ভালোবাসি প্রিয় পর্ব ৩১+৩২

#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৩১
#সুলতানা_সিমা

মাঝে মাঝে সবকিছু এতোটা বিষাক্ত লাগে মনে হয় শ্বাসপ্রশ্বাসেও বিষাক্ত অক্সিজেন ঢুকছে। আর সেই বিষ ভেতরে গিয়ে ভেতরটা বিষে বিষে ভরে যাচ্ছে। বিষাক্ত সময়গুলোতে ছোট ছোট শব্দগুলোও বিকট শব্দ হয়ে এসে কানে লাগে। আশেপাশের সবকিছু তখন অসয্য লাগে। মিষ্টি কথাগুলাও শুনায় অনেক তেতো। নীলেরও এই মূহুর্তে তাই হচ্ছে। পাশে বসে শাওন একের পর এক প্ল্যান করছে কীভাবে লুপাকে প্রপোজ করবে, আর সে চুপচাপ বসে নিজেকে কনট্রোল করছে। নীলের ইচ্ছে করছে অনেক জোরে চিৎকার করে বলতে লুপা শুধু আমার ওঁর উপর কারও অধিকার নাই। কিন্তু বলতে পারছেনা অদৃশ্য এক হাত তার গলা টিপে ধরছে।

কান্না আঁটকানো যে কতোটা কঠিন তা নীল এইমূহুর্তে হারে হারে টের পাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলে নীল নিজেকে কিছুটা শক্ত করল। খুব আশা নিয়ে এসেছিলো আজ লুপার কথাটা শাওনকে জানাবে, শাওন বুদ্ধি দিলে সে লুপাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে নয়তো বা লুপাকে প্রপোজ করবে। কিন্তু আসার সাথে সাথে শাওন তার কথা বলা শুরু করে দিছে। নীলের কাছে মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ গেলে সে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। নীল শাওনকে কিছুটা ধরা গলায় বলল”

_শা শা শাওন। আজ তাহলে উঠছি।
_আরে যাবি তো আগে বলনা কোনটা বেস্ট?
_হ্যাঁ সবগুলাই বেস্ট তোর ভাগ্যটাও বেস্ট।
_নীল হল কী তোর? আচ্ছা তুই আমাকে শুধো এটা বল কীভাবে প্রপোজ করলে লুপা না বলতে পারবে না।
_এমন ভাবে কর যেভাবে অন্যকাউকে কেউ কোনোদিন করেনি। আচ্ছা আমার মাথা ব্যথা করছে শাওন আমি যাচ্ছি।” নীল উঠতেই শাওন নীলের হাত ধরে ফেলে। সন্দেহের চোখে নীলের দিকে তাকাল। এখানে আসার পরে নীল কতো হাসি মুখে ছিল আর এখন সাথে সাথে তার চেহারায় আঁধার নেমে এসেছে। শাওন নীলকে টান দিয়ে বসিয়ে বলল”

_তুই না আমাকে কী বলবি বললি,না বলেই চলে যাচ্ছিস?
_অহ ভুলে গেছি রে। আমি বলতে চাইছিলাম আমি আবার ইন্ডিয়া যাবো।” শাওন কপাল কুঁচকে তাকাল নীলের কথাটা কেন জানি তার বিশ্বাস হচ্ছেনা। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল ”
_নীল কিছুদিনের ভেতর আমাদের এক্সাম শুরু হবে।
_হুম ভেবে দেখব আসছি এখন। অল দ্যা বেস্ট।” নীল উঠে বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো। শাওন পিছন থেকে ডাক দিলো নীল থামলো না। এখানে থাকলে তার অবাধ্য চোখ কখন বর্ষণ শুরু করবে সেটা সে নিজেও জানেনা, শাওন তার চোখের পানি দেখলে হয়তো বুঝে যাবে সেও লুপাকে ভালোবাসে তখন হয়তো নিজেকে কষ্ট দিয়ে হলেও লুপাকে ছেড়ে দিবে, কিন্তু নীল চায়না লুপার জন্য তার বন্ধুকে সে কষ্ট দিক।

এদিকে শাওনের কেন জানি মনে হচ্ছে নীল কিছু লুকাচ্ছে তার থেকে। লুপার কথা বলতেই নীলের হাস্যজ্বল মুখটা মলিন হয়ে গেছিলো। আচ্ছা এমনতো নয় সে লুপাকে ভালোবাসে। না না এমন হলে তো নীল অবশ্যই তাকে বলতো। লম্বা একটা দম ছেড়ে সেও বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। হঠাৎ করে কেন জানি খুব খারাপ লাগছে তার।

নীল বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল। লুপাকে ভালোবাসে সে একদিন দুইদিন থেকে নয়,অনেক আগে থেকেই সে লুপাকে ভালোবাসে। লুপার প্রতিটি জিনিস তাকে প্রলুব্ধ করে। লুপা নামটা শুনলেও তার বুকের ভেতর ধুকপুক করে। আজ তারই বন্ধুর ভালো লাগার মানুষটি এই লুপা। নীলের মনে হচ্ছে তার বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। লুপার মুখটা চোখে ভেসে উঠল নীলের। লুপার মায়ের ডিম ভাজি নিয়ে টেবিলে বসে চেয়ারে গা হেলিয়ে হাসার সেই দৃশ্যটা তার চোখে ভাসছে। রাগে লুপার নাক ফুলানো,ভেংচি দেওয়া,চোখ গরম করে থাকানো,লুপার সেই বিরক্তি ফোটে উঠা চেহারা। সব ভেসে উঠছে চোখে। মনে হচ্ছে তার চোখের সামনে প্রজেক্টর স্ক্রীন বাঁধানো। নীল চোখ খিঁচে মাথা চেপে বালিশে মুখ গুঁজে নিল। ভেতটা তার ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ফোনের রিংটোন শুনে বালিশ থেকে মুখ তুলে পকেট থেকে ফোন বের করলো সে। লুপা কল দিচ্ছে নীল ধরতে যাবে তার আগেই শাওনের কথা মনে পড়ে যায়। নীল ফোনটা সাইলেন্স করে শুয়ে থাকে চোখ দুটো আজ বার বার ভিজে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় বুকের ভেতর ধংস হয়ে যাচ্ছে।

______________________

রাত ১০টায় অরিন লুপার রুমে এসে লাইট অন করলো। সন্ধ্যায় সায়রা অরিনকে গিয়ে বলেছেন অরিন খুব কান্না করছে দেশের বাইরে চলে যেতে চাইছে কী হইছে সে জানে কিনা। অরিন বলেছে সে পরে বিষয়টা দেখবে। তাই এখন আসলো সে, কিন্তু রুমটা অন্ধকার। লাইট জ্বালিয়ে দেখল লুপা রুমে নেই। বারান্দায় গিয়ে দেখল লুপা সেখানেও নাই। অরিনের বুকটা ধুক করে ওঠল। ইশি দিশার রুম দেখে আর কোথাও খোঁজার সাহস হলোনা তার। লুপাকে খোঁজতে ছাদে গিয়ে থমকে গেল সে। লুপা ছাদে হাঁটু গেড়ে বসে কান্না করছে। অরিন দৌড়ে গিয়ে লুপার সামনে বসে হন্তদন্ত হয়ে বলল”

_লুপা কী হয়েছে জানু কাঁদছিস কেন? তুই ঠিক আছিস তো? এভাবে বসে আছিস কেন উঠে দাঁড়া।” অরিনকে দেখে লুপার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। হাউমাউ করে কেঁদে অরিনকে জড়িয়ে ধরে। অরিন লুপার কান্না দেখে নিজেই কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে লুপা বলল”
_আমি এতো বেশি খারাপ কেন রে অরিন? আমাকে আল্লাহ এতো খারাপ করে কেন বানাইছে?
_তুই খারাপ কে বলেছে? তুই খারাপ নয়। আমার লুপা জানুটা কখনো খারাপ হতেই পারেনা। বল না কি হইছে? দেখ এবার কিন্তু না বললে আমি তোকে মাইর দিবো।” লুপা অরিনের দুটো হাত তার গলায় লাগিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল”
_মেরে দে আমায় প্লিজ। আমি যে নিজে মরার সাহস পাচ্ছিনা রে দোস্ত। তুই আমায় মেরে দে মুক্তি দে আমায় এই বিষাক্ত জীবন থেকে। তুই সব সময় বলতি না আত্মহত্যা কেন মহাপাপ,হ্যাঁ রে আত্মহত্যা কেন মহাপাপ বল? আমার যে বাঁচতে ইচ্ছে করছে না রে। আমার মরণ কেন হয়না রে অরিন আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
_কী হইছে রে বল? বলনা প্লিজ।” লুপা কান্না করেই যাচ্ছে এইরই মাঝে লুপার ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিল অরিন। স্পষ্ট ভেসে উঠছে নীলের নাম। লুপা অরিনের হাত থেকে ফোন নিয়ে ফোন রিসিভ করে চেঁচিয়ে বলল”

_ওই বাজেলোক আমায় কেন ফোন দিছেন? আপনার বউ আছে সংসার আছে থাকেন না তাদের নিয়ে। আমার কথা শুনতে হবে কেন আপনার?” লুপার কথা শুনে অরিন হাঁ হয়ে গেল। লুপা এসব কী বলছে তাহলে কী নীলের জন্য এতোক্ষণ ধরে কাঁদছে সে। নীলের সাথে কী সম্পর্ক লুপার? আপাতত চুপ থাকল অরিন, লুপার ফোনে কথা বলা শেষ হলে জিজ্ঞেস করে নিবে।

এদিকে লুপার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে নীলের। পাগলীটা তার উপর অভিমান করে আছে। কিন্তু কোন অধিকারে এই অভিমান করছে? চাইলেও যে এই অধিকার পাবে না সে। যাইহোক,বন্ধুত্বের মাঝে কোনো ধরনের মনমালিন্য চায়না নীল। বুক ছিড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল”
_আগে অনেকগুলা কল দিলা দেখলাম। মেসেজ দিলা কী বলতে চাও আমায়। কী বলবা বলো?
_কিছুনা শুনতে হবে না আপনাকে।” লুপার কণ্ঠে কান্না অভিমান মিশ্রিত। নীলের বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করছে। এক হাতে কপাল চেপে ধরলো। লুপা আবার বলে উঠল”
_আপনি জানেন আপনি খুব খারাপ লোক। আমাদের বাসার মিনু বিড়ালের থেকেও খারাপ। ওই যে আমাদের কলেজের দারোয়ান, ওর থেকেও খারাপ। ওই লতিফ ফুসকাওয়ালা ওর থেকেও খারাপ। খুব, খুব বেশি খারাপ আপনি। খারাপের চাচা আপনি।

চোখ ভর্তি জল নিয়ে হেসে উঠল নীল। লুপার কথা শুনে তার ভেতরে সব রাগ,অভিমান,প্রতিজ্ঞা সব ভুলে গেছে সে। লুপাকে ভুলে যাবে ভাবছে সে, আসলে কী পারবে সে ভুলে যেতে? এতো বছর ধরে লুপাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে আসছে সে। পারবে তো সেই স্বপ্ন অন্য কারো চোখে দেখতে? ভাঙ্গা গলায় লুপাকে বলল”

_হুম আমি খুব খারাপ। ভালো হতে হলে কী কী করতে হবে?
_আপনার বউ কে জিজ্ঞেস করুন।” বলেই ফোন কেটে দিলো লুপা। নীল সাথে সাথে ফোন দিল, লুপা রিসিভ না করে কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলো। অরিন লুপার হাত ধরে টেনে তুলল তাকে। তারপর চোখ ছোট ছোট করে রাগি লুকে তাকাল লুপার দিকে। লুপা বলল”

_এভাবে তাকাচ্ছিস কেন?
_তলে তলে এতোদূর তাইনা? কতদিন ধরে চলছে এসব?
_তুই কিন্তু যা ভাবছিস তা নয়। তাছাড়া উনি বিয়ে করে ফেলছেন।
_ওওওওওও আচ্ছা বিয়ে করে ফেলছে। [লুপার থুতনি ধরে] ওলে আমার সুনা লে। আমাকে বোকা ভাবো?
_সত্যি উনি বিয়ে করে ফেলছে বিশ্বাস কর।
_ঠিক আছে আমি আন্টিকে বলে দিব এই বিবাহিত ছেলেটার সাথে যেন তোর বিয়ে দেয়।” লুপার মুখে লজ্জার আভা ফুটে উঠলো। লজ্জায় লাল হয়ে বলল”
_দূর কিসব বলিস।
_আচ্ছা লজ্জায় লাল হওয়া হচ্ছে? ওকে যা বুঝার তা বুঝে গেছি এবার চল নিচে চল।
_অরিন তোকে কিছু বলার ছিলো।
_পরে বলবি এখন নিচে চল তুই খাসনি বলে যে তর মাও খায়নি এটা জানিস?
_তুই খাবিনা?” অরিন একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। তার আর দিহানের খাবারটা লারা,ইশি বা দিশা রুমে দিয়ে যায়। টেবিলে বসে খায়না তারা কারণ সে আর দিহান টেবিলে গেলে। দিহানের মা আর তাঁর বড় চাচ্চু খায়না।

নীল লুপার ফোন বন্ধ পেয়েও বার বার লুপাকে কল দিচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ফোনটা বালিশের পাশে রেখে বারান্দায় চলে গেল। আজ খুব খারাপ লাগছে তাঁর লুপাকে ভুলবে কী করে সে। লুপার প্রতি ভালোবাসাটা আরও বেড়ে গেছে তাঁর। কিন্তু লুপার জন্য সে কী করে নিজের ছোট বেলার বন্ধুকে কষ্ট দিবে? এটা যে অনেক বড় স্বার্থপরতা হয়ে যাবে। বুক ছিড়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিগারেট জ্বালানো নীল। বড্ড বেশি দোটানায় পড়ে গেছে সে।

______________________________

সকালের সুনালী রোদ এসে চোখে পড়তেই কপাল কুঁচকে গেল জিহানের। চোখ খোল নিজের আবিষ্কার করল লারার চাদরের নিচে। শুধু চাদরের নিচে নয় একেবারে লারারই নিচে। লারা তাঁর বুকে মাথা রেখে শান্তি মতো ঘুমাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা সুখী দম্পতি। আসলে তো তাঁরা প্রতিরাতে বালিশের দেয়াল টপকে ভুলটা করে। জিহান উঠতে গিয়েও উঠতে পারল না। ঘুমন্ত লারার ঘুম ভাঙ্গানোটা বড্ড অপরাধের মনে হচ্ছে তাঁর। জিহান লারা মুখের দিকে তাকিয়ে তাকল। অসম্ভব সুন্দর এই ঘুমন্ত পরী টাকে। ধবধবে ফর্সা ত্বক চিকচিক করছে। নিজের অজান্তেই জিহান লারার মাথায় চুমু এঁকে দিলো। এই ভুলটা সে আজ প্রথম করছেনা। প্রতিদিনই করে। প্রতিদিন যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন লারাকে তাঁর বুকে আবিষ্কার করে। আর প্রতিদিন লারার নেশায় ডুবে সে এই ভুলটা করে বসে। তারপর ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে । কারণ লারা যদি উঠে তাকে সজাগ দেখে লজ্জা পায় সেজন্য। লারা তার বুকে থাকলে আলাদা একটা প্রশান্তি পায় সে। আজকাল লারাকে শাস্তি দেওয়ার কথা মাথায় আসেনা তার। লারাকে খারাপ ভাবতেও কেন জানি খুব খারাপ লাগে তার।

দিহান অরিনকে নিয়ে ডক্টর এর কাছে যাবে কিন্তু হাতে মাত্র পনেরো’শ টাকা আছে। নিজের স্ত্রীকে চিকিৎসা করাতে বাপ মায়ের কাছে টাকার জন্য হাত পাত্তে তার খারাপ লাগে। এতে তার আত্মসম্মানে আঘাত আনে। কিন্তু এখন অরিনকে ডঃ. না দেখালেই নয়,কারণ অরিনের শরীর অনেক বেশি দূর্বল। এ টাকা দিয়ে না হয় এখন৷ ডাক্তার দেখিয়ে নিলো। কিন্তু বাকিটা? পড়ে যদি আবার অসুস্থ হয়, হঠাৎ যদি একটা বিপদ আসে তখন? দিহান তার বাবার রুমে গেলো। সুমনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন আর হানিফ চৌধুরী খবরের কাগজ পড়ছিলেন। দিহান গলা খাঁকারি দিয়ে তার বাবাকে ডাক দেয়। হানিফ নিজের ছেলেকে দেখে পত্রিকায় চোখ রেখেই তাকে বসতে বলেন। দিহান বসে কিছুক্ষণ চুপ থাকল তারপর বলল”

_বাবা আমি একটা চাকরি করতে চাই।” দিহানের বাবা গম্ভীর গলায় বললেন”
_হুম তো?
_চাকরি নিতে যদি টাকা লাগে কিছু টাকা দিতে হবে।
_হুম। তো কি চাকরি নিচ্ছো?
_এখনো ভাবিনি। তাছাড়া বললেই তো আর চাকরি হয়ে যায়না। আমি আপাতত চলার জন্য ছোট খাটো কিছু একটা চাইছি।” হানিফ চৌধুরীর বুঝতে বাকি নেই দিহান উনাকে ইঙ্গিতে কোনো চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে বলছে। বাবা নামক ছায়ার নিচে যে সব সন্তান অলস হয়ে থাকে। বাবাকে সব সমস্যা সমাধানে হাতিয়ার মনে হয়। হানিফ চৌধুরী ভেতরে ভেতরে হাসলেন। কিন্তু বাহির থেকে গম্ভীর গলায় বললেন”

_হুম তোমার এক্সাম শেষ হোক বাকিটা দেখা যাবে এবার যাও।” দিহান গেলনা বসে থাকল। তার মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল তার মা চুপচাপ বসে আছেন। দিহান তার মাকে বলল”

_আম্মু অরিন অসুস্থ ভাবছিলাম আজকে ডক্টর দেখাব।” ছেলের কথায় সুমনা যেন জ্বলে উঠলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন ”
_ওওওও বাচ্চা পেটে চলে আইছিলো এজন্য বাড়ি আনছিলা? আর আমাদের সামনে এই নাটক, কাজের মেয়ে হয়ে থাকবা, কাজ করে খাবা। এজন্যই তো বলি আজ চাকরানী তো কাল রাণী হয়ে গেল কেমনে? বাড়িতে তোলার আগেই ফষ্টিনষ্টি শুরু করে দিছিলা?” নিজের মায়ের মুখে এমন জঘন্য কথা শুনে শরীরে কাটা দিয়ে উঠল দিহানের। কান ঝাঁ ঝাঁ হয়ে গেল তার। লজ্জা ঘৃণায় মন চাচ্ছে এখন মাটি ফাঁক হোক আর সে মাটির ফাঁকে ঢুকে যাক। লজ্জায় দিহান চোখ তুলে চাইতে পারল না,মাথা নিচু করে থাকল। মাথার ভেতর ভনভন করছে, রাগে গা রি রি করছে তার। দিহান আর একমূহুর্ত বসে থাকার শক্তি পেলনা। উঠে যাওয়া ধরল। দরজার সামনে থেতেই বিকট শব্দে থমকে গেল তার পা। পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল তার মা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর তার বাবা রাগে ফোঁস ফোঁস করে রক্তিম চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছেন। সুমনা গর্জে বলে ওঠলেন”

_এই বস্তির মেয়ের জন্য আমার সাথে এমন করছো তোমরা? যে মেয়ে টাকার লোভে বিয়ে করে এই বাড়িতে উঠেছে ওই মেয়ের জন্য? কী যোগ্যতা আছে এই মেয়ের? বড় ভাইয়া তো ঠিকি বলে জিহানের বউকে মেনে নিলেও এই মেয়েকে মেনে নেওয়া যাবে না। না আছে রূপ না আছে গুন। আমার ছেলেকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে সুখী হতে চাইছে? কোনোদিনও সুখী হবেনা আল্লাহর গজব পড়বে।
_চুপ করো একদম চুপ। নিজের ছেলের বিষয়ে কিসব বলে যাচ্ছো হুস আছে তোমার?” হানিফ চৌধুরীর কথার উপর গলা আরও উঁচিয়ে সুমনা বললেন”
_ আরো বলবো। যা সত্যি তাইতো বলছি। পেট বাঁধিয়ে এসেছে এই মেয়ে। নষ্টা মেয়ে কোথাকার। এই মেয়ের কোনো যোগ্যতাই নেই এই বাড়ির বউ হওয়ার। আরে সমাজের কাছে এই মেয়েকে বউ বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করবে।” দিহানের ইচ্ছে হলো কড়া কয়েকটা কথা শোনাতে। কিন্তু নিজের মাকে কী বলবে সে? রাগে হাতের মুঠি করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে কনট্রোল করে চলে এলো সে।

দরজার বাইরে এসে থমকে গেল দিহান। অরিন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। এখানে কী হয়েছে না হয়েছে সব যে অরিনের দৃষ্টিতে পড়েছে তা অরিনের চোখ সাক্ষী দিচ্ছে। দিহান অরিনকে হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে আসল। রুমে আসার পর অরিন দিহানের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে খাটে বসে কাঁদতে লাগল। দিহান অরিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে অরিনের চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বলল”
_কেঁদনা লক্ষীটি প্লিজ। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, আম্মু তোমাকে মেনে নিবে দেইখো। প্লিজ কেঁদনা। কষ্ট হচ্ছে আমার সুনা কান্না থামাও।” অরিন হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল ”
_ওটা যদি আপনার মা হতোনা তাহলে খুন করে দিতাম আমি। কীসের এতো দেমাগ উনার? আপনি আমার থেকে দেখতে ভালো এইটা নাকি আপনাদের টাকা আছে সেইটা? আর এতই বস্তির মেয়ে বস্তির মেয়ে বলেন কেন তন্দ্রা কী বিল গেটসের মেয়ে ছিলো? মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব কটাকে খুন করে দেই। কেন ওরা আমার থেকে আপনাকে কেড়ে নিতে চায়? মেরে দিব সবাইকে আমি,তবুও আপনাকে কেড়ে নিতে দিবনা।”

অরিন কেঁদে যাচ্ছে আর যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছে। রাগের মাথায় সে কী বলছে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। দিহান অরিনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু সে কিছুতেই স্থির হচ্ছেনা। সে বার বার বলেই যাচ্ছে খুন করে দিবে সবাইকে যে দিহানকে তার থেকে কেড়ে নিতে আসবে তাকে সে কেটে টুকরো টুকরো করে দিবে। দিহান অরিনের হাত দুটো হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল”
_অরিন কেউ কেড়ে নিবেনা আমাকে। শান্ত হও প্লিজ। যতদিন আমি তোমার আছি ততদিন কেউ পারবে না আমাদের আলাদা করতে কথা দিচ্ছি আজীবন আমি তোমার থাকবো। আই প্রমিজ।
_কিন্তু আপনার আম্মু উনি কেন এমন করে আপনি কেন কিছু বলেন না উনাকে? উনাকে সয্য হচ্ছেনা আমার, থাকবো না আমি আর বাড়িতে।
_প্লিজ সোনা শান্ত হও। কীসব বলছো রাগের মাথায়? কই যাবো আমরা বলো? তোমাকে যতটা ভালোবাসি ঠিক ততটা আমার আম্মুকেও ভালোবাসি। আমার কাছে তুমি যতটা মূল্যবান আমার আম্মুও ঠিক ততটাই মূল্যবান। হ্যাঁ আম্মুর উপর আমার অনেক অভিমান, তাঁরও আমার উপর অনেক রাগ। কিন্তু মা তো মা ই হয় তাইনা? [এটুকু বলে গলা ধরে আসলো দিহানের] এতকিছুর পরেও যখন দেখলাম আম্মুকে বাবা মেরেছে, দেখে আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে অরিন। আমি কী করবো বলো। কই যাবো আমি? আমি তোমাদের সবাইকেই চাই,তোমাদের যে আমার জীবনে বড্ড প্রয়োজন। তোমরা কেউ আমায় না বুঝলে আমি কার কাছে যাবো বলো?”

দিহানের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে সব রাগ পানি হয়ে গেলো অরিনের। দিহানের চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। অরিন দিহানের চোখের পানিটা মুছে দিয়ে দিহানের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল” সরি আর বলব না এসব”। দিহান অরিনের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো। তার কানে এখনো তার মায়ের তীক্ষ্ণ কথাগুলা এসে কানে বাজছে। মা হয়ে কীভাবে এসব বললেন তিনি? ঘৃণাও করতে পারছে না আবার সম্মানটাও করতে পারছেনা তার মাকে। দিহানের মাথার উপর নিজের মাথা রেখে অরিনও কাঁদতে লাগলো। দিহানকে সে খুব ভালোবাসে খুব বেশিই ভালোবাসে সে।

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইশি। আজ তার চোখ কোনো বাঁধা মানছে না। একের পর এক অশ্রুবিন্দু মুক্তোদানার মতো ঝরে পড়ছে। কতো হাসিখুশির পরিবার ছিল এটা, যেন আল্লাহ নিজের হাতে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিলেন। না কারো সাথে কারো জেদ ছিলো না কারো সাথে কারো ঝগড়া হতো। সারাদিন সবাই হাসিখুশি থাকতো। মিহানের মৃত্যুর পরেও চুপ ছিলো সবাই তাহলে আজ এতো এলোমেলো হয়ে গেছে কেন সব কিছু। দিহান ভালো থাকুক তার ভালোবাসা নিয়ে সুখী থাকুক এটা ভেবেই তো সে তন্দ্রার মতো মেয়ের সাথে দিহানের মিল কামনা করতো। আজ তন্দ্রার মতো খারাপ মেয়ে নয় অরিনের মতো একটা লক্ষী মেয়ে তার বউ হয়ে আছে। তাহলে সুখি নয় কেন দিহান? কেন মেজো আম্মু বুঝেনা দিহানের অসহায় মুখটা তাকে শেষ করে দেয়। অরিনকে মেনে নিলে কী এমন হয়? হোক না অরিন দিহানের থেকে অসুন্দর কিন্তু তার সাথে দিহান তো ভালো থাকবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ইশির। দিশা সেই কখন থেকে দেখে যাচ্ছে ইশির কান্না। ফুঁপিয়ে কান্না করার কারণে বার বার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে ইশির। দিশা এগিয়ে এসে ইশির কাঁধে হাত রাখল। ইশি তৎক্ষণাৎ চোখ মুছে তাকালো। দিশার দিকে। দিশা কিঞ্চিৎ হেসে বলল”

_খুব ভালোবাসিস ভাইয়াকে তাইনা?” ইশি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। দিশা ইশিকে বলে”
_কাঁদিস নারে। তোর ভাগ্যে ভাইয়ার থেকেও ভালো ছেলে আছে দেখিস।
_আমার কোনো অনুতাপ নেই দিহানকে না পাওয়ায়। আমার খারাপ লাগে রে, কেন দিহান সুখে নেই বল? তুই কী পারিস না মেজো আম্মুকে বুঝিয়ে বলতে? আব্বুকে যতবার বলি আমাকে বকা দেয়। তোর আম্মুতো তোকে বকে না, বলনা গিয়ে তুই, যেন ওদের মেনে নেয়। ও যদি অরিনের সাথে ভালো থাকে তাহলে কিসের এতো রাগ বল? আমি যে দিহানের কষ্ট দেখতে পারিনা রে। আমার যে খুব কষ্ট হয় ওর অসহায় মুখের দিকে তাকালে। আজ নিজের চোখে ওর আর অরিনের কান্নাটা দেখলাম। বিশ্বাস কর কষ্টে ভেতরটা
ফেটে হয়ে যাচ্ছে আমার।

কাঁদতে কাঁদতে ইশি জড়িয়ে ধরল দিশাকে। দুইবোন কান্না করছে আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুটি চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৩২
#সুলতানা_সিমা

দুই মাস পর

লাল নীল বাতি আর নানান ফুলে সাজানো হয়েছে শান্তি নীড়। চারদিকে হৈ চৈ ছোট ছোট বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি। বাগানের পাশে খালি জায়গাটায় আরেকটা বাগান সাজানো হয়েছে ফুলের গেট দিয়ে। কিছুদূর পর পর একটা ছোট গেট পুরোটাই ফুলের তৈরি মনে হচ্ছে। প্রতিটি গেটের পরে দুটো টেবিল। চারিদিকে লাল সাদার সমাহার। বড় একটা জায়গায় অনেক সুন্দর করে স্টেজ সাজানো হয়েছে। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা “আজ দিশার গায়ে হলুদ”।

হ্যাঁ আজ দিশার গায়ে হলুদ। তার বড় চাচ্চুর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার। দিশা এই বিয়েতে রাজি নয়, তাঁর অবুঝ মন এখনো শাওনের নামে থেমে থাকে। কিন্তু কী করার গুরুজনদের মুখের উপর কথা বলার সাহস যে তাঁর নেই। তাঁর পরিবার একবার অপমানিত হয়েছে আবার হোক এটা সে চায়না। তাই হাসি মুখে মেনে নিচ্ছে সবকিছু। কিন্তু ভেতরটা যে পুড়ে যাচ্ছে, সেটা কী কেউ দেখছে? আয়নার সামনে বসে এক ধ্যানে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে দিশা। গায়ে ফুলের গয়না। দামী একটা লেহেঙ্গা সাজগোজ করেনি এখনো তবুও তাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তারপরও খুশি নয় সে, মুখে তাঁর নকল হাসি। দরজা খুলে এসে অরিন আর লারা ঢুকলো। দুজনই হলুদ শাড়ি পরেছে। তাদের উপস্থিতি পেয়ে দিশা তড়িঘড়ি করে চোখের পানিটা মুছে নিল। অরিন আর লারা তাকে সাজানোর জন্য বসালো। বিয়ে ঠিক হয়েছে থেকে অরিন দিশার সব কিছু দেখাশুনা করছে। দিশা কী খেলো না খেলো কী লাগবে তাঁর কী কী কেনা হয়নি। সব কিছু।

অরিন আগের থেকে কিছুটা ফর্সা হয়েছে। বিয়ের পরে মেয়েরা সুন্দর হয় এটা মনে হয় সত্যিই। অরিনের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শুধু অরিন নয়,এই দুইমাসে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে শান্তি নীড়েও। দিহানের বড় চাচ্চু আর আগের মতো রাগারাগি চেঁচামেচি করেন না। দিহানও পুলিশে চাকরি নিয়েছে। তবে এটা সে আপাতত করছে, এসব চাকরি বাকরি নাকি তাকে দিয়ে হবেনা, কোনো একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করে সে চাকরি ছেড়ে দিবে। তবুও কারো কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে নিজের বউ চালাবে না।

লারা জিহানের সম্পর্কটাও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। জিহান লারাকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। সে ভাবে যেভাবে বিয়ে হোক লারা তো আর খারাপ মেয়ে নয় থাকুক না এভাবে আমার কাছে।

এদিকে নীল এই তিন মাসে পারেনি লুপাকে মনের কথাটা বলতে। শাওন ও বলেনি সে লুপাকে ভালোবাসে, কারণ শাওন আন্দাজ করে নিয়েছে নীল লুপাকে ভালোবাসে। তাই সে চায়না নীলের মনটা ভেঙ্গে দিতে। লুপা আগের মতোই নীলকে বলে আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই, কিন্তু নীল এটা ওটার বাহানা দিয়ে বিষয়টা এড়িয়ে যায়। শোনেনা লুপার কথা। তার মনে ভয় হয় লুপা যদি তাকে ভালোবাসি বলে,তাহলে সে কীভাবে লুপাকে না বলবে আর শাওনের মনটাই বা কিকরে ভাঙ্গবে। তবে লুপার সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। লুপা মাঝে মাঝে নীলকে ঝাড়ি দেয় কারণ নীল তাকে একবার তুই একবার তুমি বলে। নীলও আরো ক্ষেপায় তাকে আর সেও নীলকে শাস্তি দেয়। মাঝে মাঝে কথা বলা বন্ধ করে দেয় তখন নীল কান ধরে ওঠবস করে ভিডিও বানিয়ে লুপাকে পাঠায়। লুপা এসব এসে অরিনের সাথে শেয়ার করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়।

এই দুইমাসে সব কিছু পরিবর্তন হলেও দিহানের মায়ের মাঝে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি এখনো অরিনকে সয্য করতে পারেন না। এইতো সপ্তাহখানেক আগের কথা। অরিন রান্না করেছে শোনে তিনি না খেয়ে সারাদিন বসে থাকলেন তবুও অরিনের হাতের রান্না খেলেন না। পরে দিহান অরিনকে নিষেধ করে বলে আর যেন সে কিচেনের ধারে কাছে না যায়। এ নিয়ে কেউ কথা বললে সে যেন দিহানকে শোনায় যা করার দিহান করবে তবুও সে যেন চুপ থাকে। কিন্তু অরিন দিহানের কথা রাখতে পারেনা সে দিহানের মায়ের সাথে একদিন ঝগড়া করে। শুধু দিহানের মা নয় ইশির সাথেও দু’তিন দিন ঝগড়া হয় তার।

সেদিন ইশি আর দিশার কথা শোনার পর থেকে ইশিকে তার সয্য হয়না। ইশি দিহানের পাশে বসলে দিহানের সাথে কথা বললে তার মনে হয় কেউ যেন তার কলিজা ছিড়ে ফেলছে। দিহান অবশ্য এ নিয়ে অরিনকে বকাবকি করেনি ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছে। কিন্তু কে বুঝে কার কথা। দিহানের সাথে ইশি কথা বললেই অরিনের গা জ্বলে যায়। দিহান রুমে আসার পরে দিহানের সাথে কথা বলেনা। দুদিন আগে অরিনকে নিয়ে দিহান ডাক্তারের কাছে যায়। বাসায় ফেরার সময় দিহান চকলেট এটা ওটা তার বোনদের জন্য আনে। ইশি দিহানের সাথে চকলেট কাড়াকাড়ি করে একসাথে দুজন খাটে পড়ে যায়। সেই থেকে দিহানের সাথে রাগ করে আছে অরিন। সেদিন সারারাত ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করেছে। দিহান টেনে টুনে বুকে এনে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। রাগে অরিন বলে সে ইশিকে খুন করে দিবে সয্য হয়না তার ইশিকে। দিহান হাসে অরিনের এমন পাগলামির কথা শোনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দিহান অরিনকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়না। চুপ মেরে বসে থাকে। সারাদিন দিহান পিছে পিছে হাঁটে কিন্তু সে দিহানের সাথে কথা বলেনি। রাগে তার মাথা ফেটে যায় ইশি আর দিহানকে একসাথে দেখলে। পরেরদিন রাতে অরিন দিহানকে ঝাপটে ধরে ঘুমায়, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। দিহান ভাবে হয়তো রাগ ভেঙ্গে গেছে কিন্তু না,সকালে উঠে আবার সেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। দিহান তখন অসহায় চেহারা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অরিনের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠে। দিহানের অসহায় মুখ তাকে অনেক কষ্ট দেয়। অরিন দিহানের সাথে কথা বলতে যাবে তখনই তাঁর ফোনে কল আসে।

সেদিন যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল সে ডাক্তার কল দেয়। ডাক্তার জানায় সে প্রেগন্যান্ট। খবরটা শোনে খুশিতে সে কান্না করে দেয়। আর কথা বলেনি দিহানের সাথে, ভাবে দিহানকে সারপ্রাইজ দিবে সে। তখনই কথা হবে দিহানের সাথে। অরিন দিহানকে না খুঁজে লারার কাজে সাহায্য করতে চলে যায়। আর যাই হোক নিজের ননদের বিয়েতে তো আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবেনা।

_ভাবী তোমার ফোন ভাজতেছে।” দিশার চেঁচিয়ে বলা কথায় অরিন কেঁপে ওঠে। এতক্ষণ ধরে সে ভাবনায় ডুবে ছিলো। এভাবে দিশার চেঁচানো শোনে তাঁর কলিজা লাফাতে শুরু করছে। বুকে থু থু দিয়ে বলল”
_হ্যাঁ হ্যাঁ শো শোনছি তো।
_কই শোনছো কতক্ষণ ধরে তোমায় ডেকে যাচ্ছি।
_খেয়াল করিনি।” মৃদু গলায় বলল অরিন। দিশা বলল”
_যাও কথা বলে আসো।” অরিন ফোন হাতে নিয়েই থমকে যায় এটা কী দেখছে সে, সেই মুখোশধারী এতোদিন পরে আবার ফোন দিছে? এতোদিন ধরে মুখোশধারী কে সেটা খুঁজতে খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে এক সময় হাল ছেড়ে দেয় সে আর লারা। অরিন শুকনো একটা ঢোক গিলে। লারার বুঝতে বাকি নেই কে কল দিচ্ছে লারা ইশারা দিলো কল ধরার জন্য। অরিন ফোন নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ততক্ষণে কল কেটে যায়। আর কল আসেনা শুধু একটা মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা “বাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ে আসো”। মেসেজটা পড়ে অরিনের আত্মা শুকিয়ে যায়। মোবাইলে সময়টা দেখে নেয় সন্ধ্যা ৭টা বাজে। তারমানে অন্ধকার নেমে গেছে। এখন আবার কোন হুকুম করবে সে, দিহানকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলবে না তো? ভাবতেই কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠল অরিনের। ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। চোখের জল টলমল করছে পলক পড়লেই সেটা গড়িয়ে পড়বে। পেটের উপর হাত রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে অরিন। আজ কত খুশির দিন তাঁর। আজ সে জানতে পেরেছে সে মা হবে, দিহানের বাচ্চার মা হবে। এই খুশির দিনে এই ব্ল্যাকমেইলার কে আসতে হলো। আচ্ছা এখন যদি বলে দিহানকে ছেড়ে দিতে তখন? বললে বলুক সে দিহানকে ছেড়ে দিবেনা। দিহান যে তার রক্তে মিশে গেছে। দরকার হলে মেরে দিবে এই জানোয়ারকে, তবুও সে দিহানকে ছাড়বে না। চোখের পানি মুছে নিজেকে শক্ত করে দিশার রুমে যায় অরিন। দিশা চোখ বন্ধ করে আছে লারা তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। অরিন লারাকে মেসেজটা দেখাল। লারা মেসেজটা দেখে দিশাকে বলল”

_দিশা তুমি একটু বসো আমি অরিনকে একটা কাজ দিয়ে আসি।
_ভাবী এখানেই থাকুক কী কাজ করবে?
_না না সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয়না। তুমি বসো আমি আসছি।” লারা অরিনকে নিয়ে তার রুমে গেল। দরজা বন্ধ করে এসে তার লাগেজ বের করল। লাগেজের সব কাপড় বের করে সব কাপড়ের নিচ থেকে একটা পিস্তল বের করল। পিস্তল দেখে অরিন আঁতকে উঠল। ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে চোখ বড় বড় করে থাকাল। লারা অরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল”

_এটা নাও। উলটা পালটা কিছু বলছে দেখলেই শেষ করে দিবে তাকে।
_আ আ আ আমি।
_হ্যাঁ তুমি। আজ এতোদিন পরে কেন ডাকছে সে, বুঝনা তুমি? তার কাজ শেষ। এবার চলে যেতে বলবে তোমাকে। পারবা যেতে? আমি জানি পারবা না। তাই শেষ করে দিবে তাকে।
_আ আপু।
_ভয় কেন পাচ্ছো তুমি? আমি তো তোমার সেফটির জন্য এটা দিচ্ছি। নাও এটা।” কাঁপা কাঁপা হাতে অরিন পিস্তল হাতে তুলল। খেলনার পিস্তল ছাড়া সত্যিকারের পিস্তল সে কখনো চোখেই দেখেনি ছুঁয়া তো দূর। অরিন শাড়ীর আঁচলে লুকিয়ে নিলো। লারা লাগেজে সব কাপড় ঢুকিয়ে লাগেজ জায়গা মতো রেখে অরিনকে বলল” যাও এবার। ভয় পেয়না।” বলেই লারা চলে গেল। অরিনের মনে হচ্ছে বিষধর সাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। ছোট ছোট পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো অরিন। তাকে দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে সে কোনোকিছু লুকাচ্ছে। আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নামলো অরিন। নীল শাওন আর দিহান মিলে কিসের যেন লিষ্ট করছে। সাথে আরো দুজন আছে তাদের চিনতে পারেনি অরিন। দিহান একবার আড়চোখে অরিনের দিকে তাকাল। তারপর নিজের কাজে লেগে গেল। যতই হোক বোনের বিয়ে ব্যস্ততা তো থাকবেই। অরিন সদর দরজা পেরিয়ে আসতেই তার হাতে হেচকা টান পড়ল। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে অরিন। ভাগ্যিস শাড়ীতে পেছানো হাত ধরেনি দিহান। নয়তো এখানেই সব শেষ হয়ে যেত। অরিন দিহানের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করে। দিহান অরিনকে বলে”

_কী হইছে তোমার সকাল থেকে কিছু খাচ্ছো না কেন?
_আমার ইচ্ছা হাত ছাড়ুন। আমার কাজ আছে।
_এদিকে তোমার কী কাজ। আর না খেয়ে কিসের কাজ? যাও রুমে খাবার রেখে আসছি খাও গিয়ে।
_খাবনা আমি,আপনার আদরের চাচাতো বোনকে নিয়ে খাওয়ান।” অরিনের কণ্ঠ কান্নামাখা। চেহারা এমন বানিয়ে রাখছে যেন এবার কেঁদেই দিবে। দিহান বুঝে গেল এত সহজে অরিনের রাগ ভাঙ্গবে না। সে অরিনের কপালে চুমু দিয়ে বলল”

_আর কোনোদিন কোনো সময় ইশির হাতটাও ধরব না আমি। কথাও বলব না কখনো। হ্যাপি।
_কথা বলতে পারবেন কিন্তু ছুঁতে পারবেন না। ছুঁয়েছেন তাহলে কিন্তু,,
_তাহলে কিন্তু?
_মেরে দিবো।
_কাকে?
_সবাইকে।
_আচ্ছা আমার বউটা সবাইকে মেরে দিবে? কথা না বলে বলে যে স্বামীকেও মেরে দিচ্ছে সে দিকে খেয়াল রাখছে। এদিকে যে বউ খাচ্ছেনা বলে তার স্বামীটাও না খেয়ে আছে সেটা জানে সে?”
_সরি। আর হবেনা। যান আপনি আপনার কাজ শেষ করুন আমি আমার কাজ করে আসছি। তারপর একসাথে খাবো আমরা।
_তার আগে আমি অন্য কিছু খেতে চাই।” দিহান মুচকি হেসে অরিনের দিকে একটু ঝুকে। অরিনের ঠোঁটের দিকে তার দৃষ্টি। অরিন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। ঠোঁটে তার লজ্জার হাসি চোখে মুখে লজ্জার আভা। দিহানে অরিনের ঠোঁট ছুঁই ছুঁই এরই মাঝে কেউ চিৎকার দিয়ে উঠে

_আহহহহহহহহ্।” দিহান অরিন দুজন দুইদিকে ছিটকে পড়ে। ইশি চোখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেচারি ভাবতেই পারেনি ভুল সময়ে তার এন্ট্রি হবে। এদিকে অরিন অগ্নি দৃষ্টিতে ইশির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে সে ইশিকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। দিহান অরিনের দিকে তাকিয়ে শুকনো এক ঢোক গিলল। এই ঝড় যে তার উপর দিয়ে যাবে এতে তার কোনো সন্দেহ নাই। ইশি বলল”
_তোকে বড় ভাইয়া ডাকছে।” দিহান চুল ঠিক করে কলার ঠিক করে এদিক ওদিক তাকিয়ে চলে যেতে লেগে থেমে যায়। অরিনের দিকে আবার তাকায় অরিনের হাতের মধ্যে পিস্তল দেখে কপাল কুঁচকে ফেলে সে। অরিন এখনো ইশির দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছে। ঘরের ভিতর থেকে দিহানের ডাক এলো। দিহান অরিনের হাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চলে গেলো। কোনো বাচ্চার খেলনা হবে এটা। এটাই ভাবল দিহান। ইশিও ভিতু চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো সে। অরিন এখনো রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। আপাতত নিজেকে কনট্রোল করে চলে গেলো পুকুর পাড়ে।

__________________________________

বাড়ির পিছনের দিকটায় কখনো আসেনি অরিন,এই প্রথম আসলো। চারদিকটা তাকিয়ে দেখল অরিন। শুধু গাছ আর গাছ। বাড়ির পিছনে অনেক জায়গা আছে। দিহানরা চাইলে এখানে আরেকটা বড় বিল্ডিং করতে পারবে। বাগানের লাইটিংয়ের কিঞ্চিৎ আলো আসছে এদিকে। সে আলোতে দেখা যাচ্ছে পুকুর পাড়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। অরিন শাড়ীর কুঁচি ধরে হেঁটে এগিয়ে গেল। একটু এগুতেই তার ফোনে টুং করে একটা মেসেজ আসলো। অরিন তৎক্ষণাৎ মেসেজ চেক করলো। কারণ সে জানে ব্ল্যাকমেইলার যা বলবে মেসেজে বলবে মুখে নয়। মেসেজ ওপেন করতেই থেমে গেলো অরিন। কারণ মেসেজে লেখা ছিলো “ওখানে থামো”। অরিন দাঁড়িয়ে থাকল। মনে অজানা ভয় হচ্ছে। মুখোশধারী ঘুরে দাঁড়াল। অরিন কিঞ্চিৎ কাঁপা গলায় বললো ”

_দে দে দেখুন। তা তা তানভী আমার স স সৎ বোন। ওর ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিতে হয় দিয়ে দিন। আমার আর কিচ্ছু যায় আসেনা। তবুও আমায় আর জ্বালাবেন না। আমি দিহানকে ছাড়তে পারবো না।” অরিনের ফোনটা টুং করে বেজে উঠল। অরিন মেসেজ চেক করলো। “আজ তোমার শেষদিন”। মেসেজ টা দেখে অরিনের পৃথীবি থমকে গেল কারণ মেসেজটা অন্য নাম্বার থেকে এসেছে। আর এই নাম্বারটা তার ফোনে সেভ করা। অরিনের মাথা ঘুরে উঠে। বিশ্বাস হচ্ছেনা তাঁর যে এই নাম্বারের মানুষটা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন কাঁপা গলায় বলল”

_আ আ আপনি আমাকে এখন মেসেজ দিয়েছেন?” অরিনের ফোনে আবারও এই সেভ নাম্বার থেকে মেসেজ আসলো। অরিনে চেক করে দেখলো “হ্যাঁ কেন?” অরিনের মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এ কাকে দেখল সে? যাকে সে নিজের সব কিছু দিয়ে ভালোবাসতো। সব থেকে বেশি বিশ্বাস করতো। তাকে? অরিনের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া দেখে মুখোশধারীর কিছুটা সন্দেহ হলো। তৎক্ষণাৎ ফোন চেক করে ৪৪০ ভোল্টের শকড খায় সে। এ ভুল কীভাবে করে ফেলল সে? এতক্ষণ ধরে সে 1সিম থেকে মেসেজ সেন্ড করছে? যে সিমটা দিয়ে সে অরিন লারাকে মেসেজ দেয় সে সিমটা 2সিম। ভুলেই গেছিলো সে। তাহলে অরিন তাকে চিনে ফেলল? নিজের উপর রাগ করে ফোনটা ছুঁড়ে মারল সে।

এদিকে অরিনের দম বন্ধ হয়ে আসছে। অদৃশ্য ধারালো অস্ত্র তার কলিজা টুকরো টুকরো কেটে দিচ্ছে। অতিরিক্ত কষ্ট পেলে নাকি মানুষ পাথর হয়ে যায়। অরিনও তাই হয়ে গেছে। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে তাঁর। সমস্ত শরীরের শক্তি যেন মাটি চুষে খেয়ে ফেলছে। হাত থেকে ফোন আর পিস্তল পরে গেল। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো সে। চোখ থেকে অঝোর ধারা বৃষ্টি ঝরে পরছে। প্রাণশূন্য হয়ে গেছে সে। আজ মনে হচ্ছে এই পৃথীবির সব থেকে অসহায় হচ্ছে সে। অশ্রুভরা চোখ দুটি তোলে তাকাল উপরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে কান্নাজড়িত গলায় বলল”
_লুপা শেষ পর্যন্ত তুই?”

লুপার আর লুকিয়ে থাকার উপায় নেই মাক্স খুলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে। এত বড় ভুল করে ফেলবে কল্পনাও করেনি সে। দুজনই পাথরের মতো বসে থাকে অনেক্ষন। অনেক্ষন পর লুপা এগিয়ে এসে অরিনের কাঁধে হাত রাখে। অরিন ঝাড়া দিয়ে লুপার হাত সরিয়ে চেঁচিয়ে বলে”

_এই পাপী হাতে ধরবি না আমায়। আমার ঘৃণা হচ্ছে তোর মতো এত নীচ একটা মানুষের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিলো। আরে তুই তো হচ্ছিস বন্ধু জাতের কল,,,,,অরিন লারার মুখ চেপে ধরলো। অরিন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো লুপাকে। চেঁচিয়ে বলল ”
_এখন খারাপ লাগছে কেন শোনতে? কী ক্ষতি করেছিলাম তোর বলবি? কী শত্রুতা ছিলো তোর আমার সাথে? আরে তুই তো জানতিই আমার মা নেই আমার বাবা নেই আমি অনাথ। তবুও আমাকে তোর দাবার গুটি কেন বানালি? [কিছুক্ষণ কী একটা ভেবে] তু তু তুই আমাকে মারতে চেয়েছিলি তাইনা? তু তুই আমার দিকে ছুরি ছুঁড়ে মেরেছিলি? আমার গলা টিপে ধরছিলি?” চোখের পানিটা মুছে মাটি থেকে পিস্তল তুলে লুপারা হাতে দিয়ে বলল”

_নে মার? মেরে দে আমায়। এতো বড় ধোঁকা খেয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা নেই রে আমার। মেরে দে। [চিৎকার করে] আরে মার না”।” লুপা পিস্তলটা অরিনের দিকেই ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলল”
_মরার খুব শখ তোর তাহলে তুই নিজেই মর আমাকে মারতে বলছিস কেন?
অরিন কাঁদতে কাঁদতে বলে”
_আমাদের মনের কথাগুলা কার কাছে বলতে আমাদের কোনো দ্বিধা লজ্জা থাকেনা জানিস। বেস্টফ্রেন্ডের কাছে। একমাত্র এই একটা মানুষ যার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্কের থেকেও গভীর সম্পর্ক থাকে। যে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেয়। কিন্তু সব বন্ধু যে বন্ধু নারে। কিছু বন্ধু বিষাক্ত সাপ। তুই বলতি না তুই আমার বোন হস? ওই যে লোকে বলেনা পর কখনো আপন হয়না। আজ আমার বিশ্বাস হচ্ছে সত্যি বলে মানুষ।”
অরিন ফোন আর পিস্তলটা তুলে দৌড়ে চলে আসে ওখান থেকে। লুপা অরিনকে হাত ধরে আঁটকাতে চায় অরিন ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে আসে। বাড়ির বাম দিকে আসে অরিন। ডান দিকে স্টেজ সাজানো হয়েছে তাই ওদিকে যায়নি সে। তার এখন একা থাকাটা বড্ড প্রয়োজন। ভিতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার। কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছে।

ড্র‍য়িং রুমে সবাইকে ডেকে আনলেন দিহানের মা। দিহানকে আর জিহানকে বাইরের কাজ ভাগাভাগি করে দিচ্ছেন। সাথে নীল আর শাওন ও থাকছে। একে একে সবাইকে কাজ ভাগ করে দিচ্ছেন তিনি। পরিবারের সবাই এখানে আছে। লুপা ছিলনা এই মাত্র এসে ঘরে পা রাখলো। ইশি দিহানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। দিহান সরে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালো। ইশি আর দিহানের মা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সবাই মনোযোগ দিয়ে দিহানের মায়ের কথা শোনছে এমন সময় হঠাৎ একটা গুলি এসে দিহানের মায়ের হাতে লাগে। ভয়ে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠে। এরইমাঝে আরেকটা গুলি এসে লাগে ইশির ঠিক বুক বরাবর। সাথে সাথে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। ইশির মা লারা লুপা সবাই ইশিকে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। চিল্লাচিল্লি শুনে দিশা রুম থেকে বেরিয়ে এসে এসব দেখে দৌড়ে নিচে নেমে আসে। লুপার মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন” আরে কেউ গাড়ি বের করো।” জিহান দৌড়ে গাড়ি বের করতে যায়। দিহান বাড়ির বাম পাশে দৌড়ে যায় গুলিটা এইদিক থেকেই এসেছে। এদিকে এসেই দিহান থমকে যায়। তার সামনে অরিন পিস্তল হাতে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে…..।
চলবে…….।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here