ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব ৪

#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন

পর্ব— ৪

পাশের রুমে আম্মু, আন্টি আর মামিরা কথার ঝুড়ি নিয়ে বসেছে.. আমরা জানালা দিয়ে সবাই কান পাতলাম.. জানা কথা এখন সবার নামে শুধু বদনামী ই হবে কিন্তু তাও আমাদের জানার ইচ্ছা কার বাশটা সবচেয়ে বেশি মজাদার হয়।
ভাইদের মধ্যে তো ওভার কন্ফিডেন্ট বিরাজ করছে… তাদের এই ধারনা আজ তাদের নামে সুনাম হবে.. কারন তারা এই কয়েকদিন অনেক লক্ষি হয়ে ছিল..
তবে আমার মনে হচ্ছে না আমাকে কোন ছাড় দেওয়া হবে.. মনে হয় আমাকে আজকে বার্বিকিউ করবে আমার আম্মা.. আমি তাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললাম— বড়দের কথা শোনা বেড ম্যানারস. চল ঘুৃমিয়ে পড়ি..
সুনান ভাই দাত কেলানো হাসি দিয়ে বলল– কেন চলে যেতে চাও খুব জানি.. সবচেয়ে বেশি বাশ তো আন্টি তোর নামে দিবে.. তাই আরকি!!!
আমি তারদিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে বললাম— তোমার দাতগুলো মুলোর মতো সেগুলো দেখিয়ে আমাদের অধন্য করিও না.. সে তাড়াতাড়ি নিজের মুখ বন্ধ করে আবার জানালায় কান পাতলো.. আমিও কৌতুহল দমন করতে পারলাম না.. সবাই এখন জানালার পাশে বসে আছি আমরা.. দুঃখজনক ভাবে আমি হাসনাত ভাইয়ের পাশে বসে আছি.. তার পারফির্উমের মিষ্টি স্মেলটা নাকে আসছে আমার… এ যেন অন্যরকম লোমহর্ষ অনুভূতি..এভাবে আর কিছুখন থাকলে নির্ঘাত দম আটকে মরে যাব আমি!!! তাই ভাবলাম অন্যপাশে বসি.. আমি যেই ওঠে অন্যদিকে যেতে চাইলাম হঠাৎ হাতে কারো জোরে টান অনুভব করলাম.. আমি হুমড়িখেয়ে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম।।
আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে হালকা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বসে পড়লাম..
সবার মন জানালার বাইরে!! ভালোই হলো আমাকে কেউ দেখে নাই.. না হয় হাজারটা কোয়েশ্শন এর জবাব দিতে হতো আজকে.. তারপর হাসনাত ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ভাবলাম — এই ছেলের মাঝে এতো রহস্য কেন….কি চায় সে বোঝা ও যায় না…
এইসব ভাবতে ভাবতে কানে কারো গরম নিশ্বাস অনুভব হল হঠাৎ !! আমি চমকে সেদিক তাকানোর আগেই কেউ ফিসফিসিয়ে বলল– চুপ করে বসে থাক.. আমার পাশে বসলে কি গায়ে চুলকায় তোমার? কেন দূরে দূরে থাকতে চাও.. এইবলে সে আচমকা আমাকে নিজের দিকে এরএকটু চাপিয়ে বলল– চুপচাপ বসে থাক.. একদম নড়বে না.. শোন ওরা কি বলে।।।
আমি এখন আপাতত অন্যগ্রহে আছি.. হাসনাতের তুমি বলাটা যেন হৃদয়ে ভালোবাসার অন্য এক হাওয়া দিচ্ছে.. আমি চুপটি করে তার হার্ডবিটের শব্দ শুনতে লাগলাম.. এ যেন শুধু আমার নাম ই বলছে.. আমি নিজের অদ্ভূত কল্পনার কথা ভেবে নিজেই হেসে দিলাম..

সুনান ভাই হঠাৎ গলার কলার উচিয়ে বলল– দেখবি সবাই এখন আমার নামে কতো সুনাম করবে..
তখন ই মেজ আন্টির কথা শুনা গেল.. তিনি হতাশ হয়ে বলল– কি বলতাম বোন দুঃখের কথা,, আমার সুনানটা এতো মেয়েবাজ কেমনে হতে পারে.. যেখানে যাই সেইখানে একটা না একটা মেয়ের ওপর কি বলে ক্রশ না ম্রশ খাই.. আচ্ছা এইটা আবার কেমন খানা.. আমরা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠলাম.. আমি চোখ টিপ দিয়ে বললাম— গেলরে গেল.. একটা উইকেট পড়লো…
সুনান ভাই মুখ কালো করে অন্যদিকে তাকালো তারপর বলল– হাসিও না.. সবার পালা আসবে.. শুধু আমাকে দিয়ে সুচনা হলো এই যা…
আলভী সান্তনা দেওয়ার জন্য যেই সুনান ভাইয়ের কাধে হাত দিবে সেজ আন্টি বলে ওঠলো— আরে আপা সেইটা ক্রাশ বলে.. আমার দুই নবাবজাদা তো রোজই খাই। তোমার টা তো বড় হয়েছে ভার্সিটিতে পড়ে.. আমারটা ভাবো.. সামনে এইচ এস সি..আর সাহেবের চুলের বাহার দেখলে মন চায় গুলি করে দি তারে.. তারপর পরম আক্ষেপের সাথে বলল– বড়টা দেখে দেখে ছোটটাও খারাপ হচ্ছে.. নিজের গায়ের কাপর গুলা ও আমার জন্য রেখে দেয়.. আমি কি কাজের মেয়ে ওদের.. সেইটা বোঝা তোরা আমারে.. এই বলে আন্টির সেই কি কান্না…
আলভী ঠাস করে আরাফে গালে একটা থাপড় লাগিয়ে দিল আর মুখ ফোলিয়ে বলল– সব তোর দোষ.. তুই করবি আর শাস্তি আমি পাব…
আদি আলভিকে সান্তনা দিয়ে বলল– থাক বাদ দে.. রোজের ঘটনা..তখন মেঝ আন্টি বোনকে সান্তনা দিয়ে বলল– আরে বোন খারাপ তো আমার গুলা.. তুই চুলের কথা বলতেছিস.. আমার আদির চুলগুলা দেখিস তো মনে হয় যেন কাকের বাসা.. আমি তো ভয় পাই না জানি কোন কাক আসি ওর মাথায় নিজের বাসা বানায় রাখে… আর সাদাত টা দেখগা.. ভালো পেন্টগুলা না পড়ি টাকা দিয়ে ছেড়া পেন্ট নিয়ে আসে.. আরে বাপ তোরে কি আমরা টাকা দি না.. ফকিরের ড্রেস কেন পড়স..
আমি এই কথা শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না.. খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে ইফ্ফাতের গায়ের ওপর.. ইফ্ফাত আমাকে তুলতে তুলতে বলল– চুপ হাসিও না.. তোমার নামের সময় ওরা পার্টি দিবে.. এখনো সেজ ফুফি চুপ তারমানে দেখগা তোমার জন্য কি রেডি রাখছেন তিনি.
তখনইবড় মামি আফসুস করে বলে ওঠলো— আমার টা তো অতিরিক্ত পরিস্কার.. বাতরুমে ডুকাই দে.. এক ঘন্টা সেইখানে.. কি করে আল্লাহ ই জানে.. তারপর কোন কাজে সে নাই.. আর রান্না করতে বললে একশ হাত দূরে..
আমি আড়চোখে ইফ্ফাতের দিকে তাকালাম। বেচারী ফাটা বেলুনের মতো চুপশে গেছে।।

ইফতী ভাই নিচু স্বরে বলল– সব কাজ যদি বৌ ই করে বর কি করবে.. আর রান্নাটা বিয়ের পরেও বর থেকে শিখতে পারে.. আর অনেক ছেলেরা তাদের ভবিষ্যৎ রাগী বৌএর মান ভাঙ্গাতে রান্না ও শিখে রাখে…
ইফ্ফাত পুলকিত হয়ে এক নজরে কিছুখন ইফতী ভাইয়ার দিকে তাকালো তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিল.. ভাইয়াও আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিল…

এরা এতোটা কিউট কেন.. হাই.. আমার ইচ্ছে হচ্ছে এখনই এদেরকে বিয়ে করিয়ে দি..
হঠাৎ আমার আম্মা তার ভাষণ শুরু করলো.. আমি ঢুক গিলে জানালায় কান পাতলাম.. আর দোয়া করলাম— যাতে আমার আম্মা আমার ইজ্জতটা রাখেন.. কিন্তু সবসময়ের মতো আম্মা আমার সব আশায় বালি চাপা দিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল– তোদের গুলো অনেক ভাল.. আমার রোদেলা কোন কাজের না..সব কিছু এদিক ওদিকে. তিনি তার টেপ যে অন বাটনে ক্লিক করেছেন..অফ বাটনে টিপ দিতে ভোলেই গেলেন..
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম..হাসনাত ভাইয়ের সামনে আমার ইজ্জতের ফালুদা বানানোর কি খুব দরকার ছিল.. ইচ্ছে করছে ডরিমনের গ্যাজেট নিয়ে সব মুছে দি সবার মেমোরি থেকে যা যা শুনছে…
হঠাৎ ইষা আপু মুখে আফসোস ভরা শব্দ করে বলল— আহহারে.. তুই কি কোনদিন মানুষ হবি না.. তোকে বিয়ে দিয়ে কি হবে.. এই দরজা দিয়ে ডুকিয়ে অন্যদরজা দিয়ে বের করে দিবে..
আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে..একে তো আম্মু খুঁচিয়ে গর্ত করলো আর এই ফাজিল মেয়ে সেইখানে লবন মরিচ দিয়ে ঘুটছে.
হঠাৎ হাসনাত ভাই গম্ভির হয়ে বলল– ওর না তোর চিন্তা কর.. তোর সামনে বিয়ে.. ওর চিন্তা করার আরো অনেক মানুষ আছে..
তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল– তোরা কি এখন এইখানে বসে থাকবি নাকি ঘোমাবি??
সবাই নিশব্দে ওঠে যারযার জায়গায় গিয়ে শোয়ে পড়লো..

ভাইগুলো একটা,আরএকটা কে খুঁচিয়ে রাগারাগি করতে লাগলো তখন হাসনাত ভাইয়ের রাগী লুকে সবগুলো চুপ.. এই পোলার চোখে নির্ঘাত পাওয়ার আছে নয়তো সে কিভাবে সবকটাকে একসাথে চুপ করাই.. এইসব পাওয়ার এই নবিতাকে কেন দিতে গেল.. আমার মতো কিউট সেজুকাকে দিলে কি এমন ক্ষতি হতো.. এই গাধা দুইটাকে একসাথে চুপ করাতাম তখন আমি…
গাধা দুইটা হলো আমার দুই বদবোন.. নিজেদের কে কিছু বলেনাই দেখে খুশিতে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মুনিরা..আর সোনিয়া ইষা আপুর থেকে বিউটি টিপস নিচ্ছে.. যাতে সে আরো সুন্দরী হতে পারে.. বিশেষ করে মেকাপ নিয়ে ডিস্কাশন.. হঠাৎ আম্মু জানালার পাশে গলিতে দাড়িয়ে বলল– সানিয়া,, তোরে মেকাপের মধ্যে চুবিয়ে রাখবো আমি ফাজিল মেয়ে.. আর মুনিরা,, আর একবার তোর হাসির শব্দ শুনলে দাত খুলে নিয়ে আসবো..
সাথে সাথে দুইজন চুপ… আমার ইচ্ছে হচ্ছে গড়াগড়ি দিয়ে হাসি মুনিরার মতো.. কিন্তু নিজের ইচ্ছেকে ধামাচাপা দিয়ে আমি ঘুৃমিয়ে পড়লাম..

সকালের স্নিগ্ধ আলো আর পাখির কিচিমিচি আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো আমার.. আসলেই গ্রামের প্রকৃতিটা অনেকটা সুন্দর..
হঠাৎ নিজের পাশে জানালার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে রইলাম আমি.. এই বান্ধা এমন করে ঘুমিয়েছে কেন??
আর জানালার চোখাটের ওপর কে ঘুৃমায়.. হাতটাকে মুড়ি দিয়ে অনেক কষ্ট করে জানালার চোখাটেরর ওপর সুয়ে এদিকে তাকিয়ে ছিল সে..
আসলেইকি সে আমাকেই দেখছিল?? এইসব ভাবতেই যেন মনে বসন্তের হাওয়া ধোলা দিল.. হটাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠলো.. ইয়া আল্লাহ ৯.৩০ টা। এতো লেইট. পুরো রুম দেখে আমার ইচ্ছে হলো টাইম মেশিনে টাইম সেট দিয়ে সব কয়টাকে ঘুম পাড়িয়ে সবার আগে আমি যায় খাবার খেতে..
এইসব অসম্ভব ভাবতে ভাবতে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম আমি.. এখানে আমার হিটলার মামি.. আই মিন মেঝ মামি নতুন এক নিয়ম করে রেখছেন.. আর নিয়ম হলো যে দেরিতে আসবে সে পান্তাভাত খাবে.. আর বাকিরা রুটি… লাস্ট ৩ জন ভাত খাবে…তাও আবার পান্তা ভাত..

নিচে গিয়ে গরুর মাংসের ঝোল দেখে আমার মনের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠলো.. আমি রুটি দিয়ে খেতে পরছিনা ভেবে নিজেকে দফায় দফায় সান্তনা দিতে লাগলো..
মেঝ মামি আমাকে দেখে হেসে বলল– শেষ পর্যন্ত ওঠলা.. আমিতো ভাবলাম একেবারে দুপুরে…
আমি কিছু না বলে ভাত খেতে মন দিলাম.. কিন্তু যখন ই নিজের দোষের কথা মনে পড়ে নিজেকে কয়েকটা বকা দিয়ে নিলাম.. আসলে সব দোষ হাসনাত ভাইয়ের!! না সে এতো সুন্দর হতো… না আমি তাকে দেখে ক্রাসিত হতে হতে লেইট করতাম. এইসব ভাবতে ভাবতে খাওয়া শেষ করে ছাদে ওঠতে শুরু করলাম।। হঠাৎ হসনাত ভাই আমার সামনে নাস্তা দিয়ে বলল– চল একসাথে খাই..
আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকালাম.. সে হালকা গলা ঝেড়ে বলল– আরে আমাকে খাওয়ায় দিতে বললাম..
আমি মুখ ভেঙ্গিয়ে বললাম— পারবো না…
তখনই সে ফুফি ফুফি করে চিৎকার করতে লাগলো..আমি মুখটা পেচার মতো করে তাকে খাওয়ায় দিতে লাগলাম..সে যেন পরম তৃপ্তিতে খাচ্ছে.. সাথে আমাকে খাওয়ে দিল..
হয়তো তার হাতে জাদু ছিল না হয় এতো তাড়াতাড়ি কেন আমার মন ভাল হয়ে গেল..!!!

হঠাৎ দেখলাম সবাই চলে এসেছে.. হাসনাত মুখ বাকিয়ে বলল– তোকে কেন খাওয়ালাম জানস,, যাতে তুই খাসনি বলে কাজে চোরামী করতে না পারিস..

মনে হলো কেউ আমাকে শীতকালে পানিতে ছোড়ে মেরেছে.. আমি রাগে দুঃখে অপমানিত হয়ে ওখানে তাকে মনে মনে বকতে বকতে বেরিয়ে এলাম।।

চয়ুইভাতির আয়োজন জোরে শোরে চলছে.. আমি ঝাড়ু দিতে দিতে হাপিয়ে ওঠেছি.. এতো বড় ছাদ কেন.. আমার এখন নানার ওপর ই রাগ লাগছে.. এতোবড় বাড়ি বানানোর কি দরকার ছিল তার.. আর সাথে এতো বাচ্চাকাচ্চার এইসব ভাবতে ভাবতে নানাকে বকতে বকতে যেই সামনে তাকালাম.. ইস্পা পিংক গাউন পড়ে সিড়ি বেয়ে ওঠে এলো.. আর সামনে এসে বলল– শেষ পর্যন্ত তোমাকে ঝাড়ুদার বানিয়ে দিল..
আমি রাগী চোখে তার দিকে তাকালাম..
ইচ্ছা করছে সব ধুলোগুলো বেলচা দিয়ে এর মুখে পুরে দি..তারপর যখন মুখের ভিতর বালি কিচমিচ করবে তারপর বোঝবে..
এইসব ভাবতে ভাবতো যেই ঝাড়ু তুললাম হঠাৎ হাসনাত ভাইয়ের আহ শুনতে পেলাম… আমি পিছনে তাকিয়ে বরফ হয়ে গেলাম.. যেকানে বাঘের ভয় সেইখানে সন্ধ্যা হয়ে কেন।।এখন এই কচি মেয়ে যদি ধুৃম করে মরে যায় তাহলে হলুদের এতো সুন্দর লিপিস্টিকটা কে দিবে…

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here