ভালোবাসি বলে দাও পর্ব -০২+৩

#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

2.

বিরাট এক ব্রেক সহকারে আরিশ ভাইয়া গাড়ি থামালেন। আমি শান্ত হয়ে রইলাম এবার শুধু আমাকে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়ার অপেক্ষা। তাদের এমন পিরিতী আলাপ কে শুনতে চাই? এদের সাথে আমার যাওয়ার ইচ্ছাটা তামা তামা হয়ে গেছে। ভাবলাম উনি সত্যিই বোধ হয় আমাকে মাঝ রাস্তায় নামিয়ে বলবেন,
‘আরুপাখি বাসায় যাও, একা, হেটে হেটে, গভীর অন্ধকারে।উহু জীবনে এডভেঞ্চার।’

অপেক্ষারত চাহনিতে আমি আরিশ ভাইয়ার পতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
‘আমার বিয়ে’ গানটা আরিশ ভাইয়ার বুকটা কে একটু হলেও পোড়ালো কি তা আমায় জানতে হবে। আর পুঁড়লেও সেই পোঁড়া স্মেল আমার চাই। ডেভিল মানুষের দিল জ্বলছে।আহা!

ওনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বুঝলাম যে উনি কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার এ চাহনি মরিচীকার ন্যায় যা বোঝার ক্ষমতা আমার কখনোই হয়নি। ওনার ভ্রম ভঙ্গ করে ফারিন আপু কঠিন স্বরে বললেন,
‘ এই মেয়ে তুমি কি পাগল হলে? এভাবে কেও চেঁচিয়ে ওঠে মাঝ রাস্তায়? আর আমার বিয়ে মানেটা কি? ‘

ওনার সাথে ঝগড়া না করলেই নয়,ওনার সাথে ঝগড়া না করলে ফুপির বানানো কাচ্চি আজ আমার নিশ্চয়ই হজম হবে না। আমিও বিরষ ভঙ্গিমায় বললাম,
‘তোমরা দুজন নিজেদের মতো গল্প করছিলে তাই আমি ভাবলাম আমার বিয়ে গানটা করি। ‘

তৎক্ষণাৎ ফারিন আপুর হাতটা পৌছে গেল আরিশ ভাইয়ার কাধে, আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। আপু কিঞ্চিৎ ন্যাকামির ভঙ্গিমাতে বলে উঠলেন,
‘দিস ইজ টু মাচ আরিশ। তুই এবার কিছু বল। ‘

আমার মস্তিষ্কের কিছু কিছু নিউরোন বিষয়টাকে যেন এখনো মেনে নিতে পারছে না আর সেখানে আরিশ ভাইয়া কি আদেও ওনার কথাটা শুনেছেন? কিন্তু উনি ইশারা করে আমাকে গাড়ি থেকে দ্রুত নামতে বললেন। ইশারা পেতেই আমি বিন্দু মাত্র দেরি না করে নেমে পড়লাম। আমার পিছুপিছু উনিও নামলেন। আমি বাসার দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই উনি খপ করে পিছন থেকে আমার বাহু ধরলেন আটকালেন, আমি চমকালাম না, নির্বিকারে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম।
‘ কি হলো হাত ধরলেন কেন? ছাড়ুন আমায়। ‘

উনি এবার যেন আধা রাগ মিশ্রিত ধারায় আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন। হাতটা বেশ শক্ত করে চেপে ধরে খানিকটা ওনার দিকে আমাকে টেনে নিতেই ব্যাথা পেলাম আর বেশ চিৎকার দিয়ে উঠলাম,
‘কি হচ্ছে কি হাত ছাড়ুন। বাসায় যাবো আমি। ‘

আমার চিৎকার শুনে ফারিন আপু উনি জানালা দিয়ে উকি মেরে বললেন,
‘লেট হার গো।’ ডিসগাস্টিং মেয়ে। ‘ শেষের শব্দটআ একটু মিউট করে বললেন যাতে কারোর কানে না পৌছায় কারন উনি আরিশ ভাইয়ার কাছে তথাকথিত ভদ্র এবং আমি চূড়ান্ত অভদ্র।

ফারিন আপুর কথা শুনতেই উনি কেন জানি না আমার হাত ছেড়ে দিলেন। মনে মনে হাজারো ঝাড়ি দিয়ে বলতে লাগলাম,
‘নিজের কথায় তো আমাকে নাচিয়ে এখন দেখছি নিজেও অন্যের কথায় নাচেন। ‘

চুপ করে হাতটা কচলাচ্ছি আমি, উনার শক্ত করে ধরা জায়গাটা বেশ লাল হয়ে গেছে। উনি পুনরায় বলে উঠলেন,
‘পিছনে উঠে বসো। নাহলে কালকে থেকে ছয় ঘন্টা করে পড়াবো। ‘

তাহার এমন কথা শুনে আমার সারা শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ গতিতে ভয় ছেয়ে গেল। আমি জানতাম যে উনি ছাড়া আমার গতি নেই তবে তিন ঘন্টাটা ছয় ঘন্টা হোক তা কখনো চাইনি আমি। দ্রুত গতিতে সামনের সিটে যেতে নিলেই উনি একটা ধমক দিয়ে উঠলেন,
‘পিছনে বসো। ওদিকে কোথায় যাচ্ছো। ‘

ওনার ধমকে আমি সহ ফারিন আপুও চমকে গেছেন। আমি দ্রুত গাড়িতে উঠলাম। ফারিন আপু বোধহয় ভয়ে আর ওনার পাশে বসার কথা ভুলে গেছেন,যদি ওনাকেও অপমান করেন সেই ভয়ে। আসলে ওনাদের বয়সী মেয়েরা একটু বিচক্ষন আর বুদ্ধিমতী হয়, আমার মতো এমন উড়নচন্ডী নয় তাই হয়তো অপমানিত হওয়ার ভয়ে নিজের সিটেই বসে রইলেন। আরিশ ভাইয়া চোয়াল শক্ত করে গাড়িতে উঠলেন।

এই মানুষটাকে আমি কখনোই বুঝে উঠতে পারিনি। আমার বাবা আর আম্মু নিজেও বোধহয় আমাকে এতো ধমক দিয়ে কথা বলেলনি যতোটা সারাজীবনে উনি আমাকে ধমক দিয়েছেন। আমার তো মনে হয় মাঝে মাঝে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদি আর ওনার নামে একরাশ নালিশ করি আর আমার এমন কাওকে দরকার যে আমার এই নালিশ গুলো একনাগাড়ে সহমত দিয়ে শুনবে কিন্তু আমার সেরকম কোন মানুষ নেই যিনি ওনার নামে নিলিশ শুনবেন। আমার ভাষায় যেটা নট সো টুইটুই!

/

সামনেই টেস্ট এক্সাম তার পর আছে আরিশ ভাইয়ার কাছে বিশেষ প্রি টেস্ট যাতে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কঠিন প্রশ্ন গুলো দেওয়া হয়। তারপর এইচএসসি এক্সাম। আজকে ভাইয়া আসবেন।নিজের কলেজ শেষ করে উনি কলেজ থেকে সোজা আমাকে পড়াতে আসেন। আমার নিষ্পাপ মনে মাঝে মাঝে একটাই প্রশ্ন জাগে,
‘ব্যাটা না পড়ে টপার কিভাবে হয়? ‘

মুখের ভিতর পেন দিয়ে চেবাচ্ছি, এর জন্য প্রায়ই হাতেনাতে ধরা পড়ে ধমক খেতে হয় আমাকে আর এই অবস্থায় উনি দেখলে আর রক্ষে নেই। উনি এসে রোজ আমার হাতের কফি খান তবে আজকে আমার কফি বানানোর মন মানসিকতা একদম নেই তাই আম্মুকে দিয়ে বানিয়ে নিয়েছি তবুও কিভাবে না কিভাবে উনি ঠিক বুঝতে পারেন। মাঝে মাঝে আম্মুর ওপর আমার তীব্র সন্দেহ জাগে যে কোনভাবেই সে তাকে জানিয়ে দেই না তো যে সে কফিটা বানিয়েছে, আমি কফি বানানো তে ফাঁকি দিয়েছি। কিন্তু নিজের মেয়ের সাথে আম্মু এমন দুশমনি করবে? ভাবনাগুলোর অন্ত নেই তার আগেই একটা বড়ো ব্যাগ উনি আমার সামনে এসে রাখলেন। নিসন্দেহে সেটা তার নিজের ব্যাগ নতুবা আমার জন্য তো তিনি আর এতো এতো গিফট আনবেন না কখনোই। তার মেডিকেল এর বইগুলো আমি দেখি আর অবাক হয়, তা দেখে মনে হয় পড়াশোনা করার থেকে বিয়ে করাটা অনেক সহজ। যদিও ডক্টর হওয়ার ইচ্ছাটা আমার ছোট থেকে হলেও আমার থেকে ওনার আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্ৰহ বেশি। মনে পড়ে সেদিনটার কথা যেদিন উনি ওনার এই বিরাট ব্যাগটা আমার সামনে প্রথম এনে রেখেছিলেন আর কৌতুহল বশত আমি প্রশ্ন করে উঠলাম।
‘আরিশ ভাইয়া এতে কি? ‘

উনি তখন অত্যন্ত গম্ভীর কন্ঠে বলেছিলেন’বই। ‘

আমার দেখার ইচ্ছা জাগতেই বেশ জোরাজুরি করে একটা বই বার করেছিলাম। বইয়ের ওজন আমি নিজেই সামলাতে না পেরে আমার হাত থেকে বইটা পড়ে গিয়েছিল। ভীষনরকম একটা ধমকে সেদিন কানের পর্দাটা ফাঁটত ফাঁটতে বেঁচে যাই। তারপর থেকে বইগুলোর ওপর একটা ফোবিয়া এসে গেছে।

বই খাতা দেখলেই আমার যে ঘটনা গুলো মনে করা উচিত না সেগুলো ও মনে পড়ে যায়। আমার চোখএর সামনে একটা তুড়ি বাজিয়ে উনি ইশারায় বোঝালেন,
‘শুরু করা যাক? ‘

আমার ঘোর ভাঙলো। ওনার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বললাম,
‘ ভাইয়া একটা কথা বলি?’

আমার কথার উনি কোন উত্তর দিলেন না বরং নিজের কথাতে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন।
‘চারদিন তোমাকে পড়াতে আসতে পারবো না। তাই আজকে অনেক সময় নিয়ে পড়াবো। একটা স্ট্রং কফি লাগবে আমার চিনি ছাড়া।’

ওনি পড়াবেন না শুনলে অন্যদিন তো খুশিতে মন ভরে যায় কিন্তু আজকে কৌতূহল জাগছে কারনটা ফারিন।

বেশি আগা মাথা না ভেবে প্রশ্ন করলাম,
‘কেন প্রেমিকার সাথে ঘুরতে যাচ্ছেন? ‘

উনি চোখের দৃষ্টিতেই খু/ন করে ফেলবেন এমন এক দৃষ্টিতে তাকালেন, আমি দমে গেলাম এক নিমেষেই। মাথা নীচু করে অ আ পড়ার মতো অনর্গল পড়তে শুরু করতেই উনি আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
‘মেডিকেল পারপাসে সিলেট যাচ্ছি। আর কোন প্রশ্ন? ‘

আমি বাচ্চাদের মতো দু দিকে মাথা দুলিয়ে না সম্মতি জানাতেই উনি হঠাৎ অদ্ভুত এক প্রশ্ন করলেন,
‘আরুপাখি! ‘

আমি ভ্রু কুঁচকে জবাব দিলাম,
‘জ্বি? ‘

‘তোমার Wildest Fantasy কি আরুপাখি? ‘

আমি অবাক আর হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলাম ওনার দিকে। এমন প্রশ্ন আগে আমাকে কেও করেনি। তবে আমার ফ্যান্টাসি যেটা সেটা ওনাকে ঘিরেই সেটা কি আমার ওনাকে বলা উচিত?

মনের মাঝেকার একরাশ সংশয় জমিয়ে রেখে ওনার দিকে বাকা চোখে তাকিয়ে বললাম,
‘বলা টা কি ইম্পরট্যান্ট? ‘

উনি ধমক দেওয়ার পরিকল্পনা করেও যেন আর ধমকালেন না আমাকে, বেশ নরম কন্ঠেই বলল,
‘স্টুপিড। জিজ্ঞাসা করেছি আমি, নো এক্সকিউজ! ‘

ওনার এমন শান্ত কন্ঠস্বর শুনে আমি মাঝে মাঝে ওনার ওপর ফিদা হয়ে যায়।
‘আমার ফ্যান্টাসি আপনাকে নিয়ে। ‘

উনি কথাটা শুনে খুশি হলেন নাকি রেগে গেলেন বুঝলাম না। তবে ওনার চোখ জুড়ে একরাশ কৌতূহল দেখলাম আমি।

‘রিয়েলি? তাহলে তো শুনতেই হয় যে আমাকে নিয়েও কারোর কোন ফ্যান্টাসি থাকতে পারে।

আমি একটু পিছিয়ে বসলাম, জানি না উনি তা শোনার জন্য আদতে প্রস্তুত কি না। আমি আমতা আমতা না করে সরাসরি বললাম,
‘আপনাকে এই ডেভিলগিরি নিয়ে আমার এক আকাশ অভিযোগ। আই উইশ আপনাকে নিয়ে কারোর কাছে আমি অভিযোগ করবো আর সে আমার অভিযোগ গুলো মন দিয়ে শুনবে তবে আপনার অভিযোগ আপনাকেই করলে ভালো লাগতো আমার। অভদ্র! ‘

আমার কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই আমার হাতে বেশ জোরে একটা টান দিয়ে ওনার কাছে টেনে নিয়ে এলেন আমাকে, আমার হৃদগতি থেমে আসার উপক্রম। ওনার খুব কাছে ঝুকে আছি আমি, ওনার দৃষ্টি বলছে যেন,
‘আরুপাখি বলো আমি শুনবো। ‘

কিন্তু তেমনটা হলো না, উনি ওনার কাছে টেনে এনে এক ধমক দিলেন আর আমি চুপ, শুনতে হলো ওনার সেই বিশ্ব বিখ্যাত ডায়ালগ যেটা আমি ওনার প্রত্যেকটা ধমকের সাথে ফ্রি তে পাই।
‘নো মোর ওয়ার্ডস! ‘
#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

3.

দুই দিন অনায়াসেই পার হয়ে গেল আরিশ ভাইয়ার অনুপস্থিতে। আরিশ ভাইয়া সিলিটে গেছেন তাই এই দুদিন আমার কানদুটো প্রত্যাশিত ধমকগুলোর থেকে মুক্তি পেয়েছে। দিনগুলো যে খুব খারাপ যাচ্ছে তেমনটা মোটেও না, বড্ড শান্তিতেই কাটছে দিনগুলো, কেও সকাল সকাল ধমক দিয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছেনা, কেও তার নিজের পড়ার ফাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করছে না যে কোন্ দুষ্টুমি করছি কি না। শুধু মিস করছি আমার প্রান প্রিয় ফোন আর আমার প্রিয় সখী সানা কে। সে সেই কবে তার নানুর বাসায় গেছে ফেরার নাম গন্ধ নেই, সামনে যে এইচ এ সি এক্সাম তার সেদিকে কোন খেয়াল আছে কি আমার জানা নেই, তবে আমিই বা কন সা সিরিয়াস পড়াশোনা নিয়ে। হাহ!

আধাশোয়া হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে আছি, অবশ্যই বাসায় আমার চালচলন নবাবী ধাচের হয় তাতে সন্দেহ নেই।
সেদিন কলেজে ওনার হাতের হিটলারী থাপ্পড় খাওয়াতেই সবটা থেমে থাকেনি, আমার ফোনটা কেড়ে নিয়েছেন আর সাথে আমার গল্পের বই গুলোও। আর একটা বিরাট হুমকি দিয়েছেন যে,
‘রেজাল্ট খারাপ হলে রিকশা ওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো, আর তা থেকে আমাকে কেও আটকাতে পারবে না। তোমার বাপ ও না। ‘

কথার কি ছিরি! সেদিনের পর ওনার চড়ের একটা নাম ও দিয়ে ফেলেছি আমি, ‘হিটলারী থাপ্পড়।’

আমার সব ভাবনাগুলো রসাতল করে আম্মু ফোন হাতে নিয়ে হাঁক দেওয়ার ভঙ্গিতে ঘরে এমন ভাবে ঢুকলো যাতে যেন ভিনদেশ থেকে কোন রাজপুত্র আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আম্মুর এমন উৎকন্ঠা দেখে বুঝলাম উনি ফোন করেছেন। কথা বলার ইচ্ছাশক্তি বিন্দু মাত্র না থাকলেও বলাটা বাধ্যতামূলক নাতুবা এক্ষুনি উনি সিলেট থেকে মিসাইল ছুঁড়ে আমার পুরো বাসা টাকেই উড়িয়ে দেবেন।
আমার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে আম্মু বেরিয়ে গেল এমন একটা ভাব নিয়ে যেন তার সাথে আমি প্রেমালাপ করতে চলেছি। আচ্ছা এরা আরিশ ভাইয়া আর আমাকে নিয়ে এতো বাড়তি ভাবনা চিন্তা করেন কেন? এরা কি যানে না যে উনি ফারিন আপুকে পছন্দ করেন। ফোনের দিকে একটু বিকট ভঙ্গিতে তাকিয়ে ফোনটা কানে নিলাম। চুপ করে থাকবো আমি যতখন না উনি ভালো ভাবে কথা বলেন।
ওপাশ থেকে ওনার শ্বাস প্রশ্বাস আমার কানে আসছে, যখনই ওনার সাথে ফোনে কথা বলি ততবারই এই জিনিসটা লক্ষ করেছি আমি। আমার নিস্তব্ধতা ভাঙতে উনি বলে উঠলেন ওপাশ থেকে,
‘আরুপাখি!’

এটার উত্তর দেওয়ার প্রায়োজন বোধ করলাম না কারন আমি জানি ওনার কাছে আমি আরুপাখি।
উনি জানেন আমি উত্তর দেবো না তাই পুনরায় বললেন,
‘পড়া কতোদূর কমপ্লিট হয়েছে? ম্যাথসে প্রবলেম হয়েছে কোন? আর কনভারশন গুলো? ‘

ওনার করা এতো গুলো প্রশ্নের বিপরীতেও আমি নিরব হয়ে রইলাম। এই মুহূর্তে আমি কি করতে চাইছি আমি নিজেও জানিনা। আচ্ছা আমি কি আমার নিজের দোষভরা কাজকর্ম গুলোর জন্যই ওনার বকা খাই? আমার কি কোন সন্দেহ আছে তা নিয়ে?

ভাবনার অন্ত হলো না, উনি আগের থেকে একটু শক্ত ভাবে বললেন,
‘কালকে আমি ব্যাক করছি। পড়া রেডি রাখো। ‘

ওনার একথা আমার হজম হলো না সহজে। বিদ্যুৎ গতিতে জেগে উঠলাম, এবার কথা না বললেই নয়।
‘এই না না, আমি সব পড়েছি। এই তো এখনো পড়ছি। আপনার একদিন আগে আসার দরকার নেই। ‘

আমি এই মুহূর্তে ওনার রাগী মুখটা হয়তো কল্পনা করতে পারছি, তবে উনি আমার কর্মকান্ডে হাসলেও আমি জানতে পারবো না কারন উনি আমার কোন কাজে অন্তত হাসেন না। উনি কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘কই তোমাকে তো আমি পড়তে দেখছি না। ‘

আমি ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠলাম। উনি কিভাবে জানলেন যে আমি পড়ছি না? আমি চোখ বাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘চার চোখ নাকি আপনার যে সব দেখতে পান। ৩০০.৪ কিলোমিটার দূরে বসে আপনি কি করে জানলেন?’

অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ উনি আমার কথাতে আলতো শব্দ করে হাসলেন, ওনার হাসিতে যে আমি কতোটা বিভ্রান্ত হলাম তা আমি কখনোই বলে বোঝাতে পারবো না।
‘আমি মুখ গোমরা করে বললাম,
‘কি হলো হাসছেন যে? ‘

উনি শান্ত ভাবে বললেন,
‘কিছু না। ঠিক করে পড়াশোনা করো, বাসায় গিয়ে দেখি যেন সব পারছো। নাহলে খবর আছে।সামনে এক্সাম কথাটা যেন মাথায় থাকে। ‘

আমার রাগ আর বিরক্ত দুটোই লাগছে ওনার কথাতে। যখনই উনি বাইরে যান এই কথা গুলোই বলেন। আমি আর কিছু বললাম না, চুপ করে রইলাম। দুজনেই নিরব। উনি নিরবতা ভঙ্গ করলেন,
‘কিছু লাগবে তোমার? মানে এখান থেকে কিছু নিয়ে যাবো তোমার জন্য।’

ওনার কথা শুনে আমি চমকিত, অবাকিত, টাস্কিত হলাম। অতি খুশিতে মুখ ফসকে বলেই ফেললাম,
‘আপনি এতো ভালো কবে হলেন আরিশ ভাইয়া?’

উনি আলতো ধমকের সাথে বললেন,
‘স্টুপিড। খালি আজাইরা কথা। কি লাগবে সেটা আগে বলো। ‘

‘কিছু লাগবে না হুহ! তবে আমার একটা ব্লু কালারের পশম ওয়ালা স্কাফ লাগতো। কিন্তু তবুও লাগবে না হাহ! ফারিন আপুকে জিজ্ঞাসা করেন ওনার যদি কিছু লাগে।’

কথাটা বলার পর ফোনের ওপাশ থেকে আর উত্তর এলো না, উনি মুখের ওপর ফোনটা কেটে দিলেন সেটা নিশ্চিত হলাম। ওনার এমন পতিক্রিয়ার কারন বুঝলাম না তবে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে একটা মনে মনে অনেক কটা ঝাড়ি দিয়ে পড়তে বসলাম।

/

রাত নটার দিকে পড়া শেষ করে রুমের মধ্যে বসে আছি আমি, অনেক ক্ষিধে পেয়েছে তবুও আলসেমিতে নিচে যাচ্ছি না। হঠাৎ আচমকা রুমের দরজা খুলে সানা ঢুকে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়লো যেন। নিশ্বাস আটকে আসার উপক্রম। মেয়েটার পিঠে সপাটে একটা চড় দিয়ে বললাম,
‘এই মেয়ে ছাড়। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ‘

সানা দ্রুত আমাকে ছেড়ে আমার গালদুটো টেনে দিয়ে বলল,
‘তুই জানিস না আমি তোকে কতোটা মিস করেছি।’

আরিশ ভাইয়া যেভাবে ধমক দেন ওনাকে দেখে দেখে আমিও তেমন ধমক শিখে ফেলেছি একদম নিখুঁত ভাবে আর তার প্রয়োগ করলাম সানার ওপর,
‘এই মেয়ে! একদম মিথ্যা না। তুই মোটেও আমাকে মিস করিসনি।’
ওনার ধমক শুরু হয় এই ‘মেয়ে শব্দটা ‘দিয়ে আর তা শুনে মনে হয় এই বুঝি কান ফেটে গেল।।

সানা আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘সত্যি বলছি তোকে অনেক মিস করেছি আমি। ‘

আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। বিশ্বাস করলাম। ‘

সানা আমার ওপর কপোট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘তুই আমাকে এই দুদিনে একদম কল দিস নি কেন? ‘

আরিশ ভাইয়া যে ফোনটা আমার থেকে কেড়ে নিয়েছেন সেটা সানা জানে না, কথাটা মনে আসতেই রাগ উঠলো ভীষন।
‘তোর ভাইয়া আমার ফোনটা কেড়ে নিয়েছে। আমার ফোন এখন ওনার কাছে। তবে আমিও এমন এক লক দিয়েছি যে সারা জীবনেও খুলতে পারবে না। ‘

সানা মুখ চেপে হাসলো। তা দেখে আমি বিরক্তি ভঙ্গিমাতে প্রশ্ন করলাম
‘কি হয়েছে হাসছিস যে? ‘

সানা হাসি থামিয়ে বলল,
‘তুই তো জানিস বাসায় ফারিন আপু এসেছে, আম্মু আপু আসায় অনেক খুশি হয়েছে। আর একটা কথাও শুনলাম।’

‘কি কথা? ‘

‘খালা মনি তো ভাইয়ার সাথে ফারিন আপুর বিয়েও দিতে চাই, খালামনি বলল। কিন্তু আম্মু এখনো খালামনিকে তেমন কিছু ভাবে আশ্বাস দেইনি। যে মেয়ে এখনই এমন ভাব দেখায় না জানি সে মেয়ে আমার ভাবী হলে কেমন ভাব দেখাবে। আপু তো ভাইয়া বলতে পাগল। ‘

বিস্ময় এ আমার কপাল কুঁচকে এলো। আমাকে হতবিহ্বল দেখে সানা আচমকা আমার দু বাহু ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,
‘আরু তুই আমার ভাবী হয়ে যা না। ভাইয়াকে তোর সাথেই মানায়, আম্মুও বলে একথা।’

আমি সানার হাতটা ছাড়িয়ে রাগী গলায় বললাম,
‘বয়েই গেছে আমার ওনার সাথে বিয়ে করতে। আমি তো বিয়ে করবো তার সাথে যে আমাকে একদম ধমক দিয়ে কথা বলবে না আর কোথাও গেলে এটা জিজ্ঞাসা করবে না যে আরুপাখি কিছু আনবো? সে তো একেবারে সরাসরি এনে সারপ্রাইজ দেবে। এমন কাওকে বিয়ে করবো আমি। হু!’

সানা বিষ্ময় প্রকাশ করে বলল,
‘দেখবি ভাইয়া র শেষমেষ তোর সাথেই ভাইয়ার বিয়ে না হয়ে যায়। ‘

‘নো নেভার এভার।’

কথাটা বলেই নীচে নামলাম আমি, দেখলাম ফুপি বসে আছেন আর আম্মুর সাথে কথা বলছেন। বাবা মা এর পর ফুপি আমার সবচেয়ে প্রিয়। দৌড়ে ফুপি কে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ কেও জড়িয়ে ধরায় ফুপি চমকে গেল।
‘ কি ব্যাপার আমার আরু মা এতো খুশি যে। ‘

ফুপির কথাতে আমি হেসে ফেললাম।
‘এমনিই। তোমাকে দেখে আরও বেশি খুশি হয়ে গেলাম। ফুপা আসেনি? ‘

‘তোর ফুপা তো আজকে অফিসেই আছে, আজকে বাসায় ফিরতে দেরি হবে। ‘

‘ওহ আচ্ছা। ‘

আমি একটু চুপ হতেই ফুপি বললেন,
‘আমরা কালকে নারায়নগঞ্জ যাচ্ছি ফারিনকে বাসায় পৌছে দিতে। তুই যাবি? ‘

ফারিন আপুর নাম শুনতেই নারায়নগঞ্জ যাওয়ার মোহ মায়া ত্যাগ করলাম আমি। সরাসরি বললাম,
‘নাহ যাবো না।’

আমার না শুনতেই আম্মু কড়া স্বরে বলল,
‘কেন যাবি না কেন? ‘

আমি ফুপির গলা জড়িয়ে ফুপির কাধে মাথা রেখে বললাম,
‘আমার সামনে এক্সাম। পড়া বাকি। আর তোমার এই হিটলার বান্ধবী ওরফে তোমার ভাবীকে বলো আমার মতো মাসুম বাচ্চার ওপর এতো রেগে কথা না বলতে। ‘

ফুপি হাসলো।
‘আরে শুধু তো আমরা একা যাচ্ছি না। তোর আম্মু ও যাচ্ছে, সানা যাচ্ছে বিধায় তুই কেন বাদ যাবি? ‘

সানার মুখের দিকে তাকালাম আমি। নাহ তবুও যেতে ইচ্ছা করছে না একদম। আমি পুনরায় না করলাম।

ওই ফারিন কে আমার মিরজাফরের বউ বলে মনে হয়, কেন জানি না ওনাকে সহ্যই হয় না।

/

রাত বারোটা বাজে, সবাই নিশ্চয়ই এতখন ঘুমিয়ে পড়েছে। অতি সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে এলাম আমি, টর্চটা হাতে নিয়ে ক্যালেন্ডারের সামনে দিয়ে আঙুলের কড়ি গুনতেই একটা ঘর এসেই থেমে গেল আমার দিন গননা শুরু করলাম,আর একটা দিন পার হলেই আমার জন্মদিন? সত্যি? নিজের জন্মদিন নিয়ে কেও এতোটা নাচানাচি করে তা আমাকে না দেখলে কেও বুঝতেই পারবে না। ভীষনরকম খুশি লাগছে আমার তবে আগের বারের জন্মদিনের কথা মনে পড়ে গেল আমার। আরিশ ভাইয়া আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে আমাকে আমার প্রিয় লেখকের বই কিনে দিয়েছিলেন আর বাইকে করে ঘুরতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার উনি আর নেই।কথাটা ভেবে আনন্দ দুঃখ কোনটাই আর কাজ করছে না। বিছানায় গিয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম।

#চলবে,,,
#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here