ভালোবাসি বলে দাও পর্ব -০৪+৫

#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

4+5

সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে আম্মু আমাকে তার সামনে পুতুলের মতো বসিয়ে রেখে তৈরি হচ্ছে ফারিন আপুর বাসায় যাওয়ার জন্য আর আমি ওনার দিকে বিরস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছি তার একটাই কারন, আম্মু চাইছে যে আমিও তার সাথে সঙ্গ দিয়ে ফারিন আপুর বাসায় যায়। কিন্তু সে ভালোভাবেই জানে তার মেয়ে বিশ্ব ঘাড়ত্যাড়া তাই যতখন না তিনি বাসার বাইরে পা রাখছে তার আগ অবধি তিনি আমাকে তার সাথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
আম্মুকে দেখেও না দেখার ভান করছি। আম্মু ক্ষনিক ক্ষনিক বলে উঠছে,
‘ফারিন এর মা কাচ্চি খুব ভালো বানায়, বোরহানি টাও। তুই না গেলে কিন্তু পরে আফশোষ করবি।’

আমি আম্মুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি তাতেও একেবারে দমে গেলেন না, পুনরায় বললেন,
‘ওদের বাসাতে সুইমিং পুল আছে, একটা গোলাপী রাঙের কাঠগোলাপ গাছ ও আছে। ‘

কাঠগোলাপ নিয়ে কোন বিতর্ক নয়, আমি মনে করি সাদা কাঠগোলাপের সাথে পৃথিবীর অন্য কোন কাঠগোলাপের তুলনা চলে না তাই এবার আর একেবারেই চুপ করে থাকতে পারলাম না আমি, নিরবতা ভেঙে বললাম,
‘আম্মু কি শুরু করছো কি। কি পাচ্ছো এসব বলে। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি যাবো না। তারপর আমার প্রিয় জিনিসগুলোকে নিয়ে লোভ দেখাচ্ছো।’

আম্মু এবার তার গোছগাছ ফেলে আমার কাছে বসে আমার গালে হাত রেখে বললেন,
‘কি হয়েছে মা এরম করছিস যে। তুই তো বিরিয়ানির কথাতে না করিস না আর গেলেই বা সমস্যা কি? আর কালকে সকালেই তো ফিরে আসবো। ‘

আমি এবার রেগে গেলাম খুব।
‘তুমি আমার প্রিয় জিনিসগুলো নিয়ে এভাবে ইমোশোনালি ব্ল্যাকমেইল করবে না, আর ফারিন আপুর বাড়ি লাল কাঠগোলাপ কেন কোন ফুল গাছই থাকতে পারে না মোটেও কারন উনি একটা রাক্ষসী, ওনার বাসায় সুন্দর জিনিস কিছু থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। ‘

ওনাকে রাক্ষসী বলাতেই আম্মু ধমক দিল।
‘এভাবে কেও কাওকে বলে? তাছাড়া অতো ভালো মেয়েটাকে নিয়ে তোর এত রাগ কিসের? সামনে থাকলেও কথা বলিস না খুব একটা আমি লক্ষ করেছি। ‘

ওনার প্রতি সাই দিয়ে আম্মু একের পর একটা কথা বলেই চলেছে। আমি আর মানতে পারছি না কোনরকমে। বিরক্তির সর্বোচ্চ সীমায় পৌচ্ছাছে বিষয়টা। আমিও ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলাম,
‘সে ই বা কখন আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলে? ‘

আম্মু তখন বোকা বনে গেল একটু। সত্যিই উনি কখনও নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলেন না।
‘ও তোর থেকে বয়সে বড়ো তাছাড়া বুয়েটে পড়ে, দেখতেও সুন্দর। আর তুই ছোট মানুষ তোর সাথে কি এমন কথা বলবে, তাই হয়তো বলে না। ‘

আম্মুর কথাতে রাগ আর একটা চাপা কষ্ট দুই কাজ করছে আমার মাঝে। সহ্য হলো না আর, আমি উঠে দাঁড়ালাম আর বললাম,
‘আর কদিন পরই তো তোমার ভাগ্নার বউ হবে সে, তাদের বিয়ের পর ২৪ ঘন্টা ভাগ্নার শ্বশুর বাসায় গিয়ে সময় কাটিয়ে এসো, আমার সমস্যা নাই কিন্তু আমাকে এর মধ্যে টানবে না তুমি কখনও। আর রেডি হলে বেরিয়ে যআবে আমাকে আর ডাকবে না। ‘

কথাটা বলে রুম থেকে আমি বেরিয়ে গেলাম তড়িঘড়ি করে।
আচ্ছা ফারিন আপু উনি কি সত্যিই এতোটা ভদ্র নাকি ভদ্র হওয়ার অভিনয় করেন? কই আমার সাথে তো উনি তেমনটা নন।

ঘরে গিয়ে দরজাটা সপাটে আটকে দিলাম আমি। কিন্তু এ রাগ আমি কাকে দেখালাম। এই পুরো রুমাটাকে নাকি আমার নিজের মাঝেকার আর এক আরুকে? আফশোষ আমার রাগ বোঝার মতো কেও নেই। বাবা কাজের সূত্রে বাসায় নেই আজ পনেরো দিন, কথা দিয়েছিল আমার উনিশতম জন্মদিনের পরদিনই তিনি ফিরে আসবেন, আমি অপেক্ষাতে আছি। আসলে ওনাকে সব অভিযোগ ব্যাক্ত করবো। বাবার বুকে মাথা রেখে আমি যে শান্তি পাই তা আর কোন কিছুতে পাইনি কখনো।

মুরব্বীরা বলে রাগ হলে নাকি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়তে হয়, আমার রাগ সহজে কমার নয় তাই চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম আমি প্রায় বিশ মিনিট ধরে, আম্মু দশ মিনিট আগে বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে আমাকে কতোবার দরজা খোলার জন্য বলেছিলেন তা মনে নেই। যাওয়ার আগে ঠিকমতো সময়ে খাওয়ার কথা বলেছেন। বাসার রহিমা খালা নাকি বিকালে আসবেন আর আজকে রাতে বাসাতেই থাকবেন, কারন আমাকে বাসায় রেখে আমার চিন্তা মাথায় করে আম্মু বেরিয়েছে তাই।
অনেকখন পর রাগটা কিছুটা কমেছে।কালকে রাতের পর আরিশ ভাইয়া আর ফোন করেননি। তার কথা আমার যে সব সময় মনে পড়ে তেমনটা নয়। বিশেষ বিশেষ সময়ে আমার তার কথা মনে পড়ে, যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়, কলেজে যাওয়ার সময়, বাসায় ফেরার সময় আর সন্ধ্যা থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। আমার গোটা টাইম টেবিল জুড়ে ওনারই বসবাস। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার টাইম টেবিল থেকে যদি ওনাকে সম্পূর্ণ রূপে বাদ দেওয়া যেত তাহলে অনেক ভালো হতো। কিন্তু যখন উনি মেডিকেল পারপাস বা ডিউটির জন্য আমার টাইম টেবিল থেকে সাময়িকের বিরতি নেন তখন অদ্ভুত কোন কারণবশত সেই দিন গুলো আমার পার হয়ে উঠতেচাই না। এই যেমন আজ! কেন এমনটা হয় আমি তা জানি না। আর হয়তো কখনো জানতেও চাই না।

আম্মু বলেছে জরুরি তলব ব্যাতিত মাঝে মাঝে ল্যান্ডলাইন থেকে তাকে ফোন করতে। আচ্ছা তাদের কি আমার মতো আরিশ ভাইয়ার কাজকর্মের প্রতি আঙুল উঠাতে ইচ্ছে করে না? যেমন এই যে আমার ফোনটা তিনি নিজের কাছে বাজেয়াপ্ত করে রেখে দিলেন তার জন্য কি আমার বাসার লোক আমার হয়ে কথা বলবে না। উনি কি মি ফারফেক্ট? যার কোন সিদ্ধান্ত ভুল হতেই পারে না এমন এক ধারনা আমার বাসার লোক তাদের মনের মাঝে পুষে রেখেছে ওনার জন্য। কথাগুলো ভাবলেই আমার ব্রেন এর নিউরোন গুলো যেন ক্লান্ত হয়ে যায়। ঘুমাবার চেষ্টা করলাম জানি বৃথা ঘুম আসবে না।
এক বিশেষ রেসিপিতে এক্সপেরিমেন্ট এর কথা মাথায় আসতেই বিছানা থেকে এক লাফে নেমে পড়লাম। এখন সারা বাসা জুড়ে কেও নেই আর এই সময় আর এখনই শুরু হবে আমার নানান রকমের এডভেঞ্চার।

সময়ে অসময়ে কফি বানানো আমার অভ্যাস অবশ্যই তা আরিশ ভাইয়ার জন্য। উনি সবসময় কফি খান, বেশি স্ট্রেস পড়লে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি। আমি কখনো খাওয়ার চেষ্টা করিনি তবে আজকে নিজেও একটু ট্রাই করে দেখলে কেমন হয়?
কফিটা বানিয়ে দুটো কাপে ঢাললাম, একটা আমার আর একটা আশরাফ চাচার জন্য, উনি আমাদের বাসায় বিগত পনেরো বছর ধরে সিকিউরিটি হিসাবে আছেন,ছোট থেকেই চাচাকে দেখছি। চাচীকে ভীষনরকম ভালোবাসেন তিনি। অবশ্য এখন আর চাচী নেই, চাচীকে উনি ভীষনরকম মিস করেন। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলেই চাচার কাছে যাই তার আর চাচীর প্রেমের গল্প শুনতে, আগে বয়স অল্প থাকার দরুন চাচা শোনাতেন না তবে এখন আর বলতে দ্বিধা বোধ করেন না কারন এখন আর আমি তো আর ছোট নেই।
কফিটা নিয়ে চাচার সামনে বসলাম। চাচা আমাকে দেখতেই একগাল হাসি হেসে উঠতেই আমি বললাম,
‘চাচা এটা খেয়ে বলেন তো কেমন খেতে! ‘

চাচা বেশ আগ্ৰহ দেখিয়ে বললেন,
‘এইডা কি বানাইসো আরু মামনি?

আমি পানসে মুখ করে বললাম,
‘এক জন এই কফিটা খাই তাই আমি ভাবলাম কেমন হয় খেয়ে দেখি। ‘

চাচা মুচকি হেসে এক চুমুক নিতেই তার মুখ জুড়ে আধার ছেয়ে গেল, কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম কেমন হবে তাই নিজের আর চাচার প্রতি মহব্বত দেখিয়ে এক চামচ চিনিও দিয়ে এনেছিলাম। আচ্ছা এতো কড়া কফি উনি কি করে খান? চাচার পরপর আমিও এক সিপ নিতেই নিজের জ্বিভের প্রতি মায়া মহব্বত দেখিয়ে আর চাচার প্রতি আমার ভালোবাসা দেখিয়ে বললাম,
‘চাচা এটা আর খেয়ো না ‘

চাচা আমার সাথে মতমিল করে বললেন,
‘এমন কড়া কফি খাই কেমনে? যে খাই তার কি নিজের প্রতি মহব্বত টহব্বত একদম ই নাই নাকি? ‘

আমি বিড়বিড়িয়ে বললাম,
‘তার নিজের প্রতি দিব্যি মায়া মহব্বত আছে, নেই শুধু আমার প্রতিই। হাহ! ‘

চাচকে বললাম,
‘চাচা আজকে তোমার আর চাচীর গল্প শুনবো। আচ্ছা কি হয়েছিল চাচীর? ‘

চাচার গলা ফিকে হয়ে এলো, আর চক্ষু জোড়ার দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো। আমিও শান্ত দৃষ্টিতে চাচার দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগলাম চাচীর শেষ সময়ের গল্প, ওনার চোখে জল ভাসছে আমি তা বুঝতে পারছি, আমার গলা ধরে আসছে এক চাপা কষ্টে।
চাচা কতোই না ভালোবাসেন তার প্রিয় মানুষটাকে। আচ্ছা আমাকে কি কখনো কেও এভাবে ভালোবাসবে? কিংবা তার থেকেও বেশি!

/

চাচার গল্প শুনে মনটা ভালো লাগছে না একদমই। রহিমা খালার সাথেও গল্প করেছি বেশ কিছুখন। তাকে আমি কাজকর্ম থেকে ছুটি দিয়েছি, খালা এখন টিভি দেখছেন। কাল আমার উনিশতম জন্মদিন। অন্যবার যেমন অনেক অনেক আনন্দ আমার ভিতরে ফুটে ওঠে এবার তার ছিটেফোঁটাও পাচ্ছি না আমি। চাচার বলা ভালোবাসার কথাগুলো শুনে আমার বুক এর ভিতর হু হু করছে যেন। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না, সব কষ্টগুলো যেন গলায় এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।

আমার স্পষ্ট মনে আছে আগের বার জন্মদিনে আরিশ ভাইয়া যখন একটা নির্জন ঝিলের ধারে আমাকে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলেন আর উনি তখন বলেছিলেন,
‘মাত্র আঠারো। ভেবো না যে বড়ো হয়ে গেছো। ‘

আমি তখন নাকের ডগায় রাগ দেখিয়ে ওনাকে বলেছিলাম,
‘আমি বাচ্চা? মোটেও না। আঠারো বছর হয়ে গেছি আমি এখন মোটেও বাচ্চা না। আঠারো বছর বয়সে কতো মানুষের বিয়ে অবধি হয়ে যায়, বাচ্চাও হয়ে যায় আর আপনি আমাকে বাচ্চা বলছেন? ‘

ওনার দিক ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকটাই ঝুঁকে আমার মাথার সাথে ওনার মাথায় একটা ঠোকর খাইয়ে বলেছিলেন,
‘তুমি আমার কাছে এখনো বাচ্চাই। যেদিন তুমি আমার কাধ অবধি হবে সেদিন তুমি ভাবতে পারো যে তুমি বড়ো হয়েছো! না হলে বুঝবে তুমি আমার চোখে বাচ্চাই। ‘

আমি ওনার দিকে মুখ গোমরা করে অভিমানী সুরে বলেছিলাম,
‘ হ্যাঁ তা তো বলবেনই কারন আপনি তো জানেন যে এই পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির বেশি আমি আর লম্বা হবো না আর আপনার মতো পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা নারিকেল গাছের মতো খাম্বা হওয়ার আমারও ইচ্ছা নেই। ‘

আমার কথা শুনে উনি মুখ চেপে হেসেছিলেন। আমার মাথার সাথে হাত দিয়ে ওনার হাত অবধি ইশারা করছিলেন আর আমি ধানীলঙ্কা হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর উনি মিটিমিটি হাসছিলেন।

এক বছর আগের স্মৃতিগুলো আমার চোখে ভাসছে। এবার আমি একা। ঝগড়া করার জন্য হলেও আমার ওনাকেই দরকার। বুক এর ভিতর একরাশ শূন্যতা কাজ করছে আমার আর মস্তিষ্ক যেন নিষ্প্রাণ। আম্মু অনেকবার কল করেছে ল্যান্ডলাইনে, আমি একবার কথা বলার পর আর বলিনি, বারবার রহিমা খালার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়েছি।

অনেকখন হলো উপরে এসেছি। নীচ থেকে টিভির আওয়াজ আসছে না আর, এগারোটা বাজে প্রায়। জানালা দিয়ে দেখলাম আবহায়াটা চমকপ্রদ। ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না আর, ওড়নার আর নিলাম না, এতো রাতে তো আর আমাকে কেও দেখতে আসছে না। কথাটা ভেবে ছাদের দিকে এগোলাম আর গিয়ে বসলাম দোলনায়, দোলনার শিকলে মাথা রেখে নিস্তব্ধতার একান্ত সঙ্গ দিচ্ছি আমি। আজ বড্ড একা লাগছে নিজেকে, মনে হতে লাগলো খুব কঠিন সময় পার করছি। এতোটা একা আমার আগে কখনো লাগেনি। চোখটা বন্ধ করে পায়ের ধাক্কায় দোলনাটা মৃদু পায়ে দোলাতে লাগলাম, হঠাৎ দোলনার ওজনকে ভারী করে কেও একজন অতি সন্তর্পণে আমার পাশে এসে বসলেন। আমার শরীরটা ভয়ে ছমছম করে উঠলো। তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে পাশে তাকাতেই ওনাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। আরিশ ভাইয়া বসে আছেন আমার পাশে আমারই সাথে তবে আমার দিকে ওনার বিন্দুমাত্র নজর নেই, তিনি সামনে তাকিয়ে আছেন অচেনা একটা ভাব নিয়ে। আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে ওনার গায়ে একটা টোকা নিয়ে বললাম,
‘আপনি সত্যিকারের আরিশ ভাইয়া তো? ‘

উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাতেই আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। ঘোর ভাঙলো ওনার কন্ঠের চিরাচরিত ডাক শুনে,
‘এই মেয়ে! ‘

#চলবে,,,,

#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

5.

‘এই মেয়ে’ ধমকটা শুনতেই কেঁপে উঠলাম আমি, দ্রুত দাড়িয়ে পড়তেই উনি চোখ ছোট করে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমতা আমতা করা ছাড়া এখন কোন রাস্তাই খোলা নেই আমার কাছে। ওনার এমন চাহনি দেখে আমি চাপা স্বরে আধো আধো করে বললাম,
‘আপনি এখানে কি করছেন? ‘

ওনার কপালে ভাজ দেখা গেল, উনি আশেপাশে একবার তাকিয়ে বলে উঠলেন,
‘এটা তোমার বাড়ি? কোথাও নাম লেখা আছে? ‘

ওনার এমন ত্যাড়া কথা শুনতেই আমার মেজাজ স্বল্প বিগড়ে গেল।

‘আমার বাড়ি হলেই বা কি আর না হলেই বা কি। তাই বলে আপনি এতো রাতে এভাবে কাওকে না বলে এভাবে আচমকা উপস্থিত হবেন? ‘

উনি এমন একটা ভাব নিলেন যে তিনি এভাবে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েও কোন অন্যায় করেননি বরং তিনিই সঠিক আর সত্যবাদীর যুধিষ্ঠি।

‘ইচ্ছা হয়েছে তাই না বলে এসেছি, ইচ্ছা হলে বলেই আসতাম।’

‘আপনি কবেই বা আমার কোন কথা শুনেছেন? ‘

কথাটা এতোটাই বিড়বিড় করে বললাম যে ওনার কানে যাওয়ার নয়, অবশ্য উনি শুনতেও পেলেন না।
আমার হাতটা ধরে টেনে আগের মতোই ওনার পাশে বসালেন আর ওনার দিকে আমাকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বসালেন আর আমার বাম পা ওনার পায়ের ওপর তুলে নিলেন। আমি তো অবাকের ওপর অবাক হচ্ছি তবে ওনার কাজকর্মে বেশ ঘাবড়েও গেলাম আমি। কি করতে চাইছেন টা কি উনি?
আমি না বলে থাকতে পারলাম না।

‘এই কি করছেন টা কি আপনি? এখন কি নূপুর টুপুর পারবেন নাকি? আর আপনি এতোটা ফিল্মি হলেন কবে? শুনুন আমি কিন্তু পটছি না হুহ! ‘

আমার কথায় উনি নড়বড়ে হলেন না। উনার মুখ এর ভাবভঙ্গি ও নির্বিকার, কিছু বোঝার উপায় নেই যে কি করতে চাইছেন।

তবে তারপর উনি না করলেন তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ। উনি ওনার পকেট থেকে আমার ফোনটা বার করলেন আর খুবই স্বাভাবিক ভাবে আমার পায়ের সর্বকনিষ্ঠ আঙুল নিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিতে গেলেই পা সরিয়ে নিলাম আমি। বেশি ঝাপাঝাপি করে দোলনা থেকে নামতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়লাম মেঝেতে, হাতের কনুইয়ে ব্যাথা পেলাম জোর।
উনি রেগে গিয়ে আমাকে নীচ থেকে তুললেন। আমার দিকে নিশ্চয়ই উনি এখন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কিন্তু আমি ওনার দিকে তাকাবোনা। তাকালেই যে খেলা উনি শুরু করেছেন তা শুরু হওয়ার আগেই শেষ!

উনি হাত ধরে টেনে আমাকে পুনরায় দোলনা তে বসালেন আর নিজে হাটু ভাজ করে আমার পায়ের কাছে বসে ফোনটা নিয়ে পা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিলেন আর ফোনটা খোলা মাত্রই কিছু একটা করে তা নিজের পকেটে পুরে নিয়ে আমার দুপাশে হাত রেখে আটক করলেন আমাকে।
গম্ভীর আর কঠিন স্বরে বললেন,
‘মানে তুমি কি সত্যিই স্টুপিড? পায়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট কে দেই? কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব? এতো আনন্যাচেরাল বুদ্ধি তোমার কোথা থেকে আসে?’

আমি রাগ দেখালাম তবে ততোটাও প্রখর ভাবে নয়।
‘আমার ফোন, ইচ্ছা হয়েছে আমি দিয়েছি। ‘

কথাটা বলে আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি বলতে উনি ফোন নেবেন শুনে আমি বহু কষ্টে পায়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট টা দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি তা ধরে ফেললেন কিভাবে? তবে ওনার কাছে আমি এসব আনন্যাচেরাল কাজ করলেও আমার বুদ্ধি আমার কাছে টুইটুই মার্কা চুমু টাইপের।

উনি উঠে দাঁড়ালেন এবার।
‘বাচ্চা মানুষ আর বাচ্চাদের মতোই বুদ্ধি। আমি ঠিকই বলেছিলাম যে তুমি কখনো বড়ো হবেনা। ‘

ওনার এই বাচ্চা ডাকটা আমার গায়ে লঙ্কা গুড়ো ছেটানোর মতো এফেক্ট দেই। আমি বিঞ্জানী হলে এই জ্বালার এক বিশেষ নাম দিয়ে দিতাম হয়তো।

দোলনা থেকে নেমে ওনার পাশে যতোটা সম্ভব পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ওনার সমান সমান হওয়ার চেষ্টা করলাম তবুও ওনার কাধ অবধি হতে পারলাম টেনে টুনে।তারপর বেশ সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
‘এই দেখুন আমি আপনার সমানে সমানে লম্বা তাই আমি আর মোটেও ছোট নেই। আমার কথা শুনে উনি আমার পাশ থেকে সরে এলেন, আমি এখনো ওমন পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি বহু কষ্টে, একটা সাপোর্ট সিস্টেম থাকলে তাতে আরামে হেলান দিয়ে এভাবে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যেত। উনি এবার আমার দিকে স্বল্প ঝুঁকে গেলেন, ওনার উষ্ণ নিশ্বাস আমি অনুভব করতে পারছি, বুকের ভিতর ও ধুকধুক করতে শুরু করে দিয়েছে, হৃদগতি দ্রুত হারে চলছে। উনি এবার আচমকাই আমার মুখ এর ওপর ফু দিতেই আমি আর নিজেকে আর আমার তাল কোনটাই সামলাতে পারলাম না, পা ছেড়ে এবার সোজা হয়ে গেলাম আর পুনরায় ওনার থেকে ছোট হয়ে ওনার কাছে বাচ্চাই হয়ে গেলাম। উনি মুখ টিপে হাসছেন আমার তা দেখে রাগ হলো। উনি এবার বললেন,
‘এবার দেখো, তোমার হাইট বোধহয় বেড়ে গেছে। ‘

আমি বুঝলাম যে উনি এটা মজা করে বললেন। আমি বিরক্ত হয়ে সরে গেলাম ওনার সামনে থেকে। ছাদের কার্নিশ বরাবর দাঁড়িয়ে রইলাম। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, আমি চুলটা খোপা করে নিলাম আর খুব ভালোভাবে অনুভব করলাম যে আমার শরীরে ওড়না নেই। আমি কি এতখন ধরে এভাবেই ওনার সাথে ঝগড়া করছিলাম? ভাবতেই নিজেকে সত্যিকারের স্টুপিড মনে হচ্ছে। পিছন থেকে ডাক দিলেন উনি বেশ জোরে
‘ এই মেয়ে ওখানে কি করছো তুমি? ‘

আমি মুখ ভাঙালাম আর জোরেই বললাম,
‘আমার একটা সুন্দর নাম আছে, এই মেয়ে বলে একদম ডাকবেন না। ‘

উনিও বোধহয় এতোদূর থেকে ঝগড়া করে শান্তি পাচ্ছেন না তাই আমার কাছে এসে বললেন,
‘চলো নীচে যাও। রেডি হও।’

আমি কড়া কন্ঠে প্রশ্ন করলাম
‘কেন? কমিউনিটি সেন্টারে আপনার বিয়ে লেগেছে? ‘

এতখন ধরে যেটা মিস করছিলাম সেটা ফুলফিল হয়েছে, ওনার সাথে ঝগড়া করতে পেরেছি। কথায় কথায় এটাই ভুলে গেলাম যে আমার জন্মদিন।

‘আমি কোথাও যাবো না। আপনি যান। আমার মনে আপনার মতো অতো রঙ লাগেনি। ফারিন আপুকে নিয়ে যান। ‘

কথাটা বলতেই উনি গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। আমি অবাক আর হতবিহ্বল হয়ে ওনার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলাম।
বেশ জোরেই বললাম,
‘ভাইরে ভাই আপনার মতো বেয়াদপ লোক দেখিনি। প্রেমিকার নাম নিতে না নিতেই হাওয়া! আপনার প্রেমে ধ্বস লাগুক, ভূমিকম্প হোক। আপনার আর ওই রাক্ষসীর প্রেমে পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক দূ্র্যোগ নামুক। ‘

রাগে গা তিরতির করছে আমার। যেতে বললাম বলেই কি যেতে হবে?

বেশ কিছুখন কোন সাড়া শব্দ পেলাম না আমি। তবে কিছুখন পর পায়ের আওয়াজ পেতেই চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল যে এক পা ও নড়বো না।
উনি হঠাৎ করে একটা বড়ো প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিতেই আমি কর্কশ ভাবে বললাম,
‘ কি এসব? ‘

উনি এবার যেন রেগে গেলেন, তাহলে আমার বলা কথাগুলো কি উনি শুনে ফেলেছেন? আমি দমে গেলাম।

‘একটাও ফালতু কথা না। তাড়াতাড়ি পরো এগুলো। ‘

কথাটা শুনতেই প্যাকেটটা খুলতেই দেখলাম একটা নীল রঙের পশম ওয়ালা স্কাফ। একটা ব্লু জ্যাকেট। একটা ব্লু পশম ওয়ালা টুপি যার দু পাশ দিয়ে দুটো কিউট টেডিবেয়ার।
আমি দেখে খুশি হয়ে গেলাম।
‘আপনি কি কিউট আরিশ ভাইয়া। আপনার মতো ভাই ঘরে ঘরে হোক। ‘

উনি রাগী রাগী মুখ করে বললেন,
‘জলদি এগুলো পরো। বার হবো আমরা। ‘

আমি আহাম্মক বনে গেলাম, যদি খুব ভুল ধারণা না হয় এটা জুন মাস, ঠা ঠা করা গরম।

‘এগুলো এখন পরবো কেন? এখন কি শীতকাল নাকি? ‘

আবার উত্তরে উনি এমন ভাবে তাকালেন যাতে আমি বলতে বাধ্য হলাম,
‘পরছি পরছি এভাবে তাকানোর কি আছে? ‘

জ্যাকেটটা পড়তেই উনি হাত থেকে স্কাফ আর টুপি নিয়ে নিলেন,
‘ নিজেই স্কাফটা গলায় জড়িয়ে দিলেন আর টুপি টা পরিয়ে দিলেন। ‘

গরমে আমার প্রান ওষ্ঠাগত। আমার নাক ঘামছে সাথে সারা শরীরও। উনি একঝলক আমার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে রোমাল বার করে আমার নাকের ঘামটা মুছিয়ে দিতেই আমি মিনতির সুরে বললাম,
‘এবার এগুলো খুলে রাখি? গরম লাগছে ভীষন। ‘

‘এটা তোমার শাস্তি? ‘

অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম
‘কিসের শাস্তি? ‘

‘শুনলাম একটু আগে আমার সব গার্লফ্রেন্ড গুলো ভূমিকম্প, আর ধব্সে চাপা পড়েছে। তুমি একটু আগেই না অভিশাপ দিলে! ‘

আমি চোখ কান বুজে নিলাম। উনি আড়ালে কথা শুনেছেন?

আমি মিনমিন করে বললাম,
‘তাদের মাগফেরাত এর কামনা করি। তারা জান্নাত বাসী হোক। কিন্তু এগুলো এবার খুলি? ‘

উনি হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে বললেন,
‘ভেবে দেখছি। ‘

ওনার সাথে আমিও নামছি রকেট এর গতিতে। আশরাফ চাচা ঘুমিয়ে গেছেন। উনি দেখি বাইকের সামনে টেনে নিয়ে গেলেন।
‘হ্যাপি বার্থডে মিস টুইটুই। ‘

আমি চমকে গেলাম। এতখন মনেই ছিল না আমার। থ্যাঙ্কিউ অবধি বলতে ভুলে গেলাম।
উনি নিজেই আমার মাথা থেকে টুপি আর স্কাফটা খুলে দিলেন। আমি দম ছাড়লাম।
উনি অনেকখন আমার দিক চেয়ে রইলেন। তারপর নিজেই বললেন,
‘এগুলো চাচার ওই টেবিলের ওপর রেখে এসো। ফেরার সময় নিয়ে নিও। ‘

উনি বাইক স্টার্ট দিলেন। আমি ওনার কাজকর্মে ওবাক হই। উনি এবারো আমাকে সারপ্রাইজ দিলেন নিজে এই মুহূর্তে আমার সামনে উপস্থিত হয়ে। এর থেকে বড়ো সারপ্রাইজ আর হয়তো হতো না। আমি ওনার দিক শান্ত ভাবে চেয়ে বললাম,
‘আপনি আজকেই কেন ফিরে এলেন?আপনার না আরও দুইদিন পর ফেরার কথা ছিল? ‘

উনি উত্তর দিলেন না। এমন একটা ভাব নিলেন যেন কিছুই শোনেননি। কেবল ইশারা করে পিছনে বসতে বললেন। আমি উঠে বসে ওনাকে না ধরেই বসলাম।
উনি রাগী গলায় বললেন,
‘সাইক্লোনের গতিবেগ জানো কতো? ‘

ওনার কথার ইশারা বুঝতে পেরে ওনাকে জাপটে ধরলাম আমি। এটাতে উনি হয়তো বোঝালেন,
‘নো মোর আরগিও।’

উনি বাইক চালাচ্ছেন বেশ স্বাভাবিক গতিতে। আমার সমস্ত মন খারাপ মিলিয়ে গেছে যেন ওনার উপস্থিতিতে একনিমেশেই। তবে মাথায় খালি একটাই প্রশ্ন ঘোরে আমার,
‘আচ্ছা ওনার চোখে আমি কি কখনো বড়ো হবো না? ‘

#চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here