোগ দেওয়া আর কারো সাথে যোগাযোগ না রাখাটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। কিন্তু তাও ছেলেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।

এদিকে অনিমা কেদে কেটে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। তার একটামাত্র ছেলে। কখনো তার থেকে দূরে রাখে নি। সবসময় ছেলের সাথে থেকেছে। আজ ছয়টা মাস ছেলের শুধু কথাই শুনেছে দেখার সাধ্য হয় নি তার। আসতে বললে ফোন কেটে দেয়, ভিডিও কল দিতে বললেও ফোন কেটে দেয়। অগত্যা এর পর থেকে তার এসব বিষয়ে কিছু বলেই না। শুধু কাদে।

লন্ডন,

এখন রাত। রাতের লন্ডনের চিত্র সবসময় ভিন্ন। দিনের তুলনায় রাতে এদেশে মানুষের আনাগোনা বেশি লক্ষ্য করা যায়। রাস্তার ধারে স্টিট ফুডের দোকান সাড়িবদ্ধভাবে। নাইট ক্লাব, পাব আর বারের সংখ্যা সবকিছুর থেকে তুলনা মূলক একটু বেশিই। দিনে সবাই কাজ করে আর রাতে সেখানে গিয়ে নিজেদের রিলেক্স মুডে রেখে দেয়।

এমনি একটা ক্লাবে অনেকক্ষণ ধরে মদ্যপানে ব্যস্ত এক ২৬-২৭ বছরের তরুণ। প্রতিদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে তাকে এই একটা জায়গায় পাওয়া যায়। দিনে সে যতটা গম্ভীর ও বদমেজাজি। রাতে ঠিক ততটাই অসহায় আর নিস্বঃঙ্গ। রাত আর দিনের এই তরুণের মাঝে আকাশ পাতাল ফারাক।

হ্যা তরুণ আর কেউ নয় রাত। এই ছয় মাসের প্রতিটি রাতেই তাকে এখানে দেখা গেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। মদ্যপান করছে আর এক মনে কিসব বিরবির করছে সে।

রাত- ব বুঝো নি। ত তুমি আমাকে কলি। বুঝো নি। আ আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছো তুমি। এ এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। পেতেই হবে।(বিরবির করে)

এক বোতল মদ যেন তার কোনো কাজেই দিচ্ছে না। আজকে যেন কষ্টটা আরো বেশিই ঝেকে ধরেছে তাকে। যেখানে মানুষ অর্ধেক বোতল খেয়েই ঠি থাকতে পারে না সেখানে সে এক বোতল খায়। আর আজ যেন এই বোতলও তাকে শান্তি দিতে পারছে না। তাই সে ওয়েটারকে আরেক বোতল আনতে বলে।

রাত- ওয়েটার। ওয়ান মোর।

রনি- কি করছেন কি স্যার? এক বোতল শেষ আরো নিবেন?

রনি। রনি রাতের এখানকার পিএ। গত ছয় মাস যাবত সে আছে রাতের সাথে। রাতকে তার ভিষণ অদ্ভুত লাগে। দিনে মানুষটা এক রকম আর রাতেই এই মানুষটা আরেক রকম হয়ে যায়। মনে হয় শত কষ্ট বুকে চেপে এখানে এসে মদ্যপান করে নিজেকে হালকা করতে চায়।

রাত রক্তলাল চোঝে রনির দিকে তাকালো। রাতের চোখ দেখে রনি সেখানেই চুপ। এই লোকটাকে সে ভিষণ ভয় পায়। আবার ভালোবাসে। বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করে।

রনি পড়াশোনা শেষ করে এদেশেই সেটেল হতে চেয়েছিল৷ রনির পরিবার মধ্যবিত্ত৷ বাবা একজন বেসরকারি স্কুল শিক্ষক। সে ছাড়াও তার আরো এক বোন আর ভাই আছে। স্কলারশিপের এসেছিল লন্ডন। তার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বাবা রিটায়ার করেন। যার ফলে সব দিক দিয়েই সমস্যায় পড়ে যায় সে।

সে যেখানে আগে চাকরি করত একদিন সেখানে কিছু চুরি হয়ে যায়। সবাই তার দোষ রনিকে দেয়। রনির একটা কথাও না শুনে সেদিনি তাকে চাকরির থেকে বের করে দেওয়া হয়। রাস্তার ধারে বসে কাদছিল আর পরবর্তীতে কি হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল সে। তখন সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিল রাত। রনিকে দেখে তার সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করে। অপরিচিত বলে রনি প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে সব খুলে বলে রাতকে। রনির কথা শুনে রাত পরেরদিন রনিকে তার সাথে দেখা করতে বলে। আর সেই থেকেই রনি আছে রাতের সাথে। এমন কি এখন তারা এক বাড়িতেই থাকে। বাড়িটা অবশ্যই রাতের।

রাতের চোখ দেখে ভয় লাগলেও মনে আল্লাহর নাম নিয়ে একটু সাহস জুগিয়ে আবার বলল।

রনি- স্যার প্লিজ। অনেক হয়েছে। আর না।

রাত তাও ওয়েটারকে নিয়ে আসতে বলল। রনি ব্যর্থ পথিকের মতো চেয়ে রইল। কারণ তার আর কিছুই করার নেই। কারণ সে জানে রাতের মনের অবস্থা।

একদিন রাত প্রচুর নেশা করে। যার ফলে নেশার ঘোরে সব বলে দেয় রনিকে। রনির তারার প্রতি রাগ লাগলেও রাতের প্রতি তার সম্মান আরো বেড়ে যায়। কারণ এমন ভালোবাসা আজকাল চোখেই দেখা যায় না।

রনি রাতকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসায়। রাত নেশা ঘোরে এখনো তারাকে নিয়ে বিরবির করে যাচ্ছে।

রনি স্পষ্ট শুনতে না পেলেও বুঝতে পারছে রাত শুধু “আই লাভ ইউ তারা” বলছে।

রনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রাতকে সোজা করে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

এদিকে,

ক্লাস করে সবে বাড়ি ফিরেছে তারা। গত ছয় মাস সে বাড়ি থেকে ভার্সিটি গিয়েছে আর ভার্সিটি থেকে বাড়ি এসেছে। এ ছাড়া আর কোথায় যায় নি সে। গত ছয় মাস যেন এটাই তার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাড়িয়েছে।

আগে ভার্সিটি গিয়ে চোখ জোড়া রাতকে খুজলেও এখন আর খুজে না। কারণ বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে আসতে চোখ জোড়াও অভিমানে ভার হয়ে আছে। যদিও পরে জানতে পেরেছে রাত আবার চলে গেছে লন্ডন একবারের জন্য। তখন থেকে চোখ রাতকে খুজা একবারে বন্ধ করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু চাইলেও কি সব হয়? নির্লজ্জ আঁখি যুগল বারবার অপেক্ষা করে গেছে একটিবার প্রেমিক পুরুষটাকে দেখার জন্য।

প্রতিদিনের ন্যায় বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল তারা। সাথে সাথে এক রাশ অভিমানে ভারী হয়ে উঠল চোখ জোড়া। চোখ কোণ ভেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। একসময় জল ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হয়ে গেল চোখ জোড়া। আর ক্লান্তি বন্ধ হয়ে গেল। আর ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল তারা।

লন্ডন,

ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের ন্যায় নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল রাত। সে খুব ভালো করেই জানে তাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে। তাই সে ব্যাপারে আর মাথা না ঘামিয়ে ফোন দিল সার্ভেন্টকে লেবু পানি নিয়ে আসার জন্য। আর সে উঠে চলে গেল ওয়াসরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রুম ক্লিন আর লেবু পানি সেন্টার টেবিলে রাখা। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ডগডগ করে এক ডুকেই পান করে নিল সবটা। তারপর রেডি হয়ে বেড়িয়ে গেল।
#ভালোবাসার_স্পর্শানুভূতি
#রাইমা_মিমি
#পর্ব_২২

ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রুম ক্লিন আর লেবু পানি সেন্টার টেবিলে রাখা। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ডগডগ করে এক ডুকেই পান করে নিল সবটা। তারপর রেডি হয়ে বেড়িয়ে গেল।

যেহেতু রাত বিদেশ তাই সে অনলাইনে পরীক্ষা দিয়েই তার মাস্টার্সটা কমপ্লিট করল। এতে অবশ্য তার বাবা মা আর স্যাররা প্রথম অসন্তুষ্টতা প্রকাশ করলেও পরে রাতের জোরাজোরিতে মেনে নেয়। এভাবেই বিদেশ থেকেও দেশে মাস্টার্স কমপ্লিট করল রাত। এখন তার পুরো মনযোগ বিজনেসে। তার ইচ্ছা ন্যাশনালের মতো ইন্টারন্যাশনাল বাজারেও নিজেদের বিজনেসকে নাম্বার ওয়ান প্রমাণ করা। যার জন্য সে আধা জল খেয়ে নেমেছে।

তাদের বিজনেসের মূল অফিস বাংলাদেশে হলেও লন্ডন আর আমেরিকাতেও নতুন শাখা খুলেছে রাত। লন্ডনেরটা সে দেখে আর দেশে বাবার সাথে একজন বিশ্বস্ত লোক আছে। আর আমেরিকাতে আছে তারই চাচাতো ভাই। সে ওখানের শাখাটা দেখছে। বলতে গেলে আহমেদ গ্রুপের এই যে সাফল্যতা তার সব রাতের দ্বারাই পাওয়া।

এখন দুপুর ২টা বাজে। লাঞ্চ ব্রেক সবার। মাএ একসাথে ৩টা মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে এলো রাত। আজ কাল নিজেকে কাজের মধ্যেই বেশি ডুবিয়ে রাখে সে। যাতে তারার স্মৃতি কম হলেও তাকে একটু কম কষ্ট দেয়।

রনিকে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে বলে তাকেও খেয়ে নিতে বলল সে৷ একটু পর আরো একটা মিটিং আছে। যা তার বিজনেসের জন্য ভিষণ দরকার।

ভালোবাসার মানুষের মুখে মরে যাওয়ার কথাটা শুনে ঠিক থাকতে পারে নি সে। ভালোবাসার মানুষটাকে ওই পরিস্থিতিতে কখনো সহ্য করতে পারবে না বলে নিজেই সরে এসেছি তার থেকে। আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিল তারার অনেক অনেক স্মৃতি। যা তাকে প্রতি নিয়ত তারার কথা মনে করিয়ে দেয়।

টেবিলের উপর একটা সুন্দর ছবি বাধায় করা আছে তারার। রাত চেয়ারে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল সেই ছবিটার দিকে। মনে মনে যেন শত কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করছিল সে তারাকে নিয়ে। সেই একটা ফোন কল এসে তার কল্পনার ব্যাঘাত ঘটায়। বিরক্তি নিয়ে ফোনটার দিকে তাকায় সে। তাকিয়েই দেখে বাংলাদেশী নাম্বার।

নাম্বারটা দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে যা শুনল তা শুনে ধপ করে মাথায় রাগ উঠে গেল। সাথে হাতটা শক্ত করে মুঠ করে নিল। চোখগুলো রক্তলাল বর্ণ ধারণ করতে লাগল।

কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ফোন ধরে দিল একটা আছাড়৷ সাথে সাথে ফোন কয়েক টুকরো হয়ে গেল।

আর চিতকাত দিয়ে বলতে লাগল।

রাত- ঠিক করো নি৷ কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করো নি কলি। এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। পেতেই হবে। আই এম কামিং। আই এম কামিং ব্যাক। গেট রেডি ফর ইউর পানিশমেন্ট।(রেগে চিল্লিয়ে)

ফ্ল্যাশব্যাক,

রাত ফোনটা কানে নিয়েই বলল।

রাত- হ্যালো।

অপরপাশের লোকটি- হ্যালো স্যার আমি নাজিম।

রাত- হ্যা নাজিম বলো কি খবর ওখানের?

নাজিম- স্যার একটা খারাপ খবর আছে।

খারাপ কথাটা শুনে রাত আতকে উঠল। তার মনে অদ্ভুত সব বাজে চিন্তা ভর করতে লাগল। নিজেকে শান্ত করতে না পেরে উত্তেজিত হয়ে বলল।

রাত- খারাপ খবর মানে? কি খারাপ খবর? কারো কিছু হয়েছে? তারা তারা ঠিক আছে তো? কি হলো? বলছো না কেন? স্পিক আপ। স্পিক আপ ডেম ইট।

নাজিম- স স্যার আ আসলে।

রাত- দেখো নাজিম। হেয়ালি করো না। যা বলার ক্লিয়ারলি বলো।

নামিজ- স্যার আসলে ম্যাম……….

রাত- ম্যাম? কি হয়েছে তারার বলো নাজিম। তাড়াতাড়ি বলো ফর গট সেক।

নাজিম- স্যার ম্যাম সামির স্যারকে বিয়ে করার জন্য হ্যা বলে দিয়েছেন।

নাজিমের কথা শুনে রাত থমকে গেল। তার মাথায় কিছুই আসছে না। সে শুধু একটা কথায় ভাবছে কি করে পারল তারা? কি করে? না এটা হতে পারে না। তারা এমনটা করতে পারে না। কিছুতেই না। ভেবেই রাতের ধপ করে রাগ উঠে গেল। আর পরের কাহিনী তো আপনারা জানেনই।

আপনারা কি ভেবেছেন? রাত বিদেশ বলে কি তারার খুজ নেয় নি? অবশ্যই নিয়েছে৷ তার চলে যাওয়ার আগে পুরো সপ্তাহ জুড়ে তারার জন্য কাজ করে গেছে। তারা অজান্তে তারার পিছনে লোক লাগিয়েছে। এমনি কি তারার বাড়ির ভিতর থেকে আবার বাড়িতে আসার পর্যন্ত সব খবরাখবরের জন্য লোক আছে তারার পিছনে। তারা কখন কি করে, কোথায় যায়, কখন যায়, কার সাথে যায়, কি খায়, প্রতিটা মিনিটের খবর থাকে রাতের কাছে।

এতোদিন সব ভালোই ছিল। শুধু সামিরের সাথে চলাফেরা করা ছাড়া। তাও মেনে নিয়েছিল নিজের মনকে শান্ত করে। কিন্তু একটু আগে যা শুনল তা কিছুতেই মেনে নেওয়ার মতো না। কিছুতেই না মানে না।

বর্তমানে,

রাতের কেবিন সাউন্ডপ্রুফ হওয়ায় তার চিতকার কেউ শুনতে পেল না।

রাত রনিকে ফোন দিয়ে আসতে বলল। তারপর আবার তারার ছবিটা হাতে নিয়ে একটা শয়তানি হাসি দিল। যার আড়ালে আছে অজস্র রাগ আর অভিমান। যা একটা মানুষকে মুহূর্তেই ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

কিছুক্ষণ রনির করা দরজায় করাঘাতে ধ্যান ভাঙে রাতের।

রনি- মে আই কাম ইন স্যার?

রাত- ইয়েস কাম ইন।

রনি- স্যার ডেকেছিলেন?

রাত- হ্যা। আমার বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য ফ্লাইটের টিকিট বুক করো।

রনি- স্যার আপনি বাংলাদেশ যাবেন?(আশ্চর্য হয়ে)

হবারই কথা। কারন গত ছয়মাসে রাত বাংলাদেশে যাওয়ার কথা তো দূরে থাক, বাংলাদেশের নামও শুনতে পারে নি। বাংলাদেশের ব্যাপারে বললেই রেগে যেত সে। আর আজ সেই বলছে সে বাংলাদেশ যাবে। সত্যিই অবাক করার বিষয়।

রাত- কি হলো রনি? শুনতে পাও নি আমি কি বললাম?

রনি- আব হ হ্যা স্যার শুনতে পেয়েছি। কিন্তু স্যার আর ইউ সিরিয়াস? না মানে আপনি কি সত্যিই যাবেন বাংলাদেশ?

রাত- শুধু আমি নই। তুমিও যাবে। যাও এখন মিটিং এর ব্যবস্থা করো। গো।

রাতের কথা শুনে রনির খুশিতে নাচতে ইচ্ছা হচ্ছে। গত ৪বছর হয়ে গেছে সে দেশে যায় নি। বাবা মা ভাই বোন কে দেখে নি। অবশেষে সে যেতে পারবে। সবার সাথে দেখা করতে পারবে ভেবেই খুশিতে তার চোখ ভরে উঠল। এ যেন তার একটা বিশাল পাওয়া। সে চোখ মুছে মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে আচ্ছা বলে চলে গেল।

এভাবেই কেটে গেল ৭দিন। কিছু কাজ পরে যাওয়ায় চাইলেও আগে যাওয়ার সুযোগ পায় নি রাত। তাই অগত্যা ৭দিন পরেই তার যাওয়ার দিন ধার্য করা হয়।

বাংলাদেশ,

মাহমুদ ভিলা,

নিজের ঘরে জানালার ধারে একটা রকিং চেয়ারে বসে আছে তারা। দৃষ্টি তার বাইরে বাগানের আম গাছটাতে স্থির। এ কাজ অবশ্য তার নতুন না। যখন সে বাসায় থাকে তার বেশির ভাগ সময় হয় সে ওই আম গাছের নিচে বসে থাকে নয়ত ঘরে জানালার ধারে বসে ওই গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

দরজায় দাড়িয়ে মেয়ের এমন মনমরা মুখ দেখে ভিতর থেকে ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে মা তানিয়া আর বাবা এহসানের। গত ছয়মাস যাবত তারা তাদের ছোট প্রাণোজ্জ্বল মিষ্টি আর চঞ্চল মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছেন। সে মেয়ে সারাদিন বাড়ি মাতিয়ে রাখতো গত ছয়মাস যাবত সেই মেয়ে একদম চুপ মেরে আছে। যেন সে কথাই বলতে পারে না। প্রয়োজন ছাড়া এখন তানিয়া আর এহসানের সাথেও কথা বলে না। সবসময় মন মরা হয়ে থাকে।

যা বাবা মায়ের মনকে ভিষণ কষ্ট দেয়। সবার সামনে মেয়ে যে হাসি খুশি থাকার অভিনয় করে তা আর কেউ বুঝক আর না বুঝক বাবা মা ঠিকি বুঝেন।

তার সাথে তারা আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন যখন তাদের মেয়ে সামিরের সাথে থাকে তখন তারা একটু হাসে যা থাকে মন থেকে। সামির যথা সম্ভব তারাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে। যা বাবা মায়ের মন কে একটু শান্তি দেয়। তাদের কাছে তাদের মেয়ের খুশিই সব। কারণ তাদের একটা মাএ সন্তান। এই সন্তানই তাদের সব। তাই কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেয় নি তাকে। যখন যা দরকার তা চাওয়ার আগেই দিয়ে দিয়েছে। তাই এখন মেয়ের এমন চিএ তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।

মেয়ে ভালো করে খায় না, ভালো করে ঘুমায় না, সব সময় একা থাকে, কারো সাথে কথা বলতে চায় না। তার মুখে একটা অসুস্থ অসুস্থ ভাব ফুটে উঠেছে।

সামির যখন আসে তখন জোর করে তার সাথে তারাকেও খাওয়ানোর চেষ্টা করে।

যা দেখে তানিয়া আর এহসানের খুব ভালো লাগে। তাদের কাছে মনে হয় এমন সময় তার মেয়ের পাশে এমন কাউকে দরকার যে তাকে সময় সাপোর্ট দিবে। আর যা তারা সামিরের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে। তাই সামিরের পরিবার যখন সামিরের সাথে তারার বিয়ের প্রস্তাব দিল তখন তারা আর দ্বিমত করেন নি। কিন্তু সমস্যাটা ছিল তারাকে নিয়ে। তাদের চিন্তা ছিল তারাকে এই প্রস্তাব মানবে? কিন্তু তাদেরকে অবাক করে দিয়ে তারা এই প্রস্তাবে হ্যা বলে দেয়৷ আর যা রাতের কানেও পৌছে গেছে।

রাত ৮টা বাজে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে লন্ডন থেকে বাংলাদেশ গামী প্রাইভেট একটা জেট এসে ল্যান্ড করেছে। যা থেকে হিরো স্টাইলে নেমে আসছে ২৬-২৭ বছরের একটা তরুণ। যার স্টাইল, এটিটিউড, ড্রেস আপ এক কথায় ইউনিক। যা সবার নজর কারা।

সাদা শার্ট উপরে কালো ব্লেজার, কালো জিন্সের প্যান্ট, হাতে দামী ঘড়ি, পায়ে দামী সুজ, চুল গুলো সেট করা। এক কথায় অসাধারণ লাগছে। সাদা গায়ের রঙে আর হাইটে ৫.৯” হওয়ায় একদম পারফেক্ট লাগছে তাকে।

বিমানবন্দরের সব মেয়েরা হা হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেউ কেউ ঠেলে কথা বলতে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু কালো পোশাক ধারী কতগুলো লোকের জন্য পাচ্ছে না। সবার এমন ছোটাছুটি দেখে রাত একটা বাকা হাসি দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আর তার বাকা হাসি দিয়ে ঘায়েল করে নিয়ে গেল সবাইকে। কেউ কেউ এমন রিয়েকশন দিল যে সে ক্রাশ খেয়ে ফিট হয়ে মেরে যাচ্ছে। যা দেখে রনির অনেক হাসি পাচ্ছে। তাই মুচকি হেসে নিজেও রাতের পিছনে দিল দৌড়।

রাত বের হয়ে নিজের জন্য আগে থেকে আসা প্রাইভেট কারে বসে যাএা শুরু করল বাসার উদ্দেশ্যে। রনি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে আর পিছনে বসেছে রাত। বাকী গাড়ি গুলোতে আছে তার গার্ডরা।

আহমেদ ভিলা,

অনিমা বসে আছে সোফায় মন মরা হয়ে। কতোদিম হলো ছেলেকে দেখে না। বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে ছেলে। কিন্তু ছেলে তো তার কোনো কথাই শুনে। ভিডিও কলের কথা বললেও রাগ করে কেটে দেয় ফোন। আজকে সকাল থেকেই তার মনটা কেমন আনচান আনচান করছে। সকাল থেকে রান্নাঘরে যেই কাজ করতে যাচ্ছে ওমনি হাত থেকে সব থালাবাসন পড়ে যাচ্ছে। এ বাড়িতে কোনো আত্মীয় আসার সংকেত।(আগে কার দিনের কুসংস্কার) তাই সে আর কাজ না করে সকাল থেকেই বসে বসে চিন্তা করছে কে আসতে পারে।

এদিকে রায়হান খেয়ে দেয়ে রেডি হয়ে বের হয়েছে ঘর থেকে। উদ্দেশ্য তার অফিস।

রায়হান- অনি আমি আসছি।

কিন্তু অনিমার কোনো রেসপন্স নেই। তাই সে আবার বলল।

রায়হান- অনি। অনি আমি আসছি। দরজাটা আটকে দিতে বলো।

বলেই যেই না বাড়ির সদর দরজা খুলতে যাবে ওমনি………………………

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here