#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৩৫
#সুলতানা_সিমা
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে দিহান। মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ। তাঁর বেডের পাশে চেয়ারে বসে আছে শাওন, আর নীল বসে আছে বেডে। কাল সকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত তাঁরা হাসপাতালে আছে। কিন্তু সেটা শান্তি নীড়ের কেউ জানেনা। এমনিতেই তাঁরা কষ্টে আছে,এর মধ্যে যদি শোনে দিহান এক্সিডেন্ট করেছে, তাহলে সবার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে। তাই আর জানায়নি বাড়িতে। একবার ফোন এসেছে বাসা থেকে, নীল বলেছে তাঁরা শাওনদের বাসায় আছে।
পিটপিট করে চোখ খুললো দিহান। চোখ খুলতেই নীল আর শাওন হন্তদন্ত হয়ে, তার কেমন লাগছে,কষ্ট লাগছে কিনা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। দিহান নীল ও শাওনের কোনো জবাব দিলোনা। তাঁর ঠোঁট মুখ শুষ্ক। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষীণস্বরে বলে উঠল”
_অরিন।” নীল আর শাওন একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। আজ সকালে নিউজে দেখিয়েছে অরিন নাকি জেল থেকে পালিয়েছে। নীল দিহানকে বলল”
_এখন কেমন লাগছে রে? ” দিহান উঠতে চেষ্টা করলো। শাওন আর নীল ধরে বসালো। কিন্তু দিহান বসেও থাকতে চাইছে না, সে বেড থেকে নামতে চাইলো। নীল বললো” আরে নামছিস কেন? ওয়াসরুমে যাবি?” দিহান কোনো জবাব দিলোনা। ফ্লোরে পা রাখতেই তার মাথায় একঝাঁক ব্যথা এসে ঝেঁকে ধরলো। দিহান চোখ খিঁচে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে। নিজেকে কিছুটা শক্ত করে হাঁটা ধরে সে। তারপর বেরিয়ে আসে রুম থেকে। নীল শাওন পিছু পিছু দৌড়ে আসে। শাওন বলে ” আরে কই যাচ্ছিস তোর রেস্টের প্রয়োজন।” ডাক্তার এসে দিহানকে থামতে বলে সে থামেনা। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসে দেখে নীলের বাইক পার্ক করা। দিহান হাত পেতে ইশারা করলো চাবি দিতে। নীল কিছু বলতে যাবে দিহান হাত বারিয়ে থামিয়ে দেয়। তারপর আবার ইশারা দেয় চাবি দিতে। মুখে কিছুই বলছেনা। নীল চাবি বের করে দিহানের হাতে দিলো। দিহান বাইক নিয়ে চলে গেলো। শাওন আর নীল একটা ট্যাক্সি করে দিহানের পিছু নিলো।
বাইক চলছে দিহানের দেওয়া গতিতে, কিন্তু তাঁর চোখের জল ঝরছে তাঁর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এতোবড় ভুল সে কী করে করতে পারলো। তাঁর ভালোবাসাকে সে এভাবে নিজের হাতে কষ্ট দিলো? তাঁর সন্তান যার গর্ভে তাঁকে সে জেলে দিয়ে আসলো? কোনো যাচাই বাচাই ছাড়াই? বাবা হওয়ার খবর শোনাটা যে কতটা খুশির তা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য কারো নেই। আর সে কিনা সেই সুখটাই নিজের হাতে দুঃখের সাগরের ছুঁড়ে মারলো? দিহানের ইচ্ছে করছে নিজের কলিজায় নিজে ছুরি চালাতে। শেষ করে দিতে নিজেকে। কে সে এতোটা পাষাণ? কাল সকালে যখন শোনলো সে বাবা হবে, তখন মনে হয়েছিলো পৃথীবির সব সুখ তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে। তারপর আবার যখন শোনলো অরিন খুন করেনি, তখন সে পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিলো অরিনের কাছে। তারপর মাঝ রাস্তায় এসে কী হলো কিছু মনে নেই তাঁর।
_________________________
কাল যা ঘটেছেঃ
★
ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ভাতের প্লেট ছুঁড়ে ফেলে রুমের অনেক জিনিস ভাংচুর করে দিহান। তারপর কান্না করতে করতে বলতে লাগে “এমনটা কেন করলে অরিন। কী করিনি তোমার জন্য? নিজের সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। তবুও কেন ঠকালে আমায়? কেন বেইমানি করলে? তোমাকে বিশ্বাস করেই তো আমি জানতেও চাইনি কেন বিয়ে করেছিলে আমায়। তারপরও কেন আমার বিশ্বাস নিয়ে খেললে?” কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে খাটে এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়ে দিহান। মিনমিন করে আওড়াতে লাগে “কেন ঠকালে আমায় অরিন। খুব ভালোবাসি তোমায়, কেন বুঝলেনা সেটা।” এগুলা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে দিহান। ফোনের তীক্ষ্ণ রিংটোনের সকালে তাঁর ঘুম ভাঙ্গে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ডাঃ ফারহান কল দিয়েছে। ডঃ ফারহান তাঁদের আত্মীয় তাই কোনো কারণ ছাড়াই মাঝে মাঝে কল দেয়। বর্তমানে সে সিংগাপুর আছে। টাইম টা দেখে নিলো দিহান, সকাল 9টা বাজে। প্রথমে ফোন ধরতে চায়নি, পড়ে কী মনে করে যেন রিসিভ করে ফেলল। ফোন ধরতে ওপাশ থেকে উত্তেজিত গলায় বলল।”
_Congratulations দিহান।” ফারহানের কথাটা দিহানের কাছে বিদ্রুপের মতো শোনালো। রাগে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। দিহান ফোন কাটতে যাবে তখনই ফারহান বলে উঠল”
_কী ভাই আমাদের মিষ্টি খাওয়াবে না?
_কিসের মিষ্টি?” গম্ভীর গলায় বলল দিহান।
_কিসের মিষ্টি মানে? প্রথম বার বাবা হচ্ছো। বাংলাদেশ থেকে সিংগাপুর পর্যন্ত মিষ্টি খাওয়ানোর কথা, আর তুমি বলছো কিসের মিষ্টি। আরে ভাই হোয়াটসঅ্যাপে ফটো দিলেই আজকাল চলে। ” ফারহানের কথাটা দিহানের ভেতর খুব গভীরে গিয়ে স্পর্শ করে। লাফ দিয়ে উঠে বসে উদ্বিগ্ন গলায় বলে ” ক্ক ক্ক কী বলছো এসব বা বাবা হচ্ছি মানে?”
_কেন রিপোর্ট পাওনি? ডঃ মুন আমাকে বলল তোমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট।” দিহানের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে উঠলো। অরিন প্রেগন্যান্ট? তারমানে সে বাবা হবে? খুব খুশি খুশি লাগছে তাঁর। মনে হচ্ছে যেন সুখের রাজ্যে রাজত্ব করছে সে। সেই সুখের রাজ্যের সুখের সমুদ্রের সুখের নৌকায় চড়ে সুখের জলের উপর ভাসছে। চারদিকে শুধু সুখ সুখ আর সুখ। খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠল। খুশিতে যেন কথা বলা ভুলে গেছে সে। এতো খুশি লাগছে কেন তাঁর? ঠোঁটে হাসি চোখে জল নিয়ে কাঁপা বলল”
_আ আ আমি বা বাবা হবো?
_কেন রিপোর্ট আননি এখনো?
_না আজই আনবো গিয়ে, আমি রাখছি।” দিহান ফোন রেখে দৌড়ে রুম থেকে বের হলো। রুম থেকে বেরিয়েই পা থেমে গেলো তাঁর, মূহুর্তেই সব হাসি উধাও হয়ে গেলো। ভুলেই গেয়েছিলো অরিন কোথায় আছে।
মাঝে মাঝে যেমন আকাশে একঝাঁক পাখির বসে,আবার মূহুর্তেই তা উড়তে উড়তে চলে যায়। ঠিক তেমনি যেন তাঁর মনের এই সুখ। এই এলো আবার এই উড়ে চলে গেলো। শুকনো কয়েক ঢোক গিলে কান্না আটকাতে চাইলো সে। কিন্তু পারলো না। সুখের জলের সাথে দুঃখের জলের মিশ্রণ হয়ে গেলো। পা পিছিয়ে আবার রুমে চলে আসে দিহান। রুমে ঢুকেই জোরে একটা চিৎকার দিলো যা পৌছালো বাড়ির সবার কান পর্যন্ত। তারপর চিৎকার করে বলতে লাগলো” আমি নিজেকে শেষ করে দিবো অরিন। তোমাকেও শেষ করে দিবো।” বলেই কাঁদতে লাগে দিহান।
একটু পরে দিহানের ফোনে আবার কল আসে। ইন্সপেক্টর আহসান কল দিয়েছেন। দিহান চোখের পানিটা মুছে ফোন ধরে।
_হ্যালো।
_হ্যাঁ দিহান, তোমার বাবাকে ফোন দিলাম ধরেন নি। একটা ব্যাপার তো ঝাপসা হয়ে গেলো।
_কী ব্যাপার স্যার?
_খুনটা তোমার ওয়াইফ করে নি। অন্যকেউ করেছে।” কথাটা শোনে দিহান শকড খায়। অরিন খুন করেনি মানে। কিছুক্ষণ সে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। ফোনের ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো শোনে দিহানের ধ্যান ভাঙ্গে। তারপর কাটা গলায় বলে
“কী বলছেন স্যার। তাহলে কে খুন করেছে?
_তা জানিনা।
_স্যার আমাকে একটু খোলে বলুন প্লিজ।
_দিহান আসামির হাতে যে পিস্তল পাওয়া গেছে। ওই পিস্তলের গুলির সাথে ডেড বডিতে পাওয়া গুলির কোনো মিল নেই। কেবল তাই নয় এই গুলি পিস্তল থেকে নয় রিভলবার থেকে করা হয়েছে।
[সরি সেদিন আমি জামিল খানের হাতে রিভলবার না লেখে পিস্তল লেখে ফেলছি]
ইন্সপেক্টর আহসান রাজের কথা শোনে বড়সড় একটা ধাক্কা খায় দিহান। অরিনের হাতের পিস্তলে দুটো গুলি ছিলো না, যা দিহানের সন্দেহ আরো গাঢ় করে দিয়েছিলো। দিহান হন্তদন্ত হয়ে বলে”
_এসব কী বলছেন স্যার? আপনি সিয়র তো?
_অবশ্যই দিহান, আমি সিয়র না হয়ে তোমায় ফোন করিনি। আমার প্রথমেই মনে হয়েছিলো এটা পিস্তলের গুলি নয়। পিস্তল থেকে রিভলবার অনেকগুণ শক্তিশালী, শরীররে ড্যামেজ ক্ষতের পরিমাণ বেশি, রিভলবারে পিস্তল থেকে গুলি করার সময় রিকয়েল (ধাক্কা) পরিমাণ বেশি। পৃথিবীতে স্মিথ এন্ড ওয়েসন এর তৈরী ৫০০ ম্যাগনাম সিরিজ ব্যাপক জনপ্রিয়। যা ব্যবহার হয়েছে মৃত ইশির বেলায়। পিস্তল থেকে রিভলবারের গুলিতে বারুদের পরিমাণ বেশি থাকতে পারে এবং থাকে। তাই বলে পিস্তলেও কম থাকে তা কিন্তু নয়। তবে এখন তো রিপোর্ট সব পরিষ্কার করে দিচ্ছে। খুনটা পিস্তল দিয়ে নয়, রিভলবার দিয়ে হয়েছে। যা আসামির হাতে আমরা পাইনি।”
দিহানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। এসব কী শুনছে সে? তাহলে কী অরিন সত্যি খুন করেনি ইশিকে? বুকের ব্যথাটা তীব্র হয়ে গেলো দিহানের। শুকনো ঢোক গিলে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো। ফোনের ওপাশ থেকে ইন্সপেক্টর আবার বলে উঠলেন।
_আজ তোমার আব্বু আর চাচ্চুদের নিয়ে একবার আসবে। রাখছি এখন।” টুট টুট করে ফোন কেটে গেলো। দিহানের মাথা ভনভন করছে। শূন্য মস্তিষ্কে কিছুই আসছে না তাঁর। অরিনের কান্না ভেজা মুখ চোখে ভেসে উঠছে। কত কাকুতি মিনতি করেছিলো অরিন। পায়ে ধরে কেঁদেছিলো, আর সে কিনা। কেমন ভালোবাসা তাঁর যে ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই। দিহান আর এক মূহুর্ত বসে থাকল না, উঠে দৌড়ে বের হলো ঘর থেকে। এভাবে দিহানকে বের হতে দেখে শাওন আর নীল অবাক হয়, তারাও বের হয় দিহানের পিছে। ততক্ষণে দিহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়। নীল আর শাওন বাইক নিয়ে দিহানের পিছু নেয়। দিহান একটু আগে চিৎকার করে বলেছিলো, শেষ করে দিবে সে নিজেকে। শেষ করে দিবে অরিনকে। নীল আর শাওনের ভয় হচ্ছে, যদি উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলে। কিছুদূর যাওয়ার পরে দিহানের গাড়ি একটা বাসের সাথে ধাক্কা খায়। আল্লাহর রহমতে কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে গুরুতর আহত হয়েছে অনেকে। দিহানের মাথা ফেটে যায়। তারপর নীল আর শাওন মিলে দিহানকে নিয়ে হসপিটাল আসে।
______________________________________
বর্তমান
থানায় এসে দিহান সোজা যায় অরিনকে যেখানে রেখেছিলো ওইখানে। কিন্তু ওখানে কেউ নেই। দিহান সবাইকে ডাক দেয়৷ সবাই দৌড়ে এসে দিহানের সামনে দাঁড়ালো। দিহান জিজ্ঞেস করলো অরিন কই, কেউ কথা বলল না, সবাই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকল। দিহান চেঁচিয়ে বলে উঠলো” কথা কানে যায়না, অরিন কোথায়?” দিহানের চিৎকারে সবাই কেঁপে ওঠে। পুলিশ অফিসারের ছেলে যে নিজেও পুলিশ। তাঁকে ভয় পাবেনা তো কাকে পাবে? ভয়ার্ত গলায় এক হাবিলদার বলে ”
_স্যার মেয়েটা পালিয়েছে।” কথাটা দিহানের বুকে এসে পাথরের পাহাড় হয়ে হয়ে ধাক্কা দিলো। তাঁর হাড়গোড় যেন সব ভেঙ্গে যাচ্ছে। কষ্ট আর রাগে তার শরীর কাঁপছে। পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল তাঁর। রাগে একটা চেয়ার হাতে নিয়ে আছাড় মেরে ফেলে মেঝেতে। তারপর চেঁচিয়ে বলল ”
_তোমরা এতোগুলা মানুষ থাকতে এইটুকু একটা মেয়ে পালায় কীভাবে?
_স্যার আমরা মেয়েটাকে অনেক খুঁজছি স্যার। কিন্তু খুঁজে পাইনাই।
_জাস্ট সেট আপ ড্যাম ইট। কাকে মেয়ে মেয়ে ডাকছো? শী ইজ মাই ওয়াইফ। জাস্ট কল হার মেডাম।” জোরে কথা বলায় দিহানের মাথায় ব্যথা শুরু হয়ে যায়। মনে হচ্ছে কেউ তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে। দিহান দাঁতে দাঁত চেপে মাথা চেপে ধরে। তারপর মাথা ছেড়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ” খোঁজ লাগাও। পত্রিকায় ছবি ছাপাও। টিভিতে খবর দাও। দেশের প্রতিটি কোণায় কোণায় খুঁজো। ২৪ ঘন্টার ভেতরে খুঁজে বের করো। যদি খুঁজে না পাও তাহলে তোমাদের সবার চাকরি হারাবে।
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দিহান বেরিয়ে গেলো থানা থেকে। তারপর খোঁজতে লাগলো অরিনকে। সারাদিন খুঁজলো, রাত খুঁজলো পেলোনা অরিনের সন্ধান। তবুও থামলো না সে। নিদ্রাহীন উপবাসে কেটে যাচ্ছে সময়, তবুও মিলছেনা অরিনের কোনো খোঁজ। কই গেলো অরিন? কোথায় আছে সে? কেমন আছে এখন? ঠিক আছে তো সে? প্রশ্নগুলো খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে দিহানকে। চোখ জোড়া বার বার ভিজে যাচ্ছে। এ কেমন অসহনীয় যন্ত্রণা। এ কেমন বিষাক্ত সময়। কেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দিহানের? অপরাধী বলে অরিনের দিকে তো আঙুল সে নিজেই তুলছিলো, তাহলে কেন এতটা পোড়ছে সে?
#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৩৬
#সুলতানা_সিমা
ছয় বছর পর❤
★
★
কলকাতার একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে, দিহান নীল ও শাওন। তিন বন্ধু এখন এস এন অ গ্রুপ অফ কোম্পানির মালিক। একটা প্রজেক্টের জন্য তাঁরা তিনজনই কলকাতা এসেছে। তাদের সাথে এখানে আরও কয়েকজন বসে আছেন। তবে সব থেকে বিরক্তিকর যিনি আছেন। তিনি মোটাতাজা টাকলা একজন অভদ্রলোক। আপাতত দিহান নীল শাওনের কাছে এটাই মনে হচ্ছে। উনার নাম রঞ্জিত চ্যাটার্জি। আর বি গ্রুপ অফ কোম্পানির এমডি তিনি। সেই কখন থেকে কার সাথে যেন কথা বলে যাচ্ছেন। বার বার ঠাট্টা দিয়ে হাসছেন। আর কথা বলার সাউন্ড, মনে হয় মাইক নিয়ে কথা বলছেন। বিরক্ত হয়ে দিহান উঠে গেলো একটু অন্য পাশে। থাই গ্লাসের উপর হাত রেখে তাকালো রাস্তার দিকে। একটি মেয়ে আর ছেলে একটা ছোট বাচ্চাকে ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটা বার বার বাচ্চাটাকে কোলে নিতে চাইছে কিন্তু বাচ্চাটা হাঁটতে চায়, সে কোলে উঠবেনা। কত সুন্দর একটা পরিবার, কত সুখী তাঁরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ দিহানেরও এমন একটা পরিবার থাকতো। বুক ছিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো দিহানের।
সময়ের স্রোতে ভেসে চলে গেলো ছয়টা বছর। আজও নেই অরিনের কোনো খোঁজ। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে খোঁজেনি দিহান অরিনকে। বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় কোণায় খোঁজেছে সে অরিনকে। কিন্তু ফলাফল বরাবরই শূন্য পেয়েছে। অরিন চলে যাওয়ার পর টানা তিনদিন দিহান না খেয়ে না ঘুমিয়ে শুধু অরিনকেই খোঁজছিলো, যার কারণে সে অসুস্থ হয়ে যায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সুস্থ হতে তিন চার দিন সময় লাগে। তার সাপ্তাহখানেক পরে লুপা সবাইকে সবকিছু খুলে বলে। সবকিছু শুনে তাদের পরিবারে অনেক বড় ঝগড়াও হয়। ঘরের মানুষ ঘরের সম্মান নষ্ট করেছে শুনলে তো ঝগড়া হবেই। সেই ঝগড়ার রেশ ধরে শান্তি নীড়ের এক পরিবার তিন পরিবারে পরিনত হয়। দিহান লুপাকে দুই-তিনটা থাপ্পড় মারে, বার বার বলে তোর জন্য আমি অরিনকে হারিয়েছি। লারার প্রতিও তাঁর অনেক রাগ হয়, কিন্তু অন্যের বউ মারার,বা তাকে ধমক দেওয়ার মতো শিক্ষা সে পায়না। সেদিন তাঁর বাবা মাকে নিয়ে শান্তি নীড় থেকে বেরিয়ে আসে। লুপার বাবাও সেদিন উনার বউ বাচ্চা নিয়ে নিজের ইচ্চায় বাসা থেকে বেরিয়ে যান। কারণ লুপার বড় চাচ্চু বার বার বলছিলেন তোরা ঘরের দুষমন। ছেলে হারানোর ব্যথা এখনো তিনি ভুলতে পারেননি। তবুও ভাইদের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকেন। তারপরও যদি ভাইয়ের কাছে শুধু অবহেলা পান কেমন লাগবে? তারপর দুদিন পর দিহানের বড়মারাও চলে যান শান্তি নীড় ছেড়ে। শান্তি নীড়ে এখন আর কেউ থাকেনা। শখের গড়ে তোলা বাড়িটা এখন মানব শূন্য।
পাগলের মতো অরিনকে খোঁজতে খোঁজতে দিহান প্রায় পাগল হয়ে। মেন্টাল হসপিটালে ছিলো ছ’মাস। তারপর সুস্থ হওয়ার পরে সে অন্য রকম হয়ে যায়। আগের দিহানের সাথে এখনের দিহানের কোনো মিল নেই। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে। কারও সাথে মিশে না প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা। হাসি গুলো যেন সব উধাও হয়ে গেছে। ভুল করেও তাকে হাসতে দেখা যায়না। প্রতিরাতে তার ঘর থেকে গিটারের সুর ভেসে আসে। কোনো রাতই যে তার ঘুম হয়না গিটারের সুরই তার সাক্ষী। হানিফ চৌধুরী আর সুমনা চৌধুরী দুই বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন দিহানকে আবার বিয়ে দিতে,কিন্তু উনারা বার বারই ব্যর্থ হয়েছেন। অরিন যদি সেদিন পালিয়ে না যেতো তাহলে হয়তো পরের দিন তার জন্য সব থেকে সুখের দিন হতো। আজ সবকিছুই স্বাভাবিক থাকতো। কিন্তু আফসোস একটাদিন অপেক্ষা করে দেখেনি অরিন।
লুপা নীল শাওন দিশা কেউ ভালো নেই আজ। লুপা সবকিছু বলার পরে নীল লুপার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। লুপা এর দু’তিন সাপ্তাহ পরে নীলের সাথে দেখা করে জানায়, সে নাকি নীলকে ভালোবাসে।নীল লুপাকে রিজেক্ট করে দেয়। সে লুপাকে বলে “যে নিজের পরিবারের সম্মান নষ্ট করে, সে আমার পরিবারের সম্মান কীভাবে রক্ষা করবে? যার কাছ থেকে তাঁর সব থেকে কাছের বন্ধু ঠকে তাঁর কাছে যে আমি ঠকবো না তাঁর কী গ্যারান্টি আছে?” সেদিনের পর থেকে নীল লুপার সাথে একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। লুপা নামটা শুনলেও নাকি তাঁর ঘৃণা লাগে। কিন্তু লুপা বার বার নীলের সাথে দেখা করার জন্য বলার জন্য বেহায়ার মতো বার বার নীলের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো। কিন্তু পাষাণ নীল বিরক্ত হয়ে বাসা বদলে দেয়। সমাপ্তি ঘটে লুপার পাগলামির। এখন হয়তো লুপা জানেও না নীল কই আছে।
এদিকে দিশার বরের পরিবারের কানে তাদের আলাদা হওয়ার ঘটনা পৌছে যায়। তারপর বর নিজেই বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। আর হয়নি বিয়ে দিশার। এখনো দিশাকে বিয়ে দিতে পারেনি তাঁরা। বিয়ের কথা শুনলেই দিশা না বলে দেয়।
দিহানের হাতের আঙুলে টান পরতেই ধ্যান ভাঙ্গে তাঁর। চোখের পানিটা মুছে নিচে তাকিয়ে দেখে চার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে হাতে একটা আইসক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটা অনেক কিউট গোলাকার মুখ,টানাটানা চোখ,চোখের পাপড়ি গুলা ঘন,গাঢ় কালো। কপাল ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট চিল্কি চুল। মাথায় আবার দুইটা ঝুটি বাঁধছে। বাচ্চাটাকে দেখে দিহানের চোখ জুড়িয়ে গেল। কলিজা ঠান্ডা করার মতো সুন্দর্য নিয়ে জন্মেছে এই বাচ্চাটা। দিহান মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে ভ্রু নেড়ে জিজ্ঞেস করলো” কী।” বাচ্চাটা আইসক্রিম বাড়িয়ে দিলো দিহানের দিকে। দিহান মুচকি হাসলো তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল” তুমি খাও।” মেয়েটা কয়েকবার না সম্মতি মাথা নাড়িয়ে আবার বাড়িয়ে দিলো। দিহান বলল” আমি এসব খাই না,তুমি খাও।” বাচ্চাটা পুনরায় দিহানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। দিহানের মায়া হয়, ইস বাচ্চাটা মনে হয় কথা বলতে পারেনা। এবার না বলতে ইচ্ছে করলোনা, সে একটু নিচু হয়ে এক বাইট আইসক্রিম খেলো। বাচ্চাটা চোখ বড় বড় করে তাকালো, তারপর ভ্যা করে কেঁদে দিলো। দিহান বোকা হয়ে গেল। বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে হাতের আইসক্রিম ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে লাগল। পুরো রেস্টুরেন্টের মানুষ এক হয়ে গেলো। সবাই জিজ্ঞেস করছে কী হইছে। বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে আঙুল দিয়ে দিহানকে দেখিয়ে বলে “আমি হিসু করতে যাব বলে এর হাতে আইস্ক্রিম দিয়ে যাচ্ছিলাম। এই লোকটা আমার আইসক্রিম খেয়ে ফেলছে।” বাচ্চাটার কথাশুনে দিহান হাঁ হয়ে যায়। সবাই দিহানের দিকে অবাক হয়ে থাকালো। দিহানের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আইস্ক্রিম লেগে আছে। মানে পরিষ্কার, দিহান সত্যিই খেয়েছে। দিহান বলল” আরে না না আমি খাইনি, আসলে,,,” আর কিছু বলতে পারলোনা দিহান একটা মেয়ে বলল” আপনি না বলছেন কেন? আমি নিজের চোখে দেখেছি আপনি খেয়েছেন” আরেকজন বলল” আপনার মুখে তো আইসক্রিম লাগানো।” দিহান লজ্জায় মরে যাচ্ছে। নীল দাঁতে দাঁত চেপে দিহানকে কিঞ্চিৎ স্বরে বলল” দিহান এটা কী করেছিস তুই?” দিহান রাগি লুকে তাকালো। মেয়েটা নিজেই খাওয়ালো আবার বলছে দিহান খেয়ে ফেলছে। এই মেয়েটারে বোবা ভাবছিলো সে?
মেয়েটার কান্না থামছেই না। ম্যানেজার একটা আইসক্রিম হাতে দিয়ে বলল “এই নাও আইসক্রিম কেঁদনা”। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলল ” না আমি এইখানের আইসক্রীম খাবোনা আমার ওই আইসক্রিম খাবো।” একজন কর্মচারী এসে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল” আসো আমি তোমাকে আগের জায়গা থেকে আইস্ক্রিম কিনে দিবো কান্না থামাও।” বাচ্চাটা হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল “না ওই লোকটাকে দিতে হবে” কর্মচারী দিহানকে বলল “এটা আমাদের মালিকের মেয়ে। উলটা পালটা হলে খবর করে ছাড়বে,আপনিও আসেন।” না পারতে দিহানও গেলো পিছু পিছু, মেয়েটা কান্না করেই যাচ্ছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হবে তখন একটি মেয়ে বলল” আরে মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেন?” কর্মচারী দিহানকে দেখিয়ে বলল” আসলে এই স্যারের কাছে ও আইস্ক্রিম রেখে হিসু করতে গেছিলো। হিসু করে আসতে আসতে স্যার আইসক্রিম খেয়ে ফেলছে,তাই কাঁদছে।” দিহান মনে হয় এবার কেঁদেই দিবে। লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। কী মসলা মিশ্রিত কথা বলছে লোকটা। না জানি আর কাকে কী বলে। একটা আইসক্রিম ওয়ালার কাছে এসে থামলো লোক, দিহান আল্লাহ আল্লাহ করছে কেউ যেন জিজ্ঞেস না করে কেন কাঁদছে। কিন্তু না, দিহানের দোয়ায় পানি ঢেলে আইসক্রিমওয়ালা জিজ্ঞেস করে ফেলল “আরে কান্দে ক্যান মাইয়াটা?” লোকটা বলল” আসলে ও আইসক্রিম দিয়ে হিসু করতে গেছিলো এই স্যার ওর আইসক্রিম খেয়ে ফেলছে।” আশেপাশের সবলোক দিহানের দিকে কেমন জানি চোখে তাকাচ্ছে। লজ্জায় দিহানের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কী বজ্জাত মেয়ে আল্লাহ জানে এর মা কেমন বজ্জাত।
চলবে……।
মাথা ব্যথা নিয়ে লেখছি জানিনা কেমন হইছে। ভুল ক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।
চলবে……।